নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ
জেনারেল নিয়াযি তার সৈন্যদের নিঃশর্ত আত্মসমর্পণে সম্মত হওয়ার পর ভারতের দিকে লেফটেন্যান্ট-জেনারেল জেএস অরােরা এবং পাকিস্তানের দিকে লেফটেন্যান্টজেনারেল নিয়াযি ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ তারিখে ১৬.৩১ ঘটিকায় যুদ্ধ বিরতি চুক্তিতে স্বাক্ষর করলেন। পাক সৈন্যরা যেখানেই লড়াই করতে মনস্থ করেছে সেখানে ভালই লড়েছে এবং চরম প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেই এমন প্রকৃতির একটা যুদ্ধে জয়লাভ খুব কমই সম্ভব- একটা চরম প্রতিকূল ভূমিতে, যেখানে জনগণ পুরাপুরি শত্রুভাবাপন্ন এবং মূল ঘাঁটি থেকে অপারেশনের ভূমি সহস্রাধিক মাইল বিস্তৃত একটি শক্ত রাষ্ট্র দ্বারা বিচ্ছিন্ন। সমরে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব জাহিরের ধর্মান্ধ জোশে তাদের দৃষ্টি ঘােলাটে হয়েছিল, তারা দেখতে পায়নি তাদের আশাহীন অবস্থা এমন একটা দেশের বিপরীতে যা তাদের। তুলনায় আয়তনে পাঁচগুণ বড়, জনশক্তিতে নয় গুণ শক্তিশালী এবং সম্পদে বহুকুড়িগুণ ধনী। ভারত অত্যন্ত উৎফুল- হয়েছিল, কিন্তু ইচ্ছা করেই তা দেখিয়েছে খুব কম করে। ভারতের অন্তর্নিহিত শক্তি প্রকাশ পেতে শুরু করেছিল। সমগ্র এশিয়া এবার ভীতিমিশ্রিত বিস্ময়ে তার দিকে তাকাল। পাকিস্তানের তথাকথিত বন্ধুরা তাদের পলিসি নিয়ে দ্বিতীয়বার ভাবতে বসল। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী যিনি এমন রাষ্ট্রনায়কতা ও সাহস দেখালেন তাকে প্রেসিডেন্ট ভারতরত্ন উপাধি দিলেন কৃতজ্ঞ ও হর্ষধ্বনিতে মুখর জাতীয় সংসদের সর্বসম্মত সুপারিশে জেনারেল স্যাম মানেকশ’ যিনি ছিলেন এই সমগ্র অপারেশনের পিছনে বুদ্ধি ও অনুপ্রাণনা, তিনি ভারতের প্রথম ফীল্ড মার্শাল হলেন। সিমলা চুক্তি হল এই যুদ্ধের ফলশ্রুতি হিশাবে, যাতে সৃষ্টি হল এক নতুন জাতি-রাষ্ট্র বাংলাদেশ এবং চিরতরে ধ্বংস হল ধর্মভিত্তিক দ্বিজাতি তত্ত্ব (যা ভারতীয় উপমহাদেশের বিভক্তির ভিত্তি হয়েছিল)। ভারত ৯৩ হাজার যুদ্ধবন্দির সঙ্গে দখলকৃত পাকিস্তানি ভূমি ছেড়ে দিল, যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ দাবি করল না এবং পশ্চিম রণাঙ্গনে একতরফা যুদ্ধ বিরতি ঘঘাষণা করল । এই যুদ্ধের ফলে ভারত লাভ করল আর কিছু নয় শুধু ভুট্টোর শুভেচ্ছা; যিনি ভারতের বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত চিৎকার করতে থাকতেন কাশ্মিরের অধিকার সংক্রান্ত অনেক আগেই নিস্পত্তি হওয়া কলহের নিস্পত্তির দাবি তুলে এবং আর লাভ করল একটু আশা যে হিন্দু ভারত জয় করে অতীতের মুসলমান আক্রমণকারীদের ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি করার বাতিক থেকে পাকিস্তান বেরিয়ে আসবে।
বাংলাদেশের নতুন শাসক শেখ মুজিবুর রহমান তার স্বধর্মাবলম্বীদের মধ্যে নিজের ভাবমূর্তি ঘষে মেজে ঠিক করে নিতে এবং বিভিন্ন বিশ্ব ফোরামে তার নতুন জাতির পরিচিতি প্রতিষ্ঠিত করতে ব্যস্ত হলেন। তাঁর দেশ ধ্বংসযজ্ঞের নিচে চাপা পড়ে ছিল, কোষাগার ছিল শূন্য এবং মানবিক দুর্দশার সমস্যা ছিল অনতিক্রম্য। বেসামরিক প্রশাসন ও পুলিশের অবকাঠামাের সাংগঠনিক অবস্থা অতীব দুর্দশাগ্রস্ত, কিছু ক্ষেত্রে অনির্ভরযােগ্য, ফলে তার অর্থনীতির পুনর্গঠন এবং আইন-শৃঙ্খলা স্থাপনের কাজে তার খুব একটা সাহায্যে আসার মতাে ছিল না। আর্মি। তখনও নিজ পায়ে দাঁড়ানাের চেষ্টায় ছিল এবং পাকিস্তান আর্মি থেকে দেশান্তরিত হয়ে। আসা সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ বাঙালি অফিসারদের আত্মীকরণের সম্ভাবনায় ভীত ছিল। সর্বপ্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ তখনও একটা নতুন স্বাধীনতা পাওয়া দেশের দায়িত্বশীল শাসক দলের ভূমিকায় নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়নি, যে স্বাধীনতা অর্জিত হল প্রধানত সব রকম মত ও পথের মুক্তিযােদ্ধাদের দ্বারা। মওলানা ভাসানী তার ভাগ। দাবি করার সেই পুরনাে খেলা খেলতে শুরু করলেন। বামপন্থী ও মার্কসবাদীরা তাদের সংখ্যার অনুপাতের চেয়ে বেশ কিছু বেশি মাত্রায়ই তাদের নিজেদের চাপ প্রয়ােগ করতে লাগল। যুবকরা অভ্যন্তরীণ গােলযােগের আশঙ্কায় তাদের অস্ত্রশস্ত্র ধরে রাখল। জীবনের অবশ্য-প্রয়ােজনীয় দ্রব্যাদির অভাব বাড়তে লাগল । জনগণের চাওয়াও বাড়তে লাগল। তারা যে কোনও মূল্যে এই বিভীষিকাময় অবস্থার অবসান কামনা করল। স্থিতিশীলতা ও গােলযােগ এই দুই -এর মাঝখানে দাঁড়ানাের মতাে কারিশমা একমাত্র শেখ মুজিবের ছিল। মুজিব শৃঙ্খলা এবং সমগ্র জাতির কঠিন পরিশ্রম দাবি করলেন এবং সর্বোপরি সময় চাইলেন। কিন্তু সেই অতীব আবেগপ্রবণ ও সহজে উত্তেজিত জাতি কি তাকে সেই সময় দেবে? এই ছিল এক প্রশ্ন। নতুন জাতিকে ঠিকভাবে চলতে শুরু করানাের জন্য ভারত সর্বাত্মক চেষ্টা করছিল কিন্তু তাকে সংহতিনাশক বিরাট শক্তিসমূহের মােকাবিলা করতে হল। সে সব শক্তি ভারতের ক্ষমতার সর্বশেষ অবস্থাকে দেখল কিছুটা ভীতির সঙ্গে, ভারতের সঙ্গে মুজিবের বন্ধুত্বকে তারা ঘৃণা করল।
স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্স -এর নতুন ভূমিকা আমার সৈন্যরা তখনও গােলাগুলির সম্মুখীন হচ্ছিল । মিযাে, রাযাকার এবং চাকমাসহ অনেক প্যারা মিলিটারি বাহিনীর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া কিন্তু সশস্ত্র লােক পার্বত্য চট্টগ্রামের মতাে গেরিলা যুদ্ধের আদর্শ ভূমিতে বিচরণ করছিল- আর্মি চীফ -এর আদেশে আমি যুদ্ধ-বিরতির আদেশ দিয়েছিলাম। আমি চাইলাম তার কাছে আমার অবস্থা পরিষ্কার করতে । আর্মি চীফকে আমার উভয়-সংকটের কথা বললাম এবং পরিষ্কার করে বলতে বললাম আমাদেরকে গুলি করা হলে এবং পাক কমান্ড না মানা বিচরণশীল মিযাে দুবৃত্ত দলবলের ব্যাপারে আমাদের কী করতে হবে। তিনি বললেন আমাদের শুধু আত্মরক্ষার্থে। গুলি করতে হবে কিন্তু আমাকে আদেশ দিলেন যদি মিযােরা তাদের পাক হাই কমান্ডকে মান্য করে আত্মসমর্পণ করতে রাজি না থাকে তাহলে তাদেরকে ধাওয়া করে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে বের করে দেওয়ার জন্য। চীফ আরও বললেন: তুমি প্রতিদিন নতুন ও কৌতূহলােদ্দীপক দুঃসাহসিক কাজের সম্মুখীন হচ্ছ। বেস্ট অব লাক। আমরা যখন এলাকাটা পরিষ্কার করে মিযােদেরকে মিযােরাম সীমান্ত বরাবর আমাদের পােস্টগুলিতে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করলাম, আর্মি চীফ আমাকে নিচের সংকেত বার্তাটি পাঠালেন: তােমার পাঠানাে প্রতিটি বার্তার পাঠ অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক হচ্ছে। মিযােদের বিরুদ্ধে তােমার সাফল্যে পরমানন্দিত। বিবেচনা করাে তুমি এখন তােমার অর্জিত জয়ের সম্মান নিয়ে বিশ্রাম করতে পার । তােমার ভারতে ফেরত আসার ব্যাপারে নির্দেশসমূহের জন্য অপেক্ষা করাে। লড়াই থামল না। মিযােদের বিরুদ্ধে আমাদের আরও কিছু কাজ করতে হল । চীফ আমাদের উৎসাহিত করলেন আরেকটি মর্মস্পর্শী বার্তার দ্বারা যা সর্বস্তরের সবাইকে অভিভূত করল: সিওএএস তােমাকে জোর অনুমােদন জানাচ্ছেন এবং তােমার ফোর্স যে অসাধারণ কাজ করেছে তার জন্য অভিনন্দন। রাঙামাটি, কাপ্তাই এবং অন্যান্য শহরে নাগরিক সংবর্ধনা লাভ করে আমরা অনুভব করলাম যে বাংলাদেশের জনগণ তাদের মুক্তির জন্য আমাদের যে স্বার্থ ত্যাগ, সে ব্যাপারে অত্যন্ত কৃতজ্ঞ। একটা প্রতিনিধি দল শেখ মনির কাছে প্রস্তাব করল আমরা এমন সাংঘাতিক প্রতিকূলতার মধ্যে যা করেছি তার জন্য তারা আমাকে ও আমার ফোর্সকে সম্মানিত করতে চায়।
আমি ভাবলাম আমার যে সব স্টাফ নয়া দিলি-তে বসে এই কষ্টসাধ্য অভিযানের সময়টায় প্রচার ও প্রশংসা ছাড়া শুধু কষ্ট করে গিয়েছেন তাদেরকে যদি চট্টগ্রামে এই নাগরিক সংবর্ধনায় উপস্থিত হওয়ার সুযােগ দেয়া যায় তাহলে একটা সঠিক কাজ করা হয়। আমাদের কর্মকাণ্ডের এলাকাটা পরিদর্শন করাও তাদের উচিত অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য, যা তাদের পেশাগত জীবনের পথে সহায়ক হতে পারে। আমি চেয়েছিলাম শ্রী আরএন কাও আসুন। কিন্তু সব সময় আলােকসম্পাতের। থেকে দূরে থাকা তার স্বভাবগত, সুতরাং তিনি এর থেকে অব্যহতি চাইলেন। তবে তিনি অত্যন্ত সদয় হয়ে আমার প্রস্তাবে সম্মত হয়ে ব্রিগেডিয়ার বিবি ভাটনাগরকে, যিনি। এসএফএফ সদর দফতরে তাঁর বিশিষ্ট কাজের জন্য অতি বিশিষ্ট সেবা মেডেলে ভূষিত হয়েছিলেন, ব্রিগেডিয়ার (পেরে লেফটেন্যান্ট-জেনারেল) টিএস ওবেরয়কে, যিনি আমাদের মুজিববাহিনীর ছেলেদের প্রশিক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন, এবং ফোর্সের প্রশাসনের দায়িত্ব প্রাপ্ত কর্নেল বিডি কৌশলকে পাঠালেন। আমি আমার চীফ অব স্টাফ কর্নেল ইকবাল সিং যিনি মেনশন ইন ডেসপ্যাচেস লাভ করেছিলেন, কর্নেল পুরকায়স্থ বীর চক্র এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল খান্নার নাম উলে-খ করেছিলাম সংবর্ধনার সময় আমার সঙ্গদাতা হিশাবে। এমনকি এখানেও কোর সদর দফতর শুরুতে আমাকে ও আমার ফোর্সকে সংবর্ধনা দেওয়ার অনুমতি দিতে অস্বীকার করল। আমাকে বলা হল যে তারা এটা করেছে বিদ্বেষের বশে কারণ তারা চায় তাদের কোর কমান্ডারের সম্মানে সংবর্ধনা দেওয়া হােক। তাদের সৈন্যরা সেখানে পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণ গ্রহণ করেছে, আর বেসামরিক নেতারা, যারা আওয়ামী লীগের লােক, চায় আমাকে ও আমার ফোর্সকে আগে সংবর্ধনা দিতে কারণ তারা জানে ঐ এলাকায় কে সবচেয়ে বেশি কাজ করেছে। সত্যি বলতে কী শেখ মনি আমাদের আর্মির এই আচরণে প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন“চট্টগ্রামে কোনও সামরিক নেতাকেই সংবর্ধনা দেওয়া না হয় তা আমি দেখব।”
যা হােক পরে কিছুটা বলা কওয়ায় আর্মি কর্তৃপক্ষ আমার প্রতি বিশেষ পক্ষপাতী এই সংবর্ধনা অনুষ্ঠিত হওয়ায় মত দিল। ব্রগেডিয়ার ওবেরয় ঐ সদর দফতরে তার এক জ্যেষ্ঠ বন্ধুকে যখন বললেন যে এই সংবর্ধনা হতে না দিলে তার গুরুতরাে রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া হবে, তারপর তারা রাজি হল। আমরা একটা ভাল রকম সাজানাে প-টিফর্মে শেখ ফজলুল হক মনি, ঐ এলাকার এমএনএ জনাব আবু সালেহ এবং অন্যান্য নেতাদের দ্বারা বৃত হলাম। তারা অত্যন্ত উচ্চ প্রশংসায় ভরা বক্তৃতা দিলেন। আমার দেশ ও আমাদের প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসা। করলেন। আমি আমার বক্তৃতা শুরু করলাম বাংলায়। আমার উদ্দেশে বিপুল উল-সি ধ্বনি উঠল। প্রথম কয়েকটা বাক্য আমি নির্ভুলভাবে উচ্চারণ করার পর আমার বাকি বক্তৃতাটা ইংরেজিতে চালিয়ে গেলাম, মনি সাহেব তা বাংলায় তর্জমা করে দিলেন। অশেষ জনতা এমন উদ্দীপনা প্রকাশ করছিল, কেউ মুক্তি অর্জন করলেই যা করতে। পারে। শত শত ট্রাক ও কার বহু মাইল দীর্ঘ মিছিলের সৃষ্টি করেছিল। আমাকে আওয়ামী লীগের প্রতীক স্বরূপ একটা ইপিএনএস নৌকার সঙ্গে একটা সম্মাননা লিপি এবং শেখ মুজিবর রহমানের একটা ফটো উপহার দেওয়া হল। সম্মাননা লিপিটি বাংলা ভাষায় হাতে লেখা, তাতে অনেক সুন্দর সুন্দর কথা যা আমার উচ্চ প্রশংসায় ভরা ছিল। তারপর আমাদের বিনােদনের জন্য ঢাকার বেতার শিল্পীদের পরিবেশিত সংগীত। শােনানাে হল । আমাদের সকলের জন্য সে এক স্মরণীয় দিন ছিল ।
সূত্র : ফ্যান্টমস অব চিটাগং-দি ফিফথ আর্মি ইন বাংলাদেশ – মেজর জেনারেল (অব.) এস এস উবান