You dont have javascript enabled! Please enable it!

হাতুড়ির ঘা

উত্তর কলাম -এর বীরত্বপূর্ণ  কাজ কেন্দ্রীয় কলাম যখন বর্কল-সুভলং এলাকায় নিজেদেরকে সুবিন্যস্ত ও শক্তিশালী করে অ্যানভিল গঠনে ব্যস্ত ছিল, তখন উত্তর কলাম কর্নেল পিসি পুরকায়স্থের অধীনে মিযােরাম সীমান্তের মারপাড়ায় নিজেদেরকে কেন্দ্রীভূত করছিল এই কলামের হাতে ছিল সবচেয়ে শক্ত কাজ, কাসালং খাল বরাবর সকল শক্ত অবস্থানকে ধ্বংস করা  কাসালং খালটি সুভলং -এ কর্ণফুলি নদীর সঙ্গে মিলিত  এ সময়ে তা ফুলে ওঠে বিপুল বিস্তৃত জলাশয়ে পরিণত হয়েছিল। শত্রুর পােস্টগুলি ছিল মিযােদের দ্বারা গঠিত, পাঠান ও বেলুচিদের দ্বারা শক্তকৃত। এরা গােটা অঞ্চলটাকে জিম্মি করে রেখেছিল। কর্নেল পুরকায়স্থ ছিলেন লম্বা, সুগঠিত এবং দুঃসাহসী অফিসার মেজর আরকে মালহােত্রা এবং মেজর জিএস মান ছিলেন তার দুই সাব-কলামের কমান্ডার এই দুই মেজরের সক্ষম সহযােগিতায় তিনি তার দায়িত্ব বিশিষ্ট যােগ্যতার সাথে পালন করছিলেন। এই দুঃসাহসিক অভিযানে লীডার রাযু ছিলেন তাঁর জন্য এক শক্তির মিনার আকস্মিক ও হিংস্র এক আক্রমণে চমকে যাওয়ার পর শক্ত সারাক্ষণ ছুটাছুটির মধ্যে ছিল। মাহমুয়াম রুলুই, মাসালাং গঙ্গারাম ড়, টিনটিলা এবং মের্শিয়া -এর পােস্টগুলির পরপর খুব দ্রুত পতন ঘটল  দুটি সাব-কলাম দুসসুরি খাল মােহনায় মিলিত হল এবং মাহিলিয়া হয়ে মিয়ানিমুখ-খাল মােহনার দিকে অগ্রসর হল মিয়ানিমুখ -এর দিকে যেতে হত বিশাল বিস্তৃত জলাশয়ের মধ্য দিয়ে। কর্নেল পুরকায়স্থ ঊর্ধ্ব গতিতে অগ্রসর হওয়ার পর চাইলেন এ পর্যায়ে তার লােকেরা একটু বিশ্রাম নিক কিন্তু আমি বললাম বিশ্রাম ও পুনর্গঠন হবে কেবলমাত্র মিয়ানিমুখ দখলের পর  প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে আমি এমনকি অনুমতি দিলেও তিনি বিশ্রাম নিতে পারতেন না কারণ মের্শিয়াতে তার কোম্পানি শত্রুর ৮১ এমএম মর্টারের দ্বারা প্রতি-আক্রমণের সম্মুখীন হওয়ায় সেখানে কিছু হতাহত হয়েছিল শত্রু অবশ্য কঠিনভাবে নিষ্পিষ্ট হয়েছিল। তারা ৬ জন পাঠান ও ৪ জন মিযার মৃতদেহ ফেলে রেখে চারটি জীপে ভর্তি করে অন্যান্য হতাহতদেরকে বহন করে নিয়ে গিয়েছিল। আমি আমাদের নিজেদের ১০ জন আহত জওয়ানকে একটা হেলিকপ্টারে করে সরিয়ে নিতে ব্যত্র ছিলাম। এরকম ব্যবস্থা ঠিক হল যে নির্দিষ্ট সময়ে তাদের কাছে একটা হেলিকপ্টার পাঠানাে হবে, সেটাকে পথ দেখানাের জন্য এসএফএফ -এর ছেলেরা আগুন জ্বালিয়ে ধোঁয়ার সংকেত তৈরি করবে।

আমি ভাবলাম লড়াই চলাকালে শত্র এলাকায় পাইলট ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট পারভে জামাসজি -এর প্রথমে উড়ালে আমি সঙ্গে থাকি। ভাবলাম, যারা এমন শৌর্যপূর্ণ লড়াই করছে তাদের মধ্যে আমার উপস্থিতি দারুণভাবে মনােবল বৃদ্ধির কাজ করবে এবং হেলিকপ্টারে করে আহতদের দ্রুত সরিয়ে। নেওয়ার ব্যাপারটাকে প্রত্যেকে উচ্চ প্রশংসা করবে  আমার চীফ অব স্টাফ কর্নেল ইকবাল এই বিপজ্জনক অভিযান থেকে আমাকে নিরস্ত করতে চেষ্টা করলেন। তিনি যা বললেন তা এরকম: যুদ্ধে একটি হেলিকপ্টার হচ্ছে শত্রু যােদ্ধাদের জন্য বসে থাকা হাঁসের মতাে। আমাদের হেলিকপ্টারটা অনেক দিনের পুরনাে। শক্র এলাকায় এটা বিকল হয়েও পড়তে পারে, তাতে ব্যাপার আরও খারাপ হয়ে পড়বে যদি আমি মনে করি যে শত্রু এলাকার মধ্যে প্রথম উড়ালে একজন উচ্চপদস্থ অফিসারের সঙ্গে থাকা আবশ্যক তাহলে তিনি নিজেই যাবেন বলে প্রকৃতপক্ষেই তিনি প্রস্তাব করলেন আহতদের একটা হেলিকপ্টারে করে নিয়ে আসার জন্য আমি লড়াই -এর স্থানে যাচ্ছি শুনে সর্বজ্যেষ্ঠ এসএফএফ লীডার জেকে তার ব্যাংকার থেকে দৌড়াতে দৌড়াতে চলে এলেন তিনি আমার সিদ্ধান্তের বিচক্ষণতা নিয়ে আমার সঙ্গে যুক্তিতর্ক শুরু করলেন যদিও এটা মানলেন যে তাতে জওয়ানদের মনােবল সীমাহীনভাবে বেড়ে যাবে কিন্তু তিনি প্রশ্ন করলেন-“আপনার হেলিকপ্টারের সঙ্গে আপনি যদি গুলি খেয়ে পড়ে যান তাহলে গােটা অপারেশনটার কী হবে?” আমি আমার সদর দফতরের বাংকারে বসে বসে ক্লান্ত হয়ে পড়ছিলাম, আমার একটু তাজা বাতাসের দরকার ছিল এবং এটাই ছিল তার জন্য সবচেয়ে ভাল সুযােগ ।তাছাড়া আমি ভীষণভাবে চাচ্ছিলাম কর্নেল পুরকায়স্থ যে এলাকায় আরও অগ্রসর হবেন সে এলাকাটা পরিদর্শন করতে যদিও সেটা ছিল রীতিমতাে এক বিভীষিকা । তদুপরি আমি চাচ্ছিলম কলাম কমান্ডারের সঙ্গে ভবিষ্যৎ অপারেশন পরিকল্পনা নিয়ে আলােচনা করতে, যা সবচেয়ে ভাল করা যায় আক্রান্ত গ্রাউন্ডের উপরে একটা অনুকূল স্থান থেকে  যাই হােক, আমি হেলিকপ্টারে চড়লাম। ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট পারভে জামাসজি তাতে খুশি তিনি মেশিনে স্টার্ট দিলেন। আমরা যতখানি সম্ভব আমাদের নিজেদের এলাকার পাহাড়ি রেঞ্জ অনুসরণ করে চললাম কারণ আমরা শত্রুর অঞ্চলে আমাদের অবস্থানের সময়কাল যতদূর সম্ভব কমাতে চাচ্ছিলাম।

জামাসজি তার ম্যাপ লক্ষ্য করে যে পয়েন্টে শত্রুর অঞ্চলে ঢুকতে হবে সেই পয়েন্টে পৌছার পর আমাকে শুধু বললেন-“স্যার, আমরা এখন শত্রুর এলাকায় ঢুকলাম।” আমি ভূমিতে ধোঁয়ায় সংকেত দেখার জন্য দৃষ্টি মেলে দিলাম। আমার হৃৎপিণ্ডের গতি দ্রুততর হল। ধোয়ার সংকেত আমাদের।  নিজেদের লােকদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার পূর্ব নির্ধারিত স্থানের দিকে আমাদেরকে পথ। দেখাবে। ঘটনাক্রমে এ সময়টা ছিল সকালের খাবারের সময়। দূরে দেখা যাচ্ছিল ধোয়ার অনেকগুলি স্তম্ভ পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে উঠছে। আমাদের জানার উপায় ছিল না কোনটা আমাদের জন্য। খাবারের সময়ে ধোঁয়াকে আমাদের সংকেত হিশাবে বাছাই করে আমরা গাধার মতাে কাজ করেছি। আমরা জানতাম আমাদের লক্ষিত এলাকায় জনবসতি ছিল। এখন আর কিছু করার নেই। ঠিক তখন জামাসজি বললেন: “স্যার, আমি শুনতে পারছি শক্রর যুদ্ধ বিমানের পাইলট বলছে সে আমাদের হেলিকপ্টারটি শনাক্ত করতে পেরেছে। আমি বললাম: “ভয় পেয়াে না। সােজা ঐ দিকটার ধোয়াটার দিকে চলে যাও” (সাথে সাথে আমি লাঠি দিয়ে সবচে’ কাছের গাছের ঝাড়ের মধ্য থেকে ওঠে আসা ধোঁয়ার স্তম্ভটার দিকে নির্দেশ করলাম)। আমার নির্দেশিত ধোয়ার কাছে পৌছে আমরা দেখলাম আমাদের কিছু জওয়ান একটা কুঁড়েঘরের দিকে দৌড়াচ্ছে। আরেকটু নিচে নেমে এলে তাদের পােশাক চিনতে পারলাম। আমরা একটা বৃত্তাকার ভূমিখণ্ডে ল্যান্ড করতে চেষ্টা করলাম। ঐ ভূমিখণ্ডের একদিকে ছাড়া আর সব দিকে পানি। জামাসজি মেশিনটাকে মাটিতে স্পর্শ করালেন।

ইঞ্জিনটা চালু রইল। আমরা নেমে একটু দূরে গাছগাছালির দিকে ছুটলাম কোনও যুদ্ধবিমানের বা মর্টারের ফায়ার এড়ানাের জন্য। কর্নেল পুরকায়স্থ তাঁর অন্য গ্রুপ অফিসারদের নিয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। লীডার আমার খাওয়ার জন্য একটা পাকা আনারস নিয়ে এলেন। আমি লুব্ধ বােধ করলাম কারণ অনেকগুলি সপ্তাহের মধ্যে এই প্রথম আমি তাজা ফল দেখলাম, কিন্তু আমি ভাবলাম এটা আমার সদর দফতরে মেসে নিয়ে যাই যাতে আমার স্টাফ অফিসাররা আমার সাথে এই লােভনীয় খাবার ভাগ করতে পারেন। আহতদের যখন হেলিকপ্টারে ভােলা হচ্ছিল তখন আমি কর্নেল পুরকায়স্থের সঙ্গে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাসমূহ আলােচনা করছিলাম। সাথে চলছিল গরম এক কাপ চা, আমার সম্মানে তাড়াতাড়ি করে বানানাে। দূরের একটা কুঁড়েঘর থেকে আহতদের আনতে হচ্ছিল কাজেই তাতে বেশ কিছুটা সময় লেগে গেল। জামাসজি এই দেরির জন্য এবং শত্রুর যুদ্ধবিমানসমূহের ভয়ে উত্তেজিত হয়ে পড়ছিলেন। আমিও এ ব্যাপারে কম সচেতন ছিলাম না। শিগগিরই হেলিকপ্টার ওড়ার জন্য তৈরি হয়ে গেল। আমি যখন উত্তর কলামের অফিসার ও জওয়ানদের ছেড়ে আসলাম তখন তারা দারুণভাবে উদ্দীপিত। এখন তারা জানল যে আমরা হেলিকপ্টারে করে অল্প সময়ের মধ্যে খরচ হওয়া গােলাগুলির পুনর্ভরণ। তাে করতে পারি, হতাহতদেরও সরিয়ে নিয়ে যেতে পারি। এই পরিদর্শন আমার নিজেরসহ প্রত্যেকের জন্য দারুণভাবে মনােবলবর্ধক হয়েছিল। আমার নিজের সদর দফতরের অফিসার ও জওয়ানরা ঐ দিন থেকে আরও অনেক বেশি সম্মানের চোখে আমার দিকে তাকাত। আমরা ঐ দিন আহতদেরকে লাংলেহতে ফরওয়ার্ড হসপিটালে নামিয়ে দিয়ে শিগগিরই আমাদের সদর দফতরে ফিরে গিয়েছিলাম। শক্রর যুদ্ধ বিমানগুলি আমার হেলিকপ্টারটি শনাক্ত করার পরও কেন সেটা আক্রমণ করল না আমি তার কারণ আন্দাজ করতে পারি না। আমরা এই যুদ্ধে যে বহুসংখ্যক বিস্ময়কর ব্যাপারের অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলাম এ ছিল তার মধ্যে একটা।

ফীল্ড মার্শাল আমাদেরকে সম্মানিত করলেন

অবিরাম শত্রুর পশ্চাদ্ধাবনে আমাদের প্রতিদিনকার সাফল্যে খুশি হয়ে ফীল্ড মার্শাল মানেকশ আমার প্রতি নতুন একটা ‘ইন্সস্ট্রাকশন’ পাঠালেন। তাতে চট্টগ্রাম বন্দর এবং শহর দখল করা আমাদের লক্ষ্য হিশাবে নির্ধারণ করা হল। এই নতুন সম্মানে আমার সদর দফতরে দারুণ উচ্ছাসের সাড়া পড়ে গেল। আমাদের তেজের ভাল রকম পরীক্ষা নিয়ে আর্মি চীফ আমাদের মূল্যের স্বীকৃতি দিলেন। এ ছিল এক সর্বোচ্চ পর্যায়ের অসাধারণ স্বীকৃতি। শুধু গেরিলা যুদ্ধে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একটি ফোর্স যা যুদ্ধক্ষেত্রে একসঙ্গে হালকা-অস্ত্রধারী ৮শ’ -এর বেশি লোেক নামাতে পারে না, সেই ফোর্সকে চীনাদের দ্বারা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, ৩ হাজার মিযাের প্রতিরক্ষা ধ্বংস করে রাঙামাটি ও চট্টগ্রাম থেকে হটানাের এবং তারপর পাকিস্তান আর্মি ব্রিগেড গ্রুপকে ধাওয়া করে তাদেরকে তাদের অতীব গুরুত্বপূর্ণ ভূমি চট্টগ্রাম থেকে হটিয়ে তা দখল করার দায়িত্ব দেওয়া- এ যে কত বড় স্বীকৃতি তা সহজেই অনুমেয়। ঐ দিন আমি ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট জামাসজি-কে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আনা আনারসটা কেটে প্রথম টুকরাটা নিজে খেয়ে বাকিটা মেসের অন্য অফিসারদের মধ্যে বিতরণ করে দিতে বললাম । আমি চাইছিলাম হেলিকপ্টারে আহতদের সরিয়ে আনতে সাহায্য করে। জামাসজি যে সাহসের কাজটি করেছেন তা অন্যদের সামনে গুরুত্বের সাথে তুলে ধরতে যাতে তারাও তাদের জন্য অপেক্ষমান সর্বাধিক বিপজ্জনক কাজের জন্য উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠে। এটা করার জন্য একটা আনারসের চেয়ে ভাল কিছু আমার হাতে ছিল না । ঐ দিনই আমি এই সাহসী অফিসারকে অবিলম্বে বীর চক্র পদক প্রদানের সুপারিশ করে পাঠালাম এবং সাথে সাথেই একটা সংকেতের মাধ্যমে আর্মি চীফ পদক প্রদান নিশ্চিত করলেন-একটা চমৎকার আর্মি প্রােসিডিওর যা একটা ফোর্সের মধ্যে নতুন জীবনের সঞ্চার করতে পারে।

অনুষ্ঠানাদি শেষ, এবার আমি ভাবতে বসলাম কিভাবে রাঙামাটি দখল করা যায় । রাঙামাটি চট্টগ্রাম -এর উত্তরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যােগাযােগ কেন্দ্র, এর দখল বিখ্যাত কাপ্তাই বাঁধ দখলের ক্ষেত্রে যেমন, চট্টগ্রাম দখলের ক্ষেত্রে তেমন গুরুত্বপূর্ণ। এমনই ভাগ্য, ঠিক এই সময়েই রাঙামাটি, কাপ্তাই ও চট্টগ্রাম এই তিনটি লক্ষ্যস্থলকে ভারতীয় বিমানবাহিনীর দায়িত্ব থেকে বাদ দেওয়া হল। চট্টগ্রাম নৌবাহিনীর জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যস্থল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এটা ভারতীয় নৌবাহিনীর এয়ার উইং -এর প্রাধান্যের আওতায় চলে গেল। তাতে করে আমার যে কমান্ডােরা এই বন্দর দখল করবে তাদের সাথে সমন্বয়ের ক্ষেত্রে গুরুতরাে সমস্যা দেখা দিল। কিন্তু ঐ সময় রাঙামাটি ও কাপ্তাই নৌবাহিনীর আকাশযানের পালার বাইরে ছিল। সুতরাং আমি অনুরােধ জানালাম আমাদের অগ্রগমন সহজতর করার জন্য কুস্তিগ্রামস্থ আমাদের এয়ার স্ট্রাইক ফোর্স-কে যেন এই লক্ষ্যবস্তুগুলিতে হামলা করার জন্য আদেশ দেওয়া হয়। আমার অনেকগুলি সংকেত স্রেফ নথিভুক্ত করা হল। প্রত্যেকে বললেন- “তিনি তাে। বিমান সমর্থন ছাড়াও কাজ চালাতে পারেন; ঢাকার মধ্যে ও আশেপাশে বিমান হামলা আমাদের জন্য জরুরি প্রয়ােজন। সুতরাং যেমনটা আশা করেছিলাম তাই ঘটল। আর্মি চীফ নৌবাহিনীর সঙ্গে এমন ব্যবস্থা করেছিলেন যে তারা আমাদের বিমান সমর্থন দেবে, কিন্তু তা বাস্তবায়িত হল না। এই সময় আমাদের দ্বিতীয় হেলিকপ্টারটি কাজ করতে শুরু করল। সুভলং থেকে শত্রু রাঙামাটিতে হটে গিয়েছিল কিন্তু কাসালং খাল বরাবর অনেকগুলি পােস্ট তখনও তারা ধরে রেখেছিল। আমি অনুভব করলাম কিছু লােককে দ্রুত হেলিকপ্টারে করে রাঙামাটির কাছে তার উত্তর-পশ্চিম দিকটাতে নিয়ে গেলে শহরটাকে ঘিরে ফেলা হবে এবং ইতিমধ্যে শহরটিতে অনুপ্রবেশকারী মুজিববাহিনীর ছেলেদের সাথে তারা একযােগে অ্যাকশন চালালে শত্রু ভয় পেয়ে শহর ছেড়ে চট্টগ্রামের দিকে চলে যেতে পারে। সময় শেষ হয়ে যাচ্ছিল। সুতরাং ঐ দিনই আমি দুই হেলিকপ্টার ভর্তি লােক রাঙামাটির উত্তর-পশ্চিমের জঙ্গলে পাঠিয়ে দিলাম। হেলিকপ্টার লক্ষ্য করে মর্টার নিক্ষেপ করা হয়েছিল কিন্তু কেউ আঘাত পায়নি। বােমার কিছু ধাতব টুকরা বহন করে হেলিকপ্টার ফিরে এল । হেলিকপ্টারের গা তেমন পুরু না হওয়ায় সেগুলি তাকে ভেদ করেছিল। আমার গেরিলারা ভাল রকম মহড়া করা পরিকল্পনা অনুযায়ী ছড়িয়ে পড়ে রাঙামাটি ঘিরে ফেলল, যার অভ্যন্তরে আমাদের মুজিববাহিনীর ছেলেরা ইতিমধ্যে অনুপ্রবেশ করেছিল।

কোর সদর দপ্তর কর্তৃক বিশ্বসভঙ্গ

যখন আমরা রাঙামাটির দখল নিতে যাব ঠিক এই পর্যায়ে কোর সদর দফতর থেকে এই মর্মে সংকেত বার্তা এল যে আমাদের রাঙামাটি দখল করার দরকার নেই, সে কাজটা করতে যাচ্ছে মুক্তিবাহিনী কমান্ড (এই কোর -এর অধীনে কর্মরত)। আমাকে বলা হল যে সাময়িক সরকার চায় মুক্তিবাহিনী এই গুরুত্বপূর্ণ শহরটা দখল করুক, বাহ্যিকভাবে কিছু রাজনৈতিক কারণে। আমি জানতাম যে ঐ এলাকায় মুক্তিবাহিনী ফোর্সের কেউ ছিল না, তারা আমাদের প্রচেষ্টার সুফল নিজেরা ভােগ করতে চায়। সুতরাং আমি পাল্টা এই বলে সংকেত বার্তা পাঠালাম-“এসএফএফ জওয়ানরা এলাকাটা ঘিরে আছে, তাদেরকে আদেশ দেওয়া হয়েছে তাদের সঙ্গে সহযােগিতা করবে না এমন যে কাউকে দেখা মাত্র গুলি করতে। মুক্তিবাহিনীর লােকেরা যদি শক্রর দালাল বলে সন্দেহভাজন হয়ে হতাহত হয় তাহলে তার জন্য আমি দায়ী থাকব না।” ঐ শেষ আমরা ঐ এলাকায় মুক্তিবাহিনীর কথা শুনেছিলাম। এসএফএফ -এর স্থানীয় নৌকার বহর লেফটেন্যান্ট-কর্নেল বিকে নারায়ণের যােগ্য নেতৃত্বে রাঙামাটি শহরে প্রবেশ করল কিছুটা বাধার সম্মুখীন হয়ে। পরে আমরা জানলাম মিযাে কমান্ডার শ্রী লালডেংগা সপরিবারে রাঙামাটিতে বসবাসরত ছিলেন এবং শত্রুপক্ষ রাঙামাটি থেকে সরে যেতে পারার আগেই তারা তাকে আরও দক্ষিণে চট্টগ্রাম থেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছিল। রাঙামাটিতে শত্রুকে যেটা আরও বেশি সন্ত্রস্ত করেছিল তা হচ্ছে শহরের ওপর দিয়ে আমার হেলিকপ্টারটির অনবরত ঘােরাফেরা, যা শত্রুর মেশিনগান ও রাইফেলের ফায়ার দিয়েও ঠেকানাে যায়নি; এবং কাপ্তাই -এর দক্ষিণ-পূর্বে দুমদুমিয়া এলাকায় কতগুলি উড়াল যেখানে এক কোম্পানি সৈন্য জড়াে করছিলাম কাপ্তাই এলাকা আক্রমণ করার পর চট্টগ্রাম -এর দিকে অগ্রসর হতে। ঐ দিকে প্রায় ২শ’ মুজিববাহিনীর ছেলেকে আগেই পায়ে হেঁটে অগ্রসর হওয়ার জন্য ছাড়া হয়েছিল। পিছনভাগে এই নতুন হুমকি শত্রুকে ভীতসন্ত্রস্ত করে তুলল এবং তারা রাঙামাটি ছেড়ে হটে গেল, পিছনে ফেলে গেল রেশন, পেট্রল, তেল ও লুব্রিক্যান্ট ছাড়াও নতুন অস্ত্রশস্ত্র ও গােলাগুলির বিশাল ভাণ্ডার।

রাঙামাটিতে সরে আসা, সেখানে নাগরিক সংবর্ধনা

আমি অবিলম্বে আমার সদর দফতর রাঙামাটিতে সরিয়ে নেওয়ার আদেশ দিলাম । শেখ মুজিবের ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনি, যিনি আমাদের সঙ্গে ছিলেন, আমার জন্য একটা যােগ্য নাগরিক সংবর্ধনার আয়ােজন করার জন্য রাঙামাটি রওনা হয়ে গেলেন। আমি তাঁকে নিবৃত্ত করতে চেষ্টা করলাম কিন্তু তিনি বললেন যে এর রাজনৈতিক গুরুত্ব আছে। শহরের মধ্যকার বিমান অবতরণ ক্ষেত্রে পৌছা মাত্র আমি দেখলাম হাজার হাজার বেসামরিক লোেক আমার জন্য অপেক্ষা করছে। হর্ষোফুল- শেখ ফজলুল হক মনি বাংলা ভাষায় অত্যন্ত আবেগঘন এক বক্তৃতা দিলেন। আমি সেই মিষ্টি সুরেলা ভাষার বেশ কিছুটা বুঝতে পারলাম। নাগরিকরা তাদের দেশের মুক্তিতে ভারতের ভূমিকার দারুণ প্রশংসা করছিল । ঐ দিন অপরাহ্নে স্থানীয় একটা কলেজের অধ্যক্ষ আমাকে চা খেতে ডাকলেন এবং দু’চোখে পানি নিয়ে বর্ণনা করলেন কি করে দুজন পাক সৈন্য তাঁকে বেঁধে রেখে ভরা দিনের আলােয় তার সামনে তাঁর স্ত্রীকে বলাৎকার করেছিল। যে ভয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন তার থেকে মুক্তি পাওয়াতে তিনি বারবার ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানালেন। পরে বিকাল বেলায় স্থানীয় বৌদ্ধ উপজাতীয়গণ (চাকমাগণ), একটা বৌদ্ধ মন্দিরে একটা অনুষ্ঠানে আমাকে নিমন্ত্রণ করে সেখানে এই নতুন স্বাধীনতায় তাদের আনন্দ প্রকাশ করল। তারা তাদের নেতা রাজা ত্রিদিব রায় তখন পর্যন্ত পাকিস্তানের মন্ত্রী। থাকাতে এতদিন পাকিস্তানের পক্ষে ছিল। তার পাকিস্তানি সৈন্যদের নির্যাতন ও বলাৎকারের কিছু ঘটনার কষ্টদায়ক বর্ণনা দিল এবং তাদের সঙ্গে সহযােগিতা করার জন্য স্থানীয় রাজার দুই ছেলেকে দায়ী করল। এই দুজন রাজপুত্রকে স্থানীয় জনগণ পিটিয়ে মেরে ফেলতে পারে এটা অনুমান করে আমি তাদেরকে নিরাপদ হেফাজতে নেওয়ার আদেশ দিলাম আর তাদের মাতা রানিকে আশ্বাস দিলাম স্থিতাবস্থা ফিরে আসলে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। এক ব্রিটিশ চা-বাগানকর্তা কর্নেল হিউম, যিনি একজন স্থানীয় রাজকন্যাকে বিয়ে করেছিলেন, তার অন্তঃস্বত্তা স্ত্রীর জন্য চিকিৎসা সহায়তা এবং কার ব্যবহারের সুযােগের জন্য আমার কাছে অনুরােধ নিয়ে আসলেন। (নিরাপত্তার স্বার্থে কিছুকালের জন্য সবগুলি ‘কার’ বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল)। আমি সানন্দে তাঁর দুটি অনুরােধেই সম্মত হলাম । আমাদের নিজেদের মেডিকাল অফিসার শিশুটির প্রসবে সাহায্য করলেন। এতে কর্নেল হিউম এবং রাজার পরিবার অত্যন্ত কৃতজ্ঞ হলেন।

আমরা রাঙামাটি প্রবেশ করার আগে এবং ফেঁপে ফুলে ওঠা নদীর পানি সহজে বয়ে নিয়ে যাবে বুঝতে পেরে আমি যখন আরও কিছু কমান্ডাে নগরের মধ্যখানে নামানাের উদ্দেশ্যে স্থানীয় নৌকার একটা বহর সংগ্রহ করছিলাম, তখন আমি আর্মি চীফের কাছ থেকে একটা জরুরি সংকেত বার্তা পেয়েছিলাম। তাতে বলা হয়েছিল যে শত্রুর যে বেতার বার্তা ধরা পড়েছে তাতে ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছে যে তারা ঢাকা থেকে নৌপথে চট্টগ্রামে যাবে এবং সেখান থেকে আরাকান রােড ধরে বার্মায় পালাবে সুতরাং আমাকে আদেশ দেওয়া হচ্ছে দোহাজারি এলাকায় একটি শক্তিশালী কমান্ডাে দল পাঠিয়ে এই আরাকান রােড অবরােধ করতে। আর্মি চীফ আমাকে দুদিনের সময় দিয়েছেন। এই সময়ের মধ্যে কুড়িকে কুড়ি মাইল ভিতরের এলাকায় যেতে হবে যার পথ-ঘাট জানা। নেই, কোথায় শক্র ওৎ পেতে আছে তার ঠিক নেই। তিনি স্বীকার করেছেন যে খুব অল্প। সময়ের নােটিশে এটা করতে বলা হয়েছে, কিন্তু তিনি যােগ করেছেন: আমি জানি যে আমার পঞ্চম আর্মি কাজটা করতে সক্ষম। আমাদের চীফের দ্বারা আমরা একটা ‘আর্মির মর্যাদায় উন্নীত হয়েছিলাম। তিনি এখন আমাদের সম্ভাবনা সম্বন্ধে অনেক বেশি উচ্চ ধারণা পােষণ করছিলেন। আমরা শুধু বিমান সমর্থন ও বন্দুক ছাড়া রাঙামাটি ও চট্টগ্রাম দখল করতে পারি তাই নয়, আমরা ভূতপ্রেতের মতাে চলতে পারি, দোহাজারি পৌছতে পারি, ঐ পয়েন্টে সাংগু নদীর ওপরকার। সেতু ধ্বংস করে পাক আর্মির আরাকান রােড ধরে বার্মায় পলায়ন ঠেকাতে পারি। আমাদের মাত্র দুটি হেলিকপ্টার (এমই ৪) কাজ করছিল। পাইলটরা অস্ত্র ও গােলাগুলিসহ বড় জোর ৮ জন করে কমান্ডাে বহন করতে প্রস্তুত ছিলেন। আমার দরকার ছিল প্রতিটিতে ১৩ জন করে। সুতরাং আমরা হেলিকপ্টারের মধ্যে যা কিছু অনাবশ্যক মনে করলাম তা সব খুলে নামিয়ে ফেললাম এবং ১৩ জন করে লােক তাতে ভরলাম। তারা ক্যাচ ক্যাচ শব্দ তুলল কিন্তু ইঞ্জিন তাদের ঠিকই উড়িয়ে নিতে পারল। আমি অনবরত আরও হেলিকপ্টার চাচ্ছিলাম।

তারা অনতিদূরে বিনা কাজে বসেও ছিল। কিন্তু আমার কাছে তা কখনও পৌছয়নি। হেলিকপ্টারের স্থানে আমরা আমাদের চীফ -এর কাছ থেকে একটা নতুন অভিনন্দন বার্তা পেলাম যাতে বলা ছিল: আমার নতুন আর্মির ওপর আমার অন্তর্নিহিত বিশ্বাস আছে। এতে করে স্বাভাবিকভাবেই আমরা অসম্ভবের পথে পা বাড়াতে উদ্যোগী হলাম। আমরা আরাকান রােড -এ প্রাধান্য বিস্তার করতে দক্ষিণ অভিমুখে ছুটলাম, ওদিকে আমাদের উত্তর কলাম রাঙামাটির উত্তরে শত্রু কর্তৃক তখন পর্যন্ত ধরে রাখা পােস্টগুলির সকল অবশেষ ধ্বংস করতে ব্যস্ত রইল । আমাদের চীফ -এর কাছ থেকে আমরা আরেকটা সংকেত বার্তা পেলাম: তােমাদের জন্য আমার বিমুগ্ধ প্রশংসা । সাবাস, ওয়েল ডান। দ্রুত অগ্রসর হতে থাকো । উত্তরে আমার কমান্ডারের আরেকটি বিজয় যার পরিপ্রেক্ষিতে চীফ -এর কাছ থেকে আরেকটা অভিনন্দনজ্ঞাপক সংকেত বার্তা এল: সাবাস, এভাবে ফাটিয়ে চলাে। তােমার ওপর আমার পূর্ণ আস্থা । এ সময়ে প্রথম হেলিকপ্টারটা ভাের ৫টা ৫০ মিনিটে দোহাজারি সেতুর দশ মাইল দক্ষিণ-পূর্বের পাহাড়ি স্থান উদ্দেশ্য করে উড্ডয়ন করেছে। ঐ সেতুটা ধ্বংস করা আমার গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য। সাংগু নদীর ওপর ঐ সেতুটা উড়িয়ে দিতে পারলে শক্রর পক্ষে বার্মায় পালানাের সুযােগ খুব কমই থাকবে। সুতরাং আমার সম্পূর্ণ মনােযােগ এই কাজটায় কেন্দ্রীভূত ছিল। যা-ই হােক আর্মি চীফ ১২ ডিসেম্বর সকালের মধ্যে দোহাজারি সেতুর মতাে সবগুলি সেতুরই ধ্বংস আশা করছিলেন আমি ভাবলাম দোহাজারি সেতু ধ্বংস করার কাজে কেন্দ্রীভূত হতে থাকা অগ্রগামী কোম্পানিটির সঙ্গে আমার থাকাটা ভাল হবে। প্রথম হেলিকপ্টারটিতে যে লােকেরা উড়ে গিয়েছে তাদের কাছ থেকে একটা অল ক্লিয়ার সংকেতের জন্য অপেক্ষা করার মতাে সময় আমার ছিল না। সুতরাং আমি দ্বিতীয় হেলিকপ্টারটিতে চড়ে বসলাম। প্রথমটার পাঁচ মিনিট পরে এটা উড্ডয়ন করল, যাতে সেখানে ২৬ জনের একটা পে-টুন গড়ে ওঠার কথা । প্রথমটার কাজ ছিল আমাদের অবতরণের স্থান বিপদমুক্ত করা এবং সম্ভব হলে অতর্কিত হামলায় ধ্বংস করার জন্য দোহাজারি সেতুর দিকে অগ্রসর হওয়া ।

মেজর এসএস নেগি-কে, যিনি পরে বীর চক্র পদক অর্জন করেছিলেন, আমি আদেশ করেছিলাম অবতরণের পরেই একটা শক্ত সমর্থ প্যাট্রল বান্দরবনের দিকে পাঠিয়ে দিতে জানা গিয়েছিল যে সেখানে প্রায় ২০০ জন পাঠান ছিল এবং তাদের সমর্থন। দিচ্ছিলেন স্থানীয় রাজা (বােমং সরদার) যিনি নাকি পাকিস্তানপন্থী ছিলেন এবং শহরে তার প্রাসাদে বাস করছিলেন। মেজর নেগি-কে আরও আদেশ দেওয়া হয়েছিল একটা পে-টুন সাংগু নদীর বাঁকের দিকে পাঠাতে এবং অন্য একটা পে-টুন দোহাজারির সেতুর দিকে পাঠিয়ে অতিসত্বর সেটা ধ্বংস করতে । এই সড়ক বরাবর নৌবাহিনীর আকাশযান থেকে বোমাবর্ষণ করা ও কামান দাগা হচ্ছিল যা মেজর নেগির কাজে এসেছিল। উক্ত হামলায় এমনকি সেতুটার এক প্রান্তও আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছিল। তাতে করে আমাদের কমান্ডােরা সেতুর কাছে ঘনিয়ে আসতে পারল, সেতুর প্রতিরক্ষায় মােতায়েন পাকিস্তানি সৈন্যদের হত্যা ও উৎখাত করতে সক্ষম হল। আমাদের আক্রমণ শত্রুকে এমনভাবে মনােবলহীন করে দিল যে যারা বেঁচে গিয়েছিল তারা চট্টগ্রামের দিকে ছুটতে লাগল তাদের পিছনে সবগুলি সেতু উড়িয়ে দিতে দিতে, যে কাজটা আমাদেরকে অনেক কষ্ট কসরত করে করতে হত। বান্দরবানে পাঠানরা নিজেদেরকে প্রত্যাহার করে স্থানীয় নৌকায় করে সাংগু নদী ধরে দক্ষিণে রুমার দিকে এবং রুমা ছাড়িয়ে আরও দক্ষিণে চলে গেল। তাদেরকে স্থানীয় চাকমা ও মিযােরা পথ দেখিয়ে নিচ্ছিল। তারা আমাদের হেলিকপ্টার শক্তি সম্বন্ধে ভুল ধারণা করেছিল, ভেবেছিল কুড়িকে কুড়ি বার হেলিকপ্টার ভরতি করে বিরাটসংখ্যক কমান্ডাে আনা হচ্ছে বান্দরবান ঘিরে ফেলার জন্য। আসল ঘটনা হচ্ছে আমি আমার হেলিকপ্টারকে বান্দরবান শহর ও তার আশপাশের নদী ও পাহাড় এলাকার ওপর দিয়ে চষে বেড়াতে বলেছিলাম। সেখানে রাজার প্রাসাদটা সবচেয়ে বড় ভবন, সেটা আমার মনােযােগ আকর্ষণ করায় আমি তার ছাদের খুব কাছ দিয়ে বার বার উড়ে গিয়েছি অসাধারণ কোনও কার্যকলাপের নিশানা চোখে পড়ে কিনা দেখার জন্য। পরে ঠিক এই প্রাসাদেই রাজা আমাদের চা -এর জন্য নিমন্ত্রণ করে প্রাসাদের ওপর হেলিকপ্টারের আসা-যাওয়ায় তারা কেমন ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন সে সম্বন্ধে মজার গল্প বলেছেন। তিনি প্রতিবার আশঙ্কা করছিলেন প্রাসাদটা ধ্বংস করার জন্য একটা বােমা ফেলা হবে।

অনেক সুযােগ নষ্ট হল

যথেষ্ট আকাশযানের অভাবের কারণে আমরা শত্রুদের বন্দি করার ও তাদের অস্ত্রশস্ত্র দখল করার অজস্র সুযােগ নষ্ট করলাম । আমি সংকেতের পর সংকেত পাঠিয়ে চললাম আরও দুটি হেলিকপ্টারের জন্য আবেদন করে, যাতে করে আমাদের যে দুটি আছে তার। পাশাপাশি তা বাছাই করা লক্ষিত এলাকায় উপযুক্ত সংখ্যায় লােকবল পৌছানাের কাজে ব্যবহৃত হতে পারে। কিন্তু কোনও কাজ হল না। একটা এলাকায় অপ্রত্যাশিতভাবে হঠাৎ গমন করে আমরা সেখানে যে ভীতির সৃষ্টি করেছিলাম তা আমরা কাজে লাগাতে পারলাম না। এক ঘটনায় আমি পায়ে হাঁটিয়ে মাত্র এক সেকশন শক্তির লােকবল পাঠিয়েছিলাম ২৫০ জন পাঠানের আত্মসমর্পণ গ্রহণ করতে, যারা আমাদেরকে বিরাট বাহিনী মনে করে আত্মসমর্পণের অঙ্গীকার পাঠিয়েছিল। এই ধোঁকা মাঝে মাঝে কাজ করত। অনেক সময়ই কাজ করত না।

শত্রুর পলায়নের আশা ধ্বংস হল

দোহাজারি সেতু ধ্বংস করা এবং বান্দরবান এলাকায় সাংগু নদী শত্রুমুক্ত করার পর আমরা আর্মি চীফ-কে একথা বলার অবস্থায় আসলাম যে আরাকান রােড শত্রুকে ব্যবহার করতে না দেওয়ার এবং সাংগু নদীতে শত্রুর পরিবহন বন্ধ করে দেওয়ার অতিরিক্ত কাজ সময় অনেক হাতে থাকতেই হাসিল করা হয়ে গিয়েছে এবং তিনি এখন শত্রু কমান্ডারকে এই মর্মে হুঁশিয়ার করে দিতে পারেন যে এ অঞ্চলটা একটা মৃত্যুর ফাঁদে পরিণত করা হয়েছে, এর মধ্যে দিয়ে কেউ আর পালাতে পারবে না। আমাদের এই নিশ্চয়তা দানের পরই পাক জেনারেল নিয়াযি-কে দেওয়া আমাদের আর্মি চীফের হুঁশিয়ারি ফলপ্রসূ হল, পাক জেনারেল শর্তহীন আত্মসমর্পণের কথা গুরুত্বের সাথে চিন্তা করতে শুরু করলেন। স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্স ন্যায়সংগতভাবে শক্রর আত্মসমর্পণে একটা বড় ভূমিকা দাবি করতে পারে । আমি আর্মি চীফ -এর কাছ থেকে নিচের সংকেত বাণীটি পেলাম: তােমার অর্জনসমূহের ব্যাপারে আমি গর্বিত। আমার অভিনন্দন। চলতে থাকে এবং পুরষ্কার তােমারই হবে।

চট্টগ্রাম নিয়ে কাড়াকাড়ি 

চট্টগ্রাম বন্দর ও শহরে আগেই অনুপ্রবেশ করা মুজিববাহিনীর ছেলেরা আমার ফোর্সের। নদী পাড়ি দিয়ে রাতের বেলায় চট্টগ্রামে নামার জন্য নৌকার ব্যবস্থা করল। তারা বেতার কেন্দ্র দখল করল। বেতার কেন্দ্রের স্টাফের মধ্যে তাদের সমর্থন ছিল। তারা এমনকি পাক সৈন্যদের আত্মসমর্পণও ঘােষণা করল । ঠিক এই সময় আমি আর্মি সদর দফতর থেকে সংকেত বার্তা পেলাম যে আমার ফোর্স কর্ণফুলি নদী পাড়ি দেবে না এবং তার দক্ষিণ দিকে থাকবে। এ হচ্ছে আমাকে চট্টগ্রামে ঢুকতে দিতে অস্বীকার করা; চট্টগ্রাম হচ্ছে কর্ণফুলি নদীর উত্তর পারে । সংকেত বার্তা এও বলল যে চট্টগ্রামস্থ পাক আর্মির সেনাদের আত্মসমর্পণ গ্রহণের জন্য দুটি আর্মি ব্রিগেড চট্টগ্রামের পথে রয়েছে। একটা ছােট গেরিলা ফোর্সকে সেখানকার পাক সৈন্যদের আত্মসমর্পণ গ্রহণ করতে। দেওয়া এবং তারা এই মস্ত বন্দর নগরীটি দখল করেছে এই কথা বলার সুযােগ দেওয়া বােধ করি আর্মির পক্ষে একটু বেশি হয়ে যাচ্ছিল। আমরা সাংঘাতিক রকম হতাশ। হলাম । এতে বিস্ময় ও ক্রোধ প্রকাশ করতে শেখ ফজলুল হক মনি যা মুখে এসেছে। তাই বলেছিলেন।

সূত্র : ফ্যান্টমস অব চিটাগং-দি ফিফথ আর্মি ইন বাংলাদেশ – মেজর জেনারেল (অব.) এস এস উবান

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!