সানডে টাইমস, ১৩ জুন, ১৯৭১
“গণহত্যা”
অ্যান্থনি মাস্কারেনহাস
সানডে টাইমসের এক প্রতিবেদক পাঁচ কোটি লোক কেনো পালিয়েছে তার ভয়াবহ কাহিনী নিয়ে পাকিস্তান ছেড়ে চলে এসেছে।
মার্চ মাসের শেষের দিকে পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে হাজার হাজার বেসামরিক লোককে হত্যা করে। মার্চ মাসের শেষের দিকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সরকারের প্রভাবে সংবাদ চেপে যাওয়ার পিছনে এটাই ছিল ভয়ঙ্কর বাস্তবতা। এই কারণেই কলেরা এবং দুর্ভিক্ষের ঝুঁকি নিয়ে পাঁচ লাখেরও বেশি শরণার্থী পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে পালিয়েছে।
পাকিস্তানে সানডে টাইমসের সংবাদদাতা এন্থনি মাসকারেনহাস কতৃক প্রথমবারের মতো এই নীরবতার পর্দা ভেঙ্গে যায়। তিনি দেখেছেন পাকিস্তান সেনাবাহিনী কি করছে। তিনি বিশ্ববাসীকে বলার জন্য পাকিস্তান ত্যাগ করেছেন।
সেনাবাহিনী একটি স্বাধীন পূর্ববাংলা তথা বাংলাদেশ চিন্তার সমর্থকদের নিছকই হত্যা করেনি। এটা অন্যদের উপর ইচ্ছাকৃতভাবে চালানো হত্যাযজ্ঞ। হিন্দু ও বাঙালি মুসলমান। হিন্দুরা গুলিবিদ্ধ হয়ে মরছে এবং তাদের পিটিয়ে মারা হচ্ছে কারণ তারা হিন্দু। গ্রামগুলি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অত্যাচারের বিক্ষিপ্ত এবং অনিশ্চিত প্রতিবেদনগুলি কিছুক্ষনের জন্য বাইরের জগতে পৌঁছাচ্ছে, বিশেষত উদ্বাস্তু, মিশনারি এবং কূটনীতিকদের কাছ থেকে। অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের প্রত্যক্ষদর্শী প্রতিবেদনটি তাই নির্ভুলতা ও নির্ভরযোগ্যতার দিক থেকে অদ্বিতীয়। তিনি বাংলার অন্তর্নিহিত দুঃখদুর্দশার সংবাদ সরবরাহ করেন: কেন শরণার্থীরা পালিয়ে গেছে?
এন্থনি মাস্কারেনহাসের রিপোর্টের পিছনে একটি অসাধারণ গল্প রয়েছে।
মার্চ মাসের শেষের দিকে বাঙালি বিদ্রোহীদের চিহ্নিত করতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীরা যখন পূর্ব পাকিস্তানের দুটি বিভাগে বহাল ছিল, এটি গোপনে সরানো হয়। কিন্তু প্রায় দুই সপ্তাহ পরে পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তানে যাওয়ার জন্য আটজন পাকিস্তানি সাংবাদিককে আমন্ত্রণ জানায়। তাদের পরিকল্পনা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণকে পূর্ব অর্ধাংশে “স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসার”
একটা সুনিশ্চিত ধারণা দেওয়া, যেমনটা সরকারি কর্মকর্তা কতৃক সাংবাদিকদের নিশ্চিত করা হয়। সাংবাদিকদের সাতজনই তাদের উদ্দেশ্য অনুযায়ী কাজ করেছিলেন। কিন্তু বাকি একজন ছিলেন মাস্কারেনহাস, যিনি করাচিতে মর্নিং নিউজের সহকারী সম্পাদক ছিলেন, এবং দ্য সানডে টাইমস পত্রিকার পত্রিকাও ছিলেন।
১৮ই মে মঙ্গলবার, লন্ডনে দ্য সানডে টাইমস অফিসে অপ্রত্যাশিতভাবে তিনি আসেন। সেখানে তিনি আমাদের বলেছিলেন, তিনি একটি গল্প লিখতে চেয়েছিলেন: পূর্ব বাংলায় ঘটে যাওয়া প্রকৃত ঘটনা যা পাঁচ মিলিয়ন মানুষকে পালাতে বাধ্য করে।
তিনি বুঝেছিলেন যে তিনি যদি তার গল্প লিখেন তবে তার জন্য করাচিতে ফিরে যাবার সম্ভাবনা নেই, এবং তিনি সেটা সুস্পষ্ট করে তুলে ধরেন। তিনি বলেন, তিনি পাকিস্তান ত্যাগ করার জন্য মনস্থির করেছেন: বাড়ি, অধিকাংশ সম্পদ এবং তার চাকরি তিনি ছেড়ে দিতে চান, তার চাকরি ছিল দেশের সবচেয়ে সম্মানিত সাংবাদিকদের একজনের সমতুল্য। তার একমাত্র শর্ত ছিল, তিনি পাকিস্তানে ফিরে গিয়ে তার স্ত্রী ও পাঁচ সন্তানকে নিয়ে আসা পর্যন্ত আমরা যেন তার গল্প প্রকাশ না করি। সানডে টাইমস সম্মত হন, এবং মাসকারেনহাস আবার করাচীতে ফিরে যান। দশ দিন অপেক্ষার পর, সানডে টাইমস নির্বাহীর ব্যক্তিগত ঠিকানায় একটি বিদেশী তারবার্তা পৌছায়।
“প্রত্যাবর্তনের আনুষ্ঠানিকতা শেষ”, এটা বলছে, “সোমবার থেকে যাত্রা শুরু”। মাসকারেনহাস তার স্ত্রী ও পরিবারের জন্য দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার অনুমতি পেতে সফল হন। তাকে ছেড়ে যেতে নিষেধ করা হয়েছে। যেভাবেই হোক তিনি চলে যাওয়ার একটি উপায় খুঁজে পেয়েছেন।
পাকিস্তানের মধ্যে তার শেষ পদচিহ্ন রাখার সময়, তিনি তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের একজন উর্ধতন কর্মকর্তার, যাকে তিনি ভালোভাবে জানেন, বিপরীতে করিডোরে বসা অবস্থায় নিজেকে খুজে পান। বিমানবন্দর থেকে আসা একটা ফোনেই তার গ্রেফতার হতে পারে।
যাহোক, কোন ফোন আসেনি, এবং গত মঙ্গলবার তিনি লন্ডনে ফিরে আসেন। মাস্কারেনহাস তার বিশেষ ক্ষমতা ও বস্তুনিষ্ঠতা দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে যা দেখেছেন তাই লিখেছেন। একটি গোয়ানি খ্রিস্টান বংশধর হিসাবে, তিনি কোন হিন্দু বা মুসলিম নন। এখনকার পাকিস্তানে তার সারাজীবন কাটিয়ে, ১৯৪৭ সালে রাষ্ট্র গঠন হওয়ার পর থেকে পাকিস্তানি পাসপোর্ট সঙ্গে করে, এবং সেসময় থেকে বহু পাকিস্তানি নেতার আস্থা অর্জন করেও, ব্যক্তিগত অনুতাপ থেকে তিনি তার প্রতিবেদন লিখেছিলেন। তিনি বলেন, “আমাদের তথ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা কতৃক আমাদের সেনাবাহিনীর কর্মকান্ডকে দেশপ্রেম হিসাবে দেখানো হয়েছিলো।
তার প্রতিবেদন নিয়ে কোন প্রশ্ন নেই, তিনি দেখেছিলেন তার নিজের সংবাদপত্রের জন্যই। তাকে একটা গল্প জমা দিতে বলা হয়েছিল, যা ২রা মে সানডে টাইমস-এ প্রকাশিত হয়েছিল, যেখানে কেবল ২৫/২৬শে মার্চে যখন বাঙালি সৈন্যরা বিদ্রোহ করেছিলো এবং অবাঙালিদের বিরুদ্ধে নৃশংসতা চালিয়েছিল তার প্রতিবেদন ছিল।
এমনকি দুর্ভিক্ষের ঝুঁকি সম্পর্কিত একটা তথ্যও ছিল যা সমালোচকরা মুছে দিয়েছিল। এটি তার বিবেকের সংকীর্নতা বাড়িয়ে দিয়েছে।
কিছুদিনের ‘দ্বিধাদ্বন্দ্বের’ পর তিনি সিদ্ধান্ত নেন,তার নিজের কথায়, ‘হয় আমি যা দেখেছি তার পুরো গল্পটি লিখব, অথবা আমার লেখা বন্ধ করতে হবে; আমি আর কখনো নিরপেক্ষতার সাথে লিখতে পারব না”। এবং সেজন্য তিনি একটি প্লেনে ওঠেন এবং লন্ডনে এসেছিলেন।
পূর্ববঙ্গের পুরো ঘটনা নিয়ে বিস্তৃত জ্ঞান থাকার এবং বস্তুনিষ্ঠ কূটনৈতিক সূত্র এবং সাথে অন্যান্য শরণার্থী যারা পূর্ব বাংলার পুরো ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত জানেন তাদের সাহায্যে, আমরা তার (মাস্কারেনহাস) গল্প অত্যন্ত গভীরভাবে যাচাই করতে সক্ষম হয়েছি।
গণহত্যা: সম্পূর্ণ প্রতিবেদন
আব্দুল বারি দুর্ভাগ্যক্রমে দৌড় দিছিলেন। পূর্ববাংলায় হাজার হাজার লোকের মত তিনিও ভুল করেছেন, টহলরত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সম্মুখে দৌড়ানোর মত মারাত্মক ভুল।
তিনি ২৪ বছর বয়সী, সৈন্যবাহিনী দ্বারা বেষ্টিত একজন সামান্য মানুষ। তিনি কাঁপছিলেন, কারণ তাকে প্রায় গুলি করা হচ্ছিলো।
কুমিল্লার প্রায় ২0 মাইল দক্ষিণে মুদফরগঞ্জের কাছে একটি ছোট্ট গ্রামের উপকণ্ঠে আমরা দাঁড়িয়ে, আমি ৯তম ডিভিশনের জি-২ অপারেশনের মেজর রাঠোরের কথাবার্তা শুনেছিলাম, “সাধারনত আমরা তাকে মেরে ফেলতাম যেহেতু সে দৌড় দিছিলো,” “কিন্তু আমরা আপনার জন্য তাকে পরিক্ষা করতেছিলাম। আপনি এখানে নতুন এবং আমি দেখছি আপনি বেশ খুঁতখুঁতে রুচির মানুষ”।
“কেন তাকে মেরেছ?” আমি গভীর উদ্বেগের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করলাম।
“কারণ সে একজন হিন্দু অথবা বিদ্রোহী হতে পারে, সম্ভবত একজন ছাত্র বা আওয়ামী লীগ হতে পারে। তারা জানে যে আমরা তাদের চিহ্নিত করছি এবং তারা দৌড় দিয়ে নিজেদের সাথে বেঈমানি করছে”।
“কিন্তু কেন তুমি তাদের হত্যা করছো? এবং কেন বেঁছে বেঁছে হিন্দুদের মারছো? আমি প্রশ্ন করতেই থাকলাম।
“আপনাকে স্মরণ করিয়ে দিতে হবে” রাঠোর বলেন, “কীভাবে তারা পাকিস্তানকে ধ্বংস করার চেষ্টা করছিল? এখন যুদ্ধের ছলে আমরা তাদের শেষ করে ফেলার চমৎকার সুযোগ পেয়েছি”।
“অবশ্যই,” তিনি অবিলম্বে যোগ করেন, “আমরা কেবল হিন্দু পুরুষদেরকেই হত্যা করছি। আমরা সৈন্যরা, বিদ্রোহীদের মতো কাপুরুষ নই, তারা আমাদের নারী ও শিশুকেও হত্যা করে”।
আমি পূর্ব বঙ্গের সবুজ ভূমিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রক্তের দাগের প্রথম আভাস পাচ্ছিলাম। প্রথমে এটি ছিল বাঙালি ঘৃণার প্রতিহিংসা স্বরূপ অবাঙালিদের গণহত্যা। এখন এটা ইচ্ছাকৃতভাবে পশ্চিম পাকিস্তান সেনাবাহিনী দ্বারা সংঘটিত গণহত্যা।
খুনের শিকার শুধুমাত্র পূর্ববাংলার হিন্দু নয়, যারা ৭৫ মিলিয়ন জনসংখ্যার প্রায় ১০ শতাংশ- সাথে হাজার হাজার বাঙালি মুসলমানরাও। এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজ ছাত্র, শিক্ষক, আওয়ামী লীগ এবং বামপন্থী রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা অন্তর্ভুক্ত এবং অন্যান্য ১৭৬,০০০ বাঙালি সৈন্য এবং পুলিশ যাদের সেনাবাহিনী ধরেছিলো, যারা ২৬শে মার্চে সামনাসামনি বিদ্রোহ করেছিলো যদিও সেটা ছিল একটি স্বাধীন প্রজাতন্ত্রের বাংলাদেশের তৈরি করতে একটা অসম্পূর্ন এবং বিপজ্জনক প্রচারণা।
এপ্রিলের শেষের ১০ দিনে আমি পূর্ব বঙ্গে আমার নিজের চোখ ও কান দিয়ে যে অবিশ্বাস্য ঘটনা দেখেছি এবং শুনেছি তাতে এটা স্পষ্ট যে হত্যাকান্ডগুলি সামরিক কমান্ডারদের ক্ষেত্রে ঘটা কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়।
পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরাই কেবলমাত্র পূর্ববাংলাতে হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছেনা। ২৫শে মার্চের রাতে পাকিস্তানি সেন্সর কর্তৃক আমাকে রিপোর্ট করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল যে, পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত বাঙালি সৈন্য ও আধা-সামরিক বাহিনী বিদ্রোহ করেছিল এবং বর্বরতার সাথে অবাঙালিদের আক্রমণ করেছিল।
হাজার হাজার হতভাগ্য মুসলমান পরিবার নির্দয়ভাবে নষ্ট হয়ে যায়, যাদের অধিকাংশই বিহার থেকে আসা শরণার্থী, যারা ১৯৪৭ সালে বিভাজন দাঙ্গার সময় পাকিস্তানকে বেছে নিয়েছিল। নারীরা ধর্ষিত হয়, বা বিশেষভাবে-সজ্জিত ছুরি দিয়ে তাদের স্তন ছিন্ন করা হয়। শিশুরাও এই আতঙ্ক থেকে বাচতে পারেনি: ভাগ্যবানরা তাদের পিতামাতার সাথে নিহত হয়; কিন্তু বহু হাজার হাজার শিশুকে উপড়ানো চোখ অথবা কাটা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিয়ে সারাজীবন বেঁচে থাকতে হবে। চট্টগ্রাম, খুলনা ও যশোরের প্রধান শহরগুলোতে ২0 হাজারেরও বেশি অবাঙালি মৃতদেহ পাওয়া যায়। মৃতের প্রকৃত সংখ্যা প্রায় ১০০,০০০ এর থেকে বেশি হতে পারে, যা আমাকে পূর্ববাংলার সর্বত্র থেকে বলা হয়; হাজার হাজার অ-বাঙালি কোন চিহ্ন ছাড়াই অদৃশ্য হয়ে গেছে।
পাকিস্তান সরকার এই প্রথম ভয়াবহতা সম্পর্কে বিশ্বকে জানতে দেয়। এবং আরও ভয়ঙ্কর হত্যাকাণ্ডের পর যখন তাদের নিজস্ব সেনাবাহিনী হত্যা শুরু করে, তখন দ্বিতীয়বারের মত জানায় এটি কীভাবে দমন করা হয়েছে। দুর্ভিক্ষ ও রোগে যারা মারা গেছে তাদের গণনায় না ধরেই, পশ্চিম পাকিস্তানি কর্মকর্তারা ব্যক্তিগতভাবে হিসাব করে দেখেন যে, উভয় পক্ষই ২৫০,০০০ জনকে হত্যা করেছে।
প্রদেশটির, যেখানে দেশের অর্ধেকেরও বেশি জনসংখ্যা রয়েছে, প্রায় সফল ভাঙ্গন সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া জানাতে, জেনারেল ইয়াহিয়া খান এর সামরিক সরকার পূর্ববাংলার সমস্যাগুলির নিজস্ব “চূড়ান্ত সমাধানের” মাধ্যমে চাপ দিচ্ছে।
“আমরা পূর্ব পাকিস্তানকে এবারের এবং সকল বিচ্ছিন্ন হুমকির জন্য শুদ্ধ করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়েছি, এমনকি এতে যদি দুই মিলিয়ন মানুষকে হত্যা করতে হয় এবং ৩০ বছরের জন্য উপনিবেশ হিসেবে প্রদেশ শাসন করতে হয় তবুও, ঢাকা এবং কুমিল্লার জ্যেষ্ঠ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা কতৃক আমাকে বারবার করে বলে দেওয়া হয়েছে।
পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা পূর্ব বাংলায় ভয়ঙ্কর পুণ্যের সাথে ঠিক সেটাই করছে।
চাঁদপুরের একটি সফরের পর আমরা যখন সূর্যের অস্ত যাওয়ার দ্রুত গাড়ি চালিয়ে ফিরছি (পূর্ব পাকিস্তানে পশ্চিম পাকিস্তানী সেনারা বুদ্ধি করে গৃহঅভ্যন্তরে থাকতো) তখন টয়োটা ল্যান্ড ক্রুজারের পেছন থেকে এক জওয়ান (বেসরকারি) হেঁকে উঠলো: “সাহেব একজন মানুষ দৌড়াচ্ছে”।
মেজর রাঠোর অপ্রত্যাশিতভাবে গাড়ি থামালেন, একই সাথে তার চায়নিজ হালকা মেশিনগান দিয়ে দরজা বরাবর তাক করলেন। ২০০ গজের কম দূরত্বে হাটু সমান ধান ক্ষেতে একজন মানুষ লাফিয়ে চলছে।
“ঈশ্বরের দোহাই গুলি করো না”, আমি চিৎকার করে বললাম। “সে নিরস্ত্র। সে কেবলমাত্র একজন গ্রামবাসী”।
রাঠোর আমাকে একটি নোংরা চাহনি দেয় এবং এর মাধ্যমে একটি সতর্কবার্তা দেয় আমাকে।
যেহেতু মানুষটা (ধান ক্ষেতের) ঘন সবুজ গালিচার মধ্যে নিচু হয়ে লুকিয়ে গেছে, সেজন্য দুজন জাওয়ান ইতোমধ্যে বেরিয়ে গেছে তাকে ধরে আনতে।
জিজ্ঞাসাবাদের পুর্বে কাঁধ জুড়ে থাকা রাইফেলের হাতলে ধপ ধপ শব্দ করছে।
“তুমি কে?”
“রহমত করুন, সাহেব! আমার নাম আবদুল বারী। আমি ঢাকা নতুন বাজারের একজন দরজী”।
“আমার কাছে মিথ্যা বলো না তুমি একজন হিন্দু, কেন পালাচ্ছো?” “কারফিউ সময় প্রায় হয়ে গেছে সাহেব। তাই আমি আমার গ্রামে ফিরে যাচ্ছিলাম।”
“আমাকে সত্য করে বলো, কেন তুমি দৌড়াচ্ছিলে?”
একটি জওয়ান যখন দ্রুত অস্ত্র দিয়ে তার লুঙ্গী সরানোর চেষ্টা করলো, লোকটা উত্তর দেবার আগেই হটাত ভয় পেয়ে গেলো। চর্মের অঙ্গটি তার শরীরের সুন্নতের (লিঙ্গাগ্রচর্মছেদন) বিশেষ চিহ্ন বহন করে, যা মুসলমানদের জন্য বাধ্যতামূলক।
লক্ষ্য বিপুল সংখ্যক মানুষ
অন্ততপক্ষে, এটি স্পষ্টভাবে দেখা গেছিল যে বারী হিন্দু ছিলনা।
জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।
“আমাকে বলো, কেন তুমি দৌড়াচ্ছিলে?”
ভয়ংকরভাবে কাঁপতে থাকা বারী, আতঙ্কিত চোখে এবার আর উত্তর দিতে পারেনি।
সে তাদের হাটু গেঁড়ে পড়েছিলো।
“স্যার, তাকে মুক্তিফৌজ মনে হচ্ছে” বারী যেহেতু তার পায়ের উপর পড়ে ছিল, একটা জওয়ান তাকে সরিয়ে নিলো। (ফৌজি সৈন্যদের উর্দু প্রতিশব্দ, সেনাবাহিনীরা “বাংলার বিদ্রোহীদের” জন্য এটি ব্যবহার করছে।)
আমি রাঠোর মৃদুভাবে বলতে শুনলাম, “হতে পারে”।
আবদুল বারীকে রাইফেলের বাট দিয়ে কয়েকবার মাথায় আঘাত করা হলো, তারপর আকস্মিকভাবে একটা দেয়ালের সাথে চেপে ধরা হলো। তার আত্মচিতকারে আশেপাশের একটা কুড়েঘর থেকে একটি তরুণের মাথা বের করতে দেখা যায়। বারি বাংলায় চিৎকার করে কি যেন একটা বললো। হটাত মাথাটা উধাও হয়ে গেলো। একমুহুর্ত পর একজন দাড়িওয়ালা বৃদ্ধ লোক কুড়িঘর থেকে বেরিয়ে এলো। রাঠোর তার দিকে তাকালেন।
“আপনি কি এই লোকটিকে চিনেন?”
“হ্যাঁ, সাহেব। তিনি আবদুল বারী।”
“সে কি ফৌজি?”
“না, সাহেব, তিনি ঢাকার একজন দরজী।”
“আমাকে সত্যকথা বলো।”
“খুদার কসম (ঈশ্বরের শপথ), সাহেব, তিনি একজন দর্জি।”
হঠাৎ একটা নীরবতা। আমি বললাম, “ঈশ্বরের দোহাই তাকে যেতে দাও। আর কি প্রমাণ চাও তার নিরাপরাধের সপক্ষে?
কিন্তু জওয়ানরা দৃশ্যত অসন্তোষ প্রকাশ করছিল এবং বারির চারপাশে ঘুরতেছিল। আমি তখন তার পক্ষে আরও একবার অনুরোধ করেলাম যে রাঠোর বারীকে মুক্তি দিতে বলেছে। সেই সময় তিনি বেপরোয়া ছিলেন, এক অকথ্য মূর্তিমান সন্ত্রাস। কিন্তু তার (বারি) জীবন বেঁচে গেছিল।
অন্যরা এতটা ভাগ্যবান হয়নি।
কুমিল্লার ৯তম ডিভিশনের সদর দফতরের কর্মকর্তাদের সাথে ছয় দিনের জন্য ভ্রমণ করার সুবাদে, আমি অনেক কাছ থেকে এসব হত্যাযজ্ঞের সাক্ষী ছিলাম। আমি দেখেছিলাম গ্রাম থেকে গ্রামে এবং ঘর ঘরে হিন্দুদের তল্লাসী করা হয়, এবং দ্রুত “ছোট অস্ত্র পরিদর্শন” করে তাদের লিঙ্গাগ্রচ্ছেদন করা হইছে কিনা দেখে তাদের গুলি করে মেরে ফেলা হয়। আমি কুমিল্লায় সার্কিট হাউস (সিভিল প্রশাসনিক সদর দফতর) এর প্রাঙ্গনে আঘাত করতে করতে মেরে ফেলা অনেক মানুষের আর্তনাদ শুনেছি। আমি অন্য অসংখ্য মানুষকে টার্গেট হতে দেখেছি এবং তাদের সাহায্য করার মত মানবতা যাদের ছিল কিন্তু “নিয়ন্ত্রনের জন্য” কারফিউ এবং অন্ধকারের আচ্ছাদনে সেটা বাধাগ্রস্থ হতে দেখেছি। আমি সেনা ইউনিট হিসাবে “বিদ্রোহীদের হত্যা এবং পুড়ানো” এর নিষ্ঠুরতা দেখেছি, বিদ্রোহীদের সাফ করার পর, শহর ও গ্রামগুলিতে দাঙ্গা চালিয়ে যাচ্ছে।
আমি “শাস্তিমূলক পদক্ষেপ” দ্বারা বিধ্বস্ত পুরো গ্রাম দেখেছি।
এবং অফিসারদের কোয়ার্টারে রাতের বেলা আমি অবিশ্বাস্যভাবে সাহসী ও সম্মানিত মানুষগুলোকে তাদের দিনের বেলা করা খুন নিয়ে গর্বের ভঙ্গিতে গল্পগুজব করতে শুনেছি।
“আপনি কতটা পেয়েছেন?”
উত্তরগুলো আমার স্মৃতিকে অনুভূতিহীন করে তুলতো।
কোন পাকিস্তানি কর্মকর্তা আপনাকে “একতা, সততা ও পাকিস্তানি মতাদর্শের সংরক্ষণ” সম্পর্কে যেমনটা বলবেন, তার সবই করা হচ্ছে। সেজন্য অবশ্যই এটা অনেক দেরী হয়ে গেছে। ভারতীয় ভূখণ্ড দ্বারা প্রায় এক হাজার মাইল দূরে থাকা দুই প্রদেশকে একসঙ্গে রাখাতে সামরিক বাহিনী কতৃক যে কার্যক্রম করা হয়েছিল তা এখন সত্যিকার অর্থে মতাদর্শগত এবং মনস্তাত্ত্বিকভাবে বিষয়টা নিশ্চিত করেছে। পূর্ববাংলা শুধুমাত্র সেনাবাহিনীর ভারী অস্ত্র দ্বারা পাকিস্তানে রাখা যেতে পারে। এবং পাঞ্জাবীদের দ্বারা সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত হয়, যারা ঐতিহ্যগতভাবে বাঙালিদের অবজ্ঞা ও ঘৃণা করে।
এই দূরত্ব আজ এতোটাই পরিপুর্ন যে খুব অল্প কয়েকজন বাঙালিকে স্বেচ্ছায় পশ্চিম পাকিস্তানীদের সাথে দেখা যাবে। ঢাকা পরিদর্শনকালে আমি এক পুরানো বন্ধুর সাথে যখন দেখা করতে গিয়েছিলাম, এই ধরনের একটি দুর্দশামূলক অভিজ্ঞতা হয়েছিল। “আমি দুঃখিত,” তিনি আমাকে বলেছিলেন, “সবকিছু পালটে গেছে। যে পাকিস্তানকে আমি এবং আপনি জানতাম তা অস্তিত্বহীন হয়ে গেছে। আসুন এটাকে আমরা আমাদের পিছনে রাখি।”
সেনাবাহিনী নিয়ে যাওয়ার আগে অবাঙালিদের গণহত্যার ব্যাপারে কয়েক ঘন্টা পর একজন পাঞ্জাবি সেনা কর্মকর্তা আমাকে বলেছিল: “তারা আমাদের সাথে ১৯৪৭ সালে বিভাজন দাঙ্গায় শিখদের তুলনায় আরও নিষ্ঠুর আচরণ করেছিল। কিভাবে এটা আমরা কখনো ভুলতে বা ক্ষমা করতে পারি?”
হাড়-পেষণকারী সামরিক অপারেশনের দুটি স্বাতন্ত্র্যসূচক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এক, যা কর্তৃপক্ষ “শুদ্ধকরণ প্রক্রিয়া” বলতে চান: গণহত্যার জন্য একটি ধূর্ততা। অন্যটি হল “পুনর্বাসন প্রচেষ্টা”। পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিমাঞ্চলীয় একটি দলীয় উপনিবেশে পরিণত করার জন্য এই পদক্ষেপগুলি একটি উপায় বলা যায়। এই সাধারণভাবে ব্যবহৃত অভিব্যক্তি এবং পুনরাবৃত্তিমূলক অফিশিয়াল তথ্যসুত্রে বলা হচ্ছে বিশ্বব্যাপী উপকারে “দুষ্কর্মকারী” এবং “অনুপ্রবেশকারীদের” জন্য আইন প্রনয়ন করা হচ্ছে। এসব অপপ্রচার দূরে সরান, এবং বাস্তবতা হলো উপনিবেশিকরণ এবং হত্যা করা।
১৮ই এপ্রিল একটি রেডিও সম্প্রচারে আমি পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেলের টিক্কা খানের ভাষণ শুনি, হিন্দুদের নৃশংসতার পক্ষে যুক্তিই ছিল তার সে উদ্ধৃতি। তিনি বলেন, “পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানরা, যারা পাকিস্তান সৃষ্টির ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল, সেটা তারা জীবিত রাখতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ”। যাহোক, হিংস্র এবং আগ্রাসী সংখ্যালঘুদের দ্বারা জবরদস্তিপূর্বক জীবন ও সম্পত্তির হুমকির মাধ্যমে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠের কণ্ঠস্বর দমন করা হয়, যার ফলে আওয়ামী লীগকে ধ্বংসাত্মক পথ গ্রহণ করতে বাধ্য করে”।
অন্যরা গোপনে কথা বলতে বলতে ন্যায়পরায়ণতা খুঁজতে ব্যস্ত ছিল।
কুমিল্লায় অফিসারের মেসে ৯তম বিভাগের সদর দফতরের কর্নেল নায়ার্ন আমাকে বলেন, “হিন্দুরা তাদের অর্থ দিয়ে মুসলিম জনগণকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করেছে”। তারা সাদা প্রদেশকে রক্তাক্ত করেছে। ভারতে সীমান্ত দিয়ে অর্থ, খাদ্য এবং উত্পাদন প্রবাহিত হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তারা কলকাতায় শিক্ষিত হওয়ার জন্য কলেজ ও স্কুলের অর্ধেকেরও বেশি শিক্ষাকর্মী এবং নিজেদের সন্তানদের পাঠিয়েছিল। এটি এমন অবস্থানে পৌঁছেছিল যেখানে বাঙালি সংস্কৃতি প্রকৃতপক্ষে হিন্দু সংস্কৃতি ছিল এবং পূর্ব পাকিস্তান কলকাতার মারওয়ারি ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। আমাদের জনগণ ও জনগণের ভূখণ্ডকে তাদের বিশ্বাসের দিকে ফিরিয়ে আনার জন্য আমরা তাদের চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছি”।
অথবা মেজর বশিরকে নিয়ে যান তিনি কর্মী র্যাংক থেকে উঠে এসেছেন। তিনি কুমিল্লায় ৯ম ডিভিশনের এসএসও এবং তিনি ব্যক্তিগতভাবে ২৮ জনের শরীর গর্বিত। যা ঘটেছে সেজন্য জন্য তার নিজস্ব কারণ রয়েছে। তিনি এক কাপ সবুজ চা দিতে দিতে আমাকে জানান, এটা শুদ্ধ এবং অশুদ্ধের মধ্যে যুদ্ধ। “হয়তো এখানের মুসলমানদের মুসলিম নাম আছে এবং তারা নিজেদেরকে মুসলমান বলে। কিন্তু মনের দিক থেকে তারা হিন্দু। আপনি বিশ্বাস করবেন না যে ক্যান্টনমেন্ট মসজিদটির মৌলভী এখানে শুক্রবার নামাজের সময় ফতোয়া জারি করেছে, যারা পশ্চিম পাকিস্তানিদেরকে হত্যা করবে তারা জান্নাতে যাবে। আমরা এসব বেজন্মাদের চিহ্নিত করেছি এবং এখন অন্যদেরকেও করছি। যারা যাকি আছে তারা প্রকৃত মুসলমান হবে এবং এমনকি আমরা তাদেরকে উর্দু শিক্ষা দেব”।
সবখানে, আমি কর্মকর্তা ও পুরুষদের তাদের নিজেদের কুসংস্কারের বেড়াজালে কল্পনাপ্রসূত ন্যায়পরায়ণতার পোশাক তৈরি করতে দেখেছি। বলির পাঁঠাদের বৈধতা লাভ করতে হতো তাদের নিজস্ব বিবেকের জন্যই, যার ভয়ানক “সমাধান” ছিল আসলে একটা রাজনৈতিক সমস্যা: বাঙালিরা নির্বাচনে জিতেছিল এবং শাসন করতে চেয়েছিল। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে পাকিস্তানের পাঞ্জাবীরা যেহেতু উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও স্বার্থপরতা নিয়ে সরকারের নীতির ওপর আধিপত্য করে, তাই তাদের ক্ষমতার কোন ক্ষতি হবে না। সেনাবাহিনী তাদের সমর্থন করছিল।
সেনাবাহিনী আসার আগে, কর্মকর্তারা ব্যক্তিগতভাবে অবাঙালিদের গনহত্যার প্রতিশোধে যা করা হয়েছে তার বৈধতা প্রদান করে। কিন্তু ঘটনাগুলো স্পষ্ট করে যে এই দাঙ্গা কোন স্বতঃস্ফূর্ত বা অশাসিত প্রতিক্রিয়ার ফল নয়। এটা ছিল পরিকল্পিত।
এটা স্পষ্ট যে, লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান যখন মৃদু, স্বেচ্ছাসেবী থেকে পূর্ববাংলার গভর্নর নিযুক্ত হন, তখন থেকেই এই “চিহ্নিতকরণ” এর পরিকল্পনা করা হয়েছিল। পণ্ডিত লেফটেন্যান্ট জেনারেল সাহেবজাদা খান থেকে অ্যাডমিরাল আহসান, এবং সেখানের সামরিক কমান্ড। মার্চ মাসের শুরুতে বাঙালির বহু আকাঙ্ক্ষিত সমাবেশ বৈঠক যখন স্থগিত করা হলো, শেখ মুজিবুর রহমানের বেসামরিক আইন অমান্য আন্দোলনে গতি এসেছিল। এটা বলা হয়েছে, পূর্ববাংলায় অবস্থানরত পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যদের ক্রমবর্ধমান অপমানের কারণে শীর্ষস্থানীয় সামরিক প্রতিষ্ঠানে হওয়া অসন্তোষের জোয়ারে রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান মৌন সম্মতি দিয়েছিল। ঢাকায় পাঞ্জাবি ইস্টার্ন কমান্ড কেন্দ্রীয় সরকারের নীতি প্রতিষ্ঠা করা অব্যাহত রাখে। (সম্ভবত এটি উল্লেখযোগ্য যে, খানেরা এর সাথে জড়িত নয়: খান পাকিস্তানের সাধারণ উপনাম।)
সেনা ইউনিটগুলি ২৫শে মার্চ সন্ধ্যায় বিদ্রোহের বিরুদ্ধে ঢাকায় দমন অভিযান চালায়। পরদিন সকালে কয়েক ঘণ্টার জন্য বিদ্রোহের পরিকল্পনা করা হয়। তাদের মধ্যে অনেক লোকজনকে তালিকাভুক্ত করা হয়। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিলো, হিন্দু এবং বহু সংখ্যক মুসলিম, ছাত্র, আওয়ামী লীগ, অধ্যাপক, সাংবাদিক; এবং যারা শেখ মুজিবের আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকায় ছিলেন। প্রকাশ্য অভিযোগ করা হয় যে জগন্নাথ হল, যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দু ছাত্ররা থাকে, থেকে সেনাবাহিনীদের উপর কামান দিয়ে আক্রমন করা হয় যা রমনা রেসকোর্সে মন্দিরের চারপাশে নির্মিত দুটি হিন্দু উপনিবেশ এবং পুরনো শহরের অভ্যান্তরে শঙ্করপট্টির তৃতীয় উপনিবেশের ধ্বংসাত্মকতা খুব কমই সমর্থন করে। ২৬ ও ২৭শে মার্চ রাতে কারফিউ চলাকালীন সময়ে ঢাকা এবং আশপাশের শিল্পকেন্দ্র নারায়ণগঞ্জের উল্লেখযোগ্য হিন্দু জনগোষ্ঠী কেন সম্পূর্ণভাবে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল তাও ব্যাখ্যা করে না।
অনুরূপভাবে কারফিউ চলাকালীন যাদের গ্রেফতার করা হয়েছিল সেই সংখ্যালঘু মুসলমানদের কোনও চিহ্ন নেই। পরিকল্পিত অভিযানে সেসব ব্যক্তিদের অপসারন করা হয়েছে: হিন্দু আগ্রাসনের একটি উদ্দীপ্ত প্রতিক্রিয়া ছিল অত্যন্ত ভিন্ন ফলাফল।
একটি পেন্সিলের খোঁচা, একটি মানুষ ‘খতম’
১৫ই এপ্রিল ঢাকায় ঘুরে বেড়ানোর সময়, ইকবাল হলের হোস্টেলের ছাদে চারজন ছাত্রের পচে যাওয়া মাথা খুঁজে পেয়েছিলাম। তত্ত্বাবধায়ক বলেন, ২৫শে মার্চের রাতে তারা নিহত হয়। দুটি সিঁড়িতে এবং চারটি কক্ষের প্রতিটাতে প্রচুর রক্ত পাওয়া গেছে। বিশেষ কারণে ইকবাল হলের পিছনের একটি বড় আবাসিক ভবন সৈন্যরা বেছে নিয়েছে বলে মনে হচ্ছে। দেয়ালগুলিতে বুলেটের আঘাতে ছোট ছোট গর্ত তৈরি হয়েছে এবং সিড়িগুলিতে এখনো রয়েছে দীর্ঘদিনের দুর্গন্ধ, যদিও ব্যপকভাবে ডিডিটি পাওডার ছড়ানো হয়েছে। প্রতিবেশীরা বলেছে যে ২৩টি মহিলা ও শিশু মৃতদেহ মাত্র কয়েক ঘন্টা আগেই স্থানান্তর করা হয়েছে। ২৫শে মার্চের পর থেকে তারা ছাদে পচতেছে। এটা অনেক প্রশ্ন করার পরেই প্রমাণিত হয়েছিল যে শিকারটি প্রায় কাছাকাছি বসবাসকারী হিন্দু বস্তির। সেনাবাহিনী বন্ধ করে দেওয়ার কারণে তারা ভবনটিতে আশ্রয় চেয়েছিল।
এই গণহত্যা আশ্চর্যরকম উদ্দেশ্যহীনতার সাথে পরিচালিত হচ্ছে। কুমিল্লা শহরের সেনাশাসন প্রশাসক মেজর আগার অফিসে বসে, ১৯শে এপ্রিল সকালের দিকে আমি দেখলাম, কিভাবে ভাবনা-চিন্তা বিহীনভাবে শাস্তি নির্ধারন করা যায়। পুলিশের এক বিহারি উপ-পরিদর্শক পুলিশ লক-আপে আটক বন্দীদের তালিকা নিয়ে এগিয়ে আসেন। আগা সেটা দেখেন। এরপর, তিনি তার পেন্সিলের এক খোঁচায় আকস্মিকভাবে চারটি নামে টিক চিহ্ন দিয়ে দেন।
তিনি বলেন, “নিষ্পত্তির জন্য আজ সন্ধ্যায় এই চারটিকে আমার কাছে আনো”। তিনি আবার তালিকায় তাকান। পেন্সিল দিয়ে আরো একবার খোঁচা দিলেন। “এবং এই চোরটাকেও তাদের সঙ্গে আনবে।”
এক গ্লাস নারকেল দুধ খেতে খেতে মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করা হয়েছিল। আমি জানতাম যে দুই বন্দী হচ্ছেন হিন্দু, তৃতীয়জন ‘ছাত্র’ এবং চতুর্থজন আওয়ামী লীগ সংগঠক। জানা যায়, “চোরটা” হলো সেবাস্তিয়ান নামে এক বালক যে তার এক হিন্দু বন্ধুর বাড়ি থেকে জিনিসপত্র নিজের বাড়ি নেওয়ার সময় ধরা পড়ে।
পরে সেই সন্ধ্যায় আমি এইসব লোককে দেখেছিলাম, তাদের হাত ও পা একটি দড়ি দিয়ে বাধা অবস্থায় সার্কিট হাউস প্রাঙ্গণের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। ৬টায় কার্ফিউ শেষ হবার একটু পর, হাড় এবং মাংসের সাথে মিলিত কাঠের খটখট শব্দে কুহূ কুহূ করা এক ঝাঁক ময়না পাখি বিরক্ত হয়ে তাদের গান থামিয়ে দেয়।
মেসের রসিকতা অনুযায়ী, বেলুচ রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন আজমাত দুটি খ্যাতি অর্জনের দাবীদার। এক, ৯ম বিভাগের কমান্ডিং অফিসার মেজর জেনারেলের শওকত রাজার জন্য তার এডিসি হিসাবে কাজ করা। অন্যটি, তার সহকর্মীরা র্যাগিং এর মাধ্যমে তার ওপর চাপ সৃষ্টি করেছিল।
জানা যায়, আজমাত ছিল গ্রুপের একমাত্র কর্মকর্তা যে কখনো হত্যা করেনি। মেজর বশির তাকে নির্মমভাবে খুঁচিয়েছিলেন।
বশির এক রাতে তাকে বলেছিলো, “আসো আজমাত,” “আমরা তোমাকে পুরুষ বানাতে যাচ্ছি। আগামীকাল আমরা দেখতে পাব কিভাবে তুমি তাদের দৌড়ের উপর রাখতে পারো। এটা খুবই সহজ।”
একটা বিশেষ ব্যাপার নির্দেশ করতে বশির তার দীর্ঘ বক্তব্যের মধ্যে চলে যায়। এসএসও হিসাবে তাঁর দায়িত্ব ছাড়াও বশির ছিলেন সদর দফতরের “শিক্ষা কর্মকর্তা”। তিনিই কেবলমাত্র পাঞ্জাবি কর্মকর্তা ছিলেন যিনি অনর্গল বাংলা বলতে পারতেন। সাধারণ সম্মতিতে বশির ছিলেন স্ব-শিক্ষিত বিরক্তিকর লোক যিনি নিজের কণ্ঠ নিয়ে গর্বিত ছিলেন।
আমাদের জানানো হয়েছিল, একজন দাড়িওয়ালা (দাড়িযুক্ত মানুষ) লোক সকালে তার ভাই, যিনি কুমিল্লার একজন বিশিষ্ট আওয়ামী লীগের সংগঠক, এর খোজ নিতে বশিরের কাছে এসেছেন, যিনি কয়েকদিন আগে সেনা কর্তৃক নিখোঁজ হয়েছে। তাকে ধরেছিলাম, বশির তাকে বলেছিলেন: “সে পালিয়ে গেছে”। বুড়ো মানুষ বুঝতে পারে না যে তার ভাই একটি ভাঙা পায়ে কীভাবে পালিয়ে যেতে পেরেছিল। আমিও পারিনি। সুতরাং বশির চোখ টিপ মেরে আমাকে বুঝিয়ে দেয়।
রেকর্ড হয়তো বলবে ধর গায়া: “পালানোর সময় গুলিবিদ্ধ”। আমি কখনোই জানতে পারিনি ক্যাপ্টেন আজমাত কাওকে মারতে পেরেছিল কিনা। বিদ্রোহী বাঙ্গালী বাহিনী যারা চট্টগ্রামের উত্তরে ৭০ মাইল পর্যন্ত কুমিল্লার ফেনী হাইওয়েতে গর্ত খুঁড়েছিল, তারা সেতু ও সাঁকো ধ্বংস করে ৯ম বিভাগকে বন্ধ করে দিয়েছিল।
জেনারেল রেজা ঢাকায় পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড থেকে নরকের যন্ত্রনা পোহাচ্ছেন, পালিয়ে যাওয়া বিদ্রোহীদের জন্য দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় সীমানা বন্ধ করে দেওয়ার ব্যাপারে উদ্বিগ্ন ছিলেন। চট্টগ্রাম বন্দরে স্তুপকৃত প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরবরাহ করতে উত্তর-পূর্বের এই একমাত্র জমির রুটটি উন্মুক্ত করা অত্যন্ত জরুরী ছিল।
এসব সঙ্গত কারণেই জেনারেল রেজা খিটখিটে ছিলেন। তিনি প্রায় প্রতিদিনই এলাকা ত্যাগ করেন। তিনি ফেনীতে ফাটল ধরা সেতুটি দখল রাখতে কয়েক ঘণ্টা ব্যয় করেন। স্বাভাবিকভাবে, ক্যাপ্টেন আজমাত জেনারেলের মত ছিলেন। আমি তাকে আর দেখতে পাইনি। কিন্তু অভিজ্ঞতা যদি কোন নির্দেশক হয়, তাহলে সম্ভবত আজমাতকে তার “খুন” এবং র্যাগিং নিয়ে আরো তিন সপ্তাহের জন্য ঘাম ঝরাতে হবে। ৯ম বিভাগ ৮ই মে ফেনী এবং পার্শ্ববর্তী এলাকাটি পরিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছিল। এরমধ্যেই জোরপূর্বক অবিরাম বোমা ও কামান বাহিনী কারণে বাংলা বিদ্রোহীরা তাদের অস্ত্রসহ নিয়ে তাদের প্রতিবেশী সীমান্ত পাড়ি দেয়।
বাঙালি বিদ্রোহীদের এই বিপুলসংখ্যক সশস্ত্র ও নিয়মিত বাহিনীর পলায়ন, ৯ম বিভাগ সদর দফতরের লেফটেন্যান্ট জেনারেল আসলাম বেগের মধ্যে গভীর উদ্বেগের কারণ হয়েছিল। তিনি ব্যাখ্যা করেন, “ভারতীয়রা” স্পষ্টতই তাদের সেখানে বসতি স্থাপন করার অনুমতি দেবে না। এটা খুব বিপজ্জনক হবে। তাই তারা যতদিন সীমান্ত ওপারে থাকবে ততদিন পর্যন্ত তাদের ভোগান্তিতে রাখা হবে। আমরা তাদের খুন করতে না পারলে, আমরা দীর্ঘসময়ের জন্য গুরুতর সমস্যায় পড়ব”।
লেফটেন্যান্ট কর্ণেল বেগ একজন জনপ্রিয় আর্টিলারি অফিসার ছিলেন যিনি পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের পর চীনে কাজ করেছিলেন, যখন পাকিস্তান সেনাবাহিনী চীনা সরঞ্জামে রূপান্তরিত হচ্ছিল। তাকে একজন গর্বিত পরিবারিক মানুষ বলা হয়েছিল। তিনি ফুলও পছন্দ করেন। তিনি চাপা গর্বের সাথে আমাকে বলেছিলেন যে, কুমিল্লায় পূর্ববর্তী পোস্টিংয়ের সময় তিনি চীনের কাছ থেকে প্রচুর পরিমাণে টকটকে লালরঙা বড় শাপলাফুল এনেছিলেন যা দফতরের বিপরীত দিকের পুকুরে শোভা পাচ্ছে। মেজর বশির তাকে খুব পছন্দ করেন। একজন অফিসারের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারে বশির আমাকে বলেছিলেন যে, একবার তারা এক বিদ্রোহী অফিসারকে ধরেছিলেন, তাকে কি করা যায় সেটা নিয়ে অনেক জল্পনা-কল্পনা হয়েছিল। “অন্যরা যখন নির্দেশাবলীর জন্য টেলিফোন করায় ব্যস্ত ছিলো” তিনি বলেন, “তিনি এই সমস্যাটির সমাধান করেছেন। ডিলিয়ারগায়া। খাঁদ থেকে শুধুমাত্র লোকটির পা বেরিয়ে ছিল”।
এত সৌন্দর্যের মাঝে এতো বেশি নৃশংসতা কল্পনা করা কঠিন। এপ্রিলের শেষের দিকে যখন গেছিলাম, কুমিল্লা তখন সজ্জিত ছিল। রাস্তার উভয় দিকের দিগন্তে ছড়িয়ে থাকা সমৃদ্ধশালী ধানের সবুজ গালিচা উজ্জ্বল লাল রঙের ছটা দ্বারা এখানে সেখানে বিভক্ত ছিল। যেটাকে পূর্ন প্ররিস্ফুটিত গো/মোহর এবং যথোপযুক্তভাবে “অরণ্যের শিখা” খেতাব দেয়া যায়। গ্রামাঞ্চলের আম ও নারকেল গাছ ফল দিয়ে ভরা ছিল। এমনকি রাস্তার পাশে ছোট কুকুর সাইজের ছাগল চড়ে বেড়ানো থেকেই বাংলার প্রকৃতির প্রাচুর্যের প্রমাণ পাওয়া যায়। “আপনি নারী থেকে পুরুষকে শুধুমাত্র একটা উপায়ে আলাদা করতে পারেন”, তারা আমাকে বলেছিল, “সব মাদি ছাগল কি গর্ভবতী হয়।”
তাদের প্রতিহিংসাকে হত্যা করো এবং পুড়িয়ে দাও
সমগ্র জগতের সর্বাধিক জনবহুল এলাকা – কুমিল্লা জেলায় জনসংখ্যার ঘনত্ব মাত্র ১,৯০০ বর্গ মাইল – শুধুমাত্র কোথাও কোন মানুষের দেখা নাই।
কয়েকদিন আগে ঢাকা শহরের অদ্ভুত ফাকা গলিতে আমি আমার সহচরকে জিজ্ঞাসা করলাম, “বাঙালিরা কোথায়”? তার উত্তর ছিল, “তারা গ্রামে চলে গেছে”। এখন গ্রামাঞ্চলেও কোন বাঙালি নেই। ঢাকার মত কুমিল্লা শহরও ব্যাপকভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। এবং পূর্বের নিশ্চুপ গ্রামগুলো রেখে লাক্ষ্মামের দিকে যেতে দশ মাইল রাস্তায়, আমি কৃষক দেখেছি যাদের সংখ্যা দুই হাতের আঙ্গুল দিয়ে গননা করা যায়।
সেখানে অবশ্য স্বয়ংক্রিয় রাইফেল হাতে শতশত খাকি পোষাক পরিহিত সৈন্যবাহিনী ছিল যাদের মুখে কোন হাসি ছিলনা। আদেশ অনুযায়ী, কখনো তারা হাতের রাইফেল ত্যাগ করেনি। শক্ত, সমর্থ-সুখী পুরুষরা ক্রমাগত রাস্তাগুলি পাহারা দিচ্ছে। যেখানে সেনাবাহিনী আছে, সেখানে আপনি বাঙালিদের খুঁজে পাবেন না।
রেডিও এবং সংবাদমাধ্যমে সামরিক আইনের আদেশ ক্রমাগত পুনরাবৃত্তি হচ্ছে, সন্ত্রাসী আইনের মধ্যে কেউ ধরা খেলে তার মৃত্যুদণ্ড ঘোষনা করছে। যদি কোন রাস্তা আটকানো হয় বা একটি সেতু ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস করা হয়, তবে জায়গাটির ১০০ গজের মধ্যে সকল বাড়ীঘর ধ্বংস করা হবে এবং তাদের বাসিন্দাদের বেধে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
শব্দটি যতটুকু নির্দেশ করে তার থেকে সেটার অনুশীলন আরও ভয়ংকর। “শাস্তিমূলক ব্যবস্থা” এমন কিছু বিষয় যা শুনলে বাঙালিরা কাঁপে।
এটার অর্থ কি বুঝায় আমরা সেটা দেখলাম ১৭ই আগষ্ট সকালে যখন হাজীগঞ্জ রওনা দিলাম, যে রাস্তাটি আলাদা হয়ে চাঁদপুরের দিকে গেছে। হাজিগঞ্জের কয়েক মাইল আগে, ঐ এলাকায় সক্রিয় থাকা বিদ্রোহীরা গতকাল রাতে ১৫ ফুটের সেতুটি ক্ষতিগ্রস্থ করেছে। মেজর রাঠোর (জি-২ অপারেশন) অনুযায়ী, তৎক্ষণাৎ একদল সৈন্য পাঠানো হলো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য। ক্ষতিগ্রস্ত সেতু থেকে এক মাইলের এক চতুর্থাংশ দূরত্ব পর্যন্ত দীর্ঘ ধোঁয়ার প্রবাহ সব দিকে দেখা যায়। এবং আমরা যখন সচেতনতার সাথে কাঠের সাঁকো, যা দ্রুত মেরামত করা হয়েছে, এর উপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছি, তখন গ্রাম্য বাড়িগুলাতে আগুন ধরা শুরু করলো।
গ্রামের পিছনে কিছু জওয়ান শুকনো নারকেল পাতা দিয়ে আগুন ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিচ্ছিল। তারা আগুন জ্বালানোর চমত্কার রসদ তৈরি করছিল এবং যা সাধারণত রান্নার জন্য ব্যবহৃত হয়। আমরা গ্রামের প্রবেশপথ ও নারকেল গাছের মধ্যে হামাগুড়ি দিতে থাকা একটি দেহ দেখতে পাই। রাস্তার অন্য দিকে ধানক্ষেতের পাশে আরেকটি গ্রামে আগুনের প্রমাণ পাওয়া যায় যা ডজন খানেক বাশের তৈরি কুড়েঘর পুড়িয়েছে। সেনাবাহিনী আসার আগে শত শত গ্রামবাসী পালিয়ে যায়। নারকেল গাছের মধ্যের মানুষটার মত অন্যরা ধীরে ধীরে চলে যায়।
আমরা চলতে থাকলাম, মেজর রাঠোর বলেন, “এটার জন্য তারা নিজেরা দায়ী”। আমি বললাম কিছু বিদ্রোহীদের কর্মকাণ্ডের জন্য নিরপরাধ মানুষের প্রতি এটা অবশ্যই অত্যন্ত ভয়াবহ প্রতিহিংসা। তিনি উত্তর দেন নি।
কয়েক ঘণ্টার পরে আমরা যখন আবার চাঁদপুর থেকে হাজিগঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলাম, তখন প্রথমবারের মত আমার সাথে “হত্যা ও অগ্নিসংযোগ মিশন” এর বর্বরতার পরিচয় ঘটে।
আমরা তখনও একটি গ্রীষ্মমন্ডলীয় ঝড়ের পরিণতির মধ্যে পড়েছিলাম, যেটি এলাকাটিতে বিকালে আঘাত হেনেছে। শহরের উঁচু মসজিদ টাওয়ারের উপর একটি ঘন মেঘের ভূতুড়ে ছায়া। হালকা গুঁড়ি গুড়ি বৃষ্টিতে ক্যাপ্টেন আজহার এবং আমাদের পেছনে থাকা জীপ গাড়ির চার জনের ইউনিফর্ম ভিজতে শুরু করেছে।
আমরা এক কোণায় গাড়ি থামালাম এবং মসজিদের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকটা ট্রাক দেখলাম। আমি গুনে দেখলাম সাতটা, সবগুলো যুদ্ধপোষাক পরিহিত জওয়ানে ভর্তি। সারির একেবারে সামনে একটা জীপ গাড়ি। তৃতীয় একজনের তত্ত্বাবধানে রাস্তার ওপাশে দুইজন মানুষ রাস্তায় সারিবাঁধা একশোর বেশি দোকানের একটির দরজা ভাঙার চেষ্টা করছিল। নকশা করা সেগুন কাঠের দরজাটি দুটি কুড়ালের আঘাতে প্রায় খুলতে শুরু করেছে, মেজর রাঠোর টয়োটা থামালো।
“এইটা কি করতেছ তুমি?”
তিনজনের যিনি তত্ত্বাবধানে ছিলেন, তিনি আমাদের দিকে তাকিয়ে দেখলেন।
“মিয়া,” (ভারি কণ্ঠে) তিনি চিৎকার করে বলেছিলেন, “আপনি কি মনে করেন আমরা কি করছি?”
কণ্ঠস্বর চিনতে পেরে রাঠোর জল-তরমুজ হাসি দিলেন। তিনি আমাকে জানিয়েছিলেন, এটা তার পুরনো বন্ধু “ইফতি” ছিল – ১২তম ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রাইফেলের মেজর ইফতিখার।
রাঠোর: “আমার ধারণা করছিলাম কেউ লুটপাট করছে”
ইফতিখার: “লুটপাট? না। আমরা হত্যা করছি আর জ্বালাচ্ছি।”
হাত নেড়ে দোকানে ঢুকার ইশারা করে বললেন, তিনি গুদাম ধ্বংস করতে যাচ্ছিলেন।
রাঠোর: “আপনি কতটা পেয়েছেন?”
ইফতিখার লাজুক ভঙ্গিতে হাসলেন।
রাঠোর: “আরে বলো। তুমি কতটা পেয়েছ?”
ইফতিখার: “মাত্র বারোটা এবং ঈশ্বরের জন্যই আমরা তাদের ধরতে পেরেছিলাম। আমরা হয়তো তাদের হারিয়ে ফেলতাম, যদি আমি আমার পেছন থেকে লোক না পাঠাতাম।”
মেজর রাঠোরের লাঠির মৃদু খোঁচা খেয়ে ইফতিখার তখন পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ননা করতে চললেন হবিগঞ্জে এতো খোঁজাখুঁজির পর কিভাবে তিনি শহরের প্রান্তে এক বাড়িতে লুকিয়ে থাকা ১২জন হিন্দুর খোঁজ পেলেন। এদের খতম করা হয়েছে। এখন মেজর ইফতেখার তার মিশনের দ্বিতীয় পর্বে: জ্বালানো।
দোকানের সামনের ছোট প্রদর্শনী বাক্সটি প্যাটেন্ট ওষুধ, কাশির সিরাপ, আমের জুস, ইমিটেশনের গহনা, রঙিন সূতার গুটি, এবং ইলাস্টিক অন্তর্বাসের প্যাকেটে ঠাসা ছিলো। ইফতিখার লাথি মেরে ফেলে দিলো, কাঠের জিনিসপত্র ভেঙে আগুন জ্বালানোর উপকরন বানালো। এরপর একটা তাক থেকে তিনি কিছু পাটের শপিং ব্যাগ নিয়ে প্রস্তুত করলেন। অন্যখান থেকে কিছু প্লাস্টিকের খেলনা নিলেন। রূমালের বাণ্ডিল এবং লাল কাপড়ের ছোট বোঝা মেঝেতে থাকা স্তুপে রাখলেন। ইফতিখার সেগুলোকে একসাথে গাদা করেন এবং আমাদের টয়োটাতে বসে থাকা এক জওয়ানের কাছ থেকে একটা (ম্যাচ) বক্স ধার করেন। কিন্তু জওয়ানের নিজস্ব চিন্তা ছিল। গাড়ি থেকে লাফ দিয়ে দৌড়ে সে দোকানের মধ্যে যায় এবং দোকানের নিচু ছাদ থেকে ঝুলতে থাকা একটা ছাতা নেওয়ার চেষ্টা করে। ইফতিখার তাকে বের হয়ে যেতে আদেশ করলো।
তাকে রূঢ়ভাবে স্মরণ করিয়ে দিল, লুটপাট আদেশ বিরুদ্ধ।
শীঘ্রই ইফতেখার আগুন জ্বালালেন। তিনি পুড়তে থাকা পাটের ব্যাগ ছুড়ে দিলেন দোকানের এক কোণে; কাপড়ের বোঝা দিলেন অন্য কোনায়। দোকান জ্বলজ্বল করে পুড়তে শুরু করলো। কয়েক মিনিটের মধ্যে আমরা শাটার দরজায় আগুনের চড়চড় শব্দ শুনতে পেলাম, যেহেতু দোকানটির বাম দিকে আগুন ছড়িয়ে পড়েছিল, তারপর পরেরটাতে।
এই সময়ে, অন্ধকার বাড়তে থাকায় রাঠোর উদ্বিগ্ন হতে শুরু করে। তাই আমরা চলতে থাকলাম।
পরের দিন মেজর ইফতেখারের সাথে দেখা করার পর তিনি ক্রুদ্ধভাবে আমাকে বলেছিলেন, আমি কেবলমাত্র ছয়টি বাড়ি পুড়িয়েছি “বৃষ্টি নাহলে আমি আরো অনেকগুলো পুড়াতে পারতাম।”
মুদাফারগঞ্জ থেকে কয়েক মাইল দূরে একটি গ্রামের কাছে পৌঁছে একজন লোককে মাটির দেওয়াল ঘেষে নিচু হয়ে আছে দেখে আমরা থামতে বাধ্য হলাম। একজন জওয়ান সতর্ক করে বললো এটি ফাউজি স্নাইপার হতে পারে। কিন্তু সাবধানে অনুসন্ধানের পর দেখা গেলো একটা সুন্দর যুবতি হিন্দু মেয়ে। সে তার মানুষের জন্য শান্তভাবে সেখানে বসে ছিল, ঈশ্বরই জানেন কার জন্য অপেক্ষা করছে সে। একজন জওয়ান ১০ বছর ধরে পূর্ব পাকিস্তানী রাইফেলের সাথে ছিল এবং হালকা বাঙলা বলতে পারে। তাকে বলা হলো মেয়েটাকে গ্রামে ফিরে যাওয়ার আদেশ দিতে। সে (মেয়েটা) উত্তরে কিছু বলার চেষ্টা করে, কিন্তু সে যেখানে ছিল সেখানেই বসে থাকল, কিন্তু তাকে দ্বিতীয়বার আদেশ দেওয়া হলো। সেখান থেকে চলে আসলাম, তখনো সে সেখানেই বসে ছিল। আমাকে জানানো হয়েছিল, ” তার যাওয়ার কোন জায়গা নেই – পরিবার নেই, বাড়ি নেই”।
হত্যা এবং পোড়ানো মিশনের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার মধ্যে মেজর ইফতেখার ছিলেন একজন। সেনাবাহিনীরা বিদ্রোহীদের সাফ হওয়ার পর তারা আসে সবকিছু উচ্ছেদ করতে এবং হিন্দু ও “দুষ্কৃতকারীদের” (বিদ্রোহীদের আনুষ্ঠানিক উপাধি) ধ্বংস করতে এবং সেনাবাহিনীদের গুলিবিদ্ধ থেকে শুরু করে সবকিছু পুড়য়ে ফেলতে তারা আসে।
এই রোগাপটকা পাঞ্জাবী কর্মকর্তা তার কাজ নিয়ে কথা বলতে পছন্দ করেন। গাড়িতে বসে ইফতারখারের সাথে সার্কিট হাউসে আরেকটি অনুষ্ঠানে যেতে যেতে তিনি তার সর্বশেষ কর্ম সম্পর্কে আমাকে জানিয়েছিলেন।
তিনি বলেন, “আমরা এক বৃদ্ধকে পেয়েছিলাম”। “বেজন্মাটা দাড়ি রেখেছিলো এবং একটি ধর্মপ্রাণ মুসলিম হবার ভাব নিচ্ছিল। এমনকি নিজের নাম বলেছিল আব্দুল মান্নান। কিন্তু আমরা তার মেডিকেল পরিক্ষা করলাম এবং সে ধরা খেয়ে গেলো।
ইফতিখার বলতে থাকলেন: “আমি তাকে তৎক্ষণাৎ শেষ করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আমার লোকজন আমাকে বলেছিল যে এই ধরনের বেজন্মার ঐখানে (লিঙ্গে) গুলি প্রাপ্য। তাই আমি তার অণ্ডকোষে একটা গুলি করলাম, তারপর পাকস্থলি বরাবর একটা, তারপর মাথায় গুলি করে আমি তাকে শেষ করলাম”।
যখন আমি মেজর ইফতেখারকে ছেড়ে দিয়েছিলাম তখন তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উত্তর দিকে অগ্রসর হন। তার মিশন: অন্য একটি হত্যা এবং পুড়ানো।
সন্ত্রাস আচ্ছন্ন হয়ে বাঙালিরা দুটি প্রতিক্রিয়ার যেকোন একটি বেঁছে নেয়। যারা পালিয়ে যেতে পারে, মনে হয় উধাও হয়ে গেছে। সেনাবাহিনী আসার সাথে সাথে সমগ্র শহরগুলি পরিত্যক্ত হয়েছে। যারা কৃপণ্ঠিত দাসত্ব থেকে পালাতে পারে না, এটা কেবল তাদের দুর্দশার সাথে অপমান যোগ করে।
চাঁদপুর প্রথম উদাহরণ।
অতীতে মেঘনা নদীর এই প্রধান নদী বন্দরটি তার সমৃদ্ধ ব্যবসার জন্য এবং আনন্দোচ্ছল জীবনের জন্য সুপরিচিত ছিল। রাতে হাজার হাজার ছোট ছোট নৌকা নদীর তীরে নোঙর ফেলতো এবং (নৌকার) প্রজ্বলিত আলোয় এটাকে কল্পনার দেশ মনে হতো। ১৮ই এপ্রিলে, চাঁদপুরে অচলাবস্থা ছিল। কোন মানুষ নেই, কোন নৌকা নেই। জনসংখ্যার মাত্র এক শতাংশই রয়ে গেছে। বিশেষ করে হিন্দুরা পালিয়ে গিয়েছিল যারা মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক।
অদ্ভুত ব্যাপার হলো প্রতিটা বাড়ি, দোকান এবং ছাদে তারা হাজার হাজার উড়ন্ত পাকিস্তানি পতাকা রেখে পালিয়েছে। ব্যাপারটা ছিল যেন কোন রকম ভিড় ছাড়াই জাতীয় দিবস উদযাপন হচ্ছে। এটা ভুতুড়ে পরিবেশকে আরো ভুতুড়ে বানিয়ে দিচ্ছিলো।
প্রসঙ্গক্রমে পতাকাগুলো ছিল বীমার মত।
যেকোনভাবে একটা কথা চারদিকে প্রচার হয়েছিল যে পাকিস্তানি পতাকা বিহীন যেকোন ঘরবাড়ী শত্রুভাবাপন্ন এবং ফলস্বরুপ সেটাকে ধ্বংস করা হবে। পাকিস্তানি পতাকাগুলি কীভাবে তৈরি হয়েছিল, সেটা কোন ব্যাপার না যতক্ষণ পর্যন্ত তাতে অর্ধচন্দ্র এবং তারকা সজ্জিত থাকছে। সুতরাং পতাকা গুলো ছিলো বিভিন্ন আকারের এবং রঙের। কোন কোনটাতে প্রথাগত সবুজ রঙের বদলে নীল রঙের ব্যাকগ্রাউন্ড ছিলো। স্পষ্টতই তারা নিখুঁত নীল রঙের বাংলাদেশি পতাকার জন্য ব্যবহৃত কাপড়ে অতি দ্রুত এসব জিনিস যোগ করেছে। সত্যিকার অর্থেই সবুজের থেকে নীল রঙের পাকিস্তানি পতাকা বেশি ছিল। চাঁদপুরের মত একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে হাজীগঞ্জ, মুদাফারগঞ্জ, কসবা, ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেও; সমস্ত প্রেতাত্মাময় শহরগুলি পতাকা শোভিত।
একটি ‘সামরিক মহড়া’ এবং একটি বুদ্ধিদীপ্ত চক্ষু ইশারা
লাক্ষ্মাম ছিল অন্য প্রতিক্রিয়ার একটি উদাহরণ: অবনমন
বিদ্রোহীদের সাফ হওয়ার পর সকালে আমি যখন শহরে ঢুকেছিলাম, তখন আমি সেখানে সেনাবাহিনী এবং আক্ষরিকভাবে হাজার হাজার পাকিস্তানি পতাকা ছাড়া কিছুই দেখিনি। সেখানে দায়িত্বরত মেজর পুলিশ স্টেশনে একটা ক্যাম্প করেছিলো, এবং মেজর রাঠোর আমাকে এবং আমার এক সহকর্মী, যিনি একজন পাকিস্তানি টিভি ক্যামেরাম্যান, কে সেখানে নিয়ে গেছিল, “স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাওয়ার” উপরে একটা প্রপাগান্ডা ফিল্ম তৈরি করার জন্য – যাতে অন্তহীনভাবে প্রতিদিন স্বাগত প্যারেড এবং “শান্তি বৈঠক” সম্প্রচারিত হবে।
আমি বিস্ময়ের সাথে দেখি উনি কিভাবে এতোসব সামলান, কিন্তু মেজর বলেন এটা কোন ব্যাপারই না। “নাটক করার জন্য যথেস্ট সংখ্যক বেজন্মা এখনো বাকি আছে। আমাকে ২0 মিনিট সময় দিন”।
৩৯তম বেলুচের লেফটেন্যান্ট জাভেদকে কিছু জনতা গ্রেফতার করার কাজে নিয়োগ করা হয়েছিল। তিনি একজন দাড়িওয়ালা বয়স্ক ব্যক্তিকে ডাকেন যাকে দৃশ্যত জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আনা হয়েছিল। লোকটা তার নাম বলেছিলো মওলানা সাঈদ মো সাইদুল হক, জোর গলায় বলেন তিনি একজন দৃঢ়চিত্ত মুসলিম লীগ ছিলেন, আওয়ামী লীগের নয়। (১৯৪৭ সালে স্বাধীন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে মুসলিম লীগ নেতৃত্ব দিয়েছিলো) তিনি খুব আগ্রহী ছিলেন। তিনি জাভেদ বলেন, “২0 মিনিটের মধ্যেই আমি অন্তত ৬০ জন লোক ধরে দিতে পারবো”। “তবে আপনি যদি আমাকে দুই ঘণ্টা সময় দেন তবে আমি ২00 নিয়ে আসব”।
মওলানা সাঈদুল হক তাঁর বক্তব্যের মতই ছিলেন। আমরা সতেজকারক নারকেল দুধ কম খাচ্ছিলাম যা মেজর অনেক চিন্তাভাবনা করে সরবরাহ করেছিলেন যখন তিনি দূরে একটা চিৎকার শুনলেন। তারা শ্লোগান দিচ্ছিলো, “পাকিস্তান জিন্দাবাদ!” “পাকিস্তান সেনাবাহিনী জিন্দাবাদ!” “মুসলিম লীগ জিন্দাবাদ”। (জিন্দাবাদ হলো “দীর্ঘ জীবনের” উর্দু প্রতিশব্দ)। পরে তারা দেখতে পেল, প্রায় ৫০ জন বয়স্ক ও নিম্নবিত্ত পুরুষ এবং হাঁটুর সমান উচ্চতার শিশু সবাই পাকিস্তানি পতাকা উড়াচ্ছিল এবং সর্বোচ্চ জোর গলায় চিৎকার করতেছিল। লেফটেন্যান্ট জাভেদ আমাকে একটি বুদ্ধিদীপ্ত চোখ টিপুনি দিলেন।
কয়েক মিনিটের মধ্যে “সামরিক মহড়া” একটা “জনসভায়” পরিনত হলো যেখানে পরিবর্তন অনুযায়ী একটি পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেম এবং অতিদ্রুত ভাবি বক্তার সংখ্যা বেড়ে গেলো।
জনাব মাহবুব-উর-রহমান সেনাবাহিনীকে স্বাগত জানানোর জন্য বলা হলো। তিনি নিজেকে এন. এফ. কলেজের “ইংরেজী ও আরবি” বিভাগের অধ্যাপক হিসাবে পরিচয় করিয়ে দেন, যিনি ইতিহাসের জন্যেও চেষ্টা করেছিলেন এবং মহান মুসলিম লীগ পার্টির আজীবন সদস্য ছিলেন।”
মাহবুব-উর-রাহমান জবাব দিলেন, ভূমিকা শেষ। তিনি বলেন “পাঞ্জাবি ও বাঙালি,” “পাকিস্তানের জন্য একতাবদ্ধ এবং আমাদের নিজস্ব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি ছিল। কিন্তু আমরা হিন্দু ও আওয়ামী লীগের দ্বারা সন্ত্রাসী হয়েছি এবং বিভ্রান্ত হয়েছি। এখন আমরা ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাই যে পাঞ্জাবি সৈন্যরা আমাদের বাঁচিয়েছে। তারা বিশ্বের সেরা সৈনিক এবং মানবতার নায়ক। আমরা আমাদের অন্তরের অন্তস্থল থেকে তাদের ভালোবাসি ও সম্মান করি”। এবং তাই অন্তহীনভাবে একই শিরার মধ্যে।
“সভা’র” পরে আমি মেজরকে জিজ্ঞেস করি, তিনি বক্তৃতা সম্পর্কে কি চিন্তা করেছেন। তিনি বলেছিলেন, “উদ্দেশ্য সাধন করো”। “কিন্তু আমি এই বেজন্মাকে বিশ্বাস করি না। আমি তাকে আমার তালিকায় উঠাবো।”
পূর্ব বাংলার অন্তর্বেদনার শেষ নেই। সম্ভবত সবচেয়ে খারাপ এখনো আসেনি। সম্পূর্ণ “সাফ” না করা পর্যন্ত সেনাবাহিনী এরূপ কর্মকান্ড চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখন পর্যন্ত শুধুমাত্র অর্ধেক কাজ সম্পন্ন হয়েছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৯তম ও ১৬তম বিভাগকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পাঠানো হয়েছে বিদ্রোহী ও হিন্দুদের চিহ্নিত করতে। এটি পাকিস্তান সম্পদের একটা দেশের জন্য এটা একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং যৌক্তিক কৌশল ছিল। পশ্চিম থেকে পূর্বে ২৫,000 এরও বেশি লোক পাঠানো হয়। ২৮শে মার্চে, দুটি বিভাগকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আসার নোটিস দেওয়া হয়েছিল। তাদের খারিয়ান এবং মুলতান থেকে ট্রেনে করে করাচীতে আনা হয়েছিল। শুধুমাত্র হালকা বিছানা এবং যুদ্ধসরঞ্জামের বোঁচকা (তাদের সরঞ্জাম সমুদ্র দিয়ে আসছিলো) নিয়ে সৈন্যরা পিয়াইএ (জাতীয় এয়ারলাইন) এর মাধ্যমে ঢাকাতে চলে এসেছিল। সাতটি বোয়িং বিমানের বহর আন্তর্জাতিক এবং স্বদেশী রুট দিয়ে এসেছিল এবং ক্রমাগত সেলনের মাধ্যমে ১৪ দিনের জন্য দীর্ঘ যাত্রা করেছিল। বিমান বাহিনীর কিছু পরিবহন বিমান সাহায্য করেছিল।
১৪তম ডিভিশন থেকে ধার করা সরঞ্জাম দিয়ে সৈন্যরা তৎক্ষণাৎ কাজ শুরু করেছিল তারপর থেকে সেটা পূর্ব কমান্ড গঠন করে। কুমিল্লা থেকে চালানো ৯তম বিভাগ বিদ্রোহীদের আন্দোলন এবং তাদের সরবরাহ বন্ধ করতে পূর্ব সীমান্ত বন্ধ করার আদেশ দিয়েছিল। ১৬তম বিভাগের কাজ ছিল যশোরের সদর দফতরের সাথে মিলে প্রদেশের পশ্চিমাঞ্চলে অনুরূপ কাজ করা। মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে তারা তাদের কার্য সম্পন্ন করে। বিদ্রোহীদের যারা ভারতে পালাতে পারেনি – ইস্পাত ও আগুনে বন্ধী হয়, দুই বাহিনী বিভাগ নিষ্ঠুর চিরুনি অভিযান শুরু করেছে। এটা নিঃসন্দেহে বোঝা যাচ্ছে যে, সীমান্ত অঞ্চলের অভিজ্ঞতা এখন মধ্যবর্তী অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়বে। এটি আরও বেদনাদায়ক হতে পারে। মানুষের পালানোর কোন জায়গা থাকবেনা।
২0শে এপ্রিল ৯তম ডিভিশনের পুষ্প-প্রেমী জি-আই লেফটেন্যান্ট-কর্নেল বেগ ধারণা করেছিলেন যে চিরুনি অভিযান চলবে জুন মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত, যাতে প্রায় দুই মাস লেগে যাবে। কিন্তু এই পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে মনে হচ্ছে। গেরিলা কৌশল ব্যবহার করে বিদ্রোহী বাহিনীদের পরাজিত করা যতটা সহজ ভেবেছিল সেনাবাহিনী, ততটা সহজ হচ্ছেনা। বিচ্ছিন্ন এবং দৃশ্যত অস্পৃশ্য, বিদ্রোহীরা সড়ক ও রেলপথের নিয়মিত ধ্বংসযজ্ঞের কারণে অনেক জায়গায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে ফাঁদে ফেলে রেখেছে, যেগুলো ছাড়া সেনাবাহিনী চলতে পারে না। একজনের জন্য ৯ম বিভাগ সময়সূচী নিয়ে হতাশ ছিল। এখন মৌসুম বর্ষার তিন মাস সামরিক অপারেশন বন্ধ করার হুমকি দিয়েছে।
বর্ষাকালের জন্য, মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে পাকিস্তান সরকার চীনের কাছ থেকে নয়টি কামানবাহী নৌকা পান। আরো আসার কথা আছে। বিপুল পরিমানে গুলি বহনকারী ৮0 টনের এই কামানবাহী নৌকা এই সময়টাতে বিমান বাহিনী এবং কামান বাহিনীর কিছু দায়িত্ব নিতে পারবে, যেগুলো বৃষ্টির সময় কার্যকারী না। শত শত দেশবিদেশ তাদের সহায়তা করবে, যার জন্য লিখিতভাবে অনুরোধ জানানো হয়েছে, এবং সেগুলো সামরিক কাজে ব্যবহারের জন্য নৌকার বাইরের দিকে মোটর দিয়ে সংযুক্ত করা হয়েছে। বিদ্রোহীদের খোঁজে সেনাবাহিনী জলের দিকে যেতে চায়।
পূর্ববাংলার উপনিবেশীকরণ
বণ্টন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার কারণে দুর্ভিক্ষের স্পষ্ট সম্ভাবনাও রয়েছে। সাধারণভাবে, পূর্ব পাকিস্তানের ২৩টি জেলার ১৭টিতে খাদ্যের সংকট এবং চাল ও গমের ব্যাপক আমদানির মাধ্যমে সরবরাহ করতে হবে। গৃহযুদ্ধের কারণে এই বছরে সেটা সম্ভব হবে না। ছয়টি প্রধান সেতু এবং হাজার হাজার ছোটখাটো সেতু ধ্বংস করা হয়েছে, অনেক জায়গায় রাস্তাগুলি দুরূহ। রেলওয়ে ব্যবস্থা একইভাবে বিঘ্নিত হয়েছে, যদিও সরকার দাবি করছে অবস্থা “প্রায় স্বাভাবিক”।
চট্টগ্রাম ও উত্তর বন্দরের মধ্যে সড়ক ও রেলপথগুলি পুরোপুরি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে বিদ্রোহীদের কার্যক্রমে যারা ৭ই মে পর্যন্ত ফেনীর একটি গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ও রেল জংশন দখল করে রেখেছিল। এই ধ্বংসযজ্ঞের কারণে মজুদ খাদ্য স্থানান্তর হতে পারছেনা। স্বাভাবিক অবস্থায় চট্টগ্রাম থেকে দেশের অভ্যন্তরে ১৫ শতাংশ খাদ্যশস্য যেত নৌকায় করে। বাকি ৮৫ শতাংশ সড়ক ও রেলপথে যেতো। এমনকি নদী চলাচল ১০০ ভাগ উন্নত করলেও চট্টগ্রামের গুদামে ৭০ শতাংশেরও বেশি খাদ্যশস্যের অবমূল্যায়ন হবে।
অন্য দুটি কারণ যোগ করা আবশ্যক। একটা হলো দুর্ভিক্ষের পূর্বাভাস পেয়েছে এমন কিছু লোকজন প্রচুর পরিমাণে খাদ্যশস্য গোপনে মজুদ করেছে। এটি সংকটপূর্ন অবস্থা আরো অসীম কঠিন করে তুলেছে। অন্যটি হলো আসন্ন দুর্ভিক্ষের বিপদ প্রকাশ্যে স্বীকার করতে পাকিস্তান সরকার অপরাগ। পূর্ব বাংলার সামরিক গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান ১৮ই এপ্রিল একটি রেডিও সম্প্রচারে স্বীকার করেন যে, তিনি খাদ্য সরবরাহের ব্যাপারে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। তারপর থেকে পুরো সরকারিভাবে খাদ্যশস্য সঙ্কটের ব্যাপারটা চেপে যাওয়া হচ্ছে। কারণ এটি একটি দুর্ভিক্ষ, এর আগে যেমন সাইক্লোন হয়েছিল, সেকারণে বিদেশী সাহায্য আসার সম্ভবনা আছে এবং সেজন্য বিতরণ পদ্ধতি পরিদর্শন করতে বাইরে থেকে লোক আসবে। যেটা বহিঃবিশ্ব থেকে এই সাম্প্রদায়িক সহিংসতা লুকিয়ে রাখা অসম্ভব করে তুলবে। তাই যতদিন না সাফ করা শেষ হচ্ছে, ক্ষুধার্তরা ধুকে ধুকে মরুক।
শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে এই সমস্যা নিয়ে আলোচনা করার সময় কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের চেয়ারম্যান জনাব কার্নি স্পষ্টস্বরে বলেন, “তাদের আভ্যন্তরীণ নাশকতা দুর্ভিক্ষের সৃষ্টি করেছে”। তাই তাদের মরতে দাও। তখন সম্ভবত বাঙালির হুশ হবে”।
সামরিক সরকারের পূর্ববাংলা নীতি এতটাই পরস্পরবিরোধী এবং আত্মবিধ্বংসী যে এটির অর্থ পাকিস্তানের শাসনকারীরা কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারেনা। বল প্রয়োগের মাধ্যমে প্রাথমিক ক্ষতি সংঘটিত করার পর, এইক্ষেত্রে সরকার একগুঁয়েভাবে মুর্খের মত আচারন করছে।
এই বিচারের মধ্যে ভাসাভাসা যুক্তি আছে।
একদিকে, এটা সত্য যে সন্ত্রাসের রাজত্বের কোনও অবকাশ নেই। নিশ্চিতভাবেই, পূর্ববাংলায় পুঁজিবাজারের নীতি জোরদার করা হচ্ছে। এটি প্রতিদিনই সরকারের জন্য হাজার হাজার নতুন শত্রু তৈরি করছে এবং পাকিস্তানের দুই অংশের পৃথক আরো দ্বিগুণ মাত্রায় সুনির্দিষ্ট করে তুলছে।
অন্যদিকে, কোনো সরকারের অজানা থাকতে পারেনা যে, এই নীতি অবশ্যই ব্যর্থ হবে। (পূর্ব পাকিস্তানে অধিক সংখ্যক লোককে অনির্দিষ্টকালের জন্য ধরে রাখার মত যথেষ্ট পশ্চিম পাকিস্তানি নেই।) কঠিন প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক কারণে এবং বাহ্যিক বিশেষ করে আমেরিকার উন্নয়ন সহায়তার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনার জন্য যত দ্রুত সম্ভব রাজনৈতিক নিষ্পত্তির প্রয়োজন। ২৫শে জুন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এর প্রেস কনফারেন্সে তিনি প্রস্তাব দেন যে, এই বিষয়গুলির শক্তি তিনি স্বীকার করেন: এবং তিনি বলেন যে জুনের মাঝামাঝি সময়ে তিনি প্রতিনিধিত্বমূলক সরকারের জন্য তার পরিকল্পনা ঘোষণা করবেন।
এই সব থেকে বোঝা যায় যে, দেশের ২৪ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সঙ্কটকে সামলাতে পাকিস্তানের সামরিক সরকার বিপর্যস্তভাবে বিপরীত দিকে ছুটছে।
এটি একটি স্থুলভাবে দেখানো দৃশ্য। এটি যৌক্তিক শোনাচ্ছে। কিন্তু এটা কি সত্য?
আমার নিজের মতামত হলো এটা সত্য নয়। কারণ পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা কি বলছে এবং পূর্বদেশে তারা কী করছে সেটা দেখার প্রথম দুর্ভাগ্যজনক সৌভাগ্য আমার হয়েছিল।
আমি মনে করি যে প্রকৃতপক্ষে সরকারের পূর্ববাংলা নীতিতে কোন দ্বন্দ্ব নেই। পূর্ববাংলা উপনিবেশ করা হচ্ছে।
এটা আমার কোন খামখেয়ালি মতামত নয়। ঘটনাগুলো নিজেরাই একথা বলছে।
পূর্ববাংলায় বিচ্ছিন্নতাবাদ সৃষ্টিই হলো সেনাবাহিনীর প্রথম বিবেচ্য বিষয় এবং এটাই সর্বকালের ধ্বংসাত্মক ঘটনা। ২৫শে মার্চের পর থেকে সরকার পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান উভয়দিকেই এই ধারা অব্যাহত রেখেছে। এই সিদ্ধান্তটি সামরিক শাসকদের দ্বারা নিঃসন্দেহে গৃহীত হয়েছে এবং তারা খুব ঠান্ডামাথায় এসব করে যাচ্ছে।
যতদিন দাঙ্গা অব্যাহত থাকবে, ততদিন পূর্ববাংলায় কোনও অর্থপূর্ণ বা কার্যকর রাজনৈতিক সমাধান সম্ভব নয়।
গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হল: হত্যা কি থামবে?
১৬ই এপ্রিল কুমিল্লায় আমাদের প্রথম বৈঠকে, ৯ম ডিভিশনের কমান্ডিং অফিসার মেজর জেনারেল শওকত রাজা কতৃক আমাকে সেনাবাহিনীর উত্তর দেওয়া হয়।
তিনি বলেন, “আপনাকে অবশ্যই নিশ্চিত হতে হবে”, “আমরা এমন কোন কঠোর ও ব্যয়বহুল অপারেশনের দায়িত্বগ্রহন করছিনা যা কিনা লোকবল এবং অর্থ উভয় দিক দিয়েই ব্যায়বহুল। আমরা একটা কাজের দায়িত্ব নিয়েছি। আমরা এটি শেষ করতে যাচ্ছি, রাজনীতিবিদদের কাছে অর্ধেকেরও বেশি নয় যাতে তারা আবারো তালগোল পাকাতে পারে। সেনাবাহিনী এভাবে প্রতি তিন বা চার বছর পরপর ফিরে আসতে পারবে না। তাদের আরো গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে। আমি আপনাদের আশ্বস্ত করছি যে, আমরা কাজটা যেভাবে করছি যাতে এই ধরনের অপারেশনের জন্য আর কখনো প্রয়োজন হবে না”।
মেজর-জেনারেল শওকত রাজা হলো রণক্ষেত্রে থাকা তিন বিভাগীয় কমান্ডারদের মধ্যে একজন। তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে আছেন। তাকে তার টুপির মাধ্যমে কথা বলতে দেওয়া হয়নি।
উল্লেখযোগ্যভাবে, পূর্ব পাকিস্তানে আমার ১০ দিনের মধ্যে আমি প্রত্যেক সামরিক অফিসারের সাথে কথা বলে দেখেছি জেনারেল শওকত রাজার ধারণাগুলি প্রতিধ্বনিত হয়েছিল। এবং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জানেন যে, যারা সৈন্যদলকে মাটিতে নেতৃত্ব দিচ্ছে তারা হলো পাকিস্তানের গন্তব্যের কার্যত সালিসকারী।
সামরিক অপারেশনের মধ্যদিয়েই সেনাবাহিনীর একক মনোভাবাপন্নতা ধরা পড়ে। যেকোন মানদন্ডে এটা একটি বিরাট ঝুঁকি। এটি এমন কিছু নয় যেটা কোন দুঃখজনক পরিণতি ছাড়াই চালু এবং বন্ধ করা যেতে পারে।
সেনাবাহিনী অবস্থান করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ
সেনাবাহিনী ইতিমধ্যে মৃত ও আহত নিয়ে মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছেছে। গোপনভাবে এটি ঢাকাতে বলা হয়েছিল যে আরও অনেক কর্মকর্তারা নিহত হয়েছেন এবং পূর্ববাংলায় হতাহতদের তালিকা ইতিমধ্যেই ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বরে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সীমা অতিক্রম করেছে। সেনাবাহিনী নিশ্চিতভাবেই ছলাকলামূলক রাজনৈতিক বিবেচনার জন্য এই “বলিদান” এর হিসাব রাখবেনা, যা অতীতে খুব অর্থহীন বলে প্রমাণিত হয়েছে।
এই পর্যায়ে কার্যক্রম বন্ধ করা অসমর্থনযোগ্য এই সিদ্ধান্ত নেবে সামরিক বাহিনী এবং সৈন্যরা। এতে বাঙালি বিদ্রোহীদের সাথে আরো বেশি ঝামেলা হবে। অবিচ্ছিন্ন ঘৃণা উভয় পক্ষের উপর প্রদর্শন করা হয়েছে।
এখানে কোন যুদ্ধবিরতি বা আপোষে নিষ্পত্তি হতে পারবে না; কেবলমাত্র পূর্ন বিজয় অথবা পূর্ন পরাজয়। সময় এখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পাশে, বিচ্ছিন্ন, অস্বাভাবিক অবৈধ অস্ত্রধারী বিদ্রোহী গোষ্ঠীর পাশে নয়। অন্য পরিস্থিতিতে, যেমন একটি বর্ধিত দ্বন্দ্ব যা অন্য ক্ষমতা হিসেবে, অবশ্যই দৃশ্য পরিবর্তন করতে পারে। কিন্তু আজকের দিনটি যেমন দাঁড়িয়ে আছে তেমনি পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর সন্দেহ নেই যে এটি অবশেষে তার উদ্দেশ্য অর্জন করবে। এ কারণে হত্যাকাণ্ডগুলি দৃঢ়ভাবে গ্রহণ করা হয়েছে।
পূর্ববাংলার অপারেশনে ইতিমধ্যেই বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়েছে এবং এর অব্যাহত খরচ সরকারের সংকল্পের সাক্ষ্য দিচ্ছে। এমন অলঙ্ঘনীয় পদ্ধতিতে এই তহবিল ভরা হয়েছে সেটা স্পষ্ট করে দেয় যে সামরিক শাসনবিন্যাস, যারা হিসাব করে শক্তি প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এই ব্যয়কে একটি প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ হিসাবে গ্রহণ করেছে। অযথা ২৫ হাজার সৈন্যকে পূর্ববাংলায় উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে যা একটি সাহসী ও ব্যয়বহুল অনুশীলন। ৯ম এবং ১৬তম, এই দুটি বিভাগ পশ্চিম পাকিস্তানে সামরিক জনবল গঠন করেছে। এখন ব্যয়বহুলভাবে নতুন নিয়োগ দিয়ে তাদের সেখানে প্রতিস্থাপিত করা হয়েছে।
চীনারা সরঞ্জাম দিয়ে সাহায্য করেছে যা কারাকোরাম মহাসড়কটি ডুবিয়ে দিচ্ছে। বন্যা কমে যাচ্ছে এরকম কিছু প্রমাণ আছে: সম্ভবত চীনারা পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের প্রতি তাদের প্রতিশ্রুতির বিষয়ে বিকল্প অবস্থান নিয়েছে। কিন্তু পাকিস্তান সরকার ইউরোপীয় অস্ত্র সরবরাহকারীদের কাছে বিদেশী বিনিময় পিপার নীচে থেকে নগদ ১0 লাখ ডলারেরও বেশি অর্থ ব্যায়েও দ্বিধা করছেনা।
ঢাকা, রাওয়ালপিন্ডি ও করাচির উর্ধতন সামরিক কর্মকর্তাদের সাথে কথোপকথনে এটা নিশ্চিত হয় যে তারা পূর্ববাংলার অপারেশনের দ্রুত সমাপ্তিতে এই সমস্যাটির সমাধান দেখতে পাচ্ছে, তা প্রত্যাহারের শর্তে নয়। সেজন্য এই উদ্দেশ্যে যে টাকা প্রয়োজন তা অন্যান্য সমস্ত সরকারি ব্যয় থেকে অগ্রাধিকার পাবে। উন্নয়ন কার্যত থেমে গেছে।
এক বাক্যে, পূর্ববাংলার অপারেশন পরিত্যাগ করার জন্য সরকার খুব বেশিদূর এগোয়নি, যদি এটি আন্তরিকভাবে রাজনৈতিক সমাধান চায় তবে তা করতে হবে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বাঘের পিঠে চড়ে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু তিনি সেখানে আরোহণ করতে হিসাব করে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
তাই সেনাবাহিনী পিছাবেনা। পূর্ব কমিশন সদরদপ্তরে পূর্ববাংলার জন্য সরকারের নীতি সম্পর্কে আমাকে বলা হয়েছিল। এর তিনটি বিষয়বস্তু রয়েছে: –
(1) বাঙালিরা নিজেদের “অবিশ্বস্ত” প্রমাণ করেছে এবং পশ্চিম পাকিস্তানিদের দ্বারা শাসিত হওয়া উচিত;
(২) সঠিক ইসলামী পথে বাঙালিদেরকে পুনরায় শিক্ষিত করা হবে। “জনসাধারণের ইসলামীকরণ” – এই অর্থহীন কথার মুল অভিব্যক্তি হল-বৈষম্যমূলক প্রবণতাগুলি দূর করা এবং পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে একটি শক্তিশালী ধর্মীয় বন্ধন প্রদান করা:
(3) মেরে এবং পালাতে বাধ্য করে হিন্দুদের নির্মূল করা হয়, তখন তাদের সম্পত্তি সুযোগসুবিধা বঞ্চিত মধ্যবিত্ত মুসলমানদের উপর জয়লাভ করতে একটি সোনার গাজর হিসাবে ব্যবহার করা হবে। এটি ভবিষ্যতে প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক কাঠামো স্থাপনের জন্য ভিত্তি প্রদান করবে।
এই নীতি চরম অসমতার সঙ্গে পশ্চাদ্ধাবন করা হচ্ছে।
বিদ্রোহের কারণেই, এটি আনুষ্ঠানিকভাবে আইন জারি করা হয়েছে যে প্রতিরক্ষা বাহিনীতে পরবর্তি কোন নিয়োগ বাঙালিদের সুযোগ দেওয়া হবেনা। সিনিয়র বিমান বাহিনী এবং নৌবাহিনীর কর্মকর্তাদের, যারা কোনও ভাবে জড়িত ছিলনা, “সতর্কতা হিসাবে” অ-সংবেদনশীল পদে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। বাঙালি যোদ্ধা পাইলট যাদের মধ্যে বিমান বাহিনীর কয়েকজন সদস্য ছিল, তাদের অপমান করা হয় এবং বিমান চালাতে হয়না এমন দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এমনকি পিআইএ এয়ার ক্রু যারা দেশের দুই অংশের মধ্যে কাজ করে, সেখানেও বাঙালিদের ছেঁকে বাদ দেওয়া হয়েছে।
বিদ্রোহের পর থেকে পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসকে স্থগিত রাখা হয়েছে যা একসময় প্রায় একটি বাঙালি আধাসামরিক বাহিনী ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানে বিহারি এবং স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়োগের মাধ্যমে একটি নতুন বাহিনী সিভিল ডিফেন্স ফোর্স গঠন করা হয়েছে। বাঙালিদের পরিবর্তে বিহারিরাও পুলিশের জন্য মৌলিক উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। পশ্চিম পাকিস্তানি বাহিনী ও সেনা বাহিনী সেকেন্ডারী অফিসারগণ কর্তৃক তাদের তত্ত্বাবধান করা হচ্ছে। এপ্রিলের শেষে চাঁদপুরে পুলিশের নতুন সুপারিনটেনডেন্ট ছিলেন সামরিক পুলিশ প্রধান।
শতশত পশ্চিম পাকিস্তানি সরকারের সরকারি কর্মচারী, ডাক্তার, এবং রেডিও, টেলিভিশন, টেলিগ্রাফ এবং টেলিফোন সেবার প্রযুক্তিবিদদের ইতোমধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে পাঠানো হয়েছে। আরো অনেককে এক ধাপ অথবা দুই ধাপ প্রমোশনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে উৎসাহিত করা হচ্ছে। কিন্তু যখন চাইবে বাধ্যতামূলক স্থানান্তরিত হতে হবে। রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া সম্প্রতি একটি আদেশ জারি করেছেন যে তারা বেসামরিক কর্মকর্তাদের তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে পাকিস্তানে যে কোন অংশে হস্তান্তর করতে পারে।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ‘চিহ্নিত’
আমাকে বলা হয়েছিল যে ভবিষ্যতে পূর্ববাংলা এবং জেলা প্রশাসকের সকল কমিশনার হবে পশ্চিম পাকিস্তানের বিহারি অথবা বেসামরিক কর্মকর্তা। আওয়ামী লীগ বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের সাথে জেলার জেলা প্রশাসকগণ খুব ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত বলে উল্লেখ করা হয়। কিছু ক্ষেত্রে তাদের ধরা হয়েছিল এবং গুলি করে মারা হয়েছিল যেমন কুমিল্লার ডেপুটি কমিশনার। এই বিশেষ কর্মকর্তা ২0শে মার্চ সামরিক বাহিনীর ক্রোধের মুখে পড়েন যখন তিনি “শেখ মুজিবুর রহমানের চিঠি” ছাড়া পেট্রল ও খাদ্য সরবরাহের আবেদন প্রত্যাখ্যান করেন।
পূর্ববাংলার বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলির উপরেও সরকার ক্ষেপে ওঠেন। তারা ষড়যন্ত্র তৈরির উত্তম জায়গা হিসাবে বিবেচিত হয় এবং তাদের “চিহ্নিত” করা হচ্ছে।
অনেক অধ্যাপক পালিয়ে গেছে। কিছু গুলি করে মারা হয়েছে। তাদের পরিবর্তে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নতুন নিয়োগ দেওয়া হবে।
বেসামরিক ও বিদেশী সংস্থার সংবেদনশীল পদগুলি থেকেও বাঙালি কর্মকর্তাদের ছাটাই করা হচ্ছে। বর্তমানে সবাইকে ব্যাপকভাবে নজরে রাখা হচ্ছে।
প্রশাসন যতটা চাচ্ছে উপনিবেশকরণ প্রক্রিয়া স্পষ্টভাবে তার অর্ধেকও কাজ করছেনা। কুমিল্লার সামরিক আইন প্রশাসক মেজর আঘা এই বিষয়ে আমাকে অনেক স্পষ্ট প্রমাণ দিয়েছিলেন। স্থানীয় বাঙালি নির্বাহী প্রকৌশলীকে দিয়ে বিদ্রোহীদের দ্বারা ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া সেতু এবং রাস্তাগুলি মেরামত করাতে তার কিছু সমস্যা হচ্ছে। এই সমস্যাটি লাল ফিতায় বাধা পড়েছে এবং সেতুগুলি মেরামত বিহীন পড়ে আছে। আঘা অবশ্যই এর কারণ জানত। তিনি আমাকে বলেন, “আপনি তাদের থেকে কাজ আশা করতে পারেন না”, “যখন আপনি তাদের হত্যা করছেন এবং তাদের দেশ ধ্বংস করছেন। অন্ততপক্ষে এটাই তাদের দৃষ্টিভঙ্গি, এবং আমরা এর মাশুল গুনছি।”
বেলুচ রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন দুরানি যিনি কুমিল্লার বিমানবন্দরে কোম্পানি পাহারার দায়িত্বে ছিলেন, এই সমস্যা নিরসনে তার নিজস্ব পদ্ধতি ছিল। কন্ট্রোল টাওয়ারের দায়িত্বে থাকা বাঙালিদের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “আমি তাদের বলেছি”, “যে সন্দেহজনক কিছু করছে এমন যে কাওকে আমি গুলি করবো”। দুররানি তার কথা রেখেছিলেন। একটি বাঙালিকে গুলি করা হয়েছিল যে কয়েক ঘণ্টার আগে বিমানবন্দরে গিয়েছিল। তাকে আমাকে বলা হয়েছিল, “বিদ্রোহী হতে পারে”। দুররানির আরো একটি খ্যাতির দাবী দার। বিমানবন্দরের চারপাশের গ্রামগুলো সাফ করার সময় তিনি ব্যক্তিগতভাবে “৬০ জন পুরুষ” মারার জন্য দায়ী ছিলেন।
পূর্বাঞ্চলে উপনিবেশকরণের কঠিন বাস্তবতা লজ্জাহীন জানালার পর্দা দিয়ে গোপন রাখা হচ্ছে। কয়েক সপ্তাহ ধরে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান পূর্ব পাকিস্তানে তারা যা করছে সেজন্য রাজনৈতিক সহায়তা পাবার চেষ্টা করছে। ফলাফল ঠিক সন্তোষজনক হচ্ছেনা। এখন পর্যন্ত আসন্ন সহায়তা এসেছে ঢাকার বাঙালি আইনজীবী মৌলভী ফরিদ আহমদ, ফজলুল কাদের চৌধুরী এবং জামাত ইসলামের অধ্যাপক গোলাম আযম, এর মত লোকদের কাছ থেকে। গত ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে যাদের সবাইকেই পরাজিত করা হয়েছিল।
এই উদ্দেশ্যে আবির্ভূত একমাত্র বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব প্রদেশের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মওদুদ নূরুল আমিন এবং জাতীয় পরিষদের নির্বাচিত দুইজন আওয়ামী লীগের একজন ছিলেন। সে এখন তার সত্তর দশকে। কিন্তু নূরুল আমিন খুব সতর্কতা অবলম্বন করেন নি। এপর্যন্ত তার দুইটা প্রকাশ্য সাক্ষাত্কারেই তিনি “ভারতীয় হস্তক্ষেপ” নিয়ে উদ্বিগ্ন।
যারা “সহযোগিতা” করে, বাঙালিরা তাদের অবজ্ঞা করে। ফরিদ আহমদ ও ফজলুল কাদির চৌধুরী বেদনাদায়ক এই বিষয়ে জ্ঞাত। ফরিদ আহমদ তার জানালা বন্ধ করে রাখছে এবং যাদের যাচাই বাছাই করা হয় এবং সামনের দরজার ছিদ্র দিয়ে চেনা যায় তাদেরকেই কেবল ঘরে ঢুকতে দেওয়া হয়।
একচেটিয়া ভোঁতা পদ্ধতির মাধ্যমে সরকার আওয়ামী লীগ থেকে ৩১ জনকে পেতে সক্ষম হয়েছেন যারা জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত হয়েছেন। তাদেরকে “প্রতিনিধি সরকার” প্রতিষ্ঠাপন উপলক্ষ্যে পরিবার থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় ঢাকায় রাখা হচ্ছে। কিন্তু স্পষ্টতই এখন তারা অন্যকারো নয় বরং নিজেদেরই প্রতিনিধিত্ব করছে।
দর্জি আব্দুল বারি ২৪ বছর বয়সী ছিলেন যিনি ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছিলেন। অর্থাৎ পাকিস্তানের সমবয়সী। সেনাবাহিনী অবশ্যই শক্তি প্রয়োগ করে দেশকে একত্রে রাখতে পারে। কিন্তু পূর্ববাংলাতে এটি যা করেছে তাতে ১৯৪৭ সালে তারা দুটি সমান অংশে একটি মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যে স্বপ্ন দেখেছিল তা এখন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। পশ্চিমবঙ্গের পাঞ্জাবীরা এবং পূর্ববঙ্গের বাঙালিরা এখন নিজেদের একটি সমজাতির সহজাত নাগরিক মনে করবে এরকম সামান্যতম সম্ভাবনা আসতেও দীর্ঘদিন লেগে যাবে। বাঙালিদের জন্য, ভবিষ্যৎ এখন নিরানন্দ: বিজয়ীদের কাছে একটি উপনিবেশের অসুখকর নতিস্বীকার।