You dont have javascript enabled! Please enable it!

অপারেশন ঈগল শুরু

আকাশপথে স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের সরণ শুরু হয় আমার যােগ্য চীফ অব স্টাফ কর্নেল ইকবাল সিং এমসি কর্তৃক তার গােয়েন্দা প্রতিবেদনগুলি পাঠানাের পর  গােয়েন্দা প্রতিবেদনগুলি ছিল সরেজমিন প্রাথমিক নিরীক্ষা এবং মিযােরামের রাজধানী আইযাওয়ালে আটক কতিপয় বন্দি মিযােকে জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে। কর্নেল ইকবাল সিং ইতিপূর্বে এই বিক্ষুব্ধ এলাকায় একটা পদাতিক ব্রিগেড কমান্ড করেছিলেন এবং তাতে প্রভূত ভাল কাজ দেখিয়ে ছিলেন এই ভূখণ্ড সম্বন্ধে এবং মিযাে বিদ্রোহীরা। সাধারণত যেসব কৌশল অবলম্বন করে সে সম্বন্ধে তার ভাল জানাশােনা ছিল এই অফিসারের যােগ্যতা ও পরিস্থিতির মূল্যায়ন সম্বন্ধে আমার প্রচুর আস্থা ছিল। তিনি যে ব্রিগেডিয়ার ব্যাংক লাভ করেননি তার একমাত্র কারণ ছিল এই যে তিনি খুব বেশি সরব এবং সৎ ছিলেন তাঁর ঠিক উপরের অফিসারটির সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্ব ছিল এবং তিনি জুনিয়র হওয়ায় তাঁকে হারতে হয়েছিল আমার সৌভাগ্য যে এমন একজন। নির্ভরযােগ্য অফিসারকে আমি চীফ অব স্টাফ হিশাবে পেয়েছিলাম আকাশপথে সরে আসার পর মােটরযানে শিলচর-আইযাওয়াল-লাংলেহ সড়ক ধরে আমাদের অগ্রযাত্রা চলল দুর্ভাগ্যবশত লাংলেহ ও ডেমাগিরির মধ্যকার সড়কের ওপর চংস পাড়ি দেওয়ার সেতুগুলি ভাঙা ছিল। এই ডেমাগিরিকে আমি আমার সদর দফতর এবং প্রধান ঘাটি হিশাবে বাছাই করেছিলাম। উলি-খিত সেতুগলি ভাঙা থাকায় সব অস্ত্রশস্ত্র ও মজুদ-সামগ্রী জওয়ানদের বহন কতে হল। অনেক রসদ এবং প্রধান ওয়্যারলেস স্টেশন লাংলেহ-তে ফেলে রেখে আসা হল এই আশায় যে সেতুগুলির মেরামত হয়ে যাওয়ার পর সেগুলি ডেমাগিরিতে নিয়ে যাওয়া হবে। ডেমাগিরি ও লাংলেহ -এর মধ্যে রাত-দিন বিস্তর যাওয়া-আসা চলল। তাতে এই রকম ধারণার সৃষ্টি হল যে পূর্ব দিক থেকে চট্টগ্রামে হামলা চালানাের জন্য বিশাল এক বাহিনী সমবেত হচ্ছে ২ হাজার ফুট উঁচু সির্তে-লাং বলে পরিচিত শৈলশিরা বরাবর ডেমাগিরি অবস্থিত শৈলশিরাটি উত্তর-দক্ষিণ বরাবর, বাংলাদেশ সীমান্তের সমান্তরাল এই শৈলশিরায় আরও তিনটা পােস্ট আমি বাছাই করেছিলাম। ডেমাগিরির উত্তরে মারপাড়া এবং দক্ষিণে বর্নাপানসুরি ও জারুলছড়ি। ডেমাগিরিতে আমি এসএফএফ কলামগুলিকে কেন্দ্রীভূত করতে চেয়েছিলাম বাংলাদেশের ভিতরে আঘাত হানার জন্য।

এই পােস্টগুলিতে লম্বা সময় ধরে মজুত-সামগ্রী এবং জোগান আকাশ থেকে ফেলা হচ্ছিল এই বিভ্রান্তি বিভ্রান্তি আরও জোরদার করা হল ডেমাগিরি এবং উত্তর ও দক্ষিণে অন্য পােস্টগুলির মধ্যে মানুষ এবং জিনিশপত্রের সার্বক্ষণিক চলাফেরার মাধ্যমে। এছাড়া আমার নিজস্ব রেকি চলল  প্রকাশ্য দিবালােকে মেজর জেনারেলের উর্দিতে বৈঠায় টানা নৌকায় চড়ে আমি কর্ণফুলি নদী ধরে চললাম, শত শত মিযাের পূর্ণ দৃষ্টির সামনে দিয়ে আমি গেলাম ডেমাগিরি শহরের বেসামরিক কর্মকর্তাদের সাথে সাক্ষাৎ করতে। ডেমাগিরি হেলিপ্যাডে আমাদের একমাত্র হেলিকপ্টারটি রাখা হল। এসবে বিভ্রান্তিটা দৃঢ় হল যে। প্রায় এক ডিডিশন সৈন্য ইতিমধ্যে ডেমাগিরিতে কেন্দ্রীভূত হয়েছে। একজন বাঙালি ন্যাশনাল অ্যাসেমবি- সদস্য, এমএনএ, যিনি আমাদের সঙ্গে এসেছিলেন, অনেক মানুষকে বললেন যে শুধু ডেমাগিরিতে তিনি নিজে ৮ হাজার সৈন্য গণনা করেছেন, অথচ সেখানে কখনও আমাদের ৪শ’ লােকের বেশি ছিল না। রাঙামাটি শহরটা ছিল প্রথম বড় ধরনের লক্ষ্যস্থান কিন্তু সেখানে পৌছার একমাত্র পথ কর্ণফুলি নদী এবং প্রয়ােজন একঝাক নৌকা তিনটি পাহাড়ি রেঞ্জের মধ্যে এঁকেবেঁকে এই নদী ঐ শহরটা পর্যন্ত গিয়েছে পুরা শহরটায় শক্ত-সমর্থ পাঠান এবং কৌশলী মিযােদের মােতায়েন রাখা হয়েছে, তাদের সমর্থন দিচ্ছে সকল স্থানীয় চাকমা উপজাতি। রাঙামাটির প্রায় অর্ধেক দূরত্বে বর্কল শহরটিতে বিশেষ রকমের শক্ত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা স্থাপিত হয়েছে সবচেয়ে উচু উচু অবস্থানে যা গভীরভাবে খনিত বাংকারসমূহ দ্বারা সুরক্ষিত  বৰ্কল-সুভলং এলাকাটি শক্রর জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এই রেখা বরাবর যে কোনও আঘাতের প্রতি শত্ৰু স্বাভাবিকভাবেই অত্যন্ত সংবেদনশীল। আমরা শিগগিরই দেখলাম বকলকে আরও শক্তিশালী করা হল এবং বেশ অনেকটা নতুন। শক্তি উত্তরে এসে কর্ণফুলি নদীর উভয় পাড়ের শৈলশিরায় অবস্থান নিল আমরা নদীতে চলা নৌকা সংগ্রহ করতে শুরু করলাম । কিন্তু শুধু ছােট ছােট নৌকা। পাওয়া গেল। তার এক একটিতে চার থেকে ছয় জনের বেশি মানুষ চড়তে পারবে না। এর প্রায় সবই দুইজন মানুষের মাছ ধরা নৌকা ছাড়া আর কিছু নয়।

রণকৌশল

শুরু থেকেই স্পষ্ট হয়ে গেল যে শক্রর প্রতিরক্ষামূলক অবস্থানগুলি যেসব স্থানে গড়ে তােলা হয়েছিল এবং তাদের সরঞ্জামাদির মজুতের যে প্রাচুর্য ছিল তাতে সেগুলি হালকা। অস্ত্রে সজ্জিত গেরিলাদের দ্বারা স্থানচ্যুত করা যাবে না। তাদের জন্য দরকার ছিল ভারী মর্টার অথবা আর্টিলারি এবং আকাশযানের সমর্থনে শক্তিশালী কমান্ডাে হানা । আকস্মিকতা, গেরিলাদের সর্বোত্তম অস্ত্র, ভালরকম সুফল আনত কিন্তু এই পরিস্থিতিতে আকস্মিকতা অর্জন করা যেত অপ্রত্যাশিত সচলতার মাধ্যমে এবং তা নির্ভর করছিল। এক ঝাক হেলিকপ্টারের প্রাপ্যতার ওপর আমাদের ছিল একটা মাত্র হেলিকপ্টার, হতাহতদের সরিয়ে নেওয়ার জন্য। অতএব আমাদের সচলতা ছিল দারুণভাবে সীমাবদ্ধ। আমি মিশ্রিত কমান্ডাে-কাম-গেরিলা রণকৌশল অবলম্বনের সিদ্ধান্তে আসলাম এবং একই সঙ্গে দুটি কলাম ব্যবহারের পরিকল্পনা করলাম যার একটা অ্যানভিল অর্থাৎ কামারের নেহাই -এর মতাে এবং দ্বিতীয়টা হাতুড়ির মতাে কাজ করবে। কম সচল অ্যানভিল ফোর্স সাধারণভাবে কর্ণফুলি নদীর গতিপথ অনুসরণ করে চলবে এবং চূড়ান্ত সচল হ্যামার ফোর্স আঘাত হানবে এবং শত্রু আউটপােস্টগুলিকে অ্যানভিলের উপরে গুড়িয়ে দেবে বলে, সুভলং -এ এবং রাঙামাটিতে। তারপর তখন বিদ্যমান পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে একটা নতুন রণনীতি (strategy) অবলম্বন করা যাবে। এর নাম আমি দিয়েছিলাম অ্যানভিল হ্যামার টাক্টক্স। অনভিলকে বলা হল সাকিং অ্যানভিল বা শুষে নেওয়ায় রত অ্যানভিল, কারণ আমি চেয়েছিলাম এই অ্যানভিল অবস্থানের আশেপাশে ব্যাপকভাবে গেরিলা অ্যামবুশ চলতে থাকবে যা এর দিকে এবং এর দিক থেকে সরতে থাকা যে কোনও দলকে নিজেদের দিকে তাড়িয়ে এনে ধ্বংস করে ফেলবে। এটা সযত্নে প্রতি ফীল্ড কমান্ডারের কাছে ব্যাখ্যা করা হল। দুর্ভাগ্য যে তাদের। মধ্যে কতক ছিল আর্মি থেকে নতুন পােস্টেড এবং তারা গেরিলা যুদ্ধের সূক্ষ জটিলতাগুলি অনুধাবন করতে পারেনি। তবে তারা সাধ্যমতাে করেছেন এবং কিছু মহার্ঘ। ভুলের মাধ্যমে প্রয়ােজনীয় শিক্ষা লাভ করেছিলেন। এক্ষেত্রে প্রথমেই প্রয়ােজন ছিল নদীর ওপরে একটা যথেষ্ট বড় সেতুবন্ধ থেকে কর্ণফুলি নদী পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশের অঞ্চলে নেমে সেখান থেকে আক্রমণকারী কমান্ডোদেরকে চালিত করা। একটা আক্রমণের একেবারে শুরুতে শক্রর বাধাযুক্ত নদী পাড়ি দেওয়ার প্রচেষ্টা হচ্ছে চরম বিপজ্জনক কাজ, সকল সৈনিকই এ ধরনের ব্যাপার এড়াতে চাইবে, কিন্তু আমাদের কোনও বিকল্প ছিল না।

নদী পার হতেই হবে এবং অন্য পাড়ে শত্রুর সেনা সমাবেশ রয়েছে বলে খবর ছিল । ঘন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে বহু মাইলের পথ অতিক্রম করিয়ে ফোর্সকে আক্রমণের জন্য। তৈরিতে কিছু নির্দিষ্ট পরিমাণ বিলম্ব অবশ্যম্ভাবী ছিল। সময় বাঁচানাের জন্য আমি সিদ্ধান্ত নিলাম আমার ফোর্স সদর দফতরকে নদী পেরুনাের একটা সেতুবন্ধ প্রস্তুত করার কাজ দেব । আক্রমণ হানার জন্য সেখানে অর্থাৎ ডেমাগিরিতে একটি মাত্র কোম্পানি উপস্থিত ছিল। আমরা ১৯টা স্থানীয় নৌকা ব্যবহারের জন্য পেলাম। ডেমাগিরিতে সংগ্রহকারীরা এগুলি অর্থের বিনিময়ে সংগ্রহ করে আমাদেরকে দিতে পেরেছিল। সৌভাগ্যক্রমে নদীর অপর তীর থেকে শক্ররা সরে গিয়েছিল; আমাদের সেটা অজানাই ছিল। নিঃশব্দে ও কোনও বাধা ছাড়া নদী পার হওয়া গেল। সৈন্যরা ছড়িয়ে গিয়ে আক্রমণকারী কোম্পানিগুলির সমবেত ও সংগঠিত হওয়ার জন্য জায়গা করে দিল যদিও আমি আক্রমণকারী গ্রুপের সঙ্গে গিয়েছিলাম, তবু কোম্পানি কমান্ডারকে আমি স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযােগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম এই কোম্পানি কমান্ডার সেতুবন্ধ হস্তগত করার কঠিন কাজটা খুব ভালভাবে করেছিল তাতে করে মনােবল অনেক উঁচুতে ওঠে গিয়েছিল । সদ্যধরা মাছ ভাজা হল এবং নাস্তায় মগ ভর্তি গরম চা -এর সাথে তা পরিবেশন করা হল বাংলাদেশ অঞ্চলে কমান্ডারদেরকে আমি আমার আদেশাবলি জানিয়ে দিলাম। একটা ফোর্স যুদ্ধে তার একেবারে প্রথম অ্যাকশনে চালিত হবে এ সম্ভাবনায় প্রত্যেকে উত্তেজনা বােধ করছিল। কমান্ডাররা নিজ নিজ কমান্ডকে কাজ বুঝিয়ে দিল এবং প্রত্যেকে ঝটপট তার নিজ কাজের জন্য হেঁটে চলে গেল। শুরু করানাে এবং আদেশনির্দেশ প্রদানের সেশনটা একদম যথাযথ হয়েছে বলে মনে হল উচ্চ আশায় ভরপুর হয়ে আমি নৌকা বেয়ে ফিরে এসে আমার বাংক -এ বসে শান্তিতে দুপুরের খাবার খেলাম। তারপর আমি হেলিকপ্টারে করে দক্ষিণ কলামের সদর দফতরে গিয়ে আক্রমণ সংক্রান্ত আদেশ-নির্দেশ দিলাম এবং আরও উত্তরে উড়ে গেলাম লেফটেন্যান্ট-কর্নেল এনহুইগকে তুলে আনার জন্য এক রাত্রিকালীন সৈন্য চালনায় পা হড়কে তার হাঁটু ভেঙে গিয়েছিল এবং তাতে করে তিনি দারুণ যন্ত্রণা ভােগ করছিলেন। এই দুঃসাহসী অফিসারের ওপর আমার অনেক উচ্চ আশা ছিল। আমি তাকে নিজে পছন্দ করে বেছে নিয়েছিলাম। ফোর্সের কিছু দুরূহতম কাজের জন্য। তিনি রেকি সম্পন্ন করে চমৎকার মূল্যায়ন দিয়েছিলেন কিন্তু নিয়তি তাকে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে পদক অর্জন করতে দিল না। আমি নিশ্চিত ছিলাম তিনি তা অর্জন করবেন। এই অফিসারকে ভারতের একটা চিকিৎসা ঘাঁটিতে স্থানান্তরিত করতে হল। 

সূত্র : ফ্যান্টমস অব চিটাগং-দি ফিফথ আর্মি ইন বাংলাদেশ – মেজর জেনারেল (অব.) এস এস উবান

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!