ডেইলি টেলিগ্রাফ, জুলাই ৯, ১৯৭১
শান্ত পাকিস্তান সীমান্তে- যুদ্ধের উত্তেজনা বৃদ্ধি
ক্লেয়ার হলিংওয়ার্থ – বেনাপোল, পূর্ব পাকিস্তান
পাকিস্তানি ও ভারতীয় সৈন্যরা পূর্ব পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে ১৫০০ মাইল বরাবর সীমান্ত পারাপার হবার সকল মূল রাস্তার নো-ম্যান্স ল্যান্ড এর ৫ থেকে ৫০ গজ দূরত্বে পরস্পর বিপজ্জনকভাবে মুখোমুখি অবস্থান করছে ।
গত কয়েক সপ্তাহ ধরে, প্রতিদিন ছোট অস্ত্র,দুই-ইঞ্চি মর্টার মাঝেমধ্যে আর্টিলারি বিক্ষিপ্ত গোলাগুলির কারণে সীমান্তে উত্তেজনার তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা স্পষ্টত যুদ্ধের মত অবস্থার মধ্যে রয়েছে।
তারা যাতে কোন ছোট-খাট কিন্তু সংঘবদ্ধ হামলাকারী বাহিনীর আক্রমন থেকে পাঁচ মিনিটের জন্য নিজেদেরকে রক্ষা করতে পারে সেজন্য তারা নিজেদের বাংকার খনন, প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান এবং সীমান্তে যতদূর সম্ভব বলয় তৈরি করছে।
ঘন ঘন সতর্কতা জারি- কিছু বাস্তব কিন্তু অন্যগুলো ভূয়া। যখন সবাইকে জলাবদ্ধ পরিখার মধ্যে ঢুকতে বাধ্য করা হয়, তখন এই বিপজ্জনক যুদ্ধ খেলায় উত্তেজনা বৃদ্ধি করে যা একটি অপ্রত্যাশিত ঘটনাকে সহজেই বাস্তব জিনিসে রূপ নিতে পারে।
উভয় পক্ষের প্রেস এবং রেডিওতে প্রতিদিন ক্রমবর্ধমানভাবে একে-অপরকে “শত্রু” বলে ঘৃণা ছড়ানো হচ্ছে।
অনেক স্থানে, যখন পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ২৫ মার্চ এ দায়িত্ব গ্রহণ করে, তখন বাংলাদেশকে সমর্থন জানিয়ে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস দ্বারা দখলকৃত স্থায়ী সীমান্ত পোস্টগুলো পূর্ণদখল করতে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে ইতিমধ্যে মারাত্নক যুদ্ধ করতে হয়েছে ।
এই সাবেক সীমান্ত বাহিনী তাদের অস্ত্র এবং চারদিকে স্থায়ীভাবে নির্মিত পজিশনগুলোকে তাদের সাবেক কমরেডদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য তাক করে রেখেছে।
উত্তেজনা অব্যাহত রয়েছে
তারা এখনও ভারতীয় সীমান্তে কার্যক্রম চালাচ্ছে , তাদের কে জমির ঘাস পরিষ্কার করে তারা ওখানে আক্রমনের পজিশন তৈরি করতে দেখা যায়। সময়ে সময়ে তারা তাদের প্রফুল্লতা এবং উত্তেজনা বজায় রাখার জন্য উন্মুক্ত গোলাবর্ষণ করছে, এতে এটা নিশ্চিত যে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সীমান্ত থেকে সেনা প্রত্যাহার করতে পারছে না।
ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস ও ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্যরাও ভারতের একটু ভিতরে বাংলাদেশী গেরিলাদের শিবিরে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে।
ছয় সপ্তাহ আগে, আমি ভারতের ভিতরে তিন-লেনের ট্রাঙ্ক রোডের মাত্র কয়েকশ গজ দূরে, পাকিস্তানী দিক থেকে ছোড়া ছয় বা সাতটি মর্টার বোমা পড়তে দেখেছি এবং লক্ষ্যনীয় বিষয় যে, ভারতীয় সেনাবাহিনী ছদ্মবেশী বাংকার এবং আত্মরক্ষামূলক অবস্থান নির্মাণ করেছিল।
বাংলাদেশ গেরিলারা প্রতি রাতে সীমান্ত অতিক্রম করে পরিত্যক্ত গ্রামে সেনাবাহিনীর টহলের সময় বোমা ছোড়ে , টাইম বোমা পেতে আসে এবং ফাঁড়িতে হ্যান্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। গেরিলারা সীমান্ত এলাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্য ক্রমবর্ধমান হুমকি হয়ে উঠছে, যেখানে প্রায় সব টেলিফোন এবং বৈদ্যুতিক তারের লাইন কেটে দেয়া হয়েছে।
প্রাণবন্ত চোরাচালান
স্বাভাবিকভাবেই উভয় পক্ষই জানে যে অন্যরা কি করছে, এজেন্টরা প্রতিদিন অনেকবার পার হয় এতে বোঝা যায়, এখনও চোরাচালান ব্যবসা প্রাণবন্ত রয়েছে।
ভারতীয় অংশ উদ্বাস্তুদের দ্বারা পরিপূর্ণ এবং সেনাবাহিনীর কাছে পাকিস্তান বাহিনীকে একটি সম্পূর্ণরূপে মানব বসতিহীন গ্রামাঞ্চলে পরিচালনা করা সহজ ছিল না, গ্রাম বা এমনকি শহরে যেখানে দুই-এক জন খোড়াঁ বা একজন অন্ধ লোক রয়ে গিয়েছে।
এটা খুবই বিস্ময়কর যে উদ্বাস্তুরা তাদের জন্য পাকিস্তান কর্তৃপক্ষের তৈরী করা অভ্যর্থনা কেন্দ্রে উল্লেখযোগ্য হারে ফিরছে না। প্রতি রাতে কয়েকটি পরিবার পাঁচ বা ছয়টি “অননুমোদিত রুট” দিয়ে এখানে অনুপ্রবেশ করে এবং তাদেরকে সেনাবাহিনী ধরে নিয়ে যায়।
তাদেরকে ট্রানজিট ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয় যেখানে তাদেরকে খাবার ও কলেরা প্রতিষেধক টিকা দেয়া হয় এবং তারা যে “পাকিস্তান থেকে” তাদের এই দাবির প্রক্ষিতে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
নাগরিক কর্তৃপক্ষ এবং প্রকৃতপক্ষে উভয় পক্ষের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা সীমান্ত সংঘাত নিয়ে বাস্তবে খুবই উদ্বিগ্ন।
ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা এবং ব্যাটালিয়ন এবং কোম্পানী কমান্ডারদের মারমুখো মনোভাব প্রদর্শনের পরিপ্রক্ষিতে জাতিসংঘের শান্তি রক্ষার বাহিনীর উপস্থিতিই সবচেয়ে ভালো সমাধান ।
ভারতীয় রাজ্য উদ্বাস্তুতে পরিপূর্ণ
ত্রিপুরা থেকে পিটার গিল
পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীদের স্রোত ক্ষুদ্র ভারতীয় রাজ্য ত্রিপুরায় প্রবেশ করছে, উদ্বিগ্ন কর্মকর্তারা বহির্বিশ্বের সাথে তাদের অপর্যাপ্ত সরবরাহ রুট সংরক্ষণ করার জন্য প্রাণপ্রণে চেষ্টা চালাচ্ছেন।
বাঙালি কৃষক, তাদের অধিকাংশই মুসলমান এবং কয়েকজন শেল এবং মর্টার বোমার বীভৎত ক্ষত নিয়ে, প্রতিদিন গড়ে কমপক্ষে ১০,০০০ হারে ত্রিপুরায় পালাচ্ছে।
ত্রিপুরা কর্তৃপক্ষকে খরা মৌসুমে ১,৬০০,০০০ বাসিন্দা জনসংখ্যার খাদ্যের পাশাপাশি এখন সম্পূর্ণরূপে কর্মহীন অতিরিক্ত ১ মিলিয়ন শরণার্থীকে সামাল দিতে হচ্ছে ।
গত কয়েক দিন ধরে পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে ত্রিপুরার ৫৬০ মাইল সীমান্ত বরাবর সীমান্ত এলাকায় পরিদর্শনের সময়, ভারতীয় গ্রামগুলোকে মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যে কান্নাভেজা, ঘরহারা পাকিস্তানি কৃষকদের স্রোত এ পরিপূর্ণ হয়ে যেতে দেখেছি।
প্রানঘাতী গোলাগুলি
তারা পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং একটি স্বাধীন পূর্ববাংলা জন্য লড়াইরত মুক্তি ফৌজ গেরিলাদের মধ্যে একটি ভয়াবহ গোলাগুলির মধ্যে পড়েছিল। এক তরুণ চাষী যে ভারতীয় সীমান্ত পোস্ট এর কাছাকাছি দেবিপুর অতিক্রম করেছেন তিনি সেদিন তার গ্রামে সংগ্রহ করা চারটি মর্টার বোমার টুকরা দেখিয়েছেন।
আমরা যখন আরেকটি সীমান্ত গ্রাম অতিক্রম করছিলাম ১২ বছরের একটি মেয়ে আমাদের জীপকে ধাক্কা দিয়ে সামনে এগিয়ে দিল। শিহরিত হয়ে কেপেঁ ওঠলাম যে, তার খোঁড়া এবং মোটামুটিভাবে ব্যান্ডেজ করা হাতে দিনের শুরুতে একটি শেল স্প্লিন্টার এর আঘাত লেগেছিল। এখনো ক্ষত থেকে রক্ত ক্ষরণ হচ্ছে।
এই ঘটনাগুলোর ফলে ত্রিপুরার সরকারি কর্মকর্তারা পূর্ব পাকিস্তানের স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসার সম্ভাবনা নিয়ে স্পষ্টত সন্দেহপ্রবণ হয়ে ওঠেছেন ।
এখন পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের গেরিলা শত্রুদের বিরুদ্ধে একটি পূর্ণ মাপের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। এবং গেরিলাদের আশ্রয়ের সন্দেহভাজন গ্রাম ব্যাপক প্রতিহিংসার শিকার হচ্ছে ফলে হিন্দু ও মুসলমান উভয়ই পালাতে করতে বাধ্য হচ্ছে।
পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধের পরিব্যাপ্তিতে শরণার্থী সংখ্যার হিসাব নিকাশ ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই করে থাকেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনী গ্রামে দূরপাল্লার কামান, মানববিংধ্বসী “বায়ু বিস্ফোরক” শেল, মর্টার বোমা ও মেশিনগান মোতায়েন করেছে।
একবার ভারতীয় এলাকায়, আগরতলার কাছাকাছি শরণার্থীরা গেরিলাদের সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততা স্বীকার করেছে, বাজারঘাটে শরণার্থী শিবির এ একজন গ্রামবাসী বলল, “এখন আমরা সবাই মুক্তি ফৌজ” ।
এখানে সরবরাহ পরিস্থিতি খুব শীঘ্রই সংকটপূর্ণ হয়ে ওঠবে, সবকিছু কলকাতা থেকে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান সীমান্ত ঘুরে ১০০০ মাইল পাড়ি দিয়ে আসবে।
ব্যক্তিগতভাবে, ত্রিপুরার কর্মকর্তারা তাদের রাজ্যের দিকে ভারতীয় কেন্দ্রীয় সরকারের অসহযোগিতামূলক মনোভাবের তিব্র সমালোচনা করেছে । তারা অভিযোগ করেছেন অস্ট্রেলিয়ান এয়ার ফোর্স এর খাদ্য ও সংস্থানের সরাসরি ত্রানবাহী বিমানকে অযৌক্তিকভাবে কলকাতায় পুনরায় ফিরিয়ে নেয়া হয়েছে।
৮ মিলিয়ন গৃহহীন: পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যা
ঢাকা থেকে তারবার্তায় আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক: ভারতের চেয়ে আরও বেশি “উদ্বাস্তু” পূর্ব পাকিস্তানের ভেতরে রয়েছে। স্বভাবতই মানুষ বড় বড় দলে হিন্দু-মুসলিম একসংঙ্গে দেশের বিভিন্ন এলাকা পাড়ি দিচ্ছে, সবসময় ভীতি নিয়ে মাঝেমধ্যে দিশাহীনভাবে কিন্তু কোন অনধিকৃত গ্রামে আশ্রয় খুজতে।
মেজর জেনারেল ফরমান আলী, পূর্ব পাকিস্তানে বেসামরিক বিষয়ক দায়িত্বে রয়েছেন, স্বীকার করেছেন যে এই সাত বা আট মিলিয়ন বাস্তুচ্যুত মানুষকে নিয়ন্ত্রন করা অত্যন্ত কঠিন ।
অনেক ছোটখাট দল প্রধান সড়কের দোকান, পেট্রল পাম্প, বাজার স্টল, এবং অন্যান্য স্থাপনার দখল নিতে চেষ্টা করছে এবং এটি আরও বড় সমস্যা তৈরি করছে।