You dont have javascript enabled! Please enable it!

ব্যাঘ্রদের পােষ মানানাে

অক্টোবর ১৯৬২ -এর চৈনিক আক্রমণের পর খুব শীঘ্রই দুর্গম উত্তরের পাহাড়ের উপজাতীয়দের মধ্য থেকে স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্স গড়ে তােলা হয়েছিল। শ্রী বিএন মলি-ক তার দি চাইনী বিট্রেয়াল-মাই ইয়ারস উইথ নেহরু নামের বই -এ এই ফোর্সের কথা উল্লেখ করেছেন। মূলত এই সীমান্ত-জনদের কাজ ছিল চীনারা যদি কখনও আবার ভারতের ভূখণ্ডে অনুপ্রবেশ করে তাহলে তাদের লাইনের পিছনে থেকে গেরিলা যুদ্ধ করে চীনাদের বিরুদ্ধে গােটা লড়াই -এ সাহায্য করা। এ লােকগুলি সবাই দৈহিকভাবে অত্যন্ত শক্ত-সমর্থ এবং একেবারেই ভয়শূন্য পুনর্জন্মে বিশ্বাসী এই লােকগুলি মৃত্যুকে বিবেচনা করে ভবিষ্যতের এক শ্রেয়তর জীবনের সিং-দরােজা হিশাবে। এটা তাদেরকে প্রায়ই বেপরােয়া করে তােলে। তাদের তীক্ষ দৃষ্টিশক্তি এবং বিপদের প্রতি সহজ-প্রবৃত্তিজাত প্রতিক্রিয়ার কারণে তারা গেরিলা প্রশিক্ষণের জন্য রিক্রুট হিসাবে অনন্য সাধারণ  তারা আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ভালবাসে এবং শিগগিরই অব্যর্থ লক্ষ্যভেদী হয়ে ওঠে। একটা জিনিশ তারা খুব অপছন্দ করে তা হচ্ছে তাদের অস্ত্র থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া। তারা তাদের হালকা মেশিনগান সঙ্গে নিয়ে ঘুমাতে পছন্দ করে, এবং সেগুলি রেগুলার কোয়ার্টার-গার্ডে নিরাপদ জিম্মায় রাখার ব্যাপারটা তারা বুঝতেই পারে না। এমনকি অনেকে ইউনিট কোয়ার্টার-গার্ডে অস্ত্র জমা রাখতে বললে অপমানিত বােধ করতে পারে এবং সন্দেহ করতে শুরু করতে পারে যে কর্তৃপক্ষ হয়তাে তাদেরকে বিশ্বাস করছে না। তাদের ফুসফুসের ক্ষমতা বিপুল, তার সাথে তাদের অসাধারণ দৈহিক শ্রম সহ্য করার ক্ষমতা যােগ হওয়ায় সমুদ্রপৃষ্ঠের থেকে অনেক উচ্চ স্থানে লড়াই করার জন্য তারা আদর্শ যােদ্ধা হয়ে ওঠে। তাদের একেবারে স্বাধীনচেতা স্বভাব এবং বেশ ভাল রকম পৌরুষ গর্বের কারণে তারা আরােপিত শৃঙ্খলার বশ হতে চায় না। এটাও অনুভব করা গিয়েছিল যে তাদেরকে আর্মি বা পুলিশ অ্যাক্ট -এর অধীনে আনলে তাদের স্বাধীন উদ্যোগ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের গুণগুলিই ভোতা হয়ে যাবে অথচ ও গুলিই দেশপ্রেমিক গেরিলার প্রাণস্বরূপ।

সুতরাং সিদ্ধান্ত হয়েছিল এই স্বেচ্ছাসেবক ফোর্সটি একটি সিভিলিয়ান ফোর্স হিশাবে সংগঠিত হয়ে ইন্টেলিজেন্স ব্যুরাের পরিচালকের প্রশাসনিক নিয়ণের অধীনে কাজ করবে। এ সময় ইন্টেলিজেন্স ব্যুরাের পরিচালক ছিলেন শ্রী বিএন মল্লিক ঠিক হল তাদের প্রশিক্ষণের এবং শান্তি ও যুদ্ধকালে তাদের মােতায়েনের ভার অর্পণ করা হবে প্রথা-বহির্ভূত মনের এক সৈনিকের ওপর যিনি তাদের বিশ্বাস অর্জন করতে পারবেন এবং প্রয়ােজনের সময় তাদেরকে লড়াই -এ নামাতে পারবেন। কঠিন আর্মি কোড -এর সাহায্য ছাড়া, যে কোডে কর্তব্য এড়ানাে এবং অবৈধ কর্ম সাধনের বিবিধ অপরাধের জন্য শাস্তির বিধান রয়েছে। আর্মি সদর দফতরের পছন্দ এসে পড়ল আমার ওপর। আমি তখন একটা ফীল্ড। এরিয়াতে এক আর্টিলারি ব্রিগেডের কমান্ডে ছিলাম। আমি সবে ভালভাবে অর্জিত একটা ছুটিতে এসেছি, তখন আমাকে ডাকা হল এই অনন্য সাধারণ ফোর্সের দায়িত্ব নিতে তৎকালীন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী শ্রী কৃষ্ণ মেনন চীফ অব স্টাফ লেফটেন্যান্টজেনারেল বিএম কাউলের উপস্থিতিতে ব্যক্তিগতভাবে আমার সাক্ষাৎকার নিলেন এবং আমার কাজের দুরূহতা এবং বিপদসংকুল চরিত্র সম্বন্ধে আমার মনে কোনও সন্দেহ অবশিষ্ট রাখলেন না। আমি সব সময়েই এমন কিছু একটা চ্যালেঞ্জের জন্য উদগ্রীব ছিলাম কিন্তু এটা ছিল এমন কিছু যা ছিল আমার স্বপ্নেরও অতীত আমাকে বলা হয়েছিল যে এমন একটা ফোর্সকে আর্মি অ্যাক্টের সাহায্য ও সমর্থন ছাড়া শৃঙ্খলার মধ্যে আনা হচ্ছে বুননা বাঘকে পােষ মানানাের মতাে এবং সে প্রক্রিয়ায় বার বার জখম হওয়ার জন্য আমাকে প্রস্তুত থাকতে হবে। সেই পিছনের সময় থেকে এগিয়ে এসে আমি আনন্দের সাথে বলতে পারি যে এই ফোর্সকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করার দুঃসাধ্যতা সম্বন্ধে উচ্চ কর্তৃপক্ষ যে ভয় প্রকাশ করেছিল তা ছিল ভিত্তিহীন। এত বিচিত্র উৎস থেকে নেওয়া এত বেচিত্র্যপূর্ণ মিশ্রণে গঠিত ফোর্স এর চেয়ে ভাল শৃঙ্খলা প্রদর্শন করেছে এমন রেকর্ড নেই। আমাদের মধ্যে অপরাধ ছিল সম্পূর্ণ অনুপস্থিত প্রত্যেকে শারীরিক ও মানসিক প্রশিক্ষণ নিয়ে ব্যস্ত ছিল অনেক বছরের মধ্যে একটা মাত্র দুর্ভাগ্যজনক আত্মহত্যার ঘটনা সমগ্র ফোর্সের মধ্যে ঘটেছিল। ঘটেছিল এ কারণে যে সংশিষ্ট ব্যক্তি এক মেডিকেল পরীক্ষায় প্যারাশুট ঝাপ দেওয়ার ব্যাপারে অনুপযুক্ত বলে দেখা গিয়েছিল। তার গােড়ালির গঠন ত্রুটিপূর্ণ ছিল, তাকে ঝাপ দিতে দিলে তার পা অথবা মেরুদণ্ড ভেঙে যেত। সে প্রত্যেক লীডারের কাছে গিয়ে আবেদন করল তাকে যেন ঝাপ দিতে দেওয়া হয় কিন্তু তার আবেদন গৃহীত হয়নি।

অত্যন্ত দেশপ্রেমিক, সাহসী ও সংবেদনশীল এই ব্যক্তিটি তখন একটা গাছ থেকে ফাঁসিতে ঝুলে আত্মহত্যা করেছিল। তার অনুভূতিগুলি তার লীডারদের মনে এই ধারণা এঁকে দিয়ে গেল যে তার সত্যিকারের শারীরিক অসামর্থ্যও তাকে তার সহকর্মীদের চোখে কাপুরুষ বলে প্রতিভাত করত কারণ সে তাে প্যারাশুট-ঝাপ দিতে পারত না- এই ছিল একেবারে  প্রথম বিপদ যার সম্মুখীন হয়েছিল এই ফোর্স । ওরকম পরিস্থিতিতে তার জীবনের কোনও অর্থ ছিল না বলে সে বােধ করেছিল। এমনধারা উদ্দীনার জোয়ার সৃষ্টি হয়েছিল এ ফোর্সের মধ্যে। আমার আদেশে তারা তাদের পানাসক্তি এবং জুয়ায় আসক্তি সংযত করেছিল। এতে করে তাদের মধ্যেকার গণ্ডগােলের বড় রকমের কারণগুলি দূর হয়েছিল। অবসর পেলেই উদ্দাম নৃত্য এবং বৌদ্ধ ধর্ম সংগীতের গান বাজনায় তারা মেতে উঠত । যে কোনও অসংগত আচরণের সবচেয়ে কঠিন শাস্তি ছিল নিজেদের সম্প্রদায়ের সমাজের সামনে প্রদর্শিত হওয়া ও ধিক্কার। আর ভুল কাজ করা লােককে একজন লীডার সবচেয়ে খারাপ ধরনের যে ভয় প্রদর্শন করতে পারত তা হচ্ছে তাকে আমার অর্থাৎ ফোর্স কমান্ডার -এর সামনে হাজির করা, তার মর্মমূলের পরীক্ষা নেওয়ার জন্য। যেহেতু স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্স -এর ভারতীয় আর্মির ঘনিষ্ঠ সমর্থনে কাজ করার কথা সেহেতু সীমান্তে মােতায়েন ইউনিট ও ফর্মেশনসমূহের সঙ্গে তাদের সমবেত মহড়া করতে হত, যাতে তারা আস্থা অর্জন করতে পারে। আমি অবশ্য দাবি করত তাদেরকে আর্মির কমান্ডের অধীনে নিয়মিত সৈনিকদের মতাে প্রশিক্ষিত ও শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হােক তাদের পক্ষে কাজে লাগার উপযুক্ত হওয়ার জন্য। এটা সম্ভব ছিল না এবং এতে করে একটা গণ্ডগােল চলতে থাকত যার আর শেষ ছিল না। একটা পার্বত্য এলাকায় একটা আর্মি ব্রিগেডের বিরুদ্ধে গােটা ফোর্সটার কার্যকারিতা পরীক্ষার জন্য আর্মি সদর দফতর একটা মহড়ার আদেশ দিল। এটা স্পষ্ট হল যে তারা এই ফোর্সের সঠিক কর্মক্ষমতা পুরােপুরি বুঝতে পারেনি। আমি বললাম যে এসএফএফ -এর শ’খানেক যােদ্ধা আর্মি ব্রিগেডটিকে আটকে ফেলার জন্য যথেষ্ট, কিন্তু তারা আমাকে বিশ্বাস করল না। শেষ পর্যন্ত তাদের বুঝিয়ে রাজি করা হল। ডিরেক্টর অব মিলিটারি ট্রেনিং, একজন মেজর জেনারেল, নিজে মহড়াটা পরিচালনা করবেন এবং শক্র কোর কমান্ডারের ভূমিকাও গ্রহণ করবেন।

ভরা দিবালােকে আমার লােকেরা তাঁকে ফাঁদে আটকে ফেলল এবং তাদের নিজের আম্পায়ারকে বলল তাকে নিহত বলে রেকর্ড করতে কারণ তিনি পাঁচ মিটারের মতাে দূর থেকে তাদের রাইফেলের মুখােমুখি হয়ে পড়লেন। যে দারুণ পরিকল্পনা ও রণকৌশলের সাহায্যে তারা গােটা ব্রিগেডটাকে একদম লেজে-গোবরে অবস্থায় ফেলে আত্মরক্ষামূলক ভঙ্গির মধ্যে এঁটে ফেলল তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হল সব ক’জন শত্রু আম্পায়ার। তারা তার বেতার ও তার যােগাযােগ, গােলাবারুদ ও সরবরাহ ডাম্প ধ্বংস করে দিয়ে তাকে প্রধান মহাসড়কে আটকে দিল, সেখান থেকে সরতে গেলেই বিস্তর ক্ষতি সাধন করছিল। চীফ আম্পায়ার আমাকে রিপাের্ট দেখালেন এবং আমার লােকদের অতি উত্তম প্রশিক্ষণের জন্য আমাকে অভিনন্দন জানালেন। কিন্তু আর্মি সদর দফতর রিপাের্টটা ছিড়ে ফেলে তড়িঘড়ি একটা চিঠি পাঠিয়ে দিল যাতে দেখানাে হল যে এসএফএফ -এর প্রশিক্ষণ কত দুর্বল ছিল। একই সঙ্গে আমাদের মহড়ায় শত্রু আমি ব্রিগেড কমান্ডারকে এত ছােট একটা গেরিলা দলের হাতে পর্যদস্ত হওয়ায় অদক্ষতার অভিযােগে অভিযুক্ত করা হল। এটা মােটামুটি পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে আর্মি সরকারের কাছে প্রমাণ করতে চেয়েছিল এসএফএফ-কে তার দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য তাদের কমান্ডের অধীনে আনতেই হবে। রাজনৈতিক পর্যায়ে সেই কার্যক্রম যাতে শুরু করা হয় সেই লক্ষ্যে ঐ মহড়ার বিষয়ে তাদের মূল্যায়ন আর্মি সদর দফতর প্রতিরক্ষা সচিবের কাছে জানিয়ে দিল। কিছু কিছু আর্মির মধ্যে একজন ফীল্ড কমান্ডারকে অপবাদ দেওয়ার সবচেয়ে ভাল কৌশল হচ্ছে তাকে কোনও মহড়ায় ব্যর্থ হিশাবে প্রমাণ করা, আর মহড়ার ফলাফল বিচার করেন একজন উপরওয়ালা যিনি মহড়ার অধীন শিকারের ওপর প্রতিশােধ নিতে ঝুকে আছেন। এই স্বেচ্ছাচারী খেলায় কোনও নিরপেক্ষ বিচারকমণ্ডলী থাকে। এখানে কোনও পুনর্বিচারের আবেদনও চলে না কারণ প্রথা অনুযায়ী উর্ধ্বতন অফিসারকেই সমস্ত সামরিক বিজ্ঞতার ভাণ্ডার হিশাবে ধরা হয়। আমাদের আর্মি সম্বন্ধে এটা সত্য ছিল, অবশ্য আমি বিশ্বাস করি এখন আরও বেশি উদার মনের ও যােগ্যতাসম্পন্ন কমান্ডারগণ আসায় অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে। আমার বেসামরিক বস শ্রী বিএন মলি-ক, সবচেয়ে যােগ্যতাসম্পন্ন সিভিল সার্ভেন্টদের একজন, পুরা পরিস্থিতিটা খুব ভালভাবে বুঝতে পেরেছিলেন, কিছু বিদেশি বিশেষজ্ঞ কর্তৃক কৃত মহড়ার সেটিং এবং তার ফলাফলের বিশেষণ হাতে পাওয়ার পর। এত উচ্চ পর্যায়ে এমন নীচতা দেখে আমি সাংঘাতিক রকম বিষন্ন হয়ে পড়েছিলাম এবং উদ্বেগের সাথে অপেক্ষা করছিলাম আমাদের মূল্যের প্রমাণ দিতে- বিশেষত একটা যুদ্ধে। কিন্তু যুদ্ধ তাে কেউ নিজে নিজে খুঁজে বের করতে পারে না।

এর পরের সবচেয়ে ভাল জিনিশ হচ্ছে একটা মহড়া চালানাে এমন একজন আর্মি কমান্ডারের নির্দেশনায় যিনি শুধু তার যােগ্যতার জন্য নয়, নিরপেক্ষতার জন্যও পরিচিত। শিগগিরই তেমন একটা সুযােগ এসে গেল । জিওসিইন-সি সেন্ট্রাল কমান্ড লেফটেন্যান্ট-জেনারেল জেএস ধিলন (১৯৬৫ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আমরা যে সাফল্য অর্জন করেছিলাম তার সবটার জন্য সর্বাগ্রে যিনি কৃতিত্বের অধিকারী ছিলেন) তার একটা ডিভিশনের মহড়া করাতে যাচ্ছিলেন। এই মহড়ায় আমরা আমাদের স্বাভাবিক ভূমিকা নিয়ে যােগ দিতে পারতাম। তিনি কমান্ডার হিশাবে সর্বোচ্চ সততা এবং সামগ্রিক বিবেচনা বােধের অধিকারী বলে পরিচিত ছিলেন। আমরা ‘গরুড়’ নামের এই মহড়ায় অংশ নিলাম এবং তার ফলে আমি এমন রিপাের্ট অর্জন করলাম যা আমাদের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারে বিপুলভাবে সহায়ক হয়েছিল এবং ভবিষ্যৎ কর্মপ্রচেষ্টার ক্ষেত্রে টনিক হিশাবে কাজ করেছিল। জিওসি-ইন-সি লেফটেন্যান্ট-জেনারেল জেএস ধিলন -এর মন্তব্যসমূহ: মহড়ার নির্দেশক রিপাের্ট করছেন যে এসএসএফ কোম্পানিটি কৃতিত্বের সাথে তৎপরতা চালিয়েছে; এর ওপর যে করণীয়গুলি অর্পণ করা হয়েছিল তা তারা। সফলভাবে সম্পন্ন করেছিল; এরা তাকে গুরুতররা রূপে অকেজো করে। দিয়েছিল তাকে ছত্রভঙ্গ করে এবং একজোট হওয়ার সুযােগ না দিয়ে অর্থাৎ শত্রুর ওপর এই দলের কার্যকারিতা ছিল অত্যন্ত লক্ষণীয়। এই মহড়ায় অংশগ্রহণকারী, এর পরিচালনাকারী এবং এর আম্পায়ার সামরিক অফিসারগণ এসএফএফ -এর কার্যকারিতায় দারুণভাবে চমৎকৃত হয়েছিল। তারা সবাই মনে করে যে আমাদের হাতে নেওয়া যে কোনও অপারেশনের জন্য এসএফএফ একটা মস্ত সম্পদ হতে যাচ্ছে। প্রত্যেকে জানে যে যখন এই ফোর্সের সূত্রপাত তখন থেকে আপনিই এর স্থপতি। এই সুযােগে আমি আপনাকে অভিনন্দন জানাতে চাই এই ফোর্সের সংগঠন ও প্রশিক্ষণকে এমন উচ্চ মানে উন্নীত করায় আপনার সফলতার জন্য ।

এই শেষ অনুচ্ছেদটা ফোর্স কমান্ডার হিশাবে আমাকে উদ্দেশ্য করে লেখা। মহড়া গরুড়” -এর পরিচালকের মন্তব্য: মহড়ার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এই ফোর্স অত্যন্ত ভাল করেছে। তাদের সাফল্যের প্রধান প্রধান কারণ নিমরূপ

ক) অপারেশনের ভূমি সম্বন্ধে তাদের লােকদের সম্যক জ্ঞান ছিল।

খ) তারা অত্যন্ত চলমান ছিল, বিশেষত রাতের বেলায়।

গ) তারা দ্রুততার সাথে হানা দিচ্ছিল এবং চমক সৃষ্টি করতে পারছিল ।

ঘ) তাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল উচু স্তরের; তারা যখন কোনও ঘাঁটি বা লুকানোের স্থান ত্যাগ করছিল তখন তাদের উপস্থিতির কোনও চিহ্ন তারা 

পিছনে ফেলে যাচ্ছিল না।

ঙ) যেখানে তারা আঘাত করবে তা থেকে অন্য জায়গায় আঘাত করার ভান

করে বহুলভাবে প্রতারণামূলক ব্যবস্থা তারা গ্রহণ করেছিল। শত্রুকে বহুলভাবে প্রতারিত করতে তারা সক্ষম হয়েছিল।

মেজর জেনারেল জেওসি ডিভিশন

আমি ভেবেছিলাম পশ্চিমাঞ্চলীয় কমান্ডের জিওসি-ইন-সি লেফটেন্যান্ট-জেনারেল কেপি ক্যানডেথ, পিভিএসএম-কে একটা মহড়ায় ফোর্সটিকে পরিদর্শন করতে আহ্বান করা ফলদায়ক হবে; তাতে তিনি তাদের সামর্থ্য সম্বন্ধে নিজের জন্য একটা ধারণা নিতে পারবেন। জেনারেল ক্যানডেথ ছিলেন অত্যন্ত প্রশস্ত কল্পনাশক্তিসম্পন্ন অত্যন্ত অকপট একজন অফিসার । এসএফএফ -এর মতাে একটা অপ্রচলিত ধরনের। ফোর্স সম্বন্ধে তার চিন্তাভাবনা কেমন ছিল সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত ছিলাম না এবং যখন তিনি মহড়া পর্যবেক্ষণ করছিলেন তখন আমি উদ্বিগ্ন হয়েছিলাম। তাঁর যা বলার ছিল সে হচ্ছে এরকম: সেখানে যা দেখলাম তাতে আমি কী যে বিস্মিত হয়েছিলাম। আমি বিশেষভাবে চমকৃত হয়েছিলাম লােকগুলির উচ্চ মানের গুলি চালনায় এবং শারীরিক যােগ্যতায় । দুরূহ পার্বত্য ভূমিতে তাদের দ্রুতগতি চলনের ক্ষমতা আমার চোখ খুলে দিয়েছিল। কোনও আইন ও আদেশ ছাড়া এবং কোনও রকম শাস্তিক্রমের অনুপস্থিতিতে শৃঙ্খলা বহাল রাখা অবশ্যই একটা সত্যিকারের কঠিন কাজ এবং আপনি ও আপনার অফিসাররা যেভাবে শৃঙ্খলা বজায় রাখার কাজটা করে যাচ্ছিলেন তাতে আমি চমৎকৃত হয়েছিলাম। লােকগুলির হাসিখুশিভাব এসএফএফ -এর মধ্যে বিদ্যমান উদ্দীপনার যথাযথ ইঙ্গিত বহন করে।

পরে পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের জিওসি-ইন-সি লেফটেন্যান্ট-জেনারেল জেএস অরােরাকে, যিনি পরে বাংলাদেশে ঐতিহাসিক যুদ্ধে বিজয় অর্জন করতে যাচ্ছিলেন, আমাদের ফোর্স পরিদর্শনে আহ্বান করার সুযােগ হয়েছিল আমার। তিনি দারুণভাবে চমকৃত হয়েছিলেন। এই ফোর্স সম্বন্ধে লিখতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন- “আমার সম্পূর্ণ প্রত্যয় হয়েছে যে তারা উত্তম কাজ দেখানাের উপযুক্ত এবং সুযােগ এলেই তারা নিশ্চয়ই উত্তম কাজ দেখাবে ।… আমি আপনাকে সম্মানিত করতে চাই আপনি যা অর্জন করেছেন সে সবের জন্য আপনি তা করেছেন যে সব প্রতিবন্ধকতা ও ভুল বােঝাবুঝির মধ্যে আপনাকে কাজ করতে হয়েছে তা সত্ত্বেও। আমি এই মাত্র বলতে পারি যে একজন অপেক্ষাকৃত কম উত্তম ব্যক্তির পক্ষে, যে আপনার মতাে নিবেদিতপ্রাণ ও দৃঢ়সংকল্প নয় এমন কোনও ব্যক্তির পক্ষে, এটা করা সম্ভব হত না।” এই ভুল বােঝাবুঝির উদ্ভব সম্বন্ধে জানেন এমন একজন ব্যক্তির কাছ থেকে এরকম একটা মন্তব্য সবচেয়ে বেশি ঈলিত ছিল। এ পর্যন্ত যদ্র দেখা যায় তিনজন উচ্চ পর্যায়ের আর্মি কমান্ডার এই ফোর্সের দক্ষতার ব্যাপারে প্রত্যয়ী হয়েছেন এবং এর নেতৃত্বের ওপর আস্থা স্থাপন করেছেন। সবচে’ উৎসাহজনক বার্তা অবশ্য এসেছিল জেনারেল স্যাম মানেকশ’র কাছ থেকে, যিনি আমার অনুরােধে এই ফোর্স পরিদর্শনে এসেছিলেন। তিনি লিখলেন-“এ ছিল এক বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা। আমি খুব কমই এমন গর্বিত বােধ করেছি। তােমার সৈন্যদের দেখে মনে হচ্ছিল তাদের মধ্যে অসাধারণ হৃদয় আছে, তারা চূড়ান্ত রকম উপযুক্ত ও যােগ্য এবং তাদের মধ্যে রয়েছে বিপুল রকম অনুপ্রেরণা। এমন চমত্তার মানুষদের নেতৃত্ব দেওয়ার সুযােগ পাওয়া যে কোনও সৈনিকের পক্ষে আনন্দের ব্যাপার । পৃষ্ঠপােষকতা করার ইচ্ছা থেকে বলছি না, আমি মনে করি এত বিচিত্র এলাকা এবং পরিপার্শ্ব থেকে মানুষদের নিয়ে এমন একটা যােদ্ধা বাহিনী গড়ে তােলার বিরাট কৃতিত্ব অবশ্যই তােমার ওপর বর্তায়।” দৃশ্যপটে জেনারেল মানেকশ’র আগমনের সঙ্গে সঙ্গে সম্পূর্ণ আবহাওয়া বদলে গেল। এই বিচক্ষণ চীফ আমাদের ইতিহাসের সবচে’ বিপদসংকুল কিছু অপারেশনে আমাদের অনুপ্রাণিত ও চালিত করেছেন। সে কথায় আমরা পরে আসব ।

এই লােকদের প্যারাশুট ঝাপ প্রশিক্ষণ মানে ছিল চলন্ত বিমান থেকে লক্ষিত এলাকায় নিখুঁতভাবে প্যারাশুটসহ ঝাপ দেওয়া। যেসব লােক কোনও ধরনের একটা মাত্র মেশিনও সারা জীবনে দেখেনি তাদের জন্য এটা সােজা কাজ নয়। সুতরাং আমি প্রশিক্ষণের সবরকম উন্নত সরঞ্জামাদি যা আমাদের আধুনিক আর্মি ব্যবহার করে সেসব বাদ দিলাম কারণ সেসব নবিশদেরকে ভীত করে তােলে। আমরা গ্রাউন্ড ট্রেনিং -এর জন্য সহজ সরল কৌশল উদ্ভাবন করলাম এবং সত্যিকার ঝাঁপের জন্য উদ্বেগের সাথে অপেক্ষা করতে লাগলাম। এই স্বেচ্ছাসেবক ফোর্সে আর্মি থেকে যেসব অফিসারদের দেওয়া হয়েছিল তাদের কেউ প্যারাশুট ট্রেইনড বা প্যারাভলান্টিয়ার ছিলেন না। যদিও অনেক অফিসার এই লােকদের সঙ্গে সঙ্গে গ্রাউন্ড ট্রেনিং গ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু তাদের ধারণা ছিল তাদের কখনও কোনও আকাশযান থেকে সত্যিকারের ঝাপ দিতে হবে না, কারণ তারা প্যারা-ভলান্টিয়ার ছিলেন না। এবং তারা উচ্চতর বয়সের গ্রুপেও পড়তেন যাদের জন্য সরকার ঝুঁকি নিত না এবং  মৃত্যু বা জখমের ক্ষেত্রে কোনও ক্ষতিপূরণ দিত না। সুতরাং আমার কমান্ডে এ ব্যাপারে আমি একটা সংকটের মধ্যে ছিলাম। একটা কমান্ড কাঠামাের সুস্থতার জন্য এটা অতীব গুরুত্বপূর্ণ যে অফিসাররা জওয়ানদের সঙ্গে সঙ্গে সব রকম বিপদ-আপদের ভাগ নেবে এবং তার শুরু হবে প্রশিক্ষণের বিপদ-আপদ দিয়ে । জওয়ানদের ঝাঁপ দেওয়ানাের জন্য আমি যখন অফিসার ভলান্টিয়ারদের নাম চাইলাম, কোনও নামই এল না। সত্যিকার ঝাপের ঠিক আগের দিন ছিল সেটা। সে ছিল এক সংকটজনক অবস্থা। জওয়ানরা যুদ্ধের সময় একজন অফিসারের আদেশ পালন করবে না, যদি শান্তির সময় সে তাদের বিশ্বাস হারায়। এমন নয় যে অফিসারদের সাহসের অভাব ছিল। প্রধান কারণ ছিল যে সরকারি বিধি অনুযায়ী তাদের বয়সের কারণে তাদের ঝুঁকি আবৃত ছিল না এবং তারা তেমন ঝুঁকি না নেওয়াটা সংগত বলে মনে করেছিল। কিন্তু আমার জন্য এক্ষেত্রে সােজাসাপটা প্রশ্ন ছিল হয় জওয়ানদের আস্থা অর্জন নয় তাে কমান্ড ছেড়ে দেওয়া।

৩৬ বছরের বেশি বয়সের ব্যক্তিদের ঝুঁকি সরকার কর্তৃক গ্রহণ না করার ব্যাপারে কথাবার্তা জওয়ানদের মধ্যেও গুরুতররা প্রভাব ফেলল। তাদের মধ্যেও অনেকের বয়স এর চেয়ে বেশি ছিল এবং তারা অনুভব করল যে তাদের সেই বয়সে ঝাঁপ দেওয়া সত্যিই ঝুঁকিপূর্ণ হবে যেহেতু সরকার সেই ঝুঁকি গ্রহণ করতে যাচ্ছে না। আমার হাতে মাত্র একটা দিন ছিল এবং কোনও ক্রমেই একদিনের মধ্যে সরকারের সিদ্ধান্ত পাওয়ার সুযােগ আমার ছিল না। সুতরাং আমি আমার সামনে খােলা একমাত্র পথ অবলম্বন করলাম । ঐ বিকালেই আমি সব জওয়ানদের উদ্দেশ্যে বললাম-“প্যারাশুট-ঝাপ মােটে ঝুকিপূর্ণ নয়। এটা ভ্রমণের সবচেয়ে মনােরম উপায়সমূহের একটা। কোনও রকম ক্লান্তি ছাড়া শত্রুর কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়ার উপায় এটা। এর জন্য বেশি প্রশিক্ষণের দরকার হয় না । এবং সব বয়সের জন্যই এটা নিরাপদ। তােমরা জান আমার কোনও প্যারা-ট্রেনিং নেই কিন্তু আমি প্রত্যেকটি গ্রুপের জন্য নিজে আকাশযান থেকে ঝাঁপ দিয়ে দেখিয়ে দেব, যদি না আমার পরে কোনও অফিসার স্বেচ্ছায় জওয়ানদের আগে ঝাঁপ দেওয়ার জন্য এগিয়ে আসে। এতে গােটা আবহাওয়া যেন বিদ্যুতায়িত হয়ে উঠল। প্রত্যেকে জানত যে আমি তাদের যে কোনও জনের চেয়ে বেশি বয়সি। তারা এটাও জানত যে আমার কোনও প্রশিক্ষণ ছিল না। কিন্তু সর্বোচ্চ কমান্ডার যখন এভাবে এগিয়ে আসে তখন তার অত্যন্ত গভীর প্রভাব সৃষ্টি হয় ।

জওয়ানদেরকে এসব কথা বলে এবং তাদের তীক্ষ্ণ রণহুংকার উপভােগ করে আমি ভাবতে বসলাম কি করে জওয়ানদেরকে দেওয়া অঙ্গীকার আমি পালন করব। ঝাপ দেওয়ার কৌশল শেখার জন্য আমার হাতে আছে মাত্র একটা রাত এবং তাও আমার চা -এর টেবিল থেকে আমার ড্রয়িং রুমের কার্পেটের ওপর ঝাপ দিয়ে। একজন জুনিয়রকে অনুরােধ করলাম ঐ রাতে আমার ড্রয়িং রুমে আমাকে গ্রাউন্ড রােলটা শিখিয়ে দিতে এবং প্যারাশুটের সঙ্গে লাগানাে রশির ব্যবহার ব্যাখ্যা করতে। আমি এর কিছু কিছু প্রশিক্ষণ ভূমিতে আমার পরিদর্শনের সময় দেখেছিলাম এবং সব সময় মনে হত যে এগুলি সহজ । ঐ রাতে সবকিছু কঠিন বলে মনে হল। যা হােক আমি চা -এর টেবিল থেকে ঝাঁপ দিয়ে আমার কার্পেটের ওপর কয়েকটা বেঢপ রকমের গড়াগড়ি খেলাম। এবং আমার ইন্সস্ট্রাক্টর আমার কাছ থেকে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিলেন যে আমি কখনও কাউকে বলব না তিনি আমাকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। তিনি আমার কাছ থেকে চলে গেলেন এই কথা বলে যে পরের দিন জওয়ানদের সাথে ঝাপ দেওয়ার সিদ্ধান্ত আমি যেন পুনর্বিবেচনা করি এবং ঝাঁপ দেওয়ার আগে যেন কমপক্ষে এক মাসের নিয়মিত গ্রাউন্ড ট্রেনিং নিই । আমার জন্য ব্যাপারটা তেমন সরল ছিল না। আমি যদি এই ফোর্সকে কমান্ড করতে চাই তাহলে আমি যা বলেছি তা আমাকে করতেই হবে। আমি শ্রী বিএন মলি-ককে, যিনি তখন তাঁর সদর দফতরের বাইরে ছিলেন, আমার সিদ্ধান্তের কারণ ব্যাখ্যা করে একটা চিঠি পাঠিয়েছিলাম। তাতে আমাদের মৃত্যুর ক্ষেত্রে আমাদের পরিবারের প্রতি যথাযথ ক্ষতিপূরণ দানের ব্যবস্থাও করতে অনুরােধ করেছিলাম। অতিরিক্ত পূর্বসতর্কতা হিশাবে আমি একটা চিঠি লিখেছিলাম আমার ভাই ড. গােপাল সিং এমপি-কে, যিনি পরে অনেকগুলি দেশে আমাদের বিশিষ্ট রাষ্ট্রদূত হয়েছিলেন।

তাকে লিখেছিলাম আমি মারা গেলে তিনি যেন আমার পরিবারকে সাহায্য করেন। পরদিন আমি সবার আগে ঝাঁপ দিলাম এবং নিখুঁতভাবে ভূমিপ্রাপ্ত হলাম। আমার সফল ঝাপের কথা জানতে পেরে শ্রী বিএন মলি-ক আমাকে অভিনন্দন বার্তা। পাঠালেন, কেবল নিজের তরফ থেকে নয়, সেই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওয়াহরলাল নেহরুর তরফ থেকেও  প্রশিক্ষণবিহীন আমার এই একটি মাত্র ঝাপ পরিপূর্ণ সমাধান করে ফেলল আমাদের অনেক সমস্যার, তা শুধু জওয়ানদের সঙ্গে নয়, সরকারের সঙ্গেও। আমার ড্রাইভার হাবিলদার শাপুর সিং ঝাপ দিল। বাবুর্চিরা ঝাপ দিল, কোয়ার্টার -এস্টাররা ঝাপ দিল। সবাই তাদের প্যারা-ব্যাজ ঝুলিয়ে পৌরুষের গর্বের সাথে হাঁটতে লাগল। পরে শ্রী বিএন মলিক প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওয়াহরলাল নেহরুর সামনে তার অফিসে  জওয়ানদেরকে এসব কথা বলে এবং তাদের তীক্ষ্ণ রণহুংকার উপভােগ করে আমি ভাবতে বসলাম কি করে জওয়ানদেরকে দেওয়া অঙ্গীকার আমি পালন করব। ঝাপ দেওয়ার কৌশল শেখার জন্য আমার হাতে আছে মাত্র একটা রাত এবং তাও আমার চা -এর টেবিল থেকে আমার ড্রয়িং রুমের কার্পেটের ওপর ঝাপ দিয়ে। একজন জুনিয়রকে অনুরােধ করলাম ঐ রাতে আমার ড্রয়িং রুমে আমাকে গ্রাউন্ড রােলটা শিখিয়ে দিতে এবং প্যারাশুটের সঙ্গে লাগানাে রশির ব্যবহার ব্যাখ্যা করতে। আমি এর কিছু কিছু প্রশিক্ষণ ভূমিতে আমার পরিদর্শনের সময় দেখেছিলাম এবং সব সময় মনে হত যে এগুলি সহজ । ঐ রাতে সবকিছু কঠিন বলে মনে হল। যা হােক আমি চা -এর টেবিল থেকে ঝাঁপ দিয়ে আমার কার্পেটের ওপর কয়েকটা বেঢপ রকমের গড়াগড়ি খেলাম। এবং আমার ইন্সস্ট্রাক্টর আমার কাছ থেকে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিলেন যে আমি কখনও কাউকে বলব না তিনি আমাকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। তিনি আমার কাছ থেকে চলে গেলেন এই কথা বলে যে পরের দিন জওয়ানদের সাথে ঝাপ দেওয়ার সিদ্ধান্ত আমি যেন পুনর্বিবেচনা করি এবং ঝাঁপ দেওয়ার আগে যেন কমপক্ষে এক মাসের নিয়মিত গ্রাউন্ড ট্রেনিং নিই । আমার জন্য ব্যাপারটা তেমন সরল ছিল না। আমি যদি এই ফোর্সকে কমান্ড করতে চাই তাহলে আমি যা বলেছি তা আমাকে করতেই হবে। আমি শ্রী বিএন মলি-ককে, যিনি তখন তাঁর সদর দফতরের বাইরে ছিলেন, আমার সিদ্ধান্তের কারণ ব্যাখ্যা করে একটা চিঠি পাঠিয়েছিলাম।

তাতে আমাদের মৃত্যুর ক্ষেত্রে আমাদের পরিবারের প্রতি যথাযথ ক্ষতিপূরণ দানের ব্যবস্থাও করতে অনুরােধ করেছিলাম। অতিরিক্ত পূর্বসতর্কতা হিশাবে আমি একটা চিঠি লিখেছিলাম আমার ভাই ড. গােপাল সিং এমপি-কে, যিনি পরে অনেকগুলি দেশে আমাদের বিশিষ্ট রাষ্ট্রদূত হয়েছিলেন। তাকে লিখেছিলাম আমি মারা গেলে তিনি যেন আমার পরিবারকে সাহায্য করেন। পরদিন আমি সবার আগে ঝাঁপ দিলাম এবং নিখুঁতভাবে ভূমিপ্রাপ্ত হলাম। আমার সফল ঝাপের কথা জানতে পেরে শ্রী বিএন মলি-ক আমাকে অভিনন্দন বার্তা। পাঠালেন, কেবল নিজের তরফ থেকে নয়, সেই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওয়াহরলাল নেহরুর তরফ থেকেও। প্রশিক্ষণবিহীন আমার এই একটি মাত্র ঝাপ পরিপূর্ণ সমাধান করে ফেলল আমাদের অনেক সমস্যার, তা শুধু জওয়ানদের সঙ্গে নয়, সরকারের সঙ্গেও। আমার ড্রাইভার হাবিলদার শাপুর সিং ঝাপ দিল। বাবুর্চিরা ঝাপ দিল, কোয়ার্টার -এস্টাররা ঝাপ দিল। সবাই তাদের প্যারা-ব্যাজ ঝুলিয়ে পৌরুষের গর্বের সাথে হাঁটতে লাগল। পরে শ্রী বিএন মলিক প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওয়াহরলাল নেহরুর সামনে তার অফিসে  আমাকে হাজির করলেন। যেমন সদয়ভাবে প্রধানমন্ত্রী আমাকে গ্রহণ করলেন তা আমি কখনও ভুলতে পারি না। আমার সঙ্গে পরের শিডিউলে ঝাপ দেবেন বলে তিনি ব্যগ্র ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। আমরা সবাই শ্রী বিএন মলি-ক -এর অধীনে কাজ করে গর্বিত ছিলাম। এই নিঃস্বার্থ মানুষটি মেধায়, আত্মত্যাগে, দেশপ্রেমের চেতনায়, জাতির জন্য কাজ করায়, অমিত আত্মনিবেদনে জওয়াহরলাল নেহরু, সর্দার প্যাটেল এবং পণ্ডিত পান্ত প্রমুখ যাদের অধীনে তিনি কাজ করেছিলেন তাদের সমপর্যায়ের ছিলেন। তিনি ছিলেন সততায় অটল, অতীব আত্মসংযমী এবং কঠিন চরিত্রের মানুষ। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল তাঁর অত্যুচ্চ মেধা। তার ফলে তিনি সবচেয়ে কঠিন সময়ের পরীক্ষার সামনে সােজা হয়ে দাঁড়াতে পেরেছেন এবং এমন সব বাহিনী গড়ে তােলার কৌশল উদ্ভাবন করেছেন যা অনাগত দীর্ঘ কাল ধরে সব রকমের প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে দেশকে রক্ষা করতে সক্ষম হবে। এটা চরম দুর্ভাগ্য যে এই দেশ তার এই সব প্রতিভাবান সন্তানদেরকে তাড়াতাড়িই ভুলে গিয়েছে এবং তাদের বয়ােবৃদ্ধিতে তাদেরকে অব্যাহতি দিয়েছে, তাঁরা যথারীতি অবসরে চলে গিয়েছেন, তখন আর তাদেরকে সম্মান করার বা তাদের মেধা ও যােগ্যতাকে কাজে লাগানাের কোনও ব্যবস্থা রাখেনি। তিনি সম্প্রতি ৭৮ বছর বয়সে হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুবরণ করেছেন বাবা ওংকারনাথের একজন মহান শিষ্য হিশাবে । সকল সম্মান তার উদ্দেশ্যে। দেশ মানুষরূপী এক রত্নকে হারিয়েছে।

সূত্র : ফ্যান্টমস অব চিটাগং-দি ফিফথ আর্মি ইন বাংলাদেশ – মেজর জেনারেল (অব.) এস এস উবান

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!