You dont have javascript enabled! Please enable it!

পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূখণ্ড

সে এক ঘন-জঙ্গলাকীর্ণ পার্বত্য ভূমি সেথায় খাল দ্বারা বিভক্ত চারটি আলাদা আলাদা পর্বতমালা আছে। কর্ণফুলি নদীকে আটকানাে গেলে সেই খালগুলি ভরে ওঠে বিশাল আকার ধারণ করে। সে ক্ষেত্রে কাপ্তাই বাঁধ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কর্ণফুলি নদী সমগ্র এলাকাটিকে বিভক্ত করে প্রবাহিত উত্তর-পূর্বে ভারতীয় আউটপােস্ট ডেমাগিরি থেকে শুরু করে কর্ণফুলি নদী দক্ষিণ-পশ্চিমে চট্টগ্রাম বন্দরে শেষ হয়েছে নদীটির বেশির ভাগই নৌচলাচলের উপযুক্ত। গুরুত্বপূর্ণ শহর বর্কল, সুভলং, রাঙামাটি, চন্দ্রঘােনা এবং চট্টগ্রাম সব এক পারে অবস্থিত উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রবাহিত কাসালং খাল সুভলং -এর সন্নিকটে এই নদীর সঙ্গে মিলিত হয় এর পাড় বরাবরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ শহর আছে এবং এটাও নাব্য এর সমান্তরালে প্রবাহিত চিংগ্রি খাল রাঙামাটিতে এসে কর্ণফুলি নদীর সঙ্গে মিলিত হয় এর পারেও কিছু গুরুত্বপূর্ণ লােকালয় আছে। আরও শত শত খাল এবং হ্রদও রয়েছে কর্ণফুলি নদী এবং এই দুটি খাল হচ্ছে যােগাযােগের প্রধান ধমনি, এই চরম দুরূহ ভূভাগে যে কোনও সামরিক সাফল্যের ক্ষেত্রে চাবিকাঠি। পায়ে চলা পথ, যেখানেই আছে, চলে গিয়েছে পাহাড়গুলির শীর্ষ ধরে সাপ এবং অন্যান্য অনাকাক্ষিত জীবেরা এ এলাকায় প্রচুর বর্তমান। আমাশয় এখানে সাধারণ ব্যাপার ম্যালেরিয়া এবং আরও অনেক গ্রীষ্মমণ্ডলীয় রােগব্যাধি সম্বন্ধেও একই কথা। আরও দক্ষিণে সাংগু নদী দক্ষিণ-পূর্ব থেকে উত্তর-পশ্চিম অভিমুখে প্রবাহিত আরাকান সড়কের জন্য এ নদীর ওপর দোহাজারিতে সেতু তৈরি করা আছে। একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যবস্তু হিশাবে এই সেতুটি ধ্বংসের জন্য এসএফএফ -এর ওপর দায়িত্ব অর্পিত হয়েছিল। পার্বত্য চট্টগ্রামের পূর্ব সীমান্তের সংলগ্ন হচ্ছে ভারতের মিযােরাম রাজ্য এ সীমান্তে ভারতের কিছু বর্ডার পােস্ট আছে যেখানে সব ধরনের চলাচলের জন্য আকাশপথের ওপর নির্ভর করতে হয়।

 

ব্যতিক্রম শুধু ডেমাগিরি, ডেমাগিরি থেকে আইযাওয়াল পর্যন্ত মােটামুটি চলনসই রাস্তা আছে  মিযাে বিদ্রোহীরা এই সীমান্ত অতিক্রম করে আবার ফিরে যেত তাদের দুর্গম কিন্তু রসদে পরিপূর্ণ পার্বত্য চট্টগ্রামের ঘাঁটিগুলিতে, এ কাজে পাক কর্তৃপক্ষের নীরব সমর্থন থাকত এই এলাকায় যে বৌদ্ধ চাকমা উপজতি বাস করে, বাংলাদেশিদের স্বাধীনতার আকাক্ষার প্রতি তাদের কোনও সহানুভূতি ছিল না।  আসলে তাদের রাজা শ্রী ত্রিদিব রায় ইসলামাবাদ থেকে তাদের সঙ্গে যােগাযােগের চেষ্টা চালিয়েছিলেন তাদেরকে বাংলাদেশ-বিরােধী অবস্থান নিতে প্রলুব্ধ করার জন্য মিযাে এবং চাকমা উভয়ই আমাদের অপারেশনগুলির সময় অত্যন্ত শত্রুতামূলক ভূমিকা পালন করেছিল।  এই অংশে আমার যুদ্ধকালীন অবস্থানের পরেই কেবল আমি পরিপূর্ণভাবে বুঝতে পেরেছিলাম বার্মা ও আসামের মিযাে অধ্যুষিত অংশগুলিসহ একটি পাশ্চাত্যপন্থী খ্রিস্টান মিযযাল্যান্ড প্রতিষ্ঠায় ব্রিটিশ পরিকল্পনার গুরুত্ব। এই একই পরিকল্পনা চীনও অনুসরণ করেছে বলে মনে হয় বৃহত্তর পরিসরে, উলি-খিত ভূখণ্ডের সঙ্গে নাগাল্যান্ডকেও সংযুক্ত করে শত্রুর হাতে এটা একটা চরম দুর্দান্ত গেরিলা ঘাঁটিতে পরিণত হয়ে সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারত। চট্টগ্রামের সমতল ভূমিতেও প্রচুর গাছপালা আছে এবং উত্তর থেকে দক্ষিণে মাত্র দুটি রাস্তা আছে । অতঃপর আছে সেই বিখ্যাত আরাকান রােড যা বাংলাদেশ ও বার্মার মধ্যে একমাত্র স্থল-সংযােগ এবং ঢাকা ও চট্টগ্রামে পরাস্ত শক্রদের একমাত্র পলায়ন পথ। আলােচ্য ভূখণ্ডে প্রায়ই প্রচণ্ড তীব্রতায় ঘূর্ণিঝড় বয়ে যায়। এরকম একটা ঝড়ের অভিজ্ঞতা আমাদের হয়েছিল যখন আমরা অ্যাকশনে যাওয়ার জন্য কেন্দ্রীভূত হচ্ছিলাম। তাতে কুটিরগুলির চাল ও বেড়া উড়ে গিয়েছিল, গাছপালা উপড়ে গিয়েছিল  যা কিছু খননকৃত পরিখার মধ্যে, তা সব নিরাপদ; মাটির ওপরে যা কিছু তা নিরাপদ নয়।

মনের মিল ঘটল

আর্মি চীফ স্যাম মানেকশ’, যিনি তাঁর বন্ধুদের এবং গুণমুগ্ধদের কাছে ‘স্যাম’ বলে অভিহিত হতেন, এই যুদ্ধে জয়লাভের জন্য সকল প্রাপ্তব্য উপাদান ব্যবহারের জন্য। উৎসুক ছিলেন। পাকিস্তান যুদ্ধটা শুরু করবে এটা নিশ্চিত মনে হচ্ছিল স্পষ্টতই তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের দুরধিগম্য ভূমিতে স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্সকে ব্যবহার করতে মনস্থির করেছিলেন। সেই পার্বত্য ভূমি হচ্ছে সবদিক দিয়ে পানিতে ঘেরা পথচিহ্নহীন জঙ্গল ও পাহাড়ে পূর্ণ। প্রথমত সেখানে যে বিখ্যাত কাপ্তাই বাঁধ পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদন করত তা তিনি ধ্বংস করতে চেয়েছিলেন। বাধটা এই জংলা ভূমির মধ্য ভাগে অবস্থিত থাকায় একমাত্র গেরিলা অ্যাকশন সেটাকে ধ্বংস করতে পারত এর ধ্বংসের ফলে পুরা এলাকাটা প্লাবিত হত এবং সেখানে মােতায়েন পাকিস্তানের নিয়মিত এবং আধাসামরিক বাহিনীগুলির জন্য বিভীষিকাময় অবস্থার সৃষ্টি করত। দ্বিতীয়ত, সেখানে ছিল বিখ্যাত আরাকান রােড যা ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম, তারপর কক্সবাজার এবং সমুদ্র উপকূল বরাবর বার্মায় গিয়েছে। পাক আর্মির সৈন্যদের জন্য বার্মায় সরে গিয়ে শত্রু থেকে নিরাপদ হওয়ার একমাত্র স্থলপথ ছিল এটাই পলায়নপর পাক আর্মিকে তুলে নেওয়ার জন্য মার্কিন সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগরে আগমন করলেও এটাই হত একমাত্র পথ যা পাকিস্তানিরা ব্যবহার করতে পারত শ্রেষ্ঠতম বেলামুখ এলাকার কয়েকটা ছিল চট্টগ্রাম বন্দরের দক্ষিণ দিকে সুতরাং পাক আর্মির পক্ষে এই সড়কের গুরুত্ব এত বেশি ছিল যে তা একেবারেই বাড়িয়ে বলা সম্ভব নয় । তৃতীয়ত, খােদ চট্টগ্রাম বন্দর ছিল প্রধান বন্দর যেখানে পাকিস্তান থেকে ও তার মিত্রদের কাছ থেকে সৈন্য ও রসদের নতুন চালান এসে নামত  এই বন্দর আক্রমণ করা ও বন্ধ করে দেওয়া ছিল ভারতীয় আর্মির জন্য এক অতীব গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য, যেমন এটাকে যে কোনও মূল্যে রক্ষা করা ছিল পাক আর্মির পক্ষে অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এই সত্যের স্বীকৃতিস্বরূপ পাক কর্তৃপক্ষ এই অংশে নিয়মিত বাহিনীর ও আধা-সামরিক বাহিনীর প্রায় ৮ হাজার লােক মােতায়েন করেছিল।

এই এলাকার গুরুত্ব আরও বেড়েছিল এজন্য যে পার্বত্য চট্টগ্রাম ঢাকার দিকে আক্রমণ চালাতে উন্মুখ ভারতীয় আর্মি কোর -এর পূর্ব পার্শ্বের জন্য হুমকিস্বরূপ হয়েছিল। সে হুমকি দূর করা অতীব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সুতরাং জেনারেল মানেকশ’ এই এলাকায় প্রাধান্য বিস্তার করার জন্য এসএফএফ -এর দুর্ধর্ষ গেরিলাদেরকে ব্যবহার করার পরিকল্পনা করলেন, কারণ এটাই ছিল আর্টিলারি ও বিমান সমর্থন ছাড়া লড়াই চালাতে পারার মতাে একমাত্র ফোর্স; এমনকি ব্যাপকভাবে জলাশয় পারাপারের আবশ্যকতা সত্ত্বেও তার জন্য এই ফোর্সের কোনও বিশেষ জলযানের সরবরাহের প্রযােজন ছিল না; জলাশয় পারাপারের জন্য তারা স্থানীয় ও তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা প্রস্তুত করে নিতে পারত তার সূক্ষ্মদর্শী মেধার দ্বারা তিনি এই সমস্যার সবচেয়ে উত্তম সমাধানটি ভেবে বের করে ফেলেছিলেন এরই মধ্যে আমিও ভাবছিলাম পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধ হলে এসএফএফ-কে কাজে লাগানাের জন্য উপযুক্ত এলাকা কোনটা হতে পারে আমার ছিল দ্বৈত ক্ষমতা মুজিববাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার পর আমার দায়িত্ব ছিল বাংলাদেশ অঞ্চলের গভীরে তাদের পাঠানাে এবং সামগ্রিক বিদ্রোহটাকে নিয়ন্ত্রণ করা এটা করা যেত যদি বাংলাদেশ সীমান্তে কর্মরত আমার সেক্টর কমান্ডারদের সঙ্গে সংযােগ রাখতাম কিন্তু আমি ভাবলাম সবচেয়ে ভাল হয় বাংলাদেশের মধ্যে গভীর অভ্যন্তরে কোনও এক নিরাপদ এলাকায় প্রবেশ করে সেখান থেকে এই গােটা অপারেশনটা দেখাশােনা করা। এবং সেজন্য বিচ্ছিন্ন পার্বত্য চট্টগ্রামের চেয়ে ভাল আর কী হতে পারে? আমি আরও চাচ্ছিলাম এই ফোর্সটা কিছুটা স্বাধীন ভূমিকা পালন করুক যাতে আমরা এবং ভারতীয় আর্মি একে অপরের পথে না এসে পড়ি।

আমার একটা স্বাভাবিক অনীহা ছিল লড়াই -এর এমন কোনও ভূমিকায় যেখানে আপনার রণকৌশলগুলি বলে দেবে একজন অনমনীয় নিয়মিত সৈনিক যার হাতে থাকবে আপনার সকল অ্যাকশনের জন্য প্রয়ােজনীয় সকল সামগ্রী একটা গেরিলা ফোর্সের জন্য এর চেয়ে কম ফলদায়ক আর কিছু হতে পারে না। সুতরাং আমি প্রার্থনা করছিলাম যে এই যুদ্ধে অংশ নিতে যদি এসএফএফ -এর ডাক আসে তাহলে আমাকে যেন দুরূহ কিন্তু উপযুক্ত রণক্ষেত্র পার্বত্য চট্টগ্রাম দেওয়া হয় যেখানে আমি আর্মি হতে কম-বেশি স্বাধীন থেকে আমার লােকদেরকে উদ্যোগ গ্রহণের পূর্ণ সুযােগ দিতে পারব। আমাদের বিপুল সৌভাগ্য যে শেষ পর্যন্ত তাই-ই হয়েছিল। আর্মি চীফ আমাকে ডেকে পাঠালেন যুদ্ধে স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্স -এর ভূমিকা সম্পর্কে তার মনে কী আছে তা ব্যাখ্যা করে বললেন  এটা আমি যা কল্পনা করেছিলাম ঠিক তাই। আমাদের মনের মিল হল এবং আমাকে অবিলম্বে কাজটির জন্য প্রস্তুত হতে বলা হল। আমি বেশ খুশি মনে ফিরে আসলাম এবং অপারেশনের সেই এলাকায় ঢুকে পড়ার জন্য আমার পরিকল্পনাগুলি তৈরি করতে শুরু করলাম । আমাদের গােপন স্থানান্তর প্রক্রিয়া একটা নির্দিষ্ট পর্যায় পর্যন্ত বিমান পরিবহনের সাহায্যে সম্পন্ন হওয়ার কথা ছিল। সেখান থেকে আর্মির গাড়িসমূহ আমাদের রাস্তার মাথা পর্যন্ত আমাদেরকে নিয়ে যাবে। এই স্থানটিতে আমাদের সবাই একত্রিত হবে এবং সেখান থেকে তাদের পায়ে হেঁটে সামনে বাড়তে দেওয়া হবে স্বশরীরে সরঞ্জামাদি বহন করে। এর মানে দাঁড়াল এক জটিল স্থানান্তর পরিকল্পনা যা অন্যান্য এজেন্সিসমূহের সদিচ্ছা এবং দক্ষতার ওপর বিরাটভাবে নির্ভর করছিল এবং এর বিশদ ছকের শেষটা পর্যন্ত ঠিক ঠিক সম্পন্ন করা আবশ্যক ছিল  এই মতাে যখন পরিকল্পনা করা চলছিল তখন আমি আর্মি সদর দফতর থেকে বহু প্রতীক্ষিত আদেশনামা পেলাম ‘ইনস্ট্রাকশন -এর আকারে।

বড়ম্বরে লঘু ক্রিয়া

আর্মির মধ্যে ইনস্ট্রাকশন’ শব্দটা দিয়ে বােঝানাে হয় একজন স্বাধীন কমান্ডারের প্রতি সেই আদেশ যার দ্বারা গ্রহীতা অপারেশন চালানাের ক্ষেত্রে প্রায় সম্পূর্ণ উদ্যোগ নিজের হাতে পায়। ইনস্ট্রাকশন হচ্ছে একটা গাইডলাইন এবং সেটা বিদ্যমান পরিস্থিতির আলােকে যথাসম্ভব সবচেয়ে ভালভাবে প্রয়োেগ করতে হয়। এটা পরিষ্কার ছিল যে ফোর্সটি সরাসরি চীফ অব আর্মি স্টাফ (সিওএএস) -এর নির্দেশের অধীনে কাজ চালাবে, ঈস্টার্ন আর্মি কমান্ডার -এর নির্দেশের অধীনে নয় । কাছাকাছি আর্মি কোরগুলির সঙ্গেও এর কোনও কিছু করণীয় থাকবে না। এ ব্যবস্থায় কাজের সর্বাধিক স্বাধীনতা থাকল, শুধু এটুকু ব্যতিক্রমসহ যে আকাশ থেকে সরবরাহ নামিয়ে দেওয়া এবং মােটরযানের ব্যাপারে আমরা জিওসি-ইন-সি ঈস্টার্ন কমান্ড লেফটেন্যান্ট-জেনারেল অরােরার ওপর নির্ভরশীল ছিলাম। এ পর্যন্ত ভালই ছিল, কিন্তু বিভিন্ন কাজের বরাদ্দটা পাঠ করে আমি চমকে গেলাম । এসএফএফ-কে বলা হয়েছিল কাপ্তাই বাঁধ এবং কিছু সেতু এবং যােগাযােগ ব্যবস্থা উড়িয়ে দিতে, ঐ এলাকায় মােতায়েন পাক বাহিনীর ওপর সাধারণভাবে হয়রানি চালিয়ে যেতে, যাতে পাক সংরক্ষিত অতিরিক্ত সেনাদলের এ এলাকায় আসতে হয় এবং আক্রমণকারী কোরের পার্শভাগ নিরাপদ হয়। মৌখিকভাবে চীফ অব আর্মি স্টাফ বলেছিলেন যে এটা তার জন্য সন্তুষ্টির চেয়ে বেশি কিছু হবে যদি এসএফএফ এই কাজগুলি নির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ী সম্পন্ন করতে পারে। এটা স্পষ্ট হল যে আর্মি সদর দফতর এই ফোর্সের সম্ভাবনা সম্বন্ধে নিশ্চিত ছিল না। কিন্তু এর সম্ভাবনা ছিল যে সব কাজ দেওয়া হয়েছিল তার চেয়ে অনেক বেশি। তাছাড়া আমি ব্যগ্রভাবে চাচ্ছিলাম। যে এই লােকেরা তাদের একেবারে প্রথম অ্যাকশনে বিশাল একটা কিছু সাফল্য অর্জন করুক যাতে তাদের মনােবল বাড়ে এবং প্রমাণ হয় যে জাতি শান্তির সময় এই বাহিনীর পিছনে যে অর্থ ব্যয় করেছে তা সার্থক ব্যয় ছিল। আমি চীফ অব আর্মি স্টাফ -এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এই কার্যভারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে বললাম যে এতে আমার লােকদেরকে উদ্দীপিত করার মতাে যােগ্য চ্যালেঞ্জ অনুপস্থিত। তিনি একটু নরম হলেন, আমি কী চাই তা জানতে চাইলেন। আমি বললাম-“আমাকে চট্টগ্রাম বন্দর দখল করাটা আমার প্রধান কাজ হিসাবে দিন। কাপ্তাই বাঁধ ভাঙার মতাে অন্য কাজগুলি অতিরিক্ত কাজ হিশাবে ঠিক ঠিক জায়গা মতাে এসে পড়বে। এটা লােকগুলির সামনে একটা উপযুক্ত চ্যালেঞ্জ হিশাবে আসবে এবং আমার অপারেশনে গতিবেগ দান করবে।” তিনি বললেন-“তুমি কিভাবে এই শক্তপ্রতিরােধযুক্ত জায়গাটা দখল করবে? তােমার তাে বিমান ও আর্টিলারি সমর্থন থাকবে তােমার এমনকি ভারী মর্টারও নেই।” আমি বললাম-“সেটা আমাদের ওপর ছেড়ে দিন। আমরা আপনার বিশ্বাসের উপযুক্ত বলে নিজেদেরকে প্রমাণ করব।”

তিনি কথা দিলেন আমার অনুরােধ তিনি পরে বিবেচনা করবেন। আমি অনুভব করলাম যে আমাদের ওপর এমন একটা ভারী দায়িত্ব দেওয়ার আগে যুদ্ধে আমাদের সামর্থ্যের কিছু প্রমাণ তিনি দেখতে চান এবং এজন্য আমি তাকে দোষ দিই না। আর্মির মধ্যে এই ফোর্সের বিরুদ্ধে এত বেশি প্রতিকূল প্রচারণা বছরের পর বছর চালানাে হয়েছে যে স্যাম মানেকশ’র মতাে সমদর্শী পক্ষপাতহীন কমান্ডারও তার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। এর মধ্যে ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী শ্রী ডিপি ধর আমাকে ডেকে পাঠালে আমি আমাদের যােগ্যতা সম্বন্ধে তাকে প্রত্যয়ন করার এক সুবর্ণ সুযােগ পেয়ে গেলাম আমি তাকে বললাম যে আমার মস্ত আকাক্ষা হচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দর দখল করার পর, নৌপথে ঢাকার দিকে অগ্রসর হওয়া, গােপনে মুজিববাহিনীর সহায়তা নিয়ে ১শ’ এসএফএফ সেনাকে ঢাকায় অনুপ্রবেশ করিয়ে দেওয়া এবং ঐ শহরে ইতিপূর্বেই গােপনে কর্মরত প্রায় ২ হাজার মুজিববাহিনীর ছেলেকে আরও কর্মসচল করে তােলার মাধ্যমে সেখানকার শত্র সেনাদের মধ্যে ব্যাপক ধ্বংস ঘটানাে এসব করলে শক্রর মনােবল এমনভাবে ভেঙে যাবে যে কাছে-পিঠে ভারতীয় আর্মির সেনা দেখা মাত্রই সে আত্মসমর্পণ করবে। আমার মুজিববাহিনীর নেতারা সবাই অপারেশনসমূহ তাড়াতাড়ি শেষ করার এই পরিকল্পনার বিচক্ষণতা ও যােগ্যতার ব্যাপারে প্রত্যয়ী ছিলেন। আমরা ঐ সময় সন্দেহ করছিলাম যুদ্ধকে দীর্ঘায়িত করা হতে পারে যাতে পাক মিত্র ও বন্ধুর পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য হস্তক্ষেপ করার সুযােগ পায় । আমি মানচিত্রের ওপর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখিয়ে এসব ব্যাপার শ্রী ডিপি ধর -কে বুঝিয়ে দিলাম তিনি কথা দিলেন আমাকে প্রথমেই চট্টগ্রাম বন্দর দখল করার দায়িত্ব দেওয়ার জন্য চীফ অব আর্মি স্টাফকে চাপ দেবেন আমি জানতাম চীফ অব আর্মি স্টাফকে বােঝানাে যায় কিন্তু চাপ দেওয়া যায় না। এবং বােঝনাের সবচে’ ভাল উপায় হচ্ছে আমাদের সামর্থ্যের প্রমাণ সুতরাং আমি ঠিক করলাম সম্ভাব্য সবকিছু করব যাতে বড় রকমের সাফল্য আসে, একেবারে শুরুতেই যেন বিশাল বিজয় অর্জিত হয়। আমি পুরা পরিকল্পনাটা আমার বেসামরিক চীফ শ্রী আরএনকাও -এর কাছে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে বলেছিলাম।

আমার ওপর তার প্রচুর বিশ্বাস ছিল। অবশ্য এসএফএফ -এর ধারণার একদম সূত্রপাত থেকে আর্মি ও এসএফএফ -এর মধ্যে চলে আসা বােঝাপড়ার অভাব এবং তার ওপর আর্টিলারি ও বিমান সমর্থনের সম্পূর্ণ অনুপস্থিতি দৃষ্টে আমরা শেষ পর্যন্ত কী ফলাফল অর্জন করতে পারব সে ব্যাপারে তিনি সন্দিহান ছিলেন। আর্মি আমাকে যে প্রশাসনিক সহযােগিতা দানের কথা দিয়েছিল এমনকি সে ব্যাপারেও তিনি তেমন নিশ্চিত ছিলেন না। একই ব্যাপারে আমার নিজেরও ভয় ছিল। কিন্তু একেবারে জন্মগত আশাবাদী হওয়াতে এবং ঈশ্বরের ওপর বিশ্বাস রেখে আমি ভেবেছিলাম যে সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে যাবে। অবশ্য আমার সবচেয়ে বড় সংঘাতটা হয় আমার সংগঠনের এয়ার উইং -এর সাথে । তারা তাদের ফ্লীট থেকে এমনকি দুইটা পুরনাে হেলিকপ্টারও এই অতীব গুরুত্বপূর্ণ অপারেশনের জন্য আমার কমান্ডে ছেড়ে দিতে প্রস্তুত ছিল না। সংশি-ই পরিচালক মনে হল সেগুলিকে ঘাটিতে রেখে দিতে অত্যন্ত আগ্রহী, যাতে যুদ্ধে সেগুলি ক্ষতিগ্রস্ত না হয় । এই বেসামরিক কর্তার কাছে তার হেলিকপ্টারগুলির নিরাপত্তার তুলনায় সৈনিকদের জীবন এবং এই অপারেশনের সাফল্য কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল বলে দেখা গেল। এক্ষেত্রে মনের মিল ঘটল না । আমার বেসামরিক চীফ শেষ পর্যন্ত চমৎকার ক্রু সমেত একটি হেলিকপ্টার আমার জন্য জোগাড় করে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। কল্পনা করুন স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্স -এর মতাে সম্ভাবনাময় ফোর্স একটা অতীব গুরুত্বপূর্ণ অপারেশনে নামল একটি মাত্র হেলিকপ্টার নিয়ে, যেখানে প্রয়ােজন ছিল কমপক্ষে ছয়টা। এমন সব বড় বড় প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও আমরা যে বিশিষ্ট সাফল্যসমূহ অর্জন করেছিলাম তা দেখিয়ে দেয় কী বিপুল তেজ ও উদ্দীপনা এ সময়ে স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্স-কে ব্যাপ্ত করে রেখেছিল।

সূত্র : ফ্যান্টমস অব চিটাগং-দি ফিফথ আর্মি ইন বাংলাদেশ – মেজর জেনারেল (অব.) এস এস উবান

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!