স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্স (এস এফ এফ) সম্পৃক্ত হল
বাংলাদেশ যুদ্ধের বিবরণে অতীন্দ্রিয়বাদের কথা আনা আমার উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু কিছু অদ্ভুত ব্যাপার ঘটেছিল । আমি আমার স্ত্রীকে নিয়ে ১৯৭০ সনের ডিসেম্বরে আমার আধ্যাত্মিক গুরু বাঙালি সাধু বাবা ওংকারনাথ -এর সান্নিধ্যে কয়েকটা দিন কাটানাের জন্য বেনারস গিয়েছিলাম। গঙ্গা নদীতে অজ্ঞাতবাসে কাল যাপনের জন্য বাবা দুটি নৌকা ভাড়া করেছিলেন, একটি রান্নার কাজে একটি থাকার কাজে ব্যবহারের জন্য। সকল শিষ্য ও ভক্তদের বিদায় করে দেওয়া হয়েছিল, কেবল তার দেখাশােনার জন্য জনা চারেককে রাখা হয়েছিল। বাবার বয়স ছিল আশি, অজ্ঞাতবাসে তার দৈনন্দিন প্রয়োজনের দেখাশােনা করার জন্য দু’এক জন লােক তার দরকার ছিল। অবশ্য তিনি যথেষ্ট সদয় হয়ে আমাকে ও আমার স্ত্রীকে, দুজনকেই তাঁর সঙ্গে ঐ মনােরম ও ঐশ্বরিক আবাসে থাকতে দিয়েছিলেন। আমরা চারটি চমৎকার দিন বাবার সার্বক্ষণিক সাহচর্যে নাম সংকীর্তনের মিষ্টি সুর শুনে কাটিয়ে দিলাম । (বাবা ২৪ ঘণ্টাই তার গায়ক শিষ্যদের এক বিশেষ দলের গাওয়া নামগান-গানে গানে ঈশ্বরের নাম-শুনতে অত্যন্ত আগ্রহী ছিলেন)। সেই পবিত্রতম নদীর বুকে খেলে যাওয়া বিশাল তরঙ্গ আর তার মধ্যকার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বীচিমালাই তাে ছিল সংগীতের মতাে। সকাল সন্ধ্যায় নদী পেরিয়ে ভেসে আসত মন্দিরের ঘণ্টার সুরেলা ধ্বনি। সান্ধ্য আরতি শােনা যেত, নদীর পার ধরে শত শত আলাে জ্বলে উঠত । গঙ্গার পবিত্র জলে ভক্তদের ভাসিয়ে দেওয়া অজস্র বাতি চোখে পড়ত। বেনারসের গঙ্গার গভীর জলের ওপরে প্রশান্ত নির্জনতায় ঈশ্বরভাব -এ পরিপূর্ণ এই সাধুর মহান উপস্থিতি আমাদের চিত্তভাবকে অনেক ওপরে তুলে দিত। আজ পর্যন্ত আমি জানি না কেন বাবা আমাকে চার দিন ধরে তাঁর সঙ্গে নদীবক্ষে বাস করানাের মতাে অসাধারণ একটা কাজ করলেন, এবং ঠিক যখন আমার জগৎ আমি ভুলে যেতে বসেছি ঠিক তখনই তিনি আমার অজ্ঞাতবাসের অবসান ঘােষণা করলেন। এই খবরটা ছিল আমার জন্য ভীষণ আতঙ্কস্বরূপ। আর কোনওদিন আমি এমন মনােরম সময় কাটাইনি বা সংসারের কামনা-বাসনা থেকে নিজেকে এমন মুক্ত মনে করিনি। আমরা বেনারসে ফিরলাম। নদী পার হয়েই বাবা আমাদেরকে নিয়ে বেনারসের মন্দিরগুলিতে ঘুরে বেড়ালেন। আমরা যখন দুর্গামন্দিরে (দুর্গা হচ্ছে শক্তি, ঈশ্বরের শক্তির দিকটিই হচ্ছে দুর্গা) প্রবেশ করলাম, আমি কৌতুকভরে বাবাকে বললাম এই দৈবের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিতে। তিনি আমার হাত ধরলেন এবং সেই সুন্দর অথচ ভয়ঙ্কর শক্তির মূর্তির প্রতি সম্বােধন করে বললেন“মা, এই হচ্ছে সুজন। সে শিগগিরই যুদ্ধে যাবে। তাকে রক্ষা করাে, এবং তার বাহিনী ও ভারতের জন্য সম্মান ও বিজয় এনে দাও।”
এরপর তিনি মন্দির থেকে বের হয়ে যেতে লাগলেন, আমার ডান হাত ধরে তাঁর পিছনে পিছনে আমাকে টানতে টানতে। মন্দির থেকে বের হওয়ার পর আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম কোন যুদ্ধে আমাকে পাঠাচ্ছেন। ঐ সময় বিশ্বে বিশেষ কিছু ঘটছিল না কেবল মধ্যপ্রাচ্য ও ভিয়েতনামের দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের এলাকায় ছাড়া এবং সেখানেও ভারত সংশি-ষ্ট হতে পারে এমন মনে হওয়ার মতাে কিছু ছিল না, স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের সংশি-ষ্ট হওয়া তাে আরও দূরের কথা। বাংলাদেশে এমনকি শেখ মুজিবও জানতেন না তার দেশের জন্য কী অপেক্ষা করছে। পাকিস্তানের ব্যাপারে ইতিহাসের ক্রান্তিলগ্ন, ২৫ মার্চ ১৯৭১, তখনও অনেক দূরে। সামগ্রিক অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছিল শেখ সাহেব অর্থনৈতিক স্বায়ত্তশাসনসহ ছয় দফা নিয়ে এগিয়ে যাবেন এবং সম্ভবত পাকিস্তান শাসন করবেন একজন মহান গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রনেতা হিশাবে- সেভাবেই খ্যাতিমান ছিলেন তিনি। বাবা আমার প্রশ্নের কোনও উত্তর দিলেন না, সােজা হন হন করে হেঁটে গেলেন তার বেনারস আশ্রমের দিকে, স্বর্গীয় সংগীতের মিষ্টি সুরে যে স্থানটা আচ্ছন্ন হয়েছিল । ১৯৭১ -এর এপ্রিলে বাংলাদেশ থেকে আমাদের দেশে সাংঘাতিক রকম বিপুল সংখ্যায় শরণার্থী আসল কিন্তু প্রথম দিকে মনে হল এটা এমন একটা সমস্যা যাতে পাকিস্তানের সঙ্গে পারস্পরিকভাবে সন্তোষজনক ব্যবস্থায় শরণার্থীদের খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে, তাদেরকে আশ্বাস দিতে হবে এবং নিজেদের দেশে ফেরত পাঠানাে যাবে। শেখ মুজিব সম্বন্ধে খবর ছিল যে তিনি পাকিস্তান কর্তৃপক্ষের হাতে গ্রেফতার হয়ে আছেন, যদিও কেউ কেউ, স্বাধীন বাংলা বেতারসহ, ঘােষণা করেছিল যে তিনি বাংলাদেশের মধ্যে থেকে একটা স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালনা করছেন। কেউ কেউ বলল যে তিনি মৃত এবং অস্থায়ী সরকারের মধ্যেকার কেউ কেউ এমনভাবে কাজ করছিলেন যেন তিনি জীবিত থাকলেও পাকিস্তান কখনও তাকে তার নিজের দেশে ফেরার সুযােগ দেবে না। সপ্তায় সপ্তায় উত্তেজনা বাড়তে লাগল। দেখা গেল পরাশক্তিরা এবং আরও কিছু শক্তি ঐ লক্ষ্যেই কাজ করে যাচ্ছে, চেষ্টা করছে সর্বতােভাবে ভারতকে ভীত করতে ও পাকিস্তানের সাহস বাড়াতে।
পাকিস্তানি আর্মি পাগলের মতাে পূর্ব ও পশ্চিম উভয় অংশে যুদ্ধের জন্য তৈরি হচ্ছিল এবং তার মিত্র চীন কলহের আগুনকে উস্কে দেওয়ার সাথে সাথে তিব্বতে কিছু কিছু প্রস্তুতিমূলক সৈন্য সঞ্চালন করছিল । এ ধরনের পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের মতাে অবস্থায় আছে এমন যে কোনও দেশ একটি আকস্মিক ও উস্কানি-বিনা আক্রমণের বিরুদ্ধে পূর্বসতর্কতামূলক ব্যবস্থাদি গ্রহণ করে পারে না। বাংলাদেশে পাকিস্তানিদের দ্বারা সংঘটিত পাইকারি হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করতে সাহায্য করায় বিশ্বের জাতিসমূহকে বুঝিয়ে রাজি করতে স্বয়ং ভারতের প্রধানমন্ত্রীর মাসের পর মাস ব্যর্থ চেষ্টার পুরস্কার হিশাবে ভারত পেল পাকিস্তানিদের গােলাবর্ষণ যা সােজা আঘাত করল ত্রিপুরা, কাছাড় এবং মেঘালয় রাজ্যের রাজপথগুলিতেও, পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তের বরাবর গ্রামগুলিতে তাে বটেই। যুবনেতারা তাদের পাক শাসকদের এই মতলবের ব্যাপারে ভাল রকম সজাগ ছিলেন। সুতরাং শুরু থেকেই তারা চরম কিছুর জন্য নিজেদেরকে তৈরি করছিলেন এবং এমনকি যখন তাদের সাময়িক সরকার গল্পগুজবে ও দ্বিধাদ্বন্দ্বে কাল কাটাচ্ছিল তখন তারা শক্ত ও সােজা হয়ে দাঁড়ালেন তাদের একমাত্র ভালবাসা পরিপূর্ণ স্বাধীনতার জন্য তাদের শেষ রক্তবিন্দু বিসর্জন দিতে স্থিরপ্রতিজ্ঞ হয়ে। তাদের অস্থায়ী সরকারের মধ্যেও এমন উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন লােক ছিলেন যারা নীতির ব্যাপারে একই রকম আপশহীন ছিলেন, যারা ডুবিয়ে দিচ্ছিলেন সেই সব দুর্বল কণ্ঠস্বর যা তখনও আত্মসংবরণ ও পুনর্মিলনের পরামর্শ দিত।
আমার ডাক পড়ল
যা চলছে তা অল্প সময়ে শেষ হওয়ার মতাে ব্যাপার নয় এমনটা সন্দেহ করে ভারত সরকার অপ্রচলিত (গেরিলা যুদ্ধের একজন বিশেষজ্ঞ হিশাবে আমাকে ডেকে পাঠাল, বলল সীমান্ত এলাকাগুলি পরিদর্শন করে ও মানুষের সঙ্গে কথাবার্তা বলে একটা প্রতিবেদন পেশ করতে । আমি তড়িঘড়ি সংশিষ্ট সীমান্ত এলাকাগুলি পরিদর্শন করে এবং বাংলাদেশের বেশ কতক যুবনেতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে একটি প্রতিবেদন পেশ করে দিলাম। আমার ব্যক্তিগত পরিদর্শন থেকে মানচিত্র যা দেখায় তারই সত্যতা প্রতিপন্ন হল; তা। হল বাংলাদেশ গেরিলা যুদ্ধের স্বর্গ। বন এবং পাহাড়, নদীনালা, হ্রদ ইত্যাদি অনেক অংশকেই দুর্গম করে রেখেছে । তবু সেখানে রয়েছে মাছ -এর্গির প্রাচুর্য যা একটা গেরিলাবাহিনীকে স্বাধীনভাবে কাজ করে যেতে রসদ জোগাবে। তার ওপর যদি আপনি মাথায় রাখেন মােহভঙ্গ হয়েছে এবং ক্রুদ্ধ হয়ে আছে এমন সাড়ে ৭ কোটি মানুষের এক জনসংখ্যাকে তাহলে আন্দাজ করতে পারবেন সামরিক আইন কর্তৃপক্ষের কী বিশাল বাহিনীর দরকার হবে ঐ দেশটার যে কোনও অংশে শাস্তি শৃঙ্খলার স্রেফ বহিৰ্দশ্যটুকু বজায় রাখার জন্য। আমি ভাবলাম গেরিলা যুদ্ধ পাকিস্তানের সৈন্যবল ও অন্যান্য সম্পদ নিঃশেষে শুষে নেবে যদি তা কখনও এই পূর্বাঞ্চলকে নিজের অধিকারে রাখার জন্য যুদ্ধ চালিয়ে যেতে মনস্থ করে। দীর্ঘকাল ধরে গেরিলা যুদ্ধ চালানাের তেমনি কিছু অসুবিধাও আছে। এতে কম-দৃঢ় মনােভাবাপন্ন বেসামরিক জনসাধারণের মনােবল ভেঙে যেতে পারে শুধু শক্রর প্রতিশােধের কারণেই নয় বরং এ পরিস্থিতিতে প্রাকৃতিক সম্পদের অনটন ঘটনার কারণেও। এটা শত্রুপক্ষে বিদেশি তথাকথিত বিশেষজ্ঞ আকৃষ্ট করে। তারা এটাকে বিবেচনা করে একটা দাবা খেলা বলে, যা তারা খেলবে ক্লাব এবং বেশ্যাখানা থেকে; তারা যুদ্ধের আগুনে যথেষ্ট তেল ঢেলে জ্বালিয়ে রাখতে চাইবে, যাতে তাদের আরাম আর সুবিধাবলি অনির্দিষ্টকালের জন্য বজায় থাকে। কালক্রমে এটা সংলগ্ন দেশগুলিকেও। ক্ষতিগ্রস্ত করে তুলবে। সুবিধা অসুবিধা উভয় দিক নিয়ে আমার চিন্তা ভাবনা তখনও শেষ হয়নি এমন সময় আমার পরিচিত হওয়ার সৌভাগ্য হল কালচে রঙের কাঠিপানা এক যুবকের সঙ্গে দুজনারই এক বন্ধুর বাসায়। আমার মনে হয় তখন মে মাস ছিল। এ বাঙালি যুবকটি তখন সবে ঘুম থেকে উঠেছেন, যে ঘুমটা সত্যি তার খুব পাওনা ছিল। তিনি চোখ ডলতে ডলতে ড্রয়িং রুমে ঢুকলেন।
চোখ দুটি তার ভাল রকমেই লাল রং ধারণ করেছিল। আমরা একসঙ্গে চা -এ চুমুক দিলাম। তিনি ছিলেন মনােমুগ্ধকর, সতর্ক এবং সংবেদনশীল। একটা সরল ইস্কুলছাত্রের মতাে ভােলা মনে তিনি আমার সমস্ত প্রশ্নের। উত্তর দিলেন। এ ছিল তােফায়েল আহমেদ। আয়ুব এই যুবককে কেনার জন্য যে কোনও কিছু দিতে রাজি হতেন। জেনারেল ইয়াহিয়া একবার গ্রাম এলাকায় সফরকালে তাঁর একমাত্র নিরাপত্তা প্রহরী হিশাবে ঐ যুবকের ওপর নির্ভর করেছিলেন। সেখানে মানুষ এই যুবককে রীতিমতাে পূজা করত। তিনি অধৈর্য কলেজ ছাত্রের মতাে তড়বড়িয়ে কথা বলতে লাগলেন কিন্তু শিগগিরই শান্ত হয়ে সেই মায়ামুগ্ধকার হাসি হাসলেন যে হাসি সােজা তার হৃদয় হতে উঠে আসত। তিনি তার অপর তিন সহকর্মীর কথা বললেন এবং শিগগিরই তাদের মধ্যে দুজন দেখা দিলেন। একজন আব্দুর রাজ্জাক, আওয়ামী লীগ পার্টির সেই যুবনেতা, এবং তারপর সিরাজুল আলম, সেই আগুনের মশাল যিনি নিজেকে পুরােপুরি বিক্রি করে দিয়েছিলেন তার দেশের কাছে, অন্য কোনও আকাক্ষা যার ছিল না। শেখ ফজলুল হক মনি আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন অনেক পরে। মনির সঙ্গে সাক্ষাতের পর আমি বুঝেছিলাম প্রশংসনীয় গুণের অধিকারী অমিত আত্মত্যাগের মনােভাবসম্পন্ন এই চারজনের কাছ থেকে ঠিক কাজ পাওয়া যাবে এবং তাদেরকে বিশ্বাস করে দায়িত্ব দেওয়া যাবে । এই নেতারা আমাকে খােলামনে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে বললেন বাংলাদেশে তারা যে নিষ্ঠাবান রাজনৈতিক কর্মীদের সংগঠন রেখে এসেছেন তার কথা। বললেন যে সেসব কর্মীরা সাহসী, পরিপক্ক এবং উচ্চ সম্মানিত। তাদের শুধু দরকার সঠিক গেরিলা ধরনের প্রশিক্ষণ এবং উপযুক্ত অস্ত্রশস্ত্র তারা আরও বললেন যে তারা ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িকদের ছাড়া আর কেবলমাত্র কিছু কম্যুনিস্ট ক্যাডারদের বিরুদ্ধে যারা তাদের চীনা ও পাকিস্তানি পৃষ্ঠপােষকদের জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করছে; তারা এসব লােকদের সঙ্গে কোনও অবস্থাতেই সহযােগিতা করতে প্রস্তুত নন, তাতে করে যদি স্বাধীনতা আরও কয়েক বছর পিছিয়ে যায় এবং আরও বেশি ত্যাগ স্বীকার করতে হয় তাতেও তারা রাজি। তারা বললেন বাংলাদেশে তাদের বিরােধীরা হচ্ছে সুবিধাবাদী এবং তাদের কোনও নীতি নেই।
মােজাফফর গ্রুপে (রুশপন্থী-কম্যুনিস্ট গ্রুপে) তাদের কিছু বন্ধু ছিল কিন্তু তাঁদের বক্তব্য অনুসারে এই গ্রুপের শ্রমিক বা ছাত্রদের মধ্যে উলে-খ করার মতাে অনুসারী দল ছিল। পরে আমি শ্রী ডি পি ধর -এর অনুরােধে অধ্যাপক মােজাফফর -এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলাম এবং দেখেছিলাম তার লক্ষ্যে তিনি মােটামুটি নিষ্ঠাবান ছিলেন। ঘটনা হিশাবে আমি এখানে উলে-খ করতে পারি যে ১৯৭১ এর অক্টোবর মাসে হৃষীকেশে বাংলাদেশের মওলানা ভাসানীর সঙ্গে আমার দেখা হয়। তিনি একটা অত্যন্ত আরামদায়ক লিমুযিনে চড়ে মহান বাঙালি সাধু বাবা ওংকারনাথ -এর সঙ্গে দেখা করতে হৃষীকেশস্থ তার আশ্রমে এসেছিলেন। ভাসানী ভারতে হিন্দুবিদ্বেষী হিশাবে ভাল রকম পরিচিত ছিলেন এবং দেশভাগের সময় বিপুল হিন্দু হত্যার জন্য দায়ী ছিলেন বলে তার খ্যাতি ছিল, সুতরাং এটা আশ্চর্যজনক ব্যাপার ছিল যখন কিনা তিনি একদল ভারতীয় সরকারি অফিসার এবং তার নিজের সচিবদের সঙ্গে গাড়ি থেকে নামলেন। নব্বই বছর বয়সে তাঁকে নিটোল স্বাস্থ্যবান মনে হচ্ছিল। আমার সঙ্গে তিনি শিখদের সাহস সম্বন্ধে। কথা বললেন। তিনি এমন ধারণা দিলেন যে তিনি ভারতকে ভালবাসেন এবং তার দেশের মুক্তিতে ভারতীয় সশস্ত্র সহযােগিতা আশা করেন। বাবাও তাঁর সম্বন্ধে অনেক কিছু শুনেছিলেন কিন্তু তার প্রতি দ্রতা ও সম্ভম দেখালেন। মওলানা ভাসানী বাবাকে বাংলায় জিজ্ঞেস করলেন বাংলাদেশ মুক্ত হবে কি না এবং কত তাড়াতাড়ি। বাবা উত্তর দিলেন “তুমি যেটা চাইছ তা ঈশ্বর ইতিমধ্যে মঞ্জুর করে দিয়েছেন এবং শিগগিরই তা ঘটে যাবে। এটা এখন শুধু ভবিষ্যতের জন্য ঈশ্বর যেমন ইচ্ছা করেন সে অনুযায়ী ইতিহাসের পাতা উল্টানাের প্রশ্ন মাত্র।” মওলানা ভাসানী এই উত্তরে খুব খুশি হলেন এবং তার সচিবকে কথাটা ডাইরিতে লিখে রাখতে বললেন এই মহান সাধুর ভবিষ্যদ্বাণী হিশাবে। তারপর বাবা তাকে আশ্রম ঘুরে দেখালেন, সেখানকার সকল কার্যক্রম তাকে ব্যাখ্যা করে বললেন এবং শেষটায় মওলানা ও তার বন্ধুদেরকে তাঁর নিজের বসার ঘরে বসিয়ে ফল (প্রসাদ) খেতে দেওয়ার আদেশ করলেন। এটা ছিল বাবার শুভেচ্ছার এক বিরল নিদর্শন; আমি নিশ্চিত যে মওলানা তা অন্তর দিয়ে বুঝেছিলেন এবং চলে যাওয়ার আগে বাবার প্রতি প্রচুর সম্মান প্রদর্শন করেছিলেন। বেশ কিছুকাল যাবতই বাবা বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য প্রার্থনা করে চলেছিলেন।
এই সময় তার হৃষীকেশ আশ্রমে যথারীতি দুর্গা পূজা চলছিল। পূজার শেষে মূর্তি গঙ্গানদীতে ডুবিয়ে দেওয়া হয়। এবার কিন্তু মূর্তিকে যথাদিবসে বিদায় দেওয়া হল না। বাবা সবাইকে বললেন : “মা আমার সঙ্গে আরও কিছুটা বেশি সময় ধরে থাকবেন। আমার কতগুলি জিনিশ আলােচনা করতে হবে। দেখা গেল তিনি কাঁদছেন এবং মূর্তির প্রতি এমনিভাবে কথা বলছেন : “মা, আমি আজ রাতে গঙ্গা নদীতে ডুবিয়ে তােমাকে বিদায় দেব। এই নদীর পানির সঙ্গে সােজা বাংলাদেশে চলে যাও। সেখানে হাজার হাজার মানুষ কাঁদছে । তাদেরকে নির্যাতন করা হচ্ছে, অপমানিত করা হচ্ছে, হত্যা করা হচ্ছে। তাদের তুমি রক্ষা করাে মা, জানােয়ারগুলিকে ছুড়ে ফেলে এবং ঈশ্বরপ্রেমী এই জাতিকে তুমি মুক্ত করাে। তারা তােমার ওপর নির্ভর করে আছে মা, সুজন এবং আমার আরও কিছু শিষ্য সেখানে যাবে এই যুদ্ধে লড়ার জন্য। তাদের রক্ষা করাে। তাদের জন্য সম্মান ও গৌরব এনে দাও, ও দুবৃত্তিনাশিনী…।” ঐ রাতে তিনি অশ্রুসজলচোখে ঐ মূর্তির কাছ থেকে বিদায় নিলেন এবং তার ঘনিষ্ঠ সহযােগীরা জানল কোথায় যুদ্ধ হবে এবং তার ফল কী । যুদ্ধের পরে আমাকে এসব কথা বলা হয়েছিল। এই সময়ের মধ্যে আমাকে বাংলাদেশের জন্য এই দুর্ধর্ষ গেরিলাবাহিনীর প্রশিক্ষণ ও সংগঠনের সামরিক-রাজনৈতিক দায়িত্ব দেওয়া হয়ে গিয়েছিল । রিক্রুটিং করার কথা ছিল যুবনেতাদের । এই নেতাদের সঙ্গে পরামর্শ করে সমগ্র গেরিলা অপারেশন পরিকল্পনা করার এবং আমার ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধানে সে পরিকল্পনা কাজে পরিণত করার কথা ছিল আমার। স্বীয় আত্মার সন্তুষ্টির জন্য এর বেশি চাওয়ার মতাে আমার কিছু ছিল না। আমার সমস্ত সময় এ কাজে ঢেলে দিলাম। টেক্সট বই ঘেটে সমাধান করা যাবে এমন ব্যাপার এটা ছিল না। এটা ছিল অনন্য কিছু, এর জন্য দরকার ছিল পরিপূর্ণ ও পুঙ্খানুপুঙ্খ সমীক্ষা এবং আমার সমগ্র কর্মশক্তি। এইসব যখন চলছিল তখন আমি ভাবছিলাম যে বর্তমানে পাকিস্তান কর্তৃক মােতায়েন করা হিংস্র পাঠান ও মিযাে আধা-সামরিক বাহিনীগুলির বিরুদ্ধে, পার্বত্য চট্টগ্রামের কিছু সর্বাপেক্ষা দুর্গম জঙ্গলাকীর্ণ ভূমিতে স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্সকে লাগিয়ে দেওয়ার এ এক চমৎকার সুযােগ হতে পারে। এই পাক আধা-সামরিক বাহিনীগুলি পাক বিমানবাহিনীর দ্বারা এবং নিয়মিত পাক আর্মি ব্রিগেডসমূহ দ্বারাও সমর্থিত ছিল এবং এরা আমাদের আর্মির সবচেয়ে স্পর্শকাতর পাশ্বভাগের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তার চেয়ে বড় কথা এরা আরাকান রােড দখলে রাখছিল।
আমাদের আর্মি দ্বারা পরাজিত হলে পাক সৈন্যদের জন্য বার্মায় পলায়নের একমাত্র স্থলপথ হত এই আরাকান রােড যতদূর বােঝা গেল জেনারেল মানেকশ’ও একই রকম চিন্তা করেছিলেন এবং একদিন আমাকে ডেকে পাঠালেন এই সম্ভাবনাটা সম্বন্ধে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য। আমাদের মনের মিল হয়ে গেল এবং আমি এই স্পেশাল ফোর্স অব নর্দার্ন হিল ট্রাইবসকে এই নতুন ঝুকিপূর্ণ কাজের জন্য তৈরি করার কাজ শুরু করলাম । এই ফোর্সের লীডাররা এবং জওয়ানরা এই কাজে যােগ দেওয়ার পরিপূর্ণ অর্থ বুঝতে বেশি সময় নেয়নি। তারা লিখিতভাবে আবেদন জানাল তাদের যেন এতে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হয় এবং পাকিস্তান যদি কখনও এদেশের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেয় তাহলে তারা যেন দেশের জন্য কিছু করার সুযােগ পায় । কৃতজ্ঞতার সাথে এ আবেদন গ্রহণ করা হল। এখন আমার। দুইটা ফাইটিং কমান্ড হল। সরাসরি এসএফএফ একটি কমান্ডাে বাহিনী হিশাবে, এবং মুজিববাহিনী (গেরিলা বাহিনী), পরে যাদেরকে জেনারেল স্যাম মানেকশ’র নাম অনুসারে স্যামস বয় (SAMS boys)-ও বলা হত। জেনারেল মানেকশ’ জনাব। তাজউদ্দিনকে বলেছিলেন যে তিনি নিজে এই বাহিনী গড়ে তুলেছেন আর্মির পক্ষে বিশেষ বিশেষ কর্মভার গ্রহণ ও সম্পন্ন করার জন্য। এতে করে কারা তাদের সৃষ্টি করেছে এবং কোন উদ্দেশ্যে, এই মর্মে পুরননা যে বিতর্ক ছিল তার অবসান হয়ে গেল। কিন্তু প্রথমেই আমরা মিযােদের সম্বন্ধে এবং সংশি-ষ্ট এলাকা সম্বন্ধে আলােচনা করব। এ দুটিই খারাপের দিকে পরিস্থিতির মােড় ঘুরিয়ে দিতে পারত।
সূত্র : ফ্যান্টমস অব চিটাগং-দি ফিফথ আর্মি ইন বাংলাদেশ – মেজর জেনারেল (অব.) এস এস উবান