এই লেখাটা মেজর জেনারেল (অব.) এস এস উবান এর “ফ্যান্টমস অব চিটাগং-দি ফিফথ আর্মি ইন বাংলাদেশ” বই থেকে হুবহু নেয়া হয়েছে।
পাকিস্তানি সৈন্যরা কেমন অধঃপাতে গিয়েছিল
২৫ মার্চ ১৯৭১ -এর পরে বাংলাদেশে পাকিস্তানি সৈন্যদের দ্বারা অনুষ্ঠিত নৃশংসতার ধরন দেখে ব্যক্তিগত স্যাডিযমকে তার উৎস বলে শনাক্ত করা যায় না। সেসব নৃশংসতা ছিল অত্যন্ত ঘন ঘন সংঘটিত, সংখ্যায় অত্যন্ত বেশি এবং পাকিস্তানি আর্মির অজস্র লােক তাতে সংশিষ্ট ছিল। পাকিস্তানি আর্মির অফিসার ও জওয়ানদের দেশভাগের আগে আমার চেনা ছিল। তাদের ব্যবহার সততাপূর্ণ, ঋজু এবং পেশার উপযুক্তই ছিল। তারা এসেছিল ধার্মিক ও সম্রান্ত ভূস্বামীদের পরিবার থেকে এবং তাদের হিন্দু ও শিখ সহকর্মীদের মতােই তাদেরও স্ত্রীজাতির প্রতি শ্রদ্ধা ছিল। তাদের মধ্যে কিছু কিছু এমন ছিল যারা যে কোনও সম্প্রদায়ের একজন নিরপরাধ নারীর সম্ভ্রম রক্ষার্থে খুশিমনে নিজের জীবন দিয়ে দিতে পারত। অতঃপর তাদেরকে যখন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমানের বাংলাদেশে) তার প্রতিরক্ষা ও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার কাজে নিয়ােজিত করা হল তখন গােটা পাকিস্তানি আর্মির ক্ষেত্রে কী অঘটন ঘটল। প্ররােচনা যেমনই হােক, একটা গােটা ফোর্স নিশ্চয়ই এমন উন্মত্ত হয়ে উঠতে পারে না। প্রত্যেকটা অফিসার ও জওয়ান একযােগে অমন মারমুখাে (trigger-happy) হয়ে উঠতে পারে না, এবং মেয়েদেরকে তাদের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের সামনে প্রকাশ্য দিবালােকে, যেন ড্রিল করছে এমনভাবে, বলাৎকার করা, যৌন লিলা পরিতৃপ্ত করার জন্য অবশ্যই হতে পারে না। এমনকি মানুষ রূপে যারা জানােয়ার, তারাও এমন পাশবিকতা উপভােগ করতে পারে।
এই ফোর্সের এই বিচ্যুতির ব্যাপারে বাধ্যবাধকতা ছাড়া আর একমাত্র কারণ যতদূর দেখা যায় তা হচ্ছে রাজনেতিক মতান্ধ শিক্ষা। এর সঙ্গে যােগ করা যায় কতক উর্ধ্বতন অফিসারের নিজেদের জীবনের ভাগ্য পরিবর্তনের লক্ষ্যে রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষকে প্রভাবিত করার জন্য প্রকাশিত নির্বোধ ধর্মান্ধতা ও স্বার্থপর অত্যুৎসাহিতা। সন্ত্রাসের মাধ্যমে রাজনৈতিক পরিস্থিতি বাগে আনার জন্য ইয়াহিয়া খান জেনারেল টিক্কা খানকে বাছাই করেন যখন কিনা তার ক্ষয়ে যাওয়া সামরিক মস্তিষ্কে এর চেয়ে ভাল কোনও চিন্তা আসছিল না। কিন্তু জেনারেল ইয়াহিয়া খান আকস্মিক রােষভরে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এমনটি হতে পারে না । ইতিপূর্বে সমগ্র পাকিস্তানকে তিনি বলেছিলেন যে শেখ মুজিব ভবিষ্যতে প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন। ঐ দেশটির প্রথম নির্বাচনে শেখ যে বিপুল সমর্থন লাভে সক্ষম হন, তার ফলে ইয়াহিয়া এই বিবৃতি দিয়েছিলেন এবং শেখের নেতৃত্বে পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ রূপরেখা কেমন হবে তা আলােচনা করার কথা বলে তিনি ঢাকায় এসেছিলেন। স্পষ্টতই পরিকল্পনাটা তা’ দিয়ে ফুটানাে হয়েছিল সেইসব বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতাদের অনুরােধে যারা পাকিস্তানে কর্তৃত্বপূর্ণ ভূমিকা লাভ করতে চাইছিলেন। এই অতি জঘন্য পরিকল্পনার পিছনে যার চিন্তা প্রধানত কাজ করেছিল সে হচ্ছে পাকিস্তান পিও’স পার্টির প্রধান জনাব ভুট্টো। পাকিস্তানের পশ্চিম অংশে তিনি ভাল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিলেন, যদিও তা শেখ মুজিবের পাওয়া সংখ্যাগরিষ্ঠতার মতাে অমন বিপুল ছিল না। পাকিস্তানের একনায়ক রাষ্ট্রপতি হতে জনাব ভুট্টোর উচ্চাভিলাষ মাটিতে আছড়ে পড়েছিল জনসাধারণের কণ্ঠ উচ্চকিত হয়ে ওঠা মাত্র। যে কোনও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেই এই ফলই হত। জনাব যেডএ ভুট্টোই আবার সামরিক আইন জারি করে বেলুচিস্তানের মুসলমান ভাইদের কসাই হিশাবে কুখ্যাত জেনারেল টিক্কা খানকে পাঠানাের উপদেশ দিয়েছিলেন। তাঁদের প্রয়ােজন ছিল একজন ধর্মান্ধ সৈনিকের যার কাছে “ইসলাম বিপন্ন” এই আওয়াজটিই যথেষ্ট হত নিরপরাধ স্বধর্মীদের ওপর জঘন্য হত্যালীলায় নিয়ােজিত হওয়ার সময় বিবেকের কণ্ঠ শ্বাসরুদ্ধ করার জন্য। সেই নিরপরাধ স্বধর্মীদের একমাত্র দোষ হল তারা সমান বলে গণ্য হতে চেয়েছিল, একটা রাষ্ট্রের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হতে নয়, যে রাষ্ট্রের জন্য তারাই তাদের পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের তুলনায় অনেক বেশি আত্মত্যাগ করেছিল।
সমস্ত প্রাপ্তব্য নিদর্শন দেখায় যে, বহু চিন্তাভাবনা করে পরিকল্পনাটা করা হয়েছিল যার অনেক কিছুই চেঙ্গিস খানের ওপর লিখিত বই থেকে নেওয়া। ইয়াহিয়া খান ঢাকায় পৌছলেন এবং দেখালেন যেন সমস্যার একটা ন্যায়সম্মত মীমাংসার জন্য আলােচনা চালাচ্ছেন। তিনি শেখ মুজিবের সঙ্গে দীর্ঘ আলােচনা করলেন। শেখ মুজিব, যেমন আশা করা গিয়েছিল, তার নীতিতে অনড় রইলেন। ইতিপূর্বেই জেনারেল টিক্কা খানকে সামরিক আইন প্রশাসক হিশাবে পাঠানাে হয়ে গিয়েছিল। তার এই অফিস গ্রহণের আগে যে শপথ বাক্য পাঠের প্রয়ােজন হয় তা তাঁকে পাঠ করাতে বাংলাদেশের কেউই রাজি হননি। এটা দেখায় সামরিক আইন প্রশাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ কতদূর ব্যাপক হয়েছিল। ইসলামাবাদে খবর পেীছল যে রাজনৈতিক সমাধান সম্ভব নয়। শেখ মুজিবের ন্যূনতম দাবি ছিল পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ স্বায়ত্তশাসন যাতে প্রতিরক্ষা ও বৈদেশিক ব্যাপার ছাড়া আর সব ধরনের ক্ষমতা থাকবে। কিন্তু এই আনুকূল্যটুকু মঞ্জুর করার বিন্দুমাত্র ঝোঁক সেই সাম্প্রদায়িক একনায়কত্বের ছিল না। জনাব ভুট্টোর উচ্চাভিলাষ বাধার সম্মুখীন হয়েছিল। সে পরিপ্রেক্ষিতে তিনি সাম্প্রদায়িকতার আগুন আরও বেশি উস্কে দেওয়ার পথ গ্রহণ করলেন। তাতে করে তিনি সামরিক শক্তির প্রধান পীঠস্থান পাঞ্জাবে আরও বেশি জনপ্রিয়তা অর্জন করলেন। সেখানে চিৎকার উঠল- “সকল বিচ্ছিন্নতাবাদীকে হত্যা করাে। তাদেরকে একটা শিক্ষা দাও। মুজিব একটা ভারতীয় এজেন্ট । সকল বাঙালিই হিন্দু। তারা সবাই ষড়যন্ত্রকারী, তারা নিকৃষ্ট জাতি। সত্যিকার মুসলমান হওয়ার জন্য তাদের নতুন রক্ত দরকার, রাজকীয় পাঞ্জাবি রক্ত দরকার। জেনারেল টিক্কা খানকে সেখানে পাঠাও।” জেনারেল টিক্কা খানকে শুধু জেনারেল ইয়াহিয়া খান বােঝালেন না, বােঝালেন জনাব ভুট্টোও, যিনি ইসলামের নয়া রক্ষাকর্তা হিশাবে জনপ্রিয়তার ঢেউ -এর চূড়ায় ওঠে বসেছিলেন। পর্যায়ক্রমে জেনারেল টিক্কা বােঝালেন আর্মি সিনিয়র কমান্ডারদেরকে এবং এমন এক দল অফিসারকে বেছে নিলেন যারা একটা মুসলিম আর্মি কর্তৃক একটা মুসলিম জনগণের ওপর ব্যাপক হত্যাযজ্ঞের ব্যাপারটা বুঝতে পারবে। সে দেশের সবাই হিন্দুদের ওপর হত্যাযজ্ঞটা ভালই বুঝত কিন্তু অল্প কতকেই বুঝত কেন ঠাণ্ডা মাথায় সব মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করতে হবে, কেন সব মুসলিম যুবতিকিশােরীদেরকে বলাৎকার করতে হবে, যেটা হবে যৌনলিলা পরিতৃপ্তির ব্যাপার নয় বরং ধর্মীয় কর্তব্যের ব্যাপার, নীল-রক্তের এক নতুন প্রজন্ম উৎপাদন করার জন্য। অনেক পদকে ভূষিত লেফটেন্যান্ট-জেনারেল নিয়াযি একজন দৃঢ়চেতা কমান্ডার হিশাবে নির্ভরযােগ্য বলে বিবেচিত হলেন।
তিনি বেসামরিক জনগণের ওপর পাইকারি হত্যালীলা চালানাের পলিসি নিরবচ্ছিন্নভাবে চালাতে এবং শেষটায় সেই হত্যালীলার শিকারদের সাহায্যে আসা ভারতীয় আর্মির সঙ্গে শেষ সৈন্যটি নিহত হওয়া পর্যন্ত শেষ রাউন্ড পর্যন্ত যুদ্ধ চালাতে পারবেন। আপশ -শ্রীমাংসার জন্য আলােচনার মিথ্যা ভড়ং -এর আড়ালে জাহাজের পর জাহাজ ভর্তি সৈন্য পাঞ্জাব ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত থেকে এসে পৌছল। বিপুল সংখ্যক বেলুচ ও পাঠান আধা-সামরিক লােক আনা হল শুধু তাদেরকে বাঙালি নারীদের ওপর লেলিয়ে দিতে নয় বরং তাদের এও বুঝিয়ে দিতে যে তারা তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার দাবি। করতে থাকলে কিরূপ ফল তারা ভােগ করবে। “ইসলাম’ (পাঞ্জাবে যেমন বােঝাত) -এর স্বার্থে বাংলাদেশের তরফ থেকে আরও বেশি আত্মত্যাগের জন্য আবেদন করে যে সকল ভাবপ্রবণ যুক্তি হাজির করা হচ্ছিল তা সব শেখ সাহেব চূড়ান্তভাবে প্রত্যাখ্যান করলেন। তখন কোনও কারণ ছাড়াই ভুট্টো ঢাকায় এসে উদিত হলেন আসলে তিনি এসেছিলেন সামরিক আইন প্রশাসক ইয়াহিয়া খানের দোদুল্যমান চিত্তে শক্তি জোগাতে এবং মুজিবের মতাে গণ্ডগােল সৃষ্টিকারীদের কিভাবে শায়েস্তা করা যায় তার পরামর্শ দিতে সকল প্রস্তুতি যখন শেষ তখন জেনারেল টিক্কা চট্টগ্রামের নিরস্ত্র শ্রমিকদের ওপর গুলি। চালিয়ে স্পষ্ট করে দিলেন তিনি তাঁর দায়িত্ব সম্পর্কে কতটা পরিষ্কার দিনটা ছিল ২৩ মার্চ, সমস্ত আলােচনা আকস্মিকভাবে বন্ধ করে দিয়ে জেনারেল ইয়াহিয়া যেদিন বিমানযােগে ইসলামাবাদের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন তার ঠিক এক দিন আগে। শত শত শ্রমিককে হত্যা করা হল। তাদের মরদেহ কবরস্থ হল না, খােলা জায়গায় পড়ে রইল পচার জন্য ঢাকা ত্যাগের আগে ভূট্টো, টিক্কা ও তার দলবলের এ ধরনের কাণ্ড দেখে এতটা সন্তুষ্ট হলেন যে তিনি বলেছিলেন-“খােদাকে ধন্যবাদ পাকিস্তান রক্ষা পেল।” আমি আশা করি একদিন বাংলাদেশ সরকার পাকিস্তান আর্মি কর্তৃক বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত নৃশংসতার এক প্রকৃত সত্য ও ভাল রকম দলিলাদি সংবলিত প্রতিবেদন প্রকাশ করবে। শেখ মুজিব একজন মহান রাষ্ট্রনেতার মতাে এবং পরম বদান্যতায় শুধু যে ৯৩ হাজার পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিকে মুক্তি দেওয়ায় সম্মত হয়েছিলেন তাই নয়।
এমনকি তাদের মধ্যকার ৯৩ জন মহা-অপরাধীকেও ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপারে সম্মত হয়েছিলেন যারা এমন অমানবিক কদাচারে নিজেদেরকে ঢেলে দিয়েছিল যা হয়তাে এমনকি বর্বর জাতিসমূহের প্রাচীন ইতিহাসেও দেখা যায় না। মুক্তিযােদ্ধারা নিজেদের চোখে দেখা নৃশংসতার যে বিবরণ প্রায়ই দিত তেমন কিছু ব্যাপার এখানে নমুনা হিশাবে তুলে দেওয়া হচ্ছে । আরও বেশি বেদনাদায়ক স্যাডিস্ট কার্যকলাপের বিবরণ, যদিও তারও চোখে দেখা সাক্ষী বর্তমান, এখানে দেওয়া হচ্ছে না যেহেতু উদ্দশ্য হচ্ছে এই শােকাবহ ব্যাপারের কারণ উদঘাটন করা, বাংলাদেশিদেরকে এবং বিবেকসম্পন্ন অন্য মানুষদেরকে তীব্র মর্মবেদনা দেওয়া নয়। প্রথম বড় ধরনের হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল ২৩ মার্চ ১৯৭১ তারিখে জেনারেল ইয়াহিয়া যেদিন ইসলামাবাদে ফিরে যাওয়ার জন্য বিমানযােগে ঢাকা ত্যাগ করলেন তার একদিন আগে। ঐদিন হাজার হাজার মানুষ চট্টগ্রাম বন্দরের কাছে সমবেত হতে শুরু করেছিল। তারা ছিল প্রধানত নিরীহ গ্রামীণ মানুষ। জমায়েত নিষিদ্ধ করে কোনও সরকারি আদেশ তখন ছিল না। কোনও রকম পূর্ব সংকেত ছাড়াই তাদের ওপর স্বয়ংক্রিয় অন্ত্রের গুলি হল। এবং শীঘ্রই পুরা এলাকাটা মৃতদেহে ভরে গেল পরে মৃতের সংখ্যা দেখা গেল চার হাজারের উপরে । লাশগুলি সাগরে ছুড়ে ফেলা হয়েছিল।
২৫ মার্চ ১৯৭১ পাকিস্তানি সেনারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করে সােজা চলে গেল। জগন্নাথ হলে, যেটা ছিল হিন্দু ছাত্রদের হােস্টেল। এক শ’র বেশি ছাত্রকে তাদের কক্ষে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হল।পরদিন সকালে আর্মি ইউনিটগুলি আবার আসল । আগের দিন যারা আহত হয়েছিল তাদেরকে তারা একত্র করল। তাদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের প্রধান ডক্টর জিসি দেব-ও ছিলেন। তাদেরকে তারা হুকুম করল বিভিন্ন কক্ষে যেসব মৃতদেহ ছিল সেসব হলের অঙ্গনে একত্রে জড়ো করতে রক্তাক্ত পঙ্গু মানুষগুলির জন্য এ ছিল এক কঠিন ও বেদনাদায়ক কাজ কিন্তু তবু তাদের তা করতে হল কাজটা করা হয়ে গেলে ডক্টর জিসি দেব সহ আহত সকলকে মৃতদেহগুলির কাছাকাছি লাইন দিয়ে দাঁড় করানাে হল এবং নিষ্ঠুরভাবে গুলি করে হত্যা করা হল। তারা সবাই ছিল হিন্দু। হিন্দুদের হত্যাকারীদেরকে মুসলমানদের ঈশ্বর পুরস্কৃত করেন বলেই ঐ হত্যাকারীদের বিশ্বাস ছিল। ২৫ মার্চ ঢাকা নিউমার্কেটের নিকটস্থ বাবুপুরা বস্তির সকল ঘর আগুনে-বােমা দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হল। এ বস্তির বাসিন্দাদের প্রায় সকলে ছিল মুসলমান রিকশাওয়ালা। আগে থেকেই প্রয়ােজনীয় সংখ্যক মেশিনগান প্রস্তুত রাখা হয়েছিল জীবন্ত আগুনে দগ্ধ হয়ে মরা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য যারা পালাতে চাইবে তাদেরকে ঝাঝরা করে দিতে।
তারা কাউকেই রেহাই দেবে না নারী ও শিশুরা পুরুষদের সঙ্গে একযােগে একই ভাগ্য বরণ করল এক হাজারের বেশি মানুষ এই নরককুণ্ডে জ্বলে মরল। তারা। সবাই ছিল মুসলমান। তাদের একমাত্র দোষ ছিল তারা তাদের মতাে অজস্র মানুষের অংশ হিশাবে তাদের দুর্দশাগ্রস্ত জীবনযাপনের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ উপার্জন করতে আগ্রহী ছিল। ২৬ মার্চ নীলক্ষেত ও হাটখােলার মধ্যেকার রেল লাইনের পাশের বস্তি ঘরগুলির মুসলমান বাসিন্দাদের ওপরও একই ব্যবস্থা নেওয়া হল । আগুন-বােমা ও মেশিনগান শেষ করে দিল বিপুল সংখ্যক মানুষকে, যারা আর্মির কসাইগুলিকে চোখে দেখার সুযােগও পেল না। পুরনাে ঢাকা নগরী এলাকায় নয়া বাজার বস্তির বাসিন্দা মুসলমান আওয়ামী লীগ সমর্থকদের ওপরও একই ব্যবস্থা নেয়া হল তবে কিছুটা দয়াপূর্ণ ব্যবস্থা হিশাবে তাদের। অল্পবয়স্ক মেয়েদেরকে আর্মি ক্যাম্পে সরিয়ে নেওয়া হল বলাৎকারের জন্য। ২৫ মার্চ রাতে পাক সেনারা চট্টগ্রামের ঈস্ট বেঙ্গল রাইফেলস সদর দফতরে আক্রমণ চালাল। এই ঈস্ট বেঙ্গল রাইফেলস গঠিত ছিল অনুগত বাঙালিদের নিয়ে, তারা প্রায় ২৫ বছর ধরে পাক আর্মির অংশ হিশাবে কাজ করছিল কিন্তু তাদেরকে আর আস্থাভাজন মনে করা যাচ্ছিল না, কারণ, জানা গিয়েছিল যে তারা মুজিবের স্বায়ত্বশাসন আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল পাকিস্তানের সেবা করার জন্য প্রশিক্ষণ নিচ্ছিল এমন এক হাজার লােককে লাইন দিয়ে দাঁড় করিয়ে মেশিনগানের সাহায্যে শেষ করে। দেওয়া হল ২৫ মার্চে সিলেটে কারফিউ বলবৎ করা হল বাসিন্দাদেরকে কোনও বিজ্ঞপ্তি না দিয়েই মসজিদ থেকে নামাজ পড়ে বের হয়ে আসা একজন বৃদ্ধ লােককে গুলি করে হত্যা করা হল তারপর আর্মির লােকেরা তার দুই ছেলেকে বলল লাশ সরিয়ে নিতে তারা যখন লাশের কাছাকাছি এগিয়ে আসল তখন তাদের দুজনকেও গুলি করে হত্যা করা হল। এই তিনটি লাশের স্তুপ জনসমক্ষে পচতে দেওয়া হল অন্য যারা মসজিদে নামাজ পড়ার জন্য বেরুতে পারে তাদের জন্য শিক্ষা হিসাবে আরেকটি ঘটনার উদ্ধৃতি এরকম যে, মসজিদে নামাজরত সারি সারি মুসলমানকে মেশিনগানের গুলিতে হত্যা করা হয়েছিল এই মন্তব্যসহ যে তারা প্রকৃত মুসলমান নয় সুতরাং তাদের মসজিদে নামাজ পড়ার অধিকার নেই । সড়ক ও রেল লাইনের উভয় পাশের ঘরগুলিকে প্রণালীভাবে লুট করার পর সেগুলি জ্বালিয়ে দেওয়া হল সকল নারীকে, এমনকি কিছু বৃদ্ধ নারীকেও, তাদের পুরুষ আপনজনদের সামনে বলাকার করা হল, পরে পুরুষদেরকে গুলি করে হত্যা করা হল।
২৭ মার্চ সিলেট শহরে ঘরে ঘরে গিয়ে তলাশি করা হল। বেশির ভাগ মানুষ আগেই গ্রামাঞ্চলে পালিয়ে গিয়েছিল। যেসব মহিলা রয়ে গিয়েছিল তাদের সবাইকে বলাৎকার করা হল তাদের একজন ছিল ৬০ বছর বয়সের বৃদ্ধা একটা মেয়েকে বলাৎকার করার পর তারা তার স্তুন টুকরা টুকরা করে কেটে ফেলল । মেয়েটা পড়ে গেল এবং সেখানেই মৃত্যুবরণ করল। দালালরা, তা বিহারি হােক বা বাঙালি হােক, রেহাই পেত না যেখানে নারী-ধর্ষণের ব্যাপার জড়িত ছিল। গাহিরার একজন মুসলিম লীগারের মেয়ে পাক সেনাদেরকে চা খেতে দেওয়ার পর তারা তাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। পাকিস্তানিদের জন্য কাজ করছিল, জিকাতলা মানকেশ্বরের এমন একজন মুসলমান। ইঞ্জিনিয়ারকে জোর করে দেখতে বাধ্য করা হয়েছিল প্রকাশ্য দিবালােকে পাক সেনাদের দ্বারা তার মা, তার স্ত্রী ও তার শ্যালিকার ধর্ষিত হওয়া। ৩১ মার্চ দিবাভাগে পাক আর্মি বিহারি রিফুজীদের সঙ্গে নিয়ে চট্টগ্রাম শহরের পাহাড়তলি এলাকায় আক্রমণ চালালে প্রায় ৩ হাজার বাঙালি নিহত হল এবং সকল মহিলা ধর্ষিত হল প্রায় ৫শ’ সুন্দরী মেয়েকে টেনে নেওয়া হল ক্যান্টনমেন্টে। অসংখ্য পুরুষ তাদেরকে বলাৎকার করত। এদের মধ্যে একটি মেয়ে মন্তব্য করেছিল বলে জানা যায় যে, এতগুলি জানােয়ারের ধর্ষণের যন্ত্রণা তবু সহ্য করা যায় কিন্তু শরীরের মধ্যে অত্যধিক পরিমাণ শুক্র জমা হওয়ায় যে উত্তাপ সৃষ্টি হয় তা সহ্য করা যায় না। ১৯৭১ -এর এপ্রিল মাসটা বিশেষত শুক্ৰস্থাপনের কাজের জন্য সংরক্ষিত ছিল। ১০ এপ্রিল চট্টগ্রাম জেলার ফটিকছড়ি থানার নিযিরাহাট নামক গ্রাম ঘিরে ফেলে কাউকে হত্যা করা হয়নি, কোনও ঘরে আগুন দেওয়া হয়নি বা কোনও সম্পত্তি লুট করা হয়নি; শুধু প্রায় ২০০ জন সুদর্শনা মেয়েকে পাকিস্তানিরা বলাকার করেছিল এবং তাদের স্বামী ও পিতামাতাকে ঐ ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখতে বাধ্য করা হয়েছিল তারা সবাই ছিল মুসলমান। ৪ এপ্রিলে পাকিস্তানিদের একজন উৎসাহী দালাল জামাত-ই-ইসলামীর সদস্যের কন্যাকে তার এবং অন্যদের সাক্ষাতে চারজন পাকিস্তানি সৈন্য বলাকার করেছিল। দিনাজপুর জেলার শতকরা প্রায় চল্লিশ ভাগ মানুষ ছিল হিন্দু। তাদের মধ্যে অল্পই ভারতে পালাতে পেরেছিল কিছু হিন্দু ইসলামে ধর্মান্তরিত হওয়ার আবেদন করেছিল নির্যাতন-পূর্বক মৃত্যুর যন্ত্রণা থেকে বাঁচার আশায় । কাউকেই রেহাই দেওয়া হয়নি। সবাইকে গুলি করে হত্যা করে একটা গর্তে মাটি চাপা দেওয়া হয়েছিল ।
জনৈক শীতল সরকারের বক্তব্য অনুযায়ী ঠাকুরগাঁও -এর উত্তর-পশ্চিমে প্রায় ৭ মাইল দূরে সিঙ্গিয়া নামক গ্রামে তখন পর্যন্ত হিন্দুরা বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে রাখায় ঐ গ্রামের গােটা হিন্দু জনসংখ্যা প্রায় ১৫০০ জন মানুষকে আধঘণ্টার মধ্যে হত্যা করে হিন্দুদের নিজেদের দ্বারাই খোঁড়ানাে দুইটি বড় গর্তে মাটি চাপা দেওয়া হয়েছিল । চট্টগ্রাম শহর সম্ভবত সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ ভুগেছিল। ৫/৬ এপ্রিল শহরটিকে অবরুদ্ধ করে ফেলে সব বাড়িঘর লুট করা হয়েছিল, মহিলাদের বলাৎকার করা হয়েছিল, বলাৎকারের পরে নগ্ন মহিলাদের গবাদি পশুর মতাে বাঁধা অবস্থায় হাঁটিয়ে নদীতে নেওয়া হয়েছিল গােসল করানাের জন্য। রামগড় মিলিটারি ক্যান্টনমেন্টে ৫০ জন মেয়েকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তাদের প্রত্যেককে প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ জন লােক বলাকার করত। বলাৎকারের সময় পাকিস্তানিরা “জয় বাংলা” বলে চিৎকার করত, যা ছিল মুক্তিযােদ্ধাদের রণধ্বনি, এবং তাদের শিকার হতভাগ্য মেয়েদেরকে তাদের পিতা ‘শেখ মুজিব’ -এর সাহায্য চেয়ে চিৎকার করার জন্য বলত এখানে এসব দুর্ভোগে যারা ভুগেছিল তারা সবাই ছিল উচ্চ এবং মধ্য শ্রেণির মুসলমান। ২৬ এপ্রিল বিহারিরা (অবাঙালি) ঢাকাতে তাদের ভাষায় প্রতিশােধ দিবস’ পালন করল পাক আর্মির পূর্ণ সহযােগিতায়। ঢাকায় যে এলাকা বাছাই করা হয়েছিল তা হচ্ছে মিরপুর ও শ্যামলির মাঝামাঝি জায়গায় কারণ এখানে বাস ছিল উচ্চ ও মধ্য শ্রেণির মুসলমান গভর্নমেন্ট সার্ভেন্টদের পাক সৈন্যদের দ্বারা পুরা এলাকাটা অবরুদ্ধ হল বিহারি অবাঙালিরা তাদের স্যাডিস্ট আকাক্ষা চরিতার্থ করতে ঝাপিয়ে পড়ল। লুটপাট ও হত্যাযজ্ঞের পর তারা প্রতিটি নারীকে বলাৎকার করল যখন বলাকার চলছিল তখনও হত্যা চলছিল। প্রায় ৩ হাজার বাঙালি জীবন হারাল। কেউ জানে না কত নারী জীবন হারানাে ছাড়াও সমমও হারিয়েছিল এগুলি ছিল কিছু কারণ যেজন্য বিহারিদেরকে বাংলাদেশে নাগরিকত্ব দেওয়া হয়নি। আরেক ধরনের নিষ্ঠুরতা অনুষ্ঠিত হত যা ছিল ইতিহাসে অভূতপূর্ব। কারফিউ -এর সময়ে পাকিস্তানি সেনারা যত অল্পবয়স্ক বালকদের বাড়িগুলিতে পেত তাদের ধরে নিত, একত্র করত। তাদের চোখ বেঁধে হাতকড়া পরিয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে নেওয়া হত তাদের সমস্ত রক্ত বের করে নেওয়ার জন্য। পরে তাদের মৃতদেহগুলি বুড়িগঙ্গা নদীতে ছুড়ে ফেলা হত । সারা বাংলাদেশের অনেক জায়গায় এটা করা হয়েছে বলে জানা যায়।
রক্ত সঞ্চালনের প্রয়ােজন আছে এমন মরণাপন্ন পাক সৈনিকের জন্য বাঙালি রক্ত তাে আর তেমন একটা খারাপ নয়, তাছাড়া সেটা পাঞ্জাবি মুসলমানের রক্তধারায় প্রবেশ করার পর পবিত্ৰীকৃতও হয়ে যায়। মে ‘৭১ -এর প্রথম সপ্তায় প্রায় ২শ’ পাক সৈন্য ঢাকা ও কুমিল- জেলার সীমান্তের ওপর গজারিয়া থানার একটি গ্রামে হামলা চালিয়ে কোনও রকম উস্কানি ছাড়া শত শত নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করল এবং তাদের সম্পত্তি লুট করল ও নারীদের বলাৎকার করল। এ কাজ সম্পন্ন করার পর পাক সৈন্যরা গজারিয়া ইউনিয়নের মুসলিম লীগ চেয়ারম্যান কর্তৃক এক ভােজনে আমন্ত্রিত হল। এ লােকটি গােড়া থেকে পাকিস্তানিদের সাহায্য করে আসছিল। অন্যান্যদের সঙ্গে তার নিজের কন্যাও খাবার পরিবেশন করেছিল। এই কন্যাটিকে কোম্পানি কমান্ডার জোর করে মিলিটারি ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়ার পর আজ পর্যন্ত কেউ ঐ হতভাগ্য মেয়েটির পরিণতির কথা বলতে পারে না । অনেকে হাফিয মিয়া নামের এক মুসলমানের ওপর ভয়ঙ্কর নির্যাতনের ঘটনার কথা। বলেছিল । সিলেট জেলার শ্রীমঙ্গল শহরে, যা আগে মুক্তিবাহিনীর হাতে পড়েছিল, ২৮ এপ্রিল সকাল সাড়ে ৭টায় পাক বিমানবাহিনী বােমাবর্ষণ করলে অনেক মানুষ নিহত হল এবং বাকিরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পালিয়ে গেল । ২৯ এপ্রিল পাক সৈন্যরা শহরটা পুনর্দখল। করল, সেখানে সম্পত্তি লুট করল এবং তাদের সর্বোচ্চ প্রথা অনুযায়ী নারীদের বলাৎকার করল। তারা জনৈক হাফিয মিয়াকে গ্রেফতার করল । হাফিয মিয়া থানার একটি খাদ্য গুদামের দায়িত্বে ছিল এবং বােকার মতাে দায়িত্ব স্থান ছেড়ে পালিয়ে যায়নি। সত্য হচ্ছে, লােকটি নিজের আনুগত্যের ব্যাপারে এত গর্বিত ছিল যে তার কোনও আত্মীয়কেও পালিয়ে যেতে দিতে দিল না কারণ সে আশা করছিল সামরিক আইন কর্তৃপক্ষ শহরটি পুনর্দখল করে তাকে বড় রকমে পুরস্কৃত করবে। কিন্তু হাফিয মিয়াকে মুক্তিবাহিনী কর্তৃক এক বিহারি রেলওয়ে স্টেশন মাস্টারকে হত্যার ব্যাপারে সাহায্য করার জন্য এবং এলাকার জনগণকে তার গুদামের কিছু খাদ্যদ্রব্য নিয়ে। যেতে দেওয়ার জন্য সন্দেহ করা হল । অন্য গুদামগুলি যে লুট করা হয়েছিল এবং সেগুলির যে আর অস্তিত্বই ছিল না সে ব্যাপারটা গ্রাহ্যই করা হল না।
হাফিয মিয়ার গুদামটাই তখন পর্যন্ত অক্ষত ছিল এবং তাতে খাদ্যদ্রব্যের মজুতও ছিল। মৃত স্টেশন মাস্টারের পরিবারের উপস্থিতিতে হাফিয মিয়ার শরীরের হাড় মাংস একটু একটু করে কাটার হুকুম দেওয়া হল, আর তার নিজের পরিবারের সদস্যদের ওপর নির্যাতন করা হতে লাগল তার ওপর ঐ ধীর কিন্তু সবচেয়ে যন্ত্রণাদায়ক নির্যাতনের ফাকে ফাকে। প্রথমে হাফিয মিয়ার আঙ্গুলগুলি কেটে ফেলা হল, তারপর তার হাত, বাহু এবং পাগুলি কেটে ফেলা হল। সে যখন যন্ত্রণায় গােঙাচ্ছিল ও চিকার করছিল, তখন তার পরিবারের সদস্যদের ওপর একের পর এক নির্যাতন করা হচ্ছিল। অনেকগুলি ঘণ্টা ধরে এই বিভৎস লীলা চলল। হাফিয মিয়ার তিন মেয়েকে বলাৎকার করা হল এবং তাদেরকে ধরে নিয়ে যাওয়া হল, আর কোনও দিন তাদের কথা শােনা গেল না। পরে কুটি সেন বলে একজন হিন্দু লােককে ধরা হল যে ভারতে পালাতে পারেনি। ফুটবল মাঠে সমবেত একদল মুসলিম লীগারের হাতে তাকে দেওয়া হল এক পাক আর্মি অফিসার একটা বক্তৃতা দিল যা একজন তর্জমাকারী বাঙালি মুসলিম লীগারদের বুঝিয়ে দিল । বক্তৃতার সারকথা ছিল যে, সব হিন্দু হচ্ছে ভারতের দালাল এবং মুসলমানদের উচিত ধর্মীয় কর্তব্য হিশাবে তাদেরকে হত্যা করা। কুটি সেনকে দড়ি দিয়ে বেঁধে ঠেলে মাটিতে ফেলা হল একটা পবিত্র কাজ হিশাবে উপস্থিত সকলে তাকে পদাঘাতে পদাঘাতে হত্যা করল কুটি সেনের পুত্র বাবলা সেন ভারতে পৌছেছিল এবং ঘটনাটির বিবরণ শুনে সে গােপনে ফিরে এসে পিতার মৃতদেহের অবস্থা দেখে আত্মহত্যা করার উদ্যোগ নিল । তবে কিছু লােক তাকে অন্যরকম যে দিন আসছে তার অপেক্ষায় আত্মহত্যা থেকে নিরস্ত হতে বলল এবং সে তাই করল সে তার বাবার মৃতদেহের সকার করল কিন্তু হাফিয মিয়ার দেহের কিছু কিছু অংশ তখনও পড়ে ছিল যা শেয়ালেও খেয়ে শেষ করেনি। সিলেট জেলার মৌলবিবাজার পুনর্দখল করা হল এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহে। শহরটা লুট করা হল এবং সকল সন্দেহভাজনকে হত্যা করা হল। সকল সুদর্শনা মেয়েকে আর্মি ক্যাম্পে ধরে নিয়ে বলাৎকার করা হল। পরের দিন তাদেরকে নগ্ন অবস্থায় স্থানীয় খেলার মাঠে নিয়ে এসে মুসলিম লীগ নেতাদের সামনে সারাদিন ধরে নাচতে বাধ্য করা হল। তারপর তাদেরকে শিবপুর আর্মি ক্যাম্পে নেওয়া হল, যার পরে তাদের আর কোনও সন্ধান পাওয়া যায়নি।
১ এপ্রিল ১৯৭১ ঢাকা জেলার সাভার থানার অধীন হােলাতি গ্রামে এক ভয়ঙ্করতম ঘটনা ঘটল গ্রামটা ছােরা ও বর্শায় সজ্জিত বিহারিদের সহযােগে পাক আর্মির লােকদের দ্বারা চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলা হল। এটা ছিল আওয়ামী লীগ পন্থী হিন্দুদের গ্রাম । গ্রামটিতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হল যাতে এমনকি সকল গরুবাছুর ও অন্যান্য গৃহপালিত প্রাণীও জ্যান্ত পুড়ে গেল যারা দৌড়ে পালাতে গেল তাদের ওপর মেশিনগান চালানাে হল তবে ব্যতিক্রম ছিল কিছু মেয়ে যাদেরকে রাখা হল স্যাডিস্ট আমােদ উপভােগের জন্য শিশুদেরকে মায়ের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে ওপর দিকে ছুড়ে দিয়ে উচিয়ে ধরা বেয়ােনেটের ওপর পড়তে দেওয়া হল একাজে সিদ্ধহস্ততার অনুশীলন হিসাবে তাদের মায়েদের স্তন কেটে কেটে মৃতদেহগুলির মুখে পুরে দেওয়া হল। তখনও যারা জীবিত ছিল তাদেরকে ‘জয় পাকিস্তান’ বলে চিৎকার করতে বলা হল । তাদের বেশির ভাগই স্যাডিস্টিক কসাইগুলির কথা মতাে তাই করল। তবে ছয় বছর বয়সের একটি ছেলে না বুঝে সে যেমন অভ্যস্ত ছিল তেমন ‘জয় বাংলা’ বলে চিৎকার দিল এতে আর্মির লােকেরা এত ক্ষিপ্ত হল যে তারা ছেলেটিকে কেটে পঞ্চাশ টুকরা করল এবং একেকটা টুকরা যে হিন্দুরা তখনও জীবিত তাদের খেতে দিল তারা খেতে অস্বীকার করলে তাদের সবাইকে গুলি করে হত্যা করা হল এইভাবে পাকিস্তানের গৌরব বৃদ্ধি করা হল। যে অল্প সংখ্যক কমবয়সি মেয়েকে বাঁচিয়ে রাখা হল তাদেরকে বলা হল যে “ভয় নেই; আমরা তােমাদের আঘাত করব না বা হত্যা করব না। তােমাদেরকে বাছাই করা হয়েছে এজন্য যে তােমরা ভাল মুসলমানি শুক্র লাভ করবে এবং খাঁটি মুসলমানদের জন্ম দেবে যারা মুজিবের মতাে বাস্টার্ড নয়।” এই মেয়েদের টেনে নিয়ে যাওয়া হল টঙ্গির আর্মি ক্যাম্পে। তাদের আরেক ধরনের আচরণ তুলে ধরা যেতে পারে ২৭ এপ্রিল ১৯৭১ -এ নাশকতামূলক কাজ হিশাবে গােয়াল টেক -এ একটা রেলগাড়ি লাইনচ্যুত করার শাস্তি দিতে মনস্থ করল পাক আর্মি । আসলে রেল তার নিচের নরম মাটির ক্ষয়ের কারণে সরে গিয়েছিল। কিন্তু বাঙালিদেরকে শিক্ষা দিতে হবে, তার জন্য যে কোনও অজুহাতই যথেষ্ট। আশপাশের চারটি গ্রাম গােয়াল টেক, মর্কন, পাগার এবং আব্দুল-পুির -এর বিরুদ্ধে মুক্তিবাহিনীকে আশ্রয় দেওয়ার এবং নাশকতামূলক কাজ করার অভিযােগ তােলা হল ।
গ্রামগুলির বাসিন্দাদেরকে সপরিবারে ৩০ জনের একেকটা দলে কতগুলি নির্ধারিত জায়গায় সমবেত হতে বলা হল এবং সাথে সাথে গ্রামগুলিতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হল। এখানে পিতাদেরকে নিজেদের কন্যাদের এবং ভ্রাতাদেরকে নিজেদের বােনদের বলাকার করতে আদেশ দেওয়া হল সমবেত অন্যদের সামনে। এতে অস্বীকার করাতে নারী-শিশুসহ সকলকে হত্যা করা হল। তারা ছিল সবাই মুসলমান। কয়েক জায়গায় মানুষদেরকে আগুনে ঝাপ দিতে বাধ্য করা হল; তারা জীবন্ত পুড়ে গেল। এ ধরনের কত যে ঘটনা ঘটেছিল যা বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না। সেসব পাক আর্মির কলঙ্ক হিশাবে ইতিহাসের পাতায় লেখা হয়ে থাকবে। এটা অবশ্যই খেয়াল করতে হবে যে সামরিক উর্দির মধ্যে এই কাপুরুষগুলি বেসামরিক নারী-পুরুষদের প্রতি এমন উদ্ধত ও পৈশাচিক আচরণ করত কিন্তু এরাই যখন মুক্তিবাহিনী ও মুজিববাহিনীর সাহসী বাঙালি দেশপ্রেমিকদের মােকাবিলা করত তখন আতঙ্কে ত্রাহি মধুসূদন ডাক ছাড়ত। এই বাঙালি যােদ্ধারা যুদ্ধে পৌরুষপূর্ণ এবং নারীদের প্রতি নম্র বীরােচিত আচরণের প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করেছিল। মুক্তিযােদ্ধাদের সেরা অংশ মুজিববাহিনী সৈনিক হিশাবে আচরণের আদর্শ স্থাপন করেছিল তাদের নাম ও ভূমিকার সম্মান বজায় রেখে। মুজিববাহিনীর প্রশিক্ষণের সময় আমি যত কথা বলেছিলাম তাতে আমি এমন একটা বিপ-বের জন্য উপযুক্ত চরিত্র গঠনের ওপর জোর দিয়েছিলাম। আমি শত শত বার এ কথা বলেছিলাম- “প্রতিটি নারী হচ্ছে তােমাদের কাছে হয় মা, নয় বােন, নয় তাে কন্যা শত্রুপক্ষের মেয়েরাও যেন সহানুভূতি ও নিরাপত্তার জন্য তােমাদের দিকে তাকাতে পারে। প্রতিটি শিশু একজন সম্ভাব্য নাগরিক ও সাহায্যকারী। এমনকি রাজাকারদেরও তােমাদের মতাে চিন্তা করার জন্য বােঝাতে হবে। তাদের অনেকে পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করছে তাদের পরিবার নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য কারণ নিষ্ঠুর শক্ররা তাদরে জীবিকার্জনের সব পথ বন্ধ করে দিয়েছে। রাজাকাররা কী কঠিন অবস্থায় আছে তা বুঝতে হবে। পাকিস্তানের পক্ষে কাজ না করে সে খাদ্য পাবে কী করে? বাঙালিরা এখন যে অবস্থায় আছে তাতে তাদের সবাইকে কি তােমরা খাওয়াতে পার? যদি না পার, একজন রাজাকারকে শত্রুর দালাল বলে অভিহিত করে তাদের স্থায়ীভাবে শত্রু বানিয়াে না। তাকে এমন কিছু কাজ দাও যা সে পাকিস্তানিদের বেতনে থেকেও করতে পারে আবার সেসব করে নিজেকে বাঙালি জাতির অন্তর্ভুক্ত মনে করেও গৌরব বােধ করতে পারে।
আসলে এ ধরনের প্রশিক্ষণ ও কাজের ফলে আমরা বাংলাদেশজুড়ে অজস্র রাজাকার সমর্থক পেয়েছিলাম। তারা এমন সব মিশনে সফলভাবে কাজ করেছিল যা তাদের দেশপ্রেমপূর্ণ সাহায্য ছাড়া কার্যকর করা সম্ভব হত না। আমি সেসব শত শত ঘটনার উলে-খ করব না যাতে সাহসী রাজাকাররা মুজিববাহিনীর লােক এবং তাদের রসদপত্র এবং পরবর্তী পর্যায়ে আর্মির রসদপত্রও বহন করেছিল তারা পাকিস্তানের বেতন নিয়েও দেশের মুক্তির জন্য কাজ করেছিল বাংলাদেশে পাক আর্মির তুলনায় মুজিববাহিনীর চরিত্র ছিল অতিশয় বিপরীত পাকিস্তানি রাজনীতিবিদরা তাদের চমৎকার সেনাদের চরিত্র ধ্বংস করার জন্য দায়ী ছিলেন এবং এ জন্য ঠিক সেনাদের কাছেই তাদের জবাবদিহি করতে হবে। কিন্তু, কোনও আর্মি যখন উপরে যেমন দেখানাে হল সেভাবে নিজেকে ব্যবহৃত হতে দেয় তখন তা তার নিজের কবরই খনন করে। সৈনিকবৃত্তি হচ্ছে সবচেয়ে মহান পেশা। তার কাছে এমনকি শত্রুকে হত্যা করাও ব্যক্তিগত শত্রুতার উর্ধে আহত শত্রুর চিকিৎসা সামরিক হাসপাতালে এমনভাবে হতে হয় যেমন হয় সপক্ষের আহতদের । তাদেরকে সর্বোত্তম চিকিৎসা সেবা দিতে হয় বন্দিদের ও নিরস্ত্র বেসামরিক জনসাধারণের সাথে সম্মানসূচক ব্যবহার করতে হয়। তাহলে তারাও একই রকম ব্যবস্থা ফিরিয়ে দেয়। একজন সৈনিক কিভাবে মানুষের কাছ থেকে সম্মান আশা করতে পারে, যার উদিই তাদের ঘৃণার উদ্রেক করে। তার কী সুযােগ আছে শত্রুর কাছ থেকে নিজের অবস্থান বা কর্মপরিকল্পনা গােপন রাখার যেখানে সমগ্র জনগণই প্রতিশােধের আকাক্ষায় টগবগ করছে। একজন সৈনিকের বেছে নিতে হবে নারী ও বিজয়ের মধ্যে যে কোনও একটি, লােভ ও সম্মানের মধ্যে যে কোনও একটি, স্বার্থপরতা ও আত্মত্যাগের মধ্যে যে কোনও একটি নিরস্ত্র ও অসহায় বেসামরিক জনসাধারণের ওপর শ্রেষ্ঠত্বের গালগল্পে ভরা যাদের পেট, এমন আর্মি সত্যিকার যুদ্ধের সম্মুখীন হতে পারে না। ভারতীয় আর্মি এবং মুজিববাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর চেয়েও বেশি করে পাক সশস্ত্র বাহিনীগুলি পরাজিত হয়েছিল যাদেরকে তারা নির্যাতন ও হত্যা করেছিল তাদের প্রেতদের হাতে পূর্বাঞ্চলের পাক আর্মির আত্মা বিনষ্ট হয়েছিল বলে তারা চিরতরে সম্মান হারিয়েছিল এবং তাই সহজেই ইতিহাসের শক্তিগুলির প্রবল হানার সামনে তাদের পতন হয়েছিল।
সূত্র : ফ্যান্টমস অব চিটাগং-দি ফিফথ আর্মি ইন বাংলাদেশ – মেজর জেনারেল (অব.) এস এস উবান