You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.06.21 | নিউজউইক, ২১শে জুন, ১৯৭১ বসবাসের জন্য শ্রেয়তর স্থান - সংগ্রামের নোটবুক

নিউজউইক, ২১শে জুন, ১৯৭১
বসবাসের জন্য শ্রেয়তর স্থান

ভারতে পূর্ব পাকিস্তান থেকে স্রোতের মতো শরণার্থীদের আগমন স্তিমিত হয়ে আসতে শুরু করেছে গত সপ্তাহ থেকে, কিন্তু তাদের সাথে করে নিয়ে আসা কলেরা মহামারীর বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ চলছিলো তা এখনো চলছে। ৫,০০০-এর ও বেশি শরণার্থী ইতোমধ্যেই কলেরায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে; মহামারীর সর্বোচ্চ পর্যায়ে, কবরখোদকরা এতই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলো যে তারা আর কাজ করতে পারছিলো না, এবং ঐতিহ্যবাহী হিন্দু ধর্মের প্রথানুযায়ী শবদেহ দাহ করার জন্য প্রয়োজনীয় কাঠের সরবরাহ পুরোপুরি শেষ হয়ে গিয়েছিল। যদিও ভাড়া করা বিমানে করে প্রতিদিনই খাদ্য, চিকিৎসা সরঞ্জাম এবং ঔষধ আসছে, তারপরও ভারত এখন পর্যন্ত প্রায় ৫০ লক্ষ শরণার্থীর পরিচর্যা করার জন্য যে ২০ কোটি মার্কিন ডলারের বৈদেশিক সাহায্য প্রয়োজন তার দশ ভাগের এক ভাগ হয়তো পেয়েছে। “যে পরিস্থিতিকে পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ বিষয় বলে দাবী করা হয়েছিল”, ভারতের প্রধানমন্ত্রী, ইন্দিরা গান্ধী নয়াদিল্লীতে গত সপ্তাহে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন সংসদকে বলেন, “তা এখন ভারতের আভ্যন্তরীণ সমস্যা হয়ে উঠেছে”।

সবধরণের হতাশাব্যাঞ্জক পরিসংখ্যান সত্ত্বেও, যেভাবেই হোক, ভারতের চিকিৎসা সেবা বিভাগ চমৎকারভাবে কাজ করে যাচ্ছে। “আমি এটা বলতে পারি না যে মহামারী কমে যাচ্ছে”, বলেন মিঃ আর. এন. গুপ্তা, প্রধান সমাজকল্যাণ কর্মকর্তা নদীয়ায় অবস্থিত কৃষ্ণনগর হাসপাতালের, যেটি সবচে বেশি উপদ্রুত এলাকাগুলোর একটি। “আমরা এখনো প্রতিদিন প্রায় ৫০ থেকে ১০০ জন রোগী পাচ্ছি। পার্থক্য হচ্ছে, এই সপ্তাহে আমরা প্রায় সব রোগীকে হাসপাতালে চিকিৎসা দিতে পেরেছি। গত সপ্তাহে, রোগীর সংখ্যা এতো বেশি ছিল যে অনেক মানুষ আমাদের কাছে এসে পৌঁছানোর আগে পথেই মারা গেছে”।

কিন্তু যদিও নদীয়ার রাস্তাঘাট এখন প্রায় কলেরা রোগীশুন্য, হাসপাতাল গুলোতে এখনো অনেক অসহায়, আক্রান্ত রোগী রয়েছে। একটি চিকিৎসা কেন্দ্র, ক্যাথোলিক সেবাদানকারীদের দ্বারা পরিচালিত, সিস্টারস অফ মেরী। ইমাকুলেট, যেটিকে কিছুদিন আগে তৈরি করা হয়েছিলো প্রসূতি হাসপাতাল হিসেবে; উদ্ভোদনের দুই সপ্তাহ আগেই এটিকে চালু করা হয় কলেরা রোগীদের জন্য এবং এখন পর্যন্ত কোনো প্রসূতি এখানে ভর্তি হননি। দালানটির সবখানে সারি সারি বিছানায় ছোট্ট শিশুরা শুয়ে আছে এবং মাথার উপর ঝোলানো বোতল থেকে সঞ্জীবনী দ্রবণ তাদের ক্ষীণ শরীরে প্রবেশ করছে। “এর ফলাফল খুবই লক্ষণীয়”, নিউজউইকের টনি ক্লিফটন গত সপ্তাহে তারবার্তায় জানান। “আক্ষরিক অর্থে জীবন, তাদের শরীরে পুনরায় প্রবেশ করিয়ে দেয়া হচ্ছে, এবং আপনি চাক্ষুষ করবেন যে বোতল যতই খালি হতে থাকে ততই তারা ধীরে ধীরে শক্তি ফিরে পেতে থাকে”। কিছু রোগী সব চিকিৎসার বাইরে চলে যায়। কিন্তু সর্বক্ষণ কাজে নিয়োজিত থেকে, হাসপাতালের দুইজন চিকিৎসক এবং আটজন সেবিকা মিলে এখন পর্যন্ত কলেরা রোগে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হওয়া প্রথম ৪২৫ জনের মধ্যে আঠারো জন বাদে সবাইকে বাঁচাতে সক্ষম হয়েছেন।
“আমরা আমাদের এ্যাম্বুলেন্সগুলোকে বাইরে পাঠাই রাস্তা থেকে রোগীদেরকে তুলে আনতে”, ব্যাখ্যা করেন সিস্টার ইমাকুলেট, হৃষ্টপুষ্ট, ত্রিশোর্ধ চিকিৎসক যিনি এই হাসপাতালটি পরিচালনা করেন। “এদের কেউ কেউ কাদা এবং বৃষ্টিতে পড়ে ছিল এবং সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত অবস্থায়। তারপরেও যদি না তারা আক্ষরিক অর্থে মৃত্যুমুখে পতিত হয় তাহলে ওদের বেশীরভাগকেই আমরা সুস্থ করে তুলতে পারি। এই মেয়েটিকে” শান্তভাবে ঘুমিয়ে থাকা এক কিশোরীকে দেখিয়ে তিনি যোগ করেন, “যখন নিয়ে আসা হয় তখন তার নাড়ীর স্পন্দন ছিল না এবং শ্বাস-প্রশ্বাস চলছিল না। আমরা ওকে স্যালাইন দিই, এবং এখন সে সুস্থ আছে। এদের কারো কারো জন্য এক গ্যালন তরল প্রয়োজন হয় সুস্থ হয়ে উঠতে, কিন্তু সঠিক যত্ন নিলে, এরা দুই বা তিন দিনের মধ্যে হাসপাতাল ছেড়ে যেতে পারে”। এই চিকিৎসায় কাজ হয় শুধুমাত্র চিকিৎসক এবং সেবিকাদের নিঃস্বার্থ সেবার কারণে। “আমরা সবসময় ওদের সাথে আছি”, সিস্টার ইমাকুলেট বলেন, “এবং আমরা তাদের প্রত্যেকের পেছনে অনেক টাকা ব্যয় করি – মাথাপিছু প্রায় ৬০ টাকা (৭ মার্কিন ডলার)করে।”

এই হাসপাতালটি একটু আলাদা, কেননা এটা নতুন এবং ব্যক্তিগত তহবিল দ্বারা পরিচালিত; নদীয়ায় খুব অল্পকয়েকটি হাসপাতালই আছে যারা প্রতিটি রোগীর জন্যে ৬০ টাকা পর্যন্ত খরচ করার সামর্থ্য রাখে। কৃষ্ণনগর হাসপাতালটি বরং অনেকটা সাধারণ মানের। এমনিতে ২৫ শয্যাবিশিষ্ট হলেও, এই মুহূর্তে এখানে ৪০০-রও বেশি রোগী আছে, যাদের অনেকেই দালানের পাশে তৈরি করা কমলা রঙের তাবুর নিচে আশ্রয় নিয়েছে তাদের পরিবারের সদস্যদের সাথে। বিছানার চাদরের সরবরাহ অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে, এবং বেশীরভাগ তোষকই দূষিত হয়ে গেছে শারীরিক বর্জ্যে। রোগীরা দাগে ভরা পাতলা জালিকাপড়ে ঢাকা ৬ ফুট দীর্ঘ এবং ৩ ফুট প্রস্থের টিনের ট্রে-র উপর শুয়ে থাকে। চারিদিকে শুধু মাছি, এবং শব্দ আর দুর্গন্ধ মাত্রাধিক। শুন্য-দৃষ্টি চিকিৎসক এবং সেবিকাদের কাজের ভার এতই বেশি যে তাদের একজন গত সপ্তাহে ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ে এবং মারা যায়। এখন পর্যন্ত এতো অপরিচ্ছন্নতা সত্ত্বেও, হাসপাতালটি অত্যন্ত আশ্চর্যজনকভাবে কার্যকর রয়েছে, এবং মাত্র ৮ শতাংশের মতো রোগী মারা গেছে।

টাইফয়েডঃ পাকিস্তানের গৃহযুদ্ধের শরণার্থীরা ভারতীয় আশ্রয় শিবিরে এসেও অনেক বিপর্যয়ের সম্মুখীন। “আমরা এখন যে ভয় পাচ্ছি সেটি হচ্ছে টাইফয়েডের মহামারী”, বলেন কৃষ্ণনগর হাসপাতালের মিঃ গুপ্তা। “এখানে প্রায় পাঁচ লক্ষ মানুষ শিবিরগুলোতে এবং এখানে আসার রাস্তার পাশে বসবাস করছে। এদের অনেকেই দূষিত পানি পান করছে, এবং ওদের অনেকেই এখানে আসার অত্যন্ত কষ্টকর যাত্রার ধকলে দুর্বল। এটা টাইফয়েডের জন্য আদর্শ পরিবেশ”।

হয়তো ভারতের এই চলমান দুর্দশার কথা চিন্তা করেই, পাকিস্তানের সরকার শরণার্থীদের তাদের ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে তাদেরকে সাধারণ ক্ষমার প্রস্তাব এবং খাদ্য, বাসস্থান, চিকিৎসা সেবা এবং তাদের আগের বসতবাড়ি পর্যন্ত পরিবহনসহ পৌঁছে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে। গত সপ্তাহের এক আনুমানিক হিসাব অনুযায়ী, কয়েক হাজার বাঙালী ইতোমধ্যেই সীমান্ত পার হয়ে পাকিস্তানে ফিরে গেছে এই প্রস্তাব গ্রহন করার জন্য। কিন্তু এখন পর্যন্ত, ৫ লাখ গৃহহীন মানুষের বেশীরভাগ মনে করছে বলে মনে হয় যে, এতো সমস্যা থাকার পরেও, এই মুহূর্তে ভারত বসবাসের জন্য শ্রেয়তর স্থান।