You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.06 | নিউজউইক,৬ ডিসেম্বর , ১৯৭১ বাংলায় যুদ্ধঃ ভারতীয় আক্রমণ - সংগ্রামের নোটবুক

নিউজউইক,৬ ডিসেম্বর , ১৯৭১
বাংলায় যুদ্ধঃ ভারতীয় আক্রমণ

যখন বিভিন্ন দেশ যুদ্ধে নামে তখন তারা প্রত্যেকেই সম্পূর্ণ সৎ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে যুদ্ধ করছে বলে দাবি করে। গত সপ্তাহে যখন ভারতীয় নেতাগণ নয়া দিল্লীতে অবস্থিত সুউচ্চ গম্বুজের সংসদের কেন্দ্রীয় কক্ষে সভায় মিলিত হন, সেখানে পাকিস্তানে আক্রমণের পক্ষে অনেক টেবিল চাপড়ানো এবং উগ্র দেশপ্রেমের প্রকাশ সূচক অনেক বক্তব্য উপস্থাপন করা হয়। ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম প্রতিশ্রুতি দেন –“যদি আমরা পাকিস্তানী আক্রমণ বন্ধ করতে চাই তাহলে আমরা শুধু সীমান্তেই বসে থাকবো না, বরং আমারা ভেতরে অনুপ্রবেশ করবো। আত্মরক্ষার প্রয়োজনে সীমান্তের যত অভ্যন্তরেই প্রবেশ করা প্রয়োজন হোক না কেন, আমরা তা করবো। এই আদর্শিক চিন্তাধারা নিয়ে হাজার হাজার ভারতীয় সৈন্য পূর্ব-পাকিস্তান সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করেছে, এবং উপমহাদেশের দুই চিরশত্রুর মধ্যে অনন্ত বৈরিতার তৃতীয় পর্যায়ের সূচনার মঞ্চ এভাবেই প্রস্তুত হয়।

এই দুইটি জাতি অবধারিতভাবে একটি অপ্রয়োজনীয় যুদ্ধের দিকেই ধাবিত হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে, যার দায়ভার উভয় দেশকেই সমানভাবে নিতে হবে। গত নয় মাসে পাকিস্তান সরকারের রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্বশাসনের দাবিকে দমন করতে নির্বিচারে লক্ষ লক্ষ বাঙালি নাগরিককে হত্যা করার নৃশংস ও অদূরদর্শী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চেষ্টা চালিয়েছেন। এবং ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে ভারত সরকার পাকিস্তান বিভক্তিকরণের উদ্দেশ্যে, তার পূর্ব সীমান্তকে বাংলাদেশের মত একটি নির্ভরশীল রাষ্ট্রে পরিণত করতে এবং ইয়াহিয়ার ত্রাসের রাজত্ব থেকে পালিয়ে আসা এক কোটি বাঙ্গালী শরণার্থীর চাপ থেকে মুক্ত হতে নামে সুকৌশলে অভিযান পরিচালনা করে। নয়া দিল্লীর একজন কুটনৈতিক কৌতুক করে বলেন যে “কয়েক মাস আগেও যা আমাদের কাছে বোঝা বলে মনে হয়েছে আজকে সেটাই সুযোগে পরিণত হয়েছে”। ক্রমান্বয়ে এই যুদ্ধ পরিস্থিতির দিকে এগিয়ে যাওয়াকে আরও হৃদয়বিদারক অবস্থায় নিয়ে গিয়েছে বাঙ্গালী নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে বিচারাধীন রাখা এবং ইয়াহিয়া খানের তাকে মুক্তিদানে অনমনীয় অনীহা।

আরও দুঃখজনক যে এই সংঘাত থামানোর জন্য বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি সমূহের সক্ষমতা এবং এমনকি সদিচ্ছার অভাব লক্ষ্য করা গিয়েছে। ইয়াহিয়া সরকারর সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে ওয়াশিংটন থেকে প্রায় ৪ বিলিয়ন অর্থ –সাহায্য পাকিস্তানকে প্রদান করা হয়, তা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র এই পাকিস্তানি নেতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়। এবং, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ভারতের সাথে সাম্প্রতিক মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষর করার পরেও মিসেস গান্ধীকে নিরস্ত করতে তেমন কিছু করতে পারেনি। এই নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থায় যুদ্ধের জন্য দুই পক্ষের মাঝেই তাড়াহুড়া ছিল যদিও যুদ্ধে দুইটি দেশেরই অনেক কিছু হারাবার ছিল। একজন পাশ্চাত্যের কুটনৈতিক হতাশার সাথে বলেন যে “বেশীরভাগ ধর্মপ্রাণ মুসলমান মনে করেন তারা যুদ্ধক্ষেত্রে শহীদ হলে সেটা তাদের জন্য উত্তম পুরষ্কার, এবং ইয়াহিয়াও হয়তো তাই চায়”। অপরদিকে ভারতের ক্ষেত্রে মনে হচ্ছে, পৃথিবীর শতকরা ২০ ভাগ মানুষকে নৈরাজ্যের মধ্যে ফেলে সে উপমহাদেশের একচ্ছত্র পরাশক্তি হবার দীর্ঘদিনের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে চায়, এবং এশিয়াতে আধিপত্য বিস্তারে প্রতিপক্ষ চীনের বিপক্ষে বিশাল বাধা হয়ে দাঁড়াতে চায়।

ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে এই সংঘাত অনিবার্য ছিল। একজোড়া ক্ষিপ্ত বেড়ালের মতো এই দুই সামরিক বাহিনী মাসের পর মাস মুখোমুখি অবস্থানে পরস্পরের প্রতি কাঁদা ছোড়াছুড়িতে লিপ্ত ছিল, প্রথম আঘাত আসার আগ পর্যন্ত।

ভারত এবং পাকিস্তানের সীমান্তের ১৩০০ মাইল এলাকা জুড়েই কিছু বিক্ষিপ্ত এলাকা আছে যেখানে উভয় সীমান্তে সেনারা একে অপরের অবস্থান পরখ করছে , উস্কানি দিচ্ছে এবং সেইসাথে দাবী করছে যে তারা কখনোই আক্রমণ করবে না। কিন্তু বাস্তবিকে , ভারত অব্রোধের পরিকল্পনা করেছে। সেকারণেঈ নয়া দিল্লঈর নির্দেশ মতো সীমান্তে সকল প্রতিবেদককে নিষিদ্ধ করা হ্যেছে যাতে তারা ভারতীয় সৈন্যের রণকৌশল সম্পর্কে অবহিত হতে না পারে। নিউজউইক পত্রিকার জ্যৈষ্ঠ সম্পাদক আর্নড দি বোর্শগ্রেভ নিউ ইয়র্ক টাইমসের একজন প্রতিবেদককে সাথে নিয়ে ভারতের এই কঠোর নিরাপত্তার জাল ছিন্ন করতে সমর্থ হন। তার প্রতিবেদন অনুসারেঃ / দি বোর্শগ্রেভ রিপোর্টঃ

আমরা কলকাতা থেকে প্রায় ৫৪ মাইল ভেতরে সীমান্তবর্তী শহর বনগাঁতে এসেছি- এখানে যুদ্ধের কোন চিহ্নই নেই, কোন সৈন্য চলাচল, ভারতীয় সামরিক বাহিনীর কোন ইউনিট বা কামানের গর্জন কিছুই চোখে পড়েনি। পূর্ব দিকের রাস্তাটায় ফলক টাঙ্গানো “পাক সীমান্ত – দুই মাইল” এবং একজন ভারতীয় মেজর আমাদের থামানোর পূর্ব পর্যন্ত আমরা সেটিই অনুসরণ করতে লাগলাম। তিনি জানালেন পাকিস্তানিরা একটু সামনেই রাস্তায় গোলাগুলি করছে। মেজর আমাদেরকে রাস্তার ধারের একটি পরিখায় নিয়ে গেলেন। পথ চলতে চলতে যদিও আমরা অনিয়মিত গোলাবর্ষন এবং বুলেটের শিস শুনতে পাচ্ছিলাম, কিন্তু এরপরেও এলাকাটি ছিল শান্ত। আমরা জিগ্যেস করলাম “ যুদ্ধ তাহলে কোথায় হচ্ছে?” মেজর উত্তর দিলেন “এই পাড়ে সব কিছুই শান্তভাবে চলছে। রাতের বেলা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের কিছু গুলিবর্ষণ এবং কয়েকটি রাঊন্ড মর্টারের শব্দ ছাড়া তেমন কোন উত্তেজনা এখানে নেই আপাতত”। সীমান্ত এলাকায় ভারতীয় সৈন্যরা বেশ ভালোভাবেই অবস্থান নিয়েছে এবং একটি মজবুত লাল ইটের দেয়াল দিয়ে পথ অবরুদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু দেয়ালের থাকার অপর দিকে এখনো একটি ফলক দেখা যাচ্ছে যেটায় লেখা “পাকিস্তানে স্বাগতম”।

সীমান্তের উদ্দেশ্যে যাত্রা

যখন আমরা বনগাঁও দিকে ফিরছি হঠাৎ করেই তখন পরিবেশ অশান্ত হয়ে গেলো । দম বন্ধ করা ধূলার ঝড়ের মধ্যে বিরাট এক যুদ্ধবহর সীমান্ত এলাকায় দিকে যাচ্ছিলো। সোভিয়েতে নির্মিত কতগুলো ট্রাক ধীরগতিতে বারোটি ১০৫ মিলিমিটার কামান টেনে নিয়ে যাচ্ছিলো। পাগড়ী-পরা শিখ সেনারা রিকয়েললেস গানে সজ্জিত জীপ নিয়ে ধীরগতিতে এগিয়ে যাচ্ছিল, এবং সাথে বিশাল কতগুলো ট্রেইলারের মাধ্যমে অস্থায়ী ব্রিজ নির্মাণের সরঞ্জামাদি টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। আমরা পূর্ণ যুদ্ধসাজে সজ্জিত সশস্ত্র সৈনিক পরিবহনকারী ট্রাকের আপাতদৃষ্টিতে অন্তহীন মিছিলের ফাঁক গলে বেরিয়ে গেলাম। উভচর সাঁজোয়া যান থেকে শুরু করে কমান্ড পোস্টের জন্য আসবাবপত্র পর্যন্ত সবকিছুই বহরে ছিল, যা থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছিল যে ভারতীয় সেনাবাহিনী পাকিস্তানে প্রবেশের জন্য অবস্থান নিচ্ছিল। যদিও সীমান্তের একটু আগেই রাজপথ থেকে আমাদের সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু সেনাবাহিনী তাদের সীমান্তগামী বহর অথবা ভারতের উদ্দেশ্য কোনটাই লুকাবার কোন চেষ্টা করেনি। একজন অফিসারের সাথে চা পানের সময় তিনি বলেন “এক মাস ধরে আমার সৈন্যরা সামনে আগাবার জন্য অপেক্ষা করে আছে এবং তাদের আত্মবিশ্বাস প্রবল। ”

এই অন্তহীন বহর দেখে এবং যুদ্ধক্ষেত্রে ভারতীয় সেনা অধিনায়কদের সাথে কথা বলে এটা স্পষ্ট বোঝা গেছে যে ভারত অবশেষে তার এতদিনের যাবতীয় প্রচারণার বিপরীতে গিয়ে মুক্তিবাহিনীকে প্রত্যক্ষভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। ভারতীয় সেনাবাহীনির গতিবিধি আমরা পর্যবেক্ষণ করার পরপরই প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী প্রথমবারের মত স্বীকার করেন যে তার সেনাবাহিনীকে আত্মরক্ষার খাতিরে পাকিস্তান সীমান্ত অতিক্রম করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তবিকপক্ষে, ভারতীয় সেনাবাহিনীর এই অভিযান মূলত একটি ত্বরিত অভিযান। আমরা এই বহর দেখার আগেই ভারতীয় বাহিনী বনগাঁর উত্তরদিকের সীমান্ত অতিক্রম করে ১৩ টি পাকিস্তানি ট্যাংক ধ্বংস করে দেয়। এবং ভারত যে বাংলার যুদ্ধে তার সংশ্লিষ্টতা বৃদ্ধি করছে এর আরেকটি পরিষ্কার ইঙ্গিত পাওয়া যায় যখন ভারতের মন্ত্রীসভার একজন মন্ত্রী আমাকে জানান যে, “ এখন মধ্যবর্তী সমাধান বা আপোষ-রফায় পৌঁছানোর সময় নেই। এখন দরকার দ্রুত অগ্রগতি”।

ভারত আপাতত সবদিক থেকে আক্রমণ থেকে বিরত আছে। তার পরিবর্তে মনে হচ্ছে নয়াদিল্লী উপর্যুপরি কতগুলো দ্রুত ছোট ছোট আক্রমণের মাধ্যমে বিপুল সংখ্যক পাকিস্তানী সেনাকে নিষ্ক্রিয় করার কৌশল নিয়েছে যাতে বাঙ্গালী গেরিলাদের পক্ষে আরও বেশি এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পথ প্রশস্ত হয়। এই লক্ষ্য অর্জনে, ভারতীয়রা একাধারে সিলেট , কুমিল্লা , চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলসহ পূর্ব – সীমান্ত এলাকা এবং সেইসাথে পশ্চিমে যশোরের দিক থেকে প্রবেশ করছে। পূর্ব পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের জন্য কৃষির সমৃদ্ধ ভান্ডার যশোরকে বিপ্লবীদের পরিকল্পনার কেন্দ্রে রাখা হয়েছে। ভারতের আক্রমণের ধরন এই সময়সীমার দিকে লক্ষ্য রেখে দ্রুততার সাথে পরিচালিত হচ্ছে । শহরের চারপাশের এলাকা ভারত এবং মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীন থাকা অবস্থায় নিউজউইকের টনি ক্লিফটন পাকিস্তান এয়ার ফোর্সের বিমানযোগে সেখানে যান এবং নিম্নোক্ত রিপোর্টটি করেনঃ

এটা স্পষ্ট যে ভারতীয় বাহিনী নিয়মিত সমরাস্ত্র , ট্যাংক এবং ভারী আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করছে পাকিস্তানিদের সীমান্তে আক্রমণ চালাতে। যখন আমি যশোর পৌঁছলাম তখন দেখতে পেলাম ভারতীয় সৈন্যরা যশোর এলাকার পশ্চিমাংশের বেশ কিছু অংশ দখল করেছে এবং শহরের মূল বিমান বন্দরে থেমে থেমে গোলা বর্ষণ করছে। আমাকে দ্রুত পাকিস্তানি সদর দপ্তরে নিয়ে যাওয়া হল, সেখানে সেক্টর কমান্ডার মেজর জেনারেল এম এইচ আনসারি আমাকে ভারতীয় আক্রমণ সম্পর্কে অবগত করেনঃ “ তারা পূর্ণ শক্তি নিয়েই মাঠে নেমেছে। তাদের দুটো ব্রিগেড আছে একটি ট্যাংক রেজিমেন্ট এবং ১৩০ মি মি রাশিয়ান কামান সহ। তারা প্রায় ৬ মাইল ভেতরে প্রবেশ করেছে। এটা আমাদের জন্য অনেক বেশি তাই আমরা পাল্টা আক্রমণ শুরু করেছি এবং তাদের সীমান্ত পর্যন্ত পিছু হটতে বাধ্য করেছি।“ যখন আমি জানতে চাইলাম যদি আক্রমণকারীরা বাঙালি গেরিলা যোদ্ধা হত তাহলে কি হত, তখন আনসারি ব্যঙ্গ করলেন “ এরা বিদ্রোহী গেরিলা না। তারা ট্যাংক এবং ভারী অস্ত্র ব্যবহার করছিল এবং বিদ্রোহীদের এ ধরনের অস্ত্রশস্ত্র নেই। এসব জিনিস তো আর গাছে ধরে না”। তিনি একটু থামলেন এবং দুরাশা নিয়ে বললেন, “ তা হলে অবশ্য ভালোই হত, কারণ তখন আমরাও কিছু পেতাম”।

একটি বৃথা কাজ

আনসারি দাবী করলেন যে তার বাহিনী শত্রু পক্ষের ২০০ থেকে ৩০০ জন সৈন্যকে হত্যা করেছে এবং আরো বললেন, “আমরা কিছু কাগজপত্র এবং উর্দি পেয়েছি যা প্রমাণ করে যে তারা ভারতীয় সেনাবাহিনীর নিয়মিত সদস্য। তারা চতুর্দশ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের সদস্য ছিল।“ যখন তাকে তাদের নিহত সৈন্য সংখ্যা সম্পর্কে জিগ্যেস করা হলো তিনি তা জানাতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন, তবে এটা স্বীকার করেন যে তাদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ যথেষ্টই। তিনি বলেন “নিশ্চয় বুঝতে পারছেন যে তারা আমাদের দিকে গোলাপের পাপড়ি ছুঁড়ে মারছিল না” । যদিও আনসারী দাবি করেছিলেন যে তারা ভারতীয়দের সীমান্ত পর্যন্ত পিছু হটাতে সক্ষম হয়েছিলেন, কিন্তু কোন পাকিস্তানি কর্মকর্তা অস্বীকার করতে পারেনি যে যশোরের আশেপাশের এলাকা পুরোপুরি শত্রুদের হাতে। এবং গেরিলা অধীকৃত পূর্ব-পাকিস্তানের কোন অংশই পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক পুনরায় দখল করা প্রায় অসম্ভব একটি ব্যাপার। যদিও এখন বর্ষা মৌসুম শেষ হয়েছে, বিশাল এলাকা এখনো জলবদ্ধ এবং আক্ষরিক অর্থেই শত শত নদী – নালা , খালবিল জালের মতো ছড়িয়ে আছে এ অঞ্চলে। যেসব রাস্তাঘাট এখন পর্যন্ত ভালো আছে সেগুলো সব ছোটখাটো পথঘাট, যেখানে গেরিলাদের আক্রমণের শিকার হবার সম্ভাবনা প্রবল।

পূর্ব পাকিস্তানের বিপরীত প্রান্তে কুমিল্লা জেলা সরকারের জন্য একই রকম একটি হুমকি হিসাবে বিরাজ করছে। আমি বিমানযোগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটি পাকিস্তানি দপ্তরে গিয়েছিলাম, সেখানে পাকিস্তানি অফিসাররা জানান যে ভারতীয় সৈন্যরা বিরাট প্রতিরোধ গড়েছে। একজন পাকিস্তানি কমাণ্ডার মৃতদেহ ভর্তি রেলরোড ট্রাকের কাছে নিয়ে যান এবং আমি তাদের উদ্ধার করা অস্ত্রসমূহ দেখতে পাই। যদিও আমার পক্ষে কোনমতেই বলা সম্ভব না যে এসব গলিত মৃতদেহ ভারতীয় সেনাদের নাকি বাঙ্গালী গেরিলা যোদ্ধাদের, কিন্তু রাইফেল , স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র এবং হাল্কা মেশিনগান গুলো নিঃসন্দেহে ভারতীয় সেনাদের দ্বারা ব্যবহৃত জিনিস। এই বিগ্রেডিয়ার নিঃসন্দেহ ছিলেন যে তার শত্রুদের সকলেই ছিল ভারতীয় এবং তিনি অত্যন্ত আনন্দের সাথে যুদ্ধক্ষেত্রের বর্ণনা দিচ্ছিলেন। “ আমরা প্রায় ৩০০ থেকে ৪০০ মানুষ হত্যা করেছি , এবং এর তিনগূন লোককে আহত করেছি” তিনি উচ্ছ্বসিতভাবে আরও বললেন, “আমরা ১৯ তম পাঞ্জাব ব্যাটেলিয়ান্দের পরাস্ত করেছি এবং আরেকটাকে গুঁড়িয়ে দিয়েছি”।

ব্রিগেডিয়ারের এই রক্তপিপাসু মানসিকতা ভারতীয় এবং পাকিস্তানের মধ্যে বিদ্যমান যে সম্পর্ক তা বিবেচনা করলে একেবারেই স্বাভাবিক একটি ঘটনা। ব্রিটিশ-ভারত থেকে ১৯৪৭ সালে গঠিত হওয়ার পর থেকেই এই দুই দেশ পরস্পরের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন এবং তাদের সম্পর্ক স্বস্তিকর নয়। প্রায় ১০০০ মাইল ব্যাপী হিন্দু ভারতের দুপাশে সৃষ্ট বিভক্ত দুইটি মুসলিম রাষ্ট্র নিয়ে পাকিস্তান গঠনের প্রক্রিয়া শেষ হতে না হতেই রক্তাক্ত ‘দেশবিভাগের দাঙ্গায়’ হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়। যদিও এরপর প্রায় পঁচিশ বছরের বেশির ভাগ সময় ধর্মীয় এবং প্রথাগত বিভাজন থেকে সৃষ্ট এই ঘৃণার লাগাম টেনে রাখা সম্ভব হয়েছে, কিন্তু কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে ১৯৪৮-৪৯ এ ভারত-পাকিস্তানের প্রত্যক্ষ যুদ্ধ এবং ১৯৬৫ সালে যুদ্ধের পুনরাবৃত্তি এটা নিশ্চিত করেছে যে পারস্পরিক এই শত্রুতার অবসান হবার নয়।

ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যে শত্রুতা সেটাই কিন্তু এই উপমহাদেশের একমাত্র সমস্যা নয়। পাকিস্তানের প্রধান দুই জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে একই ধরনের বৈরিতা বিদ্যমান- এক পক্ষ হচ্ছে পাঞ্জাবীরা পশ্চিম পাকিস্তানে যাদের প্রাধান্য এবং যারা সরকার ও সেনাবাহিনী দুটোই নিয়ন্ত্রণ করে, অপরপক্ষে রয়েছে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙ্গালীরা যারা তাদের সমৃদ্ধ কৃষিভূমির ওপর পশ্চিম পাকিস্তানিদের অর্থনৈতিক শোষণের প্রতি গভীর তিক্ত মনোভাব পোষণ করে এবং তাদের দমিয়ে রাখা হয়েছে বলে মনে করে। গত ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে যখন বাঙ্গালীরা শেখ মুজিবুর রহমানের সমর্থনে ঐক্যবদ্ধ হয়, এবং তারা জাতীয় পরিষদে পরিষ্কার সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু ইয়াহিয়া সংসদের অধিবেশন স্থগিত করেন, ফলে সাধারণ ধর্মঘট শুরু হয় এবং পূর্ব পাকিস্তানে প্রাণঘাতী দাঙ্গা শুরু হয়। ইয়াহিয়ার প্রতিক্রিয়া ছিল নির্মম। তিনি পাঞ্জাবী সেনাদের পূর্ব-পাকিস্তা্নে লেলিয়ে দেন যার ফলশ্রুতিতে ১০ লক্ষের অধিক বাঙ্গালী প্রাণ হারায় এবং প্রায় ৯৮ লক্ষ ভারতে আশ্রয় নেয়। একরকম অনিচ্ছাকৃত ভাবেই তিনি এইদেশ এবং ভারতকে যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেলেন।

তুরুপের তাস ভারতের হাতে

পাকিস্তানের জন্য ভারতের সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষ নিজেকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কিছুই না। ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী পাকিস্তানের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ (নয় লক্ষ আশি হাজার ভারতীয় সৈন্যের বিপরীতে মাত্র তিন লক্ষ বিরানব্বই হাজার পাকিস্তানি সেনা) এবং পাকিস্তানের ২৮৫ টি যুদ্ধবিমানের বিপরীতে ভারতের প্রায় ৬১৫ টি যুদ্ধবিমান রয়েছে। পরিসংখ্যান বলছে নয়াদিল্লী সব দিক দিয়ে এগিয়ে আছে। সবচেয়ে বড় কথা আবহাওয়া, ভৌগলিক রাজনীতি এবং সর্বপরি মুক্তিবাহিনী তাদের সাথে যুক্ত হয়ে যৌথভাবে লড়াই করছে। ভারত পরিসংখ্যানগতভাবে খুবই সুবিধাজনক অবস্থানে। এর বাইরেও আবহাওয়া, ভূ-রাজনীতি এবং মুক্তিবাহিনী সব মিলিয়ে ভারতকে পুরোপুরি নিরাপদ অবস্থানে এনে দিয়েছে। শীতের তুষারপাতে হিমালয়ের রাস্তাগুলো বন্ধ হয়ে গিয়েছে, এর ফলে পাকিস্তানের সমর্থনে কমিউনিস্ট চীনের আক্রমণের সম্ভাবনা কমে গিয়েছে; বাস্তবে ভারত তার চীন সীমান্ত নিয়ে এতোটাই নিশ্চিন্ত যে সে তার পার্বত্য বাহিনীর একটা অংশকে পাকিস্তান সীমান্তে স্থানান্তরিত করেছে। তাছাড়া ইয়াহিয়া খানের সৈন্যরা পূর্ব পাকিস্তানের জলাভূমির মাধ্যমে একে অপরের থেকে এবং ভারতের মাধ্যমে পশ্চিমের থেকে বিচ্ছিন্ন, যা তার জন্য কৌশলগতভাবে দুঃস্বপ্নের মত। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে যে, পূর্ব-পাকিস্তানে ইয়াহিয়ার আশি হাজার সৈন্যকে একাধারে দুটো শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে- সম্মুখে ভারতীয় বাহিনী এবং পেছনে ক্রমান্বয়ে ভীতিকর হয়ে ওঠা বাঙ্গালী গেরিলাদের দল।

নিঃসন্দেহে এই দ্বিমুখী যুদ্ধই এখন ভারতের বর্তমান রণকৌশলের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। মিসেস গান্ধীর সরকার মাসের পর মাস মুক্তিবাহিনীকে প্রশিক্ষণ এবং অস্ত্র দিয়েছে। কিন্তু এরপরেও যেহেতু ইয়াহিয়ার তরফ থেকে পূর্ব-পাকিস্তানকে স্বায়ত্বশাসন দেওয়ার কোন চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না, এবং শরনার্থীদের রক্ষণাবেক্ষণে বিশাল অর্থনীতিক দুর্যোগ সৃষ্টি হয়েছে, ভারত ঝুঁকি নেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। একজন কুটনৈতিক মন্তব্য করেন “তাদের পক্ষে মুক্তিবাহিনীর বিদ্রোহকে নিজ গতিতে অগ্রসর হতে দেওয়া সম্ভব না”। তিনি আরো বলেন “সে জন্য তারা প্রক্রিয়াটি ত্বরান্বিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন”। এর ফল হিসাবেই গত সপ্তাহের অনুপ্রবেশ। এবং গত সপ্তাহে মিসেস গান্ধী সীমান্ত বাহিনীতে বেশ কয়েকবার পরিদর্শন করেন, যার ফলে নয়া আরও সম্ভাব্য নাটকীয়তার গুজব ছড়িয়ে পড়ে।

যখন ভারত এবং পাকিস্তান পরস্পরের সাথে গুলি বিনিময়ে লিপ্ত ছিল, এবং সামনে আরও বড় যুদ্ধের সম্ভাবনার কথা বলছিল, তখন বাকি বিশ্ব শুধু কথাই বলছিল। যদিওবা তারা অস্ত্র এবং অর্থ সরবরাহ করে যুদ্ধকে আরও রসদ যোগাচ্ছিল, বিশ্বের বৃহৎ শক্তিগুলো এই সংঘাত থামাতে অক্ষম বলেই মনে হচ্ছিলো। রাশিয়া, যে পশ্চিমাদের বিকল্প হিসাবে ভারতের প্রধান অস্ত্র সরবরাহকারী, তারা প্রাভদাতে অকার্যকর বুলি আওড়ানোতেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রেখেছিল, এর কারণ হয়তো মস্কো ভেবেছিল যে সে আসলে সম্ভাব্য বিজয়ীর সাথেই আছে। প্রাভদার একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “সামরিক সংঘাত প্রাণ এবং সম্পদের বিনাশের কারণ ঘটাবে, এবং দীর্ঘমেয়াদে আরও সমস্যা সৃষ্টি করবে”। পাকিস্তানের প্রধান সমর্থক গণপ্রজাতন্ত্রী চীন সরকার মূলত সোভিয়েতদের বিরুদ্ধে জোর গলায় প্রতিবাদ জানাতেই ব্যস্ত ছিল।

কেউ কারো কথায় কর্ণপাত করছে না

গুরুত্বপূর্ণ একটি পরাশক্তির এমন অসহায়ত্ব ওয়াশিংটনে যতটা নগ্নভাবে দেখা যাচ্ছে তেমনটা আর কোথাও দেখা যায়নি। যদিও নিক্সন প্রশাসন যুদ্ধরত দেশসমূহকে সংযত থাকতে অনুরোধ করেছে, কিন্তু এই আহ্বানে কেউ সাড়া দেয়নি। মূলত ভারতে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে গভীর ক্ষোভ জাগ্রত হয় কেননা তারা পাকিস্তানকে অস্ত্র সাহায্য করে আসছিলো গত মাস থেকেই তখনো এই পরস্থিতি এতোটা উত্তপ্ত হয়নি। ভারতে এখনো এ ব্যাপারে ক্ষোভ বিরাজ করছে যে যুক্তরাষ্ট্র এক মাস আগে পর্যন্তও পাকিস্তানে অস্ত্রের চালান অব্যাহত রেখেছিল। একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধ প্রসঙ্গে ক্ষোভের সাথে বলেন, “একদিকে আমাদের নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করে চলার জন্য বাহবা দেওয়া হবে, অপরপক্ষকে অস্ত্র সাহায্য দেওয়া হবে। আপনারা বলছেন যে আপনারা পাকিস্তানের উপর চাপ প্রয়োগ অব্যাহত রাখবেন। কিন্তু আমাদের মনে হচ্ছে আপনারা দুই নৌকায় পা দিয়ে চলছেন”। ইসলামাবাদেও যুক্তরাষ্ট্র কোন উল্লেখযোগ্য সাফল্যের দেখা পায়নি। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনের উপর ভর করে ইয়াহিয়া এখনো এই বিশ্বাস আঁকড়ে ধরে আছেন যে তিনি মুজিবকে মুক্তি না দিয়ে এবং মুক্তিবাহিনীর কাছে নতিস্বীকার না করেই পাকিস্তান রক্ষা করতে সক্ষম হবেন।

ইয়াহিয়ার একগুঁয়েমি এবং ভারতীয় সীমান্তে ক্রমবর্ধমান উস্কানিমূলক অনুপ্রবেশের প্রেক্ষিতে প্রেক্ষিতে এটা একেবারেই স্পষ্ট নয় কিভাবে একটি ব্যাপক সংঘাত এড়ানো যাবে। নয়া-দিল্লীর অনেক সামরিক বিশেষজ্ঞ এরই মধ্যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে এই সপ্তাহের মধ্যেই মুক্তিবাহিনীর হাতে যশোরের পতন ঘটবে, এবং স্বাধীন বাংলাদেশের ঘোষণার প্রেক্ষাপট তৈরি হবে, একই সাথে পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে একটি প্রতিশোধ নিতে যুদ্ধ ঘোষণা করবে। সেটা যদি ঘটে উপমহাদেশে এক অভূতপূর্ব সংঘাতে নিমজ্জিত হবে যাবে যা অতীতে কেউ কখনো দেখেনি। ভারত -পাকিস্তানের মধ্যে অতীতে সংঘটিত অন্যান্য যুদ্ধের মতো না এই যুদ্ধ হয়তো যে কোন একটি পক্ষের চূড়ান্ত পরিণতি নির্ধারণ করবে। একজন আমেরিকান কূটনৈতিক বলেন যে “ বাংলাদেশের জন্মের আকুতিই পাকিস্তানের ধ্বংসের ইঙ্গিত দিচ্ছে যা আগেই আমাদের জানা ছিল। ইয়াহিয়াও তা জানেন, এবং তার সৈন্যরাও এটা জানে। এবং তারা শেষ অব্দি লড়াইয়ের ময়দান ছাড়বে না”।

কেন ভারত নিজেদের ঝুকিপূর্ণ বিপদকে কাটালো না ?

যদি এই পূর্ণ যুদ্ধে যুদ্ধে ভারত পাকিস্তানকে অন্তর্ভুক্ত করতে ব্যর্থও হয়, তারপরেও এটা নিশ্চিত যে এ ব্যাপারে তাদের প্রচেষ্টার অভাবে ছিল না। এটা সত্য যে, এটা কারো কাছে বিশ্বাসযোগ্য নয় যে নয়া –দিল্লী পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যাসমূহকে ত্বরান্বিত করেছে, যার অস্তিত্ব আগে ছিল না। কিন্তু এ ব্যাপারেও কারো সন্দেহ নেই যে প্রথম থেকেই ভারত এই সংকটময় পরিস্থিতিকে সম্ভাব্য সব উপায়ে কাজে লাগাতে চেষ্টা করেছে। এটি প্রশ্নাতীত ভাবে সত্য যে “এমন সুযোগ সারাজীবনে একবারই আসে”, যে সুযোগ একজন ভারতীয় রাজনীতিবিদ দাবি করেন এখন তাদের হাতে। নয়াদিল্লী তার স্বপ্নের এক দুর্বল, বিভাজিত পাকিস্তানকে বাস্তবতায় রূপ দিতে তার পক্ষে সম্ভাব্য সর্বোচ্চ ঝুঁকি নেবে।

অধিকাংশ ভারতীয়দেরই মত যে আসলে আর কোন বিকল্প ছিল না। শরনার্থীদের ব্যবস্থাপনার জন্য খরচ এত উচ্চমাত্রায় বৃদ্ধি পাচ্ছিল যে যে নয়া-দিল্লীর কর্মকর্তারা এ বিষয়ে একমত হন যে, আরও এক বছর উদ্বাস্তু সমস্যা মোকাবেলা করার একটা পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধই বরং বেশি লাভজনক হবে। এটা প্রমাণ করার জন্য তারা হিসাবনিকাশও করে ফেলেছেন। তাদের হিসাব অনুসারে, আগামী মার্চ পর্যন্ত শরনার্থী সমস্যাকে কেন্দ্র করে ভারত সরকারের প্রায় ৯০০ মিলিয়ন ডলার খরচ হবে যা ১৯৬৫ সালে ভারত – পাকিস্তান যুদ্ধের খরচের প্রায় ১৩ গুণ। সংক্ষেপে বলতে গেলে, যদি এই সমস্যা প্রলম্বিত হয়, তবে ভারতের বাজেট এই চাপ বহন করতে পারবে না। প্রকৃতপক্ষে ভারতীয়দের সবচেয়ে বড় আশংকা করছে ছিল যাতে প্যালেস্টাইনের মতো অবস্থা সৃষ্টি না হয়, সেক্ষেত্রে সরকারকে উদবাস্তু সমস্যার সাথে সাথে পূর্ব বাংলায় বৈরী পাকিস্তানী সেনাদের ক্রমাগত এবং ব্যয়সাপেক্ষ আক্রমণ দুটোকেই মোকাবেলা করতে হবে। একজন ভারতীয় অফিসার বলেন যে “আমরা যুদ্ধের ঝুঁকি মেনে নিয়েছি। কারণ আমরা বিশ্বাস করি যে এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে যে বিপদের সম্ভাবনা আছে তা যুদ্ধের ঝুঁকির চেয়েও অনেক বেশী”।

এই ধরনের মানসিকতা পাকিস্তানের মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানকে একটি বেদনাদায়ক উভয়সঙ্কটে পতিত হতে বাধ্য করেছে- তাকে পরাজয় মেনে নিয়ে পূর্ব-পাকিস্তান থেকে অপমানজনক প্রত্যাহারে রাজি হতে হবে কিংবা একটা নিজ থেকেই একটি ভয়াবহ যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটানোর ঝুঁকি নিতে হবে। এই শোচনীয় বিকল্পগুলোর মধ্যেও ইয়াহিয়া একটি সুবিধাজনক মধ্যপন্থী অবস্থান বের করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। পাকিস্তানের তথাকথিত “২২ পরিবার” (যারা দেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যবসায়ী নেতা, যারা নিজেদের বিনিয়োগ বাঁচানোর জন্য প্রাথমিকভাবে পূর্ব পাকিস্তানে বল প্রয়োগে বিদ্রোহ দমনের পক্ষপাতী ছিলেন, কিন্তু এখন প্রলম্বিত যুদ্ধের কারণে লোকসানের আশংকা করছেন) এর চাপে ইয়াহিয়া এখন গোপনে সমঝোতা করার চেষ্টা করছেন, এমনকি পূর্ব-পাকিস্তানে গনভোটের সম্ভাবনাও চিন্তা করছেন। যুক্তরাষ্ট্রের একজন কূটনৈতিক বিষয়টি এভাবে ব্যাখ্যা করেন “এটা পরিষ্কার যে ইয়াহিয়া এতোদিনে কিছু বিষয় অনুধাবন করতে শুরু করেছেন যা মাস খানেক আগেও তার বিবেচনায় আসেনি”।

রাষ্ট্রদ্রোহিতার শাস্তি

গ্রহণযোগ্য সমঝোতায় পৌঁছতে ইতোমধ্যে ইয়াহিয়ার বেশ দেরী হয়ে গেছে। তার সমঝোতা করার ইচ্ছার স্বত্বেও এটি প্রতীয়মান হয় যে, তিনি এখনো দিল্লীর কাছে গ্রহণযোগ্য একমাত্র সমাধান- শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দেওয়া এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সম্পর্কে আলোচনা শুরু করায় অনাগ্রহী। রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে মুজিব এখনো পাঞ্জাবের লায়ালপুর শহরের কারাগারে বন্দী। ইয়াহিয়া এখনো পর্যন্ত কোন মতেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার মত অপমান মেনে নিতে প্রস্তুত নন। যতই ভারতের দিক থেকে চাপ বাড়ছে , ইয়াহিয়া এমন একজন মানুষের মত দম্ভোক্তি যে জানে যে একটি যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী তিনি বলেন “যদি তিনি(মিসেস গান্ধী) একটি যুদ্ধ চান, তবে তাকে আমি টা দেব। যদি এই মহিলা মনে করে থাকে যে সে আমাকে ভয় দেখাবে, তবে আমি সেটা পাত্তা দিতে রাজি নই”।

যদি সম্পূর্ণরূপে যুদ্ধ শুরু হয়, তবে বেশীরভাগ লোকেরই ধারনা পাকিস্তান কাশ্মীর বা ভারতের পশ্চিমাংশে প্রথম আঘাত হানবে। এটা মনে করা হয় যে পাকিস্তানের বিশ্বাস, যদি এই মাত্রার একটি সংঘাত উসকে দেওয়া যায় তাহলে এই সঙ্কট জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ আমলে নিতে বাধ্য হবে, এমনকি হয়তো ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে একটি যুদ্ধবিরতি আরোপ করা যাবে। কিন্তু তাদের এই পরিকল্পনা শুরুতেই ব্যর্থ হয়। যার একটি কারণ হলো, উপমহাদেশকে নিয়ে বৃহৎ শক্তিগুলোর দ্বন্দ্বই সে সময় জাতিসংঘের যে কোন পদক্ষেপকে থামিয়ে দিতে যথেষ্ট ছিল। আরেকটি কারণ ছিল, একটি পাকিস্তানি আক্রমণ ভারতের অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী সেনাবাহিনীকে ইয়াহিয়ার বাহিনীকে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করতে একটি অজুহাত এনে দিত যার জন্য তারা এতদিন ধরে অপেক্ষা করছিল।

অন্যভাবে বলতে গেলে, ইয়াহিয়া স্বল্প-মেয়াদে যে কৌশলই অবলম্বন করুক না কেনো, পাকিস্তানকে পূর্বাঞ্চল থেকে থেকে পিছু হটতেই হবে বলে মনে হচ্ছে। এতদসত্ত্বেও, এটা কেউ মনে করছে না যে এই অঞ্চলকে দখল করে নেওয়ার কোন ইচ্ছা ভারতের আছে। আপাতত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বিদ্রোহীরা সীমান্তের ওপারের ভারতীয় হিন্দুদের সাহায্য গ্রহণে অত্যন্ত আগ্রহী হলেও, কোন ধরনের রাজনৈতিক জবর-দখলের ভারতীয় প্রচেষ্টাকে তারা ভালো দৃষ্টিতে দেখবে না এতে কোন সন্দেহ নেই। প্রকৃতপক্ষে, ভারত তার দরজায় শুধু একটি স্বাধীন বাংলাদেশের উপস্থিতির কারণেই সম্ভাব্য এত সমস্যার সম্মুখীন হবে যে, সেটাই বাংলাদেশকে তার ভূখণ্ডে অন্তর্ভুক্ত করার ইচ্ছাকে দমিয়ে রাখবে।

পূর্ব বাংলা তার সবচেয়ে সমৃদ্ধির সময়েও আন্তর্জাতিক অনুদানের ওপর নির্ভরশীল ছিল, সেখানে সাম্প্রতিক অস্থিতিশীলতার কারণে তার পরিস্থিতি স্বাভাবিকের চেয়ে আরও খারাপ হয়েছে। এর দুর্বল যোগাযোগ অবকাঠামো এবং ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র শিল্পব্যবস্থা প্রায় পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। ন্যূনতম স্থিতিশীলতা অর্জনের জন্যও এই অঞ্চলের প্রচুর ভারতীয় অর্থ ও কাঁচামালের প্রবাহের প্রয়োজন হবে। এই ত্রাণ সাহায্য ছাড়া বাংলাদেশ নৈরাজ্যের মুখে পড়তে পারে, এবং উপমহাদেশে মার্ক্সবাদী উগ্রপন্থার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হতে পারে। পরিশেষে, যদিও সীমান্তের উভয় পারের সমাজবিজ্ঞানীরাই এই তত্ত্বকে অগ্রাহ্য করেছেন, কিন্তু নয়া দিল্লীর কিছু সরকারি কর্মকর্তা্র আশংকা যে হয়তো একটি স্বাধীন বাঙ্গালি রাষ্ট্র তার সংলগ্ন পশ্চিমবঙ্গে ভারতের অভ্যন্তরীণ বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে আরও রসদ যোগাবে।

ভারতীয় দৃষ্টিকোণ থেকে, এ ব্যাপারে কোন প্রশ্নের অবকাশ ছিল না যে একটি স্বাধীন বাংলাদেশ খারাপের তুলনায় অনেক বেশি সুফল বয়ে নিয়ে আসবে। প্রাথমিক ভাবে, নয়া দিল্লীর পক্ষে অন্তত শরণার্থী সমস্যার কিছুটা সমাধান করা সম্ভব হবে। দীর্ঘমেয়াদে, পূর্ব এবং পশ্চিম বঙ্গের মধ্যে ঐতিহ্যগত বাণিজ্য প্রক্রিয়ার পুনপ্রতিষ্ঠা ভারতের জন্য অর্থনৈতিক সুফল নিয়ে আসবে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, পাকিস্তানের এই বিভক্তির ফলে উপমহাদেশে ভারতের একচ্ছত্র আধিপত্য নিশ্চিত হলো। নিজেদের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬০ শতাংশ, বৈদেশিক বিনিয়োগের প্রায় ৫০ শতাংশ এবং আয়করের প্রায় ২০ শতাংশ হারিয়ে পাকিস্তান নয়াদিল্লী সরকারের জন্য একটি স্থায়ী হুমকি হিসাবে দাঁড়াবে সে সম্ভাবনা কম, এবং প্রতিবেশী আফগানিস্তানের মতই পাকিস্তানের একটি কূটনৈতিক জটিলতায় নিমজ্জিত হয়ে পড়াটা অবশ্যম্ভাবী বলে মনে হচ্ছে।

চীনের প্রভাব

পাকিস্তান পথ থেকে সরে যাওয়ার ফলে ভারত নিঃসন্দেহে উপমহাদেশের বাইরে তার রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করবে। বিশেষত এশিয়ায়, মিসেস গান্ধী এবং তাঁর সহকর্মীরা পিকিং এর ব্যাপক প্রাধান্য দূর করার দিকে দৃষ্টিপাত করবেন। ভারতীয়রা তাদের চীনা প্রতিদ্বন্দ্বীদের তুলনায় কূটনৈতিক অঙ্গনে দ্বিতীয় স্থানে অবস্থান করাকে দীর্ঘদিন ধরেই অসন্তোষের সাথে দেখছে, এবং চীনের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি যেভাবে নিবন্ধ সেটা নয়া দিল্লীর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জন্য আরও বেদনার কারণ হচ্ছে। ভারতের একজন রাজনীতি বিশ্লেষক মন্তব্য করেন “ নিক্সন কেন চীনকে একটি পরাশক্তি বলতে চাইছেন? তাদের পারমাণবিক অস্ত্র আছে বলে? ১৯৬০ সালেই আমরা চীনের মতোই এ ধরনের অস্ত্রের ক্ষেত্রে এগিয়ে ছিলাম, কিন্তু সকলের স্বার্থে আমরা সে পথ বেছে নেইনি। আর এখন আমাদের সাথে সৎ-সন্তানের মত আচরণ করা হচ্ছে।“ দৃশ্যত, পারমাণবিক অস্ত্র ছাড়াই ভারত দ্রুত এই সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটানোর আশা রাখে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেই দক্ষিণ এশিয়ার সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান বাধার সম্মুখীন হচ্ছে । এটা স্পষ্ট প্রতীয়মান হচ্ছে যে, কিছুটা অনিচ্ছাসত্ত্বেও সম্প্রতি পাকিস্তানকে সাম্প্রতিক সংঘাতে সমর্থন দিয়ে ওয়াশিংটন ভুল পক্ষে বাজি ধরেছে। গত সপ্তাহে আমেরিকার একজন কুটনৈতিক বলেন, “যদি পুরোদমে যুদ্ধ শুরু হয় তাহলে ভারতীয়রা ভাববে আমরা তাদের বিপক্ষে এবং পাকিস্তানিরা ভাববে আমরা তাদের সাথে বিস্বাসঘাতকতা করেছি। কেবল রাশিয়াই পেরেছে তাদের হিসাব বরাবর মেলাতে। তারা জানে যে পশ্চিম পাকিস্তানের ৬ কোটি এবং পূর্ব-পাকিস্তানের ৮ কোটি যেভাবেই যোগ করা হোক না কেন, তাতে কখনোই ভারতের ৫৫ কোটির সমান হবে না”।

প্রকৃতপক্ষে ভারতের পরেই বাংলার এই যুদ্ধে যে বিরাট বিজয় পেয়েছিল সে হলো সোভিয়েত ইউনিয়ন। অনেকেই অনুমান করেছিলেন যে মস্কোর ভারতকে সমর্থন করার উদ্দেশ্য ছিল উপমহাদেশে এবং ভারত মহাসাগরের চারপাশে ব্যাপকভাবে প্রাধান্য বিস্তার করা। কিন্তু এ বিশ্লেষণ কিছুটা তাড়াহুড়া করে করা হয়েছে বলে প্রতিপন্ন হচ্ছে, কারণ রাশিয়া এই অঞ্চলে কেবল তাদের অবস্থানই কিছুটা বৃদ্ধি করেছে তাদের পক্ষে থাকাকে কিছুক্ষেত্রে অতিরঞ্জিত করা হয়ছে। এই সংকটময় পরিস্থি্তির কোন পর্যায়েই অন্য কারো সাহায্য চাননি, এবং তার নিজ লক্ষ্যে উনি দৃঢ়ভাবে এগিয়ে গেছেন। এবং এখন ভারতের এখনকার চরম সুবিধাজনক অবস্থায় এমন আশঙ্কা খুবই কম যে দৃঢ়চেতা এই প্রধানমন্ত্রী বাইরের কারো কথা শুনবেন।

ঘর শত্রু বিভীষণ/ ঘরের চেয়ে পর উত্তম

আজকাল প্রতিদিন সকাল ৬ টায় পি এন লুথরার কলকাতার তৃতীয় তলার ফ্ল্যাটে টেলিফোন বেজে ওঠে। প্রথমবার ফোন বেজে ওঠার সাথেই ৫৪ বছর বয়সী অবসরপ্রাপ্ত বৃদ্ধ কর্নেল লুথরা ,যিনি বাঙ্গালি শরনার্থীদের জন্য ত্রাণকার্য সমন্বয় করছেন, তিনি অসংখ্য নৈমিত্তিক সমস্যার অভিযোগে জেগে ওঠেন। আজ সকালে প্রথম যে ফোন করেন তিনি জানান ভারতের সীমান্তবর্তী পূর্ব- পাকিস্তানের কুমিল্লা জেলা সংলগ্ন ত্রিপুরা রাজ্যে গতকাল বরাদ্দকৃত ৬৭ –টি খাদ্য পরিবহনকারী গাড়ির বদলে মাত্র ৪৫টি গাড়ী এসেছে। দ্রুততার সাথে তিনি কলকাতার শ্রম মন্ত্রণালয়ের তার অস্থায়ী কার্যালয়ে ছুটে যান। লুথরা তার আসামের জন্য রাখা সামান্য বরাদ্দ থেকে কিছু খাদ্য সরিয়ে নেবার আদেশ দেন। কিন্তু যখন একজন সাহায্যকারী দেখলো যে আসামের সাথে ফোনে যোগাযোগব্যবস্থা এত খারাপ যে সে তার বার্তা বোধগম্যভাবে পৌঁছাতে পারছিল না, তখন একটা টেলিগ্রাফ অর্ডার পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হল। । লুথরা অসহায়ভাবে বললেন, “সেখানে পৌঁছাতে কমপক্ষে ২৪ ঘণ্টা লাগবে। আগামী ৪৮ ঘন্টার মধ্যে আমি কোন খবর পাবো না”।

সারাদিন জুড়ে ছিল এই সমস্যা শুধু বৃদ্ধিই পাচ্ছিল। ভারতীয় সরকারের তথ্য অনুসারে ইতোমধ্যে প্রায় নয় লক্ষ আশি হাজার বাঙ্গালী শরনার্থী ভারতে প্রবেশ করেছে এবং প্রায় প্রতিদিন ১২০০০ এর মত লোক পূর্ব-পাকিস্তানের ১৩০০ মাইল দীর্ঘ সীমান্ত এলাকা দিয়ে ধুঁকে ধুঁকে প্রবেশ করছে। অন্য সব কিছুর সাথে সাথে, তারা লুথরা এবং তার ২৮০ জন সহকর্মীর জন্য যা একটি অবিশ্বাস্য কৌশলগত সমস্যা সৃষ্টি করছে। শীত এর শুরুতে হিমালয়ের পাদদেশে শীতলতম স্থানগুলোতে অবিলম্বে প্রায় ৪০ লক্ষ কম্বল বিতরণ করতে হবে, কিন্তু বাইরে থেকে ৫ লক্ষেরও কম কম্বল এসে পৌঁছেছে। পানীয় জলের জন্য বাংলাতে খননকৃত ৬ হাজার নলকূপের সাথে আরও প্রায় ৫ হাজার নলকূপ বসানো হয়েছে। সাম্প্রতিক খবরে বলা হয়েছে জরুরী ঔষধপত্রের প্রায় ৩০ শতাংশ এবং খাদ্যসামগ্রীর প্রায় ১৫ শতাংশ ১০০০ টি ত্রাণশিবিরে পৌঁছানোর আগেই খোয়া যায়, এর ভিত্তিতে লুথরা বলেন, “ আমরা আরও কড়া নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে।“ কিন্তু সহকারী এর সাথে দ্বিমত পোষণ করে বলেন “ আমরা কড়াকড়ি যত বাড়াবো, সমস্যাও তত বাড়বে। এই অনিবার্য চৌর্যবৃত্তি ঠেকানোর চেষ্টার থেকে দ্রুততা এখন বেশি জরুরী”।

শক্তিশালী/ মহৎ সাহায্য

প্রকৃতপক্ষে সকল রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে ভারতীয় ত্রাণকর্মীরা তাদের সেবার হাত প্রসারিত করেছে। কলকাতার দমদম এয়ারপোর্টের কাছে সল্টলেক ক্যাম্পের কাছে ১৬ জন ডাক্তার নিয়ে গড়ে উঠেছে একটি হাসপাতাল। যারা ক্যাম্পের শিশুমৃত্যু হার কমাতে সাহায্য নিরলসভাবে। এবং যেখানে আগে দিনে ৫০ জন শিশু মারা যেতো এখন তা কেবলমাত্র ৩ এ নামাতে সক্ষম হয়েছে। এছাড়া শিশুরা সেখানে খোলা আকাশের নীচে পড়াশোনা করছে এবং তাদের পাঠদান করছেন ১১০ শিক্ষক যারা নিজেরাও পূর্ব-পাকিস্তানের শরনার্থী।
সল্টলেক ক্যাম্পে জনসাধারণের জন্য প্রতিদিনের বরাদ্দ প্রায় ২০০ ট্রাক খাদ্য এবং রসদ- এর মধ্যে জনপ্রতি প্রায় ১০.৫ আউন্স চাল, ৩.৫ আউন্স গম এবং ৩.৫ আউন্স সব্জি বরাদ্দ করা হয়েছে। সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার পর অপুষ্টিতে আক্রান্ত শিশুদের জন্য আলাদা একটি খাদ্য কর্মসূচীর আওতায় প্রতি শিশুর জন্য প্রতি দিন এক পোয়া দুধ এবং মাল্টিভিটামিন ওষুধ দেওয়া হয়েছে।

এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, সল্টলেক ক্যাম্পটি একটি আকর্ষণের জায়গা। এরকম আরো ১৫০ টি ক্যাম্পে যেখানে বিদেশী পর্যবেক্ষকগণ যাবার অনুমতি পেয়েছেন, তারা জানিয়েছেন যে এরকম সব ক্যাম্পেই ১০ টি পরিবার বা ৫০ জন লোকের একটি ৫০ ফুট বাই ২৪ ফুট তাঁবুতে একত্রে গাদাগাদি করে থাকা একটা খুবই স্বাভাবিক বিষয়। ছোট শিশুরা চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, কেউ কাঁদছে , কেউ বা বমি করছে এবং মানুষের মল-মূত্রের দুর্গন্ধ ক্যাম্পের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ছে। এ এক দুঃসহ পরিস্থিতি। কিন্তু উদ্বাস্তুরা এর সাথেই নিজেদের মানিয়ে নিয়েছে, কারণ অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, এখানের আসার পূর্বে এদের অনেকের অবস্থা বাংলাদেশের গ্রামে এর চেয়েও খারাপ ছিল। বেশীরভাগ ক্যাম্পেই একজন শরনার্থী যদি মাত্র ৩০০ গজের মধ্যে অবস্থিত পার্শ্ববর্তী ভারতীয় একটি গ্রামের দিকে তাকায়, তবে সে দেখবে যে, এই ত্রাণ কর্মসূচীর কল্যাণে সে ভারতের স্থানীয় জনগোষ্ঠীর তুলনায় বেশি খেতে পাচ্ছে, এবং উন্নততর চিকিৎসাসেবাও পাচ্ছে।

তীব্র অসন্তোষ

সঙ্গত কারণেই উদ্বাস্তুদের প্রতি ভারত সরকারের উদার দৃষ্টিভঙ্গী ভারতের স্থানীয় জনসাধারণের মনে দিন দিন ক্ষোভ সৃষ্টি করছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যখন পূর্ব-পাকিস্তান থেকে স্রোতের মতো প্রায় ২০ হাজার শরনার্থী হঠাৎ করে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের অন্তর্গত বালাত গ্রামে প্রবেশ করে, তখন লুথরার ত্রাণকর্মীরা তৎক্ষণাৎ ৪০০ শয্যা বিশিষ্ট একটি হাসপাতালের ব্যবস্থা করে এবং সেইসাথে একটি ভ্রাম্যমান এক্স-রে ইউনিট, একটি ইলেকট্রিক জেনারেটর এবং শল্য চিকিৎসার যন্ত্রপাতির ব্যবস্থা করে। বালাত গ্রামের তিন হাজার স্থায়ী অধিবাসীরা, যাদের অনেকেই এর আগে কখনো হাসপাতালই দেখেনি, তারা শরণার্থীদের প্রতি এত নিবিড় যত্নে বিস্মিত হয় এবং স্বাভাবিকভাবেই তাদের মনে প্রশ্ন জাগে হাসপাতালে তাদের চিকিৎসারও ব্যবস্থা কেন করা হচ্ছে না। একইভাবে কলকাতা শহরে, যেখানে শহরের ৮০ লক্ষ লোকের মধ্যে অন্তত পাঁচ লক্ষ লোক বেকার এবং প্রায় ৭০ ভাগ পরিবার মাসে প্রায় ১২ ডলার মাত্র উপার্জনের উপর ভিত্তি করে বেঁচে আছে, সেখানে এমন অভিযোগ উঠেছে যে শরণার্থীরা দিনপ্রতি মাত্র ১ রুপীতে কাজ করতে রাজি হয় অথচ অদক্ষ শ্রমিকদেরই মজুরী যেখানে ৩ রুপী। কর্তৃপক্ষের কঠোর ব্যবস্থার কারণে কলকাতার বস্তিবাসী এবং একই মাত্রায় দরিদ্র উদ্বাস্তুদের মধ্যে যেকোন মূল্যে কাজ পাওয়ার জন্য দাঙ্গা পরিস্থিতি প্রতিহত করা সম্ভব হয়েছে।

এই ধরনের সামাজিক সঙ্কট এবং দোদুল্যমান অর্থনৈতিক অবস্থার ভার ভারতের বহনক্ষমতার ঊর্ধ্বে। পূর্বাভাস থেকে জানা গেছে যে , এই কর্মসূচীতে আগামী মার্চের মধ্যে ৯০০ মিলিয়ন ডলার খরচ হবে, যার মধ্যে ২৫০ মিলিয়ন ডলার বৈদেশিক সাহায্য এবং অনুদান থেকে পাওয়া গেছে। ভারতের বর্তমান মোট বাজেটের প্রায় ১৬ শতাংশ শরনার্থী সমস্যার সমাধানে ব্যয় হয়ে গেছে, এবং গত দুবছর সুফলা হওয়ায় দুঃসময়ের জন্য একটু একটু করে গড়ে তোলা সংরক্ষিত শস্যভাণ্ডার দ্রুত নিঃশেষিত হয়ে যাচ্ছে। বিশেষ কর আরোপের পাশাপাশি সরকার অন্যান্য খাতেও রাতারাতি খরচ কমাতে বাধ্য হয়েছে যেটা এমনকি দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়ন পরিকল্পনার ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলছে। নিউজউইক প্রতিবেদক আর্নড দ্য বোর্শগ্রেভকে একজন ভারতীয় কর্মকর্তা বলেন “৭২ সালে এই উদ্বাস্তু সমস্যায় আমাদের ঠিক কতো টাকা ব্যয় হবে আমরা এখনো অবগত নই। এর প্রভাব এত ভয়াবহ হতে পারে যে বিষয়ে আমাদের ভাবতেও ভয় লাগছে”।

দুঃস্বপ্নের সূচনা

কিন্তু ভারতকে অবশ্যই ভাবতে হবে যে ক্রমবর্ধমান ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে পূর্ব-পাকিস্তান থেকে আসা শরনার্থীদের অনেকেই পূর্ব-পাকিস্তানে এমনকি স্বাধীন বাংলাদেশেও ফিরতে চায়না। শরনার্থী শিবিরেরে ৮০ ভাগ জনগোষ্ঠী হিন্দু যারা পাকিস্তানি বাহিনীর রক্তাক্ত নিপীড়নের স্বীকার হয়েছে, এবং এখনে ভারতে অবস্থানকালে তাদের অনেকেই ভেবে পাচ্ছে না কেন তাদের পূর্ব পুরুষরা ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময় মুসলিম প্রধান বাংলা থেকে তাদের বের করে নিয়ে যেতে পারেনি। যদিও তাদেরকে বোঝানোর চেষ্টা করা হচ্ছে যে স্বাধীন বাংলাদেশ একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হবে যেখানে সকলের সমান অধিকার থাকবে, কিন্তু খুব অল্প সংখ্যক হিন্দুই বিশ্বাস করেন যে এই ক্রমোন্বতিশীল ত্রাণ শিবির ছেড়ে তাদের পূর্ব বঙ্গের নিজ নিজ দুর্যোগপ্রবণ গ্রামে ফিরে যাওয়া সুফলদায়ক হবে। বোর্শগ্রেভকে একজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা বলেন যে শরণার্থীদের যদি দ্রুত ফেরত পাঠানো না যায়, তবে ভারতীয় সেনাদের হয়তো বেয়নেটের মুখে তাদেরকে বাড়ি পাঠাতে হবে। নয়া দিল্লীর জন্য এমন একটা কিছু হবে একটি দুঃস্বপ্নের মতো, এবং সন্দেহাতীত ভাবে বলা যায়, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সমস্যা সমাধানের জন্য সেনাবাহিনী নিয়োগের মাধ্যমে যে ভারতীয় প্রচেষ্টা তার পেছনে এটাই অন্যতম কারণ।

দারুণ প্রচেষ্টা

যদিও এর প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে পাকিস্তান সরকারের দ্বারা বিচারাধীন অবস্থায় আছেন, কিন্তু এরপরেও স্বঘোষিত বাংলাদেশের জনগণ ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের নেতৃত্বাধীন চার সদস্যের একটি সরকার গঠন করেছে। সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমে তার দেওয়া প্রথম সাক্ষাতকারে সৈয়দ নজরুল ইসলাম নিউজ উইকের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক Arnaud de Borchgrave এর সাথে আলাপ করেন। সাক্ষাতকারের চুম্বক অংশ নিচে দেওয়া হলঃ

সংগ্রামী অভিযান

আমার ছেলেরা খুবই চমৎকার কাজ করেছে। আমরা এখন সুসংগঠিত এবং কার্যকর। জনসাধারণের দেশপ্রেমও এখন সামরিক গোয়েন্দা তথ্যের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উৎস, সব শিক্ষিত মানুষই আমাদের পক্ষে আছেন। আমার মনে হয় না আর বেশি সময় লাগবে। দখলকৃত এবং মুক্ত সব এলাকাতেই আমার পক্ষে কি পরিমাণ সমর্থন, তা আপনি নিজেই দেখেছেন।

বাইরের রাষ্ট্রের প্রভাব

এটি পুরোপুরি আমাদের নিজস্ব আন্দোলন, এবং ভারতের তরফ থেকে আমাদের উপর কোন চাপ নেই। বামপন্থীরাও আমাদের সমর্থন করছেন এবং আমার সরকারের প্রতি পূর্ণ আনুগত্য দেখিয়েছেন । কিন্তু তারা খুব বড় কোন প্রভাব রাখেন না।

যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা

যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যম কিছু মৌলিক বিষয়ে আলোকপাত করেছে। এই কাহিনী এখন সবার জানা। ফলশ্রুতিতে, তোমাদের কংগ্রেসও আমাদের সমর্থন করছে। কিন্তু আমরা এখনো বুঝতে পারছি না কেন যুক্তরাষ্ট্র সরকার আমাদের বিপক্ষে।

যুদ্ধের শেষ প্রান্তে

যদি ইয়াহিয়ার এটা অনুধাবন করার দূরদর্শিতা থেকে থাকে যে স্বাধীনতা অনিবার্য তাহলে আমরা বিনা রক্তপাতে এই সংগ্রাম স্থগিত করার ব্যাপারে আলোচনা করতে পারতাম। প্রথমত তাকে মুজিবকে মুক্তি দিতে হবে এবং স্বাধীনতার স্বীকৃতি দিতে হবে । তখনি লড়াই থামানো হবে এবং সৈন্যবাহিনী প্রত্যাহার করা হবে। যদি ইয়াহিয়া আপোষ-রফা করতে চান এবং শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরে আগ্রহী হন, তবে শুধু মুজিবকে মুক্তি দেওয়াই তার জন্য যথেষ্ট। যদি তিনি শান্তিপূর্ণ হস্তান্তরে আগ্রহী না হন, তবে আমরা শেষ পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাবো।