You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.03 | আওয়ামী লীগ ইয়ুথ কমান্ড (Youth Command) | মার্চ ১৯৭১ - সংগ্রামের নোটবুক
আওয়ামী লীগ ইয়ুথ কমান্ড (Youth Command) | মার্চ ১৯৭১
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সময় বঙ্গবন্ধুর সাথে ক্যান্টনমেন্টের সেলে যখন আলাপ করতাম তখন তাকে বলতাম যে, সংগঠনের কী হবে?’ বঙ্গবন্ধু বলতেন, “কিছু চিন্তা করিস না, আমি বের হলে পরেই সংগঠন দেখবি দারুণভাবে চাঙা হয়ে উঠবে। আমার সমস্ত জায়গায় খুঁটি পোঁতা আছে, তারগুলাে টেনে দিলেই সমস্ত কিছু ইলেকট্রিকে পরিণত হবে।” এই কথাটা আমি ঠিক সম্পূর্ণভাবে বুঝতে পারতাম না, কিন্তু বঙ্গবন্ধু জেল থেকে বের হবার পর তার কথামতােই ঘটনা ঘটল। তিনি শুধু তারগুলাে টেনে দিলেন আর সেটা একটা বিরাট বৈদ্যুতিক শক্তিতে পরিণত হল, অবিশ্বাস্য একটা ব্যাপার হয়ে গেল। আমার মনে হয় যে, সংগঠন যে ব্যাপকতা লাভ করেছিল সেটাই পরবর্তীকালে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধকে কনটেইন করতে পেরেছিল।
সংগঠনের দুর্বলতাও ছিল, আবার সফলতাও ছিল। সফলতা ছিল যে, বঙ্গবন্ধু আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে বেরিয়ে আসবার পরে যে ধরনের আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তায় বিশাল মাপের নেতা হিসেবে ইমার্জ করলেন সেটা ছিল একটা প্রবল বড় শক্তি। সাথে সাথে তাকে যখন আটক করে ফেলল, তিনি যখন দৃশ্যত বর্তমান নন, সেই সময় একটা বিরাট দুর্বলতা যে, এখন পাওয়ার স্ট্রাকচারটা কী হবে, কার্যপদ্ধতি কী।অতএব আওয়ামী লীগের ভেতরে যে প্রবণতাটা সবসময় ছিল—দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ভিত্তিতে বঙ্গবন্ধুর সাথে সম্পর্ক, সেটার ভিত্তিতেই বাকি সম্পর্কগুলাে গড়ে উঠছিল। সবাই চেষ্টা করছে বঙ্গবন্ধুর নিকটে কীভাবে যাওয়া যায়, তার ঘনিষ্ঠ কীভাবে হওয়া যায়। বঙ্গবন্ধু যতটুকু ডেমােক্রেসি প্র্যাকটিস করতেন, যতটুকু সিস্টেম করতেন বা করাতেন, ততখানিই হত। আর যতখানি তিনি। করতে চাইতেন না ততখানি সংগঠনে হত না। সেটা তিনি সৃষ্টি করেছিলেন। আমার কাছে ভাল লাগে যে, অসহযােগ আন্দোলনের সময় এখানে হাইকমান্ড নামে একটা পাওয়ার স্ট্রাকচার গড়ে উঠে। হাইকমান্ড দলের একজন প্রেসিডেন্ট, তিনজন ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং দু’জন জেনারেল সেক্রেটারি (একজন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সম্পাদক, একজন প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক)-কে নিয়ে গড়ে উঠেছিল, কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগই ছিল মূলধারা। বঙ্গবন্ধু প্রেসিডেন্ট; সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মােশতাক আহমেদ, মনসুর আলি তিনজন ভাইস প্রেসিডেন্ট; তাজউদ্দীন আহমদ এবং কামরুজ্জামান দু’জন সাধারণ সম্পাদক- এই পাঁচজনকে নিয়ে আমাদের হাইকমান্ড গঠিত ছিল এবং এঁরাই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন।
আমার কাছে যেটা সবচেয়ে ভাল লাগে, বঙ্গবন্ধু কিন্তু ওই সময় এক দৃষ্টান্তমূলক পার্টির কর্মপদ্ধতি চালু করেছিলেন। সেটা আওয়ামী লীগের জন্যে চিরকালের একটা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকা উচিত ছিল—দল পরিচালনা করার জন্য কী ধরনের সাংগঠনিক যােগাযােগ থাকা দরকার সেটা তিনি করেছিলেন। ওই হাইকমান্ডের সাথে আলােচনা না করে বঙ্গবন্ধু কোন। সিদ্ধান্ত সেই সময় নেননি। প্রত্যেকটি ঘটনাতে এবং দিনে বােধ হয় একবার তাে বটেই দুই-তিনবারও তাদের বৈঠক হত। কামাল হােসেন ও আমি ছিলাম টাস্কফোর্সে। তাজউদ্দীন সাহেব আমাদের নেতৃত্ব দিতেন। এবং প্রয়ােজন হলে হাইকমান্ড আমাদের দু’জনকে ডাকতেন, আর প্রয়ােজন না হলে ডাকতেন না। আর যখন নিগােশিয়েশন শুরু হয় তখন কামাল হােসেন সাহেব নিগােশিয়েশন টিমে ছিলেন, তখন তাঁকে হাইকমান্ডে ডাকা হত । এই ছিল তখনকার হাইকমান্ডের গঠন। অর্থাৎ হাইকমান্ড একটা ছায়া ক্যাবিনেট হিসেবেই কাজ করেছিল।
আর একটা ছিল ইয়ুথদের সাথে লিয়াজো করার বিষয়, সেটা বঙ্গবন্ধু করতেন। সিরাজুল আলম খান, তােফায়েল আহমদ, শেখ মণি, আব্দুর রাজ্জাক এঁরা ছিলেন সেই ইয়ুথ কমান্ডে। ‘৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়লাভের পর ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবর্তে বিভিন্ন ধরনের টালবাহানা চলতে থাকে। তারপর বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ এবং অসহযােগের পর্ব। অসহযােগের সময় দুটো ব্যাপার ছিল—এক, আমাদের প্রতিদিনের কর্মসূচি ও প্রশাসনকে নির্দেশ দেয়া। কারণ তখন দেশ পরিচালনার ভার এসে পড়ল কার্যত আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডের উপর । দ্বিতীয়ত, আমাদের পরবর্তী পরিকল্পনা কী তা নির্ধারণ করা। সে সময়ে তাজউদ্দীন সাহেবের উপর মূল যে দায়িত্ব ছিল সেটা হচ্ছে, প্রতিদিন কী নির্দেশ যাবে জনগণের কাছে, কী করবে, কী করবে না, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কতটুকু খােলা। থাকবে, কতটুক থাকবে না—এইগুলাে পরিকল্পনা করা, নির্দেশ দেয়া ইত্যাদি। এই কাজে আমরা টাস্ক ফোর্সের সদস্যরা সহযােগীর ভূমিকা পালন করেছি।
আমাদেরকে বিভিন্ন সেক্টরের সাথে বৈঠক করতে হত। ব্যাঙ্কার যেমন ছিলেন, টেলিফোন-টেলিগ্রাফের কর্মকর্তা ছিলেন, ওয়াসা, হাসপাতাল কর্মীরা ছিলেন— এমন সমস্ত সেক্টর । তারপর বিভিন্ন জায়গার সমস্যা, যেমন চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা—সেখানে আবার দায়িত্ব দিতে হত বিভিন্ন লােকজনদেরকে। প্রত্যেক জায়গায় সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়েছে, তিনজনকে কনভেনার করে। এই সংগ্রাম পরিষদ স্থানীয়ভাবে যে সমস্ত সমস্যা হচ্ছে তার সমাধান করত। তারপর যেখানে ক্যান্টনমেন্ট ছিল সেখানে আর্মির সাথে যে সমস্ত দ্বন্দ্বগুলাে তৈরি হচ্ছে চট্টগ্রাম, জয়দেবপুরসহ বিভিন্ন জায়গায়—সেগুলােকে সংগ্রহ করতে হত। এই সমস্ত নিয়ে সন্ধ্যার পর বঙ্গবন্ধুর সাথে আমাদের একটা আলােচনা করতে হত। ওই আলােচনায় বঙ্গবন্ধুকে সমস্ত কিছু ব্রিফ করতে হত যে, কী হল এবং আমরা কী প্রেসে দিচ্ছি ইত্যাদি। সারা পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিটি অঞ্চলের সাথে যােগাযােগ রক্ষা করার জন্য ৩২ নম্বরে ২৪ ঘণ্টা টাস্ক ফোর্স থাকত।
১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত এই ২৪/২৫টি দিন আসলে ৩২ নম্বর থেকেই এই অঞ্চলের সমস্ত কিছু পরিচালিত হত।
Reference:
ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের সাক্ষাৎকার
তাজউদ্দীন আহমদ, আলোকের অনন্তধারা, সিমিন হোসেন রিমি
সংগ্রামের নোটবুক
ছবি – ইয়ুথ কমান্ডের সাথে বঙ্গবন্ধু।
শিল্পী – গৌরব, সংগ্রামের নোটবুক।

আওয়ামী লীগ ইয়ুথ কমান্ড ১৯৭১