You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা: ১লা অক্টোবর, সোমবার, ১৪ই আশ্বিন, ১৩৮০

দুর্বৃত্ত দমনে বঙ্গবন্ধুর কড়া নির্দেশ

প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের প্রতিটি থানায় দুষ্কৃতিকারীদের তালিকা তৈরির নির্দেশ দিয়েছেন। বাংলার জনজীবনে শান্তি ও জান-মালের নিরাপত্তা বিধানের উদ্দেশ্যই বঙ্গবন্ধু সমাজবিরোধী দুষ্টচক্র দুষ্কৃতিকারী অভিযানের ব্যবস্থা গ্রহণে প্রতি জোর দিয়েছেন। কুখ্যাত চোর, ডাকাত, দুর্নীতিবাজ ও সমাজবিরোধী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার জন্য বিডি আর ও রক্ষীবাহিনীকে দেশের ২৫০ টি থানায় পাঠানোর কার্যকর ব্যবস্থা ইতিমধ্যে সম্পন্ন করা হয়েছে। থানায় থানায় পুলিশ বাহিনী দাগি চোর-ডাকাত ও দুষ্কৃতিকারীদের নামের তালিকা প্রস্তুত করার জন্য পূর্ণোদ্যমে কাজে লেগে গেছে। বঙ্গবন্ধু এবং সরকারের এই সুদীর্ঘ পদক্ষেপের ফলে দেশের বিপর্যস্ত অতিষ্ঠ জনসাধারণের মনে আস্থা ও স্বস্তিকর পরিস্থিতি উদ্রেক হওয়াই স্বাভাবিক। এ ব্যাপারে জনসাধারণ চাইছেন সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তি ও পেশাদার টাউটদের প্রভাব কিংবা রাহুগ্রাসে যেন সত্যিকারের নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে শত্রুদের তালিকা প্রণয়ন সম্পন্ন করা হয়। সমাজের কে শত্রু কে মিত্র তা প্রতিটি অঞ্চলের জনসাধারণই ভালোভাবে অবগত রয়েছেন। সরকার মহৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়েই দুষ্কৃতিকারী দমনের জন্য কড়া ব্যবস্থা অবলম্বন করতে বাধ্য হয়েছেন। দেশের জনগণ বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে এরকমই একটা সুস্পষ্ট নির্দেশ প্রতীক্ষায় ছিলেন। এই ব্যবস্থা অবলম্বনের ফলে যেন সত্যিকারের দাগি ব্যক্তিরা সাজা পায় এবং জনজীবনে শান্তি ও নিরাপত্তা ফিরে আসে, দেশের প্রতিটি মানুষের মতো আমাদেরও এটাই প্রত্যাশা। দুষ্কৃতিকারীদের তালিকা প্রণয়নের পর যদি দেখা যায় যে, যথার্থ দাগি আসামি কিংবা প্রকৃত দুষ্কৃতিকারীদের নাম তালিকায় নেই কিংবা পরিবর্তে নিরাপরাধ ও নিরীহ কোন ব্যক্তির নাম দুষ্কৃতিকারীর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে তাহলে সম্পূর্ণ ব্যাপারটাই একটা বড় রকমের প্রহসনে পরিণত হবে। কাজেই দুষ্কৃতিকারী তালিকা প্রণয়নের ব্যাপারে তাতে বিন্দুমাত্র ফাঁক ও ফাঁকি না থাকে, সেই জন্য সংশ্লিষ্ট মহল সর্তকতা অবলম্বন করা একান্ত দরকার।
স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর থেকে এ পর্যন্ত আমরা দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির যে চরম অবনতি লক্ষ্য করে আসছি, তাতে আমরা মনে করি, এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে দেশের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা কোনক্রমেই নিরাপদ থাকতে পারে না। সমাজবিরোধী দুষ্কৃতিকারীদের দৌরাত্ম্য ও তৎপরতা দিন দিন এমন অবনতির দিকে ধাবিত হচ্ছিল যে এক আতঙ্কজনক পরিস্থিতির কবলে পড়ে নিরাপদ নিশ্চিতে রাতের ঘুমও আমাদের জন্য হারাম হয়ে গিয়েছিল। আমরা ভেবেছিলাম দুস্কৃতিকারীরা বোধ হয় নিজেদের উদ্যোগেই আত্মশুদ্ধির সহজ পথ বেছে নেবে। সহৃদয় সরকারও সম্ভবত সে জন্যই এতদিন নম্র ভূমিকা পালন করার পর এবার কঠোর হতে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের প্রতি মনোযোগী হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু স্বয়ং দুর্বৃত্ত খতম অভিযানের ডাক দিয়েছেন। দেশব্যাপী এ অভিযানের সময় নিশ্চয়ই কোন পক্ষপাতিত্বের সুযোগ কিংবা অবকাশ দেয়া হবে না। বঙ্গবন্ধু নিজেও বলেছেন, তার উদারতাকে যেন দুর্বৃত্তরা দুর্বলতা মনে না করে। বঙ্গবন্ধু এবার তাই যৌক্তিক কারণেই চরম হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন যে, দুষ্কৃতিকারীদের আর রেহাই নেই। দেশের জনগণ বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে এই রকমই একটি নির্মম ও নির্দয় নির্দেশের জন্য দিন গুনছিলেন। সেই প্রত্যাশিত নির্দেশ এবার নেতার কাছ থেকে পাওয়া গেছে। থানায় থানায় দুষ্কৃতকারী দমন তৎপরতা শুরু হয়ে গেছে। খুবই আশার কথা। আমরা বঙ্গবন্ধুর এই সিদ্ধান্তকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। দুর্বৃত্তরা দীর্ঘদিন ধরেই নগরে, বন্দরে, প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে এক ভয়াবহ ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে রেখেছিল। প্রকাশ্য দিবালোকে ব্যাংক লুট, থানা ও ফাঁড়িতে হামলা এবং চিঠি দিয়ে ডাকাতির ঘটনা ছিল নিত্যদিনের ব্যাপার। এছাড়াও গুম, খুন, হত্যা ইত্যাদি পর্যন্ত কম সংঘটিত হয়নি। যদিও দেশবাসীর অকল্পনীয় ছিল তবুও এটাই ছিল স্বাভাবিক ব্যাপার। এতে দেশের মানুষের মনে নিদারুণ হতাশার জন্ম হয়েছিল। নারীর সম্ভ্রম কিংবা জনগণের জীবনের নিরাপত্তা কোন গ্যারান্টি ছিলনা। বলা চলে দুষ্কৃতকারীদের বদৌলতে আইনের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের সবরকম প্রচেষ্টার ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছিল। এমতাবস্থায় সরকারকে কঠোর না হয়ে হলে সরকারের নরম মনোভঙ্গি বিরাট বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দেখা দিত। সৌভাগ্যের বিষয় সরকার এখন দুষ্কৃতকারীদের প্রতি ক্ষমাহীন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। সংশ্লিষ্ট দুষ্কৃতকারীদের সঙ্গে জনগণের সক্রিয় সহযোগিতায় এ ক্ষেত্রে এ অভিযান কে সাফল্যমন্ডিত করে তুলতে সহায়ক হবে। দুস্কৃতকারীরা যদি সরকার দলীয় লোকও হয়, তবুও তাদের রক্ষা নেই বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধুর এ পদক্ষেপ তাই খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যবাহী তা অনুধাবন করতে আমাদের এতোটুকু বেগ পাওয়ার কথা নয়।

খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি!

কথায় বলে খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি হলে তার যোগফল শুন্য। গতকাল ‘বাংলার বাণী’তে প্রকাশিত “বাংলাদেশ বিমানের বাড়ি ভাড়া ব্যবস্থা” ও অন্য আরেকটি সহযোগী দৈনিকে “ভুল শর্তে বোয়িং ক্রয় বাংলাদেশ বিমানের বিপুল ক্ষতি” শীর্ষক সংবাদটি পড়লে স্বাভাবিকভাবে খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি বলে প্রতীয়মান হয়।
‘বাংলার বাণী’তে প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছে যে, বাড়িভাড়া চেয়ারম্যানের জন্য মাসে আড়াই হাজার টাকা এবং ডিরেক্টরদের জন্য দু’হাজার টাকা। বাংলাদেশ বিমানের চেয়ারম্যান ও ডিরেক্টরগণ সম্প্রতি অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে (ডিরেক্টর বোর্ডের সভা হিসাবে বর্ণিত) নিজেদের জন্য উপরোক্ত বাড়িভাড়া স্থির করেছেন এছাড়া বৈঠকে ২৪ ঘন্টা ব্যবহারের জন্য কর্পোরেশনের গাড়ি কতিপয় কর্মচারীর মধ্যে বিলি করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, জাতীয় বেতন কমিশন সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কর্মচারীদের মধ্যে যে বাড়ি ভাড়ার সুপারিশ করেছেন তাতে বাংলাদেশ বিমানের চেয়ারম্যান ডিরেক্টরগণ মাসে সর্বোচ্চ ২শ ৮০ টাকা বাড়ি ভাড়া হিসেবে পেতে পারেন। ইতিমধ্যে বিভিন্ন কর্পোরেশন পদস্থ কর্মচারীদের জন্য উচ্চ ভাড়ায় বিলাসবহুল যেসব বাড়ি ভাড়া করা হয়েছে কমিশন বর্তমান চুক্তি পর্যন্ত রাখার পক্ষে মত দিল বিদ্যমান ভাড়ার হারে চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধির সম্পূর্ণ বিরোধিতা করেছেন।
সহযোগী দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছে যে; যুক্তরাজ্যের টেম্পল উড কোম্পানির সঙ্গে ভুল শর্তের একটি চুক্তির জন্যেই বাংলাদেশ বিমান সম্পূর্ণরূপে দেউলিয়া হতে বসেছে। একটি বোয়িং বিমান লিজ ও বিক্রির জন্য টেম্পল উড কোম্পানির সঙ্গে যে চুক্তি রয়েছে তা এখনও শাঁখের করাতের মতো বাংলাদেশ বিমানের মূলোচ্ছেদ করছে। টেম্পল উড কোম্পানি বাংলাদেশ বিমানকে যে বোয়িংটি দিয়েছে সেটি এমনকি যদি যান্ত্রিক ত্রুটি বিচ্যুতির জন্যও অবতরণ করে তাহলে বাংলাদেশ বিমান কে তার জন্য বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা দিতে হবে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, বোয়িংটির হাইড্রোলিক সিস্টেম ভালো না হওয়ার জন্য বিমানটিকে ঘন্টার পর ঘন্টা পড়ে থাকতে হয় এবং তারজন্যে পার্কিং চার্জ দিতে হয় অনেক। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, বাংলাদেশ বিমানের আন্তর্জাতিক ফ্লাইট এর উদ্বোধনী ফ্লাইটেই টেম্পল উড কোম্পানির ওই বোয়িংটি বাহারাইনে আটকে ছিল হাইড্রোলিক লীগের জন্য। প্রসঙ্গত আরও উল্লেখ করা যেতে পারে যে, টেম্পল উড কোম্পানির সাথে চুক্তি স্বাক্ষরের আগে বাংলাদেশ বিমান বোয়িং লিজের আরো কয়েকটি প্রস্তাব পেয়েছিল। কিন্তু টেম্পল কোম্পানির প্রস্তাবটি এভিয়েশন দফতরকে আকৃষ্ট করে এবং শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ বিমান টেম্পল অব কোম্পানির সঙ্গেই এই সর্বনাশা চুক্তিটি স্বাক্ষর করে। বাংলাদেশ বিমান যখন তার আন্তর্জাতিক ভাড়া করা বিমান চালাতো তখন প্রতি তিন মাস অন্তর ভাড়া করা বিমানের কোম্পানিকে দিতে হতো ৩৩ লক্ষ ৬০ হাজার টাকা এর মধ্যে আলা জ্বালানির খরচ, ল্যান্ডিং চার্জ, মেরামত খরচ, কেবিনের ক্যাটারিং খরচ ও জরুরি হোটেল খরচ এ সবই অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু গত তিন মাসে বাংলাদেশ বিমান কে দিতে হয়েছে ৫৫ লক্ষ টাকা। এবং এ টাকা দিতে হয়েছে উল্লেখিত আনুষাঙ্গিক খরচ ছাড়াই।
পাগলেও নাকি আপন বুঝ বোঝে-এ রকম একটা প্রবাদ প্রচলিত আছে। কিন্তু বাংলাদেশ বিমানের ক্ষেত্রে তার সম্পূর্ণ বিপরীতই পরিলক্ষিত হচ্ছে। একদিকে ভুল ও ত্রুটিপূর্ণ চুক্তি মোতাবেক লাখ লাখ টাকা গচ্ছা দিতে হচ্ছে অন্যদিকে লাভ-লোকসান যাই হোক না কেন উর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের ঠাটবাট সমান তালেই চলছে। বাড়ি ভাড়া সম্পর্কে বেতন কমিশনের পক্ষ থেকে যাই বলা হোক না কেন চেয়ারম্যান ও ডিরেক্টরদের জন্য যথাক্রমে আড়াই হাজার ও দু হাজার টাকা বাড়ি ভাড়া না হলে চলে কি করে।
বাংলাদেশ বিমানের কর্মকর্তারা ভুলে গেছেন যে, দেশ একটা ক্রান্তিলগ্নের মধ্যে দিয়ে এগুচ্ছে। নানান সমস্যা ও সংকটের বাংলাদেশ জর্জরিত এমনই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে যেকোনো ভুল সিদ্ধান্ত ও আরাম-আয়েশের প্রতি অহেতুক অনুরাগ মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনবে। পূর্বাপর সবকিছু বিচার বিশ্লেষণ করে আমরা বলবো যে, দেশের ও দশের বৃহত্তর স্বার্থের প্রতি লক্ষ্য রেখেই এ হেন খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি মানসিক প্রবণতা পরিহার করা উচিত।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!