You dont have javascript enabled! Please enable it! 1973.10.08 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | ইসরাইলি আগ্রাসন | মাছের উৎপাদন ব্যাহত করে নয় | গ্রামবাংলায় চিকিৎসা সংকট | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকা: ৮ই অক্টোবর, সোমবার, ২১শে আশ্বিন, ১৩৮০

ইসরাইলি আগ্রাসন

যা আন্দাজ করা গিয়েছিল তাই হয়েছে শেষ পর্যন্ত। ভিয়েতনামের মাটিতে শান্তি পারাবত পাখা মেলে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে না নিতেই মধ্যপ্রাচ্যে আবার যুদ্ধের আগুন জ্বলে উঠেছে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের হাতের পুতুল ইসরাইল সত্তর সালের সীমান্ত যুদ্ধবিরতি চুক্তি লঙ্ঘন করে মিশর ও সিরিয়া সীমান্ত এলাকার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। ১৯৬৭ সালের পর এটাই হচ্ছে সবচাইতে বড় হামলা।
কায়রো বেতার থেকে এই প্রচন্ড লড়াইয়ের খবর ঘোষণাকরে বলা হয়েছে মিশরীয় স্থল বাহিনী সুয়েজ অতিক্রম করেছে এবং সুয়েজের পূর্ব তীরে ইসরাইলি বাহিনীর সঙ্গে তাদের প্রচণ্ড লড়াই চলছে। সিরিয়া ও মিশরীয় বিমান একযোগে ইসরাইলি বিমান বাহিনীর সঙ্গে প্রচণ্ড লড়াইয়ে লিপ্ত রয়েছে। স্টেজের ওপর এক বিমান যুদ্ধের এগারোটি ইসরাইলি বিমান ধ্বংস হয়েছে। মিশরীয় বিমান ও স্থল বাহিনীর ইসরাইলের এই সর্বাত্মক হামলার প্রতিরোধ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। মিশরীয় বাহিনী সুয়েজ খাল অতিক্রম করে শত্রু বাহিনীর উপর মারাত্মক আঘাত হেনেছে। অপর এক সংবাদে প্রকাশ, ইসরাইলি নগ্ন হামলার পরিপ্রেক্ষিতে মিশর, সিরিয়া ও লিবিয়া বাহিনী মিশরের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহমদ ইসমাইলের নেতৃত্বে একটি যৌথ কমান্ড গঠন করেছেন। মুক্তিযোদ্ধারা সিরিয় বাহিনীর সাথে যোগদান করে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যের বিষফোঁড়া ইসরাইল যে আবার একটা নগ্ন হামলা চালাবে সম্প্রতি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও ইসরাইলের যৌথ সামরিক পায়তারার ফলেই তা ইতিপূর্বে আন্দাজ করা গিয়েছিল। গত ৪ঠা অক্টোবর বাংলার বাণীতে প্রকাশিত ‘মধ্যপ্রাচ্যে আবার যুদ্ধ?’ শীর্ষক সংবাদে শিগগিরই সেখানে যুদ্ধের আগুন জ্বলে উঠবে সম্পর্কিত বক্তব্য উপস্থাপিত করা হয়েছিল। ‘বাংলার বাণী’ যা আন্দাজ করে ছিল তাই শেষ পর্যন্ত সত্যে পরিণত হল। কথায় বলে খুঁটার জোরে নাকি পাঁঠা কুঁদে। ইসরাইল আজ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের খুটার জোরে প্রতিবেশী আরব ভূমিতে যুদ্ধের আগুন জ্বালিয়েছে। সাতষট্টি সালেও জ্বালিয়েছিল। কিন্তু ইসরাইলের যুদ্ধবাজ নেতৃবৃন্দ ভুলতে বসেছেন যে সাতষট্টি সাল আর তিয়াত্তর সাল এক নয়। এই সময়ের মধ্যে ঘটনা স্রোতের গতি পরিবর্তন হয়েছে অনেক। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ভিয়েতনাম থেকে পাততাড়ি গুটিয়েছে। দক্ষিণ ভিয়েতনামের তাবেদার থিউ সরকার তাই আজ দু চোখে সর্ষেফুল দেখছেন। কম্বোডিয়ায় মুক্তিবাহিনীর দুর্বার হামলায় জন্য লননল সরকার বিপর্যস্ত ও বিধ্বস্ত। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও আভ্যন্তরীণ সমস্যা সংকটে জর্জরিত। মার্কিন সিনেট আর আগের মতো যুদ্ধের আকাশচুম্বী ব্যয় ভার বহন করতে রাজি নয়। এমনি অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ইসরাইলি যুদ্ধবাজরা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের অদৃশ্য ইঙ্গিতে মধ্যপ্রাচ্যে যে ভয়াবহ যুদ্ধের আগুন চালিয়েছে তার খেসারত তাকে দিতে হবে।
অন্যায় সবসময়ই অন্যায়। অন্যায় যে সহে আর অন্যায় যে করে দুজনেই সমান দোষে দুষী। মধ্যপ্রাচ্যের সংগ্রামী জনতা ইসরাইলের এ অন্যায় কে সহজে মেনে নেবেন না। নিতে পারেন না। ইসরাইলি হামলার সমুচিত জবাব দেবেনই। এ বিশ্বাস আমাদের রয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলি নগ্ন হামলার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ ব্যতীত ও বিক্ষুব্ধ। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদত, সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট হাফিজ আল আসাদ এবং লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট মোয়ামের গাদ্দাফীর কাছে পৃথক পৃথক বাণীতে সুস্পষ্টভাবে জানিয়েছেন যে, সমগ্র বাঙালি জাতি এই সময়ে আরব ভাইদের পশ্চাতে দৃঢ়ভাবে দন্ডায়মান রয়েছে। এ বক্তব্য শুধু বঙ্গবন্ধুর নয় এ বক্তব্য বাংলা সাড়ে সাতকোটি মানুষের। আমরা বিশ্বাস করি ইসরাইলি আগ্রাসন এর সমুচিত জবাব দিতে শুধু বাংলাদেশের মানুষই নয়-বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ আরব ভাইদের পাশে এসে দাঁড়াবে।

মাছের উৎপাদন ব্যাহত করে নয়

একটি বিশেষ সংবাদে প্রকাশঃ সরকার এর অধিক খাদ্য ফলাও কার্যক্রম গ্রহণের ফলে দেশের মাছ উৎপাদন কে নিদারুণভাবে ব্যাহত করা হচ্ছে। চাল উৎপাদনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করার ফলে মারাদোনা আঘাত আসছে। রিপোর্টে অভিযোগ এসেছে কতৃপক্ষ চাল ও মাছ উৎপাদনে ভারসাম্য রক্ষা করতে পারেননি। মাছ উৎপাদনে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে চাল উৎপাদনে ব্রতী হতে হচ্ছে সরকারকে। অধিক খাদ্য ফলাও অভিযানের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য অধিক চাউল উৎপাদন। এক্ষেত্রে মাছের উৎপাদনও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু সরকার চাউল উৎপাদনের জন্য যে সকল পদ্ধতি আরোপ করেছেন তা প্রকারান্তরে মাছের স্বাভাবিক উৎপাদন ব্যাহত করছে। জানা গেছে অধিক চাল উৎপাদনের জন্য কর্তৃপক্ষ বিল, হাওর, খাল, নদী ইত্যাদি সেচ ব্যবস্থার দ্বারা শুকিয়ে নিচ্ছে এবং প্রায় ক্ষেত্রেই ঐ সকল স্থানের পানি নিষ্কাশনের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। এর দরুন মাছের উৎপাদন নিদারুণভাবে হ্রাস পাচ্ছে। এছাড়া সরকার অধিক খাদ্য ফলাও অভিযানে কীটনাশকের দরুন যে ওষুধ ব্যবহার করছে তা মাছের জীবন নাশের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ডোবা স্থানের পানি নিষ্কাশন এর চাইতেও কীটনাশক ওষুধ মাছের পক্ষে বেশি মারাত্মক। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, মানুষের জীবন ধারণের জন্য শর্করা উপাদান যেমন প্রয়োজন তেমনি প্রয়োজন প্রোটিনেরও। একশত গ্রাম চাউলের শর্করা উপাদানের থাকে সাত ভাগ অন্যদিকে একশত গ্রাম মাছে প্রোটিন থাকে আঠারো ভাগ। এছাড়াও বিশেষজ্ঞদের মতে আমরা প্রতিদিন যে স্বাভাবিক খাদ্য গ্রহণ করে থাকি তার মধ্যে শতকরা পঁচাশি ভাগ থাকে শর্করা এবং প্রোটিন থাকে দশ ভাগ। অথচ নিয়ম অনুযায়ী একজন মানুষের জন্য প্রয়োজন শর্করা জাতীয় উপাদান শতকরা ষাট ভাগ, প্রোটিন দরকার শতকরা বিশ ভাগ, চর্বি জাতীয় উপাদান দরকার শতকরা বিশ ভাগ। এ কারণে কতৃপক্ষকে অবশ্যই শুধু চাউল উৎপাদনের ওপর গুরুত্ব দিতে গিয়ে মাছের উৎপাদনকে অবহেলা করা উচিত নয়। খাল-বিল হাওর-বাঁওড়, নদী-নালা থেকে পানি নিষ্কাশন এর সময় বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে।
সর্বোপরি কীটনাশক ওষুধ ব্যবহার করার সময় মাছের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে একথাটা উপলদ্ধি করে পদক্ষেপ নিতে হবে। আমরা মনে করি, বাংলার মানুষের জন্য ভাত যেমন একমাত্র প্রিয় খাদ্য তেমনি মাছও প্রিয় খাদ্য। ভাত-মাছ খাওয়া বাঙ্গালীদের কথা বিবেচনা করে কর্তৃপক্ষ দুটি উৎপাদনের ওপরই গুরুত্ব আরোপ করবেন বলে আমাদের বিশ্বাস।

গ্রামবাংলায় চিকিৎসা সংকট

চিকিৎসা সংকট আজকের দিনে বাংলাদেশ বিশেষ করে গ্রামবাংলায় একটি বড় আকারের সংকট। ডাক্তার নেই অর্থাৎ পাস করা ডাক্তারের অভাব বাংলাদেশের প্রায় সব গ্রামেই। ডাক্তারের তুলনায় রোগের প্রসার কিন্তু অনেক গুণ বেড়েছে। অনেক বেশি মানুষ রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। ডাক্তারের তুলনায় রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাবার ফলে গ্রামগঞ্জে হাতুড়ে-বদ্যি ডাক্তারের সংখ্যাও বাড়ছে। এই হাতুড়ে বদ্যি ডাক্তারদের হাতে হয়তো বা সাময়িকভাবে দু-একটা রোগ নিরাময় হচ্ছে বটে কিন্তু স্থায়ী চিকিৎসা কোন ব্যবস্থা কোথাও নেই। আর নেই বলেই গায়ের মানুষদের মধ্যে হতাশা বাড়ছে। সেই হতাশা থেকে কিছুটা আশার আলো পাবার জন্য তারা ভিড় জমাচ্ছেন হাতুড়ে বদ্যি ডাক্তারদের দ্বারে। সেই সুযোগ বুঝেই হাতুড়ে বদ্যি ও ডাক্তাররা গ্রাম অঞ্চলে বেশ টুপাইস কামিয়ে চলেছেন। এমনই এক খবর পাওয়া গেছে যশোর জেলার মহাম্মদপুর এলাকা থেকে। খবরে প্রকাশ, মহাম্মদপুর থানার পল্লী অঞ্চলের বিভিন্ন হাট-বাজারে হাতুড়ে ডাক্তারদের সংখ্যা মাত্রাতিরিক্ত হারে বেড়ে গেছে। থানা ও ইউনিয়ন দাতব্য চিকিৎসালয় ও ওষুধের দোকান পাটে প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র দুষ্প্রাপ্য হওয়ায় জনগণ হাতুড়ে ডাক্তারদের শরনাপন্ন হতে বাধ্য হচ্ছেন। ওইসব ডাক্তারেরা প্রতিটি হাটে মাইক লাগিয়ে গান-বাজনার মাধ্যমে জনগণকে জমায়েত করে। তারপর নানাবিধ কলাকৌশলের বক্তৃতা দিয়ে জনগণকে তাদের ফাঁদে পা দিতে বাধ্য করে। জনগণ শেষ পর্যন্ত তাদের টোপ গিলতে বাধ্য হয় এবং ওষুধপত্র ক্রয় করে। এসব হাতুড়ে ডাক্তারের ওষুধ খেয়ে কিংবা ব্যবহার করে জনগণের উপকার হয় কিনা জানা যায়নি। তবে প্রতিটি হাটে-বাজারেই জনগণকে এসব ডাক্তারদের কাছ থেকে প্রচুর ওষুধ কিনতে দেখা যায়।
বস্তুতঃ এটা কিন্তু এক মহাম্মদপুর অঞ্চলের অবস্থা নয়, গোটা বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের একটা করুন চিত্রই এর মাধ্যমে ফুটে উঠে। অন্যদিকে সারাদেশের চিকিৎসা ক্ষেত্রে যখন এমন একটা ভয়াবহ অবস্থা তখন আমাদের দেশেরই এক শ্রেণীর উচ্চ শিক্ষিত এবং বিদেশে শিক্ষা ও ট্রেনিংপ্রাপ্ত ডাক্তার তথাকথিত উন্নত জীবনের জন্য বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন বলে শোনা যায়। রোগতাড়িত দেশের জনগণকে এহেন ভয়াবহ অবস্থায় ফেলে রেখে এই তথাকথিত উন্নত জীবনের সোনার হরিণের পেছনে না ছুটে দেশবাসীর দাবিকে নিশ্চয়ই অগ্রগণ্য বলে মেনে নেবার শুভবুদ্ধির উদয় হোক। আমরা এই আশাই করি।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন