You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা: ৫ই অক্টোবর, শুক্রবার, ১৮ই আশ্বিন, ১৩৮০

তবু-শুভবুদ্ধির উদয় হোক

চীনের সহকারি পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিঃ চিয়াও কুয়ান জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বক্তৃতা দিতে গিয়ে সুস্পষ্টভাবে পুনরায় বলেছেন জাতিসংঘে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির প্রশ্নটির বিরুদ্ধে তারা আবার বিরুদ্ধাচরণ করবেন। চীন শর্তহীনভাবে জাতিসংঘের প্রাসঙ্গিক প্রস্তাবসমূহ কার্যকরী হবার পূর্বে বাংলাদেশকে জাতিসংঘের সদস্য হিসেবে স্বীকার করে নিতে অনিচ্ছুক। চীনের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য রাখতে গিয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ঢালাও অভিযোগ এনেছেন বিভিন্ন দিক দিয়ে রাশিয়া আক্রমণ করে তিনি তার নিজের দায়মুক্ত হতে চেয়েছেন। অবশ্য মিঃ চিয়াও ১৯৭১ সালের যুদ্ধের ফলে শ্রেষ্ঠ মানবিক সমস্যাবলীর সমাধান এর ব্যাপারে সাম্প্রতিক দিল্লি চুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছেন। সোভিয়েট ইউনিয়নের বিরুদ্ধে নানা প্রকার মন্তব্য করতে গিয়ে মিঃ চিয়াও বলেছেন-সোভিয়েট ইউনিয়ন অতীতের আবর্জনার স্তুপ থেকে এশিয়ার জন্য যৌথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা মেনে নিয়েছে। অথচ সোভিয়েত একটা ইউরোপীয় দেশ ও ওয়ারশ চুক্তিভুক্ত প্রধান রাষ্ট্র। এতদ্বসত্ত্বেও সোভিয়েত ইউনিয়ন এশিয়ার যৌথ নিরাপত্তা ব্যাপারে কেন এত উদগ্রীব, সে প্রশ্নও তুলেছেন মিঃ চিয়াও। তিনি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বহমান উত্তেজনার কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করেছেন যদি রাশিয়া উত্তেজনা প্রশমনে সত্যিকার অর্থেই উদ্যোগী হয় তাহলে চেকোস্লোভাকিয়া ও মঙ্গোলিয়া থেকে নিজেদের সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করছেন না কেন। এছাড়াও বিভিন্ন দিক দিয়ে রাশিয়াকে আক্রমণ করে চীনের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার বক্তব্য রেখেছেন। বাংলাদেশের প্রশ্নে চীনের ভূমিকায় আমরা মোটেই বিস্মিত হইনি। বরং চীনের বর্তমান পররাষ্ট্র নীতির পরিপ্রেক্ষিতে আমরা পূর্ব থেকেই নিঃসন্দেহ ছিলাম যে, চৈনিক রাজনীতির শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বাংলাদেশের বিরুদ্ধাচরণ করে চলবে জাতিসংঘে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির প্রশ্নটিই আজ আর কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। কেননা বিশ্বের একশত আটটি দেশ বাংলাদেশের বাস্তবতার স্বীকার করে নিয়েছে। জাতিসংঘের সদস্য দেশ এর অধিকাংশই বাংলাদেশের স্বপক্ষে। চিন্তার ভেটো প্রদানের ক্ষমতা ব্যবহার করে কতদিন আর বাংলাদেশকে ঠেকিয়ে রাখতে সক্ষম হবে। বিশ্ব আজ বাংলাদেশের পক্ষে। কেননা বাংলাদেশ আন্তরিকভাবে শান্তি ও মৈত্রীতে বিশ্বাসী। ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব কারো বিরুদ্ধে বিদ্বেষ নয়’ এই নিরপেক্ষতাই তার পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম বাহন। উপমহাদেশীয় রাজনীতিতে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক নিবিড়। এ সম্পর্কে ফাটল ধরাতে পারবে না। পাকিস্তানের সার্বভৌমত্বের ভিত্তিতে আমরা মৈত্রী স্থাপনের আগ্রহী। তবে বাংলাদেশের বাস্তবতা তাকে মেনে নিতে হবে। যেহেতু আমরা শান্তি ও মৈত্রী নীতি দ্বারা অনুপ্রাণিত সেতু ছোট বা বড় হুমকি আমাদের নীতি থেকে এতোটুকু করতে পারবে না বলে আমাদের বিশ্বাস। চীন যত বড় শক্তি হোক না কেন, যত প্রকার ভেটো বা হুমকিই দিক না কেন বাংলাদেশে তার নীতিতে অটল। কেননা আমাদের স্বাধীনতার যারা শত্রু তাদেরকে জাতি মর্মে মর্মে চিনে রেখেছে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে বিষোদগার করে জাতিসংঘ বা বৃহৎ শক্তির মধ্যে ফায়দা লুটা যেতে পারে কিন্তু বাংলাদেশের বেলায় তা সম্ভব নয়। বাংলাদেশ রক্ত দিয়ে দেশ স্বাধীন করেছে, জাতিসংঘের প্রবেশ পথ বন্ধ করে তার মৃত্যু ডেকে আনা যাবেনা। আর কেউ এ সত্য উপলব্ধি করতে না পারলেও চীনের এ সত্য জানার কথা। তবু আমরা চীনের নেতাদের নৈতিকতার কাছে আহ্বান জানাব-‘আপনাদের শুভ বুদ্ধির উদয় হোক।’

সি আই এর গোপন তৎপরতা

জন এ ক্যালকট ইউপি আই এর সাংবাদিক হিসেবে সম্প্রতি বাংলাদেশ সফরে করে গিয়ে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে যে রিপোর্ট তৈরি করেছেন তা কয়েক দিন আগে অস্ট্রেলিয়ান ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন প্রচার করেছে। সেই রিপোর্টে তিনি বলেছেন ‘আর একটা বছর ফসল ভাল না হলে সরকার নয়, বাংলাদেশই ভেঙ্গে পড়বে।’ ক্যালকট আরো বলেছেন, বাংলাদেশে বসবাসকারী অবাঙালিরা কোন অন্যায় করেনি, বাঙ্গালীদের মত তারা কোন হত্যালীলায় মেতে উঠেনি। অথচ এই নির্দোষ লোকগুলো কেবল অবাঙালি হবার কারণেই তাদেরকে বাংলাদেশ মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে। না, ক্যালকট সাহেব এইটুকুতে ক্ষান্ত হননি। তিনি আরো রিপোর্ট করেছেন, বাংলাদেশের রেলযোগাযোগ এই সব লোকদের অনুপুস্থিতিতে একবারে অকেজো হয়ে পড়েছে। এসব দক্ষ কুশলীকে প্রতিহিংসা বশতঃ উৎখাত করে অলস আনাড়ি বাঙ্গালীরা বাংলাদেশ রেলওয়েকে একটা ‘নাম কা ওয়াস্তে’ প্রতিষ্ঠান পরিণত করেছে।
জনগণের আরও তথ্য সারাদেশে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলো প্রতিপক্ষের হাতে বার বার মার খাচ্ছে। কিছুতেই এঁটে উঠতে পারছে না এবং সে জন্য সারাদেশে এক অভূতপূর্ব অরাজকতা বিরাজ করছে। এমনিতর অবস্থায় মেরুদণ্ডহীন এই দেশটি কিভাবে আর কতদিন টিকে থাকতে পারবে সে চিন্তায় তিনি চিন্তান্বিত।
বাংলাদেশ অধিক প্রচলিত একটা প্রবাদ ‘মার পোড়ে না মাসির পোড়ে।’ ইউ পি আই এর সাংবাদিক জন ক্যালকটের প্রদত্ত রিপোর্টটি পড়ে বা শুনে সেই প্রবাদ বাক্যটি আমাদের সর্বাগ্রে মনে পড়ছে। আর বঙ্গবন্ধুর ভাষায় আমার চাইতে যে মাসির পোড়ে সে মাসি মাসি নয়, সে ডাইনি।
কিন্তু আসল কথা সেটা নয়, কথা হচ্ছে একজন বিদেশী সাংবাদিক কি করে একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ সম্পর্কে এমন লাগামছাড়া অর্থহীন উদ্ভট ও বানোয়াট এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কাল্পনিক সংবাদমন্তব্য পরিবেশন করতে পারলেন? এ ব্যাপারে সরকারি মহলের যে বক্তব্য প্রকাশিত খবরের মাধ্যমে জানা যায় তাতেও আমরা বিস্মিত না হয়ে পারি না। সরকারি মহল বলেছেন আমাদের উদারতার সুযোগ নিয়ে যদি কেউ এই ধরনের কাজ করে তো আমরা কি করতে পারি? তারা আরো বলেছেন বিদেশিদের বাংলাদেশে আগমনের ওপর কড়াকড়ি আরোপ করা হলে ওই সব বাংলাদেশ-বিরোধী লোকজন এবং তাদের এদেশীয় দালালরা চিৎকার জুড়ে দেবে।
সরকারি মহলে এহেন ‘বাজে অজুহাত’ আমাদেরকে তথা গোটা দেশবাসী কে বেশি আঘাত দিয়েছে যত না দিয়েছ মিঃ ক্যালকটের রিপোর্টটি। কেননা আমরা সবাই জানি, বিশেষ করে সরকারি মহলের আরো বেশি করে জানার কথা যে স্বাধীনতা-উত্তরকালে বিধ্বস্ত বিপর্যস্ত দেশের উপর বিশেষ করে সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী সদা হিংস্র থাবা মেলে রেখেছে এ দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিনষ্ট করার প্রচেষ্টায়।
সুতরাং দেশের এমতাবস্তায় কে বা কারা কি বলছে না বলছে সেদিকে দৃষ্টি দেওয়ার চাইতে কোন পথ অবলম্বন করলে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ন থাকবে এবং সুসংহত হবে সরকারের সেদিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি। এবং এজন্য প্রয়োজন হলে যেকোনো কড়া ব্যবস্থা গ্রহণে দ্বিধাগ্রস্ত হলে চলবে না। তা না করা হলে দেশের মঙ্গলের চাইতে অমঙ্গলই ডেকে আনবে।
বিগত ১৯৫৪ সালে দৈনিক বিদেশি সাংবাদিক মিঃ ক্যালাহান তদানীন্তন পূর্ব বাংলার যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এ,কে, ফজলুল হক সম্পর্কে এক মিথ্যা, বানোয়াট ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কাল্পনিক খবর প্রকাশ করায় কেবলমাত্র তার মন্ত্রিসভার পতন নয়, গণতন্ত্রের সমাধি রচিত হয়েছিল সে কথা স্মরণ করে বলতে হয়, সেদিনের মতো এবারও মিঃ ক্যালাহানের স্থলে মিঃ ক্যালকট যে বাংলাদেশের অস্তিত্ব বিনষ্ট করতে একটা সুপরিকল্পিত প্রচেষ্টা চালিয়েছে একথা বললে একটুও বাড়িয়ে বলা হবে না। ৫৪ সালের ক্যালাহান পরে সি আই এর এজেন্ট হিসেবে ধরা পড়েছিলেন। মিঃ ক্যালকটও যে একই সংস্থার লোক নয়, এ কথা জোর দিয়ে বলা যায় না। উপরন্ত দেশের অভ্যন্তরে একশ্রেণীর সাংবাদিক এবং বিদেশী সংস্থা স্বতঃস্ফূর্তভাবে মিঃ ক্যালকটকে নানা খবর সংগ্রহ করতে সক্রিয় সাহায্য করেছে বলে তিনি দাবি করেছেন।
সুতরাং এমনতো অবস্থায় আমরা মনে করি বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করে এসব সিআইএর এজেন্ট দের খুঁজে বের করতে হবে এবং ভবিষ্যতে যাতে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে সে বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। কেননা স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি কটাক্ষকারীদেরকে কিছুতেই সহ্য করা যায় না। তাদের কার্যকলাপকে যে কোনো মূল্যে স্তব্ধ করে দিতে হবে এবং তা অসময় নয়, যথাসময়ে।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!