You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা: ৪ঠা অক্টোবর, বৃহস্পতিবার, ১৭ই আশ্বিন, ১৩৮০

আক্রান্ত আমন

পোকার আক্রমণে এদেশে শস্যহানির খবর নতুন কিছু নয়, প্রায় প্রতিবছরই এটা ঘটছে হরদমই। এবারও শস্যক্ষেত্রে পোকার উপদ্রব এর খবরটা সর্বত্রই শোনা যাচ্ছে। পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী কুমিল্লা জেলার চাঁদপুর ও চৌদ্দগ্রাম, সিলেট এর হবিগঞ্জ, যশোর জেলার লোহাগড়া ও মাগুরা, কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা, দৌলতপুর, বগুড়া জেলার জয়পুরহাট, চট্টগ্রাম মিরসরাই, সাতকানিয়া, রাঙ্গুনিয়া থানা এবং ময়মনসিংহ জেলার মোহনগঞ্জে পোকার আক্রমণে প্রায় ৭লক্ষ একর জমির ফসলের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। শুধু তাই নয় একমাত্র ময়মনসিংহ জেলার মোহনগঞ্জ এই পোকার আক্রমণে প্রায় ২৫ হাজার একর ও চাঁদপুরে ৫০ হাজার একর জমির ফসল সাভার হয়ে যাবার উপক্রম হয়েছে।
তুলনামূলকভাবে আমনটা এখনো বাংলাদেশের সর্বত্র এবং সার্বজনীন ফসল। কেননা আউশ, বোরো বা ইরি এখনও এদেশে এমন সব অঞ্চল রয়েছে যেখানটায় উৎপন্ন হয় না। কিন্তু আমনটা উৎপন্ন হয় দেশের সর্বত্রই। আর প্রতি বছরই এ দেশের প্রায় সব অঞ্চলেই আমন ধানের উপর একটা-না-একটা আক্রমণ উপদ্রব নেমেই আসে। কখনো বা সে হামলা আসে ঘূর্ণিঝড় প্রলয় রূপে, কখনো বা পোকার আক্রমণ হিসেবে আবার কখনো বা ইঁদুরের উপদ্রব। অথচ এই সার্বজনীন আমন ফসলটাকে রক্ষা করার জন্য সর্বতোভাবে কার্যকরী কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, এমন কথা খুব কমই শোনা যায়।
ঘূর্ণিঝড় প্রলয়ের হাত থেকে আমনের থর বা শীর্ষে রেনু হয়তো রক্ষা করার মত উন্নত অবস্থায় আমরা পৌঁছিনি, কিন্তু পোকামাকড়, কীটপতঙ্গ আর ইঁদুরের হাত থেকে ফসল রক্ষার মত বাস্তব ও কার্যকরী ব্যবস্থা থাকলেও সেটার প্রয়োগ হচ্ছে কই? আমন তথা শস্য ক্ষেতে ব্যাপক ভিত্তিক উন্নত মানের কীটনাশক ওষুধ ছিটানোর সার্বিক ব্যবস্থা ও এখন নেয়া হচ্ছে বলে তো শোনা যায় না। উপরোক্ত আক্রান্ত এলাকার কৃষকদের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে যে, শস্য সংরক্ষণ বিভাগের কাছে এই বিষয়ে বার বার অভিযোগ করা সত্ত্বেও তারা এ বিষয়ে কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ নিচ্ছেন না। অন্যদিকে কীটনাশক ঔষধ যাও কিছু পাওয়া যাচ্ছে তার প্রতি সে নাকি ২০ থেকে ২৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
অবস্থা যখন এই তখন আমরা অবশ্যই আশা করব কৃষি মন্ত্রনালয় তথা শস্য সংরক্ষণ বিভাগ বিষয়টির প্রতি জরুরী ভিত্তিতে গুরুত্ব আরোপ করবেন। যদি কীটনাশক ঔষধ না পাওয়া যায় যদি তাদের স্টক খালি হয়ে যায় তবে জরুরি ভিত্তিতে আমদানি করার ব্যবস্থা করবেন। কেননা চরম খাদ্য ঘাটতিতে প্রতিবছর জর্জরিত হয় আমাদের দেশ। পাকিস্তানি আমল থেকে আমরা উত্তরাধিকারীসূত্রে বার্ষিক ২৫ লক্ষ টন খাদ্য ঘাটতির মোকাবেলা করা ছাড়াও নতুন হারে খাদ্য ঘাটতি ও খাদ্য সমস্যার সম্মুখীন। সেই অবস্থায় কোন মতেই আমাদের ক্ষেতের ধান পোকামাকড়ের খোরাক করে দিয়ে পরে মানুষের মুখের আহার জোগাড়ের জন্য অন্যের দ্বারস্থ হবার পথ খোলাসা করা উচিত হবে না।

বাংলাদেশ রেলওয়ে প্রসঙ্গে

বাংলাদেশ রেলওয়ে বর্তমান বিভিন্ন দিক সম্পর্কে সম্প্রতি ঢাকার একটি পত্রিকায় একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। রিপোর্টে জানা যায়, বিনা টিকিটে যাত্রী ভ্রমণ ও অন্যান্য কারণে প্রতিবছর বাংলাদেশ রেলওয়ে প্রায় পৌনে দু’কোটি টাকা গচ্ছা দিচ্ছে। হিসাব দিয়ে বলা হয়েছে ১৯৭২-৭৩ সালের আর্থিক বছরে এক কোটি আশি লাখ চার হাজার টাকার রাজস্ব থেকে বাংলাদেশ রেলওয়ে বঞ্চিত হয়েছে। ১৯৭৩ সালের রেলওয়ে কমিশনও স্বীকার করেছে যে দেশের শতকরা বিশজন রেলযাত্রী বিনা টিকেটে ভ্রমণ করে থাকে এক্ষেত্রে যদি বিনা টিকিটে রেল ভ্রমন বন্ধ করা যায় তাহলে বছরে প্রায় দু’কোটি টাকা রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি পেতে পারে। মালামাল পরিবহনের মাধ্যমে রেল থেকে যে আয় এতদিন হত তা নিদারুণভাবে স্বাধীনতার পর হ্রাস পেয়েছে। কারণ হিসেবে রিপোর্টে বলা হয়েছে, বিধ্বস্ত রেলসেতু, রেলপথ ক্ষতিগ্রস্ত ও ধ্বংসপ্রাপ্ত রেলওয়াগন এর দরুন এই ক্ষতি পোহাতে হচ্ছে। বর্তমানে রেলপথে মাল পরিবহন ব্যবস্থার সম্পূর্ণ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে স্বাধীনতার পূর্বে অর্থাৎ ১৯৬৯-১৯৭০ সালে রেলপথে ৪৮ লাখ ২ হাজার টন মাল পরিবহন করা হতো সেখানে স্বাধীনতার পর ১৯৭২-৭৩ সালে মাত্র ২৬ লাখ ৬৯ হাজার টন মাল পরিবহন করা সম্ভব হয়েছে।
মোট রেলওয়ে ওয়াগনের পঁচিশ ভাগ বিনষ্ট এবং এর একটি বিরাট ভাগ অকেজো হয়ে পড়ে রয়েছে। সরকার ওয়াগণ বৃদ্ধির জন্য ইতিমধ্যেই যথাসাধ্য প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন বলেও জানা গেছে। চারশত ওয়াগন বাংলাদেশে এসেছে এবং ভারতসহ অন্যান্য দেশের সঙ্গে সরকার চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন। এছাড়া নতুন রেলবগি আমদানির জন্য পশ্চিম জার্মানির সঙ্গে সরকার চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন। রেলওয়ে ব্যবস্থার উন্নতি বিধানের জন্য সরকার তার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাবে বলে আমরা বিশ্বাসী। বিগত পাকিস্তান আমল থেকেই রেলওয়ে বিভাগের প্রচুর দুর্নীতি ও অব্যবস্থা ছিলো। তার মূলোৎপাটনে সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বিশেষ করে যুদ্ধকালীন অবস্থার যে সকল ক্ষতি সাধিত হয়েছে রেল বিভাগকে অবিলম্বে তার থেকে মুক্ত করতে হবে। ওয়াগণ এর কমতি পূরণ ও নতুন রেলপথ স্থাপনের সরকারকে অত্যধিক উদ্যোগী হতে হবে। বিনা টিকিটে ভ্রমণ রোধে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বিনা টিকিটে ভ্রমণ রোধের জন্য শুধু সরকারকে এগিয়ে এলেই ফল শুভ হবে বলে আমরা মনে করি না এবং এই মজ্জ গত দুর্নীতি থেকে মুক্ত করতে হলে সকল দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক ও ছাত্র সংগঠনগুলোকেও সর্বাত্মক প্রচেষ্টা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। জাতীয় জীবনের এই নৈতিক ও আর্থিক ক্ষতি পূরণের জন্য অবশ্যই একটি সংঘবদ্ধ পদক্ষেপ প্রয়োজন। তাছাড়া আমরা মনে করি যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ছাড়া দেশের সার্বিক উন্নতি দ্রুত ও গতিশীল করা সম্ভব নয়। সে কারণে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ যোগাযোগব্যবস্থা রেলওয়ে ব্যবস্থাকে সম্প্রসারিত ও আধুনিক করে গড়ে তুলতে হবে।

লবণ শিল্পের সংকট

সরকারের যথাযথ দৃষ্টির অভাবে এবং লবণের অস্বাভাবিক নিম্নমূল্যে দরুন দেশের লবণ শিল্প ধ্বংসের মুখে পতিত হয়েছে বলে গতকালকের বাংলার বাণীতে খবর বেরিয়েছে। চট্টগ্রামের লবণ উৎপাদক কেন্দ্রীয় সমিতির চেয়ারম্যান সমবায় মন্ত্রী কে জানিয়েছেন, লবণ উৎপাদনের জন্য উপযুক্ত মূল্য নিশ্চিত করার ব্যবস্থা না নিলে আগামী মৌসুমে লবণ উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবে এবং এজন্য তিনি লবণ সর্বনিম্ন মূল্য পাঁচ টাকা নির্ধারণ ও লবণ উৎপাদন সম্প্রসারিত করার প্রতি সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।
১৯৫৪ সালে নির্বাচনের পূর্বে মুসলিম লীগ ক্ষমতার ক্ষমতায় থাকাকালীন একবার লবনের মূল্য ষোল টাকা সের হয়েছিল। তখন মূলত লবণ তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তান এবং বিদেশ থেকে আসতো। সে সময়ে পথে লবণ বাহী জাহাজ ডুবে যাওয়ার দরুন লবণের সংকট দেখা দেয় এবং তার ফলে হু হু করে দাম বেড়ে প্রতিসের ষোল টাকাতে দাঁড়ায়। স্বর্তব্য যে, নির্বাচনী প্রচারণার সময় মুসলিম লীগের বিরোধীরা, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সমর্থিত কর্মীরা সুর করে জারি গাইতো-
“মরি হায়রে হায় দুঃখে বলি কারে
ষোল টাকা সের লবন খাওয়াইলো
মুসলিম লীগ সরকারে
মরি হায়রে হায়।”
বলাবাহুল্য স্বাধীনতা-উত্তরকালে অন্যান্য সমস্ত নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য যে হারে বৃদ্ধি পেয়েছে লবনের মূল্য আজও তেমন বৃদ্ধি পায় নি। এটা নিশ্চয়ই শুভ খবর সকলের কাছেই। কিন্তু তাই বলে সেই লবণ শিল্পের প্রতি সরকারের উদাসীনতার দরুন যদি দেশের লবণ শিল্প ধ্বংস হয়ে যায় কিংবা লবনের মূল্য বৃদ্ধি পায় তাহলে জনগণের পক্ষে তা যে কি মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে সে কথা উল্লেখ অপেক্ষা রাখে না।
লবণ এমনই একটি খাদ্য জাল ধনী-নির্ধন নির্বিশেষে সকলের অবশ্য প্রয়োজনীয় বস্তু অথচ যথাযথ দৃষ্টি দানের ফলে যেখানে দেশের চাহিদা পূরণ করেও উদ্বৃত্ত দু’কোটি মণ লবণ রপ্তানি করা সম্ভব, সেখানে সেই শিল্প আজ ধ্বংসের মুখে।
এমতাবস্থায় আমরা লবণ শিল্পের প্রতি কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!