নিউইয়র্ক টাইমস, ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১
বিজোয়ল্লাস
১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১,ঢাকা-পাকিস্তান। চারিদিকে শ্লোগান উঠছে “জয় বাংলা!”। ইন্ডিয়ান সেনারা ট্রাক এবং বাসের বহরে করে শহরের উত্তর দিকে পাকিস্তানী ক্যাম্পের দিকে দৃপ্তরথে এগিয়ে চলেছে। পশ্চিম পাকিস্তান সেনাবাহিনী ইতিমধ্যেই আত্মসমর্পণের চূড়ান্ত শর্ত মেনে নিয়েছে।
শহরে তখন ভীষণ ভিড় যানবাহনের। ইন্ডিয়ান সেনারা তাদের গোলাবারুদের ব্যারেলে গাঁদাফুল ভরে পাকিস্তানী সেনাদের ক্যাম্প পেরিয়ে যাচ্ছে। পাকিস্তানী সেনারা তাদের স্যালুট দিচ্ছিলো। দু-পক্ষের সেনাদের মধ্যে অনেকেই ছিলো সতীর্থ, সহপাঠী। তারা করমর্দন করে কুশল বিনিময় করছিলো। জিজ্ঞেস করছিলো পরচিতজনদের কথা।
ঢাকার রাস্তায় অফুরন্ত আনন্দ এবং উদযাপন চলছিলো বিরতিহীন! ইন্ডিয়ার পাঞ্জাবী সৈন্য এবং দেশী বিদ্রোহী সেনাদের বাঙালি জনগণ বরণ করে নিচ্ছিলো চুম্বন এবং ফুলের মাধ্যমে। তবে সৈন্যদের বেশিরভাগই ছিলো নিরানন্দ, এবং তাদের চোখে ছিলো শূন্যতা।
গাড়িগুলোতে উত্তোলিত হচ্ছিলো পশ্চিম পাকিস্তানে অন্তরীণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি, যিনি মার্চ মাস থেকে বন্দী ছিলেন। বাঙালি তার ছবিকে ঘিরে জয়োল্লাসে চিৎকার করছিলো, “জয় বাংলা”, “শেখ মুজিব”!
শোনা যায়, বাঙ্গালিরা উন্মত্ত হয়ে আক্রমণ করতে উদ্যত হয়েছিলো ঢাকায় অবস্থানরত পশ্চিম পাকিস্তানী এবং বিহারীদের ওপর, তখন একজন বিদ্রোহী নেতা তাদের থামিয়েছিলেন এই বলে, “হ্যাঁ তারা এখন আমাদের বন্দী, তাই বলে আমরা সভ্যতার সীমা অতিক্রম করতে পারি না!”।
শহরে তখন ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হবার অপেক্ষা। ইন্ডিয়ান কমান্ডার কর্তৃক বেঁধে দেয়া সময়ের আর মাত্র ১০ মিনিট বাকি। এসময় জাতিসংঘের রেডিও চ্যানেল মারফত খবর ছড়িয়ে পড়লো, পাকিস্তানের সেকেন্ড ইন কমান্ড মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি আত্মসমর্পণের শর্ত মেনে নিয়েছেন।
এর মাঝে জাতিসংঘ আশঙ্কা প্রকাশ করলো যে শহরের বর্তমান অবস্থা ধ্বংসাত্মক পরিণতির দিকে মোড় নিতে পারে, ভেঙে পড়তে পারে প্রশাসনিক ব্যবস্থা। জরুরী ভিত্তিতে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে ওয়াকি টকির মাধ্যমে খবর চলে গেলো সরাসরি সম্প্রচারের ব্যবস্থার জন্যে। মিনিট খানেক পরে কিছু ইন্ডিয়ান সেনা কর্মকর্তা আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের ঘোষণা জানালেন।
আত্মসমর্পণের ব্যবস্থাপনা সেরে নেয়ার জন্যে প্রাথমিক কথাবার্তা ওয়াকিটকির মাধ্যমে সেনানিবাসে সেরে নেয়া হলো। তবে দুজন ইন্ডিয়ান জেনারেল আগে থেকেই সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তারা হলেন, মেজর জেনারেল গন্ধর্ভ নাগরা এবং ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হারদাভ সে ক্লার। এই দুজনই শহরের উত্তর অংশে বিজয় ডঙ্কার সূচনা করেছিলেন।
বেলা ৩টার সময় ইন্ডিয়ান কর্মকর্তারা স্থায়ীভাবে যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্তের কথা জানান। তবে তখনও বিক্ষিপ্ত ভাবে গোলাগুলি চলছিলো। আত্মসমর্পণের শর্ত মেনে নেয়ার পরেও সেদিন সকালেই পাকিস্তানী সেনা দূর্গে ভারি গোলার আক্রমণ হয়েছিলো। এ ব্যাপারে দুঃখ প্রকাশ করেন ইন্ডিয়ান ইস্টার্ন কমান্ডের মেজর জেনারেল জেএফআর জ্যাকব। তিনি পাকিস্তানের ব্রিগেডিয়ার জেনারেল বকর সিদ্দিকীকে জানান, তার সেনাবাহিনীর কিছু অংশ যুদ্ধবিরতি সম্পর্কে জানতো না বলে এই অনভ্রিপেত ঘটনা ঘটেছে।
জেনারেল ক্লার পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর প্রশংসা করে বলেন, “তারা ভালো লড়েছে, তবে শেষ হাসি হাসার মত যথেষ্ট শক্তিমত্তা তারা দেখাতে পারে নি”।