১১ কার্তিক ১৩৭৮ শুক্রবার ২৯ অক্টোবর ১৯৭১
ইয়াহিয়া সরকারের নিয়ন্ত্রিত পূর্ব পাকিস্তান থেকে জাতীয় পরিষদের উপনির্বাচনে ৩১ জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতা নির্বাচিত হয়েছেন। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতা নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্যদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন কাইয়ুম সাধারণ সম্পাদক খান আবদসু সবুর, জামাত ইসলামীর আমীর অধ্যাপক গোলাম আযম, মুসলীম লীগ সভাপতি খাজা খায়ের উদ্দিন, জামাত প্রার্থী মওলানা এ কে এম ইউসুফ। (দৈঃ পাঃ)
-চট্টগ্রামে তাবেদর সরকারের অর্থমন্ত্রী আবুল কাসেম বলেন, বর্তমানে ৫০ হাজার রাজাকারকে ট্রেনিং দেয়া হচ্ছে। ট্রেনিং শেষে এদেরকে অস্ত্র-শস্ত্র সজ্জিত করে প্রতি ইউনিয়নে নিয়োগ করা হবে। রাজাকারদের সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়িয়ে এক লাখে উন্নীত করা হবে। (পাক সমচার ৭ খঃ পৃঃ ৬০৭)
-দি মনিং নিউজ- এর প্রবেশ দ্বারে গেরিলাবাহিনী গ্রেনেড নিক্ষেপ করে উল্লেখ্য এই সময়ে পাকসেনাদের ঢাকায় কর্মতৎপরতা সম্বন্ধে সাংবাদিক D.R. Mankekar লিখেছেন, ‘In a mad witch-hunt, the Pakistan Army now killed 1000 persons and arrested several thousands in the course of a through sector by sector search in Dhaka city’ (p-41)
-ভারতের প্রধামন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী অষ্ট্রিয়া থেকে লন্ডনে পৌঁছান। এখানে তিনি (অক্টঃ ৩০-৩১) ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মিঃ হীথের সাথে একান্ত বৈঠক করেন। তিনি সাংবাদিকদের পরে জানান, সর্বোপরি আলোচনা অত্যন্ত সফল হয়েছে। (She was’ on the whole satisfied with talks). উল্লেখ্য লন্ডনে পৌঁছানর পর শ্রীমতি গান্ধী রয়াল ইষ্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল এ্যাফেয়ার্সের সদস্যদের এক সভায় বাংলাদেশ সমস্যা সম্পর্কে বক্তৃতা করেন। তিনি বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক শাসন কর্তৃপক্ষ এবং পূর্ববঙ্গের নির্বাচিত নেতৃবৃন্দের মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত। কারণ, একমাত্র তাঁদের পক্ষেই সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করা সম্ভব। (‘দি টাইমস’ ৩০/১০/৭১)
-শ্রীমতি ইন্দিরাগান্ধীর লন্ডনে পৌঁছানোর পর বাংলাদেশ মিশন প্রধান ও মুজিবনগরের বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি বিচার পতি আবু সাঈদ চৌধুরী ক্লারিজেস হোটেলে গিয়ে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। শ্রীমতি গান্ধী বিচারপতি চৌধুরী পুরানো বন্ধুর মত কথা বলতে শুরু করেন। বিচারপতি চৌধুরী কর্তৃক ফ্রান্স, হল্যান্ড, ডেনমার্ক, সুইডেন ফিনল্যাণ্ড ও সুইজারল্যাণ্ড সফরের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তিনি জানতে চান। উল্লখে্য বিচারপতি চৌধুরী সেপ্টেম্বর মাস ব্যাপী ঐ সব দেশ সফরে করেছেন। বিচারপতি চৌধুরী বলেন, বিভিন্ন দেশের সরকার ও জনগণ বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতিশীল। বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের ব্যাপারে তারা
বলেন, ভারত স্বীকৃতিদানের উপর তাঁদের সিদ্ধান্ত নির্ভর করছে। আবেগপূর্ণ স্বরে তিনি আরও বলেন, শ্রীমতি গান্ধীর পিতা বেঁচে থাকলে তিনি শুধুমাত্র বাস্তত্যাগীদের আশ্রই দিয়েই ক্ষান্ত থাকতেন না। অবিশ্যি এর প্রতিদানে দেওয়ার মতো কিছুই বিচারপতি চৌধুরীর নেই। বাংলাদেশ কখনও ভারতের করদ রাজ্যে পরিণত হবে না। তবে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিবেশী ভারতের সুপ্রতিবেশী সুলভ বন্ধু রাষ্ট্রের ভূমিকা গ্রহণ করবে। এই বন্ধুত্ব ভারতের কাম্য কিনা, ভারত তা বিচার করবে।
শ্রীমতি গান্ধী ধৈর্য ধরে তাঁর বক্তব্য শোনার পর বিনীতভাবে বলেন, বন্ধুত্বের কথা উল্লেখ করে বিচারপতি চৌধুরী সৌজন্য প্রকাশ করেছেন। এ সম্পর্কে স্বাধীন বাংলাদেশের জনগণ কর্তৃক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা পর্যন্ত অপেক্ষা করা বাঞ্চনীয় বলে তিনি মনে করেন।
বিচারপতি চৌধুরী কর্তৃক উল্লেখিত প্রতিদান সম্পর্কে শ্রীমতি গান্ধী বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশ থেকে তিনি একটি মাত্র প্রতিদান আশা করেন-তা’হল গণতন্ত্র। পার্শ্ববতী দেশে তিনি সামরিক শাসন দেখতে চান না।
উপরোক্ত সাক্ষাৎকার কালে বিচারপতি চৌধুরী শ্রীমতি গান্ধিকে বলেন, লণ্ডনের এক সভায় বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদান সম্পর্কে জয়প্রকাশ নারায়ণকে প্রশ্ন করা হয়েছিল। উত্তরে তিনি বলেছিলেন, তাকে প্রশ্ন করে লাভ নেই। স্বীকৃতিদানের অধিকারী হলে তিনি বহু পূর্বে বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদান করতেন।
শ্রীমতি গান্ধী হাসিমুখে বলেন, মিঃ নারায়নের মত সরকারী দায়িত্বমুক্ত নাগরিকের অধিকার থেকে তিনি বঞ্চিত। মানবতার খাতিরে তিনি বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দকে সর্বপ্রকার সাহায্য দিচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ভারতের জনগণের স্বার্থের প্রতি নজর রাখা তাঁর প্রাথমিক কর্তব্য। তিনি ভারতের উপর একটি যুদ্ধ চাপিয়ে দিতে পারেন না। ভারতকে বিনা প্ররোচণায় জদ আক্রমণে করা হয় তাহলে কি তাঁর জবাব দিতে হবে, ভারত তা’জানে। উপযুক্ত সময় বিনাদ্বিধায় বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদান করবেন বলে শ্রীমতি গান্ধী উপরোক্ত সাক্ষাৎকার কালে বিচারপতি চৌধুরীকে আশ্বাস দেন।[ সূত্রঃ বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী নিবন্ধঃ ইন্দিরা গান্ধী মেমোরিয়াল ট্রাষ্ট -১৯৮৫ সালে ৩১ অক্টোবর প্রকাশিত স্মারক গ্রন্থ।] (স্বাঃ সংঃ প্রঃ বাঃ পৃঃ ১৭২)
Reference:
একাত্তরের দশ মাস – রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী