বাংলার বাণী
ঢাকা : ২০শে অক্টোবর, রোববার, ১৯৭৪, ২রা কার্ত্তিক, ১৩৮১ বঙ্গাব্দ
মিষ্টি তৈরীর উপর নিষেধাজ্ঞা
বাজারে দুধ সরবরাহে স্বল্পতার কারণে সরকার দুধ এবং দুগ্ধজাত দ্রব্য দিয়ে মিষ্টি তৈরী একচল্লিশ দিনের জন্য নিষিদ্ধ করেছেন। সরকারের এমনি একটি পদক্ষেপ গ্রহণের সম্ভাবনা নিয়ে বেশ কিছুদিন হয় কথাবার্তা চলছিল। জীবন ধারণের ন্যূনতম উপকরণ জনগণের নাগালের বাইরে। দেশের এমনি অবস্থায় সরকার পদক্ষেপ নিয়েছেন বাজারে প্রয়োজনীয় দুধ সরবরাহ অব্যাহত রাখার। উদ্দেশ্য অন্ততঃ দুগ্ধপোষ্য শিশু, ছোট ছোট ছেলেমেয়ে এবং রোগীদের মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করা।
দুধের এই সংকট কিন্তু আজকের নয়। অন্যান্য সংকটের মতো দুধ সংকটও ধীরে ধীরে বেড়ে উঠেছে। দেশীয় উৎপাদন প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হওয়ায় সরকার বিদেশ থেকে দুধ আমদানীর ব্যবস্থা করেন। কিন্তু সেই আমদানীকৃত দুধ নিয়েও চলে মুনাফা লুটার খেল। আমদানীকারকরা দুধ মওজুত করে তা কালোবাজারে উচ্চ মূল্যে বিক্রয় করে অবাধে মুনাফা অর্জন করে। আর দুধের অভাবে বাড়তে থাকে দুগ্ধপোষ্য শিশু, ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের অনাহারী থাকার কষ্ট দুর্ভোগ। কিন্তু অবস্থার তাতে কোনো পরিবর্তন হয়নি। খোলাবাজারে দুধের শত দুষ্প্রাপ্যতা থাকলেও কালোবাজারে অত্যন্ত চড়া মূল্যে দুধ পেতে কিন্তু বেগ পেতে হয়নি।
বর্তমান অবস্থায় দুধ এবং দুগ্ধজাত দ্রব্য দিয়ে মিষ্টি বানানো রীতিমতো বিলাসিরই সামিল। যখন শিশুরা দুধের অভাবে পুষ্টিহীনতা এবং নানা রকম ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে পড়ছে, হাসপাতালে রোগী ছটফট করছে, সারাদেশে যখন মানুষ অনাহারে ধুঁকে ধুঁকে মরছে তখন মিঠাই-মন্ডার বাহুল্য ব্যয় অমানবিক মনে হবে বৈ কি?
মিষ্টি তৈরীতে দুধের এই ব্যয় বন্ধ করা সম্ভব হলে অবশ্যই বাজারে দুধের সরবরাহ কিছু বাড়বে। কিন্তু একই সঙ্গে দুধ নিয়ে যারা মুনাফাবাজী চালিয়ে যাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা গ্রহণ অপরিহার্য। মিষ্টি বানানো বন্ধ হলে যে বাড়তি দুধটুকু বাজারে আসবে তা নিয়েও যে উচ্চতর মুনাফা ফাঁদার লোকের অভাব হবে না এটা অতীত অভিজ্ঞতা থেকে সবাই অনুমান করতে পারে। শুধু দুধের ব্যাপারেই নয় অন্যান্য খাদ্যশস্যের সরবরাহের ব্যাপারেও সরকারের কঠোর সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত।
প্যালেস্টাইন জনগণের মুক্তিসংগ্রাম জয়যুক্ত হবেই
এএফপি পরিবেশিত খবরে প্রকাশ, প্যালেস্টাইন মুক্তি সংস্থাকে জাতিসংঘ আমন্ত্রণ জানালেও ইসরাইল প্যালেস্টাইন সন্ত্রাসবাদীদের উপর আক্রমণ অব্যাহত রাখবে বলে হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেছে। জাতিসংঘে ইসরাইলী প্রতিনিধি বলেছেন, প্যালেস্টাইন মুক্তি সংস্থাকে বিতর্কে অংশগ্রহণ করার জন্য একটি প্রস্তাব পাশ করার পরও প্যালেস্টাইন মুক্তি সংস্থার প্রতি ইসরাইলী মনোভাবের কোনো পরিবর্তন হবে না। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের যে বিশেষ অধিবেশন বর্তমানে অনুষ্ঠিত হচ্ছে তাতে প্যালেস্টাইনী মুক্তি সংস্থাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে তাদের বক্তব্য রাখার জন্য। বর্তমান বিশ্বের নানা ঘটনাপ্রবাহের মাঝে এ ঘটনাটি নিঃসন্দেহে একটি উল্লেখযোগ্য বিষয়। বহুকালের একটি অমীমাংসিত ঘটনাকে জাতিসংঘের সভ্যবৃন্দ আলোচনার জন্য হলেও অনুমোদন করেছে। তাদের প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগও করে দিয়েছে। প্যালেস্টাইন মুক্তি সংস্থার পক্ষ থেকেও প্রথমবারের মতো তারা প্রতিনিধিত্ব করছে জাতিসংঘে। বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ বরাবর প্যালেস্টাইন জনগণের ন্যায়সঙ্গত দাবীর প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে এসেছে। আরব ভূমিতে বহুকাল ধরে যে উত্তেজনা, যুদ্ধ প্রভৃতি ক্রিয়াশীল রয়েছে তার একটি সুষ্ঠু সমাধান বিশ্বজনমত সর্বদাই দাবী করে এসেছে। কিন্তু দখলদার ইসরাইলী শাসকবৃন্দ প্যালেস্টাইনীদের কোনো কথাতেই কান দেয়নি। পূর্বাপর তারা উত্তেজনা জিইয়ে রেখেছে, যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে। গত বছরের অক্টোবরের ইসরাইল-মিসর এবং পরে আরব জাহানের মধ্যে যে যুদ্ধ হয়ে গেল তাতে গোটা বিশ্বকেই খেসারত দিতে হচ্ছে। এ ব্যাপারে আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রেরও দায়িত্ব কম ছিলনা। তাদের অস্ত্র সাহায্যে ও নৈতিক সমর্থন মূলধন করে ইসরাইল যুদ্ধ পরিচালনা করেছে। প্যালেস্টাইন জনগণের দাবীকে নস্যাৎ করে দেবার চক্রান্তে তারা মদদ যুগিয়েছে। এ কারণে বিশ্ব জনমতের কাছ থেকে তারা ধিক্কারও কম পায়নি। তবু প্যালেস্টাইন সমস্যার প্রশ্নটি নিয়ে আমেরিকার কোনো শান্তিপূর্ণ ন্যায়সঙ্গত উদ্যোগ আমরা লক্ষ্য করিনি। প্যালেস্টাইনবাসীদের দাবীর প্রতি মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সবক’টি দেশেরই অকুন্ঠ সমর্থন রয়েছে—এ ব্যাপারে তারা আপোষহীনও বটে। ইসরাইলের অন্যায় আচরণ এবং প্যালেস্টাইনী জনগণের ন্যায়সঙ্গত দাবীকে ন্যক্কারজনকভাবে উপেক্ষা করার প্রতিবাদেই মূলতঃ মধ্যপ্রাচ্যের তেল উৎপাদনকারী দেশসমূহ বিশ্বব্যাপী তেলের সংকট সৃষ্টি করেছে। এতে করেও বৃহৎ শক্তি বিশেষ করে আমেরিকার শুভবুদ্ধির উদয় ঘটেনি। প্যালেস্টাইনীদের দাবীর সুষ্ঠু সমাধান খুঁজে বের করার জন্য সে অগ্রসর হয়নি। আন্তর্জাতিক সংঘের একশত পাঁচটি সদস্য দেশ প্যালেস্টাইনীদের বিতর্ক অনুষ্ঠানে যোগদানের স্বপক্ষে অভিমত পোষণ করে যে নৈতিকতার পরিচয় দিয়েছে তা বিশ্বের কোটি কোটি শান্তিকামী মানুষের অভিব্যক্তির পরিচায়ক হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। আমাদের বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ এবং বর্তমানের ক্ষমতাসীন সরকার পূর্বাপর প্যালেস্টাইন জনগণের দাবীর স্বপক্ষে পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে এসেছে। জাতিসংঘের বর্তমান অধিবেশনে তাদের ন্যায়সঙ্গত দাবীর একটি শান্তিপূর্ণ সুরাহা হোক—এটাই আমাদের কামনা। মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি কপোত নির্বিঘ্নে পাখা উড়াতে যেদিন সক্ষম হবে সেদিন বিশ্বের অন্যতম একটি বিরাট সমস্যার সমাধান হবে বলে আমরা মনে করি। জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলো এ ব্যাপারে তাদের যথার্থ ভূমিকা গ্রহণ করবেন বলে আমাদের বিশ্বাস রয়েছে।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক