জয় বাংলা ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ তারিখের মূল পত্রিকা
মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
জয় বাংলা
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাপ্তাহিক মুখপাত্র
প্রথম বর্ষ, ৩৩শ সংখ্যা, ২৯শে অগ্রহায়ণ, বৃহস্পতিবার, ১৩৭৮, ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১
ঢাকা আমাদের
মহানগরীর সরকারি বেসরকারি ভবনে স্বাধীন বাংলার পতাকাঃ বঙ্গবন্ধু দীর্ঘজীবী হোন ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত
আজ (বৃহস্পতিবার) বিকেলে ঢাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পন করেছে। অগ্রসরমান মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় জওয়ানদের সম্মিলিত অভিযানে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা নগরী মুক্ত হয়েছে এবং সকল সরকারি বেসরকারি ভবনে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড্ডীন হয়েছে। মুজিবনগর থেকে শীঘ্রই স্বাধীন বাংলার প্রশাসনিক সদর দপ্তর ঢাকা স্থানান্তরিত হচ্ছে বলে জানা গেছে। তাবেদার গভর্নর মালেকের পদত্যাগের পর খানসেনারা নিজেরাই যুদ্ধবিরতি আর্জি জানায়।
আজ বাংলাদেশের বীর মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় জওয়ানগণ পাকিস্তানি হানাদারের পশ্চাদ্ধাবন করে মহানগরী ঢাকায় প্রবেশ করলে বিরান ও ধ্বংসস্তূপ নগরী আবার সজীব হয়ে ওঠে এবং জয় বাংলা ও বঙ্গবন্ধু দীর্ঘজীবী হোন, বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী স্থায়ী হোক ধ্বনীতে ঢাকার আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। খান সেনারা এবং তাদের দাবি-দাওয়া দলে আত্মসমর্পণ করেছে। আত্মসমর্পণের তারা জেনারেল মালেকের মানেক শ’র কাছে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব জানালে ভারতের সেনাপতি তাদের আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন।
ঢাকা শহর মুক্ত হওয়ার খবরে অশ্রুসজল কন্ঠে আমাদের অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট এক বাণীতে বলেছেন আমাদের বিজয় সম্পন্ন হলো। এখন আমাদের সামনে আরো কঠিন কাজ বাকি। তাহলো ধ্বংসস্তূপের মধ্যে একটা জাতির পুনর্বাসন এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক পুনর্গঠন।
প্রধানমন্ত্রীর জনাব তাজউদ্দীন আহমেদ বলেছেন স্বাধীন বাংলাদেশ বিশ্বের নিপীড়িত ও লাঞ্ছিত মানবতা একটি অকৃত্রিম বন্ধু জাতি হিসেবে গড়ে উঠবে। আমরা দেশ ও জাতিকে মুক্ত করার সংগ্রামে জয়ী হয়েছি। কিন্তু এখন জাতির পিতাকে মুক্ত করার সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে হবে।
ঢাকা আমার বাংলা আমার
(গান)
আব্দুল গাফফার চৌধুরী
এই বিজয়ের নিশান আমার
ঢাকা আমার বাংলা আমার
রক্ত নদীর পারে দেখি
রঙিন আলো সূর্য সোনার ।
দুঃশাসনের হাড়ে বাজাই বিজয় ভেরী
নতুন ভোরের বাজে বিয়ান নাই যে দেরী
শ্যামল মাটির সবুজ সোনা
গলায় গলায় সুর যে বোনা
মধুমতির মধুর স্রোতে পদ্মা বলে এল জোয়ার।।
সবুজ, লাল আর সোনায় আকা এই পতাকা
লক্ষ শহীদ চোখে তাদের স্বপ্ন মাখা
স্বপ্ন এবার সফল হলো
চলো চলো ঢাকা চলো
ধানের শীষের আগমনে চলার গতি থামবে না আর।।
ভেঙেছ দুয়ার এসেছ জ্যোতির্ময়
ঢাকা মুক্ত। ঢাকা এখন আমাদের। জয়বাংলা। স্বাধীনতার এই পবিত্র ঊষালগ্নে সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রত্যাশা পূরণের এই পবিত্র মুহূর্তে আমরা ভাবাবেগে অধীর হয়ে নয় শান্ত, সমাহিত ও সৌম্য হৃদয়ে স্মরণ করি অসংখ্য বীরের রক্তস্রোত ও মাতার অশ্রুধারা কে। স্মরণ করি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। রাত্রির তমসা শেষে আসিবে না দিন? এই প্রশ্নের জবাব এসেছে মহানগরীর ঢাকায় স্বাধীনতার রক্ত রাঙ্গা পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে। আমরা আজ গভীর কৃতজ্ঞতা সঙ্গে স্মরণ করছি ৫০ কোটি ভারতবাসীর অকুতোভয় মৈত্রী এবং তাদের জন্য নেত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর ঐতিহাসিক ভূমিকা কে। আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের সংগ্রামে ভারতের বীর সৈনিকেরা ও রক্ত দিয়েছেন, আত্মদান করেছেন এবং রক্তঋণ আছে রাখি সারা বাংলাদেশকে বেঁধে ফেলেছেন। বাংলাদেশ ও ভারতের এই মৈত্রী সুদৃঢ় হোক। স্বাধীন বাংলাদেশ চিরস্থায়ী হোক।
বহু ইতিহাসের নগরী ঢাকা
স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা। প্রায় হাজার বছরের ইতিহাস জড়িয়ে রয়েছে ঢাকার সঙ্গে অনেক কিংবদন্তি বহু কাহিনী। বিশ্বজিৎ দিগন্ত থেকে সপ্তডিঙা সাজিয়ে বণিকরা আসত বাণিজ্যের প্রসার ভরে নিয়ে যাবার জন্য। ঢাকার মসলিন উঠত সুন্দরী রাজকন্যা আর রাজরাণীদের দেহে। ইংরেজ শাসনামলে ম্যানচেস্টারের কাপড় পেরে ওঠেনি ঢাকার বস্ত্র ও বয়ন শিল্পীদের সঙ্গে। তাই তারা ধরে ধরে ঢাকার তাঁতিদের বুড়ো আঙ্গুল কেটে দিয়েছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক দল ও তাদের বাণিজ্যে আরো শোষণ অব্যাহত রাখার জন্য বুড়ো আঙ্গুল নয় বাঙ্গালীদের প্রাণ আর মানস সত্তাকেই হত্যা করতে চেয়েছিল;- বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের শহীদদের রক্তের লাল করে দিয়েছিল ঢাকার রাজপথে।
তারপর হাজারো শহীদের চাপচাপ রক্ত জমেছে ঢাকার পিচ ঢালা কালো রাজপথে। তাই আজ শহীদের রক্তস্নাত ঢাকা স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাজধানী।
* * *
কিংবদন্তিদের নগরী ঢাকা। এই নগরীর পত্তন এর কোনও সঠিক ইতিহাস জানা যায় না। কথিত আছে মুঘল সম্রাট আকবরের আমালে রাজা মানসিংহ বাংলাদেশের বিদ্রোহ দমন করতে এসে ঢাকেশ্বরীর কালী মন্দিরে পুজো দেন। এই মন্দিরটি নির্মিত হয়েছিল প্রায় ৭০০ বছর পূর্বে। এই পুজোর সময় মন্দিরের বিরাট বিরাট ডাকের শব্দ যতদূর গিয়েছিল রাজা মানসিংহের আদেশে ততদূর এলাকা নিয়ে ঢাকা নগরীর পত্তন হয়েছিল। বাংলার পাঠান রাজা সোলেমান খাঁ র আমলে ঢাকাতে স্থাপন করা হয়েছিল বাংলাদেশের রাজধানী। ভাওয়ালের গাজীদের আমলেও ঢাকাতেই ছিল তাদের রাজধানী।
ঢাকার অদূরে পাগলা। ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ যাবার পথে পড়ে। গত নয় মাস ধরে খানসেনারা পাগলার ধার ঘেঁষে বয়ে যাওয়া বুড়িগঙ্গার পাড়ে একটি জায়গাকে বদ্ধভূমি হিসেবে ব্যবহার করেছিল। ইসলাম খাঁ জলদস্যু ও বিদ্রোহীদের দমন করতে এসে পাগলা বন্দর দখল করেন। এখানে তিনি একটি দুর্গ নির্মাণ করেন। সেই দুর্গের খানিকটা ভেঙে এখন বুড়িগঙ্গার দিকে ঝুলে রয়েছে। পাগলার কালীমন্দির হয়তো আজও আছে যদি পশ্চিম পাকিস্তানী সেনারা ধ্বংস করে না থাকে। আর হয়তো আছে ৪০০ বছরের পুরনো সেই বটগাছটি। ইসলাম খাঁ নিজে যে বট গাছ রোপণ করেছিলেন বলে শোনা যায়।
মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে ইব্রাহিম খান যখন বাংলার সুবেদার, পুত্র শাহজাহান পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে কয়েক দিনের জন্য ঢাকার রাজধানী স্থাপন করেছিলেন।
শায়েস্তা খানের আমলে ঢাকা সমৃদ্ধির চরমে পৌঁছে ছিল। আর তখন সুবে বাংলার রাজধানী ঢাকার জনসংখ্যা ছিল পনের লক্ষ।
আওরঙ্গজেবের আমলে শাহজাদা আজিম উসশান যখন বাংলাদেশের নায়েবে নাজিম তখন তার অমিতব্যয়িতায় বিরক্ত হয়ে সম্রাট আওরঙ্গজেব মুর্শিদকুলী খান কে বাংলার রাজস্ব বিভাগের দায়িত্ব দিয়ে। সভাপতি মুর্শিদকুলি খাঁর সঙ্গে আজিম উসশানের বিরোধ বেঁধে যায়। মুর্শিদকুলি খাঁ সম্রাটের অনুমতি নিয়ে দেওয়ানী বিভাগের সদর দপ্তর মকসুদাবাদে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। পরে তিনি যখন সুবে বাংলার শাসনকর্তা নিযুক্ত হন তখন মুর্শিদাবাদকেই তার রাজধানী করেন। এইভাবে দীর্ঘকাল পরে বাংলার রাজধানী স্থানান্তরিত হল ঢাকা থেকে। কিন্তু সহকারি নায়েবে নাজিম এর সদরদপ্তর দীর্ঘকাল ঢাকাতেই রাখা হয়েছিল।
এরপর প্রায় ছয় শতাব্দীর বিরতি। তারপর ১৯০৫ সালে পূর্ব বাংলার আসাম নিয়ে যখন স্বতন্ত্র প্রদেশ গঠিত হয়েছিল তখন কয়েক বছরের জন্য আবার এই প্রদেশের রাজধানী প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকাতে। তারপর আবার ১৯৪৭ এর আগস্ট মাসে ঢাকা হল পূর্ব বাংলার রাজধানী। সেই থেকে শুরু হলো আবার নতুন পর্যায়ে নতুন বাংলা গঠনের আন্দোলন। সেই ইতিহাস বাঙালির জাতীয় সত্তার আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্য একটানা প্রায় দু’দশক ধরে রক্তদানের সংগ্রামী ইতিহাস।
ঢাকার রমনায় রয়েছে রমনা কালিবাড়ি। প্রায় ৯০০ বছরের পুরনো। মোগল হানাদারদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হবার জন্য এক সময়ে এই কালী মন্দিরেই ভূঁইয়াদের সঙ্গে ঈশা খাঁর মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। ইংরেজ আমলে বাংলার অগ্নি সন্তানরা সুত্রধার রক্ত শপথ গ্রহণ করত এই ঐতিহাসিক রমনার কালী মন্দিরে। খান সেনারা এবার সেই মন্দির ধ্বংস করেছে। ধ্বংস করেছে আরো অনেক কিছু- ঢাকায়, সারা বাংলাদেশে। কিন্তু হত্যা করতে পারেনি বাংলার আত্মাকে। তাই আজ স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের আকাশে উড়ছে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা।
জয় বাংলা।
দালালির পুরস্কার মৃত্যুদণ্ড
দস্যু ইয়াহিয়ার সৈন্যদের সাহায্য করে সুখে শান্তিতে বাঁচতে চেয়েছিল রংপুর জেলার বড় খাতা গুড্ডীমারী অঞ্চলের মুসলিম লীগ কর্মী মোঃ চাঁদ সদাগর ও করিম ডাক্তার। কিন্তু খানসেনাদের প্রতি আনুগত্যের পুরস্কার স্বরূপ তাদের গুলিতেই দুজন কে মরতে হয়েছে।
এই দুজন বিশ্বাসঘাতক ইয়াহিয়ার কসাই সৈন্যদের মদত দিয়েছে বাঙ্গালীদের হত্যায়, সম্পত্তি লুণ্ঠনে এবং পরিজনের পাশবিক প্রবৃত্তি চরিতার্থের ব্যাপারে।
সম্প্রতি মুক্তিবাহিনীর হাতে প্রচন্ড মার খেয়ে বড় খাতা থেকে পালাবার সময় খান সৈন্যরা মেশিনগান থেকে গুলি ছুড়ে তাদের হত্যা করে। হত্যার পর তাদের কুঁকড়ে যাওয়া দেহ গাছে ঝুলিয়ে দেয়। এরপর খানসেনারা এদের একজনের দুটি যুবতী কন্যা কে অপহরণ করে নিয়ে যায়।
তাবেদার মালিকের শেষ অধ্যায়
ইয়াহিয়া নিয়াজীর ক্রীতদাস লুপ্ত “পূর্ব পাকিস্তানের” গভর্নর আব্দুল মোতালিব মালেক লাটভবনের উপর মৃত বাহিনীর বোমা বর্ষণের পর সম্বিত ফিরে পেয়ে প্রাণ বাঁচাবার জন্য শেষ পর্যন্ত ঢাকার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে স্ত্রী-কন্যাসহ আশ্রয় নিয়েছে।
লাটভবনের মিত্রবাহিনীর বোমারু বিমান থেকে বোমা বর্ষণের আগে পর্যন্ত ইয়াহিয়ার পদলেহী কুকুর মালিক মনে করেছিল যে তাকে রক্ষা করার জন্য ব্যবস্থা হবেই। কিন্তু লাট ভবনের বোমাবর্ষণ এর পরেই মোতালিব সব মীরজাফরের মত জীবন ভয়ে কাঁপতে থাকে এবং বিবরে গিয়ে আশ্রয় নেয়।
এর আগে মোতালিব মালিক একটি বল পয়েন্ট নিয়ে একটি ছেঁড়া কাগজ এনে দেয় এবং কম্পিত হাতে ইয়াহিয়ার কাছে তাঁর ও তাঁর মন্ত্রিসভার অন্যান্য কুইসলিং-দের পদত্যাগ পত্র লিখে দেয়। পদত্যাগপত্রটি ঠিক হল কিনা তা মালিক দুজন বিদেশি কে দেখান। তারা সে সময় লাটভবনে আটক হয়ে পড়েছিল।
লাট ভবনের ওপর বোমা বর্ষণ শুরু হলে মালিক বিবর ঘাঁটিতে প্রবেশ করে তার জুতো খুলে অজু করে এবং মাথায় একটা সাদা রুমাল বেধে নামাজ পড়ে। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, নামাজ পড়ার সময় কুইজলিং মালিক তার পাপের পরিণতির কথা স্মরণ করে কাঁপছিল।
বাংলার মুক্তি সংগ্রামে নারী সমাজের ভূমিকা
গত ২৫ শে মার্চ রাত বারোটা থেকে যে সশস্ত্র সংগ্রাম আরম্ভ হয়েছে সে আমাদের মুক্তির সংগ্রাম সে আন্দোলন আমাদের বাঁচার আন্দোলন আন্দোলন আমাদের স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলন। বর্বর জঙ্গিশাহী সুদীর্ঘ ২৪ বছর ধরে আমাদের বুকের রক্ত শোষণ করে আমাদের সোনার বাংলাকে নিঃস্ব করে তার বুকে মেরেছে ছুরি। সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলা বাংলাদেশকে তারা ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। মাঠের ফসলের জঙ্গিশাহী বিমান থেকে ফেলেছে বিষ। আমাদের ঐতিহ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস করে দিয়েছে। অধ্যাপকদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। বৃদ্ধ অধ্যাপকদের ও তারা রেহাই দিতে পারেনি। বিখ্যাত দার্শনিক ডাক্তার গোবিন্দ চন্দ্র দেব কে বিছানা থেকে পথে ট্রেনে জঙ্গী তার বুকে করল বেওনেট চার্জ। এমনি করে মারা হয়েছে ডাক্তার মনিরুজ্জামান ও আরো অনেককে। জগন্নাথ হল, ইকবাল হলের ছাত্ররা পরীক্ষা পিছিয়েছে তাই রাত এগারটার দিকে সব মনের আনন্দে ঘুমিয়ে ছিল। সে অবস্থায় তাদের উপর চালানো হয়েছে মেশিনগান। রোকেয়া হলে রাত বারোটায় জঙ্গিশাহ জ্বালিয়ে দিয়েছে আগুন। ঘুমন্ত হল আগুনের লেলিহান শিখার শিকার হল। আরো কত হাজার হাজার মানুষকে এই হিংস্র পশুর শিকার হতে হয়েছে তার কোন হিসাব নেই। ভাবতে পারেন? বিশ্বাস করতে পারেন? কি নির্মমভাবে জঙ্গী শাহী আমাদের রক্ত দিয়ে আমাদেরকে স্নান করিয়েছে।
২৫শে মার্চে জঙ্গী সরকার ইয়াহিয়া ঢাকা থেকে বিদায় নিল এবং সাথে সাথে লেলিয়ে দিয়ে গেল তার পোষা কুকুরকে বাঙালির উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে বাঙালি নিধন করতে। বিশেষ করে ছাত্র- শিক্ষক- বুদ্ধিজীবী নির্মূল কর, আওয়ামী লীগ হিন্দু-মুসলমান ধ্বংস করো। যাহাতে কিনা আগত ২০ বছর পশ্চিমা গোষ্ঠী নিরাপদে শোষণ করে শাসন চালিয়ে যেতে পারে। কিন্তু না -তাহবে না- বাঙালি তা হতে দেবে না। শুধু তাই না আওয়ামিলীগ, হিন্দু, ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী ধ্বংস করে জঙ্গী সরদার শান্তি পেল না। তারা এবার নারী নির্যাতনে মেতে উঠল নারীর সতীত্ব ছিনিয়ে নিল তাদের উপর অত্যাচার। রোকেয়া হলে জ্বালিয়ে দিল আগুন। মেয়েরা আগুনের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পরলো এদিকে-ওদিকে ছড়িয়ে পড়ল। ক্ষ্যাপা কুকুর গুলির যাদের ধরতে পারলে তাদের করলে পৈশাচিক নির্যাতন। তারপর তাদের নিয়ে মিলিটারি ক্যান্টনমেন্ট ভর্তি করলো। গর্ভবতী মহিলাদের বেয়োনেটেরখোঁচা দিয়ে ধরাশায়ী করলো। তরুণী মেয়েদের ইজ্জত কেড়ে নিল। অল্প বয়সে বধূদের স্বামী ও সন্তান হত্যা করে তাদের উপর করল অত্যাচার। কিন্তু কেন? কি অন্যায় করেছিল বাংলার মেয়েরা? কি অপরাধ করেছিল তারা ইয়াহিয়ার কাছে? যার জন্য তাঁদের উপর চালানো হয়েছে এই জঘন্য অতাচার। বাংলার মেয়েদের ধরে নিয়ে জঙ্গী সরদার ব্যবসা শুরু করে দিয়েছে। পাট এর পরিবর্তে দশ হাজার তরুণী মেয়েকে বিদেশে চালান করা হয়েছে। কিন্তু কেন? এই প্রশ্নের উত্তর জঙ্গিসর্দার তোমাকেই দিতে হবে। সেদিন আগত। তোমার অত্যাচর বাঙালিরা সহ্য করবে না- বাঙালি নারী আর সইবে না। তারা আজ মুক্তিযোদ্ধা, তারাও আজ মুক্তি সংগ্রামে অংশ নিয়েছে। তারা রাইফেলস ছুড়তে জানে, জানে তারা মেশিনগান, স্টেনগান, সেল এর ব্যবহার। বাংলার নারী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার -বাংলার নারী কল্পনা দত্ত। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে শহীদ হয়েছে আরো কত স্বাধীনতাকামী বীরঙ্গনা। তারাও জন্মেছিলে বাংলা মায়ের বুকে তারাও বেড়েছিল এই বাংলার মুক্ত আলো-বাতাসে দিনে দিনে। সেই বাংলা মায়ের বুকে জন্ম আমাদেরও। বাংলার স্বাধীনতা রক্ষায় আমরাও বদ্ধপরিকর। বাংলার মেয়েরা যে যেভাবে পারছে সে সেভাবেই মুক্তিসংগ্রামের শত্রু নিধন যজ্ঞ অংশ নিয়েছে এবং নিচ্ছে।
কুমারখালীতে ২৫ জন মিলিটারিকে ২০ জন মহিলা লঙ্কার গুঁড়ো দিয়ে হত্যা করেছে।
বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামে নারীদের ভূমিকা ও কম নয়। মেয়েরা নার্সিংহোমে অংশ নিয়েছে। আহত মুক্তিযোদ্ধাদের তারা সেবা-শুশ্রূষা সুস্থ করে তুলছে যাতে তারা আবার বাংলা মায়ের বন্ধন মোচনে যুদ্ধে যেতে পারে। অনেকেই শীতের হাত থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের রক্ষা করার জন্য শীতের কাপড় তৈরি করছে। যেমন জাম্পার, মোজা, মাফলার এগুলি উল দিয়ে বুনছে। অনেক মহিলা মুক্তিবাহিনীর ট্রেনিং নিচ্ছে শত্রু নিধনের জন্য। মুক্তি সংগ্রামে অংশ নিয়েছে আবালবৃদ্ধবনিতা কেউ আজ পিছিয়ে নেই। বৃদ্ধারাও আজ মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিবাহিনীকে তারা তাদের শেষ শক্তিটুকু দিয়ে আচ্ছাদন দিচ্ছেন। বাংলার মায়েরা মুক্তিফৌজ এক ক্যাম্পে সাধারণত যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন খাদ্যদ্রব্য সময়-সুযোগমতো মুক্তিফৌজ ক্যাম্পে পৌঁছে দিচ্ছেন।
আমাদের দেশে যে মুক্তি সংগ্রাম চলছে সে সংগ্রাম একা পুরুষের নয়, এই সংগ্রাম নারীদেরও। তাই আজ বাংলার বধূরা মাথার ঘোমটা খুলে শত্রু নিধন যজ্ঞ অংশ নিয়েছে বাংলার মেয়েরা হাতে নিয়েছে রাইফেল মর্টার মেশিনগান প্রভৃতি ভারি ভারি অস্ত্র। বাংলার মায়েরা নিজ নিজ সন্তানকে আপন হাতে রক্ত তিলক ললাটে একে পাঠিয়েছেন স্বাধীনতা রক্ষায়। এই সংগ্রাম আমাদের সকলের সংগ্রাম, নারী-পুরুষ উভয়েরই সংগ্রাম। আমাদের এই সম্মিলিত সংগ্রামে আমরা জয়ী হবোই। জয় আমাদের সুনিশ্চিত। বিদ্রোহী কবির এই কয়টি লাইন আজ এই মুহূর্তে বারেবারে মনে পড়ছে।
কখনো একা হয়নিকো জয়ী
পুরুষের তরবারী
প্রেরণা দিয়েছে শক্তি দিয়েছে
বিজয়লক্ষ্মী নারী।
তাই আজ বাংলাদেশের শত্রু কবলমুক্ত। সব মুক্ত অঞ্চলে বাংলাদেশের পতাকা পতপত করে উড়ছে। সেদিন ও সুদূর নয় যেদিন আমাদের স্বাধীনতা সূর্যের সোনালী আভায় আমাদের সোনার বাংলা ঝিকমিক করবে।
জয় বাংলা
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাপ্তাহিক মুখপাত্র
প্রথম বর্ষ ৩৪শ সংখ্যা,। ৮ই পৌষ, শুক্রবার ১৩৭৮ ২৪শে ডিসেম্বর, ১৯৭১
মুজিবনগর থেকে ঢাকায় একই প্রশ্ন বঙ্গবন্ধু কবে ফিরছেন
(জয়বাংলা প্রতিনিধি)
এখন মুজিবনগর থেকে ঢাকা সর্বত্র একই প্রশ্ন একই বিষাদমাখা জিজ্ঞাসা -বঙ্গবন্ধু কবে ঢাকা ফিরবেন? পাকিস্তানি জঙ্গি জান্তার নতুন প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধুকে জেল থেকে মুক্ত করে অজ্ঞাত স্থানে গৃহবন্দি করেছেন এবং বাংলার মীরজাফর নুরুল আমিনকে ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে নিয়োগ করেছেন। এতে পর্যবেক্ষক মহল সন্দেহ করছেন বাংলাদেশ প্রশ্নে পিকিং এর মদত নিয়ে ভূট্টোচক্র নতুন চক্রান্ত অবতীর্ণ হতে পারে।
কিন্তু মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর হাতে এখন প্রায় লক্ষ্যের কাছাকাছি আলাদা স্বর্ণ এবং নিয়াজী ফরমান আলী সহ বহু হানাদার অফিসার বন্দী। সুতরাং এই বন্দীদের ফিরিয়ে নেয়ার জন্য করাচি লাহোর পেশোয়ারে যে বিক্ষোভ শুরু হবে তার পরিণতিতে বঙ্গবন্ধুকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হবেন এখন সকলের মনে অঙ্কুরিত হয়েছে। পাকিস্তানের যুদ্ধবন্দীদের লক্ষ লক্ষ পরিবার পরিজনের সম্মিলিত দাবির মুখে ভুট্টোর ভন্ডামি বেশি দিন টিকবে না এবং বঙ্গবন্ধু শীঘ্রই ঢাকা ফিরবেন এই দৃঢ় প্রত্যয় এখন সকলের বুকে। বঙ্গবন্ধুকে ফিরিয়ে দিতে গড়িমসি করে পাকিস্তানকে আরেকটি বড় আঘাত এর জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে এবং ভুট্টোকেও ইয়াহিয়ার পদাঙ্ক অনুসরণ করতে হবে।
ঢাকা কলকাতা দিল্লি
কলকাতা ও দিল্লির সঙ্গে ঢাকার টেলিফোন যোগাযোগ সম্প্রতি স্থাপিত হয়েছে।
আমাদের ডাক ও তার বিভাগের director-general জনাব লোকমান হোসেন ভারতের যোগাযোগ ব্যবস্থার সেক্রেটারি শ্রী এনভি শেলয় ও ভারত সরকারের উপদেষ্টা সিএম কে বসুর সঙ্গে গত ১৮ই ডিসেম্বর নতুন লাইনে কথাবার্তা বলেছেন।
উল্লেখযোগ্য ভারতের বিদেশ সঞ্জয় ব্যবস্থার আওতায় এই টেলিফোন ব্যবস্থা পরিচালিত হবে।
বিপুল সংবর্ধনার
বুধবার গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী সহ অন্যান্য নেতাদের মুজিবনগর থেকে ঢাকা পৌঁছলে তাদের বিপুল সংবর্ধনার জানানো হয়।
২১ জন বুদ্ধিজীবীর আবেদন
২১ জন বুদ্ধিজীবী গত ২০ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকারের কাছে লিখিত আবেদনে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের হত্যার জন্য দায়ী পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবি করেছেন। তারা এই জন্য একটি মিলিটারি ট্রাইবুনাল গঠনের জন্য অনুরোধ করেছেন বুদ্ধিজীবীগণ বলেন যে প্রকৃত অপরাধীদের শাস্তি গ্রহণ বিনা পশ্চিম পাকিস্তানের যেতে না পারে।
এই আবেদন পত্রের জনসাধারণকে অনুরোধ করা হয়েছে যে তারা যেন আইন নিজের হাতে না নেন এবং সরকারকে আইন শৃংখলা রক্ষা করতে সহায়তা করেন।
জনাব এ আর মল্লিক, ডাক্তার আনিসুজ্জামান, ডাক্তার মাজহারুল ইসলাম, শ্রী গনেশ দাস গুপ্ত, জনাব কামরুল হাসান, জনাব শওকত ওসমান প্রমুখ বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, শিল্পী-সাহিত্যিক বৃন্দ এই আবেদন করেছেন।
ভারত সাহায্য করবে
‘বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পুনর্গঠনে ভারত সর্বপ্রকার সাহায্য দেবে। নতুন রাষ্ট্রের জনগণের অর্থনৈতিক উন্নতিই তাদের স্বাধীনতা সুনিশ্চিত করবে যে স্বাধীনতার জন্য ভারতে সর্ব প্রকার ঝুঁকি নিয়েছিল।’
ভারতের কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী শ্রী ওয়াই, বি, চ্যাবণ সম্প্রতি এক জনসভায় ভাষণদানকালে উপরোক্ত মন্তব্য করেন।
বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত গণহত্যার ব্যাপারে জাতিসংঘের ভূমিকার কথা সমালোচনা করে তিনি বলেন রাষ্ট্রসংঘ বাংলাদেশে গণহত্যা বন্ধ করার ব্যাপারে কিছুই করতে পারেনি। যারা গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার ধারক-বাহক বলে দাবি করেন সেইসব বৃহৎ শক্তিরও তিনি সমালোচনা করেন।
শ্রী চ্যাবন আন্তরিক ভাবে আশা প্রকাশ করেন যে পাকিস্তান ভারত ও বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করে তার নীতির পরিবর্তন ঘটাবে। এতে তার ভবিষ্যতে ভালো হবে।
ঢাকায় চলেছি
– আবদুল গাফফার চৌধুরী
এবার মুজিবনগর থেকে ঢাকা ফেরার পালা। কত স্মৃতি মাখা কুষ্টিয়ার সেই আমের বাগান -যেখানে উচ্চারিত হয়েছে স্বাধীনতার প্রথম ঘোষণাপত্র, মুজিবনগরের প্রতি ধূলিকণা লেখা কত শহীদের রক্তাক্ত কাহিনী, নয় মাসের কত সুখ দুঃখের স্মৃতি একটি নবজাতক প্রজাতন্ত্রের সরকারি কাজকর্মের তৎপরতা, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ও কর্মীদের সেই অনুষ্ঠানে জয় বাংলা পত্রিকা প্রকাশের সেই চাঞ্চল্যকর উত্তেজনা মাখা দিনগুলো সব পেছনে ফেলে আবার ফিরে চলেছি ঢাকায়। এই ঢাকা ছেড়ে একদিন এসেছিলাম বজ্র শপথ বুকে, এখন ফিরে চলেছি আনন্দ অশ্রু আর শোকাশ্রু দুই চোখে নিয়ে।
স্বাধীনতার যুদ্ধে বিজয় মুক্তিবাহিনীর অবশিষ্ট বীর যোদ্ধারা ঢাকা ফিরে চলেছেন। যারা এসেছিলেন তারা সকলে ফিরে যাচ্ছেন না। স্বাধীনতা যুদ্ধে আত্মহুতি দিয়ে অনেকেই এখন চির নিদ্রায় শায়িত মুক্ত বাংলার শ্যামল মাটিতে। আহা ভাইরা আমার তোমরা ঘুমাও। তোমাদের রক্তের ঋণ পরিশোধ করি এমন সাধ্য আমাদের নেই। দেশমাতার তোমরাই প্রকৃত বীর সন্তান। সোনার বাংলাকে শৃংখল মুক্ত করার গৌরব তোমাদের। তোমরা আমাদের গর্ব। চিরকাল আমরা তোমাদের জয়ধ্বনী কন্ঠে ধারণ করে বেড়াবো।
ঢাকা এখন মুক্ত বাংলার রাজধানী। সংগ্রামে সাফল্যের পর এখন চলছে গঠন ও পুনর্গঠন এর পালা। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের নেতারাও মুজিবনগর ছেড়ে চলে গেছে ঢাকায়। ভাবতে ভাবতে চোখে আনন্দাশ্রু গড়ায়। যে শহীদ মিনারের ভগ্নস্তূপ দেখে এসেছি ঢাকা মেডিকেল কলেজের পাশে আবার সেখানে উঠবে শহীদ মিনারের অভ্র ভেদি চূড়া। আবার ঢাকার রাস্তা হয়তো কলরব মুখর হয়ে উঠেছে। কিন্তু আমার মনে শান্তি ও সান্তনা কোথায়? যাদের ঢাকা রেখে এসেছিলাম তাদেরকে গিয়ে আবার ফিরে পাব? যে অসংখ্য ঘরে বাতি নিভে গেছে তাও কি আবার প্রজ্বলিত হবে আমাদের প্রত্যাবর্তনে? কিন্তু কেমন করে? কোথায় ইত্তেফাকের সেই সদানন্দ মানুষটি সিরাজ ভাই যার সাথে বহুকাল সাংবাদিকতা করেছি? কোথায় পূর্বদেশের সেই তরুণ সাংবাদিক মোস্তফা যার বিয়ে খেয়েছি বছরখানেক হয়? কোথায় ডাক্তার রাব্বি, শহীদুল্লাহ কায়সার, আলীম চৌধুরী, মুর্তজা মনিরুজ্জামান? কোথায় আবার দেখা পাবো সেই শান্ত হাসিমাখা মুখ অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী ও মুনীর চৌধুরীর? বাংলার আকাশ এখন কাঁদছে। ঢাকার বাতাস এখন কাঁদছে। হায় পাকিস্তানি আইখম্যান, তোমার বর্বর ঘাতক বৃত্তি এই বিংশ শতাব্দীতেও রেখে গেলো মানবতার ইতিহাসে এক পৈশাচিক নজিরবিহীন নজির। তোমাকে ক্ষমা। না ক্ষমা নয়। তুমি যুদ্ধবন্দী নও যুদ্ধাপরাধী। পৃথিবীর আলো-বাতাস ভোগের কোন অধিকার নেই এই নরপশু, নরঘাতকদের।
ঢাকার কান্না মুজিবনগরের এই পরিত্যক্ত আকাশেও যেন শোকের কুয়াশা জমিয়েছে। পৌষের কুয়াশার চাইতেও আসা ঘন এবং ভারী। মুজিবনগর এখন শূন্য। জয়বাংলার এটাই মুজিবনগর থেকে প্রকাশিত শেষ সংখ্যা। এরপর জয়বাংলা নতুনভাবে আত্মপ্রকাশ করবে ঢাকা থেকে।
আনন্দ আর বিষাদ দুই-ই আজ আমার অন্তরে আছে। মুজিবনগরের বাতাসে বিদায়ের কান্না। ঢাকার আকাশে নতুন আগমনী সানাই। আজ মুক্ত বাংলার মুক্ত তীর্থের দিকে চেয়ে শুধু প্রার্থনা করি মনে মনে –
তোমার পতাকা যারে দাও
তারে বহিবারে দাও শক্তি।
জয় বাংলা।
আমরা দেশকে সমাজতান্ত্রিক ভিত্তিতে গড়ে তুলবো
– কামরুজ্জামান
(কলিকাতা প্রতিনিধি)
গত ১৯শে ডিসেম্বর আমাদের স্বরাষ্ট্র ও পুনর্বাসন মন্ত্রী জনাব এ এইচ এম কামরুজ্জামান বলেন বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলন পৃথিবীর মুক্তি আন্দোলনের অঙ্গ। আমেরিকা ও চীনের ষড়যন্ত্র সত্ত্বেও আমাদের সংগ্রাম জয়যুক্ত হয়েছে। এ জয়কে সুনিশ্চিত করেছে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থন।
জনাব কামরুজ্জামান ভারত সোভিয়েত মৈত্রী সমিতি আয়োজিত জনসভায় আরো বলেন আমরা দেশকে পুঁজিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সমাজতান্ত্রিক ভিত্তিতে গড়ে তুলব।
বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য ভারত স্বক্রিয়
ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বলেছেন যে ভারত দূতাবাস গুলির মারফত বিশ্বের সমস্ত সরকারকে বাংলাদেশ নেতা বর্তমানে পশ্চিম পাকিস্তানের কারারুদ্ধ শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি আদায় সাহায্য করার আবেদন জানিয়েছেন।
সম্প্রতি সানডে টাইমসের মিস্টার নিকোলাস কেরলের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকার প্রসঙ্গে তিনি আরো বলেন আমরা যথেষ্ট চাপ দিতে পারি আমি এরূপ মনে করিনা। তবে আমরা আন্তরিকভাবে আশা করি তারা (অন্যান্য রাষ্ট্র) পাকিস্তানের উপর (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি আদায়ের জন্য) চাপ সৃষ্টি করবেন।
অমর বাঙালি
শ্রী চিত্তরঞ্জন খাঁড়া
বাঙালি মরেনা কোন দুর্যোগে অমরের সন্তান
দুখানা অস্থির যদি পড়ে থাকে আবার জাগিবে প্রাণ।
দুর্বল নয় বাঙালিরা আর
বজ্র সমান দধীচির হাড়
স্বর্গমর্ত করি তোলপাড় চালায়েছে অভিযান
বাঙ্গালী মরেনা কোন দুর্যোগে অমরের সন্তান।
সাড়ে সাত কোটি বাংলার সোনা দাঁড়িয়েছে তুলি শির
তাহারে বধিবে পৃথিবীর বুকে আছে কিরে হেন বীর?
এইতো সেদিন কেই বা জানে না
লড়েছিল কত ইংরেজ সেনা
মুখে উঠেছিল মরনের ফেনা এমনিই সে পালোয়ান
বাঙালি মরেনা কোনো দুর্যোগ অমরের সন্তান।
যুগে যুগে এই বাংলার বুকে উঠেছে কত ঝড়
শাসনে শোষণ-পীড়নের ভেঙেছে এদের ঘর
দস্যুদলের কত ছলা-কলা
লিখিয়া সেসব যায় কিগো বলা
সহিব না আর পদতল লাঞ্ছনা অপমান
বাঙালি মরেনা কোন দুর্যোগে অমরের সন্তান।
ইয়াহিয়া, আজ বাংলার বুকে এসেছে নতুন দস্যু বেসে
ড্রাগনের মতো বিষ ঝরিতেছে তোমাদের নিঃশ্বাসে
মাইন পাতিয়া রোশেনারা বোন
পলকে করিল দস্যু নিধন
পথে-প্রান্তরে মরেছে এখন তোমার পাকিস্তান
বাঙালি মরেনা কোনো দুর্যোগে অমরের সন্তান।
ইয়াহিয়া! তুমি ডাকিয়া আনিল ইরান-ইরাক চীন
অস্ত্র যোগান দিয়েছে তোমায় দুশমন মার্কিন
টুকরো টুকরো হয়েছে এবার
পাকিস্তানি হারেম তোমার
বাঙালির হাতে নাহি নিস্তার শুনে রাখ শয়তান
বাঙালি মরে না কোন দুর্যোগে অমরের সন্তান।
জল্লাদ! আজ বসিয়াছো তুমি মৃত্যুর সিংহাসনে
এখনি চূর্ণ হইবে আসুন বিরাট বিস্ফোরণে
মৃত্যু কামনা করি নাকো
বাংলা স্বাধীন হলো নিশ্চয়
আমরা বাঙালি আর কিছু নয় হিন্দু মুসলমান
আমরা মরিনা কোন দুর্যোগে অমরের সন্তান।
ইতিহাসের দৃষ্টিভঙ্গিতে খুনি নুরুল আমিন
শেখ আবু হামেদ
কসাই ইয়াহিয়া খান নুরুল আমিনকে প্রধানমন্ত্রী করে পিনডিতে একটি সরকার প্রতিষ্ঠা করার পরিকল্পনা নিয়েছিল। আর পাকিস্তানের সাতটি পাঞ্জাবিতে রাজনৈতিক দল খুনি নুরুল আমিনকে তাদের দলের পার্লামেন্টারি পার্টির নেতা নির্বাচন করেছিল। বাংলাদেশ শ্মশান থেকে মহাশ্মশান হোক তবু খুনি নুরুল আমিন প্রধানমন্ত্রী হবেন। বড় খায়েস ছিলো নুরুল আমিনের কিন্তু তার সেই খোয়াব ভেঙে গেছে।
অষ্টাদশ শতাব্দীর বাংলার ইতিহাসের একটি বিশেষ পাতাকে মেলে ধরল সংবাদটি আমার চোখের সামনে। ১৭৫৬ সাল। একদিকে স্বাধীনতা রক্ষার অগ্নি মন্ত্রে দীক্ষিত যৌবন ও তারুণ্যের মূর্ত প্রতীক নতুন নবাব সিরাজউদ্দৌলা যখন উদ্যত ও বাংলার বুকে সাম্রাজ্য স্থাপনের স্বপ্নে বিভোর ইংরেজ বেনিয়াদের অভিযানে চূড়ান্ত বিজয়ের প্রাক্কালে পলাশীর যুদ্ধে লিপ্ত তখন তার প্রধান সেনাপতি ও আত্মীয় মীর জাফর আলী খান নবাব কে পরাজিত করে নিজের নবাব হবার ষড়যন্ত্রে ইংরেজ প্রতিনিধি উচ্চাকাঙ্ক্ষী ক্লাইভ ও ওয়াটসনদের সাথে গোপনে বৈঠকে ব্যস্ত।
বিংশ শতাব্দীর স্বাধীন বাংলার মুক্তিসেনারা যখন সাম্রাজ্য লুলুপ বিদেশি পাকিস্তানি সেনাদের পরাভূত করে অঞ্চলের পর অঞ্চল দখল করে চলেছে আর মুখোমুখি হচ্ছে চূড়ান্ত বিজয়ের সেই মুহূর্তে ও বিংশ শতাব্দীর বাংলার মীরজাফর নুরুল আমিন “বেইনসাফাবাদে” (বাংলা সকল সম্পদ হরণ করে নিয়ে নির্মিত রাজধানী ইসলামাবাদকে তাই বলা উচিত) বিংশ শতাব্দীর উপনিবেশবাদী বিদেশী বেনিয়াদের প্রতিনিধি জল্লাদ ইয়াহিয়া কাইয়ুম ও নজরুলের সাথে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীত্বের লোভে আলোচনা বৈঠকে ব্যস্ত ও বাংলার স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল।
বাংলার ইতিহাসের পরবর্তী পৃষ্ঠায় আমার চোখের সামনে ভেসে উঠলো। সে পাতায় লেখা আছে পলাশীর যুদ্ধের পর ক্লাইভ বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হওয়ায় মর্মাহত ও স্বাধীনতাকামী তখনকার অভিজাত শ্রেণী কে ধ্বংস করে ব্রিটিশ শাসন কে
অভিনন্দন
কার ও স্বার্থ লুণ্ঠনকারী নিম্ন বংশোদ্ভূত চাটুকার শ্রেণীর লোকদের দিয়ে নতুন আভিজাত্যের পত্তন করেন। ব্রিটিশ ও চাটুকারদের কারসাজিতে তদানীন্তন অভিজাতরা কেবল আর্থিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়েই বঞ্চিত হলো না তারা তাদের অনেক উপাধি ও হারালো। বাংলার ইতিহাসের এই পাতাটি পড়েছিলাম আরেকবার বিগত নির্বাচনের প্রাক্কালে। নুরুল আমিন তাঁর জন্মস্থান শাহবাজপুরে (কুমিল্লা জেলার সরাইল থানার অন্তর্গত) এসেছিলেন। তিনি চলে যাওয়ার পর এক সন্ধ্যায় রাস্তার উপর একটা বকধার্মিক বদমায়েশ (নুরুল আমিনের পাড়া-প্রতিবেশী অথবা আত্মীয় হবে) নুরুল আমিন ও শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে তুলনা করতে গিয়ে শেখ সাহেবের বংশের উপর কটাক্ষ করে বুঝাতে চাইলো যে শেখ মুজিবুর রহমান অনভিজাত ঘরের সন্তান ও নুরুল আমিন অভিজাত শ্রেণীর সন্তান। ইতিহাস পড়ে পড়ে মন অনুসন্ধিৎসু হয়েছে সে লোভ থেকেই বংশ তালিকা নিয়ে আমি আবিষ্কার করলাম যে নুরুল আমিন পলাশী যুদ্ধের সময়কার বাংলার স্বার্থবিরোধী দালালদের বংশোদ্ভূত সেই চাটুকারদের দ্বারা গঠিত নতুন অভিজাত শ্রেণীর একজন। তার রক্তে দালালির রক্ত মিশে আছে। আমার মনে হয় দালালদের ইতিহাস আবিষ্কারে রত হলে এমন সুন্দর তথ্য পাওয়া যাবে যে আজ যারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাহেবের নেতৃত্বে স্বাধীন ও শোষণমুক্ত করার সংগ্রাম এর বিরোধিতা করছে অথবা সংগ্রামে নির্লিপ্ত রয়েছে তাঁদের অধিকাংশই ওই কমজাতদের সন্তান। ব্রিটিশ এর বদৌলতে অভিজাত হয়েছিল তারা। আর এ তথ্য ইতিমধ্যে কিছুটা আবিষ্কৃত হয়ে গেছে ও আর ও প্রযুক্তি পরিস্ফুট ভাবে আবিষ্কৃত হবে যে শেখ মুজিবুর রহমান ও তার অনুগামী অধিকাংশ দেশেই পলাশীর যুদ্ধের সময়কার স্বাধীনতা সংগ্রামীদের রক্ত প্রবাহিত আর তারা পলাশীর যুদ্ধের সময়কার সংগ্রামী শ্রেণীর অন্তর্গত। ইতিহাসটা এমন ভাবে গঠিত হওয়ায় মনে আরেকটি আশা জাগে যে দেশ যখন স্বাধীন হয়েছে বাংলার ইতিহাস আবার নতুন করে লিখতে হবে।
বিংশ শতাব্দীর বাংলার ইতিহাস অন্যভাবেই লিখিত হবে। বিংশ শতাব্দীর মীর জাফর আলী খান ও তার মত কমজাতদের জেনে রাখা উচিত যে ইহা অষ্টাদশ শতাব্দী না, উহা ১৭৫৭ সাল না, ইহা ১৯৭১ সাল। অষ্টাদশ শতাব্দীর পলাশীর আম্রকাননে মীর জাফর আলী খান দেশদ্রোহীতায় স্বাধীন নবাব পরাজিত হয়েছিল, কিন্তু বিংশ শতাব্দীর বেইনসাফাবাদে নুরুল আমিনের দেশদ্রোহিতা সত্ত্বেও আজ কারান্তরালে থেকেও এ সংগ্রামে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জয়ী হয়েছেন।
অষ্টাদশ শতাব্দীর পলাশীর যুদ্ধের পর পরাজিত ভাগ্যবিড়ম্বিত নবাবকে মীরজাফর আলী খানের পুত্র মীরনের আদেশে আততায়ী মোহাম্মদী বেগ হত্যা করেছিল। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর বাংলার মীরজাফরদেরকেই হত্যা করে চলেছে স্বাধীনতা সংগ্রামীরা। গেছে মোনেম খান সুলতান উদ্দিন ফকাতন ও আরো অনেকে। যাবে আরো। হুশিয়ার মীরজাফর নুরুল আমিন।
ইতিহাসের ডাক এসেছে। নতুন দিনের নতুন সূর্য উদীয়মান। হাতছানি দিয়ে ডাকছে। হুশিয়ার বিংশ শতাব্দীর মীরজাফররা। সোনার বাংলা গঠনের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়েছে।
সিংহলে পাক দালাল
ত্রিদিব রায়ের মিশন ব্যর্থ
(বিলম্বে প্রাপ্ত)
চট্টগ্রামের চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় গত ২৯শে নভেম্বর কলম্বোতে সিংহলের সাংবাদিকদের প্রশ্নবানে নাস্তানাবুদ হয়ে শেষ পর্যন্ত কবুল করেছেন যে পূর্ববঙ্গে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দেওয়া দরকার।
নারীঘাতী, শিশু ঘাতী ইয়াহিয়ার বিশেষ দূত হিসেবে গত ২৫শে নভেম্বর রাজা ত্রিদিব রায় সিংহলে যান। তার উদ্দেশ্য ছিল শাক্যবংশ গৌরবের সুযোগ নিয়ে ইয়াহিয়ার অধিবাসীদের কাছে ওকালতি করা। কিন্তু চারদিন ব্যার্থ চেষ্টা করে বিফল মনোরথ হয়ে রাজা বাহাদুর ২৯শে নভেম্বর ব্যাংককের পথে পাড়ি জমিয়েছেন।
রাজা বাহাদুরের প্রচেষ্টা যে কিভাবে ব্যর্থ হয়েছে তারা টাইমস উইক এলডারএর রাজনৈতিক ভাষ্যকার কয়েকটি কথায় চমৎকার ভাবে প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন একটা ত্রিদিব রায় তো দূরের কথা শতশত ত্রিদিব রায় সিংহল বাসীদের ইয়াহিয়ার অনুকূলে নিয়ে যেতে পারবেনা। ইয়াহিয়ার এই প্রয়াস অনেকটা দালাইলামাকে তিব্বতে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার জন্য চৌ এন লাই এর কাছে দরবার করার মতোই হাস্যকর। পূর্ববঙ্গের জঙ্গিশাহীর নির্মম অত্যাচারে সিংহলের অধিবাসীদের তীব্র ক্ষোভ আন্দাজ করতে পেরে সিংহল সরকার ত্রিদিব রায়কে তেমন আদর আপ্যায়ন করতে তেমন ভরসা পাননি। সিংহল বেতারের রাজা বাহাদুর এর শহর ও মোলাকাতের কথা ও প্রচার করা হয়নি এমনকি প্রধানমন্ত্রী শ্রীমাভো বন্দরনায়েক এর সঙ্গে ত্রিদিব রায়ের সাক্ষাতের কথাও বেতার থেকে চেপে যাওয়া হয়। ত্রিদিব রায় সিংহলের বৌদ্ধ নেতাদের সঙ্গে আলাপ করেও সুবিধা পাননি।
কিন্তু মহারাজার দালালীর চাকুরীটা টেকে কিনা সন্দেহ। সিংহলের সাংবাদিকদের প্রশ্নবানে জর্জরিত রাজা বাহাদুর ত্রিদিব রায় চোখের পানিতে নাকের পানি তে বড় বেসামাল কথা বলে ফেলেছেন। রাজা বাহাদুর স্বীকার করেছেন যে পূর্ববঙ্গে অস্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছিল। শুধু তাই নয় তিনি আরও কবুল করেছেন পূর্ববঙ্গের স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার উপযুক্ত পথ হলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দেয়া।
শাফি ট্যাংক
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ট্যাংক প্রথম ব্যবহার হয়। প্রথম ট্যাংক তৈরি হয় বিলাতে ও তা ব্যবহৃত হয় ফ্রান্সের রণক্ষেত্রে জার্মানির বিপক্ষে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ট্রাংক স্থল যুদ্ধে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অভিনয় করে। ট্যাংক আধুনিক স্থল যুদ্ধের বিশেষ সহায়।
পাকবাহিনীর বহু শাফি খোয়া গিয়েছে বর্তমান যুদ্ধে। শাফি ট্যাংক আমেরিকার তৈরি। এই ট্যাংক আমেরিকা প্রথম ব্যবহার করে কোরিয়ার যুদ্ধে। শাফি ট্যাংক মাঝারি ধরনের ট্যাংক। শাফি ট্যাংকের ওজন হচ্ছে ১৮টন। এতে থাকে ৭৫ মিলিমিটার কামান।
করাচি থেকে জাহাজে করে সিংহল দূরে ৩ হাজার মাইল দূর থেকে জাহাজে করে বাংলাদেশের ট্যাংক আনা পাক ফৌজ এর পক্ষে সহজ নয়। ট্রাঙ্ক ডায়েল হওয়া তাই তার সামরিক শক্তির পক্ষে মারাত্মক ক্ষতি।
বাংলাদেশের খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির উপায়
ডাক্তার ইবনে গোলাম সামাদ
(উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়)
যুদ্ধের দিন শেষ। ধ্বংসস্তূপের মধ্য থেকে গড়ে তুলতে হয় নতুন জীবন নতুন সভ্যতা। মানুষ যুদ্ধ চায় না। চায় শান্তি। তবু যুদ্ধ দ্রুত চলে আসছে। মানব অস্তিত্বের আদিকাল থেকে আমরা যুদ্ধ চাইনি। যুদ্ধ চেপে বসেছিল আমাদের উপর। আট মাস বাইশদিন পরে বাংলাদেশের সর্বত্র দখলদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে। যুদ্ধের শেষ। এখন যা দরকার তা হলো বিভিন্ন পরিকল্পনা নিয়ে দেশ গঠনের কাজে আত্মনিয়োগ করা।
বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম জনবহুল দেশ। এখানে প্রতি বর্গমাইলে জনসংখ্যা ৯০০ জনের উপরে। জনসংখ্যার চাপ বাংলাদেশে খুব বেশি। আমাদের প্রধান সমস্যা এই বিরাট জনসংখ্যার স্বাচ্ছন্দ বিধান।
বাংলাদেশের মোট আয়তন ৩৫.৩ মিলিয়ন একর। এর মধ্যে আবাদি জমির পরিমাণ হল ২২.৫ মিলিয়ন একক। এর মধ্যে একাধিকবার ফসল উৎপাদন জমির পরিমাণ হল তিন মিলিয়ন একর। মোট আবাদি জমির পরিমাণ একাধিকবার ফসল উৎপাদনের পরিমাণ যোগ করে মোট ফসলী জমির পরিমাণ দাঁড়ায় ৩৮.৮ মিলিয়ন একর।
একটা দেশের কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করা যায় দু’ভাবে:
এক. আবার যোগও অনাবাদি জমি আবাদ করে এবং
দুই. যে জমিতে বর্তমানে ফসল উৎপাদন করা হয় তাদের ফসল উৎপাদনের পরিমাণ বাড়ানো।
যে বাংলাদেশের এখন আবাদ করা হয়না কিন্তু কলের লাঙ্গল এর সাহায্যে কর্ষণ করে ফসল ফলানো উপযোগী করে তোলা যায় এমন জমির পরিমাণ হলো এক মিলিয়ন একর এর কিছু বেশি। এই জমিতে চাষ করে চাষের মোট জমির আয়তন বৃদ্ধি করা চলে। তবে এদারা ফসল উৎপাদনের পরিমাণ অন্যান্য দেশের মতো বৃদ্ধি করা যাবে না।
অন্যান্য উন্নয়নকামী দেশের কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে দেখা যায় গত কয়েক বছরে তাদের ফসল বৃদ্ধির মূল কারণ অনাবাদি জমিতে আবাদ করে ফসল উৎপাদন। যেহেতু বাংলাদেশে কর্ষণোপযোগী পতিত জমির পরিমাণ বেশি নয় তাই বাংলাদেশের ফসল উৎপাদন বৃদ্ধির প্রধান উপায় হিসেবে গ্রহণ করতে হবে বর্তমানে আবাদি জমিতে উন্নত কৃষি পদ্ধতির প্রয়োগ। ফলে বর্তমান আবাদি জমিতে অধিক ফসল উৎপাদন করা সম্ভব হবে।
বাংলাদেশের খাদ্যশস্যের ফসল মাত্রা খুবই কম । যেখানে বাংলাদেশ ধানের গড়পড়তা ফসল একরপ্রতি ৯০০-১০০০ পাউন্ডের মতো সেখানে জাপানে একরপ্রতি ফসলের মাত্র ২০০০ পাউন্ড এর উপর। আমাদের দেশে ধানের ফসল মাত্রা কম এর একটি কারণ জমিতে প্রযুক্তি প্রয়োগের অভাব। বাংলাদেশের জমিতে একর প্রতি ৪০ পাউন্ড নাইট্রোজেন ঘটিত সার প্রয়োগ করে দেখা গিয়েছে যে এর ফলে আউশ ধানের উৎপাদন শতকরা ৩৭ ভাগ আমন ধানের উৎপাদন শতকরা ৪০ ভাগ ও বোরো ধানের উৎপাদন শতকরা ৪৬ বাড়ানো সম্ভব।।
আমাদের দেশের মাটির নিচে যে প্রাকৃতিক গ্যাসের সন্ধান এ পর্যন্ত পাওয়া গেছে তার পরিমাণ হল ৯.৩৪ মিলিয়ন মিলিয়ন কিউবিক ফুট (এমএমসি ইউ এফ টি)। গ্যাসের সঙ্গে বাতাসের নাইট্রোজেন যুক্ত করে নাইট্রোজেনঘটিত সার আমাদের প্রয়োজন অনুসারে যথেষ্ট উৎপন্ন করা সম্ভব।
বাংলাদেশের আবাদি জমির কম করে শতকরা ৬০ ভাগ শীতকালে পতিত থাকে। কারণ, শীতকালে আমাদের দেশে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ খুব কম। উপযুক্ত জল সেচের ব্যবস্থা করে, শীতকালে রবি শস্য চাষ বাড়িয়ে, আমাদের দেশের খাদ্য সমস্যাবহুল ভাবে সমাধান করা সম্ভব। পাকিস্তানি আমলের সরকারি হিসাব থেকে দেখা যায় বাংলাদেশ ১.৫ মিলিয়ন একর জমিতে জল সেচের ব্যবস্থা আছে। এই জমির পরিমাণ হল মোট আবাদী জমির শতকরা পাঁচ ভাগ মাত্র। তাই কে বলছিস ব্যবস্থা প্রসার ঘটিয়ে বাংলাদেশের খাদ্যের ঘাটতি পূরণ করা চলে।
বাংলাদেশের এক বিরাট সমস্যা হল বন্যা বন্যার পানি প্রতিবছর যথেষ্ট পরিমাণে বহন করে এনে বাংলার মাটিকে উর্বর করে। কিন্তু বলোনা আবার বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ফসলের ক্ষতির কারণ। মাঝারি রকমের বন্যার ফলে বাংলাদেশের প্রায় নয় মিলিয়ন একর জমি জলমগ্ন হয়। ১৯৫৭ সাল থেকে বন্যা নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে যেসব অনুসন্ধান হয়েছে তা থেকে দেখা যায় ভারতের সহযোগিতা ছাড়া বাংলাদেশের বন্যা নিয়ন্ত্রণের স্থায়ী প্রকল্প গ্রহণ করা সম্ভব নয়। এতদিন পাকিস্তানি রাজনীতির জন্য বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে সহযোগিতা সম্ভব হয়নি। কিন্তু বর্তমানে এই অসুবিধা আর থাকছে না।
বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম জনবহুল দেশ। কিন্তু বাংলাদেশের মাটি থেকে বাংলাদেশের মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য উৎপাদন মোটেই অসম্ভব নয়।
জাপানি পত্রিকার অভিমত
ইয়াহিয়া মুক্তিবাহিনীকে ভারতীয় সৈন্য বলে প্রচার করেছিল
(বিলম্বে প্রাপ্ত)
জাপানের প্রতিটি বহুল প্রচারিত জাতীয় দৈনিক বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের প্রতীক সর্বাত্মক সমর্থন ঘোষণা করে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সামরিক সংঘাত বন্ধ করার জন্য প্রচেষ্টারত শক্তিগুলিকে বর্তমান ভয়াবহ পরিস্থিতি উদ্ভবের প্রধান কারণগুলি সম্পর্কে অনুসন্ধান করার উপদেশ দিয়েছেন।
জাপানের প্রভাবশালী জাতীয় দৈনিক ইয়ুমিউরি সিমবুন এক নিবন্ধে বলেছেন, বিগত কয়েক মাসে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর এমন দূর্জয় এবং বিরাট আকার নিয়েছে যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বাইশ এবং তেইশে নভেম্বরে আক্রমণ দেখে তাকে ভারতীয় বাহিনীর আক্রমণে ভুল করেছে। আড়াই কোটি জাপানি নাগরিক এই পত্রিকাটি পড়ে থাকেন।
এই পত্রিকা পাকিস্তানি প্রেসিডেন্টকে নির্যাতনের বর্ণনা বাংলাদেশের কন্ঠ স্তব্ধ করার ভ্রান্তনীতি স্বীকার করে নেওয়ার জন্য তার প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
অপর একটি জাতীয় দৈনিক মইনিচি সিমবুন বলেন যে, মার্চ মাসে বাঙ্গালীদের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে রক্তের বন্যায় ডুবিয়ে দিতে যাওয়ার পরেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সূত্রপাত হয়েছে এবং দুর্জয় মুক্তিবাহিনীর জন্ম হয়েছে।
সংবাদদাতা লিখেছেন আমরা ধ্বংসপ্রাপ্ত অপর একটি গ্রামে যাই এবং অদূরবর্তী তৃতীয় আরেকটি গ্রাম পরিদর্শন করি; গ্রামবাসীরা বলেন যে আরও এগিয়ে গেলে আরো এমনই ধ্বংসপ্রাপ্ত গ্রাম দেখতে পারেন।” কিন্তু আরও গ্রাম দেখার মত সময় আমার হাতে ছিল না।
মইনিচি বলেছেন,” পূর্ববাংলায় বর্তমান অবস্থা বিয়েত নামের প্রাথমিক অবস্থায় মত বলে আমরা জানতে পেরেছি।”
আসাহি শিম্বুন এক সম্পাদকীয় নিবন্ধের বলেছেন, যে বৃহৎ শক্তিবর্গের বর্তমান সংকটের কারণের প্রতি চোখ বন্ধ করে রাখার কোনো যুক্তি নেই।
ভারতীয় সৈন্যরা বাইশে এবং তেইশে নভেম্বরে পূর্ব পাকিস্তান আক্রমণ করেছে বলে পাকিস্তানের দাবিকে জাপানি সংবাদপত্রগুলি হাস্যাস্পদ বলে বর্ণনা করেছেন।
ইয়ুমিউরি সিম্পল লিখেছেন হাস্যাস্পদ পাকিস্তানি অভিযোগ থেকেই প্রমাণিত হয় যে, বাঙালি জাতির প্রতিরোধ সংগ্রাম দূর্জয় এবং দুর্বার হয়ে উঠেছে। ইয়াহিয়া তাকেই ভারতীয় আক্রমণ বলে ভুল করছে। এই পর্যায়ে আমরা আজ এটুকুই বলতে পারি যে, বাঙালিদেরকে রুখতে পাকিস্তানি সৈন্য বাহিনী ব্যর্থ হয়েছে। পাকিস্তানি নেতাদের তা স্বীকার করে নেওয়ার সময় এসেছে।
কিন্তু তারা যদিও ভুল স্বীকার না করে এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আক্রমণকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাজ বলে গলাবাজি করে তার সৈন্যবাহিনীকে সমাবেশ করে তাহলে স্বাভাবিক পরিণতি হিসেবে ভারতকেও তার সৈন্য বাহিনী সীমান্তে রাখতে হবে।”
পত্রিকাটি সর্বশেষে লিখেছেন, বাংলাদেশের সাথে রাজনৈতিক সমঝোতায় এসে ইয়াহিয়ার কোন উপায় নেই। এই সমাধানের জন্য আমেরিকা চীন এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের চেষ্টা চালানো উচিত।
সিমবুনের সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, বিগত নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণ যে রায় দিয়েছে তার ভিত্তিতেই সমাধানের জন্য এগোতে হবে।
আসাহি শিম্বুন সম্পাদকীয়তে লিখেছেন যে, ভারত পাকিস্তান সামরিক সংঘাতের সমাধানের পথ বের করতে হলে সমস্যা সৃষ্টির মূল কারণ সম্পর্কে অনুসন্ধান চালাতে হবে।
জাপানি দৈনিক অভিযোগ করেন যে, বৃহৎ শক্তিগুলো শরণার্থীদের সম্মানের সাথে তাদের মাতৃভূমিতে ফিরে নেওয়া এবং বাংলাদেশ সংগ্রামের প্রতীক চোখ বন্ধ করে রেখেছেন। কারণ হিসেবে বলেছেন, এসব পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। কিন্তু আমরা মনে করি এ দুটি কারণ এর প্রতি যথাযথ দৃষ্টি না দিয়ে সমস্যার প্রকৃত সমাধান সম্ভব নয়।
পত্রিকার সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে যে, মানবিক অধিকারের সাথে সম্পর্কিত সমস্যা কারো ঘরোয়া ব্যাপারে হস্তক্ষেপ এর সমস্যার চাইতে অনেক ঊর্ধ্বে। যেসব দেশ বাংলাদেশে সংকট সমাধানের জন্য চেষ্টা চালাবেন তাদের উচিত হবে সংকটের গভীরে গিয়ে সে আলোকে সমাধানের চেষ্টা করা।
সম্পাদকীয়তে আরো বলা হয়েছে, পাকিস্তান দুটি কারণে ভারতীয় সৈন্যদের তার দেশ আক্রমণের ধুঁয়া তুলেছে। এজাতি অভিযোগ দায়ের করে পাকিস্তান সরকারের সৈন্যবাহিনীকে দিয়ে বাঙালি নিধনযজ্ঞের ঘটনা এবং অন্যদিকে নৃশংস সামরিক অভিযানের ফলে যে এক কোটি বাঙালি শরণার্থী হয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে সে সত্য বিশ্ববাসীর কাছে চাপা দিয়ে রাখতে চাইছে।
স্বাধীনতার পর জাতিগঠনের গুরুদায়িত্ব
ডলিনাথ
৬ই ডিসেম্বর সোমবার বেলা এগারোটা (১৯৭১ সাল) আমাদের জীবনে তথা বাংলাদেশের জীবনে এক স্মরণীয় ও বরণীয় মুহূর্ত। যে শুভ মুহূর্তে ভারত সরকার শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের স্থান দিলেন। সর্বপ্রথম আমরা ভারত সরকারের কাছে স্বীকৃতি পেলাম এবং এই স্বীকৃতিই আমাদের গৌরবের সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণ করতে সহায়তা করবে।
৭ই মার্চ (১৯৭১ সাল) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা পল্টন ময়দানে এক অগ্নিগর্ভ বক্তৃতা দিয়েছিলেন। সে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বাংলার শহরে-নগরে, আকাশে-বাতাসে বাংলার ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়েছিল। ২৩শে মার্চ স্বাধীন বাংলার পতাকা সোনালী সূর্যের মতো ঝিকঝিক করে উঠলো। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্বাধীন পতাকা পশ্চিমা গোষ্ঠীর ছিনিয়ে নিতে চাইল। চালালো অত্যাচার-নিপীড়ন। সে অত্যাচার ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। সে অত্যাচার হিটলার, নাদির শাহ, চেঙ্গিস খাঁ এর চেয়েও যথেষ্ট নির্মম-নিষ্ঠুর জঘন্য। আমরা বাঙালিরা চুপচাপ মুখ বুজে ওদের কথা সইতে চাইলাম না। আমরা প্রতিশোধ নিতে চাইলাম। আর কতদিন? সুদীর্ঘ ২৪ বছর ধরে বাঙালিরা নির্যাতনের নির্যাতিত নিষ্পেষণের জর্জরিত। এবার বাঙালিরাও শুধু রক্ত দিতে চাইল না- রক্ত নিতে ও শিখলো। তাই আরম্ভ হলো সশস্ত্র আন্দোলন আর মরণপণ সংগ্রাম। এই সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পরলো ছাত্র শিক্ষক বুদ্ধিজীবী কৃষক শ্রমিক মজুর। পুরুষের সাথে হাত মিলিয়ে বাংলা নারী সমাজ ও ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সশস্ত্র সংগ্রামে।
বাংলা মায়ের দামাল ছেলেরা চরম ধৈর্য ত্যাগ-তিতিক্ষার মধ্য দিয়ে অসীম সাহসিকতার সাথে যে মুক্তির সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে তাতে বিশ্বের কোন শক্তি এদের অভিমানকে রোধ করতে পারেনি, পারবেও না। এরা বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অনুপ্রাণিত। বিশ্বের ইতিহাসে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর বিজয়গাথা স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। মুক্তিবাহিনীকে শত প্রণাম, শত সালাম। আমাদের মুক্তিবাহিনীর প্রথমে বলতে গেলে খালি হাতেই নেমেছিল সংগ্রামে, বাংলার স্বাধীনতা রক্ষায়। ১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্ত গিয়েছিল, বাংলাদেশ ব্রিটিশের কবলে পড়েছিল। প্রায় ২০০ বছর পরে ১৯৪৭ সালে আমরা নামেমাত্র স্বাধীনতা পেয়েছিলাম। সেই স্বাধীনতার মূল্যেও ছিল বাঙালির রক্ত, বাংলার তাজা ছেলের আত্ম বলিদান। কিন্তু সেদিনকার সেই স্বাধীনতা আমরা পরিপূর্ণরূপে ভোগ করতে পারিনি। আমাদের স্বাধীনতার সূর্য উঠেছিল ঠিকই, কিন্তু সেই সূর্য দ্বিখণ্ডিত হয়ে। দুই বাংলা সম্পূর্ণ দুই রূপেই দুই মূর্তি নিয়ে। বাঙালির মনকে ভেঙে চুরমার করে বাঙালির মনের বৃষ্টিকে বাঙালির মনে ভাইয়ে ভাইয়ে বিদ্বেষ সৃষ্টি করে।
যে শুভ মুহূর্তে আমরা হিন্দু মুসলমান এক হয়েছি, হাতে হাত মিলিয়ে সংগ্রাম করে চলেছি, সেই মিলিত সংগ্রাম আমাদের চূড়ান্ত বিজয়ের পথে নিয়ে যাচ্ছে, পশ্চিমা গোষ্ঠী আমাদের মধ্যে বিদ্বেষ ঢুকিয়ে- আমাদের মধ্যে ভাঙ্গন ধরিয়ে ভেবেছিল বাঙালি হিন্দু ও মুসলমান এই দুইটি সম্প্রদায়কে পৃথক করতে পারলে এদের শক্তি ভেঙে যাবে। আর তার ফলে পশ্চিমা গোষ্ঠী নিরাপদে শোষণ করে শাসন চালিয়ে যেতে পারবে বছরের পর বছর ধরে। কিন্তু না -তা আর হলোনা। কালের চাকা ঘুরে গেল। বাঙালি হিন্দু মুসলমান একযোগে নামল সংগ্রামে। এগিয়ে চললো চূড়ান্ত বিজয়ের পথে।
আজ আমরা যে স্বাধীনতা পেয়েছি-সেই স্বাধীনতা আমাদের ধারে সহজে আসেনি। কত মায়ের বুক ফাটা ক্রন্দনের বিনিময় ক্রীত এই স্বাধীনতা, কত বধুর সিঁথির বিনিময়ে ক্রীত এই স্বাধীনতা, কত ভগ্নির দীর্ঘ নিশ্বাস এর বিনিময়ে ক্রীত এই স্বাধীনতা, কত রক্তের বিনিময়ে ক্রীত এই স্বাধীনতা। সেই মহামূল্যবান স্বাধীনতা আজ আমাদের দ্বারে আগত। এখন আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি তাই আমাদের কর্তব্য পালনে অগ্রনী হতে হবে। যেমন করে শত ত্যাগ-তিতিক্ষার মধ্য দিয়ে আমাদের স্বাধীনতা আমরা এনেছি ঠিক তেমনি করেই আমাদের কর্তব্য ও জাতি গঠনে তৎপর হতে হবে। দেশকে নূতন করে গড়ে তুলতে হবে।
আমাদের দেশ কৃষিপ্রধান তাই আমাদের প্রথম ও প্রধান কাজ কৃষির উপর নজর দেওয়া। বাংলাদেশের শতকরা ৭৫ ভাগ জমিতে ফসল ফলে। এই দেশের শতকরা ২০ ভাগ আবাদি জমির ফসল ফলে। কোন কোন ক্ষেত্রে তিন বার ও ফসল ফলে। বাংলাদেশের প্রধান অর্থকরী ফসল পাট। বিশ্বের শতকরা ৮০ ভাগ উন্নত ধরনের পাট উৎপন্ন হয় এখানে। প্রতিবছর গড়পড়তায় বাংলাদেশের প্রায় দশ লক্ষ টন পাট উৎপন্ন হয়। পাট রপ্তানি করে ১৯৬৭-৬৮ সালে বিদেশ থেকে আয় হয়েছিল প্রায় ১৩৯ কোটি টাকা। পাটের পরেই প্রধান অর্থকরী ফসল হিসেবে উল্লেখ করতে হয় চায়ের কথা। ১৯৬৮-৬৯ সালের হিসাব থেকে দেখা যায় বাংলাদেশের উৎপাদিত সারের পরিমাণ ছিল প্রায় ২৯০০০ টন, এই উপাদানটি আরও বৃদ্ধি করা যায়। বাংলাদেশে প্রতিবছর পাট, চা, চামড়া ও অন্যান্য দ্রব্য বিদেশে রপ্তানি করে ২২৫ কোটি টাকার উপর। এই টাকা কেবলমাত্র স্বাধীন বাংলাদেশের প্রয়োজনেই ব্যয় করা যাবে। এখন আমাদের চাষীদের উপর যথেষ্ট নজর দিতে হবে। তাদের উন্নত ধরনের বীজ সরবরাহ করতে হবে, ব্যাংক থেকে চাষীদের যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ ধার দিতে হবে। তাদের উন্নত ধরনের ট্রাক্টর যোগান দিতে হবে, যেসব জমিতে ট্রাক্টর চালানো সম্ভব নয় সেসব জমির কৃষককে ভালো গরুর ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের ব্যাংক থেকে যতদূর সম্ভব সাহায্য করতে হবে। কৃষকেই জাতির মেরুদন্ড একথা আমাদের ভুললে চলবেনা।
কেবলমাত্র কৃষির উপর লক্ষ্য রাখলেই চলবে না। আমাদের শিল্পের দিকেও যথেষ্ট লক্ষ্য রাখতে হবে। বাংলাদেশে কল কারখানা গড়ে তুলবার প্রচুর সম্ভাবনা আছে। আমাদের দেশে গত ২৩ থেকে ২৪ বছরে যে পরিমাণ কল কারখানা গড়ে উঠেছিল প্রয়োজনের তুলনায় তা মোটেই যথেষ্ট ছিল না। স্বাধীন বাংলাদেশে কল কারখানা গড়ে তুলবার জন্য যে অর্থ লাগবে তা পাওয়া যাবে কৃষিজাত দ্রব্যের রপ্তানি থেকে। আমাদের দেশের কাজকারবার লোকের অভাব নেই। আমাদের দেশের শ্রম সস্তা। শ্রম সংস্থা বলে কম পুঁজিতে এখানে কল কারখানা চালু করা সম্ভব। আমাদের অর্থনীতিতে বর্তমানে অসমের প্রাচুর্য দিয়ে পুঁজির অপ্রাচুর্য কে কমিয়ে নেওয়া যাবে। পরে আয় বৃদ্ধির সাথে সাথে হবে মজুরি বৃদ্ধি। দেখা দেবে আর্থিক স্বচ্ছলতা ও সমৃদ্ধি। বাংলাদেশ বাইরে থেকে তুলা রপ্তানি করে। এখানে বয়ন শিল্পের প্রসার করা চলে। বাংলাদেশের ইংরেজ আমলের দশটি কাপড়ের কল ছিল। কিন্তু পাকিস্তান হবার পর বাংলাদেশের যে হারে কাপড়ের কল হওয়া উচিত ছিল- তা হয়নি। বাংলাদেশের বাজারে তাই পশ্চিম পাকিস্তানের কাপড় বিক্রি হতো। বাংলাদেশের জলবায়ু বস্ত্রশিল্পের উপযোগী। একদিন বাংলাদেশ ছিল বস্ত্রশিল্পে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ দেশ। ঢাকার মসলিন শাড়ি ছিল পৃথিবী বিখ্যাত। ইউরোপীয় বণিকরা বাংলাদেশের প্রতি প্রধানত আকৃষ্ট হয় বাংলাদেশের তৈরি কাপড় বিক্রি করে ব্যবসায় লাভ করার জন্য। ফরাসি পর্যটক বেরনিয়ে সম্রাট আওরঙ্গজেবের সময় বাংলাদেশে আসেন। তিনি তার ভ্রমণকাহিনিতে লিখেছেন বাংলাদেশকে বলা যায় সারা পৃথিবীর বস্ত্রের আরত।
তাছাড়া বাংলাদেশের মাটির নিচে যেসব প্রাকৃতিক সম্পদ আছে -সে সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান যথেষ্ট নয়। আমাদের দেশের ছাত্রদের বিজ্ঞানের প্রতি উৎসাহিত করতে হবে। যাহাতে বাংলাদেশের সমস্ত সম্পর্কে পরিপূর্ণ ভাবে আরো কাজে লাগাতে পারি।
ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে প্রাপ্ত প্রাকৃতিক গ্যাস অনেকদিন পর্যন্ত জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা চলবে, বগুড়া জয়পুরহাট অঞ্চলে কয়লা খনির সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। খুঁজলে বাংলাদেশের মাটির নিচে তেল ও পাওয়া যেতে পারে। সমুদ্রতীরের জোয়ার ভাটার যে শক্তি তৈরি হয় তা থেকে ভবিষ্যতে বৈদ্যুতিক শক্তি উৎপাদন সম্ভব হতে পারে।
এছাড়া বাংলাদেশের নদ নদী থেকে আরও জলবিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব।
যুদ্ধে ক্ষতি হয় সেসব দেশেরই বেশি যাদের অর্থনীতি বিশেষভাবে কল-কারখানার উপর নির্ভরশীল। যুদ্ধশেষে সব দেশের মানুষের মনেই বিশেষ ধরনের নিষ্ঠা ও কর্মোদ্যম পরিলক্ষিত হয়। এই নিষ্ঠা ও উদ্যমের জোরে একটা দেশ যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি অনেক কাটিয়ে উঠতে পারে। গত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি ও জাপানের হয়েছিল ভয়াবহ ক্ষতি। কিন্তু তারা তাদের এই ক্ষয়ক্ষতি কে দ্রুত কাটিয়ে উঠতে পেরেছিল তাদের নিষ্ঠা ও কর্মতৎপরতার ফলে। যুদ্ধ শেষ আমাদের মধ্যেও জাগবে গঠনমূলক কর্মোদ্যম। এখন যেমন আমরা একযোগে লড়ছি। তখনও আমাদের একযোগে লড়তে হবে দেশের আর্থিক পূনর্গঠনের জন্য।
একটা দেশের অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য নির্ভর করে সেই দেশে প্রাকৃতিক সম্পদ, মানুষের কুশলতা ও সামাজিক ব্যবস্থার উপর। আগামী বাংলাদেশের সমাজ সংগঠন গড়ে উঠবে তার অর্থনৈতিক অগ্রগতির প্রয়োজনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ ভাবে।
সর্বোপরি আমাদের মধ্যে মৈত্রী সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে আমাদের মধ্যে বন্ধুত্ব অটুট রাখতে হবে। বিশেষ করে এই সময়ে অর্থাৎ স্বাধীনতা অর্জনের পর পরই আমাদের অর্থাৎ নারী সমাজের যথেষ্ট ভূমিকা আছে। আমাদের ভূমিকা ও আমাদের পরিপূর্ণ ভাবে পালন করতে হবে। নারী শিক্ষার হার বাড়াতে হবে, স্ত্রীশিক্ষা ব্যতীত কোন জাতিই উন্নতি লাভ করতে পারে না। শিশুদের গঠনের মূলে মায়েদের কর্তব্য সবচেয়ে বেশি। শিশু ভবিষ্যতের রাষ্ট্রগঠনের দায়িত্ব হাতে নেবে সেই শিশুকে গঠন মায়েদেরকেই করতে হয়, তাই প্রতিটি মেয়ে যদি উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয় তাহলে প্রতিটি শিশুই ভালো হয়ে গড়ে উঠবে। কিন্তু মা যদি অশিক্ষিতা হয় তাহলে সেই শিশু সহজে ভালো হতে পারে না। আমাদের বাংলাদেশের প্রতিটি মেয়েই যদি উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয় তাহলে দেশ দ্রুত পদক্ষেপে উন্নতির সর্বোচ্চ শিখরে আরোহন করবে। স্বাধীনতার পরপরই স্ত্রী শিক্ষার প্রসার বাড়ালো একটি প্রধান কর্তব্য। তার জন্য গ্রামে গ্রামে মেয়েদের স্কুল গড়ে তুলতে হবে আর কলেজের সংখ্যা বাড়াতে হবে। এখনও বাংলাদেশের বহু অঞ্চলে বাল্য বিবাহ প্রচলন আছে, এগুলো দূর করতে হবে। সরকারের আইন থাকবে ১৬ বছরের আগে কোন মেয়েকেই বিয়ে দেওয়া চলবে না। গরীব মেয়েদের যথেষ্ট সহযোগিতা হবে, অর্থের অভাবে তাদের শিক্ষা জানা বাধাপ্রাপ্ত না হয়।
সর্বশেষে আমি বলতে চাই আমাদের প্রত্যেককে জাতি গঠনে তথা দেশ গঠনে তৎপর হতে হবে। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করতে হবে। তবেই দেশের মঙ্গল তবে দেশের উন্নতি।
বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত হওয়ার আগে –
একটি গণহত্যার কাহিনী
পাকবাহিনী সেনাবাহিনীর ঢাকাসহ কতিপয় গ্রাম নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে এবং ৩০০ গ্রামবাসীকে হত্যা করেছে। মুক্তিবাহিনীর কমান্ডোদের তৎপরতা প্রতিহত করার জন্য শহরের চারিদিকে গভীর প্রতিরক্ষা ঘাঁটি স্থাপন করার জন্য ই শহর সন্নিহিত গ্রামগুলো নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে।
মৃত্যুর থাবা থেকে বেঁচে যাওয়া গ্রামবাসীরা সেই বীভৎস আক্রমণের বর্ণনা দিয়েছেন। গত সোমবার ২৯শে নভেম্বর শহরের উত্তর দিক থেকে এসে পাক সেনারা নিরীহ-নিরস্ত্র গ্রামবাসীর ওপর আক্রমণ পরিচালনা করে। একতরফা সংঘর্ষে ৩০০ গ্রামবাসী নিহত হন।
এবিসি সংবাদ সংস্থার হংকংস্থ ব্যুরোপ্রধান মিষ্টার হাওয়ার্ড টুকার-এর মতে গত শনিবারের (২৭ শে নভেম্বর) ঢাকার পাশের একটি গ্রামে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা ৭৫ জন গ্রামবাসীকে হত্যা করেছে। নিহতদের মধ্যে পুরুষ ছাড়া মহিলা ও শিশু রয়েছে। গ্রামটি নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়েছে। মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যোদ্ধাদের আশ্রয় দেওয়া হয়েছিল সন্দেহ করেই গ্রামটির নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়।
মিঃ টুকনার বিধ্বস্ত এলাকার ফটো তুলে এনেছেন। তিনি বলেন, আমরা দেখলাম সরকারি বাহিনীর যাওয়ার পর ৭৫টি মৃতদেহ পড়ে আছে। মিঃ টুকার বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের সর্বোত্র ঘটছে এটা তার খন্ডাংশ মাত্র। এটা আমরা আগেও শুনেছি, লোকজনও তাই বলতেন, এবার আমরা নিজেদের চোখেই দেখলাম।’
মিঃ টুকার বলেন যে, পশ্চিমা সেনাবাহিনীর যেসব বাঙালি গেরিলাদের প্রতি সহানুভূতিশীল তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে চায়। বিধ্বস্ত গ্রাম সম্পর্কে তিনি বলেন, কেউ-ই জানেনা ওই গ্রামটি সত্যি সত্যি ই গেরিলাদের আশ্রয় দিয়েছিল কিনা। কিন্তু সরকার অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গেই বাঙালি নিশ্চিহ্ন করার কাজটি সম্পন্ন করেছেন।
জনৈক এপি (আমেরিকা)-র ফটোগ্রাফার সম্প্রতি ঢাকা থেকে আট মাইল দূরের একটি গ্রাম পরিদর্শন করেছেন। তিনি বলেন, প্রায় অধিকাংশ খড়ের ঘরে আগুন লাগানো হয়েছে। পাশাপাশি গ্রামে তাকে যেতে দেয়নি।
উক্ত ফটোগ্রাফার অভিযোগ করেন যে, তিনি পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতে যেতে চাইলে সেনাবাহিনী বাধা দেয়। তিনি বলেন, সেই গ্রামগুলিকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে।
গণতন্ত্র আর সমাজতন্ত্রের এই সংগ্রাম চলবেই
আওয়ামী লীগ নেতাদের ঘোষণা
( বিলম্বে প্রাপ্ত)
মুজিবনগর, ৫ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সদর কার্যালয়ে আজ সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় মাতৃভূমির সার্বিক মুক্তির জন্য আরও কঠোর সংগ্রামের শপথ গ্রহণের মাধ্যমে শেখ মুজিবের রাজনৈতিক ও গণতন্ত্রের অতন্ত্র প্রহরী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকী পালন করা হয়। এই উপলক্ষ্যে এক আলোচনা সভায় সভানেত্রীর আসন গ্রহণ করেন বেগম বদরুন্নেসা আহমেদ সভায় আলোচনা প্রসঙ্গে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাংবিধানিক সাংগঠনিক সম্পাদক জনাব ওবায়দুর জামান বলেন, বাংলাদেশের মানুষেরা আজকে স্বাধীনতা আন্দলনের সূত্রপাত হয়েছিল মূলত ১৯৬২ সালে স্বৈরাচার আইয়ুবশাহী কর্তৃক শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে গ্রেফতারের দিন থাকে। সেদিন হোসেন সোহরাওয়ার্দীর গ্রেফতারের প্রতিবাদে দীর্ঘ চার বছরের রাজনৈতিক বন্ধ্যাত্বের হাত থেকে মুক্ত হয়ে বাংলাদেশের রাজনীতি সচেতন ছাত্র-জনতা যে দুর্বার আন্দোলন শুরু করেছিলেন তাঁর শেষ পরিণতিই হচ্ছে আজকের এই স্বাধীনতা সংগ্রাম, আজকের এই মুক্তির সংগ্রাম। তিনি জনাব সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুকে অস্বাভাবিক মৃত্যু বলে উল্লেখ করে বলেন যে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ সরকার সোহরাওয়ার্দী হত্যার তদন্ত করবে এবং মৃত্যুর মূল কারণ খুঁজে বের করবেই। যে হানাদার বাহিনীর অত্যাচারে বাংলাদেশের মানুষ এবার ঢাকায় সোহরাওয়ার্দীর কবর জিয়ারত করার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে তাদের সমূলে উৎখাত করে অচিরেই আবার বাংলাদেশের জনগণ ঢাকায় সোহরাওয়ার্দীর মাজারে আগেকার মতোই তার মৃত্যুবার্ষিকী পালন করবে।
সভানেত্রীর ভাষণে বেগম বদরুন্নেসা আহমদ বলেন যে, বাংলাদেশের জনসাধারণ তাদের স্বাধীন বাংলাদেশে গণতন্ত্র সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সোহরাওয়ার্দীর আদর্শকে করবে আর এই বাস্তবায়িত আদর্শের মধ্যেই হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী চিরঞ্জীব হয়ে থাকবেন। ২৪ ঘন্টার আগে দেখা সোহরাওয়ার্দীর পৃথক বাংলাদেশের স্বপ্ন “স্বাধীন বাংলাদেশ” সফল হবেই।
প্রাভদা বলেন
সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র প্রাভদা লিখেছেন “বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রশ্নটি উপেক্ষা করে পাক-ভারত উপমহাদেশের মৌল সমস্যা সম্পর্কে বিন্দুমাত্র মাথা না ঘামিয়ে পশ্চিমী শক্তিবর্গ ভারতবর্ষের ব্যাপারে বড় বেশি উৎসাহ দেখাচ্ছে।”
প্রাভদা আরো বলেছেন, পাকিস্তানের জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেও সংরক্ষিত সেনাবাহিনীকে তলব করে গোটা পরিস্থিতিটাই জটিলতর করা হয়েছে। ভারত-পাক উপমহাদেশ থেকে যে সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে, প্রাভদার মতে এটা খুবই উদ্বেগের কারণ।
অপর এক সংখ্যায় প্রাভদা লিখেছেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন বরাবর বলেছে যে, বাংলাদেশ পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিরোধ এবং হলো পূর্ববাংলা ও পশ্চিম পাকিস্তান। আমেরিকা বৃটেন ও অন্যান্য কয়েকটি দেশের কিছু প্রতিক্রিয়াশীল এই জটিল পরিস্থিতির সুযোগ নিতে চাইছে। তারাই বিষয়টিকে নিরাপত্তা পরিষদে তোলার অপচেষ্টা করেছিল।
একটি মহত্তম ব্যবস্থা
(জয়বাংলা প্রতিনিধি)
বাংলাদেশের কা দখলদার হিংস্র হায়নাদের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত আমাদের রক্তস্নাত দেশের লাখো লাখো উৎপীড়িত মা-বোনেদের সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য অননুকরণীয় মানবিক কার্যক্রম গ্রহণ করেছেন।
আমাদের স্বরাষ্ট্র ও পুনর্বাসন মন্ত্রী জনাব এএইচএম কামরুজ্জামান বাষ্পরুদ্ধ কন্ঠে মুজিবনগরে এ ঘোষণা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন আমাদের নয় মাসের রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতিটি মুহূর্তে আমাদের বহু মা-বোন দস্যুদের হাতে ধর্ষিতা হয়েছেন, অপহৃত হয়েছেন। তাদের সুষ্ঠু সম্মান দেওয়া হবে।
তিনি বলেন স্বাধীনতা সংগ্রামের ঝটিকা বিগত দিনগুলিতে আমাদের নারী সমাজ আত্মত্যাগে সুমহান দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তা বর্বর হানাদার বাহিনীর সাথে সংগ্রাম বিজয়ী মুক্তিযোদ্ধাদের চাইতে কম গৌরবোজ্জল নয়।
জনাব কামরুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশের জনগণ তাদের সম্মানের সাথে সমাজে প্রতিষ্ঠা করবেন এবং সরকার তাদের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
বিশ্বের কাছে আবেদন জনাব কামরুজ্জামান
অপর এক বিবৃতিতে বাংলাদেশের কোটি কোটি ছিন্নমূল মানুষের পুনর্বাসনের জন্য বাংলাদেশকে সমর্থনকারী বিশ্বের সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র এবং বন্ধু রাষ্ট্রের নিকট আবেদন জানান।
শিল্প-সংস্কৃতি
পাখি
অনু ইসলাম
মায়ের কোলে পাঁচ বছরের শিশু গপ্পো শুনছিল।
এই অল্প বয়সেই ওর গল্প শুনতে ভীষণ মজা লাগে। সন্ধ্যার পর ওর মা যখন ঘুমের কথা বলে তখন সুড়সুড় করে বিছানায় উঠে পরে আর আবদারের সুরে বলে একটা গল্প বল না মা?
প্রতিদিন রাজা রানী, জাদুকর, আশ্চর্য প্রদীপ, দৈত্য-দানব, আর কত রকম অদ্ভুত গল্প বলতে বলতে এক একদিন শিশুটাকে বুকে জড়িয়ে অজান্তে ঘুমিয়ে পড়ে ওর মা।
ইউনিয়ন বোর্ডের দুই হাতের কাছে সড়কের পাশেই ওদের বাড়ির। টিনের ঘর সহ একটি বাড়ির পাশে কলা গাছ আম জাম ঝোপ-জঙ্গলের মধ্যে শীত-গ্রীষ্মে দিনরাত্রি অভাব-অনটনের মধ্যেও ওরা বেঁচে আছে। চারপাশে আরো কয়েকটি বাড়ি এবং ফসলের ক্ষেত।
বাবা হাই স্কুলের মাস্টার। স্কুলের মাইনেতে সংসার চলে না। তার ওপর কোনদিনই একসাথে পুরো মাইনে পায় না। সরকারি ভাতা-তো কোন প্রশ্নই ওঠে না। তাই প্রাইভেট পড়াতেই হয়।
পাঁচ বছরের ছেলে পুতুল হাঁটাহাঁটি করে সারাদিন সারা আঙ্গিনা ঘুরে বেড়ায়। আর খোলা আকাশের দিকে দুচোখ দিয়ে সেই নাম না জানা পাখির সন্ধানে থাকে।
একদিন পুতুলের মা শুয়ে শুয় ওই পাখির গল্প বলছিল। এটা একটা অদ্ভুত ধরনের পাখি। মাটিতে কোনদিন নামেনা। নিচে বাসা বাধে না। আকাশেই ঘর। আকাশে আকাশে তার বিহার। বহু উপর থেকে ডিম পারে আর তা নিচে পড়ার আগেই তা থেকে ফুটে বাচ্চা পাখি বেরিয়ে আকাশে উড়ে যায়।
কেউ কোনদিনও পাখি দেখেছে কিনা তা পুতুলের মা বলতে পারে না। অথচ পুতুলের ভিশন শখ আহা এ পাখিটা যদি দেখতে পারতো। আর সে আশা নিয়েই প্রতিক্ষণ আকাশের দিকে চেয়ে থাকে।
পুতুলের আশা পূর্ণ করে বুঝিয়ে বা একদিন এক জোড়া পাখি ওদের গ্রামটার উপর ভীষণ চিৎকার করে ঘুরপাক খেলো। ইচ্ছার ভয়ঙ্কর টানে (তাই) পুতুল ভয় পেলোনা। খালি দুরুদুরু বুকে আর উত্তেজনায় কাঁপছিল এত চিৎকার করছে কেন ওদের কি ভীষণ ক্ষুধা পেয়েছে? গভীর বেদনায় পুতুল তাকিয়েই আছে।
এই বুঝি আকাশে ডিম থেকে পাখি বেরিয়ে আসবে। পুতুলের মা পুতুল পুতুল করে কাছে ডাকছে। পুতুলের সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপেই নেই। এক গাদা ঘরের আড়ালে চিৎ হয়ে সেই শিহরণ জাগা ডিম থেকে বাচ্চা বেরুনোর দৃশ্য দেখার অপেক্ষায় পুতুল। কিছুক্ষণ আকাশে ঘুরপাক খেতে খেতে একটা পাখি খুব নিচে নেমে কয়েকটি ডিমের মতো বস্তু পুতুলদের শব্দ করে ফেলল।
এরপর পুতুলের কোন কথা মনে নেই। যখন জ্ঞান হলো তখন পুতুল জানো তার বাবা কেউ আর বেঁচে নেই।
তারপর দিনের পর দিন গড়িয়ে যায়। পাখি দুটো আসে। আকাশের আকাশের আপন ইচ্ছায় ঘুরে ফিরে যায়। প্রতিবাদকে দুটো দেখলেই মায়ের গল্প বলার কথা মনে পড়ে যায়। আর সঙ্গে চোখে-মুখে একটা জ্বালা যন্ত্রণা এবং কি যেন একটা দৃড়তা ফুটে ওঠে।
এমনি করে আট মাস কেটে গেল। আবার আকাশে দুটি পাখি ঘুরে বেড়াচ্ছিল। আর ঠিক তখনই ভীষণ বেগে এক ঝাঁক পাখি ছুটে এলো। পুতুল এবার আশ্চর্য হল। এবার জন্য ভীষণ আশ্চর্য হল।
তাকিয়ে আছে পুতুল। পাখি দুটো একঝাঁক পাখির কবলে পড়ে সে কি চিৎকার। ভীষণ ভালো লেগেছে । একবার উপরে উঠছে আবার নিচে নামছে। পাখি দুটো কিছুতেই পালাতে পারছে না।
উহু! পুতুলের সেকি আনন্দ! হাতে তালি দিচ্ছে আর লাফাচ্ছে।
তারপর কয়েকটি মুহূর্ত গড়িয়ে গেলে।
পাখি দুটোই আকাশ থেকে চিৎকার করতে করতে মাটিতে মুখ থুবরে পড়ে গেল।
পুতুল হঠাৎ থামিয়ে দিল এবং চিৎকার করে মায়ের কবরের উপর কাঁদতে কাঁদতে বললে, “মামনি এই দেখো পাখি দুটো আজ মারা পড়েছে।”
কারো কোনো শব্দ নেই।
দু’চোখের অশ্রু শুধু প্রশ্নে প্রশ্নে সবকিছুকে তলিয়ে দিল।
বাংলাদেশ যুগ যুগ জিও
বাসবজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
সেদিন ছিল ১৯৭১ এর সাতই মার্চ। বসন্তের তপ্ত দুপুর। ঢাকার আশেপাশের জনতা গভীর উৎসাহে চলেছে রেসকোর্সের দিকে। তখন কলকাতায় বসে ঢাকা বেতার কেন্দ্রের বাংলা খবর শেষ হবার পর ঘোষকের কণ্ঠে শুনলাম একটু পরে রেসকোর্স থেকে শোনানো হবে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ। অধীর আগ্রহে বসে রইলাম অনেকক্ষন কিন্তু শুনতে পেলাম না তার সে বজ্রকন্ঠের ঘোষণা, “এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” তবে অসময়ে রেডিও বন্ধ হয়ে যাবার আগে শুনতে পেলাম অনেকগুলি অপূর্ব দেশাত্মবোধক গান যেগুলো শুনে তখনই ভীষণভাবে মনে হয়েছিল যে সেদিন সুদূর নয় যেদিন পৃথিবীর মানচিত্র কে নতুন করে ছাপাতে হবে -পূর্ব পাকিস্তানের জায়গায় লিখতে হবে বাংলাদেশ! শেষ পর্যন্ত হলও তাই।
নির্বাচনে সাফল্যের পর কোন উপায় না দেখে অভূতপূর্ব অহিংস অসহযোগ আন্দোলন ২৫শে মার্চ থেকে ইয়াহিয়ার চরম বর্বরতা শুধু ভারতে বিপুলসংখ্যক শরণার্থীর আগমন, মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকারের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন, মুক্তিফৌজের সশস্ত্র বিপ্লবের দামামা, ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের জরুরি অবস্থা ঘোষণা ও আক্রমণ, ভারতীয় সৈন্য ও মুক্তিবাহিনীর যৌথভাবে পাকিস্তানিদের শেষ অবস্থা ও শহরের সবচেয়ে স্মরনীয় ৬ই ডিসেম্বরে ভারত সরকার দ্বারা বাংলাদেশ সরকারের স্বীকৃতি লাভ। এই হল স্বীকৃতি লাভের সময় থেকে প্রায় এক বছর আগের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। কিন্তু চরম লেখায় পৌছাবার জন্য তাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৫২-র ব্যক্ত করা একুশে ফেব্রুয়ারীতে। তারপর থেকে সারা বিশ্ব জেনেছিল বাংলা হল এক স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রভাষা আর ধর্মই সব নয়। দ্বিজাতিতত্ত্বের তল্পিবাহকদের প্রকৃতপক্ষে মৃত্যু হয়েছিল ১৯৫৪-র ঐতিহাসিক নির্বাচনের কিন্তু বুলেটের জোরে এতদিন টিকে থাকার উপর তাদের স্থান হয়ে গেল কবরে নিচে এক ঘৃণ্য ইতিহাসের পাতায় এক ঘৃণ্য ভূমিকায়। আজ তাই হলো দুই বাংলার প্রগতিশীল জনগণের আনন্দ উৎসবের দিন।
নীতি যাই হোক না কেন আমাদের মুখের ভাষা, সংস্কৃতি ও সভ্যতা ও ইতিহাসে এক এবং অবিচ্ছেদ্য। সে নীবিড় সম্পর্কের মধ্যে এক বিরাট অদৃশ্য পাঁচিল তুলে দিয়েছিল পাক সরকার ১৯৬৫ সাল থেকে। ফলে দু’দেশের বাঙালিরা বলতে পারতোনা দুর্গাপূজা নববর্ষ বা ২৫ শে বৈশাখে অথবা তাদের অন্য কোন প্রয়োজনে। এবার আর তা হবেনা তাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা শুধু তাদের নয় পশ্চিমবাংলার কাছেও নিঃসন্দেহে এক বিরাট আনন্দ সংবাদ।
এতদিন পশ্চিম বাংলা তথা ভারত তার সীমান্তের দরজা খুলে দিয়েছিল প্রতিবেশী বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ অত্যাচারিত শরণার্থীদের জন্য। পশ্চিম বাংলা তথা ভারতের জনগণ সম্ভাব্য সব রকমের সাহায্য ই করে এসেছে। তাদের বন্ধুদের জন্য শুধুমাত্র তাদের ন্যায্য অধিকার পাওয়া ও ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা এক গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক সোনার বাংলা দেখার জন্য। এছাড়াও দুই দেশের বন্ধুত্ব এর ফলে অন্যান্য অনেক ব্যাপারে উভয়ের সুযোগ সুবিধা তো আছেই।
তাই আজ পশ্চিম বাংলার জনগণ এটা আশা করেন যে একদিন যে সমস্ত বাঙালিরা সব খুইয়ে দেশ ছেড়ে গিয়েছিল তারা আবার সসম্মানে বাংলাদেশের ফিরে যাবে এবং নিরাপদে থেকেই সকলের সঙ্গে চেষ্টা করবে সোনার বাংলাকে ভরিয়ে দিতে গোলাভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু আর পুকুর ভরা মাছে। সাইরেনের আওয়াজে ঢুকবে বেরোবে কারখানাতে দুচোখ দিয়ে দেখবে নীল আকাশের নিচে চিমনির কালো ধোঁয়া।
এছাড়া পশ্চিমবাংলার বুদ্ধিজীবী, পাঠক, শিল্পীদেরও বহুদিনের একটি ইচ্ছা পূরণ হলো। এবার থেকে স্বাভাবিকভাবে চলবে দুই বাংলার মধ্যে সাহিত্য ও সংস্কৃতির ভাব বিনিময়। যার ফলে দুই ধর্মের জনগণের মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপিত হবে এবং আশা করা যায় সারাবিশ্বে আজাদ হিন্দ ফৌজের পর আরেকটি উদাহরণ হয়ে থাকবে। এ প্রসঙ্গে এককালের প্রাচীরঘেরা দুই বাংলার মধ্যে সাহিত্য ও সংস্কৃতি যোগাযোগ ও উভয় ধর্মের মধ্যে সাড়া জাগানোর উদ্দেশ্যে নিবেদিত পান্নালাল দাশগুপ্তের “কম্পার “মৈত্রেয়ী দেবীর “নবজাতক” কলকাতার এপার বাংলা ওপার বাংলা দুই বাংলার প্রবাসী বাঙ্গালীদের উদ্যোগে প্রকাশিত “দর্পণ” পত্রিকার ভূমিকা উল্লেখ যোগ্য। আজ তাদের আশা পূরণ হলো।
যাই হোক বাংলাদেশ আজ স্বীকৃতি পেয়ে গেছে। সঙ্গে আছে সারা ভারতের জনগণ ও বিশ্বের অন্যান্য দেশের বহু হিতাকাঙ্খী। তাই বাংলাদেশের জনগণের মনে আজ খুশির আবেগ। এটাই স্বাভাবিক। আর এই আবেগকে গঠন মূলক কাজের মধ্যে দিয়ে যে চালিয়ে নিয়ে যাওয়া একান্ত প্রয়োজন তা বলাই বাহুল্য। শেষ করছি বাংলাদেশের সংগ্রামী জনগণকে অভিনন্দন জানিয়ে। কামনা করি দুই বাংলার সম্পর্ক আরো নিবিড় হোক, ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী দীর্ঘজীবী হোক, যুগ যুগ ধরে বেঁচে থাকুক রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুভাষচন্দ্র, জীবনানন্দের ও হাজার হাজার শহীদের রক্তে ভেজা গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ। জয় হিন্দ। জয় বাংলা।