You dont have javascript enabled! Please enable it! 1973.07.10 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও আমাদের দায়িত্ব | নতুন বেতনের হার প্রসঙ্গে | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
১০ই জুলাই, মঙ্গলবার, ১৯৭৩, ২৫শে আষাঢ়, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও আমাদের দায়িত্ব

ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের দ্বিতীয় বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে গত পরশুদিন জাতীয় প্রেসক্লাব প্রাঙ্গণে। সম্মেলনে প্রধান অতিথি ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য জনাব আবুল ফজল। প্রধান অতিথি ছাড়াও সম্মেলনে প্রায় সকল বক্তাই সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সম্পর্কে বক্তব্য রেখেছেন। তাদের সকলেরেই অভিমত সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সরকার খর্ব করেছেন। এমনকি সরকার সংবাদপত্রের স্বাধীনতার প্রশ্নে অতীতের শাসক শ্রেণীরই পথ অনুসরণ করছেন বলে তারা মত প্রকাশ করেছেন। এছাড়া স্বাধীন সংবাদপত্র বা সাংবাদিকতার প্রয়োজন একটি জাতির জন্যে বা অপরিহার্য সে কথাও সম্মেলনে বলা হয়েছে। সর্বোপরি বিভিন্ন বক্তা দেশের পুনর্গঠনের এই মুহূর্তে সংবাদপত্রের অবাধ স্বাধীনতার কথা ব্যক্ত করেছেন—এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্যে সরকারের কাছে দাবী জানানো হয়েছে।
বস্তুতঃপক্ষে সংবাদপত্রের সেবক হিসেবে আমরা সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। দেশের সংবাদপত্রের মুখ কোন অবস্থায়ই বন্ধ করা উচিত নয়। বিশেষ করে দেশে যখন গণতন্ত্র বর্তমান। পার্লামেন্টারী গণতন্ত্রের ইতিহাসে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা বিশ্বের সর্বত্রই স্বীকৃত। একটি দেশের অগ্রগতি ত্বরান্বিত করতে পারে স্বাধীন সংবাদপত্র। সরকারের চলার পথকে সুগম করে দিতে পারে সংবাদপত্র। একটি সরকার যদি সৎ ও স্বাধীন সংবাদপত্রের মতামতকে গ্রহণ করে অগ্রসর হয় তাহলে তার স্থায়িত্ব বিনষ্ট হতে পারেনা। কিন্তু যখন কোন সরকার সংবাদপত্রকে লা-পাত্তা দিয়ে অগ্রসর হয় তখন তার ক্রমাবনতি অনিবার্য হয়ে পড়ে। অতীতে আমরা আইয়ুব-ইয়াহিয়াকে সে অবস্থায় উপনীত হতে দেখেছি। অবশ্য তৎকালে গণতন্ত্র ছিলোনা। দেশ স্বাধীন হবার পর গণতন্ত্র একটি প্রধান রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে। দেশে আজ সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত। মানুষের সকল প্রকার মৌলিক অধিকার আজ সংরক্ষিত। এই মৌলিক অধিকারের প্রতি হস্তক্ষেপ করার অধিকার কোন মহলের থাকতে পারেনা। পাকিস্তান আমলের কুখ্যাত প্রেস এন্ড পাবলিকেশন্স এ্যাক্ট আজো বাতিল করে নতুন কোন নীতিমালা ঘোষণা করা হয়নি। আমরা ইতিপূর্বে শুনেছিলাম নতুন একটি নীতিমালা প্রণীত হতে চলেছে। যে নীতিমালায় লিপিবদ্ধ হবে প্রেস ও পাবলিকেশন সম্পর্কিত অধিকার। সরকারের নিকট আমাদেরও জিজ্ঞাসা কেন দেশ স্বাধীন হবার সতেরো মাস পরেও নতুন কোন নীতিমালা ঘোষণা করা হলোনা? কেন আজো সেই কুখ্যাত প্রেস এ্যান্ড পাবলিকেশন্স আইন চালু রয়েছে?
এতদসত্ত্বেও আমরা মনে করি, সংবাদপত্রের স্বাধীনতার শ্লোগান তুলে নিজেদের দায়িত্ব যেন আমরা ভুলে না যাই। এদেশের প্রতি ও জাতির প্রতি একটি রাজনৈতিক দলের চেয়ে আমাদের দায়িত্ব কোন অংশেই কম নয়। স্বাধীনতা লাভের পর এ দায়িত্ব বহুল অংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে সংবাদপত্রের মাধ্যমে যখন সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা করা হয় তখন একটি রাজনৈতিক দলের আন্দোলনের চেয়ে বেশী জনগণের দৃষ্টি আকর্ষিত হয়। গণতন্ত্রের নামে যেমন অবাধ বা যাইচ্ছে তাই করা যায় না তেমনি সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নামে যাইচ্ছে তাই লেখা উচিত নয়। সংবাদপত্র সব সময়ই জাতীয় মর্যাদার অধিকারী। কেননা জাতির বহু উত্থান-পতনের সঙ্গে তার সম্পর্কই সবচেয়ে বেশী নিবিড়। সরকার চোখে আঙ্গুল দিয়ে সব সময় আমাদের দায়িত্ব স্মরণ করিয়ে দিতে পারে না। নিজের দায়িত্ব সম্পর্কে নিজের বিবেচনা ও বিবেক দিয়েই সচেতন হতে হয়। বাংলাদেশের সংবাদপত্র জগতে সেই সচেতনা কতটুকু আছে তা একবার ভাববার বিষয়। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় যে সকল সাংবাদিক এদেশের অভ্যন্তরের দখলদার বাহিনীর সঙ্গে যোগসাজশ করেছিলো তাদের ব্যাপারে সাংবাদিক মহল আমরা কোন বয়কটের নীতি গ্রহণ করিনি। গণতন্ত্রের নামে তারাও আজ দেশপ্রেমিকের সমমর্যাদায় সমাসীন। ইতিপূর্বে প্রেস ক্লাবের এক অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই সকল দালাল সাংবাদিকদের সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন। এ ব্যাপারে আমাদের মতামতও সুস্পষ্ট যে, আমরা গণতন্ত্রের নামে, স্বাধীন সাংবাদিকতার নামে দেশের আদর্শের বিরুদ্ধে বা সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে কোন প্রকার বক্তব্য প্রকাশকে মেনে নিতে পারিনা। এ ধরনের মতামত সম্পূর্ণ রাষ্ট্রদ্রোহিতার পর্যায়ে পড়ে বলে আমরা মনে করি। সর্বোপরি, আমরা সোচ্চার হয়ে সরকারের বিরুদ্ধে লিখবো আর রাষ্ট্রীয় আদর্শের বিরুদ্ধে লেখার জন্যে, মিথ্যা খবর প্রকাশের দায়ে এবং যুদ্ধকালীন সময়ে দালালীর অভিযোগে সরকারের চোখে অভিযুক্ত হতে দেখলে স্বাধীন সাংবাদিকতার দাবী তুলে সৎ সাংবাদিকের নামাবলী পড়বো—এটা হতে পারেনা। আর এখানেই নিহিত রয়েছে জাতির প্রতি সাংবাদিকের কর্তব্য। সত্য ঘটনা তুলে ধরা এবং সরকারের ন্যায়তঃ সমালোচনা করার অন্য নামই হলো সৎ সাংবাদিকতার গণতান্ত্রিক অধিকার। আর এ ব্যাপারে তাই আমরাও কোন রাষ্ট্রীয় শক্তি বা শ্রেণী শক্তির সঙ্গে আপোষ করতে রাজী নই।

নতুন বেতনের হার প্রসঙ্গে

চলতি বছরের পয়লা জুলাই থেকেই নতুন বেতনহার কার্যকর হবে বলে মাননীয় অর্থমন্ত্রী তথ্য প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, নতুন বেতন কমিশন অনুসারে কর্মচারীদের একাংশের হার শীঘ্রই ঘোষণা করা হবে। তিনি আরো বলেছেন, সরকার নীতিগতভাবে বেতন কমিশনের রিপোর্টের সুপারিশসমূহ গ্রহণ করবেন একথা বিবেচনায় রেখেই বেতন কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়নের জন্যে বাজেটে ১৭ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
নতুন বেতন কমিশনের রিপোর্ট সরকারীভাবে প্রকাশের দাবী বেশ কিছুদিন আগে থেকে সোচ্চার হয়েছে। সকল কর্মচারীরই আশা, নতুন কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী সকলেরই বেতন বৃদ্ধি পাবে। সুতরাং বর্তমান দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে নির্ধারিত আয়ের কর্মচারীরা বেতনের নতুন হার অনুযায়ী সুবিধাভোগের প্রত্যাশা করে আসছেন। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, নতুন বেতনের হার দেখে সকলেই সন্তুষ্ট হবেন।
দেশের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ‘বিশ্বস্তসূত্রের বরাত’ দিয়ে বেতনের একটা নতুন হার কিছুদিন আগে প্রকাশিত হয়েছে। ‘বিশেষ’ বা ‘বিশ্বস্তসূত্রে’র বরাত দিয়ে প্রকাশিত বেতনের সেই হার দেখে জনমনে বিশেষ করে সরকারী চাকুরীতে কর্মরত ব্যক্তিদের মধ্যে নানা রকম প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গেছে। অনেকে বলেছেন, নতুন হার ঘোষণা করা আর না করা সমান কথা, অনেকে বলেছেন, প্রকাশিত হার অনুসারে দেশের বর্তমান অগ্নিমূল্যের বাজারে কোন লাভ নেই আবার অনেকে বলেছেন, নতুন হার মোটামুটি ভালোই হবে। বেতন কমিশন নির্ধারিত বেতনের নতুন হার এখনো সরকারীভাবে ঘোষিত হয়নি। তবে এ তথ্য জানা গেছে যে, বেতনের বাইশশ’স্তর ভেঙেচুরে মাত্র ১০টি শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়েছে। বাইশশ’কে মাত্র ১০টি স্তরে আনা কোনক্রমেই একটি সহজসাধ্য কাজ নয়। তবুও সরকার রাষ্ট্রীয় মূল আদর্শকে ভিত্তি করে জনগণের কল্যাণের কথা লক্ষ রেখে বাইশশ’ শ্রেণীকে ১০টি শ্রেণীর মধ্যে এনে সমতা রক্ষা করে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির অভীষ্ট লক্ষ্যকে বাস্তবায়িত করার প্রচেষ্টা করেছেন। সুতরাং এতে করে দু’টো শ্রেণী বিশেষভাবে ‘এ্যাফেকটেড’ হবেন। যেমন যাঁরা বেশী বেতন পেতেন তাদের বেতন পূর্ববৎ থেকে যাবে অথবা নীচের দিকেও আসতে পারে এবং যাঁরা নিম্ন বেতনভুক্ত কর্মচারী ছিলেন তাদের বেতন বৃদ্ধি পেয়ে একটা সম্মানজনক পর্যায়ে গিয়ে সর্বনিম্ন বেতন নির্ধারিত হবে। আর এর ফলে যারা মোটামুটি উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণী হিসেবে পূর্বে পরিচিত ছিলেন তাঁদের বেতন বাড়লেও তা উল্লেখযোগ্য বলে চোখে পড়বেনা। কিন্তু আসলে আমাদের দেশে চাকুরীরত কর্মচারীদের মধ্যে উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণীর লোকের সংখ্যাই সর্বাধিক। সুতরাং নতুন বেতনের হার সম্পর্কে বর্তমানে দু’টো মতামত লক্ষ্য করা যাচ্ছে। একদল চাচ্ছেন সত্বর নতুন হার কার্যকর হউক অপর দল চাচ্ছেন নতুন বেতনের হার অনুযায়ী যখন বিশেষ লাভ হচ্ছে না সুতরাং এক সময় ঘোষণা হলেই হলো।
আমাদের কথা তা নয়। আমাদের বক্তব্য নতুন বেতনের হার যাই হোক না কেন তা বিচার করতে হবে উদার এবং নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে। আমি কতটুকু লাভবান বা ক্ষতিগ্রস্ত হ’লাম তা না ভেবে সমষ্টিগতভাবে নতুন বেতনের হার গোটা সমাজে সকল কর্মচারীর ক্ষেত্রে এবং দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার সঙ্গে কতটুকু সঙ্গতিপূর্ণ সেই কথাটা মনে রেখে নতুন বেতনের হার বিচার করতে হবে, মেনে নিতে হবে। মনে রাখতে হবে বাইশশ’ স্তর থেকে মাত্র দশ এ আনার ফলে সকলে সমান লাভবান হতে পারেন না। সুতরাং সবাইকে ত্যাগী এবং সহানুভূতিশীল মনোভাব পোষণ করতে হবে। বিশেষ করে নির্ধারিত আয়ের কর্মচারীর দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থায় যেভাবে হাবুডুবু খাচ্ছেন সরকার তাদের প্রতি পূর্ণ সজাগ ও সহানুভূতিশীল মন দিয়েই তাদের বিষয় বিচার করবেন বলে আমরা গভীর আস্থা পোষণ করি। নতুন বেতনের হার দীর্ঘদিন থেকে প্রচলিত অবৈজ্ঞানিক ও শ্রেণী সৃষ্টিমূলক বেতনের হারকে ধুয়ে মুছে বিদূরিত করে সুখ স্বাচ্ছন্দ্যময় নতুন সমাজতান্ত্রিক সমাজ গঠনে সহায়ক হবে এবং সকল কর্মচারী তা আন্তরিকভাবে গ্রহণ করবেন এটাই আমরা কামনা করি। সঙ্গে সঙ্গে সাংবাদিকদের জন্য তৃতীয় বেতন বোর্ড গঠন করে সাংবাদিকদের বহুদিনের দাবী পূরণ করতে সরকার সচেষ্ট হবেন বলেও আমরা আশা রাখি।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন