You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা : ১৫ই নভেম্বর, শুক্রবার, ১৯৭৪, ২৮শে কার্ত্তিক, ১৩৮১ বঙ্গাব্দ

চূরান্ত বিজয়ের পথে একটি বলিষ্ঠ পদক্ষেপ

কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যে গেরিলা নেতা ইয়াসির আরাফাত নিউইয়র্ক পৌঁছেছেন। সেখানে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে প্যালেস্টাইনী বিতর্কের উদ্বোধন করতে গিয়ে তিনি আহ্বান জানিয়েছেন স্বাধীন সার্বভৌম এবং ধর্মনিরপেক্ষ প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র গঠনে বিশ্ব সংস্থাকে সাহায্য সহযোগিতার হস্ত সম্প্রসারণের জন্য। এই বিতর্ক চলবে বেশ ক’দিন। জাতিসংঘে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্থায়ী প্রতিনিধি জন স্ক্যালী বলেছেন, এই বিতর্কের ফলাফলের আলোকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার প্যালেস্টাইন নীতি পুনর্নির্ধারিত করবে।
জাতিসংঘে প্যালেস্টাইনী নেতা ইয়াসির আরাফাফের ভাষণ কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বস্তুতঃ কোনো রাষ্ট্রের প্রধান বা প্রতিনিধি না হয়েও তিনি যে এই বিশ্ব সংস্থার সভায় যোগ দিতে পেরেছেন এটা পরোক্ষভাবে প্যালেস্টাইনীদের ন্যায্য সংগ্রামের প্রতি জাতিসংঘের স্বীকৃতিরই নামান্তর।
এর পূর্বে রাবাতে অনুষ্ঠিত আরব দেশগুলোর এক শীর্ষ সম্মেলনে পি.এল.ও’কে প্যালেস্টাইনীদের প্রতিনিধিত্বমূলক একমাত্র সংস্থা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। এমনকি পি.এল.ও’র নেতৃত্বাধীন প্রবাসী সরকার গঠনের ব্যাপারেও আরব রাষ্ট্রসমূহ তাদের সম্মতির কথা ঘোষণা করেছেন। পরবর্তীকালে জাতিসংঘে পি.এল.ও প্রধান আরাফাতের ভাষণ এবং প্যালেস্টাইনীদের রাষ্ট্র গঠন এবং কাঠামো সম্পর্কিত স্পষ্টতর বক্তব্য তাদের সংগ্রামে নবতর এক অধ্যায়ের সূচনা করেছে।
মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতির গুণগত পরিবর্তন অনেক আগেই শুরু হয়েছে। গত বৎসরের অক্টোবর যুদ্ধ এবং তেল সম্পদের উপর আরব রাষ্ট্রসমূহের অধিকতর স্বাধীন নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা শক্তির ভারসাম্যে পরিবর্তন এনেছে। আগের চাইতে আরব দেশগুলো অধিকতর সংঘবদ্ধ। উন্নত রাষ্ট্রসমূহের অর্থনীতিতে আজ আরব বিশ্বের সিদ্ধান্তের প্রভাবকে কেউ আর খাটো করে দেখতে পারে না। এমতাবস্থায় প্যালেস্টাইনীদের সংগ্রামের এই নবতর অধ্যায় যে তাদের বিজয় সাফল্যের দিকেই বলিষ্ঠতর পদক্ষেপ তা বলাই বাহুল্য।
বিজয় লক্ষ্যে তাদের এ অগ্রযাত্রাকে আমরা অভিনন্দন জানাই। বাংলাদেশের মানুষ গোড়া থেকেই প্যালেস্টাইনীদের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে আসছে। এই সেদিনও বঙ্গবন্ধু আরব জনগণকে বাংলাদেশের মানুষের সর্বাত্মক সমর্থন এবং সহযোগিতা প্রদানের কথা ঘোষণা করেছেন। জাতিসংঘের ইয়াসির আরাফাতের ভাষণদানের পূর্বে তাঁর কাছে প্রেরিত এক বাণীতেও বঙ্গবন্ধু প্যালেস্টাইনীদের সংগ্রামের চূড়ান্ত বিজয় কামনা করেছেন। জাতিসংঘে আমাদের প্রতিনিধিদলকেও আরবদের প্রচেষ্টায় পূর্ণ সমন্বয় বিধানের জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
যাদের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে ইসরাইল সুদীর্ঘকাল তাদের সম্প্রসারণবাদী সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক নীতি অব্যাহত রেখেছে তারা অতঃপর বাস্তব পরিস্থিতি এবং বিশ্বজনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবে বলে আমরা আশা করি। ইতিহাসের অমোঘ গতিকে পরিবর্তন করার জন্য যারা উত্তেজনা সৃষ্টি এমনকি যুদ্ধোন্মদনায় উস্কানি দিয়ে চলেছে, বিশ্বশান্তির স্বার্থেই তাদের এ প্ররোচনা বন্ধ করা উচিত। একটা কথা ভুলে গেলে চলবেনা—আগের চাইতে আরব রাষ্ট্রসমূহ যে শুধু সামরিক দিক থেকেই অধিকতর শক্তিশালী তাই নয়, বরং ইসরাইলের মদদদার পুঁজিবাদ বিশ্বের অর্থনীতিতেও তাদের প্রভাব কিছু কম নয়।

বিশ্ব খাদ্য ভান্ডার প্রসঙ্গে

রোম সম্মেলনে খাদ্য নিরাপত্তা পরিষদ গঠনের যে কথা উঠেছে, বাস্তবে তাকে রূপ দিতে পারলে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পূর্ব পর্যন্ত খাদ্য ঘাটতির দেশগুলোর পক্ষে তা হবে অসময়ের একটা বিশেষ ভরসাস্থল। বন্যা, প্লাবন অথবা অনাবৃষ্টিজনিত খরার মোকাবেলা করার কোনো ব্যাপক, সুষ্ঠু ও কার্যকরী কর্মপন্থা এখনো পর্যন্ত এদেশগুলোতে গড়ে উঠেনি—সেহেতু আজ এ সমস্ত প্রাকৃতিক উপদ্রব অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর নিত্যসাথী এবং তারই ফলশ্রুতিতে এ সমস্ত দেশের কোটি কোটি লোককে দুঃসহ খাদ্যাভাব আর দুর্ভিক্ষের মোকাবেলা করতে হচ্ছে প্রতিবছর। খাদ্যাভাব মোকাবেলায় সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে খাদ্যোদ্বৃত্ত দেশগুলোর মুখাপেক্ষী হয়ে পরের নতুন নতুন শর্তের বেড়াজালে স্ব স্ব দেশের অনাহারক্লিষ্ট অগণিত মানুষের মুখে দু’মুঠো অন্ন তুলে দেয়ার দায়িত্ব নিতে হয় এবং বলা বাহুল্য অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর কাছে এ হলো প্রতিবছরের প্রাত্যহিক ঘটনা। আমাদের কৃষিমন্ত্রী গত পরশুদিন খাদ্য সম্মেলনে যোগদান শেষে ঢাকা ফিরে এসে বিমান বন্দরে সাংবাদিকদের সাথে কথাবার্তা বলার সময় ঐ প্রস্তাবিত খাদ্য ভান্ডারের কথা বলেছেন। প্রস্তাবিত খাদ্য ভান্ডার স্থাপনের কাজ যে অদূরভবিষ্যতে শুরু হচ্ছে তা অবশ্য জানা যায়নি। এ নিয়ে ভাবনা-চিন্তা হচ্ছে এবং রোম সম্মেলনে যোগদানকারী প্রতিনিধিদের অনেকেই নাকি এ ব্যাপারে আশাবাদী। আশাবাদী তাদের সাথে আমরাও, যাতে ঐ ধরনের একটা খাদ্য ভান্ডার সকলের সমবেত প্রচেষ্টায় গড়ে তুলতে পারলে জরুরী খাদ্যাভাব মোকাবেলায় আন্তর্জাতিকভাবে খাদ্যশস্য যে কোনো দেশের পক্ষে লাভের ব্যাপারে সহজ ও বেড়াজাল বহির্ভূত শর্তগুলো তাদের পক্ষে একদিকে সম্মানজনক এবং অপরদিকে সহজলভ্য হয়ে দাঁড়ায়। জানিনা খাদ্যোদ্বৃত্ত তথা উন্নত দেশগুলোর এ প্রস্তাবিত শস্য ভান্ডার সম্পর্কে আপন আপন প্রতিক্রিয়া কি। তবে এ কথা ঠিক যে, আন্তর্জাতিক খাদ্যের বাজার স্থিতিশীল রাখার প্রয়োজনে খাদ্যোদ্বৃত্ত দেশগুলোর অনেকে আজ শস্য নির্দিষ্ট পরিমাণের বাইরে উৎপাদন না করার যে মানবতা বিরোধী নীতি অবলম্বন করে চলেছেন, বিশ্ব খাদ্য ভান্ডার গঠন সম্পর্কে তাদের উদার মনোভাব অবলম্বনের প্রয়োজন রয়েছে সমধিক। কারণ যে উদ্দেশ্যে খাদ্য ভান্ডার প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন—তারা তাদের উৎপাদন বৃদ্ধি না করলে ভান্ডারে দেয় খাদ্যের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে না এবং সে মহৎ উদ্দেশ্য অচিরেই ব্যর্থ হবে। সুতরাং সব কিছু বিবেচনা করে রোম খাদ্য সম্মেলনে শস্য ভান্ডার গঠন সম্পর্কে যে কথা উঠেছে তা প্রশংসনীয় এবং খাদ্য ঘাটতির দেশগুলোর পক্ষে বর্তমান অবস্থার নিরিখে কল্যাণকর, তবে কথা ও কাজের সঙ্গতির মধ্যে মহৎ উদ্দেশ্যের সার্থকতা নিহিত—এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে বিশ্ববাসী অচিরে এ প্রস্তাবের বাস্তবায়নে সুষ্ঠু বাস্তবমুখী ও ত্বড়িৎ কর্মপন্থা গ্রহণ করবেন বলে আমরা মনে করি।

বৈদ্যুতিক ট্রেন প্রবর্তনের পরিকল্পনা

ঢাকা ‍ও চট্টগ্রামের মধ্যে বৈদ্যুতিক ট্রেন চালু করা হবে। ঢাকা-চট্টগ্রাম পথে বৈদ্যুতিক ট্রেন চালু করার জন্য বাংলাদেশ রেলওয়ে পনেরো কোটি টাকার একটি পরিকল্পনাও প্রণয়ন করেছে। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য প্রায় পঞ্চাশ ভাগ বৈদেশিক মুদ্রায় ব্যয়িত হবে। একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার সহায়তায় ইতিমধ্যেই বৈদ্যুতিক ট্রেন প্রবর্তনের সম্ভাব্যতা সংক্রান্ত রিপোর্ট প্রণীত হয়েছে। এটি একটি সুখবর তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কয়লা এবং ডিজেলের দাম যে হারে বেড়েছে, তাতে বৈদ্যুতিক ট্রেন চলাচলের প্রয়োজনীয়তা গভীরভাবে অনুভূত হওয়াই স্বাভাবিক। বৈদ্যুতিক ট্রেন প্রবর্তিত হলে বাংলাদেশ রেলওয়ের ব্যয়ভার বিপুল পরিমাণে লাঘব হবে। রেলওয়ে ট্রাকের সামান্য পরিবর্তন সাধন করলেই নাকি বৈদ্যুতিক ট্রেন চলাচলের ক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ধকতা দেখা দেবে না। এ ছাড়া বৈদ্যুতিক ট্রেন চালু করতে খুব বেশী ইঞ্জিনের দরকার নেই। এতে করে ইঞ্জিনগুলোও দীর্ঘদিন ব্যবহার উপযোগী থাকবে বলে বিশেষজ্ঞরা অভিমত দিয়েছেন।
বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা খুব উন্নত এমন দাবী আমরা করবোনা। বিশেষ করে ট্রেনের গঞ্জেন্দ্র গমন সম্পর্কে আমরা সবাই পুরোপুরি ওয়াকিবহাল। এ অবস্থায় বৈদ্যুতিক ট্রেন দ্রুতগামীতার দিক দিয়ে একটি সহায়ক শক্তি হিসেবে পরিগণিত হবে। কিন্তু শুধু ঢাকা-চট্টগ্রাম পথে বৈদ্যুতিক ট্রেন চালুর ব্যবস্থা করলে যোগাযোগ ব্যবস্থার সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, এমন মনে করার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। বাংলাদেশের অধিকাংশ রেলপথই দুর্গম। রেল লাইনে পাথর বসানো না থাকাতে প্রতিটি ট্রেনেরই গতি অত্যন্ত শ্লথ। রেল কর্মচারীদের মধ্যে অনভিজ্ঞ এবং অদক্ষ কর্মীর সংখ্যাও একেবারে নগণ্য নয়। ফলে স্বাভাবিক কারণেই বাংলাদেশের রেলযোগাযোগ ব্যবস্থা মসৃণ নয়। এই অবস্থায় কয়লা কিংবা ডিজেলবাহী ট্রেনগুলোর চলাচলের ক্ষেত্রে কোনো রকম ‍উন্নয়ন সাধন না করে ঢাকা-চট্টগ্রাম পথে বৈদ্যুতিক ট্রেন চালু করার মধ্যে খুব একটা সার্থকতা আছে বলে আমাদের মনে হয় না। ঢাকা-চট্টগ্রাম পথে বৈদ্যুতিক ট্রেন চালু করতে কয়েক কোটি টাকা ব্যয়িত হবে। বৈদ্যুতিক ট্রেন চালু করার ব্যাপারটি কাঠখড় না পুড়িয়েই সমাধা করা হবে, এ রকম চিন্তা না করাই ভালো। তাই সবার আগে বর্তমান রেল যোগাযোগের উন্নয়ন সাধন করাই রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের প্রধান কর্তব্য হওয়া উচিত ছিল। তাই বলে বৈদ্যুতিক ট্রেন প্রবর্তনের সিদ্ধান্তটিকে আমরা একেবারে নিরুৎসাহিত করছিনা। জেট যুগে গরুর গাড়ীর মতো ট্রেন চলাচল অব্যাহত থাক, এটা আমাদের কিছুতেই কাম্য হতে পারেনা। বৈদ্যুতিক ট্রেন নিশ্চয়ই চালু করা দরকার। তার অগে বর্তমান ট্রেন চলাচলের সমুয়দ অব্যবস্থার নিরসন করাও একান্ত দরকার। যদি তা না করা হয়, তাহলে বৈদ্যুতিক ট্রেনগুলোর অবস্থাও একদিন সঙ্গীন হয়ে উঠা বিচিত্র কিছু নয়। আমরা আশা করি, বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ দেশের ট্রেন যোগাযোগের ক্ষেত্রে সব রকম প্রতিবন্ধকতা দূর করার জন্যও অবশ্যই সুষ্ঠু ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। নইলে বৈদ্যুতিক ট্রেনের ভবিষ্যতকে খুব একটা উজ্জ্বল হিসেবে প্রতিভাত করা সমীচীন হবে না।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!