১২ কার্তিক ১৩৭৮ শনিবার ৩০ অক্টোবর ১৯৭১
ইয়াহিয়া খানের সামরিকচক্রের আয়োজিত জনশূন্য কবরের শান্তির পরিবেশ জাতীয় পরিষদের উপনির্বাচন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ৫০ জন নির্বাচিত হয়েছে। তন্মদ্ধে জামাতে ইসলামী- ১২, পিডিপি-১১, পিপিপি-৬, কন মুঃলীগ -৬, নেঃইসলামী-৬, মুঃলীগ-৫, কাঃমুঃলীগ-৪। দৈনিক পাকিস্তান তালিকা প্রকাশ করেছে।
ইয়াহিয়া খান বাস্তুচ্যুতদের ঘরে ফিরে আসতে সবিনয় অনুরোধ জানিয়েছেন (দৈঃপাঃ) এক বিবৃতিতে বলা হয়, খাঁটি পাকিস্তানীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন পরীক্ষা করে দেওয়ার জন্য আর্ন্তজাতিক সংস্থাকে গ্রহণ করা হবে। তিনি বলেন, মাত্র ২০ লক্ষ পূর্ব পাকিস্তানী ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। ইয়াহিয়া খান বলেন, “Refugee camps have been filled with the permanently wandering population and the parennially unemployed of calcutta and other parts of west Bengal. Besides the Indian figures also Include those who had migrated from East Pakistan in 1947 and have remained unsettled for one reason of another.” (সংবাদপত্র)
উল্লেখ্য এই সময়ে ২০ লক্ষ মুসলমান শরণার্থীসহ ৯০ লক্ষ হিন্দু মুসলমান শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল।
পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ডাঃ এ এম মালিক বলেন, ‘সেনাবাহিনীর ২৫ মার্চের কার্যক্রমে পাকিস্তান রক্ষা পেয়েছে।’ (দৈঃ পাঃ)
ঢাকা দৈনিক মনিং নিউজ এর গেটে গেরিলারা গ্রেনেড নিক্ষেপ করেন। উল্লেখ্য এ ইংরেজী দৈনিকটি ১৯৫২ স্বয়ং থেকে বাঙালীদের স্বার্থ বিরোধী ভূমিকা পালন করছে।
ঢাকার অভয় দাস লেনে অবস্থিত সেন্ট্রাল উইমেন্স কলেজে মুক্তিবাহিনীর গেরিলাদল গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। কোন হতাহতের সংবাদ জানা যায় নি। উল্লেখ্য, অবরুদ্ধ বাংলাদেশে পাকসেনাদের ব্যস্তরাখা ও জনমনে মুক্তিবাহিনীর উপস্থিতি ব্যাপকভাবে অনুভূত করানোই ছিল এসব অপারেশনের উদ্দেশ্য।
ঢাকা শহর কাঁঠাল বাগান শান্তি কমিটির সভাপতি আসাদুল্লাহ ও নারায়ণগঞ্জ শান্তি কমিটির সদস্য শাহজাহানকে গেরিলারা খতম করে।
মুক্তিবাহিনীর বিশেষ প্রশিক্ষিত দল চট্টগ্রামের জুবিলি রোডস্থ দাউদ পেট্রোলিয়ামের ‘এ্যাপোলো’ ১১ পেট্রোল পাম্পে বিস্ফোরন ঘটনা হয়। ট্রান্সফরমান বিধ্বস্ত করে চট্টগ্রাম বন্দর নগরীকে অন্ধকারে নিমগ্ন করে। সমস্ত শহরেই অন্ধকারে গ্রেনেডের বিস্ফোরণের আওয়াজে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে।
পিপিপি চেয়ারম্যান ও ইয়াহিয়া খানের বিশেষ দূত জনাব জূলফিকার আলী ভূট্টো জেনেভা থেকে প্যারিসে পৌছেন। উল্লেখ্য ফরাসী সরকার বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিষয়ে শরণার্থীদের প্রতি সহানুভূতি দেখালে অ পাক সামরিক সরকারের প্রতি অস্ত্র ব্যবসার বিশেষ ক্রেতা হওয়ায় দ্বৈত ভূমিকা পালন করেন। কিন্তু ফরাসী জনগণ, বুদ্ধিজীবীদের বাংলাদেশ সংগ্রামে নৈতিক সমর্থন এক ইতিহাস হয়ে থাকবে। আন্দ্রে মার্লোর বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে গেরিলাদের সাথে যুদ্ধে অংশ গ্রহনের ইচ্ছা প্রকাশ অ নৈতিক সমর্থন সারা বিশ্বের বুদ্ধিজীবী মহলে সাড়া জাগিয়েছিল।স্বাধীনতা অর্জনের পর আন্দ্রে মালরোকে বাংলাদেশ বিশেষ সম্মান জ্ঞাপন করা হয়।
আগষ্ট মাসের ২৪-২৫ তারিখে জেনেভায় অনুষ্ঠিত পাকিস্তানী রাষ্ট্রদূতদের এক সম্মেলনে বাংলাদেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে গোপন আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুলতান মোহাম্মদ খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনে রাষ্ট্রদূতগণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে বিভিন্ন দেশের সরকারী মহলের প্রতিক্রিয়া বর্ণনা করেন। সম্মেলনের বিবিরণী কলকাতার সাপ্তাহিক “ফ্রন্টিয়ার” পত্রিকার ৩০শে অক্টোবর সংখ্যায় ফাঁস করে দেওয়া হয়। নিম্নে তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া হলোঃ
“মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিয়োজিত রাষ্ট্রদূত আগা হিলালঈর পক্ষ থেকে জেড এম ফারুকী বলেন, চীন-মার্কিন সম্পর্ক স্থাপনের ব্যাপারে সহায়তার জন্য নিক্সন পাকিস্তানের প্রতি সহানুভূতি সম্পন্ন। মার্কিন কংগ্রেস ও জনসাধারণ বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতি সম্পন্ন তিনি স্বীকার করেন। আওয়ামী লীগ বাস্তহারাদের প্রতি সিনেটর কেনেডির সমর্থনের ফলে পাকিস্তানের সুনাম ক্ষুন্ন হয়। পূর্ববঙ্গে বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে পাকিস্তানের পক্ষে প্রচার কার্য চালনা সহজ হবে। পাকিস্তানের উভয় অংশ থেকে ছাত্র ও বুদ্ধিজীবীদের আমেরিকায় প্রচার অভিযান চালানোর জন্য পাঠান হলে সুফল পাওয়া যাবে বলে তিনি মনে করেন। সোভিয়েত ইউনিয়নে নিয়োজিত রাষ্ট্রদূত জামসেদ মার্কার মনে করেন, পাকিস্তানের সঙ্গে রাশিয়া কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করবে না। ভারত-সোভিয়েত চুক্তি শুধুমাত্র দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার রাশিয়ার প্রতিপত্তি বৃদ্ধি করবে। এই চুক্তি চীনের বিরুদ্ধে যত বেশী, ‘পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তত নয়।’
যুক্তরাজ্যে নিয়োজিত হাই কমিশনার সালঅমান আলী বলেন, ব্রিটিশ সরকার পাকিস্তানের দৃষ্টিভঙ্গির সংগে একমত নন। বিভিন্ন বাঙালী প্রতিষ্ঠানের কার্যকলাপের বিরোধীতা করার জন্য তিনি ‘পাকিস্তান সলিডারিটি’ প্রতিষ্ঠান গঠন সহায়তা করেছেন বলে প্রকাশ করেন। ব্রিটেনের সংবাদপত্র ইহুদীদের করায়ত্ত বলেই পাকিস্তান –বিরোধী এবং শ্রমিক দল ১৯৪৭ সালের দেশ- বিভাগ বানচাল করার জন্য বদ্ধপরিকর। তিনি শ্রীমতি গান্ধির যুক্তরাজ্য সফর এবং জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে শুরু হয়ার সম “দি টাইমস” ও অন্যান্য সনবাদপত্রে প্রচারমূলক বিজ্ঞাপন দেওয়ার প্রস্তাব করেন। তা ছাড়া তিনি পূর্ববঙ্গে অবাঙালী হত্তা সম্পর্কিত পাকিস্তানী চলচিচত্র প্রদর্শনের ব্যবস্থা করবেন। চীনে নিয়োজিত রাষ্ট্রদূত কে এম কায়সার বলেন, চীন বাংলাদেশের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে রাজী নয়। বাংলাদেশের প্রতি ভারতের সমর্থন সন্দেহজনক বলে চীন মনে করে। ভারত- সোভিয়েত চুক্তির খবর চীনের সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়নি। তারা মনে করে এই চুক্তি তাদের স্বার্থ বিরোধী। চীন আফগানিস্তান, বার্মা, সিংহল ও নেপালের সংগে সম্পর্ক উন্নয়ণের চেষ্টা করবে। ভারত- পাকিস্তানের যুদ্ধ শুরু হলে চীন কি ধরনের সাহায্য দেবে সে সম্পর্কে মিঃ কায়সার নিশ্চিত নন।
জাতিসংঘে নিয়োজিত পাকিস্তানী রাষ্ট্রদূত আগাশাহী বলেন,জাতি সংঘের আসন্ন সাধারণ অধিবেশনে ভারত বাংলাদেশের ব্যাপারে সদস্য-দেশগুলির জোরালো সমর্থন পাবে।তা এড়াতে হলে বেসামরিক সরকারি প্রতিষ্ঠা, উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাস্তহারাদের দেশে ফিইয়ে নেওয়া, বরতমান খাদ্য সমস্যার এবং শেখ মুজিবের বিচার স্থগিত রাখার ব্যাপারে কার্যকরী পন্থা গ্রহন করতে হবে। তিনি আরো বলেন, মার্কিন সংবাদপত্রগুলি , বিশেষ করে “নিউ ইয়র্ক টাইমস”, “ওয়াশিংটন পোষ্ট”, “টাইম” ও “নিউজউইক” পত্রিকা পাকিস্তানের প্রতি বিরুপ মনোভাবাপন। যুগোশ্লাভিয়ায় নিয়োজিত রাষ্ট্রদূত আই ই আখুন্দ বলেন, যুগোশ্লাভ সরকার পাকিস্তানের প্রতি শাহানুভূতি সম্পন্ন, কিন্তু তারা বাংলাদেশের বিদ্রোহ ভারতের হাত রয়েছে বলে বিশ্বাস করে না। ফ্রান্স, পশ্চিম জার্মানী, বেলজিয়াম, হল্যান্ড ও সুইজারল্যান্ডে নিয়োজিত পাকিস্তানী রাষ্ট্রদূতরা বলেন, এসব দেশের সরকার বাংলাদেশ সরকার সম্পর্কে পাকিস্তানের বক্তব্য মেনে নিতে রাজী নয়। পোল্যাণ্ড ও চেকোশ্লোভাকিয়াও পাকিস্তানের সঙ্গে একমত নয়। শুধুমাত্র ফ্যাসিষ্ট ফ্র্যাংকোর স্পেন পাকিস্তান সরকার সমর্থন করে। (“বাংলাদেশ নিউজলেটার” নভেম্বর ১৯৭১) (স্বাঃ সং: গ্রঃ বাঃ পৃঃ ১৩৪-৩৫)
Reference:
একাত্তরের দশ মাস – রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী