বাংলার বাণী
ঢাকা: সোমবার ১৪ই ফাল্গুন, ১৩৭৯ ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৩
আর অস্ত্রের ভাষায় নয়
এদেশে অস্ত্রের ভাষায় কেউ কথা বলবে না-এ ছিল স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের কামনা, অভিলাষ। সে অভিলাষ সে কামনা তাদের সফল হয়নি। মুক্ত স্বদেশে অবিরাম চলেছে অস্ত্রের ঝংকার, চারিদিকে সর্বগ্রাসী রণদামামা। সেই হিংসা আর উম্মাদনার মাঝেও একটি কণ্ঠ বারে বার শুধু আহ্বান জানিয়েছেন, অনুরোধ করেছেন, আকুল আবেদন রেখেছেন সকল রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, শান্তিকামী সকল সচেতন জনগোষ্ঠীর কাছে; আর যুদ্ধের দামামা নয়, অস্ত্রের হুঙ্কার ছেড়ে এসো সবে একসাথে শান্তির লক্ষ্য পথে যাত্রা শুরু করি।
কিন্তু সেই মহৎ কন্ঠের আবেদনে সাড়া দিয়ে এগিয়ে আসেনি হিংসার অপদেবতারা। প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে চলেছে তাদের রণপ্রস্তুতি। ন’মাসের স্বাধীনতা সংগ্রামে আপনজন হারা লক্ষ কোটি জনতার বিরুদ্ধে ঘোষিত হয়েছে নবতর যুদ্ধ। বঙ্গবন্ধু যখন আহ্বান জানিয়েছেন শান্তির পথে এগিয়ে যাবার তখন এই রক্তলোলুপ ক্ষুদে ক্ষুদে স্বার্থকামী রাজনৈতিক গোষ্ঠী বিশেষ পাঁয়তারা করেছেন আর এক সাগর রক্তের স্রোত বইয়ে দিতে বাংলার পথে প্রান্তরে সবুজ ঘাসে। এক উচ্ছৃংখল প্রতি বিপ্লবের প্রত্যাশা বুকে বেঁধে রাজনৈতিক অঙ্গনে নেমেছে নূতন-পুরা রাজনৈতিক ধুরন্ধরেরা।
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে এদেশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, চিন্তা চেতনার প্রতিফলন ঘটিয়ে যে রাষ্ট্রীয় আদর্শের কথা ঘোষণা করা হয় তার ন্যূনতম মূলস্তম্ভ ছিল গণতন্ত্র। মূলতঃ এই গণতন্ত্রের সংগ্রামে বাংলার মানুষ বারে বার ঝাঁপিয়ে পড়েছে স্বৈরাচারী শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে। অত্যাচার-নির্যাতন আর শাহাদাত বরণের নিত্যনৈমিত্তিকতার ভিতর দিয়ে যে গণতান্ত্রিক সংগ্রাম একদিন স্বাধীনতা সংগ্রামের রূপ গ্রহণ করল তা চরমতম সাফল্য অর্জিত হবার পর অতীতের সেই গণবিরোধী শক্তি আবার নতুন কায়দায় মাঠে নেমেছে দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের মূলে কুঠারাঘাত করার প্রচেষ্টায়। বঙ্গবন্ধুর সেই অভিসন্ধি সম্বন্ধে সম্পূর্ণ সজাগ থেকে স্বাধীনতা-উত্তরকালে মাত্র এক বৎসরের মধ্যে গণপ্রতিনিধিদের তারা প্রণীত একটা গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্রের ভিত্তিতে দেশব্যাপী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। আজ থেকে আর ন’দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে চলেছে। কিন্তু সেই নির্বাচনকে সামনে রেখে ও অস্ত্রের শক্তিতে বিশ্বাসী একশ্রেণীর লোক অবিরামভাবে অস্ত্রের ভাষায় কথা বলছেন। সাধারণ গণতান্ত্রিক রীতিনীতি কে পদতলে পিষ্ট করে গুপ্তহত্যা আর সার্বিকভাবে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ঘোষণার হুমকি দিয়ে চলেছেন। জনগণের চিন্তা বিবেক আর চেতনার প্রতি এতোটুকু শ্রদ্ধা না দেখিয়ে বলা হচ্ছে নির্বাচন নয় শক্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হবে তারই অধিকার রয়েছে দেশ শাসনের। গণতান্ত্রিক সহিংসতায় আদর্শে উজ্জীবিত গণসংগঠন তাদের এই ধৃষ্টতা ও হামলা হুমকি জবাব জনগণ ব্যালটের মাধ্যমে প্রকাশ পাবে বলে আশা পোষণ করছেন। এবং একবার যখন জনগণের রায় স্থিরিকৃত হয়ে যাবে যে, বুলেট নয় ব্যালটের মাধ্যমে গণশাসনের ম্যান্ডেট গ্রহণ করতে হবে তখন সময় আসবে কঠোর হস্তে জনগণের ইচ্ছে অনুযায়ীই অস্ত্র শক্তির মহাজনদের এ দেশ থেকে উৎখাত করবার।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর নির্বাচনী সফর এর একপর্যায়ে নওগাঁর বিশাল জনসমাবেশের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিতে গিয়ে সেই ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রূপ দেখে একটা পরিষ্কার ছবি তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশে কাউকে আর অস্ত্রের ভাষায় কথা বলতে দেয়া হবে না। শুধু তিনি কেন বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ আন্তরিকভাবে সেই কামনা করেন। আর যেন অস্ত্র হাতে কোন বর্গী তাদের সম্পদকে লুটে নেবার সাহস না পায়, অস্ত্র শক্তিতে কোন ক্ষমতাশালী যেন কেড়ে নিতে না পারে তাদের আপনজন। এমনিতেই আমরা অনেক হারিয়েছি। ধন জন, সঞ্চিত সর্বশেষ সামগ্রীটি পর্যন্ত। আজ সূর্য সন্তানার দিনে বাংলার মানুষ চায় শান্তি সমৃদ্ধি। ঐক্যবদ্ধ সহযাত্রী আমরা, লক্ষ সেই শান্তির দুয়ার।
খুটার জোরে পাঠায় কুঁদে
লাওসের প্রধানমন্ত্রী সুভান্না ফুমা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে পুনরায় বোমা বর্ষণ শুরু করার জন্য অনুরোধ করেছেন। তার অভিযোগ লাও সরকারকে প্যাথেটলাও প্রতারণা করেছে।
প্রধানমন্ত্রী সুভান্না এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন যুদ্ধ বিরতির পর প্যাথেটলাও গেরিলাদের অধিকৃত এলাকাগুলো পুনরুদ্ধারে লাও সরকারকে সাহায্য করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে বোমাবর্ষণ শুরু করবে এ বিশ্বাস তাঁর আছে।
প্রিন্স সুভান্না ফুমো যে অভিযোগ উত্থাপন করেছেন তা নতুন কিছু নয় আগেই বোঝা গিয়েছিল এমনি একটা কিছু হবে। যদি তাই না হবে তাহলে কত ২২শে ফেব্রুয়ারি লাওসে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর মাত্র চারটি দিন অতিবাহিত হতে না হতেই প্রিন্স সুভান্না ফুমা এতটা হম্বি-তম্বিই বা করবেন কেন? কথায় বলে খুঁটার জোরে নাকি পাঠা কুঁদে। প্রিন্সের ও হয়েছে সেই দশা। ভিয়েতনাম শান্তি চুক্তি সম্পাদন কালে মার্কিন সরকার জানিয়ে দিয়েছেন, প্রয়োজনে তারা লাও সরকারকে সাহায্য করবেন। শুধু তাই নয় ভিয়েতনাম মুক্তিবাহিনী অথবা উত্তর ভিয়েতনামের সৈন্য বাহিনী যাতে নতুন করে কোনো আক্রমণ চালাতে না পারে সেজন্য থাইল্যান্ডে মার্কিন সামরিক বিমান ঘাঁটি থাকবে।
সর্বশেষ সংবাদ এর জানা গেছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জন্য মার্কিন হাইকমান্ডও লাওসের প্রধানমন্ত্রী প্রিন্স সুভান্না ফুমার অনুরোধে লাওসের উপর সীমিত বিমান আক্রমণ শুরু করার অনুমতি দিয়েছে। স্পষ্টতঃই বোঝা যাচ্ছে যে, মার্কিন সরকার সহজে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মাটির থেকে হাত গুটিয়ে নেবেন না। তবে ঘরে-বাইরের জনমত আভ্যন্তরীণ সমস্যা ও সংকটের জর্জরিত হয়ে সাময়িকভাবে শান্তি চুক্তিতে স্বাক্ষরদান করেছেন।
অবশ্য মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিব মিঃ উইলিয়াম রজার্স বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনাম যুদ্ধে সমাপ্তির পর আন্তর্জাতিক ঘটনাপ্রবাহে বৃহৎ কোন ভূমিকা এড়িয়ে যাবে।
মিঃ রজার্স সঙ্গে সঙ্গে একথাও বলেছেন, বিশ্ব ঘটনাপ্রবাহ থেকে সম্পূর্ণ সরে দাঁড়ানোর মতো ভুল পদক্ষেপ তারা গ্রহণ করতে রাজি নয়। এ ব্যাপারে তারা একটি ‘বাস্তব ভিত্তিক উদ্যোগ’ নীতি প্রণয়ন করেছে।
মিঃ রজার্সের বক্তব্য থেকে এটা স্পষ্ট যে, মার্কিন সরকার কোনো কিছু থেকেই একবারে হাত গুটিয়ে নেবেন না। যেমনটা নেননি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ব্যাপারে। এখনো সেখানে যেয়ে বংশবদরা রয়েছেন তারাই মার্কিন সরকারকে সম্ভাষণ জানাবেন তাদের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাক গলাবার জন্য। প্রিন্স সুভান্না ফুমার বর্তমান কার্যকলাপ সে ইঙ্গিত বহন করছে। তবে একথা দিবালোকের মত সত্য যে, যতই বাইরের শক্তি আমদানি করা হোক না কেন তাতে কোন লাভ হবে না। ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ার জনসাধারণের মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে বোমা বর্ষণ দিয়ে দাবিয়ে রাখা যাবে না। যেমনটি রাখা যায়নি উত্তর ভিয়েতনামকে। প্রিন্স সুভান্না ফুমা আর মার্কিন সরকার এ সত্যকে যত আগে উপলব্ধি করবেন ততই মঙ্গল।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক