You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী

ঢাকা: রোববার ১৩ই ফাল্গুন, ১৩৭৯ ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৩

এটাই হোক শেষ নির্দেশ

এবার শুধুই নির্দেশ নয় তাতে কড়া ঝাঁঝ মিশিয়ে আদেশ করেছেন বঙ্গবন্ধু প্রশাসনের সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন এর জন্য। তার নিজের কাছে কোন ফাইলে বাংলার নোট না লিখে পাঠালে সংশ্লিষ্ট কর্মচারীর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলেও সে নির্দেশনামায় বলা হয়েছে। বাঁকা আঙ্গুলেই ঘি ওঠে। এবার অবস্থাটা কোন দিকে মোড় নেয় সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখছেন জনগণ, একুশের শপথের প্রদীপ্ত বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ।

কিন্তু তারা কারা? নিজের মুখের ভাষাকে স্ব-মর্যাদায় আসনদানে যাদের এত অনীহা। অবশেষে কিনা আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের হুমকি দিয়ে তাদের বাংলা ভাষা প্রচলন বাধ্য করতে হয়। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে অন্ততঃ এমন অবস্থা কেউ আশা করেনি।

আমরা অনেকেই এমন অনেক কিছু আশা করিনি যা বাংলাদেশ নিত্যনিয়ত ঘটে চলছে। বঙ্গবন্ধু শুধু প্রধানমন্ত্রী নন একটা সশস্ত্র বিপ্লবের কর্ণধার; সারা জাতির হৃদয়ে যার আসন পবিত্রতম বেদীতে প্রতিষ্ঠিত। তিনি নির্দেশ করেন অথচ তাকে অবহেলা করা হয়, বিভিন্ন ক্ষেত্রে অমান্য করার দৃষ্টান্তও রয়েছে। কিন্তু কেন? এই সাহস প্রশাসনের নাট-বল্টু-স্ক্রু এর দল পায় কোত্থেকে? সাজার শাসন দেখিয়ে যে মানুষকে নিজ ভাষায় কথা বলাতে হয় তাদের প্রয়োজন কি বাংলাদেশের আদৌ আছে? শুধু নতুন করে পুরান নির্দেশেই নয় বরং এ প্রশ্নে সুস্পষ্টভাবে একটা সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রয়োজন অদূর ভবিষ্যতে দেখা দিতে পারে।

বঙ্গবন্ধু স্বয়ং সেই স্বাধীনতার পর মুহূর্ত থেকে সকল কাজ বাংলায় করে আসছেন। বিভিন্ন ফাইলে দস্তখতদান থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় সকল অনুষ্ঠানে ভাষণদান পর্যন্ত সবকিছুই বাংলায় চলে আসছে। শুধু চলছেনা পাকিস্তানি আমলের কেনা গোলাম জিন হুজুর আমলা গংদের দরবারে। ওই দরবার টা ভেঙে দিতে হবে। কেতাদুরস্ত সাহেবদের এবার ঝেটিয়ে বিদেয় করবার সময় এসেছে। প্রতিক্রিয়াশীল মগজটাকে ধোলাই করবার কোন মহৌষধ কি সরকারের জানা আছে? বাংলার মানুষ কিন্তু জানে।

বঙ্গবন্ধু নির্দেশ দিয়েছেন। এই শেষ নির্দেশ হোক বাংলা ভাষার প্রচলন এক্ষেত্রে সে কামনাই আমরা করি। আবার চুয়াত্তুরের একুশে যাতে এই নির্দেশেরই পুনরাবৃত্তি না ঘটে। না, দেখতে হয় প্রশাসনের চেয়ারে গদিতে প্রতিক্রিয়াশীল মানসিকতার ঘাঁটি আবর্জনাস্তুপদের। শুধু বায়ান্নর একুশে নয় গত দু যুগের প্রায় প্রতিটি বৎসরে অসংখ্য মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে আমাদের জাতীয় স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্র‍ অর্জনের জন্য। কটি ক্ষুদে সাহেবদের জন্য তা বৃথা হয়ে যাবে এটা হতে পারে না, হবেও না। শেষবারের মতো আশায় বুক বেঁধে আমরা লক্ষ্য করছি। আগামী দিনে গণবিরোধী মানসিকতা কি পরিমাণ স্থান দখল করে রাখতে সক্ষম হয়। এটা একটা চ্যালেঞ্জ, প্রতিক্রিয়াশীল গণবিরোধী মানসিকতার সঙ্গে জাতীয় অগ্রযাত্রা ও শুভকামী প্রগতিশীল চিন্তা চেতনার। এ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে হবে শুধু সরকারকেই নয় বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকেও।

জল্লাদের বিচার

পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট জল্লাদ শিরোমনি ইয়াহিয়া খান এর বিচার করার জন্য প্রেসিডেন্ট ভুট্টো ক্রমশ বড় রকমের চাপের সম্মুখীন হচ্ছেন। ইয়াহিয়া খানের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে তিনি বাংলাদেশে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করেছেন। ইয়াহিয়া দেশদ্রোহী। পাকিস্তানি পত্র-পত্রিকা ইয়াহিয়ার বিচার দাবি করে অভিযোগ করেছে, তার নির্দেশে ও জ্ঞাতসারেই বাংলাদেশে ইতিহাসের জঘন্যতম অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। এই কলঙ্ক থেকে পাকিস্তানিরা অব্যাহতি চায়।

সাপ্তাহিক আউটলুক পত্রিকার সম্প্রতিক সংখ্যায় প্রকাশিত একটি নিবন্ধে বলা হয়, পাকিস্তানকে এখন তার নিজের কাছেই এবং যে অংশটি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে তার কাছে জবাবদিহি করতে হবে। এর জন্য যারা দায়ী তাদের বিশেষত এদের মূল পান্ডার বিচার করে শাস্তি দিতে হবে। যদি এ ব্যাপারে কোন কিছু না করা হয় তবে অনন্তকাল ধরে জাতিকে এই কলঙ্কের বোঝা বহন করতে হবে।

নিবন্ধে ইয়াহিয়ার বিরুদ্ধে বেআইনিভাবে ক্ষমতা দখল, অসাদাচরণ, ইচ্ছাকৃতভাবে কর্তব্যে অবহেলা ইত্যাদি অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে।

নিবন্ধকার বলেছেন, ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ থেকে ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাংলাদেশ মাত্রাতিরিক্ত অত্যাচার করেছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ উল্লেখ করা যায় শহর-গ্রামে গণহত্যা জনপদ ও গ্রামাঞ্চল ধ্বংস করা হয়েছে। লাখ লাখ মানুষকে ভারতে চলে যেতে বাধ্য করা হয়েছে ২৫শে মার্চ রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বারোজন জন অধ্যাপক ও অসংখ্য ছাত্রীকে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করা হয়েছে এবং তাদের উপর অত্যাচার করা হয়েছে।

কথায় বলে ধর্মের ঢোল নাকি বাতাসে বাজে। পাকিস্তানের শান্তিকামী জনসাধারণ বাস্তবতার আঘাতে আজ আসল চিত্রটিকে সম্যকভাবে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছেন। তারা স্পষ্ট বুঝতে পেরেছেন বাংলাদেশ নজিরবিহীন গণহত্যা, ধ্বংসযজ্ঞ, লুঠ, অগ্নিসংযোগ ও নারী নির্যাতন চালানো হয়েছিল। আর এ মানবতাবিরোধী ন্যক্কারজনক কার্যকলাপের নায়ক ছিলেন ইয়াহিয়া খান।

পাকিস্তানের জনসাধারণ একথাও বুঝতে পেরেছেন যে, সেদিনকার হত্যাযজ্ঞের নায়ক শুধুমাত্র ইয়াহিয়াই ছিলেন না-তার সঙ্গে ছিলেন আরও অনেকেই। তাই পাকিস্তানের বর্তমান প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টোর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে। কিছুদিন আগে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল খুনি ইয়াহিয়ার বিচার হবে। কিন্তু সেটা যে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতোই একটা কিছু ছিল তা বুঝতে আজ আর কারো অসুবিধা হবার কথা নয়। তাই প্রেসিডেন্ট ভিক্টর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি জনতার রুদ্ররোষ থেকে জল্লাদ শিরোমনি ইয়াহিয়াকে বাঁচাবার জন্য নামকাওয়াস্তে একটি কমিশন গঠন করেছেন। শুধু তাই নয় এখন কমিশনের সুপারিশ কোন কাজে লাগানো হচ্ছে না।

এটা আজ দিবালোকের মতো স্পষ্ট, প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো আর যা-ই করুন খুনি ইয়াহিয়া খানকে আদালতের কাঁঠগড়ায় দাঁড় করাতে সক্ষম হবেন না। তার পক্ষে তা সম্ভব নয়। কেননা তাহলে তো অনেক গোপন কথা, ষড়যন্ত্র ও আরও চক্রান্তের কাহিনী বেরিয়ে পড়বে। পাকিস্তানের জনসাধারণ জানতে পারবে বাংলাদেশের তিরিশ লক্ষ মানুষ হত্যা, দু’লক্ষের বেশি নারী নির্যাতন, শতকরা চল্লিশটি ঘরবাড়ি ধ্বংস করা, যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করা এবং মজুদ খাদ্যশস্য পুড়িয়ে দিয়ে একটা দেশ শ্মশানে পরিণত করার প্রত্যক্ষ নায়ক শুধুমাত্র ইয়াহিয়া খানই নয়-ভুট্টো, টিক্কা, নিয়াজী, ফরমান আলী ও আরো অনেকে।

ভুট্টা নিজের পাপকে ধামাচাপা দেবার জন্য এবং জনমতকে বিভ্রান্ত করার জন্য মাঝেমধ্যে ইয়াহিয়ার বিচারের কথা বলেন বটে কিন্তু তা শুধু কথার কথা মাত্র। যদি তাই না হবে তাহলে খুনির টিক্কা খান কি করে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী প্রধানের আসনে বসেন।

ভুট্টো সাহেব ইয়াহিয়ার বিচারের বিষয়টি নিয়ে যতই তালবাহানা করুক না কেন পাকিস্তানের মাটিতে একদিন না একদিন বিচার হবেই এবং তার সঙ্গে ভুট্টো, টিক্কাকেও দাঁড়াতে হবে আদালতের কাঠগড়ায়। পাকিস্তান আজ জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরিতে পরিণত হয়েছে। ঘরে-বাইরের সংকটে জর্জরিত পাকিস্তান। বেলুচিস্তান উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এ বিক্ষোভ আর বিদ্রোহের আগুন জ্বলছে। পাকিস্তানি জনসাধারণের পক্ষ থেকে খুনি ইয়াহিয়ার বিচারের দাবি উত্থাপন এর পেছনে সত্যই প্রতিফলিত হচ্ছে যে, ভবিষ্যতে যাতে পাকিস্তান আবার একটা সামরিক জান্তার লীলাভূমিতে পরিণত না হয় সেজন্যই ইয়াহিয়ার বিচারের প্রয়োজন।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!