রাজনৈতিক কলহ
মুজিববাহিনীর চার নেতার নাম আমি দিয়েছিলাম ‘অবিচ্ছেদ্য চার’। তারা হচ্ছেন শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম, তােফায়েল আহমদ এবং আব্দুর রাজ্জাক। তারা সবাই সবাইকে শ্রদ্ধা করতেন। তাঁরা একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া করতেন, ঘুমাতেন এবং কথাবার্তা বলতেন। তাঁদের কেউ একজন যদি মুজিববাহিনীর ছেলেদের উদ্দেশ্যে উদ্দীপনাময় বাণী দিতেন তাে তাতে অবশ্যই অন্য তিনজনের নাম উলে-খ করতেন। আমার মনে হত তাঁদের নিজেদের মধ্যে মনিই নেতা হিশাবে গণ্য হতেন সম্ভবত শেখ মুজিবের সাথে তার আত্মীয়তার কারণে। যখন আমাদের প্রত্যয় হল যে এই নেতৃত্বই আয়ুবকে ক্ষমতাচ্যুত করা ছাত্র বিদ্রোহের জন্য দায়ী এবং শেখ মুজিবের আস্থা যে তাদের ওপরে আছে তার কিছু প্রমাণও পেলাম, তখন আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম তারা যতদূর নিতে পারেন ততদূর পরিমাণ সাহায্য তাদেরকে করব। তারা তাদের ছেলেদের গেরিলা যুদ্ধে প্রশিক্ষণ দানের ব্যাপারে উদগ্রীব ছিলেন। আর তা দানের সেরা যােগ্যতা ছিল আমাদের হাতে। আমি শুধু মানুষকে নিয়মিত ও কমান্ডাে টাইপ অপারেশনের প্রশিক্ষণ দিতে পারত যার জন্য হাজার হাজার ছেলে-যুৰা এগিয়ে আসছিল এবং প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত হয়ে মুক্তিবাহিনীর অংশ হয়ে যাচ্ছিল। এই নেতারা আমাদের জানালেন যে অনাকাক্ষিত অনেক লােক-বাংলাদেশে নকশালপন্থীদের মতাে যারা প্রশিক্ষণ এবং অস্ত্র পাচ্ছে। তারা আমাদের সতর্ক করে দিলেন যে এই সব অস্ত্র পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ব্যহৃত হবে না বরং লুকিয়ে রাখা হবে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে নকশালপন্থী শাসন কায়েম করার কাজে ব্যবহারের জন্য। কার্যত তারা কিছু নকশালপন্থী কম্যুনিস্ট নেতার নাম উলে-খ করলেন যারা ঘটনাক্রমে কিছু বাংলাদেশি আর্মি অফিসারের আত্মীয়; সেই সব আর্মি অফিসার এখন মুক্তিবাহিনীতে, তাদের সাহায্যে ও সমর্থনে উক্ত কম্যুনিস্ট নেতারা স্বমতাবলম্বী বিপুল সংখ্যক কম্যুনিস্ট ক্যাডারকে রিক্রুট করিয়ে প্রশিক্ষিত ও অস্ত্রসজ্জিত করিয়ে নিতে সক্ষম হচ্ছে। এই ব্যাপারগুলি বিশ্বস্ততার সাথে সংশি-ষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরে আনা হয়েছিল কিন্তু স্পষ্টতই কোনও কাজ হয়নি। মুক্তিবাহিনীতে আরেক দল ফ্রীডম ফাইটার ছিল যারা সাম্প্রদায়িক এবং পাকিস্তানপন্থী । তারা স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের কাছে অস্ত্র সমর্পণে দৃঢ়ভাবে নারাজ ছিল বরং দেশজুড়ে এমনভাবে গােলমাল সৃষ্টিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল যাতে করে পাকিস্তান ফিরে আসতে পারে। ভাগ্যক্রমে তাদের সংখ্যা এসময়ে খুব বেশি ছিল না পাকিস্তান কর্তৃক বিশেষভাবে ও পাইকারিভাবে সংঘটিত নৃশংসতার কারণে।
তৃতীয় একদল ছিল; যারা ছিল খারাপ লােক বা ডাকাত, তারা দেখল সুবর্ণ সুযােগ, ভারতীয় খরচে শুধু আধুনিক অস্ত্র হাতে পাওয়ারই নয় বরং ঠিকঠাকমতাে প্রশিক্ষণ পাওয়ারও। আমি সরকারকে সতর্ক করেছিলাম যে মুক্তিবাহিনীর উপরি-উলি-খিত তিন ধরনের উপাদান একে অপরের সাথে হাত মেলাবে এবং লুকিয়ে রাখা অস্ত্র ব্যবহার করে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে গণ্ডগােল সৃষ্টি করবে। মুজিববাহিনীর নেতাদের সঙ্গে পরামর্শ করে আমি সকল মুক্তিযােদ্ধাদের যাচাই বাছাই -এর মােক্ষম পদ্ধতি তুলে ধরেছিলাম কিন্তু তা কাজে লাগানাে হয়নি। দিনের পর দিন এই নেতারা আমার কাছে ভবিষ্যৎ স্থিতিশীলতার প্রতি এইসব বিপদের অভিযােগ নিয়ে এসেছেন নতুন নতুন প্রমাণসহ। একই রকম নিয়মিতভাবে আমি তাদের নিশ্চয়তা দিতাম আমি আমার সাধ্যমতাে সব চেষ্টা করব এসব বন্ধ করার জন্য কিন্তু সব সময়ই আমি জানতাম আমরা বর্তমানে যে পরিস্থিতিতে আছি তাতে আসলে কিছু করা সম্ভব নয়। মুক্তিবাহিনীর বেশি বেশি সংখ্যক যােদ্ধাকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যাপারে চাপ বর্ধিত হারে বেড়ে চলেছিল। জোরটা ছিল সংখ্যার ওপরে এবং ঈপ্সিত সংখ্যায় তাদের পাওয়া যাচ্ছিল। একটা দায়সারা গােছের ব্যবস্থা ছিল যেখানে সাবেক পাকিস্তান ন্যাশনাল অ্যাসেবি-র দুজন বাঙালি সদস্যকে মনােনীত করা হয়েছিল তাদের খাঁটিত্ব সম্বন্ধে প্রত্যয়ন দেওয়ার জন্যে। বিশেষ স্বার্থসম্পন্ন লােকজন কর্তৃক তাদের কাছে আনা প্রত্যেকটি তালিকা আওয়ামী লীগ পার্টির এই সম্মানিত ব্যক্তিগণ এমনকি ভাসা ভাসা পরীক্ষা ছাড়াই প্রত্যয়ন করে দিতেন। একবার তালিকায় স্বাক্ষর করার পর তারা ভুল। লােককে প্রত্যয়ন দেওয়ার কথা স্বীকার করতে প্রস্তুত ছিলেন না। পুরা প্রক্রিয়াটা এমন যেনতেন ভাবে চলছিল যে এরকম ধারণা হওয়া সম্ভব ছিল এই এমএনএ-গণকে কোনও বিশেষ স্বার্থসম্পন্ন গােষ্ঠী দ্বারা বসানাে হয়েছে অথবা মুক্তির পর কী ঘটবে সে ব্যাপারটা তারা একটুও গায়ে মাখতেন না। বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার বলতে বস্তুত জনাব তাজউদ্দিনকে বােঝাত। যে জন্যই হােক মুজিববাহিনীর নেতাদের তা কখনও ভাল চোখে দেখত না এবং তাদের প্রত্যেকটি অভিযোেগকে তুচ্ছ, বাজে ও ছেলেমানুষিপূর্ণ বলে বিবেচনা করত। কর্নেল ওসমানী তার সরকার থেকে আদেশ গ্রহণ করতেন এবং বাইরে এই সব নেতার প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ হলেও তার স্বীয় সামগ্রিক কমান্ডের বাইরে মুজিববাহিনী নামে তাদের একটা আলাদা বাহিনী রাখা পছন্দ করতেন না। পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের জেনারেল অরােরা গােটা অপারেশনের ব্যাপারে চূড়ান্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি ছিলেন। তিনিও মুজিববাহিনীর ব্যাপারে খুশি ছিলেন কারণ সেটা সরাসরি তাঁর কমান্ডে রাখা ছিল না যদিও আমি মুজিববাহিনীর কমান্ডের দায়িত্বপ্রাপ্ত সৈনিক হিশাবে তাকে নিশ্চিত করে বলছিলাম যে মুজিববাহিনী বাংলাদেশের মধ্যে তার দেওয়া সকল কাজ সমাধা করবে, আমি সবসময় তার সংস্পর্শে থাকব ফলাফল জানানাের জন্য। তিনি তাতে সন্তুষ্ট হননি কারণ আমি নিজে ব্যাখ্যা করে বােঝানাের যথাসাধ্য চেষ্টা করলেও জেনারেল অরােরা এ অদ্ভুত কমান্ড কাঠামাের কারণ বুঝতে ব্যর্থ হন।
গণ্ডগােলের মূল যুবনেতারা সবসময় অভিযোেগ করতেন যে জেনারেল অরােরা’র জনাব তাজউদ্দিনের সাথে কিছু রাজনৈতিক বােঝাপড়া আছে, যেজন্য তারা দুইজনেই জোর দিতেন যেন মুজিববাহিনী তাদের কমান্ডে কাজ করে, যুবনেতাদের কমান্ডে নয়; কারণ জনাব তাজউদ্দিনের প্রতি তাদের কোনও আনুগত্য ছিল না। আমি জানতাম যে যুবনেতারা যেজন্যই হােক জনাব তাজউদ্দিনকে ভাল চোখে দেখতেন না। জনাব তাজউদ্দিনকে মনে হত কোনও একটা পরিকল্পনা নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের ব্যাপারগুলি পরিচালনা করছিলেন। তারা সবসময় ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন, কিন্তু জনাব তাজউদ্দিনের প্রতি তা ছিলেন না। ভুল বােঝাবুঝির অবসানের জন্য আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু তার মূল ছিল। অতীতে এবং অতীতে গঠিত মনােভাবগুলি দূর করার কোনও উপায় ছিল না। যুবনেতারা কোনও না কোনও ভাবে পুরনাে এমএনএ এবং এমপিএ -দের সম্মেলনকে প্রভাবিত করতে পেরেছিলেন এবং জনাব তাজউদ্দিনের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়েছিলেন এই মর্মে যে যেখানে অন্য একজনার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কথা ছিল সেখানে তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদটি জবরদখল করেছিলেন। আমার মনে হয় প্রধানমন্ত্রীর পদের জন্য তাদের পছন্দের ব্যক্তি ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। ব্যাপারটা একটা বিশ্রী অবস্থার জন্ম দিতে পারত কারণ যুবনেতারা জনাব তাজউদ্দিনকে তাদের কথামতাে তার যে স্থান তা দেখিয়ে দিতে ঝুঁকে পড়েছিলেন। এই পর্যায়ে অস্থায়ী সরকারে কোনও ভাঙন সৃষ্টি হলে গােটা আন্দোলনের জন্য তা সর্বনাশা হত । আমি মনে করি আমি এই। নেতাদের বােঝাতে সক্ষম হয়েছিলাম যে তারা যা করতে চাচ্ছিলেন তা করলে তাদের মিশনের জন্য অর্থাৎ বাংলাদেশের মুক্তির জন্য ভীষণ বিপদ ডেকে আনা হত এবং তা এমনকি আরও সাংঘাতিক পরিণতি ডেকে আনত মুক্তির পরের সময়ে । ভাগ্যিস তাঁরা স্বীকার করেছিলেন এবং যদিও ভিতরে ভিতরে তারা জনাব তাজউদ্দিনকে ভাজাপােড়া করছিলেন কিন্তু বাইরে আমার মতাে দুই একজন বন্ধু ছাড়া আর কেউ ব্যাপারটা জানত না।
আরও একটা, সম্ভবত আরও স্পর্শকাতর একটা সমস্যা ছিল যার দিকে আশু নজর দেওয়া দরকার ছিল। আসলেই এই নেতারা কিছু ভারতীয় কর্মকর্তাকে পরিচিত বাংলাদেশি নকশালপন্থীদের সাথে কথাবার্তা বলতে দেখেছেন বিলাসবহুল ভারতীয় হােটেলে; সেখানে তারা বাস করছিল বলেও তাদের মনে হয়েছে। যুবনেতারা এই লােকগুলিকে তাদের সবচেয়ে ঘােরতররা রাজনৈতিক শত্রু হিশাবে জানতেন পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক আইনের দিনগুলিতে। বস্তুত এদের বিরুদ্ধেই আওয়ামী লীগ তার যুব উইং সৃষ্টি করে। সুতরাং তারা বুঝতে পারলেন না কেন ভারত সরকার তাদের ঘাের শত্রুদের প্রতি এমন পক্ষপাতমূলক আচরণ করবে। তারা ভুল করে এই ভেবে অবাক হলেন যে আমাদের সরকার বাংলাদেশে একটা কম্যুনিস্ট পার্টিকে জোরদার করতে চায়, একটা কম্যুনিস্ট সরকার যদি না-ও চেয়ে থাকে। তারা নির্ভরযােগ্য সূত্র থেকে এও জানতে পারলেন যে মার্কসবাদী এবং মওলানা ভাসানীর লােকদেরকে অস্ত্র দেওয়া হয়েছে, আলাদা করে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। তারা এতে দারুণ হোঁচট খেলেন এবং স্বভাবতই ঝাল ঝাড়ার জন্য আমার কাছে ছুটে এলেন। আমাদের মধ্যে এরূপ কথােপকথন হল: যুবনেতাগণ- স্যার, আমরা আশা করিনি আপনারা নকশালপন্থী ও মার্কসবাদীদের প্রশিক্ষণ এবং অন্ত্রপাতি দেবেন যাতে আমরা গত পঁচিশ বছরে যা অর্জন করেছি তা বরবাদ হয়ে যায় । আমি হকচকিয়ে যাই, আমার মুখ লাল হয়ে যায় । আমি বলি: আপনারা এসব কী বলছেন? যুবনেতাগণ- আপনি বলতে চান আপনি জানেন না যে নকশালপন্থীদের প্রশিক্ষণ ও অন্ত্রপাতি দেওয়া হচ্ছে… (একটা জায়গার নাম বলে) জায়গায় এবং ভারতীয় কর্মকর্তারা তাদের নেতাদেরকে প্রথম শ্রেণির ভারতীয় হােটেলে রাখছেন ও তাদের সঙ্গে গল্পগুজব করছেন। আমি- আমি এমন ডাহা আজগবি কথা আগে শুনিনি । আমি সব সময় ভেবেছি কিছু শত্রু দালাল আমাদের মধ্যে ভাঙন ধরাবে। এখন বলেন আপনাদের মধ্যে এসব গুজব কারা ছড়াচ্ছে? যুবনেতাগণ আমরা নিজ চোখে দেখেছি এবং নিজ কানে শুনেছি, এর মধ্যে কোনও ভুলের সম্ভাবনা নেই। আমাদের মন ভেঙে গেছে এবং আমরা আমাদের সম্পূর্ণ মনােভাব পুনর্বিবেচনা করতে চাচ্ছি। আমরা আপনাকে সব সময় ভালবেসেছি আমাদের উদ্দেশ্যের ব্যাপারে আপনার আন্তরিকতার কারণে। এটা সম্ভব যে আপনার ঈশ্বরপরায়ণ প্রকৃতির কারণে আপনাদের সরকার আপনকে এ ব্যাপারে বিশ্বাস করে সব বলেনি।
এটা সম্পূর্ণ সম্ভব যে তারা এ পন্থায় কোনও বিদেশি শক্তির সঙ্গে সহযােগিতা করে তাদেরকে খুশি করতে চাইছে। দয়া করে খবর নিন এবং আমাদেরকে আপনার সরকারের পলিসি জানান। রাশিয়ানপন্থী কম্যুনিস্ট পার্টির কথা না হয় বােঝা যায়, তারা পুনর্গঠিত হলে যা কিছু হােক কেবলমাত্র কাগজেকলমে বিদ্যমান থাকবে; কিন্তু চীনপন্থী কম্যুনিস্ট পার্টি? আমার মুখে আর কথা জোগায় না। আমার কাছে কোনও উত্তর ছিল না। একমাত্র ঈশ্বর জানেন আমাদের দেশে এ ধরনের কোনও উদ্যোগের ব্যাপারে আমি কিছুই জানতাম । রাশিয়ার ব্যাপারে সপ্রশংস ছিলাম। তারা আমাদের প্রয়ােজনের সময়ে আমাদের সমর্থনে কত করেছে। কিন্তু আমি নিশ্চিত ছিলাম আমাদের দেশের ক্ষমতাবানদের কেউ বাংলাদেশে চীনপন্থী কম্যুনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করতে চাইবে না। যখন আমি যুবনেতাদের মনােভাব শ্রী আর, এন, কাও কে জানালাম, তিনি আমাকে অবাক করে দিয়ে প্রকাশ করলেন যে বাস্তবিকই মওলানা ভাসানীর নকশালাইট-রা কোনও এক স্থানে প্রশিক্ষণ পাচ্ছে। আমার প্রযত্নে তাদেরকে ছাড়া হয়নি কারণ তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে আমি ওরকম কোনও কাজ মনে-প্রাণে গ্রহণ করব না, এবং পরিস্থিতি যা হােক যুবনেতারা শিগগিরই তাদের আবিষ্কার করে ফেলত এবং দারুণ এক গণ্ডগােল দেখা দিত। এরকম একটা কিছু আবিষ্কার করব তার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। আমি সব সময় সচিব শ্রী কাও -এর প্রতি সশ্রদ্ধ ছিলাম । তার যােগ্যতা এবং সততা প্রশ্নাতীত ছিল। তিনিও একজন ঈশ্বরভীরু মানুষ ছিলেন এবং আমাকে দ্রতা ও দয়া দেখাতে তাঁর কখনও ভুল হত না। কিন্তু এক্ষেত্রে আমার বিরক্ত হওয়ার যথেষ্ট কারণ ছিল। যুবনেতাদের সামনে আমি ব্রিতকর অবস্থার মধ্যে পড়ে গেলাম । আমি প্রায় আমার বিশ্বাসযােগ্যতা হারাতে বসলাম, যদিও আমার নিজের দোষে নয়। যদি আমাকে এটা আগে বলা হত তাহলে আমি এর ন্যায্যতা প্রতিপন্ন করার মতাে কোনও অজুহাত দিতে পারতাম বা এটাকে এমনভাবে উপস্থাপন করতে পারতাম যাতে কাজপাগল লােকগুলি বুঝতে পারেন। শ্রী কাও স্রেফ বললেন- “আমরা বাংলাদেশ অস্থায়ী সরকারের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু। করিনি।
তারা ভাসানীর লােকদেরকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সংগ্রামে মস্ত সম্পদ হিশাবে দেখছেন। আমরা কিভাবে তাদের উপদেশ অগ্রাহ্য করি। দয়া করে আপনাদের যুবনেতাদের বলুন যে পছন্দ না করলেও এটা তাদের গিলতে হবে। আমরা তাদেরকে সমর্থন দেব শুধু সামগ্রিক প্রকল্পের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিশাবে, একটা স্বাধীন রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ হিশাবে নয়। তারা যদি ঠাণ্ডা না থাকে তাে তাদের দিয়ে আমাদের কিছু করার থাকবে না এবং তারা গােলায় যেতে পারে।” আমি জানতাম তিনি এসব বলেছেন অভিমানভরে, যা বলেছেন তা তার মনের কথা নয় কারণ কিভাবে তিনি আশা করতে পারেন বাংলাদেশে তাঁর আরব্ধ কাজ তিনি সম্পন্ন করতে পারবেন এই সবচেয়ে নির্ভরযা্যে এবং নিবেদিতপ্রাণ নেতৃত্ব ছাড়া, তিনি যা খুঁজে পেয়েছেন তার মধ্যে শ্রেষ্ঠ যা তাই ছাড়া । শ্রী কাও নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করে যাচ্ছিলেন ভীষণ চাপের মধ্যে, অতীব স্পর্শকাতর রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে এবং অসাধারণ সাফল্যের সঙ্গে। আমি অনুভব করছিলাম তার ওপর কিছু বাধ্যবাধকতা ছিল যা তিনি অতিক্রম করতে পারেননি। অনির্ভরযােগ্য লােকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার এই সুস্পষ্ট ভুল উদ্যোগে কোনও সুবিবেচনা আছে বলে আমার প্রত্যয় হল না এবং আমি তার অফিস ত্যাগ করলাম অনেক হতােদম অবস্থায়। আমি যুবনেতাদের বললাম কর্তৃপক্ষ স্বভাবতই বাংলাদেশের মুক্তির জন্য যুদ্ধ করতে প্রস্তুত এমন সবাইকে সাহায্য করছে তাদের নিজেদের অস্থায়ী সরকারের সুপারিশ অনুযায়ী। কিছু অবাঞ্ছনীয় লােক এর সুযােগ নিতে পারে, তা এই অসাধারণ পরিস্থিতিতে সম্পূর্ণ সম্ভব এবং এ কারণে তাদের দ্বিগুণ সতর্ক থাকতে হবে । যুবনেতাদের মধ্যে সন্দেহ, দুশ্চিন্তা রয়েই গেল। সুতরাং তারা তাদের গােপন ‘সেল’গুলি, গােপন আস্তানাসমূহ এবং সেগুলিতে যাওয়ার রাস্তা সম্বন্ধে আমাকে ছাড়া অন্য কাউকে বলার ব্যাপারে দারুণ সতর্ক হয়ে গেলেন।
আমি আত্মসম্মানের দোহাই দিয়ে তাদেরকে কথা দিয়েছিলাম যে তারা তাদের সংগঠন সম্বন্ধে যা কিছু বলবেন তা আমি অন্য কারও কাছে প্রকাশ করব না যতক্ষণ না তারা নিজেরা আগে তা প্রকাশ করেন বা করার জন্য বলেন। এসব তথ্য আমার জন্য খুব প্রয়ােজনীয় ছিল কারণ আমি সকল রকম পরিকল্পনা তাদের সহযােগিতায় করতাম। আমাদের একসঙ্গে কাজ করার মধ্য দিয়ে তাঁদের বিপুল বিশ্বাস আমি অর্জন করেছিলাম। আমি তাতে সম্মানিত বােধ করতাম এবং কোনও অবস্থাতেই সেই বিশ্বাস ভঙ্গ করতে আমি প্রস্তুত ছিলাম না। আমি তাদের গােপন কথা এমনকি তাদের নিজেদের সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের কাছেও ফাস করতে প্রস্তুত ছিলাম না। এমনকি তাদের প্রধানমন্ত্রীর কাছেও না। তাঁদের জোর সন্দেহ ছিল তাজউদ্দিন ষড়যন্ত্র করছেন স্বাধীনতার পর শেখ মুজিবকে ক্ষমতাচ্যুত করে নিজে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার। তাঁরা পরে আমাকে অকপটে বলেছিলেন-“তাজউদ্দিনের সঙ্গে তােমাদের কম্যুনিস্ট মন্ত্রী ডি.পি, ধর -এর আঁতাত আছে। আমরা তাদের দুজনার কাউকে বিশ্বাস করি না। এমনকি তোমার সরকারও জানতে পারবে না এরা দুজন স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের জন্য কী পরিকল্পনা করছেন।” তারা কর্নেল ওসমানীর কাছে কোনও তথ্য দিতে প্রস্তুত ছিলেন না, কর্নেল ওসমানী জনাব তাজউদ্দিনের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছিলেন। অথবা লেফটেন্যান্টজেনারেল অরােরার কাছেও না, যার সম্বন্ধে তাঁদের হিশাব ছিল যে তিনি তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের খেলা খেলছেন, কেন, তা তারা আন্দাজ করতে পারতেন না। তারা প্রায়ই আমাকে বলতেন যে জেনারেল অরােরা তাজউদ্দিনকে ভুলিয়ে ভালিয়ে শ্ৰীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করাতে ও মুজিববাহিনীকে তাঁর কমান্ডের অধীনে দেওয়ার ব্যাপারে চাপ দেওয়াতে চাইছিলেন। ফীল্ড মার্শাল এফ, এস, এইচ. জে. মানেকশ’, এসি পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের সদর দফতর আমার এবং আর্মি চীফ-জেনারেল, পরে ফান্ড মার্শাল, মানেকশ’ -এর মধ্যে কিছু ভুল বােঝাবুঝির সৃষ্টি করেছিল। তিনি আমার আর্মি ক্যারিয়ারে দুই দুইবার আমার ইনসট্রাক্টর ছিলেন, একবার কোয়েটা স্টাফ কলেজে এবং আরেকবার মহৌ -এ ইনফ্যান্ট্রি স্কুলে সিনিয়র অফিসারস কোর্স -এ। উভয় কোর্সেই মেধাসম্পন্ন কয়েকজন কর্নেল যােগ দিয়েছিলেন যারা পরে ভারতীয় আর্মির মেজর জেনারেল এবং লেফটেন্যান্ট-জেনারেল হয়েছিলেন । দুটি স্থানেই তিনি আমাকে শীর্ষ স্থান দিয়েছিলেন এবং আমার কৃতির জন্য আমাকে অভিনন্দিত করেছিলেন। এই ফীল্ড মার্শাল আমার দেখা সবচেয়ে তীক্ষ্ণ বুদ্ধির মানুষদের একজন। তার নিজস্ব একটা আকর্ষণ শক্তি ছিল। একজন মেধাবী রণকৌশলী, এবং জীবনের যে কোনও সমস্যার ব্যাপারে তাঁর অ্যাপ্রােচ ছিল অত্যন্ত যুক্তিবাদী ও প্রশস্ত মনােভাবাপন্ন। তাঁর এক অদম্য রসবােধ ছিল যা তার জীবনে প্রচুর ঝামেলার সৃষ্টি করেছে। প্রয়াত জেনারেল বি, এম, কাউলের সঙ্গে একবার তার লেগে গিয়েছিল এরকম সামান্য এক ঘটনায় । ব্যাপারটা জেনারেল কাউল নিজে আমাকে বলেছিলেন। জেনারেল কাউল স্বনির্ভর ভিত্তিতে প্রচুর সংখ্যক বাসভবন গড়ে তুলেছিলেন। বাসস্থানের স্বল্পতায় আর্মি হতােদ্যম হয়ে পড়ছিল, তার নিরসনের জন্যই তিনি কাজটা করেছিলেন । নিরবচ্ছিন্ন জরুরি অবস্থা চলত ।
অফিসাররা ও জওয়ানরা বেশির ভাগ সময় সীমান্ত বরাবর সময় কাটাত যেখানে স্বভাবতই কোনও পারিবারিক বাসা পাওয়ার উপায় ছিল না। বেশ কয় বছরের বিচ্ছিন্নতার পর তারা যখন তথাকথিত শান্তির স্টেশনে, যেমন আম্বালায়, পােস্টিং পেত তখন নিজেদের বাসা পাওয়ার জন্য তাদের অপেক্ষা করতে হত দুই বা তিন বছর । যখন কোনও একজনের নাম উঠত বাসার বরাদ্দ প্রাপ্তির তালিকায় ততদিনে তার আরেক দফা সীমান্ত বরাবর পােস্টিং -এর আদেশ এসে পড়ত । এটা সাংঘাতিকভাবে মনােবল ভেঙে দিত। সংশি-ষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে ব্যাপারটা উপস্থাপন করা হয়েছিল কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী। অর্থনৈতিক সংকটের কারণে কখনও এতদুদ্দেশ্যে যথেষ্ট তহবিল পাওয়া যেত না। সুতরাং জেনারেল কাউল চিন্তা করলেন স্বনির্ভর ভিত্তিতে কিছু একটা করা দরকার। তার স্বভাবসুলভ উদ্দীপনা, শক্তি এবং রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে তার প্রভাবের বদৌলতে ‘অমর প্রকল্প’ বলে এক প্রকল্প নেওয়া হল এবং তিনি এটা রেকর্ড পরিমাণ কম সময়ে এবং স্বল্পতম খরচে শেষ করলেন। প্রয়াত শ্রী কৃষ্ণ মেনন যিনি তখনকার প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ছিলেন, এবং প্রধানমন্ত্রী জওয়াহরলাল নেহরু, ব্যাপারটা দারুণভাবে পছন্দ করেছিলেন। তেমনি একটি প্রকল্প জম্মুতে শুরু করতে চাওয়া হল । জেনারেল মানেকশ’ ছিলেন সেখানে জেনারেল অফিসার কমান্ডিং (জিওসি)। সুতরাং জেনারেল মাকেশ আম্বালা আসলেন এ ব্যাপারে জেনারেল কাউলের সাথে পরামর্শ করতে। আম্বালায় অফিসারস মেসে এক ডিনার পার্টিতে কনিষ্ঠ অফিসারদের উপস্থিতিতে জেনারেল মানেকশ’ জেনারেল কাউলকে বললেন তার সঙ্গে কমান্ড বদল করতে এবং বললেন- “আপনি। বাড়ি বানাতে ওস্তাদ আর আমি প্রশিক্ষণে; আপনি জম্মুতে আমার কমান্ড নিন এবং বাড়ি বানান, আর আমি আপনার ডিভিশনের প্রশিক্ষণ দিই।” এসব কথা হালকাভাবে বলা হয়েছিল কিন্তু জেনারেল কাউল ছিলেন স্পর্শকাতর এবং সব ব্যাপারে সক্ষম হওয়ার জন্য গর্বিত ব্যক্তি। তিনি কথাটা হালকাভাবে নিলেন না। এতে দুই উর্ধ্বতন অফিসারের মধ্যে সংশােধনের অযােগ্য ভাঙনের সৃষ্টি হল যা পরে অনেক বিশ্রী জটিল ঘটনার জন্ম দিয়েছিল। যুদ্ধের পরে ফীল্ড মার্শল করাচিতে হালকা চালে একটা কথা বলে ঝামেলায় পড়েছিলেন। তিনি নাকি পাকিস্তানিদের বলেছিলেন যে তারা এ যুদ্ধে জিততাে যদি তিনি তাদের চীফ হতেন।
এ কথার কিছু গুরুতরাে ফল ফলেছিল দিলি-র রাজনৈতিক অঙ্গনে। যা হােক, ১৯৭১ -এর ইন্দো-পাক যুদ্ধের ইতিহাস লেখার সময় যখন আসবে, আমার সন্দেহ নেই ফীল্ড মার্শাল মানেকশ কর্তৃক প্রদর্শিত নেতৃত্বের গুণাবলি সে ইতিহাসে এক উজ্জ্বল স্থান দখল করবে। যখন আর্মি, নেভি এবং এয়ারফোর্সের মতাে তিনটি শক্তিশালী বাহিনীর একযােগে মসৃণভাবে কাজ করার ব্যাপার আসে তখন একজন শুধু দক্ষ নয় বরং সর্বাধিক কৌশলী এবং আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী আর্মি চীফের প্রয়ােজন হয় সমন্বয়ক হিশাবে। অন্যথায় কোনও সুফল আসতে পারে না। আমার মতে ফীল্ড মার্শলের সবচেয়ে বড় অর্জন ছিল অন্য দুই বাহিনীর চীফদের পূর্ণ সহযােগিতা লাভ করী। দেশের ভাগ্য যে এয়ার মার্শাল পি সি লাল এবং অ্যাডমিরাল নন্দ তাদের নিজ নিজ পেশায় অতিশয় দীপ্তিমান হওয়া ছাড়াও ব্যক্তিত্বে ছিলেন সৌহার্দ্যপূর্ণ, কিন্তু স্যাম মানেকশ’ ছাড়া বেশ কয়েক বারই খারাপ অবস্থার সৃষ্টি হতে পারত। ফীল্ড মার্শাল তাঁর ষাট বছর বয়সেও সুদর্শন এবং স্মার্ট। বুদ্ধিদীপ্ত রসবােধে আর আকর্ষণশক্তিতে পূর্ণ । অকপটতা ও ন্যায়পরায়ণতা দ্বারা তিনি এমনকি নিজ প্রতিপক্ষকেও কাবু করে ফেলতে পারেন। তিনি সেই অল্পসংখ্যক ফীল্ড মার্শালদের একজন যারা নিজ ভুল স্বীকার করবেন এবং অন্যের গুণ কিছু থাকলে তার স্বীকৃতি দেবেন। কেউ কোনও দোষ করলে তার প্রতি তিনি সদয় থাকেন। এটা এমন একটা গুণ যা আমাদের পরিস্থিতিতে দীর্ঘকালে কোনও সুফল দেয় না। তিনি আপনাকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করে নেবেন। তিনি যত সহজে শত্রু বানান তত সহজে বন্ধু বানান। কোনও কোনও দিক দিয়ে তিনি সেইসব ব্রিটিশ জেনারেলের ছাঁচে পড়েন যারা নিশ্চয়ই তাঁর দীর্ঘ আর্মি ক্যারিয়ারকে প্রভাবিত করে থাকবেন। তার ইংলিশ টাইপের চরিত্র ছিল, যেমন সময়ানুবর্তিতা, সঠিক পােশাক, মেসের দ্রতা, বিশ্বস্ত অধস্তনদের সঙ্গে সমপর্যায়ের মতাে ব্যবহার করা এবং তাদেরকে তাদের মতামত প্রকাশ করার সম্পূর্ণ সুযােগ দেওয়া। এটা তাকে যাদের তার কাছে যাওয়ার সহজ সুযােগ ছিল তাদের দ্বারা সহজে প্রভাবিত হওয়া সম্ভব করে তুলত। আমার দৃষ্টিতে এটা ছিল তার একটা দুর্বলতা যা তাকে অন্যদের ব্যক্তিত্বের ব্যাপার ভুল সিদ্ধান্তে উপনীত হতে উদ্বুদ্ধ করত।
বাংলাদেশের অপারেশনের ব্যাপারে দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী শ্রী ডিপি ধর -এর সাথে তার সম্পর্ক এত ঘনিষ্ঠ ছিল যে আমি একবার তাকে মন্ত্রীর পিঠ চাপড়ে দিতে দেখেছিলাম । এতে আমি একটু কেঁপে গিয়েছিলাম কারণ একজন মন্ত্রীর সাথে কোনও সার্ভিস চীফের এতটা সহজ হওয়া আমি কল্পনা করতে পারিনি। প্রয়াত শ্রী এলএন মিশ্রও তাঁর খুব বড় বন্ধু ছিলেন এবং তারা পরস্পরের সঙ্গে খুব সহজ ছিলেন । ফীল্ড মার্শালের সঙ্গে আমি একটা ভাল সংযােগ স্থাপন করেছিলাম কিন্তু পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের সদর দফতর তা বরবাদ করে দেওয়ার কোনও সুযােগই নষ্ট করত না। বাংলাদেশ অপারেশনস -এর সময়ে আমি ছিলাম দ্বৈত নিয়ন্ত্রণের অধীনে-একদিকে ফীল্ড মার্শাল, অদিকে রাজনৈতিক। ফীল্ড মার্শাল গােটা পরিস্থিতি অতিশয় ভালভাবে বুঝতেন এবং আমার সংগঠনগুলিকে -এজিববাহিনীকে ও পরে বিশেষ সীমান্ত বাহিনীকে (Special Frontier Force) তার পরিকল্পনার অঙ্গ করে নিয়েছিলেন যাতে করে তিনি অংশগ্রহণকারীদের বিশেষ চরিত্র ঠিক রেখেই এই আকনভেনশনাল সেট আপ থেকে সর্বাধিক সুবিধা বের করে নিতে পারেন। ধর এবং মিশ্র, এই দুই মন্ত্রীই প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন। এটা জেনারেল মানেক্শর জন্য বিরাট রাজনৈতিক সহায়তা নিশ্চিত করেছিল এবং বাংলাদেশ বিজয়ের পর তাঁকে সংগতভাবে ফীল্ড মার্শাল ব্যাংক দেওয়া হয়েছিল। আমি মনে করি তার এই ব্যাংক অর্জন করার জন্য যােগ্যতা ছিল সুপ্রচুর। তার সামরিক নেতৃত্বে আমাদের এক হাজার বছরের ইতিহাসে প্রথম এমন মাপের এক বিজয় আমরা অর্জন করেছিলাম যা শুধু এশিয়ার নয় বরং সারা বিশ্বের গােটা শক্তির ভারসাম্য পরিবর্তন করে দিয়েছিল এবং শান্তির প্রক্রিয়া এমনভাবে অগ্রসরমান করে দিয়েছিল যার স্বপ্ন দেখারও কোনও অধিকার আগে। আমাদের ছিল না। গােটা বিশ্ব আতঙ্কে হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছিল। প্রেসিডেন্ট নিক্সন ইতিহাসের গতি পরিবর্তনের শেষ চেষ্টা নিয়েছিলেন তাদের সবচেয়ে শক্তিশালী সপ্তম নৌবহর আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার ভয়াবহ হুমকি দিয়ে, যদিও তাতে আমরা সংকল্প থেকে টলিনি । ঐ সময় আমরা জানতাম না যে সােভিয়েত নৌবহর মার্কিন সপ্তম নৌবহরের ছায়ানুসরণ করছিল এবং নিক্সন রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ করার ঝুঁকি নিতে পারেননি। এই মহৎ উদ্যোগ দ্বারা রাশিয়া ভারতীয় জনগণের ভালবাসা অর্জন করল। কিন্তু আমি গল্পের অনেক সামনের দিকে এসে পড়েছি।
সূত্র : ফ্যান্টমস অব চিটাগং-দি ফিফথ আর্মি ইন বাংলাদেশ – মেজর জেনারেল (অব.) এস এস উবান