টাইম ম্যাগাজিন, ডিসেম্বর ২০, ১৯৭১
বাংলাদেশঃ যুদ্ধের গর্ভ থেকে একটি জাতির জন্ম
‘জয় বাংলা; জয় বাংলা’: মহান গঙ্গা থেকে বিস্তৃত ব্রহ্মপুত্র, পান্না ক্ষেত্র থেকে গ্রামের সরিষা রঙের পাহাড়, অগণিত গ্রামের অগণিত প্রান্তর থেকে ডাক উঠেছে – ‘জয় বাংলা, জয় বাংলা।’। তারা বাসের ছাদের উপরে নাচছিল এবং শহরের তাদের সংগীত সোনার বাংলা গাইতে গাইতে রাস্তায় নেমে মিছিল দিচ্ছিল। তারা ভবন থেকে অবাধে গোপন গোপন জায়গা থেকে বাংলার সবুজ, লাল এবং স্বর্ণ রঙের ব্যানার এনে উড়াচ্ছিল, তাদের কারারুদ্ধ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি উড়াচ্ছিল, রাতারাতি ট্রাক, হাউস ও পথনির্দেশক স্তম্ভে উঠে গেল। যেহেতু ভারতীয় সৈন্য প্রথমে যশোর, তারপর কুমিল্লা, তারপর রাজধানী ঢাকার উপকণ্ঠে গেছে, ছোট শিশুরা ট্রাক ধরে ঝুলছিল, বাঙ্গালিরা সর্বত্র তাদের অভিনন্দন জানাচ্ছিল তাদের স্বাধীন করতে সাহায্য করায়।
এভাবে গত সপ্তাহেএকটি যুদ্ধ শেষ বাংলাদেশ নামক নতুন জাতির জন্ম হয়। এ পর্যন্ত শুধুমাত্র ভারত ও ভুটান আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃত দিয়েছে। কিন্তু এটা জনসংখ্যার দিক থেকে বিশ্বের ১৪৮ টি দেশের মধ্যে অষ্টম। জনসংখ্যা (৭৮ মিলিয়ন), যা চীন, ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ইউ এস, ইন্দোনেশিয়া, জাপান ও ব্রাজিলের পিছনে। এর জন্ম অনেক জটিলতার মাঝে হয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানে, রাজনৈতিক উত্থান হয় এই পরাজয় এবং বিভাজনের পর। ভারতের নিজস্ব পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের পাশে একটি আলাদা বঙ্গরাজ্য সৃষ্টি হওয়ায় ৪৭ সালের স্বাধীনতার পর থেকে এখন সেখানে একটি উদ্যমী পরিবেশ তৈরি হয়েছে।
পাকিস্তানের বিভক্তি প্রায় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল যখন দুই সপ্তাহ আগে ইসলামাবাদ ভারতের কমপক্ষে তার বিপরীতে ভারত দুই দিনে পূর্ব পাকিস্তানের এয়ার ফোর্স ধ্বংস করে আকাশের দখল নেয়। বঙ্গোপসাগর আর ডেলটা গঙ্গায় ভারতীয় নেভি অপ্রতিদ্বন্দ্বীভাবে দখলে আছে। চট্টগ্রাম ও চালনা বন্দর দখলে রাখায় নতুন রসদ দরবরাহ, সৈন্য আগমন এবং পাকিস্তানি বাহিনীর পালিয়ে যাবার রাস্তা বন্ধ – যাদের সংখ্যা ৮০০০০ – এর বিপরীতে ভারতের আছে ২০০০০০। পাকসেনারা তাদের বসতি ঘাটি থেকে ১০০০ মাইল দূরে আটকে আছে।
সেখানে আরও বড় যুদ্ধ হচ্ছে যার মধ্যে আছে পাঞ্জাবি প্লেইন আর ট্যাঙ্কের সংঘর্ষ, দক্ষিণের মরুভূমিতে ১৪০০ মাইল বর্ডার জুড়ে ভারত ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে লোরাই চলছে – যেখানে দুই বাহিনীর প্রায় ২৫০০০০ জন যুদ্ধরত। সাধারণ জনগণ সীমান্ত এলাকা থেকে পালিয়ে যাচ্ছে। এবং করাচী, রাওয়ালপিন্ডি ও ইসলামাবাদ মূলত অবরোধ হয়ে আছে এবং অহোরাত্র মাথার উপর দিয়ে ভারতীয় প্লেন ভোঁ ভোঁ করে যাওয়ায় ভীতির সঞ্চার তৈরি হয়েছে।
জাতিসঙ্ঘ যুদ্ধ থামানোর জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে।কিন্তু তার সর্বোচ্চ চেষ্টা তেমন ভালো ছিলনা। তিন দিনের দহরররম মোহররম শেষে তাঁর সোভিয়েত ‘নিয়েটস’ এ থিতু হল, কাউন্সিল তখন নিরাপত্তা পরিষদে আরও বৃহৎ অথচ স্বল্প কার্যক্ষম রেজুলেশন মেনে নিল। যুদ্ধবিরতি দেয়া এবং পাকিস্তান ও ভারত উভয় দেশ সীমান্ত থেকে যাতে তাদের সৈন্য ধীরে ধীরে সরিয়ে নেবে এমন রেজোল্যুশন ১০৪ বাই ১১ ভোটে পাশ হয়।
পাকিস্তানিরা তাদের সৈন্যবাহিনী পেছানোর সঙ্গে সঙ্গে বলেছে ভারত যদি যুদ্ধবিরতি দেয় তাহলে তারা সেটাকে স্বাগত জানাবে। ইন্ডিয়ানরা বিজয়ের লক্ষ্য নিয়ে বলেছে তারা “বিবেচনা করছে” – তারা বলেছে পাকিস্তান তাদের সংখ্যা কমালেই আমাদের লক্ষ্য অর্জিত হবে এবং আমরা তা করব। এসেম্বলিতে তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী জোর করে বলার জন্য এর বাইরে আর কিছু করার ছিলনা। ভারত এই ব্যাপারে ততটা গুরুত্ব দিয়েছে বলে মনে হয়নি। কারণ তারা সব সময় জাতিসঙ্ঘকে বলে তারা শুধু অন্য দেশকে নানারকম আদর্শের উপদেশ দিয়ে থাকে। অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন যারা ভারতকে প্রতিরক্ষা বাড়াতে বলেছে – তারাও ইসরায়েলকে জাতসঙ্ঘের দেয়া আরব এলাকা থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের প্রস্তাব না মানতে উপদেশ দিতে কার্পণ্য করেনা।
আশাহীন কাজ
যাই হোক, এই মুহুর্তে যুদ্ধবিরতি পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক অবস্থার পরিবর্তন করবে না। ভারতীয় বাহিনী গত সপ্তাহে ঢাকার ২৫ মাইলের মধ্যে প্রবেশ করেছে এবং প্রতিবেদন প্রচারিত হয়েছে যে প্রায় ৫০০০ ভারতীয় প্যারাট্রুপার অবরুদ্ধ রাজধানীর পূর্বকোণগুলিতে অবতরণ করেছে। হাজার হাজার মানুষ ভয় পালিয়েছে এই ভেবে যে পাকিস্তানি সেনারা বড় আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিতে পারে। দৈনিক এবং প্রায়ই ঘনঘনভারতীয় প্লেন ঢাকা, করাচী এবং ইসলামাবাদের এয়ার পোর্টের উপর দিয়ে উড়ে যায়। ঢাকা এতিম খানার উপরে একটি পিস্টন ইঞ্জিন প্লেন ভূপতিত হওয়ায় প্রায় ৩০০ জন মারা যায়। ৭৫০ পাউন্ড বোমা নিয়ে এয়ারপোর্টের কাছে রহমত ই আলম ইসলামিক মিশনে একটি বিমান ভূপতিত হওয়ায় ৪০০ শিশু মারা যাবে। (পাকিস্তান বলে যে প্লেনটি ভারতের। কিছু বাঙ্গালি ও বিদেশিরা মনে করে এটি পাকিস্তানি। কিন্তু কিছু বিশেষজ্ঞ বলেন পিস্টন ইঞ্জিন শুধুমাত্র মুক্তিবাহিনীর কাছেই আছে।) এই সপ্তাহের শুরুতে নারায়ণগঞ্জে শ্রমিক আবাসনে দুইটি বড় বোমা পড়ায় ২৭৫ জন নিহত হয়।
চল্লিশজন শ্রমিক মারা যান এবং আরও ১০০ জন আহত হন। তাড়া বিমানের রানওয়েতে বোমার কারণে সৃষ্টি হওয়া ক্ষত মেরামতে নিযুক্ত ছিলেন। ভারত গত সপ্তাহে বিমান হামলা নেভিগেশনের উপরে একটি অস্থায়ী স্থগিত ঘোষণা করে। যাতে করে রানওয়ে মেরামত করা যায় এবং ৪০০ জাতিসঙ্ঘ রিলিফ কর্মি ও অন্যান্য কিছু বিদেশি ফিরে যেতে পারেন। এটা ঠিক করা হল – কিন্তু পাকিস্তানিরা তাদের সিদ্ধান্ত পাল্টাল। তারা জাতিসঙ্ঘের কর্মিদের ঢাকায় অবতরণ করতে দিবে না। তারা মূলত আটকে আছে। আন্তর্জাতিক রেড ক্রস হলি ফ্যামিলির পাশে অবস্থিত ঢাকা ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলকে আহতদের রিসিভ করা ও বিদেশিদের জন্য নিউট্রাল জোন হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে।
পাকিস্তানি সেনারা কিছু বাঙালিদের ভারতের তথ্যদাতা বা সাহায্যদাতা সন্দেহে হত্যা করেছে। কিন্তু প্রতিহিংসামূলক প্রতিক্রিয়া তেমন ব্যাপক স্কেলে ছিল না। পূর্ব পাকিস্তানে বেসামরিক ও সামরিক উভয় প্রকারের হতাহতের পরিমাণ মোটামুটি হাল্কা ধরা হয়েছে – কারণ ভারতীয় বাহিনী শুধুমাত্র বড় শহরে এবং জনবহুল এলাকায় আক্রমণ করেছে এবং তারা ছোট খাট যুদ্ধ এড়িয়ে চলতে চাচ্ছে।
প্রথম হারানো শহর হোল যশোর। টাইমসের উইলিয়াম স্টুয়ার্ট যিনি ভারতীয় সৈন্যদের সঙ্গে প্রধান রেলপথ জংশনে ছিলেন তিনি রীপোর্ট করেন – যশোর; ভারতের প্রথম কৌশলী পুরষ্কার। দির্ঘ গ্রীষ্মে আম পাকার মতোই সহজ মনে হোল। যুদ্ধের তেমন কোন ক্ষয়ক্ষতি হয় নি। আসলে ভারতের আক্রমণের কিছুদিন আগে যশোর থেকে পাকিস্তানের নবম ডিভিশনের সেনারা হেডকোয়ার্টার ত্যাগ করে চলে গিয়েছিল। শুধু চার ব্যাটালিয়ন সৈন্য ছিল কিছু আক্রমণ মোকাবিলায়।
“তা সত্ত্বেও, দুইটি পাকিস্তানি বাহিনী দূরে পালিয়ে যায় আর অন্য দুইটি খারাপ ভাবে আক্রান্ত হয়। ভারতীয় সেনারা সর্বত্র ছিল আর বাঙ্গালিরা তাদের শুভেচ্ছা জানায়। তারা ‘জয় বাংলা’ বলে চিৎকার করে এবং বলেন ‘ইন্দিরা গান্ধি জিন্দাবাদ।’ ঝিঙ্গরগাছায় শহরের অর্ধেক মানুষ – প্রায় ৫০০০ জন একত্রিত হয়ে শুভেচ্ছা জানায়। একজন বৃদ্ধ মানুষ বললেন ‘পাকিস্তানিরা যখন আমাদের উপর চিৎকার করেছিল তখন আমরা বুঝতে পারিনি।’ ‘কিন্তু তারা উর্দুতে বলছিল আর আমরা বাংলায় বলছিলাম।’
মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা
গত সপ্তাহে পূর্ববাংলা পাকিস্তানি শাসন মুক্ত হয়। পাকিস্তানি সেনারা দুইটি নদী বন্দর দিয়ে ফিরে যাবে। নারায়ণগঞ্জ আর বরিশাল। ধারনা করা হয়েছিল তারা সেখানে একটি অবস্থান নেবে অথবা পালানোর অন্য কোন পথ বের করবে। তারা ব্যাটালিয়ন দিয়ে শক্ত প্রতিরক্ষা ব্যাবস্থা করেছিল। আর শহরে তিনটি গ্যারিসন করেছিল। সেখানে ভারতীয় সেনারা তাদের ঘিরে রেখেছিল। ভারতীয়রা এখনো চট্টগ্রাম আর দিনাজপুরের বড় বড় শহরের দখল নেয়নি। আর্মি সাংবাদিকদের যুদ্ধরত এলাকায় যাবার অনুমতি দেয়নি। তবে কয়েকটি স্থানে ভারতীয় মিলিটারি সাংবাদিকদের তাদের সাথে নিয়ে গেছে। ত্রিমুখী ভারতীয় সাঁডাশি আক্রমণ অনেক দ্রুত ছড়িয়ে গেছে। যা আগে ভাবা যায়নি। তাছাড়া আকাশ পথ ও নৌ পথেও দ্রুত আগানো গেছে।
মনোবলহীন ও ছত্রভঙ্গ পাকিস্তানের সেনাদলকে আন্তসেনা রেডিও কলে বারবার ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল স্যাম মানেকশ আত্মসমর্পণ করার অনুরোধ করেছেন। তিনি বলেছেন , ‘তোমরা আমার সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পন না করে পালানোর উপক্রম কর তাহলে আমি সতর্ক করে দিচ্ছি তোমাদের জন্য মৃত্যু অপেক্ষা করছে।’ তিনি আরও বলেন যদি তারা আত্তসমর্পন করে তাহলে তাদেরকে জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী যুদ্ধবন্দি হিসেবে ধরা হবে। মুক্তিবাহিনীও যাতে জেনেভা কনভেনশন মেনে চলে সেই প্রতিশ্রুতি দেয়া হবে। ভারত অফিসিয়ালি মুক্তিবাহিনীকে তাদের সেনা কমান্ডের আওতায় এনেছে।
পাকিস্তানি বন্দীদের অনেকে আত্মসমর্পণ করেছেন বলে রিপোর্ট করা হয়েছে। কিন্তু অনেকে গ্রামাঞ্চলের মধ্যে মুক্ত চলাচল করছেন – সম্ভবত সাধারণ মানুষের সাথে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করছে। কিছু শহরে শক্ত প্রতিরোধ করা হয়েছে। একজন ভারতীয় সংবাদদাতা একথা জানান। যদিও শত্রুরা আত্তসমর্পন করতে চাইছে তথাপি মুক্তিবাহিনী তাদের শোধ নিচ্ছে। সময় নিন। আরও বড় কিছু হতে পারে। অপেক্ষা করুন। তিনি রহস্য করে বললেন হতে পারে যে পূর্ব পাকিস্তানের সেনাপ্রধান একটি নিশ্চিনহ করার একশন শুরু করতে পারেন।
পুরো সপ্তাহ জুড়ে পাকিস্তান তাদের জিহাদ বা পবিত্র যুদ্ধ চালিয়ে গেছে। একজন কর্নেল বলেছেন যুদ্ধক্ষেত্রে পাকিস্তানিদের কোন ক্ষয়ক্ষতি হয় নাই। তার ব্যাখ্যায় তিনি বলেন ‘জিহাদে কারো মৃত্যু হয়না। তারা চিরজীবন বেচে থাকেন।’ পাকিস্তানের রেডিও ও টিভিতে কিছুক্ষণ পরপর গান প্রচার করা হচ্ছে – ‘পুরো পাকিস্তান জেগে আছে’ এবং ‘শহিদের রক্ত বৃথা যেতে পারেনা।’ একজন সরকারি মুখপাত্র বলেন যে পাকিস্তান ভারতের ১২৩ টি বিমান ভূপতিত করেছে আর তার বিপরীতে তাদের ৭ টি বিমান ধ্বংস হয়েছে। আর মৃত্যুর অনুপাত ১৮ জনের বিপরীতে একজন। ইসলামাবাদ জানায় যে পাকিস্তান এখনো যশোর তাদের দখলে রেখেছে যদিও স্বাধীনতার কিছুক্ষণ পরে সেখানে সাংবাদিকরা ঘুরে এসেছেন।
গত সপ্তাহে অবশ্য প্রেসিডেন্ট আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানের সরকার তার দেশের মানুষকে প্রস্তুত করতে যাচ্ছেন যে তারা পূর্ব অঞ্চল হারাতে যাচ্ছেন। একজন সরকারি কর্মকর্তা প্রথমবারের মত বলেন পাকিস্তানি বিমান বাহিনী পূর্ব অঞ্চলে আর অপারেটিং করছে না। পাকিস্তানি বাহিনী আরও শক্তিশালী যুদ্ধ যন্ত্রের কাছে নিষ্ক্রিয় হয়ে আছে। এবং সংখ্যার তুলনায় যা ভারতীয়দের ৬ জনের বিপরীতে ১ জন এবং সরঞ্জামের আধুনিকতা একটু বাড়ীয়ে বলা হয়েছে।
শিখ ও গুর্খা
বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের ভাগ্য পূর্ব অঞ্চলে নির্ধারিত হবে। ভারত ও পাকিস্তান বাহিনী একে ওপরের জন্য কষ্টদায়ক স্ল্যাব করার চেষ্টা করছে সীমান্তের ১৪০০ মাইল জুড়ে। এটি কাশ্মীরের উঁচু শহর থেকে শুরু করে পাঞ্জাবের সমতল পর্যন্ত বিস্তৃত। আর অন্যদিকে পশ্চিম ভারতের মরুভূমি এলাকা। সেখানে দাঁড়ীয়ালা খাকি তুরবান পরিহিত শিখ – কঠিন সমান মুখের গুর্খা যাদের কাছে বাঁকা ছুরি থাকে নিজেদের বেল্টের কুক্রিতে। এছাড়াও সেখানে আরও অনেক উপজাতি আছে। সীমান্তের একশনে উভয় অঞ্চল শুনশান আছে আর প্রতিরক্ষা দেয়া কঠিন।
যুদ্ধে একে অপরের বিরুদ্ধে প্লেন, ট্যাংক, আর্টিলারি ব্যাবহার করছে এবং উভয় পাশে সম্পদ আর হতাহত হচ্ছে প্রচুর – মনে হচ্ছে তা পূর্ব অঞ্চলের চেয়ে বেশি। বেশিরভাগ অঞ্চলে দুই বাহিনী জড়ো হয়ে শেষ করেছে ১৯৬৫ সালেই। তারপরেও সেখানে আক্রমণাত্মক পরিবেশ ছিল। ভারতীয় সেনাদের কৌশল ছিল আত্মরক্ষামূলক – তারা কোন আক্রমণ করেনি যতক্ষণ তারা আক্রান্ত হয়েছে।
ওল্ড বয় এটিচিউড
সবচেয়ে রক্তাত যুদ্ধ হয়েছিল চাহাম এলাকায়। যুদ্ধবিরতি এলাকা থেকে ৬ মাইল দূরের একটি উপত্যক্যা এলাকা। এটি ১৯৪৯ থেকে কাশ্মীরকে প্রায় সমান দুই ভাবে ভাগ করে রেখেছে। পাকিস্তানিরা চরম ঘাতের জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। একথা বলেছিলেন একজন ভারতীয় মুখপাত্র – তিনি জানান এখানে ভারতের হতাহত অনেক বেশি। তবে তিনি জানান পাকিস্তানের হতাহত আরও বেশি। পাকিস্তানের লক্ষ্য ছিল ভারতের জম্মু শহরে আক্রমণ করা। এবং ২০০ মাইল লম্বা জম্মু শ্রীনগর রাস্তায় আক্রমণ করা যা ভারতের সাথে কাশ্মীর উপতক্যার সংযোগপথ। ভারতীয়দের মুনাওয়ার রবি নদির তির এলাকা থেকে ভারতীয়দের সরিয়ে দেয়া হয় – এটি তারা দখলে রাখার অনেক চেষ্টা করেছিল।
চাহাম এবং অন্যান্য বিচ্ছিন্ন যুদ্ধ ছাড়া উভয় পক্ষ ‘ পুরনো বালক” সুলভ মনোভাব দেখাচ্ছে। তুমি যদি আমার গুরুত্তপূর্ন বেইজে আক্রমণ না কর তাহলে আমি তোমারটায় আক্রমণ করব না। এসবকিছুর পেছনে অনেক পাকিস্তানি ও ভারতীয় অফিসাররা আছে। এদের মধ্যে দুই দেশের কমান্ডিং জেনারেল একসাথে স্যান্ডহার্স্ট বা দেরাদুনের স্কুলে গিয়েছিল। ভারতের পূর্ব অঞ্চলের দায়িত্বে থাকা কমান্ডিং অফিসার লে জে জাগজিত সিং অরোরা পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ক্লাসমেট। একজন ভারতীয় অফিসার বললেন আমরা একসাথে স্কুলে গিয়েছিলাম কিভাবে একে অপরকে হত্যা করা যায়।
টাইমসের মারাহ ক্লার্ক পশ্চিম সীমান্ত থেকে ঘুরে এসে জানিয়েছেন বাইরে থেকে দেখলে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে একটি সুনির্দিষ্ট পুরানো ঢঙের এবং বিবেকী বাহিনী বলে মনে হয়। একজন আমেরিকান প্রতিনিধি জানান আপনি যত ভিতরে প্রবেশ করবেন ততই আরও নিত্য নতুন তথ্য পাবেন। কিন্তু কিছু কাজ সাড়তে হবে। কনভয় দ্রুত উপরে উঠানো হল, আর্টিলারি অফিসাররা তাদের কামান তাক করল। তাদের মনোবল অত্যন্ত উচ্চ এবং ভারতীয় কর্মকর্তারা সবসময় পাকিস্তানীদের সম্পর্কে প্রসন্নভাবে বলে ‘ওইসব বন্ধুরা’’
পরিত্যক্ত কাপড়চোপড়
পাকিস্তানের অন্যতম শহর সেহজ্রা – যা ভারতীয় এলাকা দিয়ে লাহোরের পুর্ব সীমান্ত বরাবর – ভারতীয় সৈন্যরা সেখান আগাচ্ছে। ক্লার্ক সেখানে মাঠে কাজ করা পুরুষদের সাথে কথা বললেন। তাদের মাথার উপর দিয়ে জেট বিমান উড়ে যাচ্ছিল। আর দূরে কামানের গোলার শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল। তিনি জানালেন রাস্তার পাশে বিনামূল্যের স্টল আছে। উঠতি বয়সের ছেলেরা কমলা, বাদাম ও কলার ব্যাগ গাড়ি থেকে ফেলে যায় – যে গাড়িতে করে সৈন্যরা এদিক দিয়ে যায় এবং চিৎকার করে উৎসাহ দিয়ে যায়। যখন আমাদের জিপ থামে, তারা আমাদের ঘিরে রাখে এবং আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকে – তারা চায় যে আমরা কোন গল্প লিখি যে তাদের গ্রাম স্বাধীন – এবং আমরা ধরা পড়িনি – যা সব সময় পাকিস্তানি রেডিওতে প্রচার করা হয়।
আমরা সীমান্তে আসার পড় ভারতীয় কমান্ডার আমাদের গ্রহণ করলেন। তিনি রাত ৯ টায় তার গুর্খা সৈন্যরা কিভাবে অপারেশন জিতেছিল এবং পাকিস্তানিদের বিতাড়িত করেছিল সেটা বর্ননা করছিলেন। “আমি মনে করি আমরা আশ্চর্যজনকভাবে তাদের পরাজিত করেছি” তিনি বলেন ‘এবং আমাদের একজন পাকিস্তানি এলাকা ঘুরে নিশ্চিত করেছেন।’ তার বিছানায় একটি সুটকেস আছে এবং এটা তড়িঘড়ি করে আটকানো হয়েছে। এতে কয়েকটা জামা, কিছু মোজা, ট্রাউজার আছে। ট্রাউজারটি ফ্লানেলের তৈরি ও অনেক সুন্দর – লেভেল লাগান আছে – এম আব্বাস টেইলার্স – যা রাওয়ালপিন্ডিতে অবস্থিত। কর্নেল – শহর ছেড়েছেন – এটা নিশ্চিত এবং তার কাপড়চোপড় এখানে রেখে গেছেন।
সেহজ্রার দক্ষিণে ভারতীয় সাঁজোয়া ইউনিট পশ্চিম পাকিস্তানেড় সীমান্ত পেরিয়ে বালির উপর দিয়ে চলাচল করছে। এখানে শত শত বর্গমাইল মরুভূমি অবস্থিত। তাদেরকে বলা হোল যেখানে অন্তত দুইটা তাল গাছে আছে ও অগভীর ব্রাকিশ পানির জলাধার আছে। শত্রুদের যেসব জিনিসপত্র জব্দ করা হয়েছে তার মধ্যে উট ও আছে। এই অভিযানের কারণ হোল ধারনা করা হচ্ছে যেহেতু পূর্ব বাংলার পরিবর্তে এই অঞ্চলে ভারতের কিছু যায়গা দখলে নেয়া। সেটা এখন অসম্ভব মনে হচ্ছে। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন জাতি হোক – ভারত চায় পশ্চিমের কিছু এলাকায় দরকষাকষি করতে।
ভারতের পশ্চিম অংশে পূর্ণ যুদ্ধকালীন সতর্কতা চালু আছে। সমস্ত শহর সম্পূর্ণরূপে রাতে ব্লাক আউট করে দেয়া হয়।প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সতর্কবার্তা যে সামনে একটি লম্বা, অন্ধকার ডিসেম্বর আছে। বিমান আক্রমণ সাইরেন প্রায় একটানা বাজছে। পাঞ্জাবে আই এস এর সময় সেখানে ১১ টি বিমান আক্রমণ সাইরেন বেজেছিল। যদিও এই দু শহরেরে উত্তেজনায় বোমা বিস্ফোরণে অনেকে হতাহত হয় যখন পাকিস্তানি বিমান বাহিনী বারবার সীমান্তে আক্রমণ করে। তাদের আক্রমণের মধ্যে ছিল অমৃতসর – যেখানকার স্বর্ন মন্দির শিখদের কাছে অন্যতম পবিত্রতম স্থানের মধ্যে একটি। পাকিস্তানের প্রথম আক্রমণের শিকার হয় আগ্রা – সেখানে তাজমহলকে জঙ্গলে টুইগ ও পাতার সাথে তুলনা করা হয় এবং কাপড় দিয়ে ঢেকে দেয়া হয় কারণ মাঝরাতে এর মার্বেল পাথর চন্দ্রপ্রভার মত আল দিতে থাকে।
ভারত পূর্ব অঞ্চলে বড় কোন আঘাত হানতে চায় না কারণ নয়া দিল্লি চায়না বড় কোন জটিলতায় জড়াতে। যদিও দুই দেশ আরে আগে আরও দুইবার মুখোমুখি হয়েছে। অফিসিয়ালি সেগুলো জল জম্মু আর কাশ্মীরের স্লেট যা দুই দেশের কেউ দখলে নিতে পারেনি ১৯৪৯ সালে যুদ্ধবিরতি দেয়ার আগ পর্যন্ত। এই এলাকাটি দখলে নেয়াড় জন্য নয়াদিল্লীর চাপ না দেয়াড় পেছনে অনেক কারণ আছে।
প্রথমে একটি সন্দেহ যে আজাদ কাশ্মীরের মানুষ, যা পাকিস্তানের অংশ – এটিকে যদি ভারতকে নিয়ন্ত্রণ করতে বলা হয় সেক্ষেত্রে ভারত বিব্রতকর বিদ্রোহের মুখোমুখি হয়ে যেতে পারে। দ্বিতীয় কারণ হলো ১৯৬৩ সালে চীনের সঙ্গে ভারতের সংক্ষিপ্ত কিন্তু রক্তাক্ত যুদ্ধের পর পাকিস্তান, চীনের সাথে একটি প্রাথমিক সীমান্ত চুক্তি করে। কাশ্মীর থেকে চিন পর্যন্ত এটি ১৩০০ বর্গমাইল বিস্তৃত। পিকিং পুরাতন সিল্ক রুট হাইওয়ে লিঙ্কড করছে যেটা পাকিস্তানের কাশ্মীরের গিলজিত থেকে শুরু। পুরো রাস্তা মোটর হাইওয়ে। এটি অস্ত্রবিরতি লাইন লাদাখ দিয়ে গিয়েছে। যদি কোন কারণে তখন ভারত চায়নার রাস্তা বয়া কাশ্মীরের একটি অঞ্চল দখল করে তখন স্বভাবতই নয়াদিল্লীর সাথে পিকিং এর সম্পর্ক্টা হয়রানির মুখোমুখি হবে।
ধারাবাহিক হয়রানি
অন্য দিকে পাকিস্তানের অনেককিছু পাবার আছে।যদি এটা তারা ভারতের থেকে নিয়ন্ত্রণে নিতে পারে – বিশেষ করে উপত্যকাটা – তাহলে তাদের জন্য কৌশলগত কারণে অনেক লাভ হবে। এটা অনেক গুরুত্তপূর্ন কারণ এর সাথে চিন, আফগানিস্তান সহ ভারত-পাকিস্তানের সীমান্ত বিরাজমান। তাছাড়া এই এলাকার লোক মূলত মুসলমান।
এখনো এই যুদ্ধের ফল পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণকে ব্যে বেড়াতে হচ্ছে। প্রায় সব সময় ইসলামাবাদ, করাচী আর অন্যান্য শহরের উপর দিয়ে উড়ে যাওয়া বিমানের শব্দ মানুষকে সব সময় ভীতির মধ্যে রাখছে। টাইমসের লুইস করার রাওয়ালপিন্ডি থেকে তারবার্তায় জানান এখানে বড় কোন বোমা বর্ষন হচ্ছে না – তবে চলমান আক্রমণ চলছে – সেখানে শত শত হটা হত হচ্ছে। এভাবে যখন মাথার উপর দিয়ে বিমান যায় – শহরের জীবন একদম থেমে যায়। মানুষ দৌড়ে ট্রেঞ্চের নিচে আশ্রয় নেয়। মাথায় উলের শাল নেধে দরজার আড়ালে দাঁড়ীয়ে থাকে উটপাখির মত। কাশ্মীরের পাহাড়ের জন্য রাডারে ভারতের বিমান ধরা পড়ে না যতক্ষণ পর্যন্ত না সেগুলো ১৫ কিলোমিটারের মধ্যে আসে।
পাকিস্তানিরা তাদের অটোগুলো কাঁদা দিয়ে মুড়ে রেখেছে যাতে ভারতীয় বিমান সেগুলোকে চিহ্নিত করতে না পারে। রাতের আক্রমণে কোন আলো ছাড়া রাস্তার ট্রাফিক মেনে চলতে হয়। এবং এতে করে বিমান আক্রমণে মরার চেয়ে ট্রাফিক দুর্ঘটনায় মরার ভীতি আরও তৈরি হয়। সরকার মটর চালকদের বলেছে শুধু তাদের আলো ঢেকে রাখতে – গত সপ্তাহে পাকিস্তান তাদের নিজেদের স্যাবর জেট বিয়ান ভূপতিত করেছে। একটি পয়েন্টে মিলিটারিরা একটি এন্টি ক্র্যাফট মেশিন গান রাওয়ালপিন্ডি ইন্টারন্যাশনাল হোটেলের উপরে সেট করেছে – কিন্তু সেখানকার গেস্টরা এটাকে ঠিকই বিপদজনক মনে করে।
সোভিয়েত বিমান
নয়া দিল্লিতে মেজাজ তেমন আনন্দময় কারণ ভারতের মূল লক্ষ্য ছিল পূর্ব বাংলায় একটি সরকার প্রতিষ্ঠার পরে শরনার্থিরে খুব দ্রুতই ফিরে যাবে। যখন প্রধানমন্ত্রী গান্ধী গত সপ্তাহে উভয় হাউজে বললেন ভারত হবে প্রথম সরকার যারা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে – এতে সবাই তেমন বিস্মিত হয়নি। তবুও সদস্যরা তাদের চাপড়ে উত্সাহ যোগান আমোদ প্রকাশ করেন। ‘বাংলাদেশের জনগণের বিরতপূর্ন সংগ্রাম স্বাধীনতা আন্দোলন ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায় খুলেছে,” মিসেস গান্ধী বলেন। ‘সমগ্র বিশ্বের মানুষ দেখেছে বাংলাদেশের মানুষ তাদের ইচ্ছাকে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য যেভাবে মত দিয়েছেন তা অনেক দেশের সরকারেই দেখা যায়না।’
নয়াদিল্লিতে অল্প আনন্দ ছিল তবে নিক্সন প্রশাসন দ্রুতগতিতে ঘোষণা করেন যে উপমহাদেশে যুদ্ধের পরিবেশ তৈরির জন্য ভারত দায়ী। জাতিসংঘের রাষ্ট্রদূত জর্জ বুশও এমন মন্তব্য করেছেন। ভারতের কর্মকর্তারা আশ্চর্য হয়েছে যে দ্রুততায় সাধারণ পরিষদে এই রিপোর্ট করা হয়েছিল যা তাদের মর্মাহত করে। সেখানে এক পক্ষীয়ভাবে যুদ্ধবিরতি ও সৈন্য অপসারণের জন্য ভোট চাওয়া হয়।
যুদ্ধোপকরণের জন্য আহবান
এদিকে এখনও বিপদ হল অন্যান্য জাতির জড়িত হতে পারে। পাকিস্তান তুরস্কের উপর চাপ দিচ্ছে বলে যানা যায়। তবে তারা নিজেরা নিজেদের ঝামেলায় আছে। তাদের কাছে জাহাজ, ট্যাংক, বাজোকা এবং ছোট অস্ত্র এবং গোলাবারুদ চাওয়া হয়েছে। যেহেতু তুরস্ক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের থেকে ভারী অস্ত্র সংগ্রহ করে তাই এগুলো পাকিস্তানকে দিতে হোলে তাদের আমেরিকান অনুমোদন লাগবে। এছাড়া যানা যায় যে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতে রসদ পাঠানোর জন্য কায়রোতে বিমানে জ্বালানি ভরার জন্য স্টেশন হিসেবে ব্যাবহার করছে। প্রায় ৩০ টা আটোনভ- ১২ ট্রান্সপোর্ট যেগুলোর প্রত্যেকটা দুইটি ডিজমেন্টেল্ড এম আই জি অথবা দুইটি এস এ এম ব্যাটারি বহন করতে পারে – এগুলো গত সপ্তাহে এসেছে। বিমান আক্রমণে মিশর নাখোশ হয়েছে বলে যানা যায় । ওয়াশিংটন জানিয়েছে যে সেয়াটো ও সেন্টো চুক্তি পাকিস্তানে রসদ সরবরাহের বিপক্ষে যায় না।
যদি বাংলাদেশ সরকার সপ্তাহের শেষ নাগাদ রাজধানী ঢাকাতে শেষ না হয়ে থাকে তাহলে এটা ধরে নিতে হবে যে তাদের ভিত্তি শক্ত। যেমনটা মিসেস গান্ধি পার্লামেন্টের বক্তব্যে বলেছেন যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের নেতারা তাদের গণতন্ত্রের কৌশল, আদর্শ, সামাজিকতা, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং একটি অনবদ্য সমাজ গঠনের উপর মুল্যায়িত হবেন। এখানে জাতি, ধর্ম, লিঙ্গ অথবা ধর্মমত ভিত্তিতে কোনো বৈষম্য করা হবে না। বাংলাদেশ সরকার তাদের বৈদেশিক সম্পর্ক বিষয়ে তাদের সংকল্প প্রকাশ করেছেন যেখানে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং উপনিবেশবাদ বিরোধী অবস্থা , বর্ণবাদ বিরোধিতা, সাম্রাজ্যবাদিতার বিরুদ্ধে অবস্থান সহ একটি নীতি অনুসরণ করার ইচ্ছা প্রকাশ করা হয়েছে।
বাংলাদেশের স্বপ্ন দুইবার প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। চব্বিশ বছর আগে, বাঙালি পাকিস্তান নামক নতুন জাতির জন্য ভোট দেয়। যা ছিল ব্রিটিশ ইন্ডিয়া থেকে একটি আলাদা মুসলিম দেশ হবার লক্ষ্যে। তার পর অনেক দিন ধরে ধর্মীয় ঐক্য জাতিগত ও আঞ্চলিক সংকীর্ণতার মধ্যে ভাঙ্গা গড়া হচ্ছিল। যেমন পশ্চিম পাকিস্তানে স্বৈরাচারী মোসলেমরা পূর্বে তাদের বাঙ্গালি ভাইদের শোষিত করছিল। এক বছর আগে গত সপ্তাহে, বাঙালি পাকিস্তানের প্রথম দেশব্যাপী নির্বাচনে অবাধ নির্বাচনে ভোট দেয়। শুধুমাত্র তদের নেতা মুজিবকে বিজয়ী করতে। কিত্নু তা নৃশংসভাবে পশ্চিম পাকিস্তানীদের হাতে শেষ হয়ে যায়। সেই আঘাতে সম্ভবত ১০০০০০ মানুষ মারা যায় ও ১০ মিলিয়ন শরনার্থি অন্য দেশে চলে যায়। আর হাজার হাজার অবর্ণনীয় গৃহহীন ক্ষুধার্ত এবং অসুস্থ মানুষ পরে থাকে।
যারা ভারতে আসার কর্দ্মাক্ত পথে কলেরায় মারা গেছেন অথবা পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর হাতে অনির্বচনীয়ভাবে নৃশংসতার শিকার হয়েছেন সেই স্মৃতি এখনো স্মৃতিতে কাঁচা হয়ে আছে। আর সেখানে ছিল শিশু, অন্ধ এবং মস্তিষ্কের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ, যারা তাদের জীবনের বাকিটা অপুষ্টির ক্ষত বহন করবে। গত সপ্তাহে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে থেকে প্রথম নতুন দেশের প্রথম কূটনৈতিক মিশন খোলার হয় নয়া দিল্লিতে। স্বপ্ন সত্যি হয়েছে। কিন্তু আপনারা জানেন কোটা দুঃস্বপ্নের মধ্যে দিয়ে আমাদের যেতে হয়েছে।
অর্থনৈতিক সম্ভাবনা
নতুন জাতি অর্থনৈতিকভাবে কতটা স্থিতিশীল? বাংলাদেশের উপরে যাওয়া ছাড়া আর কোথাও যাওয়ার নেই। পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় অঞ্চল হলেও সে সমস্ত দেশের ৫০% অবদান রেখেছে এবং বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ৭০% আয় তাদের। কিন্তু বিনিময়ে শুধুমাত্র একটি ছোট শতাংশ পেয়েছে। পূর্ববাংলার অর্থনীতির বিপদ হল এটি প্রচন্ডভাবে পাট ও পাটজাত-কাপড়ের উপর ভিত্তি করে তৈরি। কিন্তু এবং সিন্থেটিক এর পরিপূরক হচ্ছে ধীরে ধীরে। কিন্তু হয়ত সে তার নিজস্ব বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ ধরে রাখতে পারবে না। এখন নির্মাতারা শিল্প ও রপ্তানীকারকদের বিকাশ করতে সক্ষম হবেন। এছাড়া ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে বাণিজ্য শুরু হবে, এবং ভারতের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার পরিবর্তে নয়া দিল্লির সঙ্গে যৌথ বিপনন নীতিমালা প্রণয়ন করিতে পারিবে। ভারতও আগামী বছরের মধ্যে বাংলাদেশের খাদ্য সমস্যায় সাহায্য করতে ইচ্ছুক।
বাংলাদেশকে ভারতের সমর্থন করার প্রধান কারণ হল যে বাংলাদেশ উদ্বাস্তুদের দ্রুত সরিয়ে নিতে পারবে। এবং তাদের জমি ও জিনিসপত্র পুনঃস্থাপন হবে। বাংলাদেশ সরকারও পাকিস্তান থেকে যুদ্ধ প্রস্তুতির জন্য সচেষ্ট হতে পারবে।
পশ্চিম পাকিস্তানে কি আসে যায়? পূর্ব পাকিস্তানে হারা, কোন সন্দেহ নেই, তাদের মনোবলের জন্য একটি আঘাত ও রাজনীতিতে একটি বড় পতন। কিন্তু ইসলামাবাদ সরকারের পক্ষে এমন একটি অঞ্চল যা রাজনৈতিকভাবে লজিস্টিকালি ও সামরিকভাবে পরিচালনা করা কঠিন ছিল এবং জনসংখ্যা কমে ৫৮ মিলিয়ন হয়েছিল যারা সজাতি। সে অর্থে এই ব্রেক আপ একটি আশীর্বাদ হতে পারে। তবে তাদের অনুভূতি তাদের ফিরিয়ে দিতে সাহায্য করার জন্য যথেষ্ট বৈদেশিক সাহায্য পেতে আশা করা যেতে পারে।
নেতৃত্বশূন্যতা
গত সপ্তাহে ইয়াহিয়া বেসামরিক সরকারের জন্য প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ৭৭ বছর বয়সী বাঙালি নুরুল আমিন কে নিয়োগের ঘোষণা দেন। যার কাছে তিনি তার সামরিক শাসন ক্ষমতার কিছু অংশ দিবেন বলে প্রতিজ্ঞা করেছেন। গত ডিসেম্বরের নির্বাচনের বিয়োগান্ত নাটকের পর আমিন আসলেন। ঐ নির্বাচনে মুজিবের আওয়ামী লীগ পরিষদের ১৬৯ টি আসনের মধ্যে ১৬৭ টি জিতেছে; আমিন, যিনি একজন দেশপ্রধানের সন্মান পেয়েছেন তিনি ছিলেন অন্য দুইটি আসনের একজন। কিন্তু তিনি মূলত একটি ফিগারহেড, এবং তার ডেপুটি হিসেবে দেয়া হয়েছে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোকে যার মানে তিনি সম্ভবত ক্ষমতার সিংহ ভাগ পাবেন। এটা আশাতীতভাবে দ্রুত হয়েছে। গত সপ্তাহে রিপোর্ট হয় যে ইয়াহিয়ার পতন আসন্ন হতে পারে। ভুট্টো একজন ঘৃণাপূর্ণ, প্রো চীনা রাজনীতিবিদ যিনি ইয়াহিয়াকে অসুস্থভাবে প্রভাবিত করে নির্বাচনের ফলাফলকে সরিয়ে দিয়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়া থেকে মুজিবকে দূরে রাখতে সফল হয়েছেন।
বাংলাদেশের প্রধান অসুবিধা নেতৃত্বের শূন্যতা। ইয়াহিয়া কি মুজিবকে মুক্তি দেবেন? – সেই জাদুকরী নেতা যিনি দেশভাগের পর থিক বাঙ্গালিকে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখাচ্ছেন। আওয়ামী লীগের সকল নেতা যারা বাংলাদেশের সরকার গঠন করার পর গত এপ্রিল থেকে নির্বাসিত আছেন তারা মুজিবের পুরোনো সহকর্মী এবং তার অনুপস্থিতিতে দায়িত্ব পরিচালনার জন্য দায়বদ্ধ – যেহেতু তিনি কারারুদ্ধ। কিন্তু একটি দুর্বল নতুন জাতি শাসন করা একটি রাজনৈতিক দল পরিচালনার চেয়ে আরো কঠিন। তার চাইতে বড় ব্যাপার হল মুজিবের মত ক্যারিজমা আর কারো নেই যে এত মিলিয়ন শক্তিশালী জনতা কে আকৃষ্ট করে রাখবে। শীর্ষ নেতাদের যারা গত গত ডিসেম্বরের বাতিল করা জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে অপ্রতিরোধ্য মার্জিন দ্বারা আসন জিতেছেন তাদের মধ্যে আছেন: – সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ৪০। তিনি মুজিবের অনুপস্থিতিতে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট। তিনি একজন আইনজীবী যিনি অতীতে শেখের সহকর্মি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি সাবেক প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে সংগ্রামের সময় সক্রিয় ছিলেন, এবং যখন মুজিব জেলে নিক্ষিপ্ত হয়েছিল, তখন তিনি বিরূপ সময়ে পার্টির নেতৃত্ব দেন। – তাজউদ্দীন আহমদ, ৪৬, প্রধানমন্ত্রী, একজন আইনজীবী যিনি ১৯৪৯ থেকে আওয়ামী লীগের প্রধান সংগঠক। তিনি অর্থনীতির একজন বিশেষজ্ঞ এবং দলের নেতৃস্থানীয় বুদ্ধিজীবীদের একজন। খন্দকার মোশতাক আহমেদ , ৫৩, পররাষ্ট্র মন্ত্রী, একজন আইনজীবী যিনি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন এবং আওয়ামী লীগ স্থাপনে সাহায্য করেছেন।
সবচেয়ে আশু সমস্যা হল অবাঙালি ও বাঙ্গালিদের মধ্যে যে রক্তযুধ সেটা থামানো। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর সাথে অবাঙ্গালিরা সহযোগিতা করছিল। এর পরে , পূর্ববাংলার সরকারি কর্মকর্তাদের যারা যুধ চলার পরেও বাংলাদেশে থাকতে চেয়েছেন তাদেরকেই স্বাধীনতার পরে নতুন প্রশাসনের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। ভারতীয় স্বীকৃতি আগেই পাওয়া গেছে। একটি কারন জাতিসঙ্ঘের কাছে উদীয়মান ছিল যে ভারত যুদ্ধে এসেছিল এটাকে তাদের প্রদেশ বানানোর আশায়। আরেকটি ছিল বাংলাদেশ সরকার যাতে আর্মির থেকে দেশ স্বাধীন করার পরে দ্রুত সরকার গঠন করতে পারে। যেহেতু নয়া দিল্লি পশ্চিম পাকিস্তানী উপনিবেশবাদ এর বিনিময়ে ভারতীয় উপনিবেশবাদ তৈরি করতে চায়না তাই তারা বাংলাদেশ সরকারকে তাদের নিজস্ব পথে চলতে দিয়েছে।
পিছনে হাঁটা
এমন কোন পথ কি আছে যে পাকিস্তানিরা এখনো একটি উল্টো মোড় নিতে পারে? ভারতীয়দের পূর্ব অঞ্চল থেকে সরিয়ে একটি নতুন রাষ্ট্রকে তার সদ্য ভুমিস্ট অবস্থাতেই শেষ করে দিতে পারে? কার্যত পারেনা। জানালেন – প্রতিবেদক ক্লার্ক। তিনি তারবার্তায় একথা জানান। টাইমসের দুইজন সাংবাদিক সম্প্রতি পাকিস্তান সফর শেষ করেছেন। ক্লার্ক পশ্চিম থেকে আর স্তিওার্ট পূর্ব থেকে সংবাদ দেন। যারা পাকিস্তান ও ভারতের মাঝখান থেকে সুবিধা আদায়ের আশা করেছিলেন তারা তা করতে পারবেন না।
তাই সপ্তাহের শেষে যেসকল উদ্বাস্তুরা এত দূর পর্যন্ত পায়ে হেঁটে ভারতে আসছিলেন তারা আবার বাড়ীতে ফিরে আসার জন্য দির্ঘ পথে রওনা দিয়েছেন প্রাণের টানে। কারো জন্য এটা ছিল আত্মীয় এবং বন্ধুদের নিয়ে খুশির পুনর্মিলন আর কারো জন্য অশ্রু। এবং যারা আর ফেরত আসবে তাদের জন্য অনুভূতি ছিল অন্যরকম। কিন্তু সেখানে নতুন ঘরবাড়ি বানাতে হবে, নতুন জাতি তৈরি করতে হবে। সেখানে জমি ও পরে আছে – সবুজ এবং মায়াবী।
নোবেল জয়ী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন “মানব ইতিহাস ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছে অপমানিত মানুষের জয়জয়কার দেখার জন্য।’ উত্থান হয়েছে – তবে অনেক দামের বিনিময়ে। উপমহাদেশের যুদ্ধ এবং নতুন জন্মগ্রহণকারী হাড় ফাটা দারিদ্র্যের দেশ – বাংলাদেশের বিজয় – দুঃখপূর্ন।
যুক্তরাষ্ট্র: কসাইখানা নীতি
নিক্সন প্রশাসন গত সপ্তাহে ভারত ও পাকিস্তানের উপর তার নীতির জন্য সমালোচিত হয়েছে। দুই সপ্তাহ আগে যখন যুদ্ধ দুই ঐতিহ্যগত শত্রুদের মধ্যে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ছিল, স্টেট ডিপার্টমেন্টের মুখপাত্র একটি অস্বাভাবিক ভোঁতা বিবৃতি জারি করল, তারা ভারতকে দোষী করল। তার পরেই জাতিসংঘে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত জর্জ বুশ ভারতের কাজকে “আগ্রাসন” বলে উপাধি দিলেন। এমন একটি শব্দ যা ওয়াশিংটন পরবর্তীকালে কোনমতে একটা কিছু বুঝিয়েছে।
সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি ঘোষণা করেন যে প্রশাসন গত আট মাসের পাকিস্তানী সেনাবাহিনী কর্তৃক পূর্ববাংলার নৃশংস এবং নিয়মানুগ নিপীড়নের সময় বধির হয়ে ছিলএবং এখন ভারতের তাদের নিজেদের পূর্ববর্তি সীমান্তের অস্থিতিশীলতায় নেয়া পদক্ষেপকে দোষী করা হচ্ছে। সিনেটর এডমন্ড মুস্কি এবং হুবার্ট হামফ্রে কেনেডির কথাই প্রতিধ্বনিত করেন।
সমালোচনা শুধু উচ্চাভিলাষী রাজনীতিকদের দ্বারা সীমাবদ্ধ ছিলনা। নিউ ইয়র্ক টাইমসে জন পি লুইস – এক সময়কার ইউ এস এইডের ভারতীয় পরিচালক (১৯৬৪-৬৯) এবং এখন প্রিন্সটন এ জন এবং ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স উইডরো উইলসন বিদ্যালয়ের ডিন -লিখেছিলেন: “আমরা বিশ্বে আমাদের অবস্থান দাঁড় করিয়েছি। আমাদেরকে সম্প্রতি বিশ্ব লক্ষ্য করেছে এমন একটি নৈতিক ব্যাপারের বিপক্ষে দাঁড়াতে হচ্ছে। এটি অনেক বড় ও সাধারণ ইস্যু। আমরা বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম জাতির বিপরীতে একটি ছোটখাট সামরিক স্বৈরশাসনের পক্ষ নিয়েছি। ব্রিটেনে রক্ষণশীল লন্ডন ডেইলি টেলিগ্রাফ এ ওয়াশিংটন কে একটি ভণ্ড কূটনৈতিক কাজ বলে অভিযুক্ত করা হয়েছে যা সমান্তরাল থাকতে পারে না।
মার্চ থেকে যখন পাকিস্তানি সেনারা পূর্ব বাংলায় রক্তাক্ত নাটক মঞ্চস্থ করেছে, বেসামরিক হাজার হাজার হত্যা করেছে ও প্রায় ১০ মিলিয়ন মানুষ ভারতীয় সীমান্ত পার হয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে – সেই সময়ে মার্কিন সরকার নৃশংসতার তেমন সমালোচনা করে নাই এবং পাকিস্তানের সামরিক শাসক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান-একজন মানুষ যাকে প্রেসিডেন্ট নিক্সন পছন্দ করেন। ওয়াশিংটন পাকিস্তানের সাথে তার সখ্যতার জন্য যা করার করেছে। তার উপরে ওয়াশিংটন প্রশাসন ইসলামাবাদের প্রশংসা করেছিল যখন গত জুলাইতে প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জারের গোপন চায়না সফরে তারা সাহায্য করেছিল। ভারত তার ঐতিহ্যগত শত্রুদের এভাবে সাহায্য করতে দেখে ওয়াশিংটনের উপর আকস্মিক হতবাক হয়েছিল – কারণ চীন তাদেরও সাথে ১৯৬২ সালে সংক্ষিপ্ত যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল। লোকচক্ষুর অন্তরালে অনেক স্টেট ডিপার্টমেন্ট কর্মকর্তার আহ্বান নিরর্থক হয়ে যায়। কারণ সরকার ইয়াহিয়ার ব্যাপারে কঠোর অবস্থান নেন – মানবিক ও রাজনৈতিক উভয় দিক থেকেই।
গত পাঁচ বছরে, চীন পাকিস্তানের প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রকে বাস্তুচ্যুত করেছে। ভারত, ক্রমবর্ধমানভাবে সামরিক সাহায্যের জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নের উপর নির্ভরশীল।অবশেষে মস্কোর সাথে গত গ্রীষ্মে বন্ধুত্বপূর্ন একটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি সম্পন্ন করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সোভিয়েত শিবিরের মধ্যে ভারতীয়দের সরানোর জন্য একমাত্র দায়ী সরকার না। কিন্তু ইয়াহিয়ার সাথে নোংরাভাবে থাকার যে কৌশল তার কারণে ভারত সোভিয়েত ক্যাম্পের দিকে ধাবিত হয়েছে। এবং তারা আমেরিকার কাছে নৈতিক সমর্থন আশা করেনি। চুক্তির ফলে ভারতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব নিষ্ক্রিয় হয়ে গেল।
প্রশাসনের বর্তমান রাগ আরো সাম্প্রতিক একটি ঘটনা থেকে ছড়িয়েছে। গত মাসে ইন্দিরা ওয়াশিংটনে তার সফরকালে প্রেসিডেন্ট নিক্সঙ্কে বিশ্বাস করাতে চেয়েছিলেন যে তার দেশের যুদ্ধে যাবার কোন ইচ্ছে নেই। পরবর্তীতে, ভারতীয় সেনা যা করল তাতে মনে হল তারা এটা আগে থেকেই পরিকল্পনা করে রেখেছিল।
ওয়াশিংটন কর্মকর্তারা জানালেন মিসেস গান্ধীর সফর ছিল বৃহদায়তনের যুদ্ধ প্রস্তুতির জন্য একটি ধোঁয়াশা তৈরি করা। রিচার্ড নিক্সন অগ্নিশর্মা ছিলেন এবং সরকারি বিবৃতিতে ভারতকে আগ্রাসক হিসেবে ব্র্যান্ডিং করেছে।
গত সপ্তাহে, ইউ এস নীতির ন্যায্যতা প্রমাণ করতে রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টা কিসিঞ্জার একটি সংবাদ সম্মেলন করেন। (মন্তব্য পটভূমি হিসেবে ব্যাবহার করা যাবে যতক্ষণ পর্যন্ত সিনেটর ব্যারি গোল্ডওয়াটার কংগ্রেশনাল রেকর্ড থেকে ব্রিফিংয়ের একটি প্রতিলিপি মুদ্রণ করেন। ) কিসিঞ্জার জোর দিয়ে বলেন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সত্যিই পাকিস্তানের পক্ষে ছিল না, কিন্তু একটি শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধান করার জন্য শান্তভাবে এবং নিবিড়ভাবে কাজ করেছে। বস্তুত, ভারতীয় হামলার সময় তিনি দাবি করেন, ইউ এস কূটনীতিকরা ও কলকাতা ভিত্তিক বাংলাদেশ নেতৃত্ব ইয়াহিয়া খানকে আলোচনা করে সমাধানের কথা বলেছে। নয়া দিল্লি বলেছে পূর্ব পাকিস্তানের যুদ্ধে ওয়াশিংটন বিশ্বাস করে ও যুদ্ধবিরতি প্রত্যাখ্যান করেছে কারণ তারা পূর্ববাংলা থেকে পাকিস্তানি সেনাদের বিতাড়িত করতে চেয়েছে।
এটা বলা যেতে পারে যে ওয়াশিংটন দোষী কারণ ভারতীয় এবং পাকিস্তানীদের ঐ অবস্থা চলাকালেও সে ভেবেছে যে একটি রাজনৈতিক সমাধান সম্ভব। এটা তাদের সরলতা ও দুর্ভাগ্য। পূর্ব বাংলায় ক্রমাগত ক্ষমতাশূন্যতা থাকার পরেও এটা ভারতীয়দের কাছ থেকে আশা করা অবাস্তব যে তারা তাদের প্রধান শত্রুর সাথে যুদ্ধবিরতি দেবে। এবং একটি স্থায়ী ঘা দেয়া হয়েছে যেমনটি ইজরায়েলের কাছে আশা করা হয়েছিল যখন ১৯৬৭ সালে সিনাইয়ে অগ্রসর হতে তাদের নিষেধ করা হয়েছিল।
এটা সত্য যে চীনের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নীতির কারণে ভারতীয়দের সঙ্গে রণকৌশলে যেতে ওয়াশিংটনের সীমাবদ্ধতা বেড়েছে। কিন্তু এই ব্যাখ্যা ভারতীয় উপমহাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে তাদের প্রশাসন যেভাবে পরিচালনা করেছে সেখানে এই ব্যাখ্যা বা অজুহাত খাটেনা। কারণ তাদের কাজ ও কথা এক প্রকারের প্রতারণা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (১) যখনি পূর্ব এশীয় সংঘাত নিরপেক্ষ করার জন্য একটি পরিবেশ তৈরি হয়েছে তখন তারা সেখানে বাধা দিয়েছে; (২) রাশিয়া-ভারত, চায়না- পাকিস্তান লাইন-আপ শক্তিশালী করা দিকে ঝুঁকেছে; (৩) আপাতদৃষ্টিতে একটি বিশেষ শাসক যাদের শাসন প্রক্রিয়া পাশবিক এবং যারা প্রায় পরাজিত তাদের পক্ষে আদর্শগত ও রাজনইতিকভাবে অবস্থান নিয়েছে;(৪) উপ-মহাদেশে একজন কসাইইয়ের মত তার অবস্থান তৈরি করেছে।