#কুমিরার_যুদ্ধঃ
মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রতিরোধযুদ্ধ, চট্টগ্রাম
চট্টগ্রাম শহর থেকে ১৪ মাইল উত্তরে অবস্থিত কুমিরা সীতাকুন্ড উপজেলার একটি জনবসতিপূর্ণ এলাকা। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে অপরূপ কুমিরা প্রতিরক্ষাব্যুহ রচনার জন্য একটি আদর্শ অবস্থান। কারণ সাগরবিধৌত পাহাড়দুহিতা কুমিরাতে এগোতে হলে ডানে ও বায়ের প্রতিবন্ধকতাকে সামাল দিয়ে বাঁকানো সঙ্কীর্ণ পথ দিয়েই শত্রুকে আসতে হবে। এই কুমিরাতে ১৯৭১ সালের ২৬ শে মার্চ শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধ “কুমিরার যুদ্ধ”। স্বাধীনতা যুদ্ধে ঊষালগ্নে ২৫ মার্চের কালরাতেই ক্যাপ্টেন রফিকের নেতৃত্বে দেশপ্রেমিক ও দুর্জয়সাহসী ইপিআর সদস্যরা স্থানীয় ছাত্র-জনতার সাহায্যে হানাদার পাকবাহিনীকে পর্যুদস্ত করে হালিশহর ও পাহাড়তলী এলাকায় গড়ে তোলে এক সফল প্রতিরোধ। একই সময়ে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারের কোম্পানি কমান্ডার এম এস এ ভূঁইয়া পাহাড়তলীতে এসে ক্যাপ্টেন রফিকের ইপিআর বাহিনীতে যোগ দেন। এদিকে ষোলশহরে অবস্থিত অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টও মেজর জিয়ার নেতৃত্বে স্বাধীনতাযুদ্ধে সামিল হলে মুক্তিকামী জনতার মনোবল আরো দৃঢ় হয়ে ওঠে। অন্যদিকে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের প্রবল প্রতিরোধের সংবাদের পরিপেক্ষিতে ২৫ মার্চ রাতেই পাকবাহিনীর একটি শক্তিশালী সৈন্যদল চট্টগ্রামের উদ্দেশে কুমিল্লা ত্যাগ করে। কুমিল্লা থেকে ক্যাপ্টেন বাহান ক্যাপ্টেন রফিককে এ
বিষয়ে জানান। ৮০ থেকে ১০০ টি যান নিয়ে পাকবাহিনী এক বিরাট কনভয় চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে। এই সংবাদ পাওয়ামাত্র ক্যাপ্টেন রফিক পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কলামটি অ্যাম্বুশ করার জন্যে সুবেদার মুসার নেতৃত্বে হালিশহর থেকে এক কোম্পানি সৈন্য কুমিরায় প্ররণ করেন। সুবেদার মুসার সহকারী ছিলেন হাবিলদার মোশতাক চৌধুরী। এদিকে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারেরে কোম্পানি কমান্ডার ক্যাপ্টেন এম এস এ ভূঁইয়া ক্যাপ্টেন রফিকের পরামর্শক্রমে বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং ইপিআর-এর কিছু সৈন্য নিয়ে কুমিরার দিকে অগ্রসর হন।
এদিকে পাকবাহিনীর ৫৩ তম ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফি’ নেতৃত্বে ২৪ ফ্রান্টিয়ার্স ফোর্স, ফিল্ড ইঞ্জিনিয়ার ডিটাচমেন্ট ও ৮৮ মর্টার ব্যাটারি (১২০ মিমি মর্টারবাহী) সৈন্যদল কুমিরা যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। অন্যদিকে ১০২ জন সৈন্য (ইপিআর ও ইবিআরসি রিক্রুট), স্থানীয় কয়েক সহযোদ্ধা একটি মেশিনগান, একটি ৩ ইঞ্চি মর্টার, এলএমজি রাইফেল ও সাদাবন্ধু-এই অপ্রতুল ছুটাছুটি করতে শুরু করে। বিগ্রেডিয়ার শফি নিজের প্রাণ বাঁচাবার জন্য পাহাড়ের দিকে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটে যান। পলায়নপর বিক্ষিপ্ত পাকসেনাদের ওপর গ্রামবাসীরা চোরাগোপ্তা হামলা তাদের আরো সশস্ত্র করে তোলে। তারা ভয়াবহ বিপর্যয়ে পড়ে। অবশ্য বিপর্যয় কাটিয়ে উঠে পাকসেনারা সংগঠিত হয়ে পাল্টা আক্রমণের চেষ্টা করে। শুরু করে মেশিনগান, মর্টার এবং আর্টিলারির গোলাবর্ষণ। উভয়পক্ষে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়। আর্টিলারি ফায়ারের সাহায্যে মুক্তিবাহিনীর মেশিনগান ধ্বংস করার প্রয়াস ব্যর্থ হয়। প্রায় দুঘন্টা ধরে যুদ্ধ চলে। ইতোমধ্যে শত্রুর তিনটি ট্রাকে আগুন লেগে যায়। অনেক চেষ্টা করেও হানাদারবাহিনী
মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরধব্যূহ ভেদ করতে সক্ষম হয়নি। ফলে, যুদ্ধের পরিস্থিতি মুক্তিবাহিনীর অনুকূলেই থেকে যায়। এ পরিস্থিতিতে পাকবাহিনী পশ্চাদপসরণ করে স্থানীয় যক্ষ্মা হাসপাতালসহ আশেপাশের পাহাড়ি এলাকায় প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করে। এ যুদ্ধে প্রাণপণ লড়াই করে অবশেষে সুসজ্জিত পাকবাহিনী পরাজয় স্বীকার করে পিছু হটতে বাধ্য হয়। ফেলে যায় দুই ট্রাক অস্ত্র অ গোলাবারুদ। প্রথমদিনের যুদ্ধে ফ্রন্টিয়ার্স ফোর্সের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাহনুর খানসহ হানাদার বাহিনীর বিভিন্ন পদবীর প্রায় ১৫২ জন সৈন্য নিহত হয়। মুক্তিবাহিনীর ১৪ বীরসৈনিক শাহাদাৎ বরন করেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম এ প্রতিরোধে যুদ্ধে স্থানীয় জনসাধারণের স্বতঃস্ফ্রূর্ত ব্যাপক অংশগ্রহণ একটি উল্লেখযোগ্য দিক। তারা জায়গায়-জায়গায় ব্যারিকেড তৈরি করে, সীতাকুণ্ড এলাকার বিভিন্ন মিল-ফ্যাক্টরির নিরাপত্তা বিভাগের অস্ত্র, বিভিন্ন ব্যক্তির লাইসেন্সধারী অস্ত্র অ স্থানিয়ভাবে সংগৃহীত কিছু অস্ত্রসহ দা, বাঁশের লাঠি, বোতল ভর্তি এসিড নিয়ে পাকবাহিনীর মোকাবেলায় অংশ নেয়। উল্লেখ্য, বাদশা মিয়া নামে এক যুবক কতিপয় সঙ্গিসহ রামদা হাতে পাকসেনাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লে পাকসেনাদের বেয়োনেটের আঘাতে তিনি শহীদ হন। কুমিরার যুদ্ধে তিনিই প্রথম শহীদ।
২৬ মার্চ অর্থাৎ প্রতহম দিনের যুদ্ধ শেষে মুক্তিবাহিনীর সীমিত গোলাবারুদ প্রায় ফুরিয়ে আসে। এ অবস্থায় ক্যাপ্টেন সুবেদ আল ভূঁইয়া গোলাবারুদ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে চট্টগ্রাম শহরে আসেন। তবে মুক্তিযোদ্ধা সৈনিকরা ঐ সীমিত গোলাবারুদ নিয়ে অসীম সাহসীকতার সাথে লড়াই করতে থাকে। অবশ্য স্থানীয় যুবকদের সক্রিয় সহযোগিতায় মূলত মাত্র শ’খানের মুক্তিযোদ্ধার পক্ষে তিনদিন পর্যন্ত শক্তিশালী পাকবাহিনীকে প্রতিরোধ করে রাখা সম্ভব হয়েছিল। পাকিস্তানীরা মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যূহ ভেদ করার জন্য ২৬ তারিখ থেকেই আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকে। শক্তি বৃদ্ধির লক্ষ্যে তারা গোলান্দাজ সাপোর্ট এবং নিকটবর্তী উপকূল বরাবর সমুদ্রপথ গানবোট ফায়ারসাপোর্টের ব্যবস্থা করে। নতুনভাবে প্রস্তুত হয়ে অবশেষে ২৮ মার্চ পাকসেনারা মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের ওপর ত্রিমুখী আক্রমণ পরিচালনা করে। এই পর্যায়ে হালকা অস্ত্রে সজ্জিত এবং সীমিত গোলাবারুদ নিয়েস্বল্প সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধার পক্ষে অনেক গুণ শক্তিশালী পাকবাহিনীর সাঁড়াশি আক্রমণ প্রতিহত করা অসম্ভব হয়ে পড়লে তারা পিছু হটতে বাধ্য হন। তবে ,উক্তিবাহিনির এ অর্জন অস্বীকার করার উপায় নেই যে, পশ্চাদপসরণের আগে তারা পাকবাহিনীর বিপুল ক্ষতি করতে সক্ষম হয়েছিল। অস্ত্র অ দর্পশক্তিতে বলিয়ান পাকবাহিনীর মনস্তাত্ত্বিকভাবে সৃষ্ট ক্ষতিই এর মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ।