You dont have javascript enabled! Please enable it! 1947 | ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস - সংগ্রামের নোটবুক

ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস

বাংলাদেশের বাঙালির জাতীয় জীবনে আন্দোলন সংগ্রামের সূচনা ইতিহাসে ভাষা আন্দোলন একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক অধ্যায়।
বর্তমানে বাঙালির মাঝে মােটাদাগে একটি বাক্যে ভাষা আন্দোলনকে চিহ্নিত করা হয় ৫২ এর ভাষা আন্দোলন’। কিন্তু ভাষা আন্দোলন একটি নির্দিষ্ট বছরের বাঁধনে সীমাবদ্ধ ছিল না। ভারতবর্ষে বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা এবং বিতর্ক দীর্ঘ দিনের। সেই ভারত বর্ষের স্বাধীনতার আগে থেকে।
১৯০০ খ্রি. যুক্ত প্রদেশের গভর্নর স্যার অ্যান্টেনি যুক্ত প্রদেশের সরকারি দফতর থেকে উর্দু ভাষা, ফার্সি এবং উর্দু বর্ণমালার পরিবর্তে দেবনাগরী অক্ষরে হিন্দিকে সরকারি অফিস আদালত শিক্ষা ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ভাষা রূপে ঘােষণা দেন। মুসলিম সমাজ এতে খুবই ক্ষুব্ধ হয়।
নওয়াব মুহসিন উল-মুলক (১৮৩৭-১৯০৭) উর্দু সংরক্ষণ সমিতির (Urdu Defence Association) এর মাধ্যমে বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদ সভার আয়ােজন করেন এবং সরকারকে তার আদেশ রিভিউ বা পুনঃবিবেচনা করার অনুরােধ জানান। যুক্ত প্রদেশের লেফটেন্যান্ট গভর্নর স্যার অ্যান্টেনি ম্যাকডােনাল্ড এই অনুরােধে কর্ণপাত না করে বরং নওয়াব মুহসিন উল-মুলককে আন্দোলন থেকে সরে না আসলে তার পরিচালিত ‘আলীগড় কলেজে সরকারি সাহায্যদান কাজ বন্ধ করে দেয়ার হুমকি দেন। এই এক হুমকিতে আপাতত আন্দোলন স্তিমিত হয়ে আসে।
ভারতবর্ষে ইংরেজ আধিপত্যের বহু আগে থেকেই ভারতে মােগলদের দাফতরিক ভাষা ছিল ফার্সি। ইংরেজরা এসে ফার্সির পরিবর্তে ইংরেজি ভাষার প্রচলন শুরু করে দাফতরিক ভাষা হিসেবে ভারতের বেশির ভাগ অঞ্চলে। তখন তারা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে দাপ্তরিক কাজ সুষ্ঠভাবে পরিচালনার উদ্দেশ্যে স্থানীয় ভাষা ব্যবহারের গুরুত্ব অনুধাবন করল। এই উপলব্ধি থেকে ইংরেজ শাসকরা ভারতের বিশাল রাজ্য বাংলা শাসনের জন্য বাংলার দাপ্তরিক কাজে যেমন জমি জায়গার দলিলপত্র লেখা, জমিদারের পাট্টা, খাজনার রশিদ, পরচা এসব ইংরেজি বা ফার্সির পরিবর্তে বাংলার প্রচলিত ব্যবহার গ্রাহ্য করে নেয়া হয়।

কায্য আমলনামা
আবদুল গফুর ভূঞা, পিতা মৃত বেছু ভূঞা, সাং মহজমপুর দক্ষিণ কাজিপাড়া, থানা- বৈদ্দের বাজার, জেলা-ঢাকা।… বরাবার।
মাে: পাণ্ডব প্রধান, পিতা মৃত মৃদুল প্রধান, সাং মহজমপুর পশ্চিম কাজিপাড়া থানা- বৈদ্দের বাজার জেলা- ঢাকা। … কায্য আমলধারী ধারা পত্র মিদং কাৰ্য্যাঞ্জে আমার নিম্ন তফসিলভুক্ত ৬০ (ষাট) শতাংশ চাষী জমি। সাধারণ স্বত্বরায়তী জোতস্বত্ব পত্তন করার মনস্থ করিলে সাধারণ জোতস্বত্ব পত্তন নেওয়ার প্রার্থী হইলে তােমার প্রার্থনা মঞ্জুর করিয়া অত্র আমলধারী দ্বারা তােমাকে লিখিয়া দিতেছি যে অধ্য হইতে ইহার বার্ষিক খাজনা নিয়মিত শিক্ষাকর এবং পরবর্তীতে সরকার কর্তৃক যাহা কর ধার্য্য হইবে তাহা দিতে বাধ্য থাকিবে। এই ৬০ (ষাট) শতাংশের সেলামী বাবদ ৬০০ (ছয়শত) টাকা গ্রহণ করিলাম। অদ্য হইতে তুমি তােমার পুত্র/ পুত্রাধী ভােগ দখল করিতে পারিবে এবং হস্তান্তর করতে পারিবে। এতদ্বার্থে সুস্থ সজ্ঞানী আমলধারী পত্র লিখিয়া দিলাম। তাং বাংলা ১৩৩৯, ৮ ই মাঘ।

তফসিল
থানা-বৈদ্দের বাজার, সাব রেজিস্টার নারায়ণগঞ্জ অধীনে জেলা- ঢাকা কালেক্টরী তৌজির- ১৫৫১/ ১২৭৭৪/ ১২৭৭৫/ ৮২৯ বি- ৮৪০ ডি ১ সিকিমী তল্লাছ তৌতন্ন পােদ্দার উক্ত তালুকের মালিক, ২০৫ নং খতিয়ান বৈদ্দের বাজার জেলা- ঢাকা ৬০ নং মৌজা কাজিপাড়া ২৪৩ খতিয়ান ভুক্ত দাগ নং- ৫৪৭ (পাঁচশত সাত চল্লিশ) দাগের উত্তরে। সলিমউদ্দিন নাল এই চৌহদ্ভুিক্ত।

স্বাক্ষী :
১। মাে: ইয়াছীন সরকার, সেকের হাট।
২। কাজী তাইজউদ্দীন, মহজমপুর
লিখক
রমিজ উদ্দিন ভূঞা বুরুলী

ভারতে ইংরেজদের শাসন বিস্তারের বেশ কয়েক যুগ পরে ইংরেজ শাসিত ভারতের সাধারণ ভাষা বা মূল ভাষা কি হবে এটা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। ততদিনে অবশ্য ইংরেজরা ভারতীয়দের মধ্যে ধর্মীয় বিদ্বেষের বীজের চারা উপ্ত করতে সক্ষম হয়েছে। হিন্দু মুসলিম বিদ্বেষের চারা তখন ইংরেজদের দেয়া কূটবাতাসে দোল খাচ্ছে।
হিন্দু আধিপত্যের কংগ্রেস মহল এক বাক্যে হিন্দীর স্বপক্ষে রায় প্রদান করে। স্বাভাবিকভাবেই মুসলমানরা বিপক্ষে দাঁড়িয়ে যায়। উর্দুর পক্ষে মত প্রকাশ করে।
যদিও উর্দুকোনাে অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের ভাষা ছিল না। তবে এই দুই মতবাদের বিপক্ষে বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল থেকে বাংলাকে ভারতের সাধারণ ভাষা রূপে গণ্য করা হয়।
কিন্তু অল্প দিনেই সুচতুর ইংরেজদের কাছে বহু ভাষাভাষী মানুষের দেশে বিশাল ভূভারতকে শাসন করার জন্যে দাফতরিক ভাষা হিসেবে একটি মাত্র ভাষা ইংরেজির প্রচলন কঠিন এবং প্রায় অসম্ভব ব্যাপার হিসেবে বােধগম্য হয়।
বাংলাকে বাংলা অঞ্চলের প্রধানভাষা এবং রাষ্ট্রীয় কাজের প্রধান ভাষা করার পক্ষে সর্বপ্রথম মত প্রকাশ করেন ন্যাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেড নামক একজন ব্রিটিশ লেখক। জীবনের বেশ কিছুদিন বাংলা অঞ্চলে বসবাস করে তিনি বাংলার প্রয়ােজনীয়তা উপলব্ধি করেন। এ গ্রামার অব দ্য বেঙ্গল ল্যাঙ্গুয়েজ’ নামে তিনি একটি বই রচনা করেন ১৭৭৮ সালে। এই বইটিকে বলা হতাে হ্যালহেডের ব্যাকরণ। লেখক তার এই বই এর ভূমিকায় ফার্সির পরিবর্তে বাংলাকে সরকারি কাজকর্মে ব্যবহারের প্রস্তাব উপস্থাপন করেন।
পরবর্তীতে বাংলা ভাষার শব্দ প্রাচুর্য, ভাবপ্রকাশের উন্নত এবং ব্যবহারিক সব সুবিধার কাজ পর্যালােচনা করে বাংলা ভাষাকেই বাংলা অঞ্চলে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করেন ন্যাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেড।
১৯১৮ সালে ভারতের ‘সাধারণ ভাষা’ অর্থাৎ রাষ্ট্রভাষা কী হবে, তা নিয়ে বুদ্ধিজীবী মহলে চিন্তা-ভাবনা শুরু হয়। ১৯২০ সালে বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথের গড়া শান্তি নিকেতনে বাংলার বুদ্ধিজীবীগণের এক সভা আহবান করা হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন স্বয়ং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কিন্তু অবাক করা বিষয়, সভায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভারতের সাধারণ ভাষা অর্থাৎ রাষ্ট্রভাষা হিসেবে হিন্দির পক্ষে নিজের মত পােষণ করেন। উপস্থিত বাঘা বাঘা বুদ্ধিজীবী পণ্ডিতেরা রবীন্দ্রনাথের মতকে অবনত মস্তকে সমর্থন করেন। তবে এ প্রস্তাবের সরাসরি বিরােধিতা করেন সভায় অংশগ্রহণকারী জ্ঞান তাপস ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ। সভায় তিনি বাংলার স্বপক্ষে দীর্ঘ এক প্রবন্ধ পাঠ করেন। প্রবন্ধে তিনি বাংলা অঞ্চলে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার প্রয়ােজনে, বাংলা ভাষার উৎকর্ষ এবং সৌন্দর্যকে তুলে ধরেন। কিন্তু তখনকার সময়ে রাজনৈতিক কারণে ভারতের সকল অঞ্চলে বাঙালির এই দাবি বা মতামত গৃহীত হয়নি।
কাজেই উপমহাদেশে সাধারণ ভাষা বা ‘লিংগুয়া ফ্রাঙ্কা নিয়ে ব্রিটিশ ভারতেই বিতর্কের সূত্রপাত হয়েছিল।
ব্রিটিশ বা ইংরেজরা এদেশে আগমনের বহু আগে থেকেই বাংলাভাষি প্রধান অঞ্চলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য একটি শক্ত ভিতের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল। বাংলা ভাষা হাজার বছরের প্রাচীন। চর্যাপদ তার নিদর্শন। মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্যসমূহ, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, পদ্মাবতী মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। দ্বাদশ শতকের কবি আবদুল হাকিম (১৬২০ – ১৬৯০) লিখেছেন :
যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী
সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় জানি।
দেশী ভাষা বিদ্যা যার মনে না জুড়ায়
নিজ দেশ ত্যাগী কেন বিদেশে ন যায়।

সাহিত্য সম্পদে বাংলা ভাষা যে এশিয়ার শ্রেষ্ঠতম- এ কথা কংগ্রেসের অনেক। পণ্ডিত ও রাজনৈতিক নেতারাও স্বীকার করেছিলেন। ভাষার বিতর্ক চলাকালে কংগ্রেসের অন্যতম নেতা জওহরলাল নেহেরু ১৯৪৬ সালে একবার পূর্ববঙ্গে আসেন। দেখে শুনে ফিরে গিয়ে তাঁর এক বক্তৃতায় পূর্ববঙ্গ ও আদি বাংলাদেশে সম্পর্কে তাঁর যে ধারণা জন্মেছে তা তিনি ব্যক্ত করেন। তিনি মত প্রকাশ করেন, ‘বঙ্গদেশের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য, জলবায়ু, গাছপালা, মানুষ, জীবন যাপন পদ্ধতি প্রমাণ করে দেয় যে, নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়ে এবং সম্পূর্ণ আলাদা একটি দেশ এবং মারাঠা ও গুজরাটি ভাষা অগ্রসর, বিশেষভাবে আধুনিক বাংলা সাহিত্যের মৌলিকতা ও সৃজনী প্রতিভা হিন্দি হইতে অধিক।
১৯২১ সালে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার লিখিত দাবি ইংরেজ সরকারের কাছে উত্থাপন করেন নবাব সৈয়দ নওশাদ আলী। তিনি দাবি উপস্থাপন করেছিলেন ভারতের রাষ্ট্রভাষা যা-ই হােক, বাংলার রাষ্ট্রভাষা করতে হবে বাংলা ভাষাকেই।
ভারতের সাধারণ ভাষা নিয়ে এ বির্তকের সময়কালে ১৯২৬ সালে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজও বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চা ও জ্ঞান-বিজ্ঞান। বিকাশের উপর গুরুত্বারােপ করা হয়।
১৯৩৭ সালে দৈনিক আজাদ পত্রিকায় বাংলা ভাষার স্বপক্ষে এক দীর্ঘ সম্পাদকীয় ছাপা হয়। জনৈক শ্রীযুক্ত প্রফুল্ল কুমারের এক বিবৃতিকে উদ্ধৃত করে সম্পাদকীয়তে সরকারকে বলা হয়, হিন্দি বা হিন্দুস্থানি ভাষায় কোনাে উচ্চাঙ্গের সাহিত্য নেই, শব্দ সম্পদও বেশি নয়। কিন্তু বাংলা ভাষার সে যােগ্যতা আছে। তাই ভারতের রাষ্ট্রভাষা বাংলার চেয়ে হিন্দির যােগ্যতা কোনাে অংশেই বেশি নয়। ‘সাহিত্যের মধ্যে বাংলা সমস্ত প্রাদেশিক ভাষার মধ্যে শ্রেষ্ঠ। বাংলা ভাষায় বিবিধ ভাব প্রকাশােপযােগী শব্দের সংখ্যাও বেশি। অতএব বাংলা সব দিক দিয়েই ভারতের রাষ্ট্রভাষা হইবার দাবি করতে পারে।’
সম্পাদকীয়তে বিস্তারিতভাবে বলা হয়: একদিকে মানভূম, সিংভূম, সাঁওতাল পরগনা, পূর্ণিয়া, ভাগলপুর, অন্যদিকে শ্রীহট্ট, গােয়ালপাড়া, কাছাড়, পর্যন্ত বাঙ্গলার আসল সীমানা। এই বিস্তৃত ভূখণ্ডে প্রায় ৭ কোটি ৩০ লক্ষ লােক বাঙ্গলা ভাষায় কথা বলে। হিন্দি ভাষার সংখ্যা এর চেয়ে বেশি নয়। তাহা ছাড়া আসামী, উড়িয়া, মিথিলিও বাঙ্গলারই শাখা ভাষা বলিতে অত্যুক্তি হয় না। পূর্ববঙ্গে ও বাঙ্গলার বিভিন্ন জেলায় উচ্চারণের কিছু প্রভেদ আছে বটে, কিন্তু লেখ্য বাঙ্গলার রূপ সর্বত্র একই। সাহিত্যের দিক দিয়া বাঙ্গলা ভারতের সমস্ত প্রাদেশিক সাহিত্যের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। বাঙ্গলা ভাষার বিবিধ ভাব প্রকাশ উপযােগী শব্দের সংখ্যাও বেশি। অতএব বাঙ্গলা সবদিক দিয়াই ভারতে রাষ্ট্রভাষা হইবার দাবি করতে পারে।
‘মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেস হিন্দিকে ভারতের রাষ্ট্রভাষা করিবার প্রস্তাব করিয়াছে বটে, কিন্তু এ বিষয়ে বাঙ্গলা ভাষার চেয়ে হিন্দির যােগ্যতা কোনাে দিক দিয়াই বেশি নহে। একদিকে বিহার হইতে রাজপুতনা, অন্যদিকে গারােয়াল হইতে মধ্যপ্রদেশ পর্যন্ত হিন্দি ভাষা বিস্তৃত বটে, কিন্তু এই ভূ-ভাগের মধ্যে ৪-৫ রকমের হিন্দি প্রচলিত। তাহাদের পরস্পরের মধ্যে পার্থক্য যথেষ্ট। ইহা ছাড়া হিন্দির পাশাপাশি উর্দুও ভারতের রাষ্ট্র ভাষা হইবার দাবি করিতেছে। রাষ্ট্রভাষার আসনের উপর বাঙ্গলা ভাষার দাবি সম্বন্ধে আর একটি কথাও বিশেষভাবে জোর দিয়ে বলা যাইতে পারে রাষ্ট্রভাষার নির্বাচন লইয়া হিন্দি-উর্দুর সমর্থকদের আজ যে তুমুল সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ উপস্থিত হইয়া গিয়াছে, তাহার ফলে হয়ত উর্দু ও হিন্দির মধ্যে কোনােটীরই রাষ্ট্রভাষার আসন অধিকার করা সম্ভব হইবে না। কিন্তু বাঙ্গলাকে রাষ্ট্রভাষা রূপে গ্রহণ করা হইলে এই সাম্প্রদায়িক সংঘাত-সংর্ঘষের আশংকা বহু পরিমাণে কমিয়া যাইতে পারে। কারণ মােছলেম ভারতের অন্তর্গত অংশ খাঁটি বাঙ্গলাভাষী। হিন্দি ও বাঙ্গলার মধ্যে প্রতিযােগিতা হইলে বাঙ্গালাকে সমর্থন করা তাহাদের পক্ষে খুবই স্বাভাবিক।
জ্ঞানতাপস দেওয়ান মােহাম্মদ আজরফ ‘ভাষা আন্দোলন সাতচল্লিশ থেকে বায়ান্ন (মােস্তফা কামাল) গ্রন্থের নাম ভূমিকায় বলেছেন ‘মূলত ভাষা আন্দোলনের দু’টি পর্যায় রয়েছে। প্রথম পর্যায় ১৯৪৭-৪৮ সালের আন্দোলন। এতে অংশগ্রহণকারী ছিলেন ছাত্র, শিক্ষক, অধ্যাপক ও সচেতন বুদ্ধিজীবী শ্রেণী এবং দ্বিতীয় পর্যায়ের আন্দোলন হল ৫২ সালের গণআন্দোলন। এ দুটি পর্যায় নিয়েই সামগ্রিকভাবে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস।
ভাষা আন্দোলনের সামগ্রিক ইতিহাসে আরাে একটি পর্যায়ের যােগ হয়ে যায় বা ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসের আরাে একটি পর্যায় রয়েছে সেটি হচ্ছে, ভারত বিভাগ উত্তর ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস। এই সময়কাল বঙ্গভঙ্গ (১৯০৫-১৯৪৭) ভারত ভাগ পর্যন্ত বিস্তৃত। তাহলে ভাষা আন্দোলনের মােট ৩টি পর্যায় দাঁড়ায়। প্রথম পর্যায়ের কার্যক্রমকে আন্দোলন না বলে ভাষা প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টাও বলা চলে। এই দীর্ঘ সময়ব্যাপি ভারতে মূল ভাষা কি হবে তাই নিয়ে আলােচনা -বির্তক, লেখালেখি এসবই চলছিল। তখনকার কবি সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবী চিন্তাশীল ব্যক্তিগণের মধ্যে সমগ্র ভূভারতের একক ভাষা বা সাধারণ ভাষার প্রশ্নে বিতর্ক শুরু হয়।
কংগ্রেসের সর্বোচ্চ নেতৃবৃন্দের পক্ষ থেকে হিন্দিকে সমগ্র ভারতে রাষ্ট্রভাষা করার জোর প্রচেষ্টা শুরু হয়। এতে মােহনদাস করম চান্দ গান্ধীসহ কংগ্রেসের শীর্ষস্থানীয় উদার দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী বলে ইতিমধ্যে পরিচিত সকল নেতৃবৃন্দই জড়িত ছিলেন। বিশেষ করে শীর্ষস্থানীয় হিন্দু নেতৃবৃন্দ। এই পরিপ্রেক্ষিতে উত্তর ভারতের মুসলমানদের পক্ষ থেকে হিন্দির পাল্টা দাবি হিসেবে উর্দুকে সমগ্র ভারতের রাষ্ট্রভাষা করার যৌক্তিকতা ও দাবি-উত্থাপন করা হয়। এলাহাবাদের হাইকোর্টের মাননীয় প্রধান বিচারপতি মােহাম্মদ সােলায়মানের সর্বভারতীয় রাষ্ট্র ভাষার প্রশ্নে ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (হায়দারাবাদ) এক আলােচনা সভায় মত প্রকাশ করেন : ভারতের বিভিন্ন ভাষাভাষী অধিবাসীদের মধ্যে এমন একটি ঐক্যসূত্রের যােগ রহিয়াছে যাহা ইউরােপের কোনাে দেশের মধ্যে নাই। … ভারতবর্ষে একভাষা ও একজাতীয় বর্ণমালা প্রচলনের আদর্শ হয়তাে অনাগত বহু বর্ষ যাবত আদর্শের রাজ্যেই থাকিয়া যাইবে; তথাপি ভারতবর্ষে অন্তত একটি ভাষা। আছে যাহা ভারতের সমস্ত প্রধান প্রধান শহরে প্রচলিত, সর্বাপেক্ষা অধিক সংখ্যক লােক যে ভাষায় অভিজ্ঞ এবং পৃথিবীর অধিক স্থানের লােক যে ভাষায় কথা বলিয়া থাকেন। … ভারতবর্ষের ভাষা জগতে ইহা (উর্দু) এক নতুন অভ্যুদয়। বিগত বহু শতাব্দী যাবত হিন্দু ও মােসলেম সংস্কৃতির ঘাত-প্রতিঘাত মিলন-মিশ্রণের ভিতর দিয়া এই ভাষার উদ্ভব হইয়াছে।
এই দুই ভাষাভাষীর দাবির অবস্থানের বিপরীত তখন থেকেই বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলের চিন্তাশীল এবং প্রগতিশীল মানুষের মধ্যে বাংলাকে ভারতের সাধারণ ভাষা করার প্রস্তাব উত্থাপিত হয়।
১৯৪৩ সালে মাসিক মােহাম্মদী পত্রিকায় এক প্রবন্ধে বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও রাজনীতিবিদ জনাব আবুল মনসুর আহমদ লেখেন, “উর্দু নিয়া এই ধস্তাধস্তি না করে আমরা সােজাসুজি বাংলাকেই যদি পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বা জাতীয় ভাষারূপে গ্রহণ করি তবে পাকিস্তান প্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আমরা মুসলিম বাংলায় শিক্ষিত সম্প্রদায় নিজেরাই পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রীক সামাজিক, শিক্ষাগত অর্থনৈতিক ও শিল্পগত রূপায়নে হাত দিতে পারব। ততদিনে অবশ্য ভারতের বুকে মুসলমানদের স্বতন্ত্র আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার দাবি অর্থাৎ স্বাধীন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দাবি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছে। ১৯৪০ সালে হিন্দু প্রাধান্যবাদ রাজনৈতিক দল কংগ্রেসের পালা মুসলমানদের রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগের মাধ্যমে। ইংরেজদের কাছ থেকে ভারতের স্বাধীনতা লাভের ক্ষেত্রে ভারত দুটো স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে সােচ্চার তখনকার ভারতবাসী। ১৯৪০ সালে লাহাের প্রস্তাবে ভারত স্বাধীন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দাবির সঙ্গে সঙ্গে সর্বভারতীয় পর্যায়ে মুসলমানদের মধ্যে হিন্দুর বিপরীতে পাল্টা দাবি হিসেবে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার মানসিকতা মুসলমানদের মধ্যে আরাে প্রবল হয়।
১৯৪৭ সালে ১৪ আগস্ট দুভাগে বিভক্ত পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পূর্ব পাকিস্তানের লেখক বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে রাষ্ট্রভাষা বিষয়টি নতুন প্রত্যয় নিয়ে। প্রতিভাত হয়।
বিভাগ পূর্বকালেই কলিকাতা ও ঢাকায় পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সােসাইটি এবং পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ নামে দুটো সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে ওঠে। বিভিন্ন সময়ে এই সংগঠনগুলাের সভা, মিটিংয়ে বহুবার বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের ভাষাভাষা করার ব্যাপারটি আলােচিত হয়। লাহাের প্রস্তাবের আলােকে তখন অবশ্য ভারতে বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলগুলাে নিয়ে (পরবর্তী পূর্ব পাকিস্তানসহ) স্বাধীন সার্বভৌম বাঙলা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় ছিল বাঙালির মাধ্যমে। লাহাের প্রস্তাবে স্বাধীন বাঙলারই প্রস্তাব ছিল লাহাের প্রস্তাব।
১৯৪০ সালের ২২ ও ২৩ মার্চ লাহােরে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের এক অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। ২ দিনের এই অধিবেশনের সমাপ্তি অনুষ্ঠানে ২৩ মার্চ অবিভক্ত বঙ্গের প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা এ, কে, ফজলুল হক ব্রিটিশ সরকারের প্রতি ভারতের স্বাধীনতা প্রদানের ভারতবর্ষের দশ কোটি মুসলমানের স্বকীয় জীবনধারা স্বাধীনভাবে পরিচালনার উদ্দেশ্যে স্বতন্ত্র বাসভূমি কায়েমের দাবিতে এক দিকনিদের্শনামূলক প্রস্তাব রাখেন। মুসলমানদের স্বতন্ত্র বাসভূমি দাবির এই প্রস্তাবই ইতিহাসে পাকিস্তান প্রস্তাব’… নিখিল ভারত মুসলিম লীগের অত্র অধিবেশনের সুবিবেচিত অভিমত এই যে, এ দেশে কোনাে শাসনতান্ত্রিক পরিকল্পনাই কার্যকর কিংবা মুসলমানদের নিকট গ্রহণযােগ্য হইতে পারে না, যদি অতঃপর বর্ণিত মূলনীতিমূহের ভিত্তিতে তাহা পরিকল্পিত হয়। যথা ভৌগােলিক নৈকট্য সমন্বিত। ইউনিটগুলাে প্রয়ােজন অনুসারে সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলে যেমন, ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চল সমন্বয়ে অবশ্যই স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ গঠন। করিতে হইবে, যেখানে অন্তর্ভুক্ত ইউনিটগুলাে স্বায়ত্বশাসিত ও সার্বভৌম হইবে। এই মতাে … আরও ক্ষমতা দিতেছে।