১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ
পাকিস্তানের ২৩ বছরে প্রত্যক্ষ ভােটে প্রথম দেশব্যাপী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর এবং ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসে। ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসনের আগে শুধু প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সামরিক শাসনের অধীনে সব নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল পরােক্ষ ভােটে নির্বাচনের পূর্বে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ৩ ডিসেম্বর এক বেতার ভাষণে বলেন- Many doubts were expressed regarding the sincerity and intention of this regime but despute this, we remained stead fast in our aim of bringing back democracy in our land.
১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর জাতীয় পরিষদের এবং ১৭ ডিসেম্বর প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন সুশৃঙ্খলভাবে অনুষ্ঠিত হয়। জাতীয় পরিষদের ৩০০ আসনের মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানের উপজাতীয় এলাকার ১টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়নি। এছাড়া বাকি ২৯৯টি আসনে মােট ১৫৭০ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের ১৬২টি আসনে ৭৬৯ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। পূর্ব পাকিস্তানে প্রার্থীদের গড় হচ্ছে ৯.৭৫। অপরদিকে পশ্চিম পাকিস্তানে প্রার্থীদের গড় হচ্ছে ৫.৬ জন। পশ্চিম পাকিস্তানে জাতীয় পরিষদের ১৩৮টি আসনে স্বতন্ত্র ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মােট ৮০১ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সংখ্যা পূর্ব পাকিস্তানের তুলনায় পশ্চিম পাকিস্তানে বেশি। এখানে ২১০ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। অপরদিকে পূর্ব পাকিস্তানে স্বতন্ত্র প্রার্থী ১০৯ জন।
৭ ও ১৭ ডিসেম্বরের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনের পর ঘূর্ণিদুর্গত নির্বাচনী আসনগুলােতে ১৯৭১ সালের ১৭ জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় । ৯টি জাতীয় পরিষদ ও ১৮টি প্রাদেশিক পরিষদ এবং অন্যান্য
৯২
স্থানে তিনটি প্রাদেশিক পরিষদ আসনে নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হয়। এসব আসনগুলােতেও আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে। বাংলার মানুষ তাদের স্বাধিকার আদায়ের জন্য আওয়ামী লীগকে ভােট দেয়।
১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য সংরক্ষিত ১০টি মহিলা আসনে আওয়ামী লীগ থেকে জাতীয় পরিষদে ৭ জন নির্বাচিত হয়। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংরক্ষিত মহিলা আসন সহ ১৬৭টি আসন লাভ করে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে বিজয়ী হয়। বাকি দুইটি আসনের একটি পায় স্বতন্ত্র প্রার্থী পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজা ত্রিদিব রায় এবং পিডিপির নূরুল আমীন। স্বতন্ত্র সদস্য রাজা ত্রিদিব রায় পরবর্তীসময় আওয়ামী লীগে যােগদান করেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের পক্ষে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে একটি আসনও না থাকায় দলটি পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা সত্ত্বেও আঞ্চলিক মর্যাদার বাইরে ফিরে আসতে সক্ষম হয়নি। কারণ পশ্চিম পাকিস্তানের ৪টি প্রদেশ নিয়ে যে বিশাল ভূখণ্ড সেখানে আওয়ামী লীগের হয়ে কথা বলার কেউ থাকে না।
৯৩
পশ্চিম পাকিস্তানে ৪টি প্রদেশের মধ্যে পাঞ্জাবে ৬৪টি, সিন্ধুতে ১৮টি ও উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে ১টি আসনসহ মােট ৮৩টি জাতীয় পরিষদের আসনে জয়ী হয়ে পাকিস্তান পিপলস পার্টি দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। ওয়ালী ন্যাপ উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে জাতীয় পরিষদের ১৮টি আসনের ৩টিতে এবং বেলুচিস্তানের ৪টি আসনের মধ্যে ৩টিতে জয় লাভ করে, পাঞ্জাব ও সিন্ধুতে জাতীয় পরিষদের কোনাে আসনে জয়ী হয়নি। ১০ দিন পর অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৮৮টি আসন লাভ করে। তার আগে থেকেই অর্থাৎ জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের ফলে সকলের মনে ধারণা তৈরি হয়েছিল যে । নির্বাচনের ফলাফল কী হতে পারে।
পশ্চিম পাকিস্তানে নির্বাচনের ফলাফল ছিল ভিন্ন রকমের, কোনাে দলই। সেখানে ম্যান্ডেট পায়নি। পাঞ্জাব ও সিন্ধু প্রদেশে পিপলস পার্টি সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে পরিচিতি পায়। ভুট্টোর ব্যক্তিগত আকর্ষণ, তার ভারতবিদ্বেষী। বিষােদগার এবং রুটি কাপড়ে মাকানে’য় আহবান তাকে প্রতিষ্ঠা করলাে। জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে পাকিস্তান পিপলস পার্টি পশ্চিম পাকিস্তানে ১৪৪টি আসনের মধ্যে ৮৮টি আসন লাভ করে । সাংগঠনিক দিক থেকে পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের প্রায় সবগুলাে আসন লাভ করলেও পশ্চিম পাকিস্তানে তারা কোনাে আসন পায়নি। পক্ষান্তরে জুলফিকার আলী ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টি পূর্ব পাকিস্তানে কোনাে প্রার্থী মনােনয়ন দিতে না পারলেও পশ্চিম পাকিস্তানে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। ভুট্টো দাবী করলেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানে তার দল সংখ্যাগরিষ্ঠ । উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও বেলুচিস্তান এই দুটি প্রদেশের প্রথমটিতে ১টি ও দ্বিতীয়টিতে কোনাে আসনেই পিপলস পার্টি জয়ী হয়নি। সুতরাং পশ্চিম পাকিস্তানে তাঁর দল সংখ্যাগরিষ্ঠ এ কথা যুক্তিসিদ্ধ ছিল না। এক ইউনিট বাতিল করার পর পশ্চিম পাকিস্তানকে এভাবে প্রদেশ হিসেবে গণ্য করে সংখ্যাগরিষ্ঠতার দাবী অযৌক্তিক। পাঞ্জাব ও সিন্ধু প্রদেশে পিপলস পাটি ছিল। সংখ্যাগরিষ্ঠ। কিন্তু ভুট্টো বিষয়টা ভিন্নভাবে উপস্থাপন করতে লাগলেন। বাহ্যত তা দেখে যে কারাে মনে হতে পারে, পূর্ব পাকিস্তানে আছে আওয়ামী লীগ এবং পশ্চিম পাকিস্তানে আছে কেবল পিপলস পার্টি অর্থাৎ সমানে সমান। পাকিস্তান ব্যাপী কেন্দ্রীয় দল ওয়ালী ন্যাপ একমাত্র বেলুচিস্তান প্রদেশেই
৯৪
সরকার গঠন করার মতাে আসন পায়। যদিও উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে তারা হাজারভী গ্রুপের সাথে কোয়ালিশন সরকার গঠনের মতাে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে তারা ১টি মাত্র আসন লাভ করতে সমর্থ হলেও পাঞ্জাব ও সিন্ধুতে তারা কোনাে আসন লাভ করতে পারেনি। ডানপন্থী ধর্মীয় দলগুলাে দুই অঞ্চলেই ব্যর্থ হলাে। জামায়াতে ইসলামি করাচীর মােহাজের মহলে সমর্থন পেলেও তাদের প্রধান ঘাঁটি পাঞ্জাবে তারা ব্যর্থ হলাে।
পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনের এই ফলাফল ছিল অভাবিত। পূর্ব পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্র প্রতিরক্ষা ও গােয়েন্দা বিভাগ নির্বাচনের পূর্বে। প্রেসিডেন্টের কাছে একটি রিপাের্ট দিয়েছিল। সে রিপাের্টের সাথে নির্বাচনী ফলাফলের শুধু গরমিলই হয়নি সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র পরিস্ফুট হয়। ধারণা করা হয়, গােয়েন্দা বিভাগের রিপাের্টের ভিত্তিতেই পাকিস্তানের সামরিক জান্তা এমন একটি নিরপেক্ষ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে সাহস করেছিল। তাদের ধারণা ছিল, পাকিস্তানের দক্ষিণপন্থী দলগুলাে যথা পিডিপি, মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামি ও আসগর খানের গ্রুপ প্রমুখ নির্বাচনে আশাতীত ফল লাভ করবে। এমনকি আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও সত্যিকার অর্থে ফলাফল এত বেশি তাঁর অনুকূলে যাবে সেটাও ধারণা করতে পারেননি। তিনি পূর্ব পাকিস্তানে তার সংখ্যাগরিষ্ঠতা সম্পর্কে নিশ্চিত ছিলেন। কিন্তু সে সংখ্যাগরিষ্ঠতা শুধু নিরঙ্কুশ নয়, একেবারে দু’একটি আসন বাদে পুরাে গরিষ্ঠতা অর্জন এতটা হয়তাে তিনি কল্পনায়ও আনেননি । শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানে ৯০% আসন লাভের কথা ব্যক্ত করেছিলেন। কিন্তু তিনি পেয়েছিলেন প্রায় ৯৯.৯৯% ভাগ আসন। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠীর মনােভাব ও তাদের পরিকল্পনা সম্পর্কে আবুল মনসুর আহমদ উল্লেখ করেছেন- ‘প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া সহ পশ্চিমা নেতারা আশা করিয়াছিলেন যে, সব দল না হইলেও বেশিরভাগ দলই কিছু কিছু আসন পাইবে, যতই জনপ্রিয় হােক আওয়ামী লীগ ন্যাশনাল এসেম্বলির পূর্ব পাকিস্তানের ভাগের ১৬৯টি আসনের মধ্যে একশ’র বেশি আসন পাইবে না, বাকি আসনগুলাের অধিকারী জামাতে ইসলামী নিযামে ইসলাম ও দুই তিনটা মুসলিম লীগের সকলেই স্ট্রং সেন্টারের শাসনতন্ত্র রচনার ব্যাপারে পশ্চিমা পার্টিগুলাের সাথে। থাকিবেন। এমনকি সরকার গঠনের ব্যাপারে তারা আওয়ামী লীগের চেয়ে পশ্চিমা দলগুলাের সাথেই কোয়ালিশন করিবেন। (প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৩৭-৫৩৯)
৯৭
নির্বাচনের ফলাফল সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে ইয়াহিয়া খানের মন্ত্রিসভার অন্যতম সদস্য জি ডব্লিউ চৌধুরী মন্তব্য করেছেন- ‘নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর এবং যে কোনাে মানদণ্ডেই তা ছিল অবাধ ও নিরপেক্ষ । ভাগ্যের পরিহাস এটাই ছিল অখণ্ড পাকিস্তানের সর্বপ্রথম ও সর্বশেষ প্রকৃত নির্বাচন। নানা মহলে ব্যক্ত অভিমতের বিপরীতে নির্বাচনী ফলাফল অন্ততঃ পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষেত্রে শাসক মহল কিংবা সেখানকার রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহের যে কোনাে ঐকান্তিক পর্যবেক্ষকের কাছেই কোনাে বিস্ময় উদেককারী ছিল না। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের নির্বাচনী ফলাফল বিস্ময়ের উৎপাদন করে বিশেষ করে সেখানে ডানপন্থী ও ধর্মীয় দলগুলাের সম্পূর্ণ পরাজয়ে এবং একজন অপাঞ্জাবী ভুট্টোর পশ্চিম পাকিস্তানের নেতা হিসেবে আরাে সঠিকভাবে বললে পাঞ্জাবের নেতা হিসেবে উত্থানে। (অখণ্ড পাকিস্তানের শেষ দিনগুলি, পৃ. ১২২)।
দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে মােট প্রদত্ত ভােটের শতকরা ৩ ভাগ ত্রুটিপূর্ণ হওয়ায় বাতিল করা হয়েছে। ১৫৩টি ভােটদান কেন্দ্রে ১ কোটি ৬৪ লাখ ৬০ হাজার ভােটার ভােটদান করেছে এবং ৪ লাখ ১৩ হাজার ৮০০’রও বেশি ব্যালটপত্র বাতিল ঘােষিত হয়েছে । বেসরকারি হিসেব মতে মােট ভােটারের শতকরা ৫৫.৮ ভাগ ভােটার পূর্ব পাকিস্তানে ভােট দিয়েছে। জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে মােট রেজিস্টার্ড ভােটারদের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে শতকরা ৫৭ ভাগ, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে শতকরা ৪৮ ভাগ, পাঞ্জাবে ৬৯ ভাগ, সিন্ধুতে ৬০ ভাগ এবং বেলুচিস্তানে শতকরা ৬০ ভাগ ভােটার ভােটদান করেছেন। প্রধান নির্বাচন কমিশন সূত্র থেকে জানা যায়, সামগ্রিকভাবে দেশের সর্বমােট ভােটার সংখ্যার শতকরা প্রায় ৬০ ভাগ ভােটদাতা ভােট প্রদান করেছেন। ভােটদানে উৎসাহ ছিল প্রচুর। পূর্ব পাকিস্তানে ৫৭, পাঞ্জাবে ৬৯, সিন্ধুতে ৬০, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে ৪৮ এবং বেলুচিস্তানে ৪০ শতাংশ ভােট প্রদত্ত হয় এবং ৩ শতাংশ ভােট বাতিল হয় যায়। সফদার মাহমুদের মতে, মােট ভােটের মধ্যে আওয়ামী লীগ আনুমানিক ২২.৩৯% ভােট পেয়েছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের ভােট ছিল শতকরা ১০০ ভাগ। নির্বাচন কমিশনের মতে, আওয়ামী লীগ ৭৫% ভােট পেয়েছে। আবার অন্য ভাবে বলা হয় যে, মােট ভােটারের মাত্র ৪২% ভােট আওয়ামী লীগ পেয়েছে। এর মধ্যে হিন্দু ভােটারের সংখ্যা ছিল ১৫% এবং পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম ভােটের ১৭% লাভ করে।
৯৮
নির্বাচনের ফলাফলে দেখা যায় যে, জাতীয় পরিষদের আসনে বিজয়ী আওয়ামী লীগ প্রার্থী আশরাফ আলী চৌধুরী সর্বাধিক ভােট পেয়েছেন। অধিক সংখ্যক ভােট লাভের ক্ষেত্রে পার্টি প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। আশরাফ আলী চৌধুরী ১৮১৭৪৪ ভােট পেয়েছেন। পক্ষান্তরে দ্বিতীয় স্থান অধিকারী শেখ মুজিবুর রহমান ১৬৪০৭০ ভােট পেয়েছেন। অপর একটি আসনেও বঙ্গবন্ধু ১২২৪৩৩ ভােট লাভ করেছেন। আবার প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে চূড়ান্ত সরকারি ফলাফল ঘােষণার পর জানা যায় যে, পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ রহমান ৮৯২১৩ বৈধ ভােটের মধ্যে ৮৬৬০১টি ভােট পেয়েছেন।
নির্বাচনে প্রদত্ত ভােটের ৮২ শতাংশ আওয়ামী লীগ পাওয়ায় বেশিরভাগ প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়। জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনােনীত প্রার্থীরা একচেটিয়াভাবে অপর সকল প্রার্থীকে বিরাট ব্যবধানে পরাজিত করে। ফলে প্রায় ৫০০ নির্বাচন প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হবে বলে মনে করা হয়েছে। বিভিন্ন দলের ও স্বতন্ত্র প্রার্থী মিলে মােট ৭৪৬ জন প্রার্থী ১৫৩টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। বিজয়ী আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের সঙ্গে অপরাপর প্রার্থীর ভােটের ব্যবধান এত বেশি হয় যে, নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বিগণের জামানত বাজেয়াপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। যাদের স্থান তৃতীয় ও তারও পরে তাদের জামানত বাজেয়াপ্ত হওয়া অবশ্যম্ভাবী। যে প্রার্থী প্রদত্ত ভােটের এক অষ্টমাংশ পাবেন না তার জামানত বাজেয়াপ্ত হবে। প্রার্থী পিছু এক হাজার টাকা হিসেবে নির্বাচন কমিশন জামানত বাজেয়াপ্ত হওয়ার কারণে ৫ লক্ষ বা ততােধিক টাকা পেয়েছে বলে অনুমান করা হয়। পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে মােট ১৭৪৪ জন প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে। প্রাদেশিক নির্বাচন কমিশন সূত্র থেকে জানা যায় যে, প্রার্থীদের জামানত বাজেয়াপ্ত করার ফলে বাজেয়াপ্ত মােট টাকার পরিমাণ হচ্ছে প্রায় ৬ লক্ষ টাকা। আনুমানিক ৬৬ শতাংশ প্রার্থী তাদের জামানত হারিয়েছেন। জামানত সবচেয়ে বেশি বাজেয়াপ্ত হয়েছে মুসলিম লীগ কাইয়ুম পন্থী, এরপরে রয়েছে কনভেনশন মুসলিম লীগ ও প্রগ্রেসিভ মুসলিম লীগ। যে সব দল জামানত হারিয়েছেন তাদের মধ্যে সবচেয়ে কম ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে জামায়াতে ইসলামি ।
৯৯
নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ে পাকিস্তান রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রতিক্রিয়া
নির্বাচন পরবর্তী সময়ে পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ ও পশ্চিম পাকিস্তানে পিপলস পার্টি জয়ী হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তান রাজনৈতিক অঙ্গনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দৃশ্যমান। তাদের প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলাে। নির্বাচনের ফলাফলকে কীভাবে গ্রহণ করেছে তা জানা যায়।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ৭ ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে অসাধারণ সাফল্যের জন্য আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান ও পিপলস পার্টি প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টোকে অভিনন্দন জানান । দুই নেতার নিকট প্রেরিত একই ধরনের দুইটি অভিনন্দন বাণীতে প্রেসিডেন্ট বলেন, আপনার দলের অসাধারণ সাফল্যের জন্য আমি আপনাদের অভিনন্দন জানাই। নির্বাচনী ফলাফলে প্রকাশিত হয় যে, পাকিস্তানের জনগণের অতি বৃহৎ অংশ জাতীয় জীবনের এই ক্রান্তিলগ্নে আপনাদের দলের উপর আস্থা স্থাপন করেছে । আমাদের মাতৃভূমির ঐক্য ও সংহতি রক্ষা এবং জনগণের রাজনৈতিক আকাংখা পূরণ, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমৃদ্ধি বিধানে সক্ষম একটি শাসনতন্ত্রের আশায় দেশবাসী এখন সাগ্রহে অপেক্ষা করিবে। আমি আশা ও প্রার্থনা করি, আপনাদের নেতৃত্বে ও তত্ত্বাবধানে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা তাদের ওপর আরােপিত শাসনতন্ত্র প্রণয়নের গুরু দায়িত্ব সুচারুভাবে পালন করতে সমর্থ হবেন। পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথম সাধারণ নির্বাচনের পর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বিজয়ী প্রার্থীদের অভিনন্দন জানান। তিনি এক বিবৃতিতে জানান যে, গত ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত আমাদের ইতিহাসের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে যেসব প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছেন, আমি তাদের অভিনন্দন জানাই। বিজয়ী প্রার্থীরা এখন তাদের রায়ের মাধ্যমেই বিনম্র আর মহানুভবতা প্রদর্শন করবেন বলেই আমার বিশ্বাস। তিনি আরাে বলেন, এ প্রথমবারের মতাে পাকিস্তানের জনগণ প্রাপ্তবয়স্ক ভােটাধিকারের ভিত্তিতে প্রত্যক্ষ ভােটে নিজেদের প্রতিনিধি নির্বাচনের অবাধ সুযােগ পেয়েছে। উত্তেজনা ছিল অত্যন্ত প্রবল কিন্তু জাতি যে সুশৃঙ্খলার পরিচয় দিয়েছে তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় আর তাই তা সর্বমহলে প্রশংসাও লাভ করেছে। এতে জাতির রাজনৈতিক সচেতনতার প্রমাণ পাওয়া গেছে। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের মূল পরিকল্পনা সামরিক সরকারের রয়েছে। নির্বাচন হচ্ছে তার প্রথম পর্যায় মাত্র। দ্বিতীয় পর্যায় হচ্ছে একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়ন । এ
১০০
জন্যই নবনির্বাচিত প্রার্থীদের আমি স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি যে, জনগণ তাদের ভােট দিয়ে তাদের ওপর বিরাট আস্থা স্থাপন করেছে। দেওয়া নেওয়া ও সহনশীলতার ভিত্তিতে এখনই তারা শাসনতন্ত্র প্রণয়নের কাজে লেগে যান । জাতি এখন তাদের কাছে এই চাচ্ছে। জাতি তাদের ওপর যে আস্থা স্থাপন করেছে তারা তা রক্ষা করবেন এ বিশ্বাস আমার আছে। তাদের প্রচেষ্টা সফল হােক এটাই আমার কামনা। প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি আবদুস সাত্তার বলেন, সার্বজনীন ভিত্তিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পর পাকিস্তান বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশে পরিণত হয়েছে। বিপুল সংখ্যক লােক ভােটদানের ফলে ইহা প্রতিপন্ন হয়েছে যে, দেশের ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্র নির্ধারণ এবং যে রাজনৈতিক অবস্থার অধীনে শাসিত হবে সে সম্পর্কে নিজেদের মনােভাব জ্ঞাপনের জন্য জনসাধারণ উদগ্রীব । তিনি তাঁর বক্তব্যে আরাে বলেন, জনসাধারণ যে তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার সম্পর্কে সচেতন এবং কোনাে শক্তিই যে তাদের অভিপ্রায় অনুযায়ী অধিকার প্রয়ােগের ব্যাপারে নিবৃত্ত করতে পারবে না তা প্রমাণিত হয়েছে। তাদের রাজনৈতিক পরিপক্কতা লক্ষ্য করে বৈদেশিক পর্যবেক্ষকরাও বিস্মিত হয়েছেন। নির্বাচনের ফলাফল দৃষ্টে এই ধারণা বদ্ধমূল হয়েছে যে, জনসাধারণ অবস্থার পরিবর্তন সাধনের জন্য কাজ করতে প্রস্তুত। এই নির্বাচনে এটিই প্রমাণিত হয়েছে যে, তারা আঞ্চলিকতা ও ব্যক্তিত্বের ভিত্তিতে ভােট প্রয়ােগ করেনি। তারা নীতির ভিত্তিতে ভােট প্রয়ােগ করেছে।
পাকিস্তান পিপলস পার্টি প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো নির্বাচনের ফলাফল ঘােষণার পর টেলিফোনে শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে আলােচনা করেন এবং পূর্ব পাকিস্তানে একচেটিয়া জয় লাভের জন্য শেখ মুজিবুর রহমানকে অভিনন্দন জানান। পাকিস্তান পিপলস পার্টির করাচী জোনের চেয়ারম্যান আবদুল হাফেজ পীরজাদা বলেন, গণপরিষদে আওয়ামী লীগ ও পিপলস পার্টির সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ নির্ধারিত ১২০ দিনের শাসনতন্ত্র রচনার পথ সহজ করে তুলেছে। পাকিস্তান পিপলস পার্টির করাচী শাখার সভাপতি আবদুল হাফিজ পীরজাদা বলেছেন যে, গণপরিষদের পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ও পিপলস পার্টির প্রার্থীরা বিপুলভাবে নির্বাচিত হওয়ার নির্দিষ্ট ১২০ দিনের মধ্যে শাসনতন্ত্র রচনার সম্ভাবনা উজ্জল হয়ে উঠেছে। তাঁর মতে পিপলস পার্টির প্রার্থীরা জয়লাভ করায় শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করা সহজতর হয়েছে। তিনি
১০১
পাকিস্তান পিপলস পার্টির বিজয়কে জনগণের বিজয় বলে উল্লেখ করেছেন।
জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাংবাদিক সম্মেলনে এক বিবৃতিতে ঘােষণা করেন যে, আমাদের জনগণ এক ঐতিহাসিক রায় প্রদান করেছে। তারা এক অবিরাম সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তাদের এ রায় প্রদানের অধিকার অর্জন করেছে। আমাদের লক্ষ্য ৬-দফা এবং তা বাস্তবায়িত না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে। তিনি দেশবাসীকে এ আশ্বাস দেন যে, ৬-দফা ভিত্তিক পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের ব্যবস্থা সম্বলিত শাসনতন্ত্র প্রণীত হবে এবং ছয়দফাকে সামগ্রিকভাবে বাস্তবায়িত করা হবে। আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে পাঞ্জাব ও সিন্ধু প্রদেশে বিজয়ী হওয়ায় পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রধান ভুট্টোকে অভিনন্দন জানান। তারযােগে। প্রেরিত এক ফিরতি অভিনন্দন বার্তায় শেখ মুজিব তাঁর নিকট অভিনন্দন বাণী প্রেরণ করার জন্য ভুট্টোকে ধন্যবাদ জানান। জাতীয় পরিষদ নির্বাচনের মতাে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান আরেকবার ভােট দিয়ে আওয়ামী লীগের প্রতি পূর্ণ সমর্থনের পরিচয় দান করায় জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। জনতার উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের এই বিজয় আসলে বাংলাদেশের শােষিত জনগণের বিজয়।
নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে নিজ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন পাকিস্তান ন্যাশনাল লীগের প্রেসিডেন্ট আতাউর রহমান খান, কৃষক শ্রমিক পার্টির সভাপতি এ এস এম সােলায়মান, পাকিস্তান ইসলামিক প্রজাতন্ত্র দলের সভাপতি মওলানা নুরুজ্জামান, কাউন্সিল মুসলিম লীগ প্রধান মিয়া মমতাজ মােহাম্মদ দৌলতানা, প্রাদেশিক মুসলিম লীগ প্রধান খাজা খয়েরউদ্দিন, মীর সাইফুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক আতাউল হক খান, কাউন্সিল মুসলিম লীগের নেতা এয়ার মার্শাল (অব.) নূর খান, পাকিস্তান কনভেনশন মুসলিম লীগের সভাপতি ফজলুল কাদের চৌধুরী। তারা তাদের প্রতিক্রিয়ায় দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ ও পশ্চিম পাকিস্তানে পিপলস পার্টির চূড়ান্ত বিজয়ের জন্য শেখ মুজিবুর রহমান ও জুলফিকার আলী ভুট্টোকে অভিনন্দন জানান। তারা সকলে দেশের ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্র থেকে শুরু করে সকল ধরনের কর্মকাণ্ডে উভয় দলকে সহযােগিতা করার কথা ব্যক্ত করেন।
১০২
কিন্তু ব্যতিক্রম দেখা যায় পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামির আমীর অধ্যাপক গােলাম আযম এর বিবৃতিতে। তাঁর মতে, নির্বাচনে পাকিস্তানের রাজনীতি যুক্তির চেয়ে ভাবাবেগ দ্বারাই বেশি পরিচালিত হয়েছে। এমনকি আইন শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়ােজিত সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও কর্তৃপক্ষ বিগত এক বছরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে স্বাধীন ভাবে কাজ করার যথাযথ নিশ্চয়তা দানে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। তিনি বলেন নির্বাচনের ফলাফল যাই হােক না কেন, গণতন্ত্রের প্রতি তাঁর দলের অকুন্ঠ বিশ্বাস রয়েছে। গণতন্ত্রই দেশে রাজনৈতিক নেতৃত্ব পরিবর্তনের একমাত্র মাধ্যম বলে তিনি দৃঢ়তার সাথে উল্লেখ করেন। এই বিবৃতি প্রদানের একদিন পর গােলাম আযম শেখ মুজিবকে অভিনন্দন জানিয়ে পূর্ণ সহযােগিতা দান ও গঠনমূলক বিরােধিতার আশ্বাস দেন। কিন্তু ঢাকায় গােলাম আযমের সভাপতিত্বে প্রাদেশিক জামায়াতে ইসলামির দুইদিন ব্যাপী কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় নির্বাচনী ফলাফলকে মেনে নিতে অস্বীকার করা হয়। এই সভায় বলা হয়, নির্বাচন নিরপেক্ষ হয়নি। কিন্তু ১২ ডিসেম্বর জামায়াতে ইসলামির ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের কার্যকরী পরিষদের জরুরী সভায় দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে সন্তোষ প্রকাশ করে প্রস্তাব গৃহিত হয়। জামায়াতে ইসলামির নেতা অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল ওমরাও খান জাতীয় পরিষদে নির্বাচনে অনিয়মানুবর্তিতা ও দুর্নীতি সংক্রান্ত অভিযােগের সত্যতা অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, নির্বাচনে দুর্নীতির অভিযােগ বানােয়াট এবং ভিত্তিহীন। ভােট গ্রহণকারী কর্মচারীদের আচরণ ছিল সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ এবং প্রশংসাযােগ্য।
ন্যাপ ভাসানী পন্থীরা যদিও নির্বাচনে অংশ নেয়নি তবু ন্যাপ প্রধান মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এক সাংবাদিক সম্মেলনে পশ্চিম পাকিস্তান ন্যাপের সাথে পূর্ব পাকিস্তান ন্যাপের সম্পর্কচ্ছেদের কথা ঘােষণা করেন। তিনি আওয়ামী লীগের এ ঐতিহাসিক বিজয়কে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার প্রশ্নে জনসাধারণের গণভােটের রায় বলে মন্তব্য করেন। নির্বাচনের ফলাফল সম্পর্কে ওয়ালী ন্যাপের সভাপতি খান আবদুল ওয়ালী খান বলেন যে, পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে, যে দু’টি রাজনৈতিক দল প্রধানত বিজয়ীর বেশে আবির্ভূত হয়েছে, সে দুটি দল হলাে আওয়ামী লীগ ও পিপলস পার্টি। দু’টিই মূলত আঞ্চলিক দল। কারণ পশ্চিম পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের বুনিয়াদ নেই, পূর্ব পাকিস্তানে পিপলস পার্টির অস্তিত্বই নেই। এই
১০৩
ঘটনা দুই রাজনৈতিক দলের পথে প্রধান প্রতিবন্ধক স্বরূপ। এক অর্থে এর গুরুত্ব তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ দেশ রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। পূর্ব পাকিস্তান ন্যাপ ওয়ালী পন্থী সভাপতি অধ্যাপক মােজাফফর আহমদ ও সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আলতাফ হােসেন এক যুক্ত বিবৃতিতে বলেনপূর্ববাংলার জনগণ গণতন্ত্র, স্বায়ত্তশাসন ও নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য দীর্ঘদিন যাবৎ সংগ্রাম করে আসছে। তা বাস্তবায়নে দৃঢ় সংকল্পই ৭ ডিসেম্বরের নির্বাচনের মাধ্যমে পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে। পাকিস্তান ডেমােক্রেটিক পার্টির প্রধান নূরুল আমীন জাতীয় পরিষদ নির্বাচনের পর তাঁর এক প্রতিক্রিয়ায় গণতন্ত্রের আস্থাশীল হিসেবে জনগণের রায়কে সম্মান করার কথা বলেন। নবাবজাদা নসরুল্লাহ খান অভিযােগ করেন, আবেগ উত্তেজনার পরিবেশে দেশে এ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। পাকিস্তান ডেমােক্রেটিক পার্টির ভাইস প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল (অব.) সরফরাজ খান জাতীয় পরিষদে নির্বাচনে বিপুল বিজয়ের জন্য শেখ মুজিব ও ভুট্টোকে অভিনন্দন জানান। অবিভক্ত বাংলার প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশিম সাধারণ নির্বাচনে বিরাট সাফল্য লাভের জন্য শেখ মুজিব ও ভুট্টোকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, ইসলাম কখনাে বিপদাপন্ন হয়নি বা হবেও না। যারা নিজেদের ইসলাম পছন্দের দাবীদার বলে ঘােষণা করেছেন এবং ইসলামের অভিভাবক সেজে বসেছেন তারাই বিপদাপন্ন হয়েছেন। নির্বাচনে পাকিস্তানের জনসাধারণ যে উচ্চমানের রাজনৈতিক সচেতনতার পরিচয় দিয়েছে তার জন্য অভিনন্দন জানান। খিলাফতে রব্বানী পার্টির চেয়ারম্যান এ এম এম মােফাখখার সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সাফল্য অর্জনের জন্য শেখ মুজিবের প্রতি আন্তরিক অভিনন্দন জানান।
নির্বাচনের ফলাফলের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে অ্যান্থনী ম্যাসকারেনহাস উল্লেখ করেছেন-
‘নির্বাচনের ফলাফল বিভিন্ন লােকের কাছে বিভিন্ন তাৎপর্য বহন করেছিল। আওয়ামী লীগের পতাকাতলে বাঙালীরা ছিল বিজয়ােল্লাসে উল্লসিত। এই প্রথমবারের মতাে তারা প্রকৃত ক্ষমতার আশায় উজ্জীবিত হয়েছিল। এর সঙ্গে অতীতের উপনিবেশিক শাসনপদ্ধতির অবসান ঘটানাের এবং দুই দশকের শােষণের প্রতিকার করার যােগ্যতা তারা অর্জন করেছিল।
১০৪
১০৪
ভুট্টো কেবল পাঞ্জাবে এবং করাচীতে অপ্রত্যাশিত বিজয় লাভ করেও বিস্তৃত রাজনৈতিক ক্ষেত্র সম্পর্কে তার উল্লাসকে দমন করতে পারেননি। জামাতে ইসলামির মতাে ধর্মভিত্তিক দলগুলাে তাদের পরাজয়কে সহজভাবে স্বীকার করে নিতে পারেনি। সর্বোপরি জামাত প্রকাশ্যভাবে সরকারি হস্তক্ষেপের অভিযােগ তুলেছে। জনগণ যেভাবে তাদের রায় দিয়েছে, সেকথা ভেবে সমগ্র দেশ চরম বিস্ময়বােধ করেছে। … নির্বাচনের ফলাফল সম্পর্কে সরকার ছিল নিরপেক্ষ এবং সরকার নিজেকে কেবল পরিবর্তনশীল কর্তৃপক্ষ হিসেবে দাবী করেছিল যা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কাজে এবং যত শীঘ্র সম্ভব নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপার ছিল উৎসর্গীকৃত। (বাংলাদেশ লাঞ্ছিতা, পৃ. ৭২-৭৩)।
নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভূমিধ্বস বিজয়ের কারণ
নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় ছিল অভূতপূর্ব। আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিব তার বিভিন্ন বক্তৃতা বিবৃতির মাধ্যমে জনগণের সামনে নির্বাচনের গুরুত্ব তুলে ধরেন। তিনি বলতে থাকেন যে, এ নির্বাচন বাঙালীদের বাঁচা মরার লড়াই। ছয়দফা দাবী আদায় তথা স্বাধিকার আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য নির্বাচনের রায় ছিল একটি উল্লেখযােগ্য পদক্ষেপ । নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু দৃপ্তকণ্ঠে ঘােষণা করেন যে, লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত তাঁর সংগ্রাম চলবে। পাকিস্তানের তেইশ বছরের ইতিহাসে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে কিনা তা নিয়ে প্রথম দিকে সকলের মনে সন্দেহ ছিল । কিন্তু পরবর্তীসময় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের গৃহিত বিভিন্ন পদক্ষেপ দেখে সব রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণও আশান্বিত ছিল যে, দেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন হবে। যথাসময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘােষণা জাতিকে আরাে বেশি আশান্বিত করে তােলে। শেষ পর্যন্ত নির্দিষ্ট সময়ে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচন সর্ব মহলে গ্রহণযােগ্য হয়। কেউ কেউ নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তুললেও আওয়ামী লীগের বিজয়কে স্বীকার করে নেয়। পাকিস্তানের বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলাের ভরাডুবি তাদেরকে বাধ্য করে আওয়ামী লীগের বিজয়কে স্বীকার করে নিতে । আওয়ামী লীগের বিজয়ের পেছনে যেসব বিষয় কাজ করেছে সেগুলাে হলাে-
আওয়ামী লীগ শুরু থেকেই নির্বাচনকে গুরুত্বের সাথে নেয়। আইয়ুব
১০৫
খানের সময় থেকে এ দলটি প্রত্যক্ষ নির্বাচনের দাবী করতে থাকে। কিন্তু মৌলিক গণতন্ত্রের স্রষ্টা আইয়ুব খান সে দাবী পূরণ করেনি। বরং নিজের। ক্ষমতাকে পাকাপােক্ত করার জন্য একের পর এক পরােক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে এক দশক শাসন করেছে। পূর্ব বাংলার মানুষের দাবী দাওয়াকে অস্ত্রের ভাষায় দমন করে রাখা হয়। পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক পরিস্থিতি দমনের জন্য আশ্রয় নেন নির্যাতন, জেল জুলুমের। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে বিনা বিচারে মিথ্যা অভিযােগে কারাগারে পাঠানাে হয়। শেষ পর্যন্ত গণঅভ্যুত্থানের মুখে ইয়াহিয়া খানের হাতে ক্ষমতা সমর্পন করে রাজনীতি থেকে বিদায় নেন। পরবর্তী সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান শুরু থেকেই ঘােষণা দিয়েছিলেন যে, প্রাপ্তবয়স্কদের প্রত্যক্ষ ভােটে নির্বাচন দিবেন। তিনি ঘােষণা করেন যথাসময়ে রাজনীতির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিবেন। আওয়ামী লীগ প্রেসিডেন্টের একথার পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ঘরােয়া রাজনীতির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু তাঁর নির্বাচনী কার্যক্রম চালিয়ে যান। ১৯৭০ সালের ১ জানুয়ারি রাজনীতির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার পর বঙ্গবন্ধু আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেন। কারণ প্রথম থেকেই তাঁর লক্ষ্য ছিল নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে বিজয় ছিনিয়ে আনা। ঈপ্সিত লক্ষ্য পূরণের জন্য তিনি নির্বাচনী ছক তৈরি করেন। নিজে সার্বক্ষণিক ব্যস্ত থেকে নির্বাচনী প্রচারণা কার্যক্রম চালান। সমগ্র পূর্ব বাংলায় নির্বাচনী প্রচার কার্য চালান এবং জনগণের মাঝে আওয়ামী লীগের প্রতীক নৌকা মার্কায় ভােট দিতে উৎসাহিত করেন। নিজে সারা দেশে প্রচার কার্যের অংশ হিসেবে। জনসভা, সভা-সমাবেশ করতে থাকেন। সব বক্তৃতা বিবৃতির মাধ্যমে তাঁর ছয়দফা দাবীর কথা দৃঢ় ভাবে ব্যক্ত করেন। তিনি বলতে থাকেন ছয়দফার মাধ্যমে বাঙালীদের মুক্তি আসবে। তার ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাসের প্রতিফলন ঘটে নির্বাচনী রায়ে। জনগণ আওয়ামী লীগকে বিপুল ভােটে বিজয়ী করে ।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাঁর রাজনীতিক জীবনের শুরু থেকেই সাধারণ মানুষের অধিকার, দাবী দাওয়ার প্রতি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বারােপ করেন। তাঁর রাজনীতির হাতেখড়ি শহীদ সােহরাওয়ার্দীর কাছ থেকে। মুসলিম লীগের রাজনীতি থেকে শুরু করে ছাত্র রাজনীতিতেও তিনি সবসময়ই ছিলেন সরব। তিনি ছিলেন একজন সুবক্তা। সাংগঠনিক ক্ষমতা ছিল অসাধারণ। রাজনৈতিক
১০৬
প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা এবং অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। ১৯৪৯ সালে পাকিস্তানের বিরােধী রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের উত্থান ঘটার সময় তিনি তাঁর যােগ্যতাবলে লব্ধ প্রতিষ্ঠ দলের যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। কয়েক বছর পর তিনি সাধারণ সম্পাদক হিসেবেও নির্বাচিত হন। রাজনৈতিক জীবনে তিনি শিক্ষা পেয়েছিলেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী, ফজলুল হক ও মওলানা ভাসানীর মতাে অভিজ্ঞ নেতাদের কাছ থেকে। যা তার পরবর্তী রাজনৈতিক জীবনে একটি ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি করেছিল। আইয়ুব শাসনামলে আওয়ামী লীগে নেতৃত্বের অভাব দেখা দিলে তিনি নিজ যােগ্যতা বলে আওয়ামী লীগের প্রধান হিসেবে দলটির দায়িত্ব গ্রহণ করেন । তিনি নিজের ছয়দফা দাবীকে সমগ্র দেশব্যাপী প্রচার করেন। ছয়দফার ব্যাপারে তাঁর আপসহীন মনােভাব, স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলনে নেতৃত্ব দান এসব কিছু তাঁকে পূর্ব পাকিস্তানের যােগ্য রাজনৈতিক ব্যক্তিতে পরিণত করে। আইয়ুব খান শেখ মুজিবের জনপ্রিয়তায় ভীত হয়ে তাঁর বিরুদ্ধে একের পর এক মিথ্যা মামলা দায়ের করে কারাগারে অন্তরীণ রাখেন। কিন্তু ছাত্র জনতার আন্দোলনের ফলে শেষ পর্যন্ত শেখ মুজিবকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। এ সময়ই শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দেওয়া হয় এবং তিনি পরিণত হন। গণমানুষের নেতা হিসেবে। জনগণ তাঁকে বাংলার স্বাধিকার আদায়ের অন্যতম নেতা হিসেবে মেনে নেয়। তখন থেকেই শেখ মুজিব বুঝতে পারেন যে, বাঙালীদের মুক্তি আসবে স্বাধিকার আদায়ের মাধ্যমে। মানুষের অধিকার ও পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের জন্য তিনি সংগ্রাম করার ঘােষণা দেন। এ জন্য তিনি বেছে নেন নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা। তিনি বলতে থাকেন যে, জনগণের মুক্তি আসবে ছয়দফা দাবী বাস্তবায়নের মাধ্যমে। তারাও উপলব্ধি করতে পারে যে, ছয়দফার মাধ্যমে তাদের দাবী দাওয়া পূরণ হবে। তাদের বিশ্বাস ছিল এ পরিবর্তনের সূচনা করতে পারে শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগ। সেজন্য জনগণ তাদের দাবী দাওয়া আদায়ের জন্য ও নিজেদের স্বায়ত্তশাসনের অধিকার পাওয়ার জন্য আওয়ামী লীগকে ভােট দিয়ে বিজয়ী করে। আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক দল হলেও দেশের দু’অংশে তার সমান জনপ্রিয়তা ছিল। পাকিস্তান আওয়ামী লীগের প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানসহ পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গা থেকে জাতীয় পরিষদ নির্বাচনের এক সপ্তাহ পর পর্যন্ত
১০৭
তারযােগে প্রায় ৪ হাজার অভিনন্দন বার্তা পেয়েছেন। ৪ হাজার তারবার্তার মধ্যে অর্ধেকের বেশি পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এসেছে। এসব অভিনন্দন পাওয়ার ক্ষেত্রে কাজ করেছে শেখ মুজিবের ব্যক্তিগত চরিত্র, সাংগঠনিক দক্ষতা, দলের সুযােগ্য নেতৃত্ব। জনগণ বুঝতে পরে যদি আওয়ামী লীগকে দায়িত্ব দেওয়া হয় তাহলে তাদের দাবী দাওয়া, তাদের অধিকার পূরণ হবে।
১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে মােট পঁচিশটি রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করে। বৃহৎ দলগুলাের মধ্যে আওয়ামী লীগ ছিল অন্যতম। নির্বাচনে একমাত্র আওয়ামী লীগ একক ভাবে সমগ্র জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের আসনে মনােনয়ন দেয়। বাকি কোনাে দলই সব আসনে প্রার্থী দিতে সক্ষম হয়নি। আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিব দলের প্রধান হিসেবে এবং পার্লামেন্টারি বাের্ডের সিদ্ধান্ত অনুসারে যােগ্য প্রার্থীদের মনােনয়ন দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে তরুণ নেতবৃন্দদেরকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। আওয়ামী লীগ। একমাত্র দল যারা মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে প্রাধান্য দিত অর্থাৎ আওয়ামী লীগের বেশিরভাগ নেতা ছিলেন মধ্যবিত্ত শ্রেণির শিক্ষিত ব্যক্তি। যারা দলের প্রতি আনুগত্যশীল ছিলেন তারাই মনােনয়ন পাওয়ার ক্ষেত্রে এগিয়ে ছিলেন। এসব তরুণ কর্মঠ নেতৃবৃন্দ দলের বিজয়ের ব্যাপারে ছিল আশাবাদী। তারা নির্বাচনী প্রচারণা কাজের জন্য দেশের একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে বেড়িয়েছেন । নিজের দল ও দলের কর্মসূচি জনগণের সামনে তুলে ধরেছেন। প্রচারণা কার্যে শেখ মুজিব নির্দিষ্ট কর্মসূচি তৈরি করেন এবং কেন্দ্রীয় নেতাদেরকে দায়িত্ব ভাগ করে দেন। নিজে নির্বাচনী প্রচারণার পাশাপাশি দলের সব নেতাকে জনগণের কাছাকাছি গিয়ে তাদের অভাব অভিযােগ শােনার জন্য বলেন। তাদের সকলের প্রচারণার মূল কথা ছিল ছয়দফা দাবীকে কেন্দ্র করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব দেশের সব আসনকে সমান গুরুত্ব দিয়ে প্রচারণা চালান। এমনকি পশ্চিম পাকিস্তানে মাত্র আটটি আসনে প্রার্থী মনােনয়ন দিলেও সেখানে শেখ মুজিব নিজে প্রচারণা কার্য চালিয়েছেন। এছাড়া শুরু থেকেই বঙ্গবন্ধু এককভাবে নির্বাচন করার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন। তিনি কোনাে দলের সাথে আতাঁত করতে রাজি ছিলেন না। কেননা তিনি তাঁর দলের বিজয়ের ব্যাপারে আশাবাদী ছিলেন। শেখ মুজিবের দলের প্রতি ভালবাসা, সাংগঠনিক তৎপরতা, দলের সব নেতাদের একযােগে কাজ করা এবং সুসংগঠিত প্রচারণার ফলে জনগণের মনে এই আশাবাদ জাগ্রত হয় যে, যদি তারা
১০৮
আওয়ামী লীগকে বিজয়ী করে তাহলে হয়তাে তাদের এতদিনের দাবী দাওয়া, অধিকার তারা ফিরে পাবে। এ লক্ষ্য থেকেই তারা আওয়ামী লীগকে ভােট দিয়ে বিজয়ী করে ।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পর থেকে পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানকে তাদের একটি অংশ মনে না করে উপনিবেশ হিসেবে শােষণ করতে থাকে। এ শােষণ চলতে থাকে দীর্ঘ তেইশ বছর ধরে । অর্থনৈতিক, সামাজিক, শিক্ষা, চাকুরি, ব্যবসা বাণিজ্য, সামরিক সব ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানকে বঞ্চিত করে। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ বৈষম্যের শিকার হয়। এমনকি রাজনৈতিক ভাবে সচেতন পূর্ব বাংলার লােকদের নেতৃত্ব শূন্য করার জন্যও একের পর এক ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র করা হয়। বঙ্গবন্ধু সর্বপ্রথম এ বৈষম্যের কথা তুলে ধরেন। তিনি তাঁর ছয়দফা দাবীর মাধ্যমে পূর্ব বাংলার সমঅধিকার ও স্বায়ত্তশাসনের দাবী করেন। নির্বাচনী প্রচারণার সময় আওয়ামী লীগ ‘সােনার বাংলা শশ্মান কেন এই শিরােনামে একটি পােস্টার প্রকাশ করে। যা জনমনে খুব আলােড়ন সৃষ্টি করে। জনগণ তখন বুঝতে পারে যে, শাসক গােষ্ঠী তাদের এতদিন কীভাবে শােষণ করেছে। আর এ শােষণের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য তারা বেছে নেয় ১৯৭০ সালের নির্বাচনকে । ব্যালটের মাধ্যমে তারা তাদের রায় প্রদান করে এবং পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র নির্ভরযােগ্য রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের হাতে নতুন নেতৃত্ব তুলে দেয়।
আওয়ামী লীগ এককভাবে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পাশাপাশি নির্বাচনী ইশতাহারে বিস্তারিত কর্মসূচি তুলে ধরে। আওয়ামী লীগের ইশতাহার ছিল অনেক বেশি জনকল্যাণমুখী। ছয়দফার বাস্তবায়ন, বাঙালীর প্রতি বৈষম্য দূর, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, কৃষক শ্রমিকদের কল্যাণে গৃহিত কর্মসূচি এসব কিছু জনগণকে বেশি আকৃষ্ট করে। জনগণ বুঝতে পারে যে, অন্যান্য দলের নির্বাচনী ইশতাহারে পূর্ব বাংলার স্বার্থের কথা তেমন বলা হয়নি। তাই তারা সেসব দলের মিথ্যা বুলিতে আকৃষ্ট হয়নি। নির্বাচনী ইশতাহারের ছয়দফার দাবীর প্রতি তারা সমর্থন জানাতে আওয়ামী লীগকে ভােট দান করে।
নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় ছিল বাঙালীদের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের চরম অবজ্ঞা ও উদাসীনতার বিরুদ্ধে রুদ্র রােষের বহিঃপ্রকাশ। এই নির্বাচনে পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ ছয়দফা দাবীর পক্ষে সুস্পষ্ট
১০৯
রায় প্রদান করে। মূলত আওয়ামী লীগ পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবীতে সারা বাংলাদেশে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। নির্বাচনী ফলাফলের একটি অন্যতম লক্ষ্যণীয় দিক ছিল- যে সকল দল দীর্ঘদিন ধরে পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িকতার বীজ ছড়িয়ে এসেছে, পাকিস্তানের বিভিন্ন ভাষাভাষীর জাতির মধ্যে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে অস্বীকার করে এসেছে এবং সাধারণ মানুষকে শােষণের জোয়ারে আবদ্ধ রাখতে চেয়েছে, সেসব দক্ষিণপন্থী দলগুলােকে পাকিস্তানের জনগণ নির্বাচনের মাধ্যমে সরাসরি বর্জন করল । এই নির্বাচনে পাকিস্তানবাদী উগ্রপন্থী ধর্মান্ধ দলগুলাের দারুণ পরাজয় ঘটে । পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠীর কাছে নির্বাচনের রাজনৈতিক ফলাফল ছিল ১৯৭০ সালের পূর্ব বাংলায় ঘূর্ণিঝড় ও সামুদ্রিক জলােচ্ছাসের কারণে প্রাকতিক ক্ষয়ক্ষতির চেয়েও অধিক ভয়াবহ।
১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে এটা স্বয়ং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন। ২৭ নভেম্বর ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট বক্তৃতা প্রদান করেন। বক্তৃতায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১২ নভেম্বরের প্রলংয়করী ঘূর্ণিঝড়ে বিপর্যস্ত ও বিধ্বস্ত পূর্ব পাকিস্তানের উপকূলীয় অঞ্চলের সর্বশ্রান্ত ব্যক্তিদের সাহায্য দান ও উদ্ধারকার্যে সরকারি নিস্ক্রিয়তার ব্যাপারে শেখ মুজিবের অভিযােগ মেনে। নেন। এ সাংবাদিক সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সম্পর্কে একটি প্রচ্ছন্ন ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন । ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের অকল্পনীয় ক্ষয়ক্ষতির পরিপ্রেক্ষিতে দেশব্যাপী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রশ্নে সৃষ্ট সকল প্রকার জল্পনা ও কল্পনার অবসান ঘটিয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া সাংবাদিক সম্মেলনে সুস্পষ্টভাবে ঘােষণা করেছিলেন, নির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ প্রধান দ্রুত ক্ষমতাসীন ও তাঁর স্থলাভিষিক্ত হােক এটা তিনি আশা করেন । যত শীঘ্র তিনি আমার স্থান অধিকার করতে পারবেন, আমি তত বেশি আনন্দিত হবাে। আমি আমার ব্যারাক জীবনে ফিরে যেতে উদগ্রীব।
আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিব তাঁর ঐতিহাসিক ছয়দফা দাবী উত্থাপন করার পর থেকে পশ্চিম পাকিস্তান শাসকগােষ্ঠী প্রচার করতে থাকে যে, ছয়দফা বাস্তবায়ন হলে দেশ খণ্ড বিখণ্ড হয়ে যাবে । অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলাে প্রচার করতে থাকে শেখ মুজিব ছয়দফার মাধ্যমে বিচ্ছিন্নতার কথা
১১০
ভাবছেন। কিন্তু পূর্ব বাংলার জনগণ বুঝতে পারে স্বায়ত্তশাসন মানে আলাদা হয়ে যাওয়া নয়। ছয়দফার সাথে ছাত্র সমাজের এগারাে দফা যুক্ত করা হয় । যখন জনগণের মাঝে ছয়দফার যৌক্তিকতা তুলে ধরা হলে জনগণও বুঝতে পারে, একমাত্র ছয়দফার মাধ্যমে পূর্ব বাংলার স্বাধিকার অর্জন করা সম্ভব। আর শেখ মুজিব যে বিচ্ছিন্নতার দাবী করছেন তা মিথ্যা তাও তারা উপলদ্ধি। করতে পারে। এমনকি নির্বাচনের পরে পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামির প্রধান অধ্যাপক গােলাম আযম লাহােরে বলেন যে, ‘গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্য প্রায় অর্জিত হয়ে এসেছে এবং এখন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সুষ্ঠু কার্যকারিতায় জাতিকে সহযােগিতা করতে হবে। জনগণ মাসওয়াত ই মােহাম্মদী পক্ষে ভােট দিয়েছে। শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি অবিচার অবসানের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করলে পশ্চিম পাকিস্তানের জনসাধারণ তাঁর সাথে সহযােগিতা করা উচিত। শেখ মুজিব কখনাে বিচ্ছিন্নতার আওয়াজ তােলেন নাই এবং তিনি কখনও এ ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন না। নির্বাচনে পূর্ব বাংলার পূর্ণ সাফল্য লাভের অধিকারী আওয়ামী লীগের দাবী ছিল স্বায়ত্তশাসন, স্বাধীনতা নয়। উল্লেখ করার মতাে ব্যাপার এই যে, নির্বাচনের পূর্বে বা নির্বাচনের সময় কিংবা নির্বাচনের পরে কখনাে একবারও শেখ মুজিব স্বাধীনতার দাবী উত্থাপন করেননি।
আওয়ামী লীগের বিজয়ের পেছনে কাজ করেছে দলীয় শৃঙ্খলা, দলীয় প্রধানের নির্দেশ অনুযায়ী সব কেন্দ্রীয় নেতার একযােগে নির্বাচনী প্রচারণা। কেননা বঙ্গবন্ধুর প্রচারণার কৌশল ছিল নির্বাচনের আবেদন নিয়ে জনগণের কাছে পৌছতে হবে। আর সে কাজটাই করেছে আওয়ামী লীগ প্রধান সহ সব। কেন্দ্রীয় নেতা। তাজউদ্দীন আহমদ, এ এইচ এম কামরুজ্জামান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এম মনসুর আলী, খন্দকার মােশতাক আহমদ, ড. কামাল হােসেন এমনকি ছাত্রলীগের নেতারাও আওয়ামী লীগের হয়ে ব্যাপক ভাবে প্রচারাভিযানে দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে গিয়েছেন। আওয়ামী লীগই একমাত্র দল যারা সবচেয়ে বেশি প্রচারণা চালিয়েছে, সভা শােভাযাত্রা করেছে। তাদের সকলের প্রচারণার মূল কথা ছিল ছয়দফা। ব্যাপক মাত্রায় প্রচারাভিযানের কারণে আওয়ামী লীগ জনগণের কাছে সবচেয়ে বেশি গ্রহণযােগ্যতা পেয়েছে।
১১১
আওয়ামী লীগের জয়ের পশ্চাতে কাজ করেছে ভােটারদের ভােট দানের আগ্রহ ও উৎসাহ উদ্দীপনা। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ তেইশ বছরে জনগণ কখনও সরাসরি তাদের ভােটাধিকার প্রয়ােগ করতে পারেনি। যার কারণে এই প্রথম যখন তারা ভােটাধিকার প্রয়ােগ করার সুযােগ পায় তারা এটার সদ্ব্যবহার করে। অনেক ভােটার মনে করে যদি সে সময়মতাে তার ভােট না দেয় তাহলে হয়তাে তার ভােটের জন্য শেখ মুজিব জিততে পারবে না । এক্ষেত্রে মনে করা হয় যে, জনগণ একান্তই নিজের দায়িত্ববােধের জায়গা থেকে তাদের প্রথম রাজনৈতিক অধিকার প্রয়ােগ করেছে। আর এ প্রয়ােগের ক্ষেত্রে এমন দলকে বেছে নিয়েছে যাতে তাদের ভােটটি নষ্ট না হয় । জনগণও হয়তাে বুঝতে পেরেছিল যে, এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ম্যান্ডেট হবে।
নির্বাচনে শেখ মুজিবের ভােট চাওয়ার কৌশলও ছিল ভিন্নতর। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ সহ সব মুসলিম লীগের নেতারা। জনগণের কাছে ভােট চাইতে গিয়ে বলেছিলেন যদি ল্যাম্পপােস্টকেও তারা যােগ্য প্রার্থী মনে করেন তবে তাহলে যেন সেটাকে ভােট দিয়ে জয়ী করে । একই কৌশল ছিল ১৯৭০ সালের নির্বাচনেও। বঙ্গবন্ধু ভােট চাওয়ার ক্ষেত্রে বলে দিয়েছিলেন প্রার্থী কে তা বিবেচ্য নয়, যদি তারা উপযুক্ত প্রার্থী না পায়। তাহলেও যেন নৌকা প্রতীককেও ভােট দেয়। জনগণ তাই ভােট দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রার্থী কে তা বিবেচনা করেনি। তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল শেখ মুজিব ও নৌকাকে ভােট দেওয়া। যার কারণে শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তান থেকে একক ভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে।
অনেকে মনে করেন সত্তরের নির্বাচনের প্রাক্কালে ‘ভােটের আগে ভাত চাই’ স্লোগান উচ্চারণ করে মওলানা ভাসানী যে সযত্নে ভাসানীপন্থী ন্যাপের বামপন্থী মহলকে দিয়ে নির্বাচন বয়কট করেছিলেন, সেটা শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগকে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দেওয়ার লক্ষ্যে একটি রাজনৈতিক কৌশল ছিল । মওলানা ভাসানী যদি নির্বাচনে অংশ নিলে ভাসানীপন্থী ন্যাপও কিছু আসন পেতাে। সেক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না হলেও প্রথম স্থান অর্জিত হতাে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ভাসানী পন্থী ন্যাপ নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানাের কারণে ভাসানী পন্থী ন্যাপের ভােটগুলােও শেখ মুজিবের বাক্সে পড়ে।
১১২
রাও ফরমান আলী আওয়ামী লীগের বিজয়ের পেছনে নিজস্ব একটি ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ উপস্থাপন করেছেন। তাঁর মতে-
‘যে রাজনৈতিক দলগুলাে দায়সারা ভাবে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছিল, নির্বাচনে পরাজয়ের আশংকা করছিল বা প্রচারাভিযানে পিছিয়ে পড়ছিল, তাদের জন্য ঘূর্ণিঝড় ও জলােচ্ছাসে সৃষ্ট বিপর্যয় এক আর্শীবাদ হয়ে দেখা দিয়েছিল। এ ধরনের নেতৃবৃন্দ নির্বাচনকে স্থগিত করার দাবী তুললেন। আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের বিরুদ্ধে জয় লাভের ব্যাপারে তারা কোনাে ভাবেই নিশ্চিত ছিলেন না। যাদের সামান্য হলেও পরিষদে যাওয়ার আশা ছিল, তারাও আওয়ামী লীগের আধিপত্যাধীন পরিষদে গিয়ে বিচ্ছিন্ন হতে চাচ্ছিলেন না। উদ্দেশ্য যাই হােক না কেন, নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা থেকে তারা বিরত হয়েছিলেন। এর ফলে জনগণ যখন দেখলাে যে, পাকিস্তানের অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলাে নির্বাচনের পরাজয়ের ভয়ে নির্বাচনী অঙ্গন থেকে বিদায় নিচ্ছে তখন জনগণ তাদের করণীয় বুঝতে পারে। প্রত্যাহারের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচনটি এক তরফা বিষয়ে পরিণত হয়ে পড়েছিল। প্রথম থেকে এগিয়ে থাকা আওয়ামী লীগকে উল্লেখযােগ্য কোনাে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্মুখীন হতে হয়নি। ধারণা করা হয়েছিল যে, নির্বাচনের প্রাক্কালে আওয়ামী লীগে বাঙালী জাতীয়তাবাদের অনুভূতি উস্কে দেয়ার এবং এর ফলকে কাজে লাগানাের উদ্দেশ্যে কতিপয় বিষয়কে সামনে নিয়ে আসবে। কিন্তু সে প্রচেষ্টা আর চালাতে হয়নি। তাদেরকে শুধু ঠোট নাড়তে হয়েছে, বাকি কাজ করে দিয়েছে প্রকৃতি, স্থানীয় সংবাদপত্র ও বিদেশি সাংবাদিকরা। (বাংলাদেশের জন্ম, পৃ. ৪১-৪২)।
পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের প্রতি এই বিপুল রায় ছিল প্রকারান্তরে ছয়দফা কর্মসূচির প্রতি গণরায়। এই গণরায় ছিল পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের জন্য পূর্ব বাংলাবাসীর ম্যান্ডেট স্বরূপ। আওয়ামী লীগের প্রতি জনগণের দেওয়া এই ঐতিহাসিক রায়ের মাধ্যমে জনগণ অন্যান্য রাজনৈতিক দলসমূহের কর্মসূচিকে প্রত্যাখ্যান করে। পাকিস্তানে ইসলামি শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে ডানপন্থী দলসমূহের এই স্লোগান পূর্ব বাংলার জনগণ প্রত্যাখ্যান করে।
সেপ্টেম্বর মাসে পূর্ব বাংলায় ভয়াবহ বন্যা হয়। ডানপন্থী দলগুলাের দাবীর মুখে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান নির্বাচন পিছিয়ে দেন। কিন্তু নির্বাচনী
১১৩
প্রচারণা লােকালীন পূর্ব বাংলার দক্ষিণের উপকূল অঞ্চলে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় ও জলােচ্ছ্বাস। লাখ লাখ মানুষ প্রাণ হারায়। এ সময় পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠী তাদের প্রতি সাহায্যের হাত না বাড়িয়ে বরং যে বিমাতা সুলভ আচরণ করে। পশ্চিম পাকিস্তানিদের এ আচরণ বাঙালীদের খুব ব্যথিত করে। দুর্যোগের ভয়াবহতা স্বীকারে সরকারের গড়িমসি, ত্রাণকাজে। এগিয়ে আসতে অনীহা, সামরিক বাহিনীর লােকজনের দুর্বব্যহার এবং পদে পদে বাধাবিপত্তি বাঙালীদের খুব তিক্ত করে তােলে। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠী এমনকি পশ্চিম পাকিস্তানের কোনাে রাজনৈতিক দলের নেতাও এসময় পূর্ব বাংলার লােকদের পাশে এসে দাঁড়ায়নি। ব্যতিক্রম ছিলেন শুধু খান আবদুল ওয়ালী খান। শাসকগােষ্ঠীর এমন কার্যকলাপে পূর্ব বাংলার জনগণ বুঝতে পারে, এখন থেকে নিজেদের পথ নিজেদেরকেই বেছে নিতে হবে। কারাে ওপর নির্ভর করে নয় নিজেদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে। তাই এদেশের জনগণ নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য। এবং শাসকগােষ্ঠীকে সমুচিত জবাব দেওয়ার জন্য বেছে নেয় ব্যালট বাক্স। ব্যালটের মাধ্যমে তারা রায় দিয়ে আওয়ামী লীগকে বিজয়ী করে।
১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন ছিল পাকিস্তানবাসীর কাছে দীর্ঘ আকাঙ্ক্ষিত একটি নির্বাচন। বিশেষ করে পূর্ব বাংলা তথা বাংলাদেশের জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলাের কাছে ছিল রাজনৈতিক অধিকার প্রয়ােগের সুযােগ। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সামরিক শাসনের বলে পাকিস্তানের ক্ষমতার সিংহাসনে আসীন হলেও প্রাথমিকভাবে তিনি তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছেন। তবে তার এ প্রতিশ্রুতি রক্ষার পশ্চাতে যে দুরভিসন্ধি ছিল তা হয়তাে পাকিস্তানের জনগণ জানতে পারেনি। একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যাপারে তিনি কতটুকু আন্তরিক ছিলেন তা নিয়ে প্রশ্নের উদ্রেক হতে পারে কেননা তার পরবর্তী কর্মকাণ্ড এ প্রশ্ন উত্থাপনের সুযােগ তৈরি করে দেয়।
পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ ছিল বেশি। ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্রযন্ত্রের উদ্ভব। এরকম একটি রাষ্ট্র পাকিস্তান শুরু থেকেই পূর্ব অংশের জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষার বীজকে উৎপাটিত করতে চেয়েছেন। বিশ শতকের গােড়ার দিকে প্রতিষ্ঠিত বাঙালী মধ্যবিত্ত শিক্ষিত শ্রেণির হাত দিয়ে
১১৪
বাঙালী জাতীয়তাবাদের গােড়াপত্তন হয়েছিল। জাতীয়তাবাদের এই চেতনায় বাঙালী তার নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য বারবার গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ে আন্দোলন সংগ্রামে ব্যাপৃত হয়েছে। পাকিস্তান রাষ্ট্র জন্মের পর পূর্ব বাংলার জনগণের কাছে আকাঙ্ক্ষিত বিষয় ছিল একটি সুষ্ঠু সাধারণ নির্বাচন। যেখানে কোনাে মৌলিক গণতন্ত্রী নামক প্রশাসন যন্ত্র ভােট প্রয়ােগ না করে সার্বজনীন ভােটাধিকারের ভিত্তিতে প্রত্যক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠী সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার পর থেকেই নির্বাচনী পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
নির্বাচনে পাকিস্তানের উভয় অংশের তিনটি ধারার রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করে। সবাই জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতি খেয়াল রেখে নির্বাচনী ইশতাহার প্রণয়ন করে। আবার অন্যদিকে পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠী রাষ্ট্রীয় প্রচারমাধ্যমে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রধানদের দলীয় কর্মসূচি জনগণের সামনে তুলে ধরার একটি সুযােগ তৈরি করে দেয়। সব রাজনৈতিক দল নিজেদের জয়ের ব্যাপারে আশান্বিত হয়ে প্রচার প্রচারণা চালাতে থাকে। তাদের এ প্রচার প্রচারণা ছিল শান্তিপূর্ণ। নির্বাচনী স্লোগান ও পােস্টার প্ল্যাকার্ডে এক দল অপর দলকে আক্রমণ করে বক্তৃতা বিবৃতি দিয়েছে, স্লোগান দিয়েছে কিন্তু তাদের এ আচরণ কখনাে সহিংসতায় রূপ নেয়নি। গণতান্ত্রিক মানসিকতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তারা নির্বাচনী লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছে। ৭ ডিসেম্বর জাতীয় পরিষদের নির্বাচনের ফলাফল ঘােষিত হওয়ার পর থেকেই বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলাের প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যায়। পরাজিত দলের প্রধানরা নিজেদের পরাজয়কে মেনে নিয়ে বিজয়ী দলের প্রধানদের অভিনন্দন জানিয়ে বক্তৃতা বিবৃতি দিয়েছেন। কেউ কেউ আবার দু অঞ্চলে বিজয়ী দুটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও পাকিস্তান পিপলস পার্টিকে ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্র ও সরকার গঠন প্রশ্নে সহযােগিতা প্রদান করার কথাও ব্যক্ত করে। তবে নির্বাচনের দৃশ্যপট রাতারাতি পাল্টে যায় জাতীয় পরিষদের ফলাফল ঘােষিত হওয়ার পর। দেখা যায় যে, বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরা তাদের নিশ্চিত পরাজয় জেনে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে অংশ নেয়া থেকে সরে দাঁড়ায়। জাতীয় পরিষদের নির্বাচনের মতাে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনের ফলাফলও একই ধরনের হয়। এখানেও দু অঞ্চলে দুটি রাজনৈতিক
১১৫
দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। যদিও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে পাকিস্তান পিপলস পার্টির বাইরেও বেশ কয়েকটি দল কিছু সংখ্যক আসন লাভ করতে সক্ষম হয়। রাজনৈতিক দলগুলাের জামানত বাজেয়াপ্তের হারও ছিল চোখে পড়ার মতাে। নির্বাচনকে ঘিরে আদর্শগত দিক থেকে রাজনৈতিক দলগুলাে তিনটি ধারায় বিভক্ত হলেও নির্বাচনের ফলাফলের প্রশ্নে সকলের মতামত ছিল একই রকম। সবাই এ নির্বাচনকে জনগণের সুস্পষ্ট রায় বলে মেনে নেয়। যা গণতান্ত্রিক রীতিনীতির পরিচায়ক। নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু এ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে সহায়ক হয়েছিল কিছু বিষয়। যা আওয়ামী লীগকে বিজয়ী করে। নির্বাচনকে ঘিরে যে রাজনৈতিক উত্তাপ তৈরি হয়েছিল তা ফলাফল ঘােষিত হওয়ার পর প্রশমিত হয়। পাকিস্তানের দু অংশের জনগণ অপেক্ষা করতে থাকে পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ শাসনকর্তা ও শাসনতন্ত্রের জন্য। যার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের আপামর জনসাধারণের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে।
Reference: ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন বাংলাদেশের অভ্যুদয় – মোশারফ হোসেন