You dont have javascript enabled! Please enable it! 1970 | ১৯৭০ সালের নির্বাচনী ইশতাহার ও প্রচারণা কার্যক্রম - সংগ্রামের নোটবুক

১৯৭০ সালের নির্বাচনী ইশতাহার ও প্রচারণা কার্যক্রম

১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার অভিপ্রায়ে নির্বাচন কমিশন আন্তরিকতার সাথে তাঁর কাজ সমাপ্ত করে। ভােটার তালিকা সম্পন্ন করার পর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের নির্দেশ অনুযায়ী নির্বাচনী কমিশনার নির্বাচনী তফসিল ঘােষণা করেন। উল্লেখ্য যে, ১৯৭০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে রাজনৈতিক কার্যকলাপের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। এর পরপরই পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলাে তাদের নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করে। নির্বাচনের জন্য তারা বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে। রাজনৈতিক দলগুলাে তাদের নির্বাচনী ইশতাহার ও কর্মসূচি জনকল্যাণমুখী করার মাধ্যমে ভােটারদের মন আকৃষ্ট করার চেষ্টা করে। সকলের নির্বাচনী ইশতাহারে প্রাধান্য পায় জাতীয় ও প্রাদেশিক বিষয়ের বিভিন্ন সমস্যা ও তার সমাধানের প্রতিশ্রুতি। পাশাপাশি সামরিক শাসনের সময় গৃহিত বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে কোনগুলাে তারা গ্রহণ করবে আর কোনগুলাে তারা বাদ দিয়ে নতুন করে তৈরি করবে তার কর্মপন্থা। কমবেশি সব রাজনৈতিক দলগুলাে তাদের নির্বাচনী ইশতাহারে পূর্ব বাংলার কথা উল্লেখ করে, বিশেষ করে পূর্ব বাংলার বিভিন্ন সমস্যা ও তার সমাধানের উপায়। দেশের সংবিধানের রূপরেখা, জাতীয় ও প্রাদেশিক সমস্যাসমূহ, বৈদেশিক সম্পর্ক কেমন হবে, জনগণের কল্যাণে কী কাজ করবে তার ব্যাপক কর্মসূচি। প্রত্যেক রাজনৈতিক দল নিজেদের কর্মসূচি নিয়ে দেশের সর্বত্র প্রচার কার্য শুরু করে। বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলাে তাদের নির্বাচনী প্রচারণা ও বক্তৃতা বিবৃতিতে প্রচার করতে থাকে তাদের দলের শ্রেষ্ঠত্ব ও তাদের গৃহিত বিভিন্ন কর্মসূচির কথা। এক দল অপর দলের সমালােচনা শুরু করে। এভাবে রাজনৈতিক দলগুলাে। নির্বাচনী যুদ্ধে অবতীর্ণ হয় । সমগ্র দেশব্যাপী শুরু হয় নির্বাচনী জোয়ার ।
৪১
১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান থেকে অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দলগুলােকে আদর্শগত দিক থেকে তিনটি শ্রেণিতে বিন্যস্ত করা যায়। যেমন-
তালিকা ৩; আদর্শগত রাজনৈতিক দলগুলাের শ্রেণিবিভাগ
বাম – –
১. ন্যাপ (ভাসানী ও ওয়ালী গ্রুপ)
২. জাতীয় গণমুক্তি দল।
৩. সিন্ধু-সংযুক্ত দল (কেবল সিন্ধু কেন্দ্রিক)
মধ্য
১. আওয়ামী লীগ
২. পাকিস্তান পিপলস পার্টি।
৩. পাকিস্তান ডেমােক্রেটিক পার্টি
৪. পাকিস্তান মুসলিম লীগ (তিনটি গ্রুপ)
৫. কৃষক শ্রমিক পার্টি
৬. পাকিস্তান জাতীয় লীগ
৭. পাকিস্তান ন্যাশনাল কংগ্রেস
ডান
১. নিখিল পাকিস্তান জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম
২. জামায়াতে ইসলামি
৩, মারকাসী জমিয়তে আহলে হাদীস
৪. মারকাজে জমিয়তে উলামা
৫. জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম
সূত্র: জি ডব্লিউ চৌধুরী, অখণ্ড পাকিস্তানের শেষ দিনগুলি, ঢাকা: হক কথা প্রকাশনী, ১৯৯১। পৃ. ১১২

১৯৭০ সালের নির্বাচনে অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দলগুলাের মধ্যে একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায় যে, কোনাে জাতীয় নেতা বা কোনাে জাতীয় দল ছিল না। মুসলিম লীগের তিনটি শাখা, জামায়াতে ইসলামি, পাকিস্তান ডেমােক্রেটিক পার্টির সমগ্র পাকিস্তান ব্যাপী সংগঠন ছিল এবং তারা পাকিস্তানের উভয় অংশে প্রার্থী দিয়েছিল । কিন্তু এসব দলগুলাের কোনােটির পূর্ব পাকিস্তানে জনপ্রিয়তা ছিল না। এমনকি পশ্চিম পাকিস্তানের পাকিস্তান পিপলস পার্টির তুলনায় তারা পিছিয়ে ছিল । নির্বাচনে দুটি দল সবচেয়ে বেশি রাজনৈতিক গুরুত্ব পায়। দুই অঞ্চলের দুটি রাজনৈতিক দল- পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী লীগ ও পশ্চিম পাকিস্তানের পাকিস্তান পিপলস পার্টি। এ দুটি দল রাজনৈতিক ভাবে জাতীয় দল হিসেবে নয় বরং আঞ্চলিক দল হিসেবে বেশি
৪২
প্রাধান্য পেয়েছে। কেননা দুটি দল আঞ্চলিক ভাবে প্রাধান্য বিস্তার করতে পেরেছে এবং অঞ্চলভিত্তিক প্রার্থী মনােনয়ন দিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে আঞ্চলিক মেরুকরণ হয়েছে, জাতীয় দল বা জাতীয় নেতৃত্ব গড়ে ওঠেনি।
নির্বাচনী ইশতাহার
নির্বাচনী ইশতাহার যে কোনাে রাজনৈতিক দলের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থার কর্মসূচি বিশেষ। ইশতাহারের মাধ্যমে নির্বাচনে অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দলগুলাে তাদের নির্বাচনী ওয়াদা ও কর্মসূচি জনগণের সামনে তুলে ধরে। রাজনৈতিক দলগুলাে নির্বাচনে জয়ী হলে জনগণের কল্যাণে ও দেশের কল্যাণে কী কাজ করবে তার পূর্ণাঙ্গ বিবরণ থাকে। অর্থাৎ জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতি লক্ষ্য রেখে রাজনৈতিক দলগুলাে তাদের নির্বাচনী ইশতাহার ঘােষণা করে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে অংশ নেওয়া বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলাে বিভিন্ন বক্তৃতা-বিবৃতির মাধ্যমে বা আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনী ইশতাহার ঘােষণা করে ।
আওয়ামী লীগ
আওয়ামী লীগ তার নির্বাচনী ইশতাহারের শুরুতে উল্লেখ করে যে, জনগণের নিরবচ্ছিন্ন, সুকঠিন ও সুপ্রতিজ্ঞ দীর্ঘ সংগ্রামের ঐতিহ্যময় পটভূমিতে আওয়ামী লীগ জনগণের সামনে উপস্থিত চ্যালেঞ্জ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই চ্যালেঞ্জকে গ্রহণ করার জন্য যে সাহস এবং সংকল্পের প্রয়ােজন জাতির উপর তাদের বিশ্বাস, জনগণের উপর আস্থা এবং সর্বোপরি সর্বশক্তিমানের উপর তাদের ঈমানের মাধ্যমেই আওয়ামী লীগ তা লাভ করেছে। তাই গণতান্ত্রিক উপায়ে বিপ্লব সাধনের জন্য এবং তা দিয়ে বর্তমানের অন্যায় অবিচারের উপর প্রতিষ্ঠিত কাঠামাের স্থলে অঞ্চলে অঞ্চলে ও মানুষে মানুষে। ন্যায়বিচার রক্ষাকারী একটি নতুন শাসনতান্ত্রিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগের ঘােষণাপত্র প্রণয়ন করা হয়েছে। পাকিস্তানের প্রতিটি অঞ্চল ও প্রতিটি নাগরিকের ক্ষেত্রে সুবিচারের নিশ্চয়তা বিধানের জন্য এই ঘােষণাপত্রে একটি ব্যাপক রূপরেখা প্রদান করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতাহারে মূল বিষয়গুলাে ছিল-
৪৩
১. শাসনতন্ত্রের মাধ্যমে এমন একটি সজীব গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে যেখানে জনগণ স্বাধীনতা ও মর্যাদার সাথে জীবনযাপন করতে পারবে এবং ন্যায় ও সাম্য বিরাজ করবে।
২. পাকিস্তান হবে অঙ্গ রাষ্ট্রগুলাের প্রত্যেকটি ছয়দফা ফর্মুলার ভিত্তিতে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রদানকারী ফেডারেল যুক্তরাষ্ট্র।
৩. শশাষণমুক্ত ন্যায় ও সাম্যবাদী সমাজ গঠন করা অর্থনৈতিক কর্মসূচির মূল লক্ষ্য।
৪. পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের পর থেকে ২৩ বছরের বেশি সময় ধরে পূর্ব পাকিস্তান থেকে ক্রমাগত পশ্চিম পাকিস্তানে সম্পদ পাচার এবং বৈদেশিক মুদ্রা ও সাহায্যের সিংহভাগ পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যবহারের ফলে আন্তঃআঞ্চলিক বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছে তা নিরসন করা হবে।
৫. কৃষি ও গ্রামের জনগণের অবস্থার উন্নয়নের জন্য অগ্রাধিকারসহ গ্রাম ও শহরের জীবনযাত্রার মধ্যকার বিদ্যমান বৈষম্য দূর করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
৬. জমির ব্যবহারিক পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনা হবে।
৭. পূর্ব পাকিস্তানের কৃষি ব্যবস্থা পুনর্নির্মাণের যে কোনাে পরিকল্পনা গ্রহণের ক্ষেত্রে বন্যা নিয়ন্ত্রণের উপর গুরুত্ব দেওয়া হবে।
৮. আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার ঘােষণা অনুযায়ী শ্রমিকদের অধিকারের নিশ্চয়তা বিধান করা হবে।
৯. পাকিস্তানের দুইটি রাষ্ট্রভাষা বাংলা ও উর্দু যাতে জীবনের সর্ব ক্ষেত্রে ইংরেজির স্থলাভিষিক্ত হতে পারে তার ব্যবস্থা করা হবে।
১০. বৈদেশিক নীতিতে দেশের জনসাধারণের আশা আকাঙ্ক্ষার এবং রাষ্ট্রের স্বার্থের প্রতি লক্ষ্য রেখে একটি স্বাধীন জোট নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা হবে ।
ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ওয়ালী ন্যাপ)
ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ওয়ালী গ্রুপ তাদের নির্বাচনী ইশতাহারে ঘােষণা করে যে, আসন্ন নির্বাচনে জনগণের সামনে দুটি প্রশ্ন উত্থাপিত হবে। একটি হলাে দেশের শাসনতন্ত্র সম্পর্কে এবং অন্যটি হলাে ভবিষ্যতে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের গঠন ও এদের কর্মসূচি সম্পর্কে। গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র
৪৪
ও দেশপ্রেমিক গণতান্ত্রিক সরকার গঠনের জন্য ন্যাপ জনগণের সামনে সেসকল কর্মসূচির কথা উল্লেখ করে-
১. পাকিস্তানকে একটি পূর্ণ স্বাধীন, সার্বভৌম জনকল্যাণমূলক ফেডারেল রাষ্ট্রে পরিণত করা হবে। ২. রাষ্ট্র পরিচালনার সর্বময় ক্ষমতা জনগণ দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিত্বমূলক আইনসভার হাতে ন্যস্ত থাকবে।
৩. বাংলা ও উর্দুকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়া হবে ।
৪. কৃষকদের স্বার্থে পূর্ব বাংলার ভূমি ব্যবস্থার সংস্কার করা হবে ।
৫. শ্রমিকদের জীবনধারণের উপযােগী নিম্নতম মজুরি, চাকুরির স্থায়ীত্ব, দৈনিক আট ঘন্টা এবং সপ্তাহে ৪৪ ঘন্টা কাজের সময় নির্ধারণ, বাসস্থান, চিকিৎসা, ছুটি, শিক্ষা ও উপযুক্ত বােনাস এবং সমাজ বীমার ব্যবস্থা করা হবে ।
৬. দেশকে দ্রুত শিল্পায়িতকরণ ও সুষম অর্থনীতি গড়ে তােলার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানাে হবে।
৭. সেন্টো, সিয়াটো, পাক মার্কিন সামরিক চুক্তি ও অন্যান্য সকল দ্বি পাক্ষিক সামরিক চুক্তি বাতিল করা হবে।
৮. সাধারণ শিক্ষার ক্ষেত্রে ধর্মীয় শিক্ষাকে ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে গণ্য করা হবে।
৯. পূর্ব বাংলা তথা পাকিস্তানের উভয় অংশকে দেশরক্ষা ব্যবস্থায় স্বয়ংসম্পূর্ণ করা হবে।
১০. দেশের দুই অংশের বা অঞ্চল সমূহের মধ্যে যে অর্থনৈতিক বৈষম্য বিদ্যমান রয়েছে তা স্বল্পসময়ের মধ্যে দূর করা হবে।
১১. সর্ব প্রকার সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদের অবসান ঘটিয়ে রাষ্ট্রীয়, সামাজিক জীবনে সংখ্যালঘুদের সমানাধিকারের নিশ্চয়তা বিধান করা হবে।
ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ভাসানী গ্রুপ)
নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা নিয়ে ন্যাপ ভাসানী নিজেদের মধ্যে দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভুগতে থাকে। তারপরও ন্যাপ ভাসানী তাদের নির্বাচনী ইশতাহার ঘােষণা করে। ন্যাপ ভাসানীর নির্বাচনী ইশতাহারের গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলাে হলাে:
৪৫
১. পাকিস্তানকে সম্পূর্ণ স্বাধীন ও সমাজতান্ত্রিক ফেডারেল রাষ্ট্ররূপে প্রতিষ্ঠা করা হবে।
২. পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা হবে । সব দেশীয় রাজা, উপজাতীয় এলাকা, এজেন্সি ও এ ধরনের অন্যান্য বিশেষ এলাকাকে প্রদেশগুলাের সাথে অন্তর্ভুক্ত করা হবে । ৩. জাতিসংঘের মৌলিক অধিকার সনদ অনুযায়ী ধর্মীয় মতবাদ, বংশ, গােত্র নির্বিশেষে সবাইকে নিজ নিজ ধর্ম পালন করার অধিকারের নিশ্চয়তা বিধান করা হবে।
৪. সব নাগরিককে খাদ্য, কর্মসংস্থান, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা,নিরাপত্তা ও ন্যায় বিচারের নিশ্চয়তা প্রদান করা হবে ।
৫. সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নারী সমাজকে পুরুষের সমান অধিকার দেওয়া হবে।
৬. বেকার, বৃদ্ধ ও অক্ষমদের সাহায্য করা হবে।
৭. গণভােটের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ নির্ধারণের অধিকার আদায়ের জন্য কাশ্মীরীদের সাহায্য করা হবে।
৮. পূর্ব পাকিস্তানে ভূ-স্বামীদের কাছ থেকে বিনা ক্ষতিপূরণে জমি নিয়ে | ভূমিহীনদের মধ্যে বণ্টন করা হবে।
৯. শিল্পক্ষেত্রে ইজারাদারী ও পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অবসান করা হবে ।
১০. শ্ৰমিক আইন সংস্কার করে উন্নত করে শ্রমিকদের কলকারখানার লভ্যাংশের অংশীদার করা, ট্রেড ইউনিয়ন গঠন, ধর্মঘট ও সম্মিলিত দর কষাকষির অধিকার প্রতিষ্ঠা করা হবে ।
১১. দেশের উভয় অংশের প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
১২. স্বাধীন ও সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা হবে ।
জামায়াতে ইসলামি জামায়াতে ইসলামির লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানকে এমন একটি রাষ্ট্রে পরিণত করা যা কোরআন সুন্নাহর পূর্ণ অনুগত এবং খােলাফায়ে রাশেদীনের আদর্শের অনুসারী । জামায়াতে ইসলামি তাদের ইশতাহারে যে সকল মূল বিষয় উল্লেখ করে
৪৬
১. শাসনতান্ত্রিক ও স্বায়ত্তশাসনের ক্ষেত্রে ফেডারেল কেন্দ্রে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইন পরিষদ গঠন করা হবে।
২. পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অনগ্রসরতা দূর করা হবে।
৩. পূর্ব পাকিস্তানের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা প্রতিরক্ষা ও বৈদেশিক বিষয়ের ব্যয় ও কেন্দ্রীয় সরকারের দেনায় পূর্ব পাকিস্তানের আনুপাতিক হিস্যা আদায়ের পর সম্পূর্ণ অর্থ পূর্ব পাকিস্তানে ব্যয় করা হবে।
৪. পূর্ব পাকিস্তান থেকে পুঁজি পাচার প্রতিরােধ দূর করার জন্য সম্ভাব্য উপায় অবলম্বন করা হবে ।
৫. প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানকে সম্ভাব্য উপায়ে আত্মনির্ভরশীল করে তােলা হবে।
৬. দেশের সব সম্পদ এমনভাবে বণ্টন করা হবে যাতে উভয় অঞ্চলের মাথাপিছু আয় সমপর্যায়ে উন্নীত হতে পারে ।
৭. পূর্ব পাকিস্তানের বন্যা প্রতিরােধ, গঙ্গা ও তিস্তার উপর অবিলম্বে বাঁধ নির্মাণ, ব্রহ্মপুত্র বাঁধ ও পুল প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য কেন্দ্র থেকে আর্থিক সাহায্য প্রদান করা হবে।
৮, ইসলামের যেসব বিধান আইন হিসেবে একটি ইসলামী রাষ্ট্রে চালু থাকা উচিত সেগুলাে প্রবর্তনের জন্য আইন প্রণয়ন করা হবে।
৯. মুসলমানদের মধ্যে ব্যাপকভাবে নামাজ কায়েমের জন্য সম্ভাব্য সব উপায় ও সুযােগ সুবিধার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
১০. শিক্ষার প্রচলিত স্তর থেকে সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত ইসলামী জীবন দর্শন সংযুক্ত করা হবে ।
১১. আর্থিক ক্ষেত্রে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করা হবে ।
১২. সরকারি উদ্যোগে যাকাত, সদকা এবং সাধারণ নিরাপত্তার উদ্দেশ্যে ফি সাবিলিল্লাহ সাহায্য সংগ্রহের ব্যবস্থা করা হবে।
পাকিস্তান পিপলস পার্টি
পাকিস্তান পিপলস পার্টির নির্বাচনী ইশতাহারের মূল দিকগুলাে ছিল –
১. ইসলামী মূল্যবােধ ও দেশের জনসাধারণের আশা আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক দিক দিয়ে একটি বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তােলা হবে ।
৪৭
২. গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য দেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও সভাসমিতি অনুষ্ঠানের। স্বাধীনতা, ভােটাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবে।
৩. দেশের প্রশাসন যন্ত্রের সব স্তর থেকে দুর্নীতি নির্মূল করা হবে।
৪. জাতীয় সম্পদ আহরণকারী কৃষক শ্রমিকদের অধিকার সংরক্ষণের জন্য শােষণ নীতির অবসান ঘটানাে হবে।
৫. শিল্প কারখানার শ্রমিকদের কাজের বর্তমান অবস্থার অগ্রগতি সাধন করা হবে।
৬. শিক্ষার অবাধ অধিকার দেওয়া হবে।
৭. বিদেশি শত্রুদের মােকাবেলার জন্য গণবাহিনী গঠন করা হবে।
৮. দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক কাঠামাের আমূল পরিবর্তন করা হবে ।

পাকিস্তান মুসলিম লীগ
মুসলিম লীগের তিনটি শাখার নর্বাচনী ইশতাহারে মূল বিষয়গুলাে ছিল-
১. প্রদেশসমূহের সমন্বয়ে পাকিস্তান হবে একটি ফেডারেল রাষ্ট্র।
২. পাকিস্তানের রাজধানী ও কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিষ্ঠানাদি পূর্ব পাকিস্তানে স্থাপন করা হবে।
৩. কেন্দ্রীয় চাকুরী ও রাষ্ট্রদূত পদে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব হবে জনসংখ্যাভিত্তিক। এবং অনধিক পাঁচ বছরের মধ্যেই এই প্রতিনিধিত্ব হাসিলের ব্যবস্থা করতে হবে।
৪. শিক্ষার সর্বস্তরে কোরআন ও দীনিয়াত শিক্ষা, কারিগরি ও সাধারণ শিক্ষা এবং পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানে নির্দিষ্ট স্তর পর্যন্ত বাংলা ও উর্দু শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হবে।
৫. কোরআন ও সুন্নাহর বিধিকে দেশের চূড়ান্ত আইনরূপে গণ্য করা হবে।
৬. শরিয়তের বিধি মােতাবেক মহিলাদের অধিকার ও সুযােগ সুবিধার নিশ্চয়তা প্রদান করা হবে।
৭. পাকিস্তানে এমন একটি গণসরকার প্রতিষ্ঠা করা হবে যেখানে প্রাপ্তবয়স্কদের ভােটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষা বাস্তব রূপ লাভ করবে ।
৪৮
৮. আইনের চোখে সমঅধিকারসহ সব রকমের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করা হবে।
৯. ১০ বছরের মধ্যে দেশের দু’অংশের মধ্যেকার অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করার জন্য পাকিস্তান সরকারের শাসনতান্ত্রিক দায়িত্ব থাকবে ।
প্রচারণা কার্যক্রম
১৯৭০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। এ প্রেক্ষিতে বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলাে নির্বাচনী প্রচারকার্য শুরু করে। নির্বাচনী প্রচারণা চলেছিল এক বছর ব্যাপী। নির্বাচনে ১১টি রাজনৈতিক দল পাকিস্তানের উভয় অংশে তাদের প্রার্থী মনােনয়ন দেয়। নির্বাচনী প্রচারণার সময় দেখা যায় যে, আওয়ামী লীগ ও পাকিস্তান পিপলস পার্টির সবচেয়ে বেশি জনসমর্থন রয়েছে। এছাড়া অন্যান্য জাতীয় ভিত্তিক দল যেমন জামায়াতে ইসলামি, পিডিপি, মুসলিম লীগের খুব কমই জনসমর্থন রয়েছে। নির্বাচনী প্রচারণার সময় পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলাে বিভিন্ন কৌশল গ্রহণ করে। পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ ছিল একমাত্র রাজনৈতিক দল যাদের সমালােচনায় মুখর ছিল অন্য দলগুলাে। এদের মধ্যে ছিল ডানপন্থী রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামি, পিডিপি ও মুসলিম লীগের তিনটি গ্রুপ, অন্যদিকে বামপন্থীদের মধ্যে ছিল ন্যাপ ভাসানী ও ওয়ালী গ্রুপ।
নির্বাচনের পূর্বে পশ্চিম পাকিস্তানের সরকার সিদ্ধান্ত নেয় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দকে তাদের দলের ইশতাহার ও নীতি যাতে সরকারি বেতার ও টেলিভিশনে প্রচার করতে পারে সে সুযােগ দিবে । এই প্রথম রাজনীতিবিদদের সরকারি মালিকানার বেতার টেলিভিশনে তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য ব্যবহারের সুযােগ দেওয়া হয়। এই সিরিজ বক্তৃতা শুরু হয় ২৮ অক্টোবর ১৯৭০ সালে এবং ১৯ নভেম্বর পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে। এ সময়ের মধ্যে ১৪টি দলের নেতৃবৃন্দ ভাষণ দেন। এটি শুরু হয় আওয়ামী লীগের শেখ মুজিবের মধ্য দিয়ে এবং শেষ হয় সংযুক্ত সিন্ধু ফ্রন্টের জি.এম. সাঈদ এর বক্তব্যের মধ্য দিয়ে। প্রথম বক্তৃতার ভার পড়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উপর। কারণ বর্ণমালা অনুসারে আওয়ামী
৪৯
লীগের আ’ সব দলের নামের প্রথমে আসে। সরকারের এই উদ্যোগের প্রশংসা করে আবুল মনসুর আহমদ বলেন| পাকিস্তানের ইতিহাসে শুধু পাকিস্তান কেন, পাক ভারত উপমহাদেশে, এমনকি আফ্রো এশিয়ায় এই সর্বপ্রথম নির্বাচন প্রতিযােগিতায় শরিক সব পার্টির নেতাদের রেডিও টেলিভিশনে নিজ নিজ পার্টির প্রােগ্রাম সম্বন্ধে দেশবাসীর উদ্দেশ্যে ভাষণ দিবার সুযােগ দেওয়া হইল । এটা করিলেন স্বয়ং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া। আফ্রো এশিয়ান গণতন্ত্রের জীবনে একটা নূতন ইতিহাস সৃষ্টি করিলেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া । (আমার দেখা রাজনীতি পঞ্চাশ বছর পৃ. ৫৩৯)
আওয়ামী লীগ
১৯৭০ সালের জানুয়ারিতে রাজনৈতিক কার্যকলাপের ওপর আরােপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের অনেক আগেই আওয়ামী লীগ তার নির্বাচনী প্রচারাভিযান শুরু করে। নির্বাচনী এলাকাগুলাের বৃহত্তম অংশের স্বার্থের দিকে খেয়াল রাখার জন্য প্রয়ােজনীয় পদক্ষেপ নেয়। পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় সব রাজনৈতিক দল যখন আলােচনা, জল্পনায় ব্যস্ত তখন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ নির্বাচনের প্রস্তুতিতে সম্পূর্ণ মনােযােগ দেয়। এ জন্য শেখ মুজিব অন্য নেতাদের সঙ্গে নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের জেলাগুলাে সফর করেন। তিনি জেলা ও মহকুমা পর্যায়ে দলীয় কর্মীদের উদ্দেশ্যে ঘরােয়া বৈঠকে ভাষণ দেন। কেননা এ সময় সামরিক আইন বলবৎ থাকায় জনসভা অনুষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল। শেখ মুজিবের ভাষণের মূল বক্তব্য ছিল ছয়দফার দলীয় দাবীগুলাে পূরণ, সার্বজনীন বয়স্ক ভােটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের বিধান সম্বলিত শাসনতন্ত্র প্রণয়নের জন্য জনপ্রতিনিধিত্বশীল জাতীয় পরিষদ গঠন। শেখ মুজিব পরিষ্কার ভাবে বলেন, আওয়ামী লীগের প্রথম ও সর্বাগ্রে লক্ষ্য হলাে, নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য স্বায়ত্তশাসন অর্জন করা। পরে অন্যান্য পরিবর্তন আসবে। আর সেগুলাে এর আগে যেমন ঘটবে না, তেমনি যুগপৎ স্বায়ত্তশাসনের সাথেও তা আসবে না। তিনি আরাে স্পষ্ট করে বলেন, দ্বিতীয় দফায় পরিবর্তনগুলােকে ক্রমান্বয়ে খাপ খাইয়ে নিয়ে প্রবর্তন করা হবে। শেখ মুজিব অসাম্প্রদায়িক বাঙালী জাতীয়তাবাদের কথা বলেন এবং জয় বাংলা ছিল
৫০
তাদের মূল স্লোগান। তিনি পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক বাঙালীদের শােষণের কথা তুলে ধরেন এবং বলতে থাকেন ছয়দফা দাবীর মাধ্যমে এ শােষণ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। তিনি ইসলাম পছন্দ দলগুলাের সমালােচনা করে বলেন যারা মনে করে ধর্মীয় বন্ধন পাকিস্তান রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি এবং ধর্মকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে তারা পাকিস্তান রাষ্ট্রের শত্রু । তিনি ধর্মকে রাজনীতির উর্ধ্বে রাখার চেষ্টা করেন। তিনি বলেন, I am a Muslim and I have firm faith in the Almighty God. . . none should utilize the name of Islam for any ulterior objective. তিনি বলেন, হিন্দু ও মুসলমান উভয়ে বাঙালী জাতীয়তাবাদের অংশ। তিনি হিন্দুদের উদ্দেশ্যে আবেদন জানিয়ে বলেন তাদের দেশত্যাগ করে ভারতে যাওয়ার দরকার নেই। হিন্দুদের তাদের মুসলমান ভাইদের পাশাপাশি জন্মভূমিতে থাকার সমঅধিকার রয়েছে। আওয়ামী লীগের রাজনীতি বাঙালী পুনর্জাগরণের সংস্কৃতি থেকে গড়ে ওঠা যা ভাষা আন্দোলনের সময় থেকে গড়ে উঠেছিল। বাঙালী জাতীয়তাবাদ ও অসাম্প্রদায়িকতার পাশাপাশি আওয়ামী লীগ সংসদীয় গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করে। এ সময় পূর্ব পাকিস্তানের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা হিসেবে শেখ মুজিবের রাজনৈতিক তৎপরতা পর্যবেক্ষক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তাঁর জীবনে একটি অভাবিত পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় এ সময়। তিনি পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার সাথে সমাজতন্ত্রের কথাও বলতে শুরু করেন। সমসাময়িক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল শেখ মুজিবের রাজনৈতিক চিন্তার ক্ষেত্রে সাধিত এ পরিবর্তনকে অভাবিত মনে করে তাকে ব্যঙ্গ করতে থাকেন। বিশেষ করে তৎকালীন পাকিস্তানে যারা নিজেদের সমাজতন্ত্রের একমাত্র ‘সােল এজেন্ট বলে ভাবতেন, শেখ মুজিব প্রধানত তাদের আক্রমণের শিকার হন। এনায়েতুল্লাহ খান সম্পাদিত সাপ্তাহিক হলিডে বঙ্গবন্ধুর সমাজতান্ত্রিক চিন্তাকে ব্যঙ্গ করে কার্টুনও প্রকাশ করে। ১৯৭০ সালে শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ঘােষণায় সমাজতন্ত্র’ শব্দটি যােগ করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন । এ সময়ের বিভিন্ন বক্তৃতা, বিবৃতি ও সাক্ষাৎকারে তিনি যে বক্তব্য রাখেন তা তাঁর নতুন রাজনৈতিক গতিধারার গুরুত্বপূর্ণ চিহ্নবাহী। এ সমাজতন্ত্র কোনাে মার্কসীয় সমাজতন্ত্র ছিল না। এটি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন ধাঁচে গড়ে ওঠা মতবাদ যা একান্ত বঙ্গবন্ধুর সুযােগ্য চিন্তার ফসল। যশােরের এক জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বলেন, তাঁর দল যে সমাজতন্ত্রের ধারণা চালু করেছে তা দেশের জন্য
৫১
প্রয়ােজন। এটা বাইরের কোনাে দেশ থেকে আমদানি করা হয়নি। তিনি বলেন এই দেশের ভবিষ্যৎ সমাজ হবে সমতা ও সামাজিক ন্যায়বিচার এবং আইনের চোখে সবাই সমান হবে। চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগের এক জনসভায় তিনি আওয়ামী লীগের সমাজতন্ত্র বলতে শােষণমুক্ত সমাজ ব্যবস্থার কথা বলেন। এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেন- We shall not import this socialism either from Russia or from China; The elected representatives of the people would build up this socialism according to the needs of the country and on the basic of national resources. By natural resources my party means environment, religion, social customs and attitude to the life, national health and genius of the people. (দৈনিক মর্নিং নিউজ, ১ সেপ্টেম্বর ১৯৬৯)
নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ এইচ. কামরুজ্জামান লাহােরে পাঞ্জাব ছাত্রলীগের সমাবেশে বলেন, প্রত্যেক দেশের নিজস্ব কিছু অদ্ভুত সমস্যা রয়েছে যেটি তার নিজস্ব উপায়ে সমাধান করতে হয়। তিনি বলেন, সমাজতন্ত্রের মূল ধারণা হচ্ছে সুপরিকল্পিত অর্থনীতির মাধ্যমে দেশের জাতীয় সম্পদের সুষম বণ্টন । তিনি আরাে উল্লেখ করেন আওয়ামী লীগের আন্দোলন হবে সামাজিক আন্দোলন যা পাকিস্তানের সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে এবং এতদিন তা গুটিকয়েক পরিবারের হাতে নিয়ন্ত্রিত হতাে। আওয়ামী লীগ শ্রেণী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সামাজিক উন্নয়ন ব্যাখ্যা করেনি। তারা বিশ্বাস করে যে একটি সামাজিক বিপ্লব ও সামাজিক অর্থনীতি যা গণতান্ত্রিক উপায়ে অর্জন করা যাবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব দাবী করতেন তাঁর দল ডান বাম কোনাে পন্থা নয় বরং মধ্যপন্থা নীতি অনুসরণ করে।
আওয়ামী লীগ শুরু থেকেই নির্বাচনকে আন্তরিকতার সাথে নিয়েছে। এটা দ্বারা বুঝায় না যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মনে করতেন নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশের সব সমস্যার সমাধান হবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের এ সম্পর্কে যথেষ্ট সন্দেহ ছিল যে, শাসক শ্রেণী সহজেই আনন্দের সাথে জনগণের রায় মেনে নিবে না। যার কারণে তিনি জনগণকে আরেকটি সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেন। তিনি বলতেন আওয়ামী লীগ চেষ্টা করবে নির্বাচনের মাধ্যমে ছয়দফার দাবী অনুযায়ী সমাধানের উপায় খোঁজা। তাই আওয়ামী লীগ দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিল অন্য কোনাে দলের সাথে আতাত না করতে। ওয়ালী ন্যাপ
৫২
আওয়ামী লীগের সাথে আতাঁত গড়ে তুলতে সবচেয়ে আগ্রহী ছিল। ওয়ালী ন্যাপের নেতা মােজাফফর আহমেদ তার বিভিন্ন বক্তৃতা বিবৃতিতে বলেন, আওয়ামী লীগের ছয়দফা দাবী বাস্তবায়ন হওয়া জরুরী কিন্তু তা বড় কোনাে শক্তিশালী আতাত ছাড়া সম্ভব নয়। শেখ মুজিব এর ছয় দফা ও ছাত্রদের এগার দফা’র মধ্যে অভিন্ন বিষয়গুলাে নিয়ে ঐক্য হতে পারে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ছাত্রলীগকে বলেন, “যুক্তফ্রন্টের মাধ্যমে জনগণের কোনাে সত্যিকারের কল্যাণ নিশ্চিত করা যাবে না।” তিনি জোর দিয়েই বলেন, “আমরা দল বা নেতাদের ঐক্য চাই না, আমরা জনগণের ঐক্য চাই।” তিনি আরাে বলেন, যদি অন্যান্য দলের সদস্যরা আওয়ামী লীগের আদর্শ বিশ্বাস করে তাহলে তাদের নিজ নিজ সাইনবাের্ড বদলে আওয়ামী লীগে যােগ দেওয়া উচিত। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট রাজনীতির উল্লেখ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তিনি আবার একই স্বাদ নিতে প্রস্তুত নন। তাঁর উল্লেখিত সমমনা দল বলতে পূর্ব পাকিস্তান ন্যাপ মােজাফফর-ই ছিল স্পষ্টতই সেই দল। এ দলটি নির্বাচনের জন্য বারবার যুক্তফ্রন্ট গঠনের তাগিদ দিয়ে আসছিল। পূর্ব পাকিস্তান ন্যাপ মােজাফফর-ই ছিল একমাত্র রাজনৈতিক দল যা প্রায় সব মৌলিক সমস্যার সমাধানের প্রশ্নে আওয়ামী লীগের মতবাদের সবচেয়ে কাছাকাছি। কিন্তু শেখ মুজিব, ১৯৬৯ সাল থেকে বলে আসছিলেন যে, যেভাবেই হােক যে পন্থায় হােক আওয়ামী লীগ ছয়দফা কর্মসূচি বাস্তবায়িত করবে। অবশ্য এর জন্য শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে তা করা হবে। তবে জনপ্রতিনিধিরা পরিষদের ভিতরে যদি কাজটি করতে না পারেন তাহলে তা জনসাধারণকে পরিষদের বাইরেই করতে হবে। যদি রাজপথে এ ইস্যু সমাধান করতে হয় তাহলে এক বিশাল আন্দোলনের প্রয়ােজন হবে যা কোনাে বিশেষ একটি দলের সাংগঠনিক সামর্থে কুলাবে না। এ আন্দোলন জাতীয় আন্দোলনে রূপ নিবে। তাই আওয়ামী লীগ কারাে সাথে জোট না করলেও তার তেমন কোনাে ক্ষতি হবে না। অথচ নির্বাচনের পর স্বায়ত্তশাসনের দাবী যে প্রক্রিয়াতেই পূরণ হােক না কেন, তা হবে আওয়ামী লীগের নামে। এজন্য আওয়ামী লীগ কোনাে ধরনের আতাতের ব্যাপারে উদাসীন থাকে। যারা আতাঁত চেয়েছিল তারা এ বিষয়টি জানতাে। আর সে কারণে তারা সবচেয়ে আধিপত্যশীল দলের সাথে থাকতে চেয়েছিল ।
৫৩
১৯৭০ সালের ৬ জুলাই আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ৯ দিন ব্যাপী পশ্চিম পাকিস্তান সফর শেষে ঢাকা ফিরে এক সংবাদ সম্মেলনে ঘােষণা করেন, আওয়ামী লীগ এককভাবে নির্বাচন করবে। কারণ দলের জাতীয় ও প্রাদেশিক কার্যনির্বাহী কমিটি কোনাে প্রকার নির্বাচনী ঐক্যজোট গঠন করার। বিরােধী। কোনাে আতাঁত প্রশ্নে আওয়ামী লীগের অনাগ্রহ দেখে মনে হয় এটি একটি সুচিন্তিত মতের প্রতিফলন। ১৯৭০ সালের জুন মাসে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে সাধারণ সম্পাদকের এক রিপাের্টে পরিষ্কার ভাবে বলা হয় যে, অন্যান্য দলের সঙ্গে নির্বাচনী আতাত হলে তাতে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হবে। তাই এখন জনসাধারণকে তাদের নিজ প্রতিনিধি ও দল বেছে নিতে হবে। এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ যে ব্যাখ্যা দিয়েছে তাতে বলা হয়‘এর অর্থ অবশ্য এই নয় যে, আমরা দেশের অন্যান্য গণতান্ত্রিক শক্তির সাথে কোনােই যােগাযােগ রাখবাে না, ইতঃপূর্বে বলা হয়েছে যে, যদি আগামীতে রাজনীতি গণতন্ত্রের পথে না এগিয়ে যায় এবং আমরা গণআন্দোলন গড়ে তুলতে ও সংগ্রাম শুরু করতে বাধ্য হই সেক্ষেত্রে আমরা দেশের অন্যান্য গণতান্ত্রিক দলের সহযােগিতাকে স্বাগত জানাবাে। প্রথম দিকের এক জনসভার বক্তৃতায় শেখ মুজিব ঘােষণা করেন যে, পাকিস্তান টিকে থাকার জন্যই এসেছে এবং কোনাে শক্তিই একে ধ্বংস করতে পারবে না।’ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের দাবীগুলাের মধ্যে প্রাধান্য পেয়েছিল বাঙালীদের দাবীসমূহ যা শেখ মুজিব কর্তৃক উচ্চারিত হয়েছিল। প্রথমত- শেখ মুজিব অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের তারিখ দাবী করেছিলেন, দ্বিতীয়ত- তিনি। ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র গ্রহণ করতে অনিচ্ছুক ছিলেন কারণ এর প্রতি তাঁর। প্রধান আপত্তি ছিল প্রতিনিধি নির্বাচনের পদ্ধতি যা ‘এক ব্যক্তি এক ভােট’ এর ভিত্তিতে ছিল না। এছাড়া তিনি কেন্দ্র ও প্রদেশের সম্পর্কের ব্যাপারেও আপত্তি তুলেছিলেন। তিনি এক ইউনিট ভেঙ্গে দেওয়ার পক্ষপাতি ছিলেন। এছাড়া তিনি দাবী করেন রাজনৈতিক দলগুলাের পূর্ণ কর্মতৎপরতা প্রতিষ্ঠার । কেননা ইয়াহিয়া খানের জারিকৃত সামরিক শাসনের ফলে ঘরােয়া রাজনীতিতে আলাপ-আলােচনা, সম্মেলন ও সংবাদ মাধ্যমে বিবৃতি দেওয়ার অনুমতি থাকলেও জনসভা, মিছিল ও জনসমাবেশের অনুমতি ছিল না। আওয়ামী লীগ তার ছয়দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে নির্বাচনী প্রচারাভিযান চালায়। এ দল। আগাগােড়া এ কথাই বলে যে, তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে পাকিস্তানে
৫৪
শােষণমুক্ত এক জনসমাজের অভ্যুদয় ঘটানাে। নির্বাচনী প্রচারাভিযানের প্রধান ভাষণগুলােতে কোনাে ঐতিহ্যগত বা চিরায়ত শ্রেণিহীন সমাজ কিংবা কোনাে নাস্তিক সমাজ সম্পর্কে কোনাে কোনাে মহল যাতে কোনাে প্রকার আশঙ্কার উদ্রেক না হয় সেদিকে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা হয়। আওয়ামী লীগ তাদের ছয়দফা যেভাবে জনগণের কাছে পেশ করেন তাতে পাকিস্তানের সার্বভৌম মর্যাদায় কোনােরকম পরিবর্তন সাধনের দাবী ছিল না। প্রথম দফায় বলা হয়, সরকারের ধরন হবে ফেডারেল ও পার্লামেন্টারি পদ্ধতির। শেখ মুজিব তার নির্বাচনী বক্তৃতাসমূহে বারবার জোর দিয়ে বলেন যে, তিনি কেবল প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন চাচ্ছেন, দেশকে ভাগ করা কিংবা তার ইসলামী আদর্শকে দুর্বল করা তাঁর লক্ষ্য নয় । আবুল মনসুর আহমদের ভাষায় বলা যায়- ‘জনপ্রিয় পার্টিসমূহের মধ্যে কার্যত একমাত্র আওয়ামী লীগই ছয় দফার ভিত্তিতে সে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। জনগণ তাদের অন্তরের প্রতিনিধি নির্বাচন করিয়াছিল। তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সার্বভৌমত্বের সামনে সামরিক প্রেসিডেন্টের এলএফও ঝড়ের মুখে তৃণখণ্ডের মতাে উড়িয়া গিয়াছিল। (প্রাগুক্ত, পৃ. ৫২৪)।
১৯৭০ সালের ২ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জের এক বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু বলেন, ছয় দফা কার্যক্রম বাস্তবায়িত করা হবে এবং তাতে পাকিস্তানের সংহতি কিংবা ইসলাম বিপন্ন হবে না।’ ২৪ সেপ্টেম্বর আরেক নির্বাচনী জনসভায় শেখ মুজিব নির্বাচনকে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে একটি গণভােট বলে অভিহিত করেন। ৬ নভেম্বর ১৯৭০ সিলেটে এক ভাষণে তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগের ছয় দফা কার্যক্রমের উদ্দেশ্য হচ্ছে কেবল আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের মাধ্যমে শাসনতন্ত্রে পূর্ববঙ্গের স্বার্থরক্ষার নিশ্চয়তা বিধান করা।’
আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতারাও তাদের বক্তৃতা বিবৃতিতে একই ধরনের কথা বলেছেন। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ ১৯৭০ সালের ২১ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জে বলেন যে, ছয়দফা আদায়ের প্রশ্নটি দেশের অখণ্ডতা ও সংহতির সঙ্গে বিশেষভাবে জড়িত। নিখিল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ.এইচ.এম কামরুজ্জামান ১৯৭০ সালে লাহােরে এক জনসভায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন যে, পাকিস্তানকে খণ্ডবিখণ্ড করা তাদের দলের উদ্দেশ্য নয়। এর আগে ১৯৭০
৫৫
সালের ২১ জুন রাজশাহীতে এক জনসভায় বক্তৃতায় তিনি বলেন, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান অচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ। নির্বাচনী প্রচারণা যতই তুঙ্গে উঠছিল ততই শেখ মুজিবের জনপ্রিয়তা প্রকট হচ্ছিল। ফল স্বরূপ অন্যান্য দলের প্রায় সব নেতাই শেখ মুজিবকে ও তাঁর ছয়দফাকে পাকিস্তানের বিরােধী বলে প্রচার করছিলেন। অতীতের সঙ্গে তুলনা করলে শেখ মুজিবের নির্বাচনী অভিযান ছিল ১৯৪৫-৪৬ সালে জিন্নাহর পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অভিযানেরই অনুরূপ। প্রচারাভিযান যতই এগিয়ে চলছিল ততই এটা প্রতীয়মান হচ্ছিল যে, শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগ-ই পূর্ব পাকিস্তানে একমাত্র প্রতিনিধিত্বশীল দল । ১৯৬৯ সালের ১৮ জুলাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাঁর বাসভবনে সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন-ই হচ্ছে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের সমস্যার ভদ্রজনােচিত সমাধান। তিনি বলেন, ভদ্রলােকের চুক্তিতে কখনাে বিচ্ছিন্নতার সুর ধ্বনিত হতে পারে না। শেখ মুজিব বলেন, দরিদ্র জনগণের ন্যায্য দাবীর প্রতিষ্ঠার জন্য আমার সংগ্রাম । আমি একজন সমাজতন্ত্রী । বিচ্ছিন্নতা সম্পর্কে শেখ মুজিবের এরকম কঠোর মনােভাবের কারণ পাকিস্তানের রাজনীতিতে তাঁকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে অভিহিত করা হতাে। পাকিস্তান এবং ইসলামকে যেসব রাজনীতিবিদ এক করে ফেলতেন এবং ধর্মকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতেন তাদের উদ্দেশ্য করে শেখ মুজিব ১৯৬৯ সালের ২৪ আগস্ট ঢাকা জেলা বার সমিতির সম্মেলনের বক্তৃতায় বলেন, পাকিস্তানে ইসলাম টিকে থাকবেই। কিন্তু ইসলামকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। তিনি বলেন, স্বায়ত্তশাসন মানে আলাদা হওয়া নয়। শক্তিশালী কেন্দ্রের তুলনায় শক্তিশালী পাকিস্তান। আরাে বেশি প্রয়ােজন। ১০ সেপ্টেম্বর ১৯৬৯ সালে চট্টগ্রামে এক বক্তৃতায় ৬দফা কর্মসূচির মাধ্যমে সমাজতন্ত্র কায়েমের পক্ষপাতিত্বের কথা বলেন। তিনি বলেন, ইসলাম সমাজতন্ত্রের পরিপন্থী নয়। কারণ ইসলাম চায় সামাজিক ন্যায়বিচার। তিনি আরাে বলেন, দুরভিসন্ধি চরিতার্থ করার জন্যে কারাে ইসলামের নাম ব্যবহার করা উচিত নয়। ইসলাম ও সমাজতন্ত্রের মধ্যে কোনাে বিরােধ নেই । বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব জনগণের মধ্যে যেভাবে সমাজতন্ত্র সংক্রান্ত বক্তব্য ছড়িয়ে দিচ্ছিলেন, তা ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ এতদিন ধরে প্রতিক্রিয়াশীলরা সমাজতন্ত্রীদের জব্দ করার জন্য প্রধানত ধর্মকেই ব্যবহার করেছে। কিন্তু সমাজতন্ত্রীরা তাদের বিরুদ্ধে কখনাে পাল্টা জবাব
৫৬
দিতে পারেনি। ১৯৭০ সালের ৭ জুন রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় জামায়াতে ইসলামি ও ন্যাপ ওয়ালীর সমালােচনা করে বলেন, জামায়াতে ইসলামি ইসলামের ঠিকাদার হতে চায়। এ দলটি ৩ বছরে ১১টি পত্রিকার মালিক হয়েছে এবং প্রচুর বই পত্র ছাপিয়েছে, এরা এত টাকা কোথায় পায়? ন্যাপ ওয়ালী মােজাফফর এর সমালােচনা করে বলেন, একটি দল ঐক্য ঐক্য করে তাদের মাথা খারাপ করে দিচ্ছে। তাদের তিনি আওয়ামী লীগে যােগদানের আহবান জানান। ডিসেম্বরে নির্বাচন পিছিয়ে যাওয়ার পরপরই পাকিস্তান জডে নির্বাচনী তৎপরতা পুরােদমে শুরু হয়ে যায়। এ সময় কাইয়ুম। পন্থী মুসলিম লীগের সহ সভাপতি ওয়াহিদুজ্জামান শেখ মুজিবের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলে শেখ মুজিব ঘােষণা করেন, তিনি ওয়াহিদুজ্জামানের ভরাডুবি ঘটাবেন। ২৮ আগস্ট ১৯৭০ সালে মুসলিম লীগ নেতা কাজী কাদের ও ওয়াহিদুজ্জামান এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের সাক্ষী রেখে বলেন, যদি আওয়ামী লীগের নেতারা নির্বাচনে জিততে পারেন তাহলে তারা হাতের কবজি থেকে কনুই পর্যন্ত চুড়ি পরে ঘুরে বেড়াবেন। ওয়াহিদুজ্জামান আরাে বলেন, গােপালগঞ্জ কেন্দ্র থেকে তিনি যদি আওয়ামী লীগ প্রার্থীর কাছে পরাজিত হন তাহলে তিনি রাজনীতি ছেড়ে দেবেন। কাজী কাদের বলেন, রাজশাহী কেন্দ্র থেকে আওয়ামী লীগ নেতা কামরুজ্জামান জিতলে তিনিও রাজনীতি ছেড়ে দিবেন।
জাতীয় পরিষদে পূর্ব পাকিস্তানের ১৬২ আসনে এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩১৩ আসনে দলীয় মনােনয়ন দেওয়ার জন্য শেখ মুজিবকে প্রধান করে একটি পার্লামেন্টারি বাের্ড গঠন করা হয় । ২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিব ঢাকায় তার দলের মনােনীত প্রার্থীদের নাম ঘােষণা করেন । এদিন তিনি নির্বাচনের পূর্বেই রাজবন্দিদের মুক্তি দাবী করে বলেন, একমাত্র সিন্ধু যুক্তফ্রন্ট ব্যতীত আওয়ামী লীগ আর কারাে সাথে নির্বাচনী জোট করবে না। আওয়ামী লীগ-ই একমাত্র দল যারা পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সব আসনেই প্রার্থী দেয়। আওয়ামী লীগের মনােনয়ন প্রার্থীর সংখ্যা ছিল বিপুল । ১৯৭০ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর পূর্ব পাকিস্তানে থেকে আওয়ামী লীগ মনােনীত প্রার্থীদের তালিকা ঘােষণা করার সময় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও যুগপৎ আওয়ামী লীগের সংসদীয় বাের্ডের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ উল্লেখ করেন যে, যথাক্রমে
৫৭
জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের ১৬২ ও ৩০০ আসনের জন্য ৩৫৯ ও ১৫৫৬টি আবেদনপত্র পাওয়া গেছে। আওয়ামী লীগ নির্বাচনী দৌড়ের প্রথম ধাপে অন্য দলগুলাের তুলনায় অনেক এগিয়ে থাকে। আওয়ামী লীগে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সব আসনে প্রার্থী দেয়। সে তুলনায় মাত্র একটি দল জাতীয় পরিষদের ও দুইটি দল প্রাদেশিক পরিষদের ৫০ শতাংশের বেশি আসনে প্রার্থী দিতে সক্ষম হয়। আওয়ামী লীগ ও অন্য দলগুলাের মধ্যে এ ব্যবধান থেকে বােঝা যায় যে, অন্য দলগুলাের কোনােটিই পূর্ব পাকিস্তানের রঙ্গমঞ্চে নতুন ছিল না। অনেক বেশি সংখ্যক আসন নির্বাচনী এলাকা থেকে প্রার্থী দিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতার অক্ষমতার কথা প্রমাণ করে যে, তাদের প্রভাব ছিল একান্ত স্থানীয় পর্যায়ে।
আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের ইস্যুকে সামনে রেখে যা ছয়দফা দাবীর মধ্যে গুরুত্ব পায়। বেশিরভাগ ইসলামিক দলগুলাে মনে করে যে, প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টি নিয়ে বাড়াবাড়ি করার কোনাে দরকার নেই। কারণ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ঘােষণা দিয়েছেন পাকিস্তানের পরবর্তী শাসনতন্ত্র ঠিক করবে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টি। তাই কোনাে দলের এটিকে নির্বাচনের ইস্যু বানানাে উচিত নয়। এ দাবী পুরােপুরি অগণতান্ত্রিক। একমাত্র জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা নির্বাচিত পরিষদ এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিবে। এ দাবী তােলা হয় আওয়ামী লীগের অবস্থানকে দুর্বল করার জন্য। এমনকি মওলানা ভাসানী ইসলামী দলগুলাের সাথে একাত্মতা করে তাদের এ দাবীর প্রতি সমর্থন জানান। পাকিস্তান ডেমােক্রেটিক পার্টির নবাবজাদা নসরুল্লাহ খান বলেন, যদি প্রেসিডেন্ট প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের ব্যাপারে নির্বাচনের পূর্বে সিদ্ধান্ত নিতেন তাহলে ছয়দফা দাবী উত্থাপনকারী পূর্ব পাকিস্তানি নেতাদের দাঁড়ানাের আর জায়গা থাকতাে না। নসরুল্লাহ খান তাঁর যুক্তির পক্ষে ব্যাখ্যা দেন যে, প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টি যদি অমীমাংসিত থাকে তাহলে পূর্ব পাকিস্তানের এক ধরনের সংকীর্ণ মনের রাজনীতিবিদরা একে নির্বাচনের ইস্যু হিসেবে ব্যবহার করবে এবং তা পাকিস্তানের উভয় অংশের স্বার্থের বিরুদ্ধে যাবে। এর ফলে ১২০ দিনের মধ্যে শাসনতন্ত্র রচনা করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। পিডিপি প্রধান নূরুল আমীনও নির্বাচনের পূর্বে স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্ন মীমাংসা করার কথা বলেন। পূর্ব পাকিস্তান পিডিপি সভাপতি আবদুস সালাম খান পরামর্শ দেন নির্বাচনের পূর্বে একটি
৫৮
বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্রে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন কেমন হবে তা ঠিক করা উচিত। পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামির আমির অধ্যাপক গােলাম আযমও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে অনুরােধ করেন। নির্বাচনের পূর্বে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টি সুরাহা করার জন্য। কাইয়ুম পন্থী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক খান আবদুস সবুর খান দাবী করেন প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টি প্রেসিডেন্টের নিজের সমাধান করা উচিত। মওলানা ভাসানীও একই দাবী করেন। তিনি টাঙ্গাইলের সন্তোষে কৃষক সমাবেশে দাবী করেন নির্বাচনের পূর্বে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টি লাহাের প্রস্তাব অনুযায়ী সমাধান হওয়া উচিত। তিনি আরাে বলেন, প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টি যদি নির্বাচনী ইস্যুতে পরিণত হয় তাহলে তা দেশের উভয় অংশের জনগণের মধ্যে তিক্ততার সৃষ্টি করবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতামত ছিল স্বায়ত্তশাসন সহ সব সাংবিধানিক সমস্যা জনগণের মাধ্যমে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা সমাধান হওয়া উচিত। মওলানা ভাসানীর দাবীর সমর্থনে তিনি বলেন, স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টি নির্বাচনের পূর্বেই প্রেসিডেন্টের সমাধান করা উচিত। তিনি বলেন, “We are not beggars. We know how to establish the rights of the people’. 96 testa ওয়ালী ন্যাপের সভাপতি অধ্যাপক মােজাফফর আহমদ ও সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আলতাফ হােসেন এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেন, প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের ব্যাপারে একমাত্র নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সিদ্ধান্ত নিবেন। তারা বিস্ময়ের সাথে আরাে বলেন যে, ভাসানীর মতাে বামপন্থী একটি দল কী করে ডানপন্থী দলের সাথে হাত মিলিয়ে সামরিক শাসনের পক্ষে কথা বলেন। পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো উল্লেখ করেন যে, প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টি জাতীয় পরিষদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই সিদ্ধান্ত নিবে।
সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও ভুট্টো প্রায় একই সংগ্রাম নীতি বা কৌশল গ্রহণ করেন। শেখ মুজিব পশ্চিম পাকিস্তান বিরােধী প্রচার আর ভুট্টোর ছয়দফা বিরােধী প্রচারের ফলে নির্বাচনের শুরু থেকেই দু’অঞ্চলের লােকদের মধ্যে অবিশ্বাস ও দূরত্ব বৃদ্ধি পেতে থাকে। সাধারণ নির্বাচনের শুরুতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান প্রত্যেক দলের নেতাকে রাষ্ট্রীয় প্রচার মাধ্যম বেতার টেলিভিশনে তাদের দলের কর্মসূচি ঘােষণা করার জন্য অনুরােধ
৫৯
জানান। তখন সর্ব মহল প্রেসিডেন্টের এ উদ্যোগকে স্বাগত জানায়। কিন্তু গণ্ডগােল বাধলাে ২৮ অক্টোবর শেখ মুজিবের বক্তৃতা নিয়ে । শেখ মুজিবের কথা হচ্ছে, এ ভাষণে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের জায়গায় বাংলাদেশ এবং জয় বাংলা বলবেন। এছাড়া তাঁর এ লিখিত ৩০ মিনিটের বক্তৃতার সবটুকু পড়তে দিতে হবে; না হলে বক্তৃতা দিবেন না। বহু দেন দরবার ও ঢাকা পিণ্ডি যােগাযােগ করেও তার কোনাে সুরাহা হলাে না। শেষ পর্যন্ত নির্ধারিত সময়ের ঘন্টাখানেক আগে পিণ্ডি থেকে খবর আসে শেখ মুজিব বাংলাদেশ নয় পূর্ব বাংলা বলতে পারেন। এরপর শেখ মুজিব দেশবাসীর উদ্দেশ্যে ভাষণ দান কালে ছয়দফা দাবীর বিস্তারিত ব্যাখ্যা দান করেন এবং জয় বাংলা ও খােদা হাফেজ বলে বক্তৃতা শেষ করেন।
জাতীয় গণমাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা উপলক্ষে দৈনিক পাকিস্তানে সংগ্রামী জনতার আর একটি বিজয়’ শিরােনামে সংবাদে বলা হয়- ‘গতকাল বুধবার ২৮শে অকটোবর ছিল দেশের সংগ্রামী জনতার বিজয়ের আর একটি দিন। সরকারী প্রচার সংস্থার ইতিহাসে গতকাল ছিল এক নয়া যুগ প্রবর্তনের প্রথম দিন। গত ২৩ বছরের মধ্যে গতকালই ক্ষমতাসীন সরকারের সদস্য নন এমন একজন রাজনৈতিক নেতাকে বেতার এবং টেলিভিশনে তাঁর দলীয় কর্মসূচী বলার সুযােগ দেয়া হয়েছে।
নির্বাচন উপলক্ষে বেতার ও টেলিভিশন আয়ােজিত বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের বকতা মালার প্রথম বক্তা আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবর রহমান গতকাল তাঁর ভাষণের প্রারম্ভেই বেতার ও টেলিভিশনে বকতৃতা দানের এই সুযােগকে জনতার সংগ্রামের প্রথম বিজয় বলে অভিহিত করেন। আর রুহের মাগফেরাত কামনা করে সে সকল বীর শহীদানদের যাদের ত্যাগের মহিমায় মহিমান্বিত আন্দোলন গত বছর পরিণত হয়েছিল। ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানে।
জনসাধারণ উন্মুখ আগুনে প্রহর গুণছিল। বেতারে টেলিভিশনে রাজনৈতিক দলপতিদের নির্বাচনী বকতৃতা প্রচার করা হলে এই ঘােষণার পর থেকেই তাদের আগ্রহ প্রহর পেরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল। পাকিস্তানের ইতিহাসে ঘটনাটি প্রথম। কোন নেতা কেমন বকতৃতা দেবেন, কার বকতৃতা জোরালাে হবে এসব আলােচনা তাে চলেছেই এমনকি কোন নেতার বাচনভঙ্গী ও প্রকাশভঙ্গী কেমন হতে পারে তা নিয়েও জল্পনা কল্পনা হয়েছে। কোথাও কোথাও উত্তাপও সৃষ্টি হয়েছে।
৬০
এই আগ্রহেরই প্রতিচ্ছবি দেখেছি গতকাল সন্ধ্যায়। আওয়ামী লীগ প্রধান। শেখ মুজিবের নির্বাচনী ভাষণ দিয়ে গতকাল শুরু হয়েছে এই সিরিজ অনুষ্ঠান । বকতৃতা শ্রবণ ও নেতাকে পর্দায় দর্শনের জন্যে বেতার ও টেলিভিশনের সামনে ভীড় জমে প্রচুর। সন্ধ্যা ছয়টা কডিতে বেতারে বকতা শােনার পর সাড়ে সাতটায় বক্তাকে টেলিভিশনের পর্দায় দেখার জন্য ভীড় বেড়েছে বৈ কমেনি।
বিভিন্ন বাসভবনে প্রতিবেশীরা ভীড় জমিয়েছে কিন্তু সবচেয়ে বর্ণময় দৃশ্যের অবতারণা হয়েছে বিভিন্ন এলাকার দোকান পাটের সামনে। দোকানের সামনে রাস্তায় ভীড় জমে গেছে। জনসভায় লােক যেমন বসে ও দাঁড়িয়ে বকতৃতা শােনে তেমনি এক ছােটখাট সভার শ্রোতা হয়ে বিভিন্ন দোকানের সামনে শত শত লােক বকতৃতা শ্রবন ও দর্শন করেছে । গাড়ী থামিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে কেউ, আবার কেউ বা পাশে দাঁড়ানাে কোন রিকশার ওপরেই ঠায় দাঁড়িয়ে পড়েছেন।
বকতৃতা শােনানাের সুবিধার জন্যে বিভিন্ন এলাকার দোকানীরা তাদের টিভি সেটকে সাময়িকভাবে দোকানের বাইরে বসিয়ে দেন। বায়তুল মােকররম-স্টেডিয়াম এলাকায় এমনি দুটি দোকানের সামনের শ্রোতা-দর্শকের সংখ্যা এক পর্যায়ে ছােটখাট সভার রূপ ধারণ করে। | কোথাও কোথাও বাসাবাড়ীর সামনেও এমনি ভীড় জমে। এবং তা এড়ানাের জন্যে বাড়ীওয়ালা তার টিভিসেট ঘরের বাইরে বসিয়ে দেন অথবা ঘরের জানালা দরজা খুলে দেন। বেতারে যখন বক্তৃতা প্রচারিত হচ্ছিল শহরের কোথাও কোথাও তা মাইকযােগে প্রচার করা হয়।
শেখ মুজীবের গতকালের এই বকতৃতা শ্রবণ অনুষ্ঠানের জন্য কোথাও কোথাও খানিকটা ঘটা করে আয়ােজনও করা হয়। পুরনাে ঢাকার গেন্ডারিয়ায় একটি নৌকোর প্রতীকের মধ্যে বসিয়ে দেয়া হয়েছিল একটি টিভি সেট । কোথাও কোথাও শেখ মুজীবের বকতা চলাকালে টিভি সেটের উপর মাল্যও ঝুলিয়ে দেয়া হয় ।
বকতৃতা শেষ হওয়ার সাথে সাথে বেতার ও টিভি সেটের সামনে শ্লোগানে শ্লোগানে আওয়ামী লীগ কর্মীরা এলাকা মুখর করে তােলে। বকতা চলাকালেও মাঝে মধ্যে শ্লোগান উঠেছে। শেখ মুজীবের বকতৃতা ঢাকার জনগণের অশ্রুত নয়। কিন্তু সুসংবদ্ধ লিখিত ভাষণে শেখ মুজীবের গতকালের
৬১
বকতব্য পেশের পর শ্রোতারা তাঁর বকতব্য নিয়ে আলােচনামুখর হয়ে ওঠে। বকতব্যের বিভিন্ন দিক নিয়ে শ্রোতায় শ্রোতায় কোথাও কোথাও বাদানুবাদ হয়। (২৮ অক্টোবর ১৯৭০)।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাঁর বেতার ও টেলিভিশন ভাষণে উল্লেখ করেন যে, আওয়ামী লীগের ছয়দফা ও অন্যান্য অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উদ্দেশ্য সকলের প্রতি ন্যায়বিচার । কাজেই এসব কখনাে ইসলাম বিরােধী হতে পারে না। কেননা ছয়দফা কর্মসূচি ছিল আওয়ামী লীগের প্রধান অবলম্বন। ১৯৬৬ সাল থেকে পরবর্তীকালে এ দল একটানা এ কর্মসূচি বাস্তবায়নকেই তাঁর একমাত্র লক্ষ না হলেও সর্বাগ্রগণ্য উদ্দেশ্য হিসেবে প্রচার করেছে। ১৯৭০ সাল নাগাদ এ কর্মসূচি পূর্ব পাকিস্তানি জনগণের ভবিষ্যৎ অস্তিত্বের প্রতীক হয়ে ওঠে। তাই ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ঠিক আগে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের অন্য যে কোনাে রাজনৈতিক গােষ্ঠীর চেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল। শেখ মুজিব ও তাঁর রাজনৈতিক দল পূর্ব পাকিস্তানে এগিয়ে ছিল। আওয়ামী লীগ ১৯৭০ সালের জুন মাসে একটি মিছিল বের করে যেখানে প্রায় ৪ লক্ষ লােক বৃষ্টিতে ভিজে মিছিলে অংশ নেয়। শেখ মুজিব তখন ঘােষণা দেন আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে ৭০-৮০% ভােট পাবে। অন্য রাজনৈতিক দলগুলাে তাদের সমালােচনায় বলতে থাকে, নির্বাচন যদি স্বায়ত্তশাসন অর্জনের ক্ষেত্রে রেফারেন্ডম হয় তাহলে তা পশ্চিম পাকিস্তানে কোনাে সমর্থন পাবে না । ডানপন্থী ও ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলাে যুক্তি দেখায় যে, শেখ মুজিবের ছয়দফা দেশে কার্যকরী হবে না এবং এতে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার বিষয়টি ভেঙ্গে পড়বে। শেখ মুজিবের কাছে প্রধান চ্যালেঞ্জ ছিল ন্যাপ ভাসানী। কারণ মওলানা ভাসানী ইসলামিক সমাজতন্ত্র প্রচার করেন এবং দেশের কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণির ওপর তার অসাধারণ প্রভাব ছিল। যা শেখ মুজিবের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বি হিসেবে দাঁড়ায়। কম গুরুত্বপূর্ণ দলগুলাে যেমন পিডিপি, জামায়াতে ইসলামি, মুসলিম লীগের তিনটি গ্রুপ এদের প্রায়ই জনসমাবেশ করতে পুলিশি নিরাপত্তার প্রয়ােজন হতাে। এজন্য শেখ মুজিব এদের সমালােচনা করে বলেন যে, এসব দল সবসময় সামরিক শাসনের ছাতার নিচে থাকতে বেশি পছন্দ করে এবং নির্বাচনের পরে এসব দলের পূর্ব পাকিস্তানে কোনাে স্থান হবে না ।
৬২
আওয়ামী লীগ এর প্রধান শেখ মুজিব নির্বাচনী কর্মকাণ্ডের অংশ হিসেবে সমগ্র পূর্ব বাংলায় ঘুরে বেড়ান। এরপর তিনি নির্বাচনী প্রচারণার কার্যে পশ্চিম পাকিস্তান যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কারণ পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি। হিসেবে নির্বাচনী প্রচারে সেখানেও অংশ নেওয়া তাঁর কাছে আবশ্যক বলে মনে হয়েছিল। ১৯৭০ সালের ২৭ জুন করাচীতে রওয়ানা হওয়ার মুহূর্তে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, উভয় অংশের দরিদ্র মানুষের হক আদায়ই আমার লক্ষ্য। করাচীতে পৌছে তিনি বলেন, পাকিস্তান ২২ পরিবার নয় ১২ কোটি মানুষের। এবারের নির্বাচনে সে প্রশ্নের মীমাংসা হবে। শেখ মুজিব পশ্চিম পাকিস্তানের করাচী ও লাহােরে বেশ কয়েকটি জনসভায় ভাষণ দেন।
সব রাজনৈতিক দলগুলাের মধ্যে আওয়ামী লীগ ও পিপলস পার্টি ছিল। সবচেয়ে বেশি সক্রিয়। তারা একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বির নাম উচ্চারণ করতাে। রাজনৈতিক দলগুলাের নেতাদের মধ্যে শেখ মুজিব ও ভুট্টো ছিলেন সবচেয়ে তরুণ, উদ্যমী, ব্যবহারের দিক দিয়ে মার্জিত, শক্তিশালী প্রচারণা চালিয়ে জনসমাগম ঘটাতে পারতেন। এ দুটি দলের মিছিল মিটিংয়ে তাদের অনুসারীরা তাদের নেতাদের ছবিসম্বলিত পােস্টার বহন করতেন। নির্বাচনী প্রচারণার প্রাথমিক পর্যায়েই এটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে, জাতীয় ইসলাম পছন্দ দলগুলাের সামান্যই জনসমর্থন ছিল। সমর্থনের ধারা ছিল আঞ্চলিকতামুখী ও বামপন্থী । বামপন্থী দলগুলাে সাংবিধানিক পন্থায় পুরােপুরি বিশ্বাস করতাে না। তারা মনে করতাে কেবল সংঘাত ও সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমেই বাঙালীর অধিকার আদায় করা সম্ভব। রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়ায় আওয়ামী লীগ বামপন্থী দলগুলাের চেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল। পরবর্তীকালে অন্য দলগুলােও প্রদেশব্যাপী মিছিল ও সভা সমাবেশের আয়ােজন করেছে। কিন্তু জনসমর্থনের দিক দিয়ে প্রথম থেকেই আওয়ামী লীগ ছিল অন্যান্য সকলের চেয়ে অনেক বেশি অগ্রণী অবস্থানে। আওয়ামী লীগের জনসমর্থন দেখে অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলাে আওয়ামী লীগের নামে মিথ্যাচার করতে থাকে যে, তারা ভারতের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে তাদের নির্বাচনী ব্যয় নির্বাহ করছে । নেতা ও কর্মীদের সকলেই ছিলেন উদ্বুদ্ধ, ভাবাবেগে বাঙালী জাতীয়তাবাদের অনুরক্ত।
আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তার কারণে পাকিস্তান পন্থী দলগুলাে নিজেদের নির্বাচনী ব্যয় মিটানাের জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার কাছে সাহায্যের আবেদন
৬৩
জানিয়েছিল। তাদের যুক্তি ছিল ১৯৭০ সালের নির্বাচন পাকিস্তানের ভাগ্য নির্ধারণ করবে। পাকিস্তান অখণ্ড রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকবে না বাংলাদেশের সৃষ্টি হবে, তা নির্ভর করছে নির্বাচনের ফলাফলের ওপর।
নির্বাচনী প্রচারাভিযান পূর্ণ বেগে চলতে থাকে। শেখ মুজিব এবং অন্য নেতৃবৃন্দ সড়ক ও রেলপথ, নৌকাযােগে দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। আওয়ামী লীগের মূল প্রচার ছিল ছয়দফা দাবী আদায় করা। এই উদ্দেশ্যে দলটি বাঙালী জাতীয়তাবাদকে তুলে ধরে। পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক শােষণ, অবিচার, চাকরিতে বৈষম্য, মূলধন পাচার, অবজ্ঞা বঞ্চনার কথা তারা তুলে ধরে। অব্যাহত এই প্রচারণা ক্রমান্বয়ে সরকারি। কর্মচারীদের ওপর প্রভাব ফেলতে শুরু করেছিল, এটা উপজাতীয়তাবাদের একটা বৈশিষ্ট্য। এটা একবার ছড়িয়ে পড়লে সাধারণত ছড়াতে থাকে। এর ফলে সরকারি কর্মচারী ও সংস্থাসমূহের আনুগত্য, দক্ষতা ও বিশ্বস্ততা মারাত্নকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে থাকে। সরকার তার নির্বাহীদের ক্ষমতা হারায়। যার ফলে শাসন কাজ পরিচালনা করার এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষার সামর্থ্যের ওপর প্রতিকূল প্রভাব পড়ে। সরকারের সিনিয়র সচিবসহ সরকারি কর্মচারীদের বেশিরভাগই আওয়ামী লীগের চিন্তাধারার সমর্থকে পরিণত হয়েছিল। সরকারের চেয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের প্রতি তাদের আনুগত্য বেশি ঝুঁকতে থাকে।
জামায়াতে ইসলামি
মাওলানা আবুল আলা মওদুদীর জামায়াতে ইসলামি ছিল একটি গােড়া ধর্মভিত্তিক দল। যারা মনে করত মুসলিম লীগ ইসলামের প্রকৃত প্রতিনিধিত্বকারী দল নয়। মাওলানা মওদুদী মনে করতেন মুসলিম লীগ ইসলামকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করছে। জামায়াতে ইসলামি মনে করে যে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি পূর্ব পাকিস্তানের যে দুঃখ দুর্দশা তা সত্যি। জামায়াত ইসলামি বিশ্বাস করে যে, এসব দুঃখ দুর্দশা তৈরি হয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের ভুল নীতির কারণে। সঠিক ইসলামিক শাসনের মাধ্যমে এসব দুঃখ দুর্দশা দূর করা যাবে । জামায়াত ইসলামি বিশ্বাস করে ইসলামি আদর্শ, সংসদীয় গণতন্ত্র এবং আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন পাকিস্তানের সংহতি রক্ষা করবে। মাওলানা মওদুদী মনে করেন ১২০ দিনের মধ্যে কখনাে-ই শাসনতন্ত্র
৬৪
প্রণয়ন করা সম্ভব নয়। তিনি মনে করেন আওয়ামী লীগের ছয়দফার মাধ্যমে কখনাে ফেডারেল সরকার গঠন করা যাবে না এবং আওয়ামী লীগের মিথ্যা জাতীয়তাবাদের মূল লক্ষ্য ভারতীয় ও আমেরিকানদের সহযােগিতায় পৃথক একটি রাষ্ট্রের সৃষ্টি। মওদুদী ও তার দল বিশ্বাস করে যে, ইসলাম হচ্ছে একমাত্র শক্তি যা পাকিস্তানের মুসলমানদের একত্রিত করবে। তারা আওয়ামী লীগের ধর্মনিরপেক্ষতার সমালােচনা করেন। অধ্যাপক গােলাম আযম মনে করেন, প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন ও পূর্ব পাকিস্তানের দুঃখ দুর্দশা দূর করার সাথে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি ও বাঙালী জাতীয়তাবাদের কোনাে সম্পর্ক নেই। অধ্যাপক গােলাম আযম বিশ্বাস করেন, শেখ মুজিবুর রহমান তার বাঙালী জাতীয়তাবাদ দ্বারা পূর্ব ও পশ্চিম বাংলাকে একত্রিত করার চেষ্টা করছেন। অন্যান্য ইসলামিক দলগুলাের মতাে জামায়াতে ইসলামিও পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রের বিরােধী কারণ এগুলাে অনৈসলামিক। গােলাম আযমের মতে সমাজতন্ত্র হচ্ছে পুঁজিবাদের একটি জঘন্য রূপ। জামায়াতে ইসলামি পাকিস্তানের প্রধান মাওলানা আবু আলা মওদুদী ৩ নভেম্বর বেতার টেলিভিশন ভাষণে বলেন, জামায়াত পাকিস্তানে এমন একটি ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করতে চায় যা খােলাফায়ে রাশেদীনের আদর্শ অনুসরণ করবে।
ন্যাপ (ভাসানী গ্রুপ)
মওলানা ভাসানীর ন্যাপ কোনাে ঐক্যবদ্ধ দল ছিল না। এখানে অনেকগুলাে ধারা বা উপদল তৈরি হয়েছিল যারা সকলে মওলানা ভাসানীকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানে নির্বাচনের ঘােষণা দেওয়ার পর ভাসানী মাওপন্থী নীতি অনুসরণ করে বলেন যে, তাঁর দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না। তিনি আরাে বলেন, তাঁর দল চেষ্টা করবে সহিংস উপায়ে সামাজিক বিপ্লব করার। অবশ্য এ মানসিক অবস্থা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ধীরে ধীরে তার মনের পরিবর্তন ঘটে এবং নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৬৯ সালের ৫ অক্টোবর মওলানা ভাসানী সাংবাদিকদের বলেন যে, পাকিস্তানের সমস্যাগুলাে একমাত্র সমাজতন্ত্রের মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব, নির্বাচনের মাধ্যমে নয়। তিনি বিশ্বাস করেন যে নির্বাচনের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। তিনি পরামর্শ দেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের উচিত সব রাজনৈতিক দলের নেতাদের নিয়ে
৬৫
একটি গােলটেবিল বৈঠক আহবান করা এবং সেখানে স্থির হবে ভবিষ্যতের শাসনতন্ত্রের খসড়া কী হবে এবং তা গণভােটের মাধ্যমে নির্ধারিত হওয়া উচিত। মওলানা ভাসানী ছিলেন একজন কৃষক নেতা এবং তিনি ১৯৫৭ সালের ডিসেম্বর মাসে কৃষক সমিতি গঠন করেন। কিন্তু আইয়ুব খানের সময় এর কার্যক্রম খুব সীমিত ছিল। আইয়ুব খানের পতনের পর তিনি কয়েকটি কৃষক সম্মেলন করেন। এরকম একটি কৃষক সমাবেশে শেরপুরে তিনি দাবী করেন ‘ভােটের আগে ভাত চাই’। ১৯৭০ সালের জানুয়ারি মাস থেকে ভাসানী নির্বাচনে অংশ নেয়ার ব্যাপারে ইতিবাচক মনােভাব ব্যক্ত করেন। তিনি বলতে থাকেন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে তিনি জনগণের দুঃখ-দুর্দশা দূর করবেন। ক্ষমতার জন্য নয় জনগণের অধিকারের জন্য পরিষদে যাবেন। ১৯৭০ সালের জানুয়ারিতে টাঙ্গাইলের সন্তোষে দ্বিতীয় কৃষক সমাবেশে তিনি বলেন, সমাজতন্ত্রের মাধ্যমে জনগণের সমস্যার সমাধান করা যাবে এবং এটি অর্জন হবে বিপ্লবের মাধ্যমে। মওলানা ভাসানীর নিজ দলের অনেকে তাঁর নির্বাচনে অংশ নেওয়া ও ইসলামিক সমাজতন্ত্রের ধারণাকে সমর্থন করেননি। এর ফলে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দলের অভ্যন্তরে বিভাজন তৈরি হয়। ভাসানী ন্যাপ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে কিনা তা নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগতে থাকে। দলে অবস্থিত চরম বামপন্থীদের একটি উপদল নির্বাচন বর্জনের জন্যে চাপ দিলে ঢাকায় দলের জরুরী কাউন্সিল আহবান করা হয়। শেষ পর্যন্ত জুন মাসে লাহােরে অনুষ্ঠিত দলের বৈঠকে নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত বহাল থাকে। দলের পূর্ব পাকিস্তান শাখার সাধারণ সম্পাদক মশিউর রহমান যাদু মিয়া তৃতীয় আরেকটি প্রস্তাব এনে বলেছিলেন, ভাসানী ন্যাপ নির্বাচনে শুধু টোকেন অংশগ্রহণ করবে। কিন্তু তাঁর এ প্রস্তাব বৈঠকে পাস হয়নি। ১৯৭০ সালের ৫ নভেম্বর ন্যাপ প্রধান মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী বেতার টেলিভিশন ভাষণে বলেন, যদিও আমাদের মধ্যে অনেক মতের পার্থক্য রয়েছে, তবুও আমরা পাকিস্তানকে ভালােবাসি। ভাসানী ন্যাপের যারা নির্বাচন বিরােধী ছিলেন, তারা দেশের সর্বত্র নির্বাচন বয়কটের আহবান জানিয়ে মিছিল মিটিং করতে থাকে । ৯ নভেম্বর ঈশ্বরদীতে ভাসানী ন্যাপের মতিন-আলাউদ্দিন গ্রুপ ও পূর্ব বাংলা ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীরা একটি নির্বাচন বিরােধী মিছিল বের করে। ইতােমধ্যে ১২ নভেম্বর পূর্ব বাংলায় ঘূর্ণিঝড় ও জলােচ্ছাস হলে ২৪ নভেম্বর ভাসানী ন্যাপের জরুরী বর্ধিত সভা আহবান করা হয়। মওলানা
৬৬
ভাসানী এতে যােগদান করা থেকে বিরত থাকেন। তাঁর অনুপস্থিতিতে ভাসানী ন্যাপের যে ১৪ জন প্রার্থী জাতীয় পরিষদের এবং ২৫ জন প্রার্থী প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছিলেন, তাদের প্রতি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানাের নির্দেশ দেওয়া হয়। বস্তুত ভাসানী ন্যাপের একটি গ্রুপ অনেক আগে থেকেই নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিরােধিতা করে আসছিল। ঘূর্ণিঝড়ের ইস্যুতে তারা চরম রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করে এবং শেষ মুহূর্তে আংশিক সফলতা অর্জন করে। মস্কোপন্থী ন্যাপের কোনাে জনপ্রিয় নেতা ছিল না, মােজাফফর আহমদের জনগণের ওপর প্রকৃত পক্ষে কোনাে প্রভাব ছিল না। পূর্ব পাকিস্তানের বামপন্থী শক্তিগুলােও ছিল দ্বিধাবিভক্ত এবং কোনাে সুসংগঠিত ভিত্তি ছিল না তাদের। উপদলীয় কোন্দলে তারা দুর্বল হয়ে পড়েছিল। ভাসানী গ্রুপ মােহাম্মদ তােয়াহার নেতৃত্বে একটি উপদল বেরিয়ে যাওয়ার কারণে দুর্বল হয়ে পড়ে। তােয়াহা ছিলেন নির্বাচন পদ্ধতির বিরােধী। তিনি গ্রামীণ জনগণের মাঝে রাজনীতি সচেতনতা সৃষ্টি করতে বেশি বিশ্বাসী ছিলেন। অন্যান্য পিকিংপন্থী দলগুলাে ভাসানীর সাথে রয়ে যায়। মওলানা ভাসানীর অনেক কৃষক অনুসারী ছিল কিন্তু তােয়াহার পদত্যাগের পর ভাসানী ন্যাপ ক্রমাগত দুর্বল হয়ে পড়ে। আবদুল মতিনের নেতৃত্বেও উপদল ভারতের, বিশেষত পশ্চিম বাংলার নকশালীদের মতাে বিপ্লবী কৌশলের পক্ষপাতি ছিল।
ন্যাপ (ওয়ালী গ্রুপ)
১৯৫৪ সালে পাকিস্তানে কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ঘােষিত হয় এবং পরবর্তীসময় ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি কমিউনিস্ট আদর্শে গড়ে ওঠে। একসময় ন্যাপ দুটি ধারায় বিভক্ত হয়ে যায়। একটি মস্কোপন্থী ন্যাপ ও অন্যটি পিকিংপন্থী ন্যাপ । মস্কোপন্থী ন্যাপের নেতৃত্ব দেন খান আবদুল ওয়ালী খান এবং পূর্ব পাকিস্তানে নেতৃত্ব দেন অধ্যাপক মােজাফফর আহমদ। আওয়ামী লীগের মতাে ওয়ালী ন্যাপও নির্বাচনকে গুরুত্বের সাথে নেয়। এই দলের নেতারা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করতেন, তারা আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের ভিত্তিতে একটি ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করে। তারা প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের সমর্থন করে এবং দাবী করে যে প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক বিষয় ও মুদ্রা কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে থাকবে। তারা
৬৭
মনে করে পাকিস্তানের জনগণের মূল সংগ্রাম হওয়া উচিত সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ এবং একচেটিয়া পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে। অধ্যাপক মােজাফফর আহমদ ও অন্যান্য ন্যাপ ওয়ালীর নেতারা মনে করেন যে, আওয়ামী লীগের যে স্লোগান ‘জাগাে জাগাে বাঙালী জাগাে’ এটি দেশের জন্য ক্ষতিকর। কারণ এটি প্রদেশে বাঙালী পুঁজিবাদের উত্থান ঘটাবে। তাদের মতে স্লোগান হওয়া উচিত বাংলার কৃষক ও শ্রমিকরা জাগাে’। মওলানা ভাসানীর ইসলামিক সমাজতন্ত্রের সমালােচনা করে অধ্যাপক মােজাফফর আহমদ বলেন- “There is only one kind of socialism- it is scientific socialism. Any other kind of socialism is a hoax to the people.”
ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ওয়ালী গ্রুপ এর প্রধান খান আবদুল ওয়ালী খান ৬ নভেম্বর বেতার টেলিভিশন ভাষণে ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্রে মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা বিধান করে কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র ও নিম্নবিত্তের দাবী পূরণ করার কথা ঘােষণা করেন।
পাকিস্তান ডেমােক্রেটিক পার্টি
পাকিস্তান ডেমােক্রেটিক পার্টি গঠিত হয় ১৯৬৯ সালে। চারটি রাজনৈতিক দলের ছােট অংশ যথা নূরুল আমীনের ন্যাশনাল ডেমােক্রেটিক ফ্রন্ট, চৌধুরী মােহাম্মদ আলীর নেজাম ই ইসলাম, নবাবজাদা নসরুল্লাহ খানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের একটি অংশ, জাস্টিস পার্টির আসগর খান এরা ১৯৬৯ সালের ২৪ জুন যৌথ ঘােষণার মাধ্যমে নতুন দল গঠন করে। যাদের আটটি লক্ষ্য ছিল । পিডিপিও শুরু থেকেই নির্বাচনকে গুরুত্বের সাথে নেয়। এর সভাপতি নসরুল্লাহ খান মনে করেন যে ১২০ দিনের মধ্যে পরিষদের পক্ষে শাসনতন্ত্র রচনা করা অসম্ভব। পিডিপি সংসদীয় গণতন্ত্র, একটি শক্তিশালী কেন্দ্র ও ইসলামী আদর্শের কথা প্রচার করে। পিডিপি পূর্ব পাকিস্তান প্রধান নূরুল আমীন উল্লেখ করেন পাকিস্তানের সংবিধান অবশ্যই ইসলামের মূল নীতির ভিত্তিতে রচনা করতে হবে। তিনি সব ধরনের বিদেশি আদর্শের সমালােচনা করে বলেন, পাকিস্তানকে তার গৌরবােজ্জ্বল আদর্শ অনুযায়ী চলতে হবে। নূরুল আমীন শক্তিশালী কেন্দ্রের সাথে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের কথা বলেন। পিডিপি পাকিস্তানের উভয় অংশের মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্য দূর
৬৮
করতে চায়। পিডিপি আওয়ামী লীগের ছয়দফা ও বাঙালী জাতীয়তাবাদের সমালােচনা করেন। পিডিপির সহ-সভাপতি মাওলানা ফরিদ আহমেদ ঘােষণা করেন যে, ছয়দফা হচ্ছে পাকিস্তানকে ভাঙ্গার একটি ষড়যন্ত্র । পাকিস্তান | ডেমােক্রেটিক পার্টির প্রধান নুরুল আমীন ১০ নভেম্বর তার বেতার ও টেলিভিশন ভাষণে বলেন, মুখরােচক চোখ বাঁধানাে স্লোগান বা মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে নয়, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পাকিস্তানের সমস্যার সমাধান করা হবে। পিডিপির পূর্ব পাকিস্তানি নেতা মৌলবী ফরিদ আহমদ আইয়ুব খানকে প্রেসিডেন্ট পদ থেকে যেভাবে উৎখাত করা হয়েছে, ঠিক সেভাবে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবকেও পাকিস্তানের রাজনীতি থেকে উৎখাতের জন্য জনগণের প্রতি আহবান জানান। রাজনীতিতে জুলফিকার আলী ভুট্টোর উপস্থিতিও দেশের স্বার্থের পরিপন্থী বলে তিনি উল্লেখ করে বলেন, তাঁকেও জনগণের সহ্য করা উচিত নয়। মৌলবী ফরিদ আহমদ পশ্চিম পাকিস্তানে এক জনসভায় বক্তৃতাকালে বলেন, শেখ মুজিবের ৬ দফা পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে এবং একবার ৬ দফা বাস্তবায়িত হলে পূর্ব পাকিস্তান দ্বিতীয় ভিয়েতনামে পরিণত হবে। এর ফলে পশ্চিম পাকিস্তান ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে এবং সীমান্ত প্রদেশ পাখতুনিস্থান হিসেবে স্বাধীন হয়ে যাবে। সিন্ধু ও বেলুচিস্তানও স্বাধীন হয়ে যাবে। ফলে অসহায় ও একাকী পাঞ্জাব হয়ে পড়বে হরিয়ানা ও পূর্ব পাঞ্জাবের করুণার পাত্র।
ন্যাশনাল প্রগ্রেসিভ পার্টি
আতাউর রহমান খানের ন্যাশনাল প্রগ্রেসিভ পার্টি একটি ধর্মনিরপেক্ষ দল হলেও রাজনীতিতে এ দলের তেমন গুরুত্বপূর্ণ কোনাে প্রভাব ছিল না। আতাউর রহমান খানের মতে, দেশে পাঁচটি আঞ্চলিক জাতি রয়েছে যারা বাঙালী, সিন্ধু, পাঞ্জাবি, পাঠান ও বালুচ নামে পরিচিত। তিনি দাবী করেন ফেডারেল শাসনের আওতায় এগুলােকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দেওয়া উচিত। তিনি পরামর্শ দেন দেশকে পাকিস্তান ফেডারেল যুক্তরাষ্ট্র হিসেবে পরিণত করা এবং এর সংবিধান হওয়া উচিত ফেডারেল পদ্ধতির। প্রকৃতিগত দিক থেকে সাংবিধানিক এবং বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে ধর্মনিরপেক্ষ । তিনি বলেন, ইসলাম একটি ইহজাগতিক ধর্ম এবং দেশকে একটি আদর্শ রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তােলা
৬৯
উচিত। পাকিস্তানের শক্তিশালী কেন্দ্রের বিরােধিতা করে বলেন পাকিস্তানের ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়বে যদি আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনকে অবহেলা করা হয়। পাকিস্তানের সংবিধান লাহাের প্রস্তাব অনুযায়ী করা দরকার বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি সন্দেহ প্রকাশ করেন যে, যদি ১২০ দিনের মধ্যে সংবিধান তৈরি করা হয় তাহলে তা জগাখিচুড়ি হয়ে পড়বে। আদর্শগত দিক থেকে আওয়ামী লীগ ও ন্যাশনাল প্রগ্রেসিভ লীগের মধ্যে খুব সামান্য ব্যবধান। রয়েছে। একসময় আতাউর রহমান আওয়ামী লীগে ছিলেন এবং সে দলের নেতা হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন। তিনি সামাজিক অর্থনীতিতে বিশ্বাস করতেন এবং পূর্ব পাকিস্তানের স্থলে বাংলাদেশ রাখার কথা সমর্থন করেন। পরবর্তীসময় তিনি আওয়ামী লীগ ত্যাগ করেন এবং শেখ মুজিবের সমালােচনা করে তাঁকে একনায়ক হিসেবে উল্লেখ করেন। আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি আমেনা বেগম (পরবর্তীসময় ন্যাশনাল প্রগ্রেসিভ লীগে যােগ দেন।) আওয়ামী লীগ ছাড়ার কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন যে, ন্যাশনাল প্রগ্রেসিভ লীগ অনেক বেশি গণতান্ত্রিক এবং সমষ্টিগত নেতৃত্বে বিশ্বাসী কিন্তু আওয়ামী লীগ ব্যক্তিকেন্দ্রিক এবং এখানে কোনাে গণতন্ত্র নেই। পরবর্তীকালে দেখা যায় আতাউর রহমানে খানের একনায়কতান্ত্রিক আচরণের কারণে দলটি অলি আহাদের নেতৃত্বে আরেকটি ভাগে বিভক্ত হয়।
মুসলিম লীগ
পাকিস্তানে অনেকগুলাে ইসলামিক দল বিদ্যমান থাকলেও তাদের মধ্যে কোনাে ঐক্য ছিল না। তারা পূর্ব পাকিস্তানে সামাজিক ন্যায়বিচারের কথা বললেও আওয়ামী লীগের ছয়দফা বিরােধী ছিল। তারা মনে করত ছয়দফা। পাকিস্তানের সংহতিকে নষ্ট করবে। তারা জাতীয় সংহতি ও ইসলামিক আদর্শের কথা বলতে থাকে। তারা মনে করতাে দেশের অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান করা যাবে ইসলামিক নীতি অনুসারে। মুসলিম লীগের তিনটি ধারা ছিল কনভেনশন মুসলিম লীগ, কাউন্সিল মুসলিম লীগ এবং কাইয়ুমপন্থী মুসলিম লীগ । তিনটি ধারাই নিজেদের পাকিস্তান মুসলিম লীগের অংশ বলে মনে করত। নির্বাচনের পূর্বে এ তিনটি ধারা একত্রিত হয়ে একটি জোট গঠন করতে চেয়েছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের এ চেষ্টা ব্যর্থ হয়।
৭০
ক. কনভেনশন মুসলিম লীগ
প্রতিষ্ঠাকালীন কনভেনশন মুসলিম লীগের প্রধান ছিলেন আইয়ুব খান। ১৯৬৯ সালে পূর্ব পাকিস্তানের গণঅভ্যুত্থানের মুখে আইয়ুব খানের পতন হয় । তাঁর পতন ও রাজনীতি থেকে পদত্যাগের পর চট্টগ্রামের ফজলুল কাদের চৌধুরী এই দলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হন। তিনি নির্বাচনী প্রচারাভিযানে বলেন, যদি জনগণ তাদের ভােট দিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার সুযােগ করে দেয় তাহলে তারা জনগণের চাহিদা পূরণ করবে। তিনি বলেন, ব্যাংক বীমা সহ। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলাে ঢাকায় স্থানান্তর করা হবে এবং সশস্ত্র বাহিনীতে ৫০ শতাংশ লােক পূর্ব পাকিস্তান থেকে নিয়ােগ দেওয়া হবে। ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে ফজলুল কাদের চৌধুরী বলেন, তাঁর দল পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে চায়। আর এজন্য নৌ বাহিনীর সদর দপ্তর প্রদেশে স্থানান্তর করা হবে। ফজলুল কাদের চৌধুরীর একথার প্রেক্ষিতে দৈনিক সংবাদ সম্পাদকীয় নিবন্ধে লিখে যে, ফজলুল কাদের চৌধুরী কী ভুলে গেছেন কিছুদিন আগে তাদের কনভেনশন মুসলিম লীগের প্রধান আইয়ুব খানের ১১ বছরের দুঃশাসনের কথা?’ ফজলুল কাদের চৌধুরী পরিষ্কার ভাবে জানান যে, তাঁর দল প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের পক্ষপাতি এবং শক্তিশালী কেন্দ্রের পক্ষে । চট্টগ্রামের এক জনসভায় তিনি হুমকি দিয়ে যারা জয় বাংলা শ্লোগান তুলে তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘােষণার কথা বলেন। তিনি জনগণকে দুইটি বিষয় থেকে সাবধান থাকার জন্য বলেন, একটি হচ্ছে বাইরে থেকে আগত কমিউনিস্ট ও ন্যাপের প্রভাব এবং যারা ভারতীয়দের সাহায্যে বাঙালী জাতীয়তাবাদের প্রপাগান্ডা করে ।
খ. কাউন্সিল মুসলিম লীগ
কাউন্সিল মুসলিম লীগের প্রধান মিয়া মমতাজ দৌলতানা ১৯৬৬ সালের জুলাই মাসে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্য দূরীকরণে সাত দফা দাবী উত্থাপন করেন। এই সাত দফার অনেক দাবী বাঙালীদের কাছে পরিচিত ছিল যার কারণে জনগণের মাঝে বড় ধরনের কোনাে প্রভাব ফেলতে পারেনি। তাদের দুই অর্থনীতি আওয়ামী লীগের দ্বারা সমর্থিত হয়নি। আওয়ামী লীগ জনগণের মাঝে খুব জনপ্রিয়তা অর্জন করে তাঁর বাঙালী জাতীয়তাবাদ কথা দ্বারা যা কাউন্সিল মুসলিম লীগ করতে পারেনি। নির্বাচনের সময় অন্যান্য ইসলামিক
৭১
দলগুলাের মতাে কাউন্সিল মুসলিম লীগ পাকিস্তানের জন্য শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকারের দাবী জানায়। তারা আওয়ামী লীগের সমালােচনায় মুখর হয়ে ওঠে। পেশশায়ারে এক বক্তৃতায় দৌলতানা বলেন, যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের কাঠামাের ভিতরে পূর্ব পাকিস্তানের দুঃখ দূর করা হবে এবং পাকিস্তানের সংহতিকে টিকিয়ে রাখা হবে। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের ছয় দফা দাবীর মাধ্যমে দেশের সংহতি নষ্ট হবে। পাকিস্তান রাষ্ট্রের সমাজতন্ত্রের সমালােচনা করে তিনি বলেন – .. country was not in need of any foreign ‘ism’ and those who propagated ideologies other than Islam were an enimies of Pakistan. Pakistan would become an Islamic Welfare State in which the rights of the workers, peasants and others would be safe-guarded according to the Islamic principles. দৌলতানা অন্যান্য ইসলামিক দলগুলাের মতাে ভারতকে পাকিস্তানের বড় শত্রু বলে মনে করেন।
গ. কাইয়ুমপন্থী মুসলিম লীগ
কাইয়ুমপন্থী মুসলিম লীগের প্রধান কাইয়ুম খান ইসলামিক আদর্শের অনুসারী ছিলেন এবং বিশ্বাস করতেন যে শক্তিশালী কেন্দ্রের মাধ্যমে জাতীয় সংহতি ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব। তিনি মনে করেন প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক বিষয়, আন্তঃপ্রাদেশিক ও আন্তর্জাতিক ব্যবসা বাণিজ্য, মুদ্রা ব্যবস্থা সহ প্রদেশের রাজস্ব আদায়ের ক্ষমতা কেন্দ্রের হাতে থাকবে। পূর্ব পাকিস্তানের খুলনাতে এক জনসভায় কাইয়ুম খান বলেন, শেখ মুজিবুর রহমান, লাল শার্টের নেতা খান আবদুল গাফফার খান, ন্যাপ ওয়ালীর নেতা ওয়ালী খান এবং সিন্ধুর জি.এম সাঈদ পাকিস্তানের স্বাধীনতাকে নষ্ট করার জন্য চক্রান্ত করছে। তিনি পাকিস্তানের সংহতি ও আদর্শ রক্ষায় বিশ্বাসের জন্য ভাসানী, মওদুদী, ভুট্টো ও নসরুল্লাহ খানের প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, শেখ মুজিব, ওয়ালী খান এবং জি.এম সাঈদ ভারতীয়দের সহায়তায় পাকিস্তানকে অকার্যকর রাষ্ট্র হিসেবে পরিণত করার খেলায় লিপ্ত । তিনি সন্দেহ পােষণ করেন যে, কাউন্সিল মুসলিম লীগ এবং ওয়ালী ন্যাপের মধ্যে গােপন বােঝাপড়া তৈরি হয়েছে। তিনি মনে করেন ভারত পাকিস্তানের এক নম্বর শত্রু এবং সব লােক তা মনে করে। তিনি অভিযােগ করেন ভারত পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করে
৭২
দেশের ভেতরে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করছে। ইসলামি ব্যবস্থার পক্ষপাতিত্ব করে তিনি বলেন, “আমি পুঁজিবাদ, সমাজতন্ত্রের বিরােধী এবং আমার দল কৃষক, শ্রমিক ও সমাজের দরিদ্র জনগণের জন্য ইসলামের মূলনীতি অনুযায়ী ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবে। খুলনার খান আবদুস সবুর খান কাইয়ুম মুসলিম লীগে যােগ দেন। যােগ দেওয়ার পর সবুর খান তীব্রভাবে আওয়ামী লীগের সমালােচনা করে বলেন, যদি আওয়ামী লীগের ছয়দফা পাকিস্তানের জনগণের কল্যাণে করা হয় তাহলে ভারতীয় বেতার কেন এর সমর্থন করছে? জাতির উদ্দেশ্যে বেতার টেলিভিশন নির্বাচনী ভাষণে কাইয়ুম খান বলেন, তাঁর দল পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও অন্যান্য জাতীয় বিষয়ের ব্যাপারে স্বার্থ রক্ষা করবে এবং তাঁর দল শক্তিশালী কেন্দ্রের বিপরীতে অধিকাংশ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করবে।
পাকিস্তান পিপলস পার্টি
পাকিস্তান পিপলস পার্টির জুলফিকার আলী ভুট্টো ইসলামিক সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করতেন। ভুট্টোর সমাজতন্ত্রের সাথে দেশের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের কোনাে সম্পর্ক নেই। সত্যিকার অর্থে পূর্ব পাকিস্তানে এ দলের কোনাে অস্তিত্ব ছিল না। পিপিপি’র পূর্ব পাকিস্তান শাখার সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদীন পিপিপি ছেড়ে কৃষক সমিতি দলে যােগদান করেন। পিপিপি পূর্ব পাকিস্তান শাখার চেয়ারম্যান মাওলানা নুরুজ্জামান ভুট্টোর দলের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেন এবং নিজে আলাদা পিপলস পার্টি গড়ে তােলেন। তিনি এক বিবৃতিতে বলেন, তাঁর দল পূর্ণ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে এবং পাকিস্তানের আইন পরিষদ হবে এককক্ষ বিশিষ্ট। তিনি ছাত্রদের এগারাে দফাকে সমর্থন জানান এবং বলেন যে ইসলাম হবে পাকিস্তানের সমাজ কাঠামাের মূল ভিত্তি। তিনি বলেন, ভুট্টোর দল এসব দাবী শর্তহীন ভাবে মেনে নিবে না এবং সত্যিকার অর্থে গ্রহণ করবে না। পিপলস পার্টির প্রধান ভুট্টো শেখ মুজিবের বাঙালী জাতীয়তাবাদের কঠোর সমালােচনা করেন। কিন্তু ভুট্টোর জন্য তেমন কোনাে সহজ পথ ছিল না। কারণ পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালীরা ছিল সমভাবাপন্ন, তারা পশ্চিম পাকিস্তানিদের আর বিশ্বাস করতে পারছিল না। অপরদিকে পশ্চিম পাকিস্তানে বিদ্যমান ছিল উপআঞ্চলিকতাবাদ । ভুট্টো তার নির্বাচনী প্রচারণা কার্য চালাতে গিয়ে পশ্চিম
৭৩
পাকিস্তানে কয়েকটি সমস্যা অনুভব করেন। যেমন- এক ইউনিট ব্যবস্থা পাঞ্জাবিদের নিকট জনপ্রিয় হলেও পশ্চিম পাকিস্তানের যেসব ছােট ছােট প্রদেশ ছিল তারা এক ইউনিট ব্যবস্থা মানতে পারেনি। ভুট্টো পাঞ্জাবে যেভাবে বক্তৃতা প্রচারণা চালাতে পারতেন সে হারে বেলুচিস্তান বা উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এমনকি নিজ নির্বাচনী এলাকা সিন্ধুতেও ভালাে বক্তৃতা দিতে বা জনগণের মাঝে তেমন আবেদন সৃষ্টি করতে পারেননি। পশ্চিম পাকিস্তানের বড় বড় জোতদাররা তখন পর্যন্ত ছিল প্রেসার গ্রুপ যাদের সমর্থন তখনও ভুট্টো আদায় করতে পারেনি। এসব সমস্যা সত্ত্বেও ভুট্টো নির্বাচনী প্রচার কার্য চালিয়ে যান। ভুট্টোর প্রধান স্লোগান ছিল ‘ইসলাম হচ্ছে আমাদের বিশ্বাস, গণতন্ত্র হচ্ছে আমাদের নীতি এবং সমাজতন্ত্র হচ্ছে আমাদের অর্থনীতি’ তাঁর দলের ঘােষণাপত্রে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মৌলিক পরিবর্তনের, পুঁজিবাদের মুলােৎপাটন এবং ইসলামী সমাজতন্ত্রের অঙ্গীকার করেন। এছাড়া ভুট্টো শেখ মুজিবের ছয়দফার কঠোর সমালােচনা করেন। ভুট্টো পূর্ব পাকিস্তানে কোনাে নির্বাচনী সভা, বক্তৃতা করেননি এমনকি পূর্ব পাকিস্তানে ভােট আদায়ের জন্য তেমন কোনাে প্রচারণা কার্যে অংশ নেননি। তাঁর সব আগ্রহ ছিল পশ্চিম পাকিস্তানকে কেন্দ্র করে। তার এ কৌশলকে জি ডব্লিউ চৌধুরী মন্তব্য করেছেন যে, ভুট্টো পাকিস্তানের ঐক্যের চেয়ে ক্ষমতার রাজনীতিতে বেশি আগ্রহী ছিলেন।
প্রথম দিকে পূর্ব পাকিস্তানের চেয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের ডানপন্থী দলগুলাের অবস্থা ভালাে ছিল। মধ্যপন্থীদল যেমন কাউন্সিল মুসলিম লীগ, পিডিপি এসব দলের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযােজ্য। কিন্তু এসব দলের বয়স্ক নেতারা ছিলেন পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পূর্বেকার মানুষ যদিও ১৯৭০ সালের নির্বাচনের অধিকাংশ ভােটারের জন্ম পাকিস্তান রাষ্ট্রে। তাই এসব বয়স্ক নেতৃবৃন্দ নির্বাচনী অঙ্গীকার হিসেবে যেসব কথা প্রচার করেন যেমন ইসলামী আদর্শ, কেন্দ্রীয় সরকার এসব তরুণ ভােটারদের মন আকৃষ্ট করতে পারেনি। এদিক থেকে ভুট্টোর কর্মসূচি ও নীতি ছিল অনেক বেশি সফল। নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানে শেখ মুজিবের সফলতার চেয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের ভুট্টোর সফলতা ছিল কম, কিন্তু অধিকতর প্রচণ্ড শক্তিসমূহ, পাকিস্তানের জটিল সমস্যাসমূহ এবং উপ আঞ্চলিকতাবাদ ও ভাষাগত উত্তেজনা যা তাকে মােকাবেলা করতে হয়েছে সেদিক থেকে বিচার করলে ভুট্টোর সফলতাও ছিল উল্লেখযােগ্য।
৭৪
মূলত পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৭০ সালের নির্বাচনী অভিযান ছিল মাত্র এক ব্যক্তির প্রদর্শনী বিশেষ । ১৯৪৫-৪৬ সালে ভারতের মুসলমানদেরকে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে বলে দেওয়া হয়েছিল যে, যদি তারা ল্যাম্পপােস্টকেও মনােনয়ন দেয় তাহলে তাকে যেন ভােট দেওয়া হয় । আগের বেলায় এ নির্দেশ আসে কায়েদ ই আজমের কাছ থেকে, পরবর্তীসময় এ নির্দেশ আসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কাছ থেকে। শেখ মুজিবের নিজের নির্বাচনী আবেদনের সাথে ছিল একটি আবেদনময়ী পােস্টার যার শিরােনাম ছিল সােনার বাংলা শশ্মান কেন? অবশ্য কোনাে কোনাে মহল আওয়ামী লীগের কার্যকারিতাকে তেমন আমল দেয়নি। যেমন রাজশাহীর একজন ধনী ও প্রভাবশালী কনভেনশন মুসলিম লীগ প্রার্থীর বিশ্বাস ছিল যদি তিন মুসলিম লীগ ও জামায়াতে ইসলামির মতাে ডানপন্থী দলগুলাে তাকে সমর্থন দেয় তাহলে আওয়ামী লীগ, পিডিপি, ন্যাপ ভাসানী ও ন্যাপ ওয়ালীর মধ্যে বিরােধীদলীয় ভােট ভাগাভাগির ফাঁকে তিনি সুনিশ্চিতভাবেই নির্বাচনে জয়ী হবেন। ঐ একই জেলায় নির্বাচনী প্রচারাভিযান চলাকালে অনেকের মনে এ ধারণা জন্মে যে, শেখ মুজিবের জনপ্রিয়তার ভাটার টান পড়েছে কেননা তিনি সব গণতান্ত্রিক শক্তিগুলােকে একত্রিত করার মতাে দুরদর্শিতা দেখাতে পারেননি। আরাে মনে করা হয় জয় বাংলা স্লোগান জনপ্রিয় হয়নি।
নির্বাচনী স্লোগান
১৯৭০ সালের নির্বাচনেও কিছু স্লোগান লক্ষ্য করা যায়। স্লোগানগুলাে দ্বারা একদিকে যেমন নিজ দলের প্রার্থীদের গুণকীর্তণ করা হতাে অন্যদিকে প্রতিদ্বন্দ্বিদেরও সমালােচনা করা হতাে। নির্বাচন এগিয়ে আসার সাথে সাথে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন দল ও প্রার্থীর স্লোগান জমে উঠেছিল। রাজনৈতিক দলগুলাের পরিচিত স্লোগানগুলাের পাশাপাশি নির্বাচনের সময় প্রার্থীদের নিয়ে ও তাদের নির্বাচনী প্রতীক নিয়ে অনেক নতুন স্লোগান তৈরি হয়। আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামি কিংবা ন্যাপের মতাে যেসব রাজনৈতিক দলের কোনাে পেটেন্ট স্লোগান নেই তাদের সমর্থকেরাও নির্বাচন এগিয়ে আসার সাথে সাথে পেটেন্ট জাতীয় স্লোগান তৈরি করেছে। এক শ্লোগানের জবাবে তৈরি হতাে পাল্টা স্লোগান। এসব স্লোগানের মাধ্যমে নির্বাচনী প্রতীকের নতুন
৭৫
নতুন তাৎপর্য আবিষ্কার করা হতাে। ঢাকার নির্বাচনী এলাকাগুলােতে যেসব স্লোগান লক্ষ্য করা যায়-
১. হারিকেনে তেল নাই, নৌকা ছাড়া উপায় নাই।
২. নৌকা ডুবিল হায় হায় করিল; আলাে যদি পেতে চাও হারিকেনে ভােট দাও।
৩. নৌকাতে বৈঠা আছে, বঙ্গবন্ধুর ভােট আছে।
৪. নৌকা যাইবে ভাইস্যা, ভােট দেন ঠাইস্যা।
৫. নৌকাতে দিলে ভােট, তা পাবে দেশের লােক।
৬. পদ্মা-মেঘনা-মধুমতি, নৌকা ছাড়া নাইকো গতি ।
৭. নৌকার মাঝি মুজিব ভাই, আপনাদের কাছে দোয়া চাই।
৮. আওয়ামী লীগে দিয়া ভােট, বীর বাঙালী বাধো জোট।
৯. স্বাধীনতার শপথ নিন, নৌকা মার্কায় ভােট দিন ।
১০. গাছের আগায় পক্ষী, মুজিব ভাই লক্ষ্মী।
এছাড়া আওয়ামী লীগের কিছু পরিচিত স্লোগান ছিল-
১. জয় বাংলা।
২. তােমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা।
৩. জাগাে জাগাে বাঙালী জাগাে।
৪. জেগেছে জেগেছে বাঙালী জেগেছে।
কাউন্সিল মুসলিম লীগের কিছু স্লোগান ছিল । যথা-
১. নৌকাতে বৈঠা নাই, বঙ্গবন্ধুর উপায় নাই ।
২. শেখ মুজিবের ভাঙ্গা নাও, গাব দাও মাটি দাও।
৩. নৌকা ডুবিল হায় হায় করিল।
৪. আলাে যদি পেতে চাও, হারিকেনে ভােট দাও ।
৫. ফরিদপুর না ঢাকা- ঢাকা ঢাকা।
৬. নিজের পথ বেছে নাও, ঢাকাবাসী এক হও।
আওয়ামী লীগের কর্মীরা সব দলের বিরুদ্ধেই ছড়া আকারে শ্লোগান দেয়। সদরঘাট ও স্টেডিয়াম এলাকায় ছয়দফা ব্যাজ ও নৌকার প্রতীক বিক্রিকারী
৭৬
কয়েক ব্যক্তি আবার সব দলকে ঘায়েল করে স্লোগান দেয়। এসব স্লোগানের। মাধ্যমে তারা তাদের জিনিস ফেরী করার চেষ্টা করছে। তারা যেসব স্লোগান দেয়-
১. ভােট দিলে পাল্লায়, দেশ যাবে গােল্লায়।
২. কুঁড়ে ঘরে চাল নাই, মােজাফফরের ভােট নাই।
৩. সাইকেলের পাম্প নাই, কনভেনশনের ভােট নাই।
৪. ছাতা হলাে ফুটা, পিডিপিরা হলাে ঝুটা।
৫. হারিকেনে তেল নাই, দালালদের ভােট নাই।
৬. নৌকাতে বৈঠা আছে, বঙ্গবন্ধুর ভােট আছে।
জামায়াতে ইসলামির বিরুদ্ধে রমনা-মিরপুর-মােহাম্মদপুর এলাকায় আওয়ামী লীগ কর্মীরা স্লোগান দেয়-
দাঁড়িপাল্লার পইরন নাই, জামাতীদের ভােট নাই ।
তাদেরকে চিনেন কি কথায় কথায় বুজুরকী ।
হাতে ছুরি মিঠা জবান বাঙালীরা সাবধান।
ঢাকার মিরপুর ও মােহাম্মদপুর এলাকায় জামায়াতে ইসলামির কিছু স্লোগান। লক্ষ্য করা যায়-
১. যা করে আল্লায় ভােট দিব পাল্লায়।
২. দাঁড়িপাল্লা মার্কায় ভােট দিলে ইনসাফ হবে তিলে তিলে ।
৩. হাদিসকো কোরআনকো ভােট দো মজিানকো।
৪. কায়েম করাে ইসলামকো ভােট দো মীজানকো।
৫. দাঁড়িপাল্লা হাতে নিয়ে পাওনা গণ্ডা নিন ছিনিয়ে ।
৬. অধিকার আদায়ের শপথ নিন, দাঁড়িপাল্লায় ভােট দিন ।
এছাড়া জামায়াতে ইসলামির কিছু পেটেন্ট শ্লোগান ছিল-
১. পাকিস্তানের উৎস কি লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ।
২. আমার নেতা তােমার নেতা বিশ্বনবী মােস্তফা।
৩. ইসলামী মুক্তির একই পথ ইসলামী বিপ্লব।
৭৭
খিলগাঁও এলাকায় জামায়াত কর্মীরা তাদের মিছিলে যেসব স্লোগান দেয়-
হুজুগে বাঙাল হবেন না লোভের কাঙ্গাল হবেন না।
দীনের দাবী ভুলবেন না ন্যায়ের পথে পা দিন।
দাঁড়িপাল্লায় ভােট দিন।
এগুলাে ছাড়াও জামায়াতে ইসলামির কর্মীরা জায়গায় জায়গায় আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে স্লোগান দেয়। যেমন-
নৌকা উঠছে গাছের আগায়
আওয়ামী লীগ হায় হায় ।
পাকিস্তান ন্যাশনাল লীগের ইকবাল আনসারীদের একটি স্লোগান ছিল-
দেশবাসীর মঙ্গলে ভােট দেবেন লাঙ্গলে ।
ওয়ালী ন্যাপের স্লোগান ছিল
১. তােমার ঘর আমার ঘর কুঁড়েঘর কুঁড়েঘর ।
২. কুঁড়েঘরে থাকে কারা কৃষক শ্রমিক সর্বহারা ।
৩. দিকে দিকে একি শুনি কুঁড়েঘরের জয়ধ্বনি।
৪. কৃষক শ্রমিক এক জোট, কুঁড়ে ঘরে দিব ভােট।
ওয়ালী ন্যাপের পেটেন্ট স্লোগান ছিল-
জয় বাংলার জবাবে জয় সর্বহারা।
তােমার আমার ঠিকানা ক্ষেত খামার কারখানা।
মিছিলের স্লোগান ছাড়াও এসময় দেয়ালে ও কাগজের যে পােস্টার ছিল তাতে লেখা ছিল অনেক স্লোগান। যেমন-
১. জয় বাংলার গােপন কথা আকাশ বাণী কলকাতা।
২. হালত খারাপ জয় বাংলা।
৩. ফরিদপুরে ভাত নাই ঢাকা এসে বাহাদুরী।
৪. জয় বাংলা জয় হিন্দ লুঙ্গি ছেড়ে ধুতি পিন্দ।
৫. যদি চাও মঙ্গল কষে ধরাে লাঙ্গল।
৬. মাটির সাথে চুকতি লাঙ্গল দেবে মুকতি।
৭. গােলাম আজমকে ভােট দিন।
৭৮
৮. আমার স্থান তােমার স্থান পাকিস্তান পাকিস্তান।
৯. ন্যায়ের পথ বেছে নিন গােলাম আজমকে ভােট দিন।
১০. জাগাে জাগাে মুসলিম জাগাে।
১১. ৬ দফা ১১ দফা কায়েম করাে।
১২. নৌকা মার্কায় ভােট দিন।
১৩. তােমার নেতা আমার নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ।
১৪. শেখ মুজিবের উকতি পূর্ব বাংলার মুকতি।
১৫. নৌকায় উড়েছে পাল বঙ্গবন্ধুর হাতে হাল।
১৬. বাংলার মীরজাফর সাবধান সাবধান।
১৭. আমার টাকা ফিরিয়ে দাও নিজের সম্পদ নিজেই ভােগ করতে চাই।
১৮, জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতা খর্ব করা চলবে না।
১৯. লাহাের প্রস্তাবের ভিত্তিতে স্বায়ত্তশাসন চাই।
২০. পাল্লা কো তােড় দো হাতী কো ভােট দো।
পূর্ব পাকিস্তানের মতাে পশ্চিম পাকিস্তানেও এসময় নির্বাচনী স্লোগান দেখা যায়। বিশেষ করে পশ্চিম পাকিস্তানের পাঞ্জাব নির্বাচন উপলক্ষে উৎসব মুখর হয়ে ওঠে। পিপলস পার্টির যেসব স্লোগান লক্ষ্য করা যায়
১. ভুট্টো জিয়ে হাজার সাল।
২. সাডা ভুট্টো আওয়েই আওয়ে (আমাদের ভুট্টো আসবেই আসবে)।
৩. লালটান (লণ্ঠন) কো তােড় দো, তলােয়ারকে ভােট দো, চামচাগিরি (দালালগিরি) ছােড় দো।
পিডিপির স্লোগান ছিল-
১. মারেঙ্গে, মারজায়েঙ্গে মেজর কো কামিয়াব বানায়াঙ্গে।
২. মাহফুজে লাহােরকো ভােট পায়েঙ্গে।

Reference: ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন বাংলাদেশের অভ্যুদয় – মোশারফ হোসেন