You dont have javascript enabled! Please enable it!

নির্বাচনের প্রস্তুতি
১৯৬৯ সালের ২৬ নভেম্বর জেনারেল ইয়াহিয়া খান ঘােষণা করেন যে, যত শীঘ্র সম্ভব প্রাপ্তবয়স্কদের প্রত্যক্ষ ভােটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে। এই নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাজ হবে দেশকে একটি ব্যবহারযােগ্য শাসনতন্ত্র দেওয়া এবং যেসব রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যা জনমনকে আলােড়িত করেছে তার সমাধান বের করা। সেদিক থেকে ইয়াহিয়া খানের প্রত্যক্ষ ভােটের মাধ্যমে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ঘােষণা ছিল প্রথমবারের মতাে বাঙালীদেরকে এক ব্যক্তি এক ভােট এর ভিত্তিতে প্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে ন্যায্য অংশ প্রদানের প্রতিশ্রুতি। যা পাকিস্তানের রাজনীতিতে এক বৈপ্লবিক ঘটনা। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান তাঁর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের জন্য অর্থাৎ একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্বাচন ব্যবস্থাপনার আওতায় কিছু পদক্ষেপ নেন। এক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন নিয়ােগ থেকে শুরু করে নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশ পর্যন্ত সব বিষয় নির্বাচনের প্রস্তুতির অন্তর্ভুক্ত।
জেনারেল ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের শাসনভার গ্রহণের পর শীঘ্র নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তরের ঘােষণা দিলে পাকিস্তানের জনগণ তা সন্তুষ্ট চিত্তে গ্রহণ করে। প্রেসিডেন্টের আইনগত কাঠামাে আদেশ ঘােষণায় পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলাে এ ভেবে খুশি হয় যে দীর্ঘদিন পর পাকিস্তানে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। যার মধ্য দিয়ে সামরিক শাসনের অবসান ঘটবে এবং জনসাধারণের প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু সেপ্টেম্বর মাসে পূর্ব পাকিস্তানের কিছু এলাকায় প্রবল বন্যা হয়। বন্যার জন্য ভােটারদের ভােট দানে অসুবিধার কথা উল্লেখ করে কিছু রাজনৈতিক দল নির্বাচন পেছানাের দাবী জানায়।
২৭
ইয়াহিয়া খান প্রথমদিকে এতে সাড়া না দিলেও পরবর্তীসময় জনগণের ভােটদানের কথা বিবেচনা করে নির্বাচনের নতুন তারিখ ঘােষণা করেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ঘােষণা অনুযায়ী ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর জাতীয় পরিষদের এবং ১৭ ডিসেম্বর প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনের তারিখ নির্দিষ্ট হয়। নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে ইয়াহিয়া খান যে কৌশল অবলম্বন করেন তা বাহ্যিক দৃষ্টিতে দেখলে মনে হবে তিনি রাজনৈতিক দল এবং জনগণের মতামতকে প্রাধান্য দিয়েছেন। কিন্তু এর পেছনে ইয়াহিয়া খান ডানপন্থী দলগুলাের প্রতি সমর্থন দানের কৌশল গ্রহণ করেছিলেন। কেননা ইয়াহিয়া খানের বিশেষ গােয়েন্দা রিপাের্ট অনুযায়ী পাকিস্তানে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার মতাে কোনাে রাজনৈতিক দল ছিল না। নির্বাচনে জয়ী হতে পারে ডানপন্থী ইসলামী দলগুলাে। যার কারণে সামরিক সরকার ডানপন্থী দলগুলােকে সবসময় সমর্থন ও সহযােগিতা করেছে, এমনকি কখনও আর্থিক সহায়তা প্রদান করেছে। কয়েকটি ডানপন্থী রাজনৈতিক দল একত্রে কোয়ালিশন সরকার গঠন করলেও তাদের প্রধান হিসেবে ইয়াহিয়া খান নিজের ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখার স্বপ্ন দেখেছিলেন। নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ায় বিশেষ করে বাম ও ডানপন্থী দলগুলাে খুশি হয়। তারা মনে করে নির্বাচন পিছিয়ে যাওয়ায় তারা লাভবান হবে। নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ায় অনেক রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ প্রেসিডেন্টকে অভিনন্দন জানিয়ে তাদের মতামত প্রকাশ করে। তবে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান প্রেসিডেন্টের এরকম সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে বলেছেন, নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ায় আওয়ামী লীগের অবস্থার কোনাে পরিবর্তন ঘটবে না। তিনি ঘােষণা করেছেন তাঁর দল নির্বাচন বানচাল করার যে কোনাে প্রচেষ্টাকেই প্রতিহত করবে। বন্যার প্রেক্ষিতে নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার দাবীদারদের সমালােচনা করে বলেন, এর দ্বারা তারা বন্যার্তদের কোনাে উপকারই করেননি। নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার অন্যতম দাবীদার একজন নেতা এখন মস্কো সফর করে বেড়াচ্ছেন বলেও তিনি উল্লেখ করেন। নির্বাচনের নতুন তারিখ ঘােষণা করা হলেও কিছু রাজনৈতিক দল আরও পেছানাের জন্য দাবী জানায়। কিন্তু এভাবে নির্বাচন পেছাতে থাকলে কতটুকু কার্যকরী হবে তা তাদের ভাবনার মধ্যে ছিল না। তারা জাতীয় স্বার্থ অপেক্ষা স্বীয় স্বার্থ রক্ষায় বেশি তৎপর হয়ে পড়েন। নতুন নির্বাচনের তারিখ ঘােষণার পর যখন সকল রাজনৈতিক দল তাদের নির্বাচনী
২৮
প্রচারণা কাজে পুরােপুরি মগ্ন তখন ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের দক্ষিণ বাংলার উপর দিয়ে বয়ে যায় এক ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ও জলােচ্ছ্বাস। এতে আনুমানিক প্রায় দশ লক্ষ লােকের প্রাণহানি ঘটে। ঘূর্ণিঝড় ও জলােচ্ছ্বাসের পর আবারাে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলাে নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার দাবী জানাতে থাকে। একমাত্র আওয়ামী লীগ ব্যতীত অন্য সব দল এর পক্ষে ছিল। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান শেষ পর্যন্ত দুর্গত এলাকার জন্য নতুন নির্বাচনের তারিখ ঘােষণা করে জাতীয় ও প্রাদেশিক নির্বাচনের পূর্বের তারিখ বহাল রাখেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান উপলদ্ধি করতে পেরেছিলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের এরকম দুর্যোগময় মুহূর্তে কেন্দ্রীয় সরকারের যে পরিমাণ সাহায্য সহযােগিতা করার প্রয়ােজন ছিল তা তারা করতে পারেনি। এখন যদি আবার এই দুর্যোগের অজুহাতে নির্বাচন পেছানাে হয় তাহলে জন অসন্তোষ সৃষ্টি হওয়া অমূলক নয়। কারণ ইয়াহিয়া খানের পূর্বসুরী এই জন অসন্তোষের মধ্য দিয়েই রাজনীতি থেকে সরে গিয়েছেন। পূর্বসরীর পথ ধরে তিনিও যদি সেই পথে হাঁটেন তাহলে তাঁর যে গােপন ইচ্ছা তা বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্থ হবে। তবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সাথে পরামর্শ করে পশ্চিম পাকিস্তানের উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও বেলুচিস্তানের কিছু নির্বাচনী এলাকায় জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদসমূহের নির্বাচন অক্টোবর মাসে অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত বহাল রাখেন। যা সরকারি প্রেসনােট থেকে জানা যায় । আইনগত কাঠামাে আদেশ সংশােধন করে বলা হয় ডিসেম্বর মাসে খারাপ আবহাওয়া ও বিভিন্ন এলাকার অধিবাসীদের বাসস্থান পরিবর্তনের ফলে উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও বেলুচিস্তানের যে সব নির্বাচনী এলাকা নির্বাচন অনুষ্ঠানের অনুপযােগী বলে বিবেচিত হবে সে সব এলাকায় ১৯৭০ সালের ৩১ অক্টোবরের পূর্বে নির্বাচন সম্পন্ন করার জন্য প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এ ঘােষণায় আরাে বলা হয় নির্বাচন অক্টোবর মাসে অনুষ্ঠিত হলেও ভােট গণনা ও তার ফলাফল মূল নির্বাচনের সঙ্গে একযােগে ডিসেম্বর মাসে ঘােষণা করা হবে। কিন্তু পরবর্তীসময় এ সিদ্ধান্তও বাতিল করা হয়। নির্বাচন কমিশনার জানায় যে, পূর্ববর্তী ঘােষণা অনুযায়ী ডিসেম্বর মাসে সারাদেশে একসাথে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এ সিদ্ধান্ত বাতিল করার পেছনে কারণ হিসেবে জানা যায় যে, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও বেলুচিস্তানের কোনাে কোনাে এলাকায় অক্টোবরে
২৯
নির্বাচন একটি বিতর্কমূলক রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। কোনাে কোনাে রাজনৈতিক দল এ সিদ্ধান্তকে অভিনন্দন জানালেও কিছু দল এর তীব্র সমালােচনা করে।
একটি গণতান্ত্রিক দেশের নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য একটি স্বাধীন নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন জরুরী প্রয়ােজন। নির্বাচন কমিশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পূর্বে ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি কীভাবে একটি সুষ্ঠু অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করা যায় তার সামগ্রিক অবস্থা তত্ত্বাবধান করেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান তাঁর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য প্রথমেই একটি নির্বাচন কমিশন গঠন করেন। ১৯৬৯ সালের ২ জুলাই ইয়াহিয়া খানের ঘােষণা অনুযায়ী পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টের বাঙালী বিচারপতি আব্দুস সাত্তারের নেতৃত্বে একটি নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়।
নির্বাচন কমিশন গঠনের পর তাদেরকে দায়িত্ব দেওয়া হয় কীভাবে একটি সুষ্ঠু অবাধ নির্বাচন করা যায় তার প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের । সার্বজনীন ভােটাধিকারের ভিত্তিতে জনসাধারণের প্রতিনিধি নির্বাচনের উদ্দেশ্যে ভােটার তালিকা প্রণয়নের জন্য প্রেসিডেন্ট একটি নির্দেশ জারি করেন। যা ১৯৬৯ সালের ভােটার তালিকা নির্দেশ নামে অভিহিত । এই নির্দেশ অনুযায়ী প্রধান নির্বাচন কমিশনারের ক্ষমতা নির্ধারণ করা হয়। এছাড়া স্টাফ ও রেজিস্ট্রেশন অফিসারদের নিয়ােগ এবং অন্যান্য কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে সাহায্য গ্রহণের ব্যবস্থা করা হয়। এই নির্দেশ অনুযায়ী বলা হয়, প্রণীত ভােটার তালিকার বৈষম্য কিংবা সে অনুযায়ী কোনাে বিবরণী বা কার্যক্রমের আইনানুগ দিক সম্পর্কে আদালতে কোনাে প্রশ্ন তােলা যাবে না। প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে ভােটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার উপযুক্ত যে কোনাে নাম ভােটার তালিকাভুক্ত করার ক্ষমতা দেওয়া হয়। নির্বাচন কমিশনের প্রাথমিক কাজ ছিল একটি সার্বজনীন ভােটার তালিকা প্রস্তুত করা। ভােটার তালিকা প্রস্তুত ছাড়াও তাঁর দায়িত্ব ছিল নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ। নির্বাচন কমিশন সাফল্যের সাথে এ কাজ সমাপ্ত করেছিল। নির্বাচন কমিশনের সর্বপ্রথম কাজ ছিল এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া, ১৯৭০ সালের নির্বাচনের জন্য আইয়ুবীয় পদ্ধতির অধীনে যে ভােটার তালিকা প্রস্তুত হয়েছিল তা গ্রহণ করা হবে কিনা। বর্তমান ভােটার তালিকা গ্রহণের বিরুদ্ধে প্রধান অভিযােগ ছিল আইয়ুবের নির্বাচন পদ্ধতি ছিল পরােক্ষ । এই ভােটার তালিকা প্রস্তত করা হয়েছিল
৩০
মৌলিক গণতন্ত্রীদের নির্বাচনের উদ্দেশ্যে; প্রাদেশিক কিংবা কেন্দ্রীয় পরিষদের সদস্যদের নির্বাচনের জন্য নয়। আইয়ুব খানের অধীনে যে নির্বাচন কমিশন। ছিল তাঁর নেতৃত্বে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ছিলেন না বরং একজন কার্যনির্বাহী কর্মকর্তা ছিলেন যিনি কয়েক বছর আইয়ুব খানের সচিব ছিলেন। স্বাভাবিকভাবে এই কমিশনের কাজ জনগণ কর্তৃক গৃহিত হয়নি। এসব বিষয় ধর্তব্যের মধ্যে নিয়ে বিচারপতি আব্দুস সাত্তার নতুন ভােটার তালিকা প্রস্তুত করার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৬১ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী সাড়ে এগারাে কোটি লােক অধ্যুষিত দেশে ভােটার তালিকা প্রণয়ন খুব সহজ কাজ ছিল না। কেননা জনসংখ্যার অধিকাংশ ছিল অশিক্ষিত এবং সুদূর গ্রামাঞ্চলে। বসবাসরত, যেখানে যােগাযােগ ব্যবস্থা ছিল খুবই খারাপ। প্রেসিডেন্ট নতুন। ভােটার তালিকা প্রণয়ন বিধি জারি করেন যাতে যথাযথভাবে ও জনগণের সন্তুষ্টি অনুযায়ী ভােটার তালিকা করা যায়। এতে বলা হয় ১৯৬৯ সালের ভােটার তালিকা আইন অনুসারে আবাসিক ভবনের অধিবাসীদের বিবৃতির উপর ভিত্তি করে নতুন ভােটার তালিকা তৈরি করা হবে। তালিকা প্রণয়নকারীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে এই তথ্য সংগ্রহ করবেন। পূর্ব পাকিস্তানে বাংলায় এবং পশ্চিম পাকিস্তানে উর্দুতে ভােটার তালিকা প্রস্তুত করা হবে । ভুয়া ভােটার তালিকা যাতে না করা হয় এ সমালােচনা এড়াতে নির্বাচন কমিশন অত্যন্ত সতর্কতার সাথে পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ভােটার তালিকা প্রণয়নে সারাদেশব্যাপী স্থাপন করা হয় এক বিরাট কার্যকরী ব্যবস্থা। এ ব্যবস্থায় ছিলেন ২৮৫ জন রেজিস্ট্রেশন অফিসার, ১৪০৪ জন সহকারী রেজিস্ট্রেশন অফিসার, ১৪১২১ জন সুপারভাইজার এবং ৪৫,৭৬৬ জন গণনাকারী। নির্ভুল ভােটার তালিকা প্রণয়নের উপর গুরুত্বারােপ করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ঢাকায় নির্বাচনী কমিশনের কর্মচারীদের দুইদিন ব্যাপী উচ্চ পর্যায়ের সম্মেলনে বলেন, জাতি যাতে একটি নির্ভুল ভােটার তালিকা পেতে পারে, নির্বাচনী কমিশনের সে ব্যাপারে যত্নবান হতে হবে। নির্বাচন কমিশন ১৯৭০ সালের ১৫ জুনের মধ্যে ভােটার তালিকা প্রণয়নের কাজ সম্পন্ন করে। নতুন ভােটার তালিকার প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল ১৯৬৯ সালের ২৭ আগস্ট। ভােটার তালিকা প্রণয়ন করার পর তা প্রকাশ করা হয়। উদ্দেশ্য ছিল যদি কোনাে দাবী কিংবা আপত্তি থাকে দ্রুত তা নিষ্পত্তির জন্য ৩১৫ জন রিভাইজিং অথরিটিস নিয়ােগ দেওয়া হয়েছিল। এদেরকে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের হাইকোর্টের সহায়তায়
৩১
নিয়ােগ দেওয়া হয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তানের প্রকাশিত ভােটার তালিকার বিরুদ্ধে সর্বমােট ২০,৬৫০টি দরখাস্ত দেওয়া হয় যার মধ্যে ১৫,০০৭টি গ্রহণ। করা হয়। পশ্চিম পাকিস্তানে তেমনি ৬,৯০৪টি দরখাস্ত দেওয়া হয় যার মধ্যে ৫,৭৭৬টি গৃহিত হয় এবং ১,১২৪টি প্রত্যাখ্যান করা হয়। তালিকাভুক্ত সর্বমােট ভােটারের মধ্যে ৩ কোটি ২২ লক্ষ ছিল পূর্ব পাকিস্তান এবং ২ কোটি ৫২ লক্ষ ছিল পশ্চিম পাকিস্তান হতে । নির্বাচনে পাকিস্তানে মােট ভােটারের সংখ্যা ছিল ৫ কোটি ৬৪ লাখের উপর। তালিকাভুক্ত ভােটার সংখ্যা ছিল দেশের জনসংখ্যার প্রায় ৬০% যা ছিল একটি আদর্শ অনুপাত। ভােটার তালিকা সম্পন্ন হওয়ার বিষয়ে দৈনিক পাকিস্তানে বলা হয়- জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনের প্রথম পর্যায়ের কাজ আজ সম্পন্ন হয়েছে। দেশের সর্বত্র চূড়ান্ত ভােটার তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। … ভােটার তালিকা ছাপাতে প্রায় ২ কোটি টাকা খরচ হয়েছে এবং প্রতি পৃষ্ঠা ২০ পয়সা দামে ভােটারদের কাছে বিক্রি করা হবে । (২ জুলাই ১৯৭০)।
নির্বাচনী ভােটার তালিকার সাথে সাথে জরুরী হয়ে দেখা দেয় নির্বাচনী এলাকার সীমা নির্ধারণ । নির্বাচনী কমিশনারের এক বিবৃতিতে নির্বাচনী সীমানা সম্পর্কে বলা হয় যে, গ্রাম অঞ্চলে এক একটি গ্রামকে নির্বাচনী এলাকা এবং শহরাঞ্চলে একটি ওয়ার্ড বা মহল্লা বা রাস্তাকে নির্বাচনী এলাকা হিসেবে গণ্য করা হবে। প্রধান নির্বাচনী কমিশনার বিচারপতি আব্দুস সাত্তার শপথ নেওয়ার পরপরই ঘােষণা দেন নির্বাচন কমিশন ভােটার তালিকা তৈরি করা ছাড়াও নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ করবে। এ লক্ষ্যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১৯৭০ সালের নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ আদেশ জারি করেন। নির্বাচনী সীমানা নির্দেশকরণের জন্য বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে চেয়ারম্যান ও পাকিস্তানের দুই অংশের হাইকোর্টের একজন করে বিচারপতি নিয়ে একটি কমিশন গঠিত হয়। পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচনী এলাকার ব্যাপারে আপত্তি ও পরামর্শ কমিশন কর্তৃক শােনা হয় ১৯৭০ সালের ১১ মে থেকে ২২ মে পর্যন্ত । কমিশন পূর্ব পাকিস্তানে জাতীয় পরিষদের ৫৮টি নির্বাচনী এলাকা এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৯৬টি নির্বাচনী এলাকায় ভাগ করে । পশ্চিম পাকিস্তানে জাতীয় পরিষদের ৩৯টি এবং ৪টি প্রদেশকে ৮৯টি প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনী এলাকায় বিভক্ত করা হয়। নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ শেষে পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচনী এলাকার চূড়ান্ত তালিকা ১৯৭০ সালের ৫ জুন এবং
৩২
পশ্চিম পাকিস্তানের নির্বাচনী এলাকার তালিকা ১৯৭০ সালের ২৫ জুন প্রকাশ করা হয়।
সরকার ১৯৬১ সালের আদমশুমারীর ভিত্তিতে একব্যক্তি একভােট’ অনুযায়ী জাতীয় পরিষদের আসন সংখ্যা নির্ধারণের জন্য বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করেন। প্রায় ৪ লাখ লােকের সমন্বয়ে এক একটি নির্বাচনী এলাকা গঠিত হয়। প্রধান নির্বাচন কমিশনার এক বিজ্ঞপ্তিতে নির্বাচনী এলাকার সংজ্ঞায় বলেন, গ্রাম অঞ্চলে এক একটি গ্রামকে এক একটি নির্বাচনী এলাকা এবং শহর অঞ্চলে একটি ওয়ার্ড শুদ্ধরূপে বললে মহল্লা বা রাস্তাকে নির্বাচনী এলাকা হিসেবে গণ্য করা হবে।
যে কোনাে নির্বাচনে নির্বাচনী প্রতীক একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন বিভিন্ন দলের নিকট থেকে নির্বাচনী প্রতীকের আবেদন গ্রহণ করা হবে বলে কমিশন ঘােষণা দেয়। নির্বাচন কমিশন আসন্ন সাধারণ নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য ৩৯টি রাজনৈতিক দলের জন্য নির্বাচনী প্রতীক বরাদ্দ করে। পরিষদের অনূন্য ২৫টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে এ প্রতিশ্রুতি পাওয়ার পর রাজনৈতিক দলগুলাের জন্য নির্বাচনী প্রতীক বরাদ্দ করা হয়। কমিশনের স্বীকৃত নির্বাচনী প্রতীকের সংখ্যা ৫৩টি। বাকি ৩৪টি প্রতীক চিহ্ন ব্যক্তিগত ভাবে নির্বাচনী প্রার্থীদের মধ্যে বণ্টন করা হয় । ৪২টি রাজনৈতিক দল প্রতীকের জন্য আবেদন করেছিল। এর মধ্যে প্রথম দফায় ১৯টি দলের জন্য এবং পরবর্তীসময় আরও ৫টি দলের জন্য নির্বাচনী প্রতীক বরাদ্দ করা হয়েছে।
৩৩
তালিকা ১: নির্বাচনী প্রতীকের তালিকা
ক্রমিক নং রাজনৈতিক দলের নাম নির্বাচনী প্রতীক।
১. পাকিস্তান আওয়ামী লীগ – নৌকা
২.পাকিস্তান ডেমােক্রেটিক পার্টি- ছাতা
৩.জামাতে ইসলামি – দাঁড়িপাল্লা
৪. পাকিস্তান পিপলস পার্টি। -তলােয়ার
৫ . পাকিস্তান মুসলিম লীগ (কাইয়ুম গ্রুপ) -বাঘ
৬ . পাকিস্তান মুসলিম লীগ (কনভেনশন) – সাইকেল
৭ . ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ভাসানী গ্রুপ) -ধানের শীষ
৮ . ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ওয়ালী গ্রুপ) -ঘােড়া
৯ . পাকিস্তান মুসলিম লীগ (কাউন্সিল)- লণ্ঠন
১০. জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম -খেজুরগাছ
১১. জমিয়তে আলীয়াই মােজাহেদিন। পাগড়ী
১২. খাকসার তেহরিক -বেলচা
১৩.নিখিল পাকিস্তান কেন্দ্রীয় জমিয়তে উলেমা ই ইসলাম ও নেজামে ইসলাম – বই
১৪.পাকিস্তান ন্যাশনাল কংগ্রেস। -কলস
১৫. সিন্ধু করাচী মুহাজির পাঞ্জাবী পাঠান মুস্তাহিদ মাহাজ -ঘােড়া
১৬.গণতন্ত্রী দল -গরু
১৭ | জাতীয় গণমুক্তি দল -মােমবাতি
১৮ | বেলুচিস্তান যুক্তফ্রন্ট-চেয়ার
১৯ | কৃষক শ্রমিক পার্টি-হুক্কা
২০.পাকিস্তান ন্যাশনাল লীগ -লাঙল
২১. মারকাজী জমিয়তে আহলে হাদীস-গােলাপ
২২. সিন্ধু ইউনাইটেড ফ্রন্ট- ছড়ি
২৩ মারকাজী জমিয়তে উলামায়ে ই ইসলাম-চাবি
সূত্র: দি ঢাকা গেজেট, এক্সট্রাঅর্ডিনারি, সেপ্টেম্বর ১৯৭০, পৃ. ৯৫১
৩৪
স্বতন্ত্র প্রার্থীদের প্রতীকের জন্য সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী এলাকার রিটার্নিং অফিসারদের কাছে আবেদন করার কথা বলা হয়। তাদের বরাদ্দের জন্য ৩১টি প্রতীক ছিল । প্রতীকগুলাে হচ্ছে- আতা, গরুর গাড়ি, ঘুড়ি, তালা, রেলগাড়ির ইঞ্জিন, কাচি, লােটা, চাকা, ফেজটুপি, হরিণ, ছুরি, মই, বেহালা, হাতি, টোঙ্গা, এরােপ্লেন, মাছ, আনারস, আম, দোয়াত-কলম, বােতল, ঢােলক, রেডিও, বাস, টেবিল, সেতু, রকেট, প্রদীপ, কাপ, পিরিচ ও মশাল । যে কোনাে নির্বাচনে নির্বাচনী তফসিল ঘােষণার পর আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনের প্রচার প্রচারণা শুরু হয়। নির্বাচন কমিশন ৭ ডিসেম্বর জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে প্রত্যেক নির্বাচনী এলাকা থেকে একজন করে সদস্য নির্বাচনের জন্য ভােটারদের প্রতি আহবান জানিয়ে ইশতাহার জারি করেন। ১৭ ডিসেম্বর প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচনের ব্যাপারেও একই রকম ইশতাহার জারি করা হয়। প্রেসিডেন্ট কর্তৃক ১০ জুলাই জারিকৃত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ (নির্বাচন) অর্ডিন্যান্স ১৯৭০ অনুযায়ী এ ইশতাহার জারি করা হয়। তফসিল অনুযায়ী ১৫ অক্টোবর মনােনয়ন পত্র দাখিল, ১৭ অক্টোবর বাছাই ও ২৪ অক্টোবর মনােনয়ন পত্র প্রত্যাহারের দিন ধার্য করা হয়। প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনের জন্য ১৯ অক্টোবর মনােনয়ন পত্র দাখিল, ২১ অক্টোবর বাছাই ও ২৮ অক্টোবর মনােনয়ন পত্র প্রত্যাহারের তারিখ নির্ধারণ করা হয়।
তফসিলে উল্লেখ করা হয়, জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে দেশের উভয় অঞ্চলে সকাল সাড়ে আটটা থেকে বিকেল সাড়ে চারটা পর্যন্ত ভােট গ্রহণ করা হবে। নির্বাচন কমিশনারের সূত্র থেকে জানা যায় দেশের আসন্ন নির্বাচনে ৬ কোটি ৬৫ লাখ ভােটার অংশগ্রহণ করবে। নির্বাচন কমিশন নির্বাচন বাবদ ব্যয়ের হিসাব ধরে প্রায় ৫ কোটি টাকা।
সারাদেশে ৫০০ রিটার্নিং অফিসার, ১৪০০ সহকারী রিটার্নিং অফিসার, প্রায় ৩০ হাজার প্রিসাইডিং অফিসার ও প্রায় ৩ লাখ পােলিং অফিসার নির্বাচনের সময় কাজ করার জন্য নিয়ােগ দেয়া হয়। নির্বাচনে ৩ লাখ ব্যালট বাক্স ব্যবহার করা হয়। জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে মােট ১৩ কোটি ৫৬ লাখ ব্যালট পেপার ছাপানাে হয়। মনােনয়ন পত্র প্রত্যাহারের পর ব্যালট পেপার ছাপা শুরু হয়। পাকিস্তান ন্যাশনাল লীগ প্রধান আতাউর রহমান খান নির্বাচন বয়কটের সিদ্ধান্ত এবং ভাসানী ন্যাপ নির্বাচন প্রত্যাখ্যান
৩৫
করলেও ব্যালট পেপারে তাদের নাম ছিল। নির্বাচনে মওলানা ভাসানী, আতাউর রহমান খান, ইউসুফ আলী চৌধুরী, কৃষক শ্রমিক পার্টির সভাপতি এ.এস.এম. সােলায়মান ভােট দেননি।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে জাতীয় পরিষদে আসন সংখ্যা ছিল সাধারণ ৩০০ এবং মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত ১৩টি। প্রাদেশিক পরিষদে আসন সংখ্যা ছিল সাধারণ ৬০০ এবং মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত ২১টি। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলাে পৃথক পৃথক ভাবে প্রার্থী মনােনীত করে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে মােট ৭৮১ জন প্রার্থী এবং পশ্চিম পাকিস্তানে জাতীয় পরিষদে মােট ৮০০ জন প্রার্থী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে।
৩৬
ভােট গ্রহণের দিন ভােটাররা যাতে নির্বিঘ্নে ভােট প্রদান করতে পারে সেদিকেও নির্বাচন কমিশন সতর্ক দৃষ্টি দেয়। নির্বাচনকালীন সময়ে প্রদেশের শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য ১৪,৪৯৫টি নির্বাচন কেন্দ্রে প্রায় ১ লক্ষ ১০ হাজার আনসার সদস্য মােতায়েন করা হয় বলে সরকারি হ্যান্ড আউটের মাধ্যমে জানানাে হয়। প্রাদেশিক নির্বাচনের সময় পূর্ণ শান্তি বজায় রাখার জন্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় এবং ভােট গ্রহণের দিনে ব্যাপকভাবে সেনাবাহিনী সদস্যদের মােতায়েন করা হবে বলে সরকারিভাবে ঘােষণা করা হয়। জাতীয় পরিষদের নির্বাচনেও এমন ব্যবস্থা করা হয়। সেনাবাহিনী রাস্তায় টহল দিবে ও নির্বাচনের পূর্বে বা নির্বাচনের সময় যাতে কোনাে ধরনের বেআইনী
৩৭
কার্যকলাপ অনুষ্ঠিত না হয় এবং নির্বাচন যাতে সুশৃঙ্খলভাবে হয় সে ব্যাপারে অতিরিক্ত সতর্ক দৃষ্টি রাখবে।
নির্বাচনের সময় ভােটদান পদ্ধতি কেমন হবে তা জানিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের পত্রপত্রিকায় জানিয়ে দেওয়া হয়। নির্বাচন কমিশনারও ভােটদান। পদ্ধতি সম্পর্কে ভােটারদের সচেতন করার জন্য পর্ব পাকিস্তানে ও পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে নির্বাচনী মহড়ার আয়ােজন করে। বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য এটি ছিল খুবই গ্রহণযােগ্য। কারণ এ মহড়ার ফলে যে সকল অশিক্ষিত মানুষ ভােটার ছিল তাদের এ সম্পর্কে সচেতন করা হয় যাতে তারা সুষ্ঠুভাবে ভােটদান করতে পারে। নির্বাচন কমিশন নতুন ভােটদান পদ্ধতি চালু করে। নতুন পদ্ধতিতে ব্যালট পেপারে প্রার্থীদের নাম ও তাদের নিজেদের নামের পাশে নির্বাচনী প্রতীক থাকবে। এছাড়া পুলিং বুথে চারকোনা সিল ও প্যাড রাখা হবে। ভােটারগণ ব্যালট পেপারে নিজের পছন্দের প্রার্থীর নামের পাশের প্রতীক চিহ্ন অথবা প্রার্থীর নামের মধ্যে সিল মেরে পুলিং অফিসারের সামনে রাখা ব্যালট বাক্সে ফেলে দিলে ভােট দেওয়া শেষ হবে। দুইটি নামের অথবা প্রতীক চিহ্নের মাঝখানে সিল পড়লে সিলের বেশিরভাগ অংশ যেদিকে পড়বে সে প্রার্থীকে ভােট দেওয়া হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হবে।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে ভােট গণনা ও ফলাফল প্রকাশ সম্পর্কে নির্বাচন কমিশনার জানান যে, নির্বাচনের রিটার্নিং অফিসাররা ভােটকেন্দ্র থেকে পাওয়া নির্বাচনের প্রাথমিক ফলাফল সংবাদমাধ্যমগুলােকে সরবরাহ করবে। তবে বিভিন্ন ভােট কেন্দ্র থেকে পাওয়া ফলাফল বিন্যাসের পর সরকারিভাবে ফলাফল প্রকাশ করা হবে। নির্বাচনী ফলাফল কীভাবে প্রকাশ করা হবে তা নির্বাচন কমিশন সিদ্ধান্ত নিয়ে জানায় যে, দেশব্যাপী নির্বাচন কেন্দ্রসমূহের প্রিসাইডিং অফিসাররা নিজেদের নির্বাচনী এলাকায় প্রাপ্ত ভােট গণনা করে। রিটার্নিং অফিসারের নিকট পাঠাবেন। প্রধানত মহকুমা ও জেলা সদর দপ্তরে অবস্থিত এ সব রিটার্নিং অফিসার পাকিস্তান বেতারসহ অন্যান্য সংবাদ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের নিকট ঐ ফলাফল প্রেরণ করবে। রিটার্নিং অফিসাররা প্রাদেশিক নির্বাচনী কমিশনারের কাছে এ সকল ফলাফল জানাবে। প্রাদেশিক কেন্দ্রসমূহের চূড়ান্ত ফলাফল টেলিভিশনসহ অন্যান্য সংবাদ প্রচারকারী মাধ্যমের নিকট পাঠানাে হবে। প্রাদেশিক নির্বাচনী কমিশনের
৩৮
নিকট রিটার্নিং অফিসারদের এবং কেন্দ্রীয় নির্বাচনী কমিশনের নিকট প্রাদেশিক নির্বাচনী কমিশনের ফলাফল পাঠানাের সুবিধার জন্য টেলিফোন ও টেলিগ্রাফ বিভাগ তারযােগাযােগ স্থাপন করবে। বেতার টেলিভিশন ও অন্যান্য প্রচারমাধ্যম কর্তৃক এসব ফলাফলকে ভােট গণনার অস্থায়ী ও বেসরকারি ফলাফল হিসেবে প্রচার করা হবে। প্রত্যেকটি নির্বাচনী এলাকার সব ভােট কেন্দ্রের ফলাফল একত্র করার পর প্রত্যেকটি নির্বাচনী এলাকার ফল সরকারিভাবে ঘােষণা করা হবে।
১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের পূর্বে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি আব্দুস সাত্তার সব রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের সাথে বৈঠক করে ছয়টি মূলনীতি বিশিষ্ট আচরণ বিধি প্রণয়ন করেন। এগুলাে হলাে-
১. অন্য রাজনৈতিক দলের সভায় হাঙ্গামা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে দলীয় কর্মী, সমর্থক ও শুভানুধ্যায়ীদের বিরত রাখার জন্য রাজনৈতিক দলগুলাের চেষ্টা করা উচিত।
২. রাজনৈতিক দলগুলাের নেতৃবর্গ ও কর্মীদের অন্যান্য নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগতভাবে কটুক্তি পরিহার করা উচিত।বক্তৃতা ও স্লোগান মার্জিত এবং শালীনতা ও শিষ্টতার নীতি ভিত্তিক হওয়া উচিত।
৩.জননেতা ও রাজনৈতিক কার্যকলাপে অংশগ্রহণকারী অন্যান্য সবাইকে দায়িত্ববােধ ও সম্মানবােধ সহকারে অবশ্যই কাজ করতে হবে। নিজেদের মত ও কর্মসূচি প্রচারকালে তাদের এ কাজ করার ব্যাপারে অন্যদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা উচিত নয়। কারণ তা। গণতন্ত্রের পরিপন্থী।
৪. দলের নিজস্ব কর্মসূচি ও নীতি ব্যাখ্যাকারী প্ল্যাকার্ড ও অন্যান্য সচিত্র প্রচারণা অন্যান্য দলের নেতৃবর্গের বিরােধী হওয়া উচিত নয়।
৫. হাঙ্গামার আবেদন জানানাে বা হাঙ্গামার হুমকি প্রদান বা হাঙ্গামা সৃষ্টি কঠোরভাবে এড়িয়ে চলা উচিত।
৬. জনসভায় অস্ত্রশস্ত্র বহন করতে দেওয়া হবে না এবং এ ব্যাপারে কঠোরভাবে সরকারি বিধি পালন করতে হবে। জনসভায় হাতবােমা ও অন্যান্য বিস্ফোরক দ্রব্য ব্যবহার করা উচিত নয় ।
৩৯
এই ছয়টি আচরণবিধি ছাড়াও রাজনৈতিক দলগুলাের কর্মসূচি প্রচারের কাজে মসজিদকে ব্যবহার না করার জন্যও প্রধান নির্বাচন কমিশনার উল্লেখ করেন। বাহ্যতদৃষ্টিতে বিচার করলে বলা যায়, পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথম সার্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কদের ভােটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান তাঁর গৃহিত বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে আন্তরিকতার পরিচয় তুলে ধরেছেন। একটি সুষ্ঠু অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও প্রধান নির্বাচন কমিশনার সব ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। নির্বাচনী ব্যবস্থাপনার আওতায় নির্বাচনের জন্য নতুন ভােটার তালিকা থেকে শুরু করে নির্বাচনী তফসিল পর্যন্ত সব কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করেন। ভােটার তালিকা প্রণয়নে নির্বাচন কমিশন এবং সীমা নির্দেশ করণ কমিশনের নির্বাচনী এলাকা নির্ধারণের কাজ দেশে স্বাগত জানানাে হয়। কোনাে বড় রাজনৈতিক দল কিংবা কোনাে পত্রপত্রিকায় বিচারপতি আব্দুস সাত্তারের নেতৃত্বে গঠিত দু’টি কমিশনের সদিচ্ছার ব্যাপারে কোনাে সন্দেহ প্রকাশ করেনি। প্রত্যেক ব্যক্তি দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনের আয়ােজন নিয়ে সন্তুষ্ট ছিল। সমগ্র দেশবাসী অপেক্ষা করতে থাকে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য। ১ জানুয়ারি ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলাের উপর থেকে রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার ফলে সব দল একযােগে নির্বাচনী প্রচার কার্য শুরু করে । সবাই নিজেদের জয়ের ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করে। ভােটারদের কাছে তাদের নিজস্ব কর্মসূচি ও তাদের সন্তুষ্ট করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয় । সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় পাকিস্তানের তেইশ বছরের ইতিহাসে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার মতাে পরিবেশ তৈরি হয়।

Reference:

১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন বাংলাদেশের অভ্যুদয় – মোশারফ হোসেন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!