1974.12.10 | ফিল্ড মার্শাল মানেকশ’র সাক্ষাৎকার | সাপ্তাহিক বিচিত্রা
বিচিত্রা
১০ই ডিসেম্বর ১৯৭৪
বাংলাদেশ সীমান্তে আমি শ্রেষ্ঠ বাহিনীর সমাবেশ ঘটিয়েছিলাম—ফিল্ড মার্শাল মানেক শ’
[ভারতের একটি পত্রিকায় সম্প্রতি ফিল্ড মার্শাল মানেক শ’ এর সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে। মানেক শ’ ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রাক্তন চীফ অব স্টাফ। ’৭১-এর পাক-ভারত যুদ্ধে তিনি ভারতের তিন বাহিনীর (সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী) সমন্বয় কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন।
এই সাক্ষাৎকারে ’৭১-এর পাক-ভারত যুদ্ধ ও ফলাফল সম্পর্কে ভারতীয় মনোভাব খুজে পাওয়া যাবে। এবং মানেক শ’ এখানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী, দেশ ও যুদ্ধ সম্পর্কে মতামত রেখেছেন এবং কিছু ব্যক্তিগত প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। মূল সাক্ষাৎকারটির প্রথম অংশ অপ্রয়োজনীয় বলে বাদ দেওয়া হয়েছে।]
প্রশ্ন ঃ বহু বছর আগে বৃটিশরা ভারত ছেড়ে চলে গেলেও ভারতীয় সেনাবাহিনী মেজাজে, শিক্ষায় একটু বেশী বেশী বৃটিশ। স্বাধীনতার ২৫ বছর পর-ও ভারতীয় সেনাবাহিনীতে ‘দ্য স্কিনার্স হর্স’ রেজিমেণ্ট রয়েছে—এটা কি আপনার কাছে আশ্চর্য লাগে না?
উত্তর ঃ ওদের ‘স্কিনার্স হর্স’ বলা হয়, আসলে সেনাবাহিনী ঐতিহ্যের মাধ্যমে চলে বলে। নিজেকে ‘সিন্ধু হর্স’ বা ‘হডসন্স হর্স’ বলা একটু উন্নাসিকতা বটে। এটা কিছুকালের জন্যে থাকবে।
প্রশ্ন ঃ কোন কোন সমালোচক বলে থাকেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর ভারতীয়করণ….
উত্তর ঃ কিন্তু ভারতীয় সেনাবাহিনী নিঃসন্দেহে ভারতীয়।
প্রশ্ন ঃ এবার পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতর গত যুদ্ধ নিয়ে কিছু বলব। আমার কিছু পাকিস্তানী বন্ধু আছে, ওরা বলে ‘তোমরা জিতেছ ঠিক, কিন্তু এটা ছিল অসম যুদ্ধ। তোমাদের সৈন্যসংখ্যা বেশী, অস্ত্র বেশী, তোমরা আমাদের ঘেরাও করেছ। এই অবস্থায় সবাই জয়লাভ করে।’ আপনি কি বলবেন?
উত্তর ঃ ঐভাবে দেখলে পাকিস্তানের সঙ্গে সব ঝগড়াই তো অসম। আমাদের জনসংখ্যা ৫৫ কোটি, পাকিস্তানের সাড়ে ৭ কোটি। আমি ধরে নেব আপনি সমস্যাকে ওভাবে দেখবেন না। হ্যা, ওরা ঘেরাও হয়েছিল। তবে আমাদের যে সমস্যা ছিল ওদের তা ছিল না। আমাদের আর একটা সীমান্ত ছিল—চীন সীমান্ত। তারপর ছিল শরণার্থী সমস্যা। আমাদের পশ্চিম অঞ্চলেও যুদ্ধ করতে হয়েছে। অবশ্য বাংলাদেশ সীমান্তে আমি শ্রেষ্ঠ বাহিনীর সমাবেশ ঘটাই তবে তা অন্যান্য সীমান্তের ব্যাপারে ঝুকি নিয়ে।
প্রশ্ন ঃ যোদ্ধা হিসেবে পাকিস্তান বাহিনীকে আপনি কি চোখে দেখেন?
উত্তর ঃ আমার মনে হয় ওরা খুব ভাল যোদ্ধা।
প্রশ্ন ঃ তাহলে ওরা এত খারাপভাবে যুদ্ধ করল কেন?
উত্তর ঃ আমি তো জানি ওরা সাংঘাতিক নিপূণতার সঙ্গে যুদ্ধ করেছে।
প্রশ্ন ঃ সাধারণ নাগরিকদের এমন ধারণা দেয়া হয়েছে ওরা যুদ্ধ করেনি।
উত্তর ঃ হ্যা, ওরা দৃঢ়তার সঙ্গে লড়েছে।
প্রশ্ন ঃ তাহলে আমাদের ধারণা ভুল?
উত্তর ঃ যুদ্ধ শুরু হওয়ার কিছুদিন পর প্রশ্ন উঠল পাকিস্তানীদের ক্ষতি কে বেশী করছে—আমি না গেরিলারা? ফলে এটা তাদেরই স্বার্থে ছিল আমার কাছে আত্মসমর্পণ করা। কারণ ‘মুক্তিবাহিনী’র প্রতিশোধ স্পৃহা ছিল। তারা (পাকিস্তানীরা) জানত আমার তা ছিল না। অবশ্য ঠিক সুড়সুড় করে ওরা খাচায় বন্দী হয়নি। ওরা লড়েছে জোরের সাথে। তারা জানত তারা পারবে না তখনই আত্মসমর্পণ করার সিদ্ধান্ত নেয়। ওরা আরো তিন চার দিন পরে চালিয়ে দিতে পারত। এতে বেশী দিন লাভ হত না। উভয়পক্ষের কিছু জওয়ানের মৃত্যু হত।
প্রশ্ন ঃ জরুরী না হলেও একটা প্রশ্ন ‘আত্মসমর্পণ গ্রহণের জন্যে ঢাকা গেলেন না কেন?
উত্তর ঃ কারণ পাকিস্তানের পুরো বাহিনী আত্মসমর্পণ করেনি, করেছে একটি অংশ।
প্রশ্ন ঃ তাহলে এটা প্রোটোকলের ব্যাপার ছিল?
উত্তর ঃ না, ঠিক তা-ও নয়। আমি ভাবলাম সেই সেক্টরের কমান্ডার আত্মসমর্পণ গ্রহণ করুক।
প্রশ্ন ঃ আপনাকে ঢাকা পাঠানোর চেষ্টা হয়নি?
উত্তর ঃ মানুষ তাই ভেবেছে। আমি তা শুনবো কেন? এটা যে অঞ্চলে যুদ্ধ হয়েছে সেই অঞ্চলের কমান্ডার সেখানে নেতৃত্ব দিয়েছে এবং তিনিই আত্মসমর্পণ গ্রহণ করেছেন। যদি কাশ্মীর অঞ্চলে হত তাহলে সেখানকার কমান্ডারকে আমি আত্মসমর্পণ গ্রহণের জন্যে পাঠাতাম।
প্রশ্ন ঃ কিন্তু আপনা কি না যাওয়াই উচিত ছিল?
উত্তর ঃ দুটো কারণে (১) পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটা অংশ আত্মসমর্পণ করেছে, (২) আমি মনে করি আঞ্চলিক কমান্ডারের তার নিজের কৃতিত্বের ভাগ নেয়ার অধিকার রয়েছে। আমি তা চুরি করে নেব কেন?
প্রশ্ন ঃ আমাদের (ভারত) সাফল্যের মূল কারণ কোথায়?
উত্তর ঃ প্রথমত স্বচ্ছ রাজনৈতিক নির্দেশ ছিল। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ ছিল খুবই নিখুত। তার তিন বাহিনীর টিমওয়ার্ক। আমি সিনিয়র হিসেবে ছিলাম চেয়ারম্যানের। এয়ার চীফ মার্শাল লাল ও চার্লস নন্দ (নৌবাহিনী) আমার অনেকদিনের চেনা। ফলে কাজের সুবিধা হয়েছে।
তাছাড়া পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্বে ‘পরিকল্পনা’ করে যুদ্ধ হয়নি। আমরা প্রতি মিনিটের প্ল্যান করেছি বিস্তারিতভাবে।
প্রশ্ন ঃ তখন (রাতে-দিনে) আপনার কাজের সময় কি ছিল?
উত্তর ঃ ওহ্। কাজ ছিল সাংঘাতিক। দৈনিক ১৮-১৯ ঘণ্টা, কোন সময় তারও বেশী। ফলে যুদ্ধ তাড়াতাড়ি শেষ হওয়ায় ভাল হয়েছে, কি বলেন?
প্রশ্ন ঃ এটা কি সত্য সেই সময়, রাতে, বেশ দেরীতে আপনাকে একটি হোটেলে মদ খেতে দেখা যেত?
উত্তর ঃ ঠিক। প্রতি রাতে ২০ মিনিটের জন্যে আমি হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে যেতাম—মদ খেয়ে, আবোল-তাবোল বকতাম—একেবারে আবোল-তাবোল—তারপর আবার যুদ্ধক্ষেত্রে ফিরে আসতাম।
প্রশ্ন ঃ অবসরবিনোদনের কি নির্দিষ্ট টেকনিক থাকে? লোকে বলে সংকটকালে চার্চিল তাজা চুরুট জ্বালিয়ে, ব্রান্ডির গ্লাস নিয়ে চোখ বুজে বু’দ হয়ে থাকতেন।
উত্তর ঃ এটা নির্ভর করে নিজর ব্যক্তিত্বের উপর। আমার ক্ষেত্রে আমি এক গ্লাস হুইসকী আর সুন্দরী মহিলাদের সঙ্গে কথা বলতে পছন্দ করি।
প্রশ্ন ঃ আপনি বলেছেন প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে পরিষ্কার নির্দেশ পেয়েছেন। আপনি সম্পূর্ণ স্বাধীন ছিলেন?
উত্তর ঃ সেনাবাহিনীর কাজে কোন হস্তক্ষেপ হয়নি। তবে সবকিছু রাজনৈতিক প্রয়োজনে যতটুকু দরকার তা-ই করা হয়।
প্রশ্ন ঃ মন্ত্রিসভায় কোন মতভেদ ছিল না?
উত্তর ঃ থাকলেও তা আমার ব্যাপার ছিল না। আমার প্রতি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ ছিল সুস্পষ্ট।
প্রশ্ন ঃ একটা সুন্দর গল্প প্রচলিত আছে, যুদ্ধের সময়, কোন উত্তেজনাময় (যুদ্ধের ঘটনার দিক থেকে) সভায় প্রধানমন্ত্রী ‘কোন প্রশ্ন’ করলেই আপনি হাত তুলতেন এবং বলতেন, ‘ইয়েস প্রাইম মিনিস্টার, আপনি নিজেকে এত সুন্দর রেখেছেন কি করে?’
উত্তর ঃ সুন্দর গল্প, তবে সত্য নয়।
প্রশ্ন ঃ তবে আপনি ‘বরফ গলাতে’ পারতেন?
উত্তর ঃ হ্যা আমার রসবোধ আছে, কখনো কখনো আমি কৌতুক করতাম।
প্রশ্ন ঃ তার সঙ্গে আপনার ব্যক্তিগত সম্পর্ক সবসময় ভাল ছিল?
উত্তর ঃ হ্যা। সার্ভিস চীফ হিসব প্রধানমন্ত্রীকে প্রাপ্য সম্মান আমি দিতাম তবে ‘জ্বী হুজুর’ মার্কা লোক আমি ছিলাম না। আবার কারো কারো মত তার পাশে হাত ভাজ করে দাড়িয়েও থাকতাম না।
প্রশ্ন ঃ মন্ত্রিসভায় তিনিই সম্ভবত সবচাইতে সহজ ছিলেন?
উত্তর ঃ আমি অন্যভাবে বলি। তিনি ভিন্নভাবে মানুষ হয়েছেন। আপনি তার সঙ্গে কথা বলতে পারেন, কৌতুক করতে পারেন। তার রসবোধ আছে। তিনি মানবিক।
প্রশ্ন ঃ ফিল্ড মার্শাল আপনি যখন অবসর গ্রহণ……….
উত্তর ঃ আমি অবসর নিই নাই।
প্রশ্ন ঃ ওয়েল, আর্মির চীফ অব স্টাফ না থাকার পরও আপনি ছিলেন নায়ক। তারপর আপনাকে ফিল্ড মার্শালের সম্মান দেয়া হল, সবাই খুশী হল। আপনি সামাজিক অনুষ্ঠানে যেতে শুরু করলেন। তারপর ইংল্যান্ডে গিয়ে এক সাক্ষাৎকার দিলেন যার ফলে আপনাকে বিব্রত হতে হল। ঠিক কি বলেছিলেন আপনি এবং কোন ক্ষেত্রে তা বলেছিলেন?
উত্তর ঃ কৌতুকের ব্যাপার হল বিলাতে আমি কোন সাক্ষাৎকার দিই নাই। আমি জানি আপনি কি বলতে চাইছেন। ‘ডেটলাইন দিল্লী’ নামক পত্রিকার এক রিপোর্টার—১৯ বছরের একটি মিষ্টি মেয়ে ফটোগ্রাফারসহ আমার কাছে এল। আমি তখন দিল্লী ক্যান্টনমেন্ট। সে আসার পর তাকে আমি কেক খেতে দিলাম। তাকে মনে হল আমার সঙ্গে কথা বলার চাইতে কেক খাওয়ায় বেশী মনোযোগী—তার বয়সী হলে আমিও তাই করতাম।
আমি হাসি-ঠাট্টা-তামাশা করলাম এবং সে অনেক প্রশ্ন করল। সে এদিক ওদিক দেখতে লাগল। তাকে আমার শোবার ঘর দেখিয়ে বললাম ‘এটা আমার শোবার ঘর’ তারপর সংলগ্ন দরোজা খুলে বললাম ‘এটা আমার স্ত্রীর শোয়ার ঘর।’ মেয়েটি বলল ‘আপনারা এক ঘরে থাকেন না?’ বললাম, ‘না আমার স্ত্রী বলে আমার নাক ডাকে। আপনি জানেন আমি খুব রসিক। সঙ্গে সঙ্গে আমি বললাম, ‘অন্য মেয়েরা এই অভিযোগ করে না।’ তখন সে আমার বাথরুমে এসে পাচটা ইলেকট্রিক দাতের ব্রাশ দেখে জিজ্ঞেস করল, ‘এগুলো আপনি কিসে ব্যবহার করেন?’ আমি বললাম, ‘আমার ৪টা কুকুর আছে, তাদের দাত মেজে দিই।’ এটা ছিল আসলে কৌতুক।
সে জিজ্ঞেস করল আমি সব সময় গুর্খাদের সঙ্গে ছিলাম কি না? আমি বললাম বৃটিশ আমলে গুর্খাদের সঙ্গে থাকার প্রশ্ন আসে না কারণ গুর্খারা ভারতীয় হয়েছে মাত্র ’৪৭ সালে। সে তখন জানতে চাইল ’৪৭-এর আগে আমি কোথায় ছিলাম। বললাম বিখ্যাত রেজিমেন্ট ‘দ্য ফ্রন্টিয়ার ফোর্সে।’ সে বলল সেই রেজিমেণ্ট এখন কোথায়। বললাম পাকিস্তানে। মেয়েটি বলল ‘সেই ফোর্সের সঙ্গে কেন গেলেন না?’ জবাবে বললাম, ‘মিঃ জিন্নাহ যেতে বলেছিলেন। কিন্তু আমি তাকে জানিয়েছি যে আমি অমৃতসরের, অমৃতসর ভারতের অংশে পড়েছে এবং আমার বাবা-মা’র সম্পত্তি আছে বোম্বেতে, তার উপর আমি বিয়ে করেছি বোম্বের এক সুন্দরী মেয়েকে।
‘ধরুন’, মেয়েটি তখন বলল, ‘আপনি যদি যেতেন?’ মেয়েটির সঙ্গে তখন প্রায় ৯০ মিনিট কেটে গেছে, আমি চাইছিলাম সে চলে যাক। তাই জবাব দিলাম, ‘যদি পাকিস্তানে যেতাম তাহলে আমি প্রধান সেনাপতি হতাম’ এবং নীচু হয়ে তার পেছনে চাপড় মেরে বললাম, ‘এবং তোমাদের পরাজিত করতাম।’
মেয়েটি অবশ্য সাংবাদিক কায়দায় লিখে বসল ফিল্ড মার্শাল বলেছেন, তিনি যদি পাকিস্তানে যেতেন তবে সেখানকার প্রধান সেনাপতি হয়ে ভারতকে পরাজিত করতেন।
প্রশ্ন ঃ কিন্তু খবরটা লন্ডল থেকে কি করে উৎপন্ন হল?
উত্তর ঃ না, এটা ‘ডেটলাইন দিল্লী’র ফেব্রুয়ারী সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। সবাই পড়েছে, সবাই হেসেছে। কেউ কিছু বলেননি। এপ্রিলে আমি লন্ডনে যাই তখন পার্লামেণ্টের অধিবেশন শুরু হয়।
আপনি হয়ত জানেন ফিল্ড মার্শাল হলে বিতর্কিত বিষয় হতে হয়। অনেকে হিংসা করে। রাজনৈতিক হিংসাও থাকে। আমি সাধারণ ‘ক্যাবলাকান্ত’ সৈনিক ছিলাম না। আমি আমার কাজ করেছি, কোন আমলা বা মন্ত্রীকে বেশী গুরুত্ব দিই নাই। ফলে অনেকের জেলাসীর জন্ম দিয়েছি আমি। তখন কেউ তা প্রকাশ করেনি। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমার সম্পর্ক খুব ভাল ছিল, আমি কোন ব্যাপারে সোজা তার সঙ্গে আলাপ করতাম এবং তার পরামর্শে কাজ করতাম। অন্য কারো তোয়াক্কা করতাম না। এতেও অনেকে অখুশী হতেন।
এসব ঘটনা হিংসার সৃষ্টি করে। আমি তা বুঝি। আমি যখন বিলাতে তখন পার্লামেণ্টে এ নিয়ে প্রশ্ন করা হল। কেউ আমাকে প্রশ্ন করেনি। আমার কাছে কৈফিয়ৎ চায়নি। সবাই নিজ নিজ বিবৃতি পড়তে লাগলেন ফিল্ড মার্শাল এই বলেছেন, ঐ বলেছেন। ফিল্ড যা কোনদিন বলেনি। যাহোক সবকিছু ঘটে যাওয়ার ২০ দিন পর কাগজে আমি তা দেখলাম। এখন একজন কি করতে পারে? ‘ডেটলাইন’-এর মেয়েটি এক নিবন্ধে জানাল সেটা সবটাই ছিল কৌতুক।
মেয়েটিকে আমি দোষ দিই না। সে কোন ক্ষতি করেনি। বরং সে মূল সাক্ষাৎকার সেভাবে রসিয়ে লিখেছিল। কিন্তু যারা ফিল্ড মার্শালকে পছন্দ করে না তারা এটাকে বানাল হাতিয়ার। অযৌক্তিক ব্যাপার হল যখন এ প্রশ্ন পার্লামেণ্টে উঠেছিল তখন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী উঠে বলতে পারতেন, ‘ফিল্ড মার্শাল এখন এখানে নেই, আমরা জানি না তিনি কি বলেছেন না বলেছেন কিন্তু তিনি তা বলেননি।’
প্রশ্ন ঃ আপনি ফিরে আসার পর আপনার কাছে কৈফিয়ৎ তলব করা হয়েছিল?
উত্তর ঃ আমাকে কৈফিয়ৎ তলব করে কার সাহস? আমি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করলাম, বললাম এটা হতে দেওয়া ঠিক হয়নি। আমি খুব মর্মাহত হয়েছি। আমার অবশ্য করার কিছু নেই। অবশ্য প্রধানমন্ত্রীকেও আমি বুঝি। কি করবেন তিনি? করুণা হয়। সবসময় পার্লামেণ্টে দাড়িয়ে সবার সমর্থনে এগিয়ে আসতে হবে। ওরা প্রধানমন্ত্রীর সম্পর্কে, তার ছেলের সম্পর্কে, তার বন্ধুদের সম্পর্কে সব সময় কিছু না কিছু একটা বলেই যাচ্ছেন। এবং যখনই কেউ কারো বিরুদ্ধে কিছু বলছেন, তখনই তিনি পার্লামেণ্টে দাড়িয়ে সে ব্যক্তির সমর্থনে এগিয়ে আসতে পারেন না।
প্রশ্ন ঃ এখন আপনি অনেক স্বেচ্ছা নির্বাসনে…………
উত্তর ঃ না, নির্বাসন কেন হবে। কাউকে কোথাও না কোথাও থাকতে হবে। আমি পাঞ্জাবের লোক, আমার স্ত্রীর পাঞ্জাব পছন্দ নয়। সে আবার বোম্বের যেখানে আমি থাকতে পারি না?। প্রথমতঃ অবশ্য সেখানকার থাকা খরচ আমার পক্ষে চালানো সম্ভব নয়। দ্বিতীয়তঃ আমি খোলামেলা জায়গায় থাকতে পছন্দ করি। তাই আমরা নীলগিরিতে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। নীলগিরিকে আমরা ভালভাবে চিনি। ৪ বছর আমি ওয়েলিংটনের স্টাফ কলেজে কমানডেন্ট ছিলাম।
প্রশ্ন ঃ ঐ ঘটনার পর দিল্লী ত্যাগের জন্যে কোন চাপ আসেনি আপনার ওপর?
উত্তর ঃ ফিল্ড মার্শালকে অন্য কেউ চাপ দেবে কি করে?
প্রশ্ন ঃ না, আমি বলতে চাইছিলাম এরকম ঘটনার পর পরিবেশ একটু শত্রুভাবাপন্ন মনে হতে পারে না কি?
উত্তর ঃ না। না।
প্রশ্ন ঃ কারণ কেউ কেউ মনে করছেন এ ঘটনর পর আপনার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করা হয়েছে।
উত্তর ঃ হ্যা। অনেকে করে। আমার স্ত্রী তা অনুভব করে। আমি করি না। আমি মনে করি ওরা দুষ্ট প্রকৃতির লোক। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব এখনো আছে। আমি দিল্লী গেলে তার সঙ্গে দেখা করি। আমার প্রতি তার দুর্বলতা রয়েছে। আমি নিশ্চিত—আমি যদি তার কাছে কোন চাকুরী চাই তিনি দেবেন। কিন্তু আমি চাকুরী চাই না।
প্রশ্ন ঃ আপনি অবসর নিতে আগ্রহী? কি করে সময় কাটান? গলফ খেলেন?
উত্তর ঃ না। আমি গলফ খেলি না। আমার সুন্দর বাড়ি আছে, একটা বাগান আছে, বাগানে আমি গোলাপ লাগিয়েছি। কিছু মুরগী আছে আমার। মুরগী ডিম দেয়—না দিলে আমি একটু উৎকণ্ঠিত হই। আমার একটা গরু এবং গরুর বাচ্চা রয়েছে। আমার স্ত্রী আছে। আমি গানের বেশ ভক্ত।
প্রশ্ন ঃ আপনি কখনো ফিল্ড মার্শাল পদ থেকে পদত্যাগ করার কথা ভেবেছেন?
উত্তর ঃ না। তবে আমি কখনো কখনো বিরক্ত হই। মাঝে মাঝ রাগ হয়। তখন আমি ভাবি ‘আমি কে?’ আমি শুধু একজন ফিল্ড মার্শাল। ওরা প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কেও অনেক কথা বলে। তবে ভারতের জনসাধারণ খুব ভাল। আমি যেখানে যাই—উত্তরে বা দক্ষিণে—সমান ভালবাসা পাই। এটাই যথেষ্ট। কিছুসংখ্যক কম্যুনিস্ট বা বাবু বা আমলার ষড়যন্ত্রে কি এসে যায়?
প্রশ্ন ঃ কেউ কেউ বলেছেন আপনি দেশের ক্ষমতা গ্রহণ করে দেশের দুর্নীতি বন্ধ করুন। আপনি বরাবর বলেছেন রাজনীতি সৈনিকের কাজ নয়। আমি একটা একাডেমিক প্রশ্ন করতে চাই। ভারতে সামরিক অভ্যূত্থান কি সম্ভব? কেউ বলে অসম্ভব কারণ এর বিরাট এলাকা ইত্যাদি।
উত্তর ঃ অবশ্যই সম্ভব। আপনি যদি পাকিস্তানকে পরাজিত করতে পারেন অবশ্যই এদেশের ক্ষমতা হাতে নিতে পারেন। এটা এমন কোন কঠিন কাজ নয়। কিন্তু আমি কখনো তা চিন্তা করিনি।
০০০০