জয় বাংলা ৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ তারিখের মূল পত্রিকা
মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
জয় বাংলা
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মুখপত্র
প্রথম বর্ষ, অতিরিক্ত সংখ্যা, ১৯শে অগ্রহায়ণ, ৬ই ডিসেম্বর
বাংলাদেশ স্বীকৃত
ভারতের পার্লামেন্টের ইন্দিরা গান্ধীর ঘোষণাঃ
আরো কয়েকটি দেশের স্বীকৃতি দান আসন্ন
আজ (সোমবার) স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার এশিয়ার সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ ভারতের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি লাভ করেছে। জয় বাংলা। জয়তু শেখ মুজিব।
ভারতের সর্বজন শ্রদ্ধেয়া প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী আজ সকালে পার্লামেন্টের উভয় পরিষদের অধিবেশনে বাংলাদেশ সরকারের স্বীকৃতিদানের কথা তুমুল হর্ষধ্বনির ভিতরে ঘোষণা করেন।
আশা করা যায়, ভারতের এই স্বীকৃতি দানের পর বাংলাদেশ সরকার ইউরোপ, এশিয়া ও আমেরিকার অন্ততপক্ষে আরো ২১ টি রাষ্ট্রের আশু স্বীকৃতি লাভ করতে পারেন।
সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধানমন্ত্রী মিঃ আলেস্কি কোসিগিন এক সাংবাদিক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দানের বিষয়টি সরকার কর্তৃক বিবেচিত হওয়া সম্পর্কে ইঙ্গিত প্রদান করেন।
ভারতের পার্লামেন্টের সকল দলীয় সদস্যদের তুমুল হর্ষধ্বনির মধ্যে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের ঘোষণাটি পাঠ করেন। উল্লেখযোগ্য যে, ৩রা ডিসেম্বর দিবাগত রাত্রে ভারতের উপর পাকিস্তানের কাপুরুষোচিত বিমান আক্রমণের সংবাদ শ্রবণ এর পর জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ শ্রীমতি গান্ধী বলেন,’এখন বাংলাদেশের যুদ্ধ ভারতের ও যুদ্ধ।’
প্রসঙ্গত বলা দরকার, চলতি সালের ১০ই এপ্রিল তারিখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপ্রধান এবং তার অনুপস্থিতিতে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে রাষ্ট্রপ্রধান এবং তাজউদ্দিন আহমেদকে প্রধানমন্ত্রী করে প্রথম স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়। অতঃপর ১৭ই এপ্রিল তারিখে কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথপুর গ্রামের এক আম্রকাননে আনুষ্ঠানিকভাবে এই সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং মন্ত্রিসভার সদস্যগণ- যথাক্রমে তাজউদ্দিন আহমেদ, খন্দকার মোশতাক আহমেদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও এইচ এম কামরুজ্জামান শপথ গ্রহণ করেন। শপথ গ্রহণের অব্যবহিত পরেই অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান ভারতসহ বিশ্বের সকল দেশের কাছে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের স্বীকৃতির জন্য অনুরোধ জ্ঞাপন করেন।
আজ সকল ফ্রন্টের মুক্তিবাহিনীর দুর্বার অগ্রগতি এবং ভারতীয় জওয়ানদের এই মুক্তিযুদ্ধে সশস্ত্র সহায়তাদানের ফলে স্বাধীন বাংলাদেশ একটি বাস্তব ও স্বীকৃত সত্য। জয় বাঙ্গালীর জয়। গণতন্ত্র ও সমাজবাদের জয়। জয় মানবতা ও মানব স্বাধীনতা। জয় বাংলা।
জয় বাংলা
স্বাধীন বাংলাদেশ আজ জগৎ সভায় সম্মানিত ও স্বীকৃত। এশিয়ার সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ বাংলাদেশ সরকারকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি প্রদান করেছেন। আরো বহু দেশের স্বীকৃতি দান আসন্ন। একদিকে যখন মুক্তিবাহিনীর দুর্বার অগ্রগতির মুখে গোটা দখলীকৃত বাংলাদেশ অচিরেই মুক্ত হতে চলেছে, ঠিক সেই সময় বাংলাদেশের এই স্বীকৃতি শুধু বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের মুক্তিযুদ্ধের জয় নয়, গোটা এশিয়া গণতন্ত্র ও মানব স্বাধীনতার স্বীকৃতি ও বিজয়।
আজ আমরা গভীর শ্রদ্ধা ও সম্মানের সঙ্গে স্মরণ করি আমাদের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। যিনি নাৎসী ইয়াহিয়ার কারাগারে দুঃসহ বন্দী জীবন যাপন করছেন। স্মরণ করে পশ্চিম পাকিস্তানী নরপশুদের হাতে নিহত বাংলার দশ লাখ শহীদ নর-নারীকে, স্মরণ করি মুক্তিযুদ্ধে বীর সেনানীরা আত্মহুতি দিয়েছেন তাঁদের শৌর্য, সাহস ও দেশপ্রেমকে স্মরণ করি সোনার বাংলার মাটি, মানুষ ও সৌন্দর্য, হাজার বছরের ঐতিহ্য কৃষ্টি, সভ্যতাও ভাষাকে। স্মরণ করি ভাষা আন্দোলনের শহীদদের, স্মরণ করি শিক্ষা আন্দোলনের শহীদদের, স্মরণ করি বিভিন্ন ছাত্র আন্দোলন- ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের শহীদদের।
স্বাধীনবাংলা আজ বাস্তব সত্য। বাস্তব সত্য স্বাধীন বাঙালি জাতির অস্তিত্ব। জয় বাংলা।
এক কন্ঠে নানান সুর
বাংলাদেশ সমস্যা ও সে ব্যাপারে ভারতের ভূমিকা সম্পর্কে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পুরোপুরিভাবে অযৌক্তিক মনোভাব আঁকড়ে ধরে থাকতে পারছে না বলে মনে হয়। বৃহৎ শক্তির বড় গলার জোর যাই থাক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা যে এই উপমহাদেশের সঙ্কট নিরসন না করে বরং তা আরও বাড়িয়ে তুলবে সে সত্যটি দুনিয়ার কাছ থেকে গলার জোরে যে চেপে রাখা যাবেনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বুঝতে পেরেছেন বলে মনে হয়।
অতঃপর গত শুক্রবার মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র মিঃ চার্লস ব্রে যে মন্তব্য করেছেন তা থেকে আপাতদৃষ্টিতে তাই মনে হয়।
তিনি বলেছেন যে ভারতীয় বাহিনী যদি পূর্ববঙ্গের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে তাহলে তারা তাকে আক্রমণ আখ্যা দেবেন না।
ভারতীয় উপমহাদেশে উত্তেজনা বৃদ্ধিতে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন যাতে উত্তেজনা হ্রাস পাবে যুক্তরাষ্ট্র তাই চায়। মিঃ ব্রে স্বীকার করেছেন যে ভারত কে আক্রমণ কারী আখ্যা দিয়ে উপমহাদেশে উত্তেজনা হ্রাস করা যাবে না। কিন্তু তিনি যে সঙ্গে আরেকটি সত্য কথা অনুক্ত রেখেছেন যে, পাক হানাদারদের উপর বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর আক্রমনকে ভারতীয় সৈন্যদের আক্রমণ বলে চিহ্নিত করলে শুধু সত্যের অপলাপই করা হবে, সমস্যার কোনো সমাধান তাতে হবে না।
যাতে উত্তেজনা হ্রাস পাবে যুক্তরাষ্ট্র তাই চায় বলে তিনি মন্তব্য করেছেন সে মন্তব্যের অনুকূলে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার কার্যকরী প্রমাণ তিনি হাজির করেন নি। বর্তমানে উত্তেজনা হ্রাসের একটাই পথ রয়েছে। সে পথটি হচ্ছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যাওয়া এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দেয়া। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কি সে পথে পা বাড়াবে?
জয় বাংলা
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মুখপত্র
প্রথম বর্ষ ৩১শ সংখ্যা, ২৩ শে অগ্রহায়ণ, ১৩৭৮ ১০ই ডিসেম্বর ১৯৭১
ঢাকার মুক্তি যেকোনো মুহূর্তেঃ
যশোর ও কুমিল্লার পর খুলনা ও চাঁদপুর মুক্ত
বঙ্গবন্ধুকে চাই
(জয়বাংলা প্রতিনিধি)
বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর দুর্বার অভিযানের মুখে এখন ঢাকা শহরের মুক্তি আসন্ন। আগামী ৪৮ ঘন্টার মধ্যে ঢাকা শহর মুক্ত হতে পারে। ঢাকা থেকে ইয়াহিয়ার দস্যু বাহিনীর লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজি পশ্চিম পাকিস্তানে পলায়ন করেছেন।পলায়নপর পাকিস্তানি সৈন্যরা জলপথে পলায়নের জন্য বরিশাল ও নারায়ণগঞ্জে সমবেত হয়েছিল। ভারতের প্রধান সেনাপতি তাদের আত্মসমর্পণের জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। ইতিপূর্বে কুমিল্লা-সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, যশোর দুর্গসহ যশোর আখাউড়া, খুলনা প্রভৃতি শহর মুক্ত হয়েছে। চাঁদপুর থেকে সম্মিলিত বাহিনী এখন ঢাকার পথে।
জাতিসংঘের গৃহীত যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব ভারত প্রত্যাখ্যান করেছে। ফলে ফ্যাসিস্ট জঙ্গিশাহীকে রক্ষার আরেক মার্কিন চক্রান্ত ব্যর্থ হয়ে গেছে। ইসলামাবাদে বসে জেনারেল ইয়াহিয়া লোলচর্মবৃদ্ধ নুরুল আমিন ও জুলফিকার আলী ভুট্টো কে মৃত পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ও উপপ্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগের কথা ঘোষণা করেছেন। ভুট্টো জাতিসংঘে ধর্ণা দেয়ার জন্য মোটর যোগে নিউইয়র্ক এর পথে কাবুল রওয়ানা হয়ে গেছেন। তিনি ভারতে বিমানের আকাশ পথে যেতে সাহসী হননি।
বাংলাদেশ সরকার এক বেতার ঘোষণায় বাংলাদেশের জনগণের প্রতি ধৃত পাকিস্তানি সৈন্য ও তাদের সহযোগীদের হত্যা না করে মুক্তিবাহিনীর হাতে অর্পণ এর নির্দেশ দিয়েছেন। পাকিস্তানের প্রায় চার ডিভিশন সৈন্যকে বন্দি করে তাদের বিনিময়ে বঙ্গবন্ধু এবং পশ্চিম পাকিস্তানের অবস্থানকারী কয়েক লাখ বাঙালিকে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা হবে।
বাংলাদেশ প্রজাতন্ত্রের অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম ঘোষণা করেছেন আমরা এখন বঙ্গবন্ধুকে চাই। একটি স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান কে অবৈধভাবে জেলে আটকে রাখার কোন অধিকার ইয়াহিয়ার নেই।
প্রধানমন্ত্রীর জনাব তাজউদ্দীন অশ্রুভরা চোখে বলেন, এই নবজাতকের (স্বাধীন বাংলাদেশের) প্রথম ক্রন্দনধ্বনি যার কারণে প্রথম পৌঁছানো উচিত ছিল, সেই বঙ্গবন্ধু এখন আমাদের মধ্যে নেই, এটা আমাদের জন্য পরম দুঃখের বিষয়। এই পরম আনন্দের মুহূর্তে আমাদের মধ্যে তার অনুপস্থিতি আমাদের হৃদয়কে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। (অসমাপ্ত)
প্রধানমন্ত্রীর জনাব তাজউদ্দিনের বেতার ভাষণের পূর্ণ বিবরণ
সযত্নে ভিন্ন ভাষাভাষী ও ভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকদের রক্ষা করুন
গত ৮ই ডিসেম্বর বিকেল চারটায় রেডিও বাংলাদেশ থেকে প্রচারিত এক ভাষণে প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমেদ বলেন, হানাদারদের চূড়ান্ত আঘাত হানার সময় এসেছে। এমন কথা যেন কেউ বলতে না পারেন, এই পরম প্রত্যাশিত মুহূর্তে আমাদের কর্তব্যের ডাকে সাড়া দিতে ব্যর্থ হয়েছি। তিনি বাংলাদেশের জনগণকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, তারা যেন আইন ও বিচার নিজের হাতে গ্রহণ না করেন। বরং আইন অনুযায়ী অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে সরকারকে সহযোগিতা দেন। ভিন্ন ভাষাভাষী ও ভিন্ন সম্প্রদায়ের কোন লোক কে কোন ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা হলে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর অম্লান আদর্শ এবং স্বাধীনতা পতাকার অবমাননা করা হবে। সুতরাং ব্যক্তিগতভাবে প্রতিশোধ গ্রহণের স্পৃহা থেকে সকলকে বিরত থাকতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, শীঘ্রই সারা বাংলাদেশকে হানাদার কবলমুক্ত করার কাজ শেষ হবে এবং তখন গৃহহীন, অসুস্থ, শিশু, বৃদ্ধ, নারী সকলেই নিজেদের বাস্তভিটায় ফিরে যেতে পারবেন।
জনাব তাজউদ্দীন ঘোষণা করেন, নবজাত স্বাধীন বাংলাদেশের আদর্শ শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের, জোট নিরপেক্ষতা এবং সকল প্রকার উপনিবেশিকতা ও সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা। আমরা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাজতান্ত্রিক জীবন গঠনের অভিলাষী।
তিনি বলেন ভারত ও ভুটানের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে অন্যান্য সকল দেশের উচিত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করা। জাতিসংঘের যুদ্ধবিরতির জন্য মার্কিন চক্রান্তকে তিনি অন্ধ ও বিকৃতনীতি আখ্যা দেন। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক পারস্পরিক বন্ধুতা ও মৈত্রীর দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হবে।(অসমাপ্ত)
ঠেলার নাম বাবাজি!
ঠেলার নাম বাবাজি। ঠেলা পড়লে ভুতেও কথা বলে। বাংলাদেশে মুক্তিবাহিনীর গুতোয় আজ অনেকেই বঙ্গবন্ধুকে ভাই ডাকতে শুরু করেছে। যে গোলাম আযমরা মাত্র ক’দিন আগেও বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগকে খতম করে দিতে পেরেছে মনে করে আনন্দে বগল বাজাচ্ছিল আজ তারাই বঙ্গবন্ধুর প্রেমে পড়ে গেছে বলে মনে হয়।
বিবিসির এক খবরে প্রকাশ, বাঙালির জানের দুশমন খুনী মওদুদীর গর্দভ ঢাকার গোলাম আযম গত রবিবার করাচিতে এক বিবৃতিতে বলেছে, আমার বন্ধু শেখ মুজিব বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমর্থন করছে বলে আমি বিশ্বাস করিনা।
খুনি মওদুদীর আরেক গর্ধভ গোলাম আযমের গোলাম সাবেক পূর্ব পাকিস্তান জামাত ইসলামের সাধারণ সম্পাদক মাওলানা আব্দুল খালেকও ঐদিন এক বিবৃতিতে বলেছেন,”অন্যরা যাই ভাবুক আমার বন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানকে আলাদা করতে চাইছেন বলে আমার মনে হয় না।”
প্রকান্তর প্রকারান্তরে মওদুদীর গর্ধবদ্বয় বঙ্গবন্ধুর মুক্তি দিয়ে পাকিস্তান রক্ষার পক্ষেই মত প্রকাশ করেছে।
* * *
অন্যদিকে খুনি নুরুল আমিনকে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি ও আওয়ামী লীগের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার ব্যাপারে মতামত জানাতে বলা হলে সে বলেছেঃ আমার মতামত নিয়ে শেখ মুজিবকে গ্রেফতার বা আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হয়নি। সুতরাং বর্তমানে প্রেসিডেন্ট যা ভালো মনে করবেন তিনি তাই করবেন। আমার মতামতের কোনো দরকার পরেনা।”
* * *
এছাড়া গত শুক্রবার খুনি ইয়াহিয়ার সাথে সাক্ষাতের পর আইয়ুব খানের রাজনৈতিক জারজ সন্তান জুলফিকার আলী ভুট্টো বলেছে, আমি নিজেও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হলেন শেখ মুজিবকে মুক্তি দিতাম না।
মুক্ত এলাকার গ্রামে বন্দরে
সারোয়ার জাহান
(জয়বাংলার প্রতিনিধি)
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
তারপর আর কেউ আসেনি। আমরাও আর সন্দেহজনক কোন লোককে এলাকায় ঢুকতে দিইনা। বাচ্চা থেকে বুড়ো পর্যন্ত যেই কোনো অপরিচিত লোক দেখুক অমনি সব কাজ ফেলে মুক্তিবাহিনীকে খবর দেবেই।” পাশে কয়েকজন লোক দাঁড়িয়ে ছিল। কিছু জিজ্ঞাসা না করে তাদের মধ্যে একজন বলল, খানসেনারা থাকতে আগে প্রায় হাট লুঠ হত। এখন আর তা হয়না। দশ পয়সা দিয়ে একটা ডাব কিনে খাচ্ছিলাম। এমন সময় লেফটেন্যান্ট চৌধুরী এলেন। আমরা বেশ কিছুদুর হেটে চললাম। এখন আমরা ইছামতির তীরে। নারিকেল বাগানের পাশ কেটে সামনে দাঁড়াতেই দেখলাম পাকবাহিনীর ফেলে যাওয়া এক বিধ্বস্ত ঘাটি। লেফটেন্যান্ট বললেন এখানেই চলেছে মূল লড়াই। মজবুত পাকা বাংকারে গোল করে সাজিয়েছিল পাক দস্যুরা এই ঘাঁটি। অফিস ঘরটিও ছিল একটা পাকা দালান। মুক্তিবাহিনীর অতর্কিত প্রচন্ড আক্রমণে খানসেনারা তেরোটি লাশ ফেলে পালিয়ে যায়। তাদের পাকা অফিস ঘরটিও নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। মুক্তিবাহিনীর এক বীর সৈনিক মাইন পুঁততে গিয়ে বিস্ফোরণে শহীদ হন। বিশ্বের সেরা যোদ্ধা বলে যে পাকিস্তানের ফৌজ গর্ব করে তাদের এমনই এক সুরক্ষিত ঘাঁটি বাংলাদেশের অগ্নি সেনারা বীরদর্পে দখল করে নিয়েছে। এ দৃশ্য দেখে আমাদের বুক গর্বে ফুলে উঠলো।
পৃথিবীতে তখন সন্ধ্যা নামছে কিন্তু আমরা বাংলাদেশের নতুন সূর্যোদয়ের প্রস্তুতি দেখছি। যেখানটায় দাঁড়িয়ে ছিলাম সেখানে থেকে আরো কিছুদূর হেঁটে এলাম আরেক জায়গায়। সেখানে অস্থায়ী হাসপাতাল গড়ে উঠেছে। কিছুটা জঙ্গল ঘেরা জায়গায় তাবু টেনে গড়ে উঠেছে এ হাসপাতাল। চৌকিতে শুয়ে আছেন আহত কয়েকজন মুক্তিসেনা আর কয়েকজন নাগরিক। ডাঃ শাহজাহান বললেন, হাতের কাছে যা আমরা পাচ্ছি তাই দিয়ে কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। তার সহকর্মী মেডিকেল কলেজের শেষ বর্ষের ছাত্র, জাহিদ, তিনি বলেন, বাংলাদেশকে তো আমরা নতুন করে গড়ে তুলছি। আমাদের যাত্রাপথের কোনো অসুবিধাই আমরা পরোয়া করিনা। আমি বললাম, গলি থেকে যখন রাজপথে নেমেছি -তখন এই রাজপথ ধরে রাজত্বে আমরা বসবোই।
আমরা আরো এগিয়ে চললাম একেবারে ইচ্ছামতী নদীর তীরে। নদীর ওপারে বন্ধু দেশ ভারত। আমাদের সাথে একজন মুক্তি সেনা বললেন আমাদের হাজার হাজার দেশবাসীকে খানসেনারা ভারতে তাড়িয়ে দিয়েছে, তাদের সবাইকে মুক্ত স্বদেশভূমিতে ফিরিয়ে আনার জন্য আমরা যুদ্ধ করছি। একদিকে আমরা মুক্ত এলাকায় প্রতিরোধ ব্যবস্থা মজবুত করব, অপরদিকে এলাকার পর এলাকায় শত্রুকবল মুক্ত করব। এমনি করে একদিন গোটা বাংলাদেশ থেকে শত্রুরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। দেশের মানুষ পাবে সমৃদ্ধ জীবন -এইতো আমরা চাই। আমি বললাম, আপনারা আমাদের সাথে সারাদিন পথ দেখিয়ে চলেছেন অথচ আপনাদের সাথে আলাপেই করা হয়নি। আচ্ছা বলুনতো এই যে, আপনারা লড়ে চলেছেন প্রতিনিয়ত, আপনাদের মৃত্যুর ভয় করে না? সৈনিক বন্ধুটি বললেন, সারাদিন তো ঘুরে স্বচক্ষে দেখলেন প্রতিটি মানুষ আমাদের পেছনে পাহাড়ের মত দাঁড়িয়ে আছে। এরা সবাই লড়তে চায়; কিন্তু এত অস্ত্র আমরা দিতে পারছিনা। দেখুন, যেখানে সমগ্র জনতাই আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, সেখানে লড়াইয়ের মাঠে যদি আমরা মরিও এই জনতাই আমাদের অমর করে রাখবে, তাদের প্রতিষ্ঠিত জীবনে আমরা রসদ হয়ে বেঁচে থাকব।” ইছামতির তী্র থেকে তখন ফেরার পথে হাঁটা শুরু করেছি। কিন্তু সেদিকে আমার খেয়াল নেই। সৈনিক বন্ধুর কথার সাথে আমার কেবল এই ফটোগ্রাফার বন্ধু আলমের একটি কথা মনে পড়ছিল, জীবনে কি আছে, দেশ আর মাটি, এইতো জীবন!”
কুকুরের লেজ!
জাতিদ্রোহী মীরজাফর, বাংলার কুলাঙ্গার পশ্চিম পাকিস্তানের পুঁজিপতি, সামন্তবাদী, ঔপনিবেশিক শাসনের পা চাটা দালাল, খুনি নুরুল আমিন আবার স্বরুপে আত্মপ্রকাশ করেছে। সে এবং ভুট্টো মিলে মৃত পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ও ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী হচ্ছে। কুকুরের লেজ বারো বছর চোঙায় পুরা থাকলেও তা সোজা হয় না এবং কুকুরকে ঘৃত, ছানা যাই খাওয়ানো হোক না কেন একটা বিশেষ জিনিস দেখলেই লোভ সামলাতে পারে না। এরাও ঠিক সেই ধরনের লোক।
পাকিস্তান রাজনৈতিক সমাধান চায় না
রুশ পত্রিকা ক্লাসমায়া ইজভেদা-তে বলা হয়েছে যে, ভারত উপমহাদেশে বর্তমানে সামরিক উত্তেজনা ভয়ঙ্কর ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই অশান্তির জন্য পাকিস্তানি বিশেষ ভাবে দায়ী। কারণ পাকিস্তান শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ পরিত্যাগ করেছে। শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ পরিত্যাগ করে পাকিস্তান পরিস্থিতিকে ভয়ঙ্কর রকম জটিল করে তুলেছে।
বাংলাদেশকে স্বীকার কর
৩০শে নভেম্বর ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার ও পাকিস্তানকে কমনওয়েলথ থেকে বহিষ্কারের দাবি জানানো হয়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হিত এ বিষয়ে আলোচনা ওঠানো বন্ধ করেন।
সিংহল পার্লামেন্টে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে বিতস্তা
সিংহল লোকসভায় বাংলাদেশ প্রসঙ্গ নিয়ে দুই পক্ষে বিতস্তার সৃষ্টি হয়। সিংহলের তামিল নেতা ধর্ম লিঙ্গম অভিযোগ করেন, অজ্ঞানে অথবা অজ্ঞাতসারে সিংহল সরকার পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে পাকিস্তানি ফৌজ অস্ত্রপাতি সিংহল হয়ে যেতে দিয়ে বাংলাদেশে পাক সামরিক চক্রকে গণহত্যায় সহায়তা করেছে। সিংহল হয়ে পাক সামরিক বাহিনীর সৈন্যদের অসামরিক পোশাকে বাংলাদেশের যেতে দেওয়া হয়েছে।
মিস্টার ধর্ম লিঙ্গাম সিংহলের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমাভো বন্দরনায়েক এর কাছে আবেদন করে বলেন বাংলাদেশে গণহত্যা বন্ধের জন্য ইয়াহিয়ার উপর আপনার প্রভাব বিস্তার করুন। ইয়াহিয়া খানকে মানবাধিকার লংঘন করা থেকে বিরত করুন।
ইয়াহিয়ার জেনারেলরা বিচার শেষ হবার আগেই বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসি দিতে চায়
মার্কিন সংবাদ সাপ্তাহিক টাইম শেষ পর্যন্ত নিক্সনী কায়দায় পাকিস্তানের রাজনীতিতে পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করেছে এবং জঙ্গি চক্রের নায়ক ও বাংলাদেশ গণহত্যার শ্রেষ্ঠতম রূপকার জানোয়ার ইয়াহিয়ার ইমেজ সৃষ্টি করার কাজে সুচতুরভাবে অগ্রসর হয়েছে।
২৮শে নভেম্বর নিউ ইয়র্কে প্রকাশিত টাইমস এর সর্বশেষ সংখ্যায় ইনিয়ে বিনিয়ে বলা হয়েছে যে, বাঙ্গালীদের সাথে ইয়াহিয়া খান সমঝোতায় আসার ব্যাপারে আগ্রহী কিন্তু তার চরমপন্থীর জঙ্গী জেনারেলরা তা হতে দিচ্ছে না। এর অর্থ হচ্ছে ইয়াহিয়ার কোন দোষ নেই। সেতো দুধের মত সাদা ফেরেশতা মানুষ। দোষ সব হচ্ছে তার জেনারেলদের।
হিংস্র নেকড়ের ইয়াহিয়ার ইমেজ সৃষ্টির কারণ হচ্ছে তার সাথে যেন বাংলাদেশ সরকার আলোচনায় বসে। টাইমস এর মূল বক্তব্যঃ ইয়াহিয়ার মত মানুষ হয় না। সুতরাং তার সাথে পাকিস্তানের কাঠামোর মধ্যে বাংলাদেশ সমস্যার আলোচনায় প্রবৃত্ত হওয়া উচিত।
পত্রিকাটিতে বলা হয়েছে, নিক্সন নাকি ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী কে এমন একটি শান্তি প্রস্তাব দিয়েছিলেন যাতে বাংলাদেশ এবং ভারত উভয়ের সাথে ইয়াহিয়ার আলোচনার কথা ছিল।
রিপোর্টে বলা হয়েছে নিক্সন ভারতে নমনীয় মনোভাব গ্রহণের জন্য প্রস্তাব করেছিল এবং ওয়াশিংটন বর্তমানে কারারুদ্ধ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে আলোচনা করতে ইয়াহিয়াকে সম্মত করাতে চেষ্টা করেছিল।
‘টাইম’ আরো বলেছে যে, শ্রীমতি গান্ধী সংযত হতে সমর্থ হয়েছিলেন কিন্তু পাকিস্তানের জেনারেলরা শেখ মুজিবুর রহমানের তথাকথিত ষড়যন্ত্র মামলা শেষ হবার আগেই তাকে খতম করে দিতে চাচ্ছে। টাইম একজন পশ্চিমা কূটনীতিকদের ভাষ্য উদ্ধৃত করে বলেছেন, ”এমন হতে পারে মুজিব হয়ত বাংলাদেশে জীবিত ফিরে যেতে পারবে না।”
জেনেভা থেকে ফরাসি সংবাদ সরবরাহ প্রতিষ্ঠানের খবরে বলা হয়েছে যে, আন্তর্জাতিক যুরিস্ট কমিশন পাকিস্তান সরকার কর্তৃক শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার সম্পর্কে সম্পূর্ণ গোপনীয়তা অবলম্বন করায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সামরিক ট্রাইব্যুনালে শেখ সাহেব কে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলে তাকে মার্জনা করার জন্য কমিশন এক তারবার্তায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে অনুরোধ করেছেন।
তারবার্তায় আরও বলা হয়েছে যে, কমিশন সুনিশ্চিত মে, শেখ এর প্রাণদণ্ড দেওয়া হলে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটবে।
স্বাধীন বাংলায় কার্টেল, মনোপলির কোন স্থান থাকবে না
-মতিউর রহমান
( কলকাতা প্রতিনিধি প্রেরিত)
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বাণিজ্য ও শিল্প বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং পার্লামেন্ট সদস্য জনাব মশিউর রহমান গত ২৩শে নভেম্বর কলকাতা ভারতীয় ক্ষুদ্র শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের এক সমাবেশে বক্তৃতা প্রসঙ্গে হানাদার বাহিনীর নখরাঘাতে ক্ষতবিক্ষত বাংলাদেশের অর্থনীতি গড়ে তোলার ব্যাপারে ভারতসহ সহানুভূতিশীল প্রতিটি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সহযোগিতা কামনা করেন।
বাঙালি জাতীয়তাবাদের মহানায়ক শেখ মুজিবুর রহমানের ঘটনার পুনরাবৃত্তি করে জনাব মতিউর রহমান বলেন যে, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র এবং সমানাধিকারের আদর্শ বিধিতে বাংলাদেশের শাসনতন্ত্র পরিচালিত হবে। আমরা সব ব্যাপারেই সব দেশের সহানুভূতি কামনা করব কিন্তু শোষণের মনোভাব নিয়ে বাংলাদেশে যারা প্রবেশ করতে চাইবে তাদের প্রবেশের দুয়ার আমরা রুদ্ধ করে দেবো।
ফেডারেশন অফ অ্যাসোসিয়েশন অফ স্মল ইন্ডাস্ট্রিজ অফ ইন্ডিয়ার পূর্বাঞ্চল শাখা আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে জনাব রহমান বক্তৃতা করেন। অনুষ্ঠানে যোগদানের জন্য বাংলাদেশ নেতা মুজিবনগর থেকে কলকাতায় এসেছিলেন।
জনাব মতিউর রহমান বলেন যে, আমাদের বীর জনগণের সুগভীর দেশপ্রেম এবং দেশকে গড়ে তোলার স্পৃহা আমাদের বিধ্বস্ত অর্থনীতি পুনর্গঠনের প্রধান (৪)
মুক্তিসংগ্রামে মায়ের প্রেরণা
আইভি রহমান
সাংগঠনিক সম্পাদক আওয়ামী লীগ মহিলা শাখা
মুক্তাঞ্চলেই মায়েদের সভা ডাকা হয়েছিল। প্রায় দু’ঘণ্টা ধরে চলছিল সবার কাজ। একে একে সবাই বিদায় নিতে গেলেন। সারাদিনের খাটুনিতে মাথা ঝিমঝিম করছে। টেবিলের উপর মাথা রেখে চোখ বুঝেছিলাম কিছুক্ষণের জন্য। হঠাৎ পায়ের শব্দ মাথা তুলে দেখি আনুর মা এসে দাঁড়িয়েছে আমার টেবিলের কাছে।
আমাকে মাথা তুলে সোজা হয়ে বসতে দেখে বললেন,” মাথাটা ধইরছে বুঝি, টিইপ্পা দিমু? হেসে বললাম না তেমন কিছু না, এমনিতেই সেরে যাবে।”
“না না সরম কইরো না। যা খাডনী পইড়ছে ধইরবনা ক্যান।” আনুর মা ভাবী সত্যি সত্যি মাথায় হাত লাগাতে আসছে দেখে রীতিমতো শঙ্কিত হয়ে পড়লাম। বললাম তেমন কিছু মাথা ধরে নি। সভা শেষ হবার পর একটু জিরিয়ে নিচ্ছিলাম। থাক ওসব। আচ্ছা ভাবী সভাতো হলো, সবাইকে বললাম এবং সবাই স্বীকার করলেন প্রত্যেকে নিজেদের জন্য কিছু কাপড় জামা, কাঁথা, সেলাই করে দেবেন। সত্যি হবে তো?
“অইবোনা মানে আইজ থাইক্যা হগলে লাইগ্যা যাইবো। মুক্তিবাহিনীর ছাওয়ালগুলো আমাগো ছাওয়াল না? ছাওয়ালগো বাঁচান আমাগো ফরজ না?” একটা গর্বিত দীপ্তিতে আনুর মা ভাবীর মুখখানি ঝলমলি করে উঠলো। মাতৃত্ব ঝরে পড়লো তার কণ্ঠ থেকে। বিস্মিত হলাম এই অশিক্ষিত গ্রাম্য মহিলা তেজস্বীতায়। মুক্তিবাহিনীর ছেলেদের প্রতি তার অকৃত্রিম দরদে। একটু ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করলাম আচ্ছা ভাবি আনুর কোন খবর পেয়েছ? আনোয়ার ওরফে আনু ভাবির একমাত্র ছেলে। ভাবি বিধবা, দুটি মেয়ে, একটি ছেলে। আর একটি ছেলে ছিল হাবিব নাম। কারখানায় কাজ করতো। এ্যাকসিডেন্টে মারা গেছে দু’বছর আগে। মেয়ে দু’টির বিয়ে হয়েছে, যার যার স্বামীর বাড়ি থাকে। আনুই ছিল ভাবীর কাছে। বোশেখের শেষে বিয়ে ঠিক হয়েছিল একটা লক্ষী মেয়ের সাথে। সে বিয়ে আর হতে পারেনি। এরইমধ্যে ইয়াহিয়ার জল্লাদ বাহিনী বাংলাদেশের উপর চালিয়েছে নারকীয় আক্রমণ। রক্তের বন্যায় ভাসিয়ে দিয়েছে সারাটা দেশ। যে মেয়েটির সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয়েছিল তার বাবা-মাকে হত্যা করেছে খুনী পাকসেনা। মেয়েটির কোন হদিস নেই। আনু তার মাকে নিয়ে চলে এসেছে মুক্তাঞ্চলে। তার মামার বাড়িতে। এখানে এসে আনু শুধু ছটফট করতো আর বলতো “মা আমাকেও কিছু করতে হবে।”
ভাবি প্রথমে ভয় পেতেন। আনুকে বোঝাতে চেষ্টা করতেন। “আমারে দেহাই তোর অহন ফরজ কাম”। আনু বেশি কিছু কথা বাড়াতো না। একদিন আনু ফিরল বিকেলে, মুখটা থমথম করছে। মাকে ডেকে বলল, শুনেছ মা, রিজিয়াকেকে মিলিটারিরা ধরে নিয়ে গেছে। রিজিয়ার সাথে তার বিয়ে ঠিক হয়েছিল।
আনুর মা ভাবি আফসোস করেছিলেন খবরটা শুনে। কিন্তু তার জন্য আরও কিছু অপেক্ষা করছিল। আনুই বললো, আমি মুক্তিফৌজে যাব। রিজিয়া কে উদ্ধার করব।”
আন মুক্তিফৌজে যাবে শুনে হকচকিয়ে গিয়েছিলেন, আনুর মা ভাবি। বোকার মত জিজ্ঞেস করলেন, রিজিয়াকে উদ্ধার কইরা কি কইরবি?
“বিয়ে করবো। তার দোষ কি মা। আমার সাথেই তার বিয়ের কথা ঠিক হয়েছিল। আমারই তাকে রক্ষা করা উচিত ছিল। আমি পারিনি আমারই দোষ। ও যদি বেঁচে থাকে ওকে উদ্ধার করতে পারি তবে আমি ওকেই বউ করে ঘরে আনবো। আনু লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে বলে ফেলে কথাটি। আনুর মা ভাবি আনুর কথার জবাব দিতে পারেননি। ঠিকই তো রিজিয়ার দোষ কি? আজ যদি তার দুই মেয়ের এই অবস্থা হতো। ছেলের কথায় রাগ হয়না তার গর্বই হয়। তার কয়েকদিন পর আনু মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছে। এখন সে আছে পূর্ব রণাঙ্গনে। তারেই কুশল জিজ্ঞাসা করলাম ভাবীকে।
তার লাইগাই ফিরা আইলাম। এইহানে আইবার আগে আনুর একখানা চিডি আইছে। তোমার কাছেত পইড়া শুনুম বইল্যা নিয়া আইছি।” আনুর মা ভাবি তার বুকের জামার ভেতর থেকে একখানা খাম বের করলেন। আট দিন আগেকার লেখা চিঠি। আনু লিখেছেঃ
মা ,
কয়েকদিন তোমাকে কোন খবর দিতে পারিনি। কারণ আমাদের দুটো লড়াই লড়তে হয়েছে। মা, তোমার দোয়ায় দুটো লড়াইতেই আমরা জিতেছি। হানাদার পাকসেনাদের আমরা মেরে কুকুরের মত তাড়িয়ে দিয়েছি। দুইটা ঘাঁটি আমরা দখল করেছি। দুটো লড়াইয়ে আমরা ৮১ জন পাক সেনাকে খতম করেছি। তোমার দোয়ায় আমাদের কারো গায়ে আঁচড়টিও লাগেনি। জানো মা লড়াইতে যাওয়ার আগে আমি কিছুক্ষণের জন্য চোখ বুজে তোমার মুখটি স্মরণ করতাম আর আমার দেহে শক্তির বান ডাকতো কেন এমন হয় মা? আমার মনে হয় মায়েরাই সকল শক্তির উৎস। তাইতো আমরা দেশকে মা বলে ডাকি, বলি দেশ মাতা। আরেকটি খবর বলি মা, একটা ঘাঁটি থেকে আমরা তের জন মেয়েকে উদ্ধার করেছি। বর্বর দস্যুরা ওদের উলঙ্গ করে আটকে রেখে ওদের উপর পাশবিক অত্যাচার করত। সবগুলো মেয়ে রিজিয়ার বয়সী। উদ্ধার করার পর কি কান্না ওদের। দুজন আত্মহত্যাই করতে চেয়েছিল। আমি ওদের রিজিয়ার গল্প বলেছি। বলেছি রিজিয়াকে উদ্ধার করতে পারলে আমি ওকে বিয়ে করব, স্ত্রীর সম্মান দেবো। ওরা তাতে কিছুটা সান্তনা পেয়েছে। আমাকে ওরা ভাই বলে ডাকে। ওরাও মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছে। আমাদের হাসপাতালে মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা শুশ্রূষা করে।
মা, আমার দেশকে যারা ধ্বংস করেছে তাদের আমরা ধ্বংস করব। আমরা পশুদের বাংলার পবিত্র মাটি থেকে সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন করে দেবো। তুমি দোয়া করো মা, আমরা জিতব নিশ্চয় জিতবো। তোমার কোলে মাথা রেখে খুবই করে ঘুমাবো। কেমন? ইতি –
তোমার “আনু”
চিঠি পড়া শেষ হলো। আনুর মা ভাবির চোখ থেকে টসটস জল ঝরে পড়ছে।
কেঁদো না ভাবি। আনু নিশ্চয়ই ফিরবে। মন খারাপ করো না। আনুর মা ভাবিকে সান্তনা দিতে গেলাম।
মন খারাপ না খুশি লাগতাছে।আনু আমাগো দেশের লাইগ্যা লড়তাছে এর থাইকা আর খুশী কি অইবো। কারবালায় কাশেমের মাথায় কাসেমের মা যুদ্ধে যাওনের আগে পাগড়ী বাইন্ধা দিছিলো। আমিও নিজের হাতে ওরে কাপড় পরাইয়া দিছি। আনু আমার কাসেম। চোখের জল মুছে ফেলা আনুর মা ভাবি হাসলেন। তার সারা মুখে ছড়িয়ে পড়েছে একটি স্মরণীয় দীপ্তি। এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। বাংলাদেশের মেয়েরা এমনই বলে বাংলার মুক্তিবাহিনী সোনার ছেলেরা নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছে।
যশোর মুক্ত হওয়ার কাহিনী
ক্যান্টনমেন্ট যুদ্ধ
ক্যান্টনমেন্ট বলতে বোঝায় সৈন্যদের জন্য অস্থায়ী আবাসিক এলাকা। যুদ্ধের আগে, এ ধরনের সেনা সমাবেশ করা হয়। বাংলায় একে আমরা বলতে পারি সেনা শিবির। ভারত ও পাকিস্তানের ক্যান্টনমেন্ট শব্দটা পেয়েছে আলাদা মানে। এখানে ইংরেজি ক্যান্টনমেন্ট শব্দটা প্রয়োগ করা হয়, বেসামরিক শহর থেকে দু তিন মাইল দূরে আলাদা ভাবে তৈরি সামরিক এলাকা বা শহর। এখানে সেনাবাহিনীর লোকেরা থাকে স্থায়ীভাবে। অঞ্চলটি হয় নানাভাবে সুরক্ষিত।
বাংলাদেশ পাকিস্তান সরকারের পাঁচটি ক্যান্টনমেন্ট ছিল। এর মধ্যে সবচেয়ে পুরানো ঢাকা শহরের কাছে কুর্মিটোলা নামক জায়গার ক্যান্টনমেন্ট। ঢাকার পরেই আসে যশোর শহরের কাছে ও কুমিল্লা শহরের কাছে অবস্থিত ক্যান্টনমেন্ট দুটির কথা। চট্টগ্রাম শহরের কাছে ও ক্যান্টনমেন্ট আছে। সবশেষে তৈরি ক্যান্টনমেন্ট রংপুর ক্যান্টনমেন্ট। কিন্তু এই ক্যান্টনমেন্ট পুরোপুরি তৈরি হবার আগেই আরম্ভ হয় বর্তমান যুদ্ধ।
ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের পরেই যশোর ক্যান্টনমেন্ট এর গুরুত্ব। এই ক্যান্টনমেন্টে ছিল প্রায় এক ডিভিশন পদাতিক সৈন্য বাহিনী, পেট্রোল, ডিপো, হাসপাতাল, অস্ত্রাগার, সামরিক বিমান অবতরণের জন্য প্রায় এক মাইল লম্বা অবতরণ ক্ষেত্র। গোটা ক্যান্টনমেন্ট এলাকা সুরক্ষিত কংক্রিটের শক্ত বাঙ্কার দিয়ে। এখানে মাটির নিচে আছে অনেক প্রকোষ্ঠ, জলাধার, রসদ রাখবার স্থান। যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে সমস্ত সৈন্য পাঠিয়ে ও সমস্ত খুলনা বিভাগে ও রাজশাহী বিভাগে যুদ্ধ পরিচালনা করা যায়। যশোর ক্যান্টনমেন্টের দক্ষিনে বেনাপোল যশোর রোড। উত্তরে চৌগাছা যশোর রোড, পূর্বে ঢাকা রোদ ও তার পাশ দিয়ে রেল লাইন। এই রেল লাইন দিয়ে দক্ষিনে যাওয়া যায় খুলনায়। উত্তরে যাওয়া যায় রাজশাহী বিভাগের বিভিন্ন জায়গায়। এখানে এখন আছে পাঞ্জাবি, বালুচর, পাঠান রেজিমেন্টের লোক। আগে বেঙ্গল রেজিমেন্টের লোকেরা এখানে থাকতো। কিন্তু এই রেজিমেন্টের অনেক বাঙালি কে মেরে ফেলা হয়েছে বন্দী করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে অন্যত্র। আর কিছু আগেই পালিয়ে এসে যোগ দিয়েছে মুক্তিবাহিনীতে।
ক্যান্টনমেন্ট গুলো তৈরি করা হয়েছিল সৈন্যদের স্থায়ী ঘাঁটি হিসেবে। এখান থেকে সৈন্য, গোলাবারুদ, ট্যাঙ্ক, সাঁজোয়া গাড়ি, গোলন্দাজ বাহিনীকে অন্যত্র প্রয়োজনমতো পাঠাতে পারবার জন্য প্রস্তুত থাকত। যশোর ক্যান্টনমেন্ট ছিল উত্তর ও মধ্য বাংলার মূল পাক সামরিক ঘাঁটি বর্তমানে যশোর ক্যান্টনমেন্ট তিনদিক থেকে আক্রান্ত হওয়ার পর মুক্ত।
শরণার্থীর চিঠি
দেবেন্দ্রনাথ দত্ত
সভাপতি, পটুয়াখালী জেলা সাহিত্য পরিষদ, বাংলাদেশ
(পবিত্র ঈদ উপলক্ষে কলকাতা থেকে জয়বাংলা সম্পাদকের কাছে প্রেরিত)
আজ রমজানের পবিত্র ঈদ। মনে পড়ে অতীত বছরগুলির কথা। এমন দিন কত ঘরে মুসলিম ভাইদের দাওয়াত পেয়ে তাদের উৎসবের শরিক হতাম। আজ পড়ে আছি দুস্পার দুরে। পরে আছি গভীর বেদনা ভরা বুকে বাইরে জন্মভূমির কোলছিন্ন বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ। সাত পুরুষের আঙুল ধরে ভাই কাকা, চাচা, মামা, দাদু, দোস্ত এমনই নানা ডাকে যাদের সাথে চলে এসেছে আমাদের পৃথিবীর বাঁধন, তারা অনেকেই এখন আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে অলক্ষ্য দূরে। তাই দূর থেকে সেই ফেলে আসা ভাইদের প্রতি জানাচ্ছি এবারের ঈদ মোবারক।
আমরা কেন এলাম দেশ ছেড়ে। ইচ্ছে করে নয়, বাধ্য হয়েছি আসতে। আমরা বিতাড়িত হয়েছি। বাংলার দুষ্টগ্রহ নৃশংস অত্যাচার, সর্বস্ব লুন্ঠন, গণহত্যা, অগ্নিদাহ, মা বোনের উপর পৈশাচিক বর্বরতার বীভৎসতা -এমনি সব অবস্থা সৃষ্টি করেছিল, ভাইয়ের বিরুদ্ধে ভাইকে লেলিয়ে এমনি বিষময় করেছিল আমাদের বেঁচে থাকার বাতাস যার ফলে নিঃস বিপন্ন বিক্ষত হয়ে শেষটায় প্রতিবেশী দেশের দোরে আমাদের শ্রম প্রার্থী হওয়া ছাড়া গত্যন্তর ছিল না।
কিন্তু আপন মাতৃভূমি, আগ পুরুষের স্মৃতিমাখা ভিটে-মাটি, নিত্যদিনের মাঠ-ঘাট নদী-খাল আকাশ, গাছপালা, পাখি, আশৈশবের চেনা জানায় মাখামাখি প্রতিবেশীদের ছেড়ে কেউ কি পারে দীর্ঘদিন প্রবাসী জীবনে শান্তি পেতে? পারেনা। পাচ্ছিনা। তাই বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ শরণার্থী আমরা স্বদেশ মায়ের কোলে ফিরে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল।
দেশের মুসলমান ভাইয়েরা আজ পবিত্র ঈদের উৎসবে মুখরা মনের ময়লা ঝেড়ে সূচি শুদ্ধচিত্তে তারা জামাতে মিলে খোদার দরগায় মোনাজাত করবেন। এই মহতি অনুষ্ঠান এর আসলে তাদের মনে কি ঘটবে না স্বদেশ বিতাড়িত দুঃখী শরণার্থীদের স্মৃতির একটুখানি ছায়াপাত? তাদের প্রাণের তন্ত্রে বেজে উঠবে না কি আমাদের বেদনার সমতানে একটি করুণ সুর? আমরা জানি নিশ্চয়ই দেয়া হবে। তাই আবেদন করছিঃ আসুন এই পবিত্র দিনে এক আদম সন্তান আমরা বাংলার হিন্দু মুসলমান সকল ভাই অন্তরে অন্তরে সকল বেদনা বাসনা নিবেদনের পর বিশ্ব পিতার কাছে মোনাজাত করি যেন আমাদের বেদনা ও বিচ্ছেদের অবসান ঘটে, যেন পশু হাতের পেষনে বিতাড়িত বাংলার সন্তানেরা পূর্ণ নিরাপত্তা, পূর্ণ স্বাধীনতা নিয়ে ফিরে যেতে পারে স্বদেশের কোলে, প্রতিবেশীদের প্রীতির মাঝে; আসুন আমরাআরো মোনাজাত করি, যারা কুটিল চক্রের পৈশাচিক লীলায় ক্রীড়নক হয়ে বাংলার প্রতি মীরজাফরী বৃত্তিতে জড়িয়ে পড়েছেন তারা যেন এই পাপ মুক্ত হয় পবিত্র সুন্দর চিত্তে ভ্রান্ত পথ থেকে ফিরে আসে।
চক্রান্তকারীদের মতলব ছিল তার জাগ্রত বাংলাকে জ্ঞানে, অর্থে, জনতায় দুর্বল করে বুকের পরে চিরকাল করবে প্রভুত্বের মসনদ আর চিরকাল অক্টোপাসের মতো চালিয়ে যাবে শোষণ। তাদের সেই বর্বর বাসনা অলীক স্বপ্নে পরিণত হতে চলছে। খোদার রাজ্যে শয়তানীর দাপট চলতে পারে না বেশিদিন। একদিন নির্ঘাত নেমে আসে তার উপর তাঁর কঠিন ন্যায়দন্ড।
সেই ন্যায়দন্ড নেমে এসেছে মুক্তিকামী আহত বাঙালির রক্ত শিরায়। নইলে কেন ওই বঙ্গবন্ধু? কিসের উদ্দীপনায় সহস্রফণা বাসুকীর মতো ফুসে উঠেছে বাংলার তরুণরা। কোন অগ্নি বলে বলিয়ান হয়ে ক্ষীণকায় অসামরিক বাঙালির সন্তানেরা দুর্বল হয়ে মৃত্যুর পানে তুলে ধরেছে পাঞ্জা, দুর্জয় সাহসের মরন আহবে হোলি খেলছে দুর্ধর্ষ শত্রু দানবের রক্তে?
বাংলার স্বর্ণপ্রভা উদয়ের পথে। তার অরুণ ছটায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে এমন বাংলা যেখানে থাকবে না কোন শোষণ-নির্যাতন, দারিদ্র্যের পেষণ, বাইরের কোনো প্রভুয়ানা ব্যক্তি স্বাধীনতার কোন বাঁধা; ধানের চালে, দুধে মাছে, বারো মাসে তেরো পার্বণে প্রতিবেশীর পারস্পারিক অনাবিল আবার হাসবে আমাদের সুজলা শ্যামলা কনকভূষণা স্নেহময়ী বাংলা মা
আসুন পরম পালক মঙ্গলময়ের চরণ তলে মোনাজাত করি। সেই শুভ আগমনে কে আমরা স্বাগত জানাতে পারি। জয় বাংলা।
নৃশংস হামলা
(৪) অনেকেই ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পালাতে চেষ্টা করে। তারা গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারায়। তারপর সৈন্যরা গৃহে গৃহে তল্লাশি শুরু করে তারা হাতের কাছে যা পেয়েছে -অলংকার নগদ টাকা সবকিছু পকেটস্থ করে। তারা এসময় আরও বহু লোককে হত্যা করে। কয়েকটি গৃহে তারা হাতবোমা নিক্ষেপ করে। এ নারকীয় হত্যাযজ্ঞ সারারাত ধরে চলে। এ এক ভয়াবহ দৃশ্য। প্রাণ ভয়ে ভীত মানুষের সকরুণ কান্নার বিবরণ দান দুঃসাধ্য।
রক্তদ্বারা বঙ্গবন্ধুর মুক্তি অর্জিত হবে
-খন্দকার মুশতাক
ভারত বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি প্রদান করায় গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদ আশা প্রকাশ করেন যে, বাংলাদেশ ও ভারতের মৈত্রী চিরস্থায়ী হবে এবং শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থান ও পঞ্চশীল আদর্শের এক বিরাট স্তম্ভ হয়ে থাকবে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াশিংটন ও পিকিংয়ের ভূমিকা সমালোচনা করেন এবং সোভিয়েত সরকারের নীতির প্রশংসা করেন। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, বঙ্গবন্ধুকে যেকোনো মূল্যে মুক্ত করতে হবে। রক্তদ্বারা যদি স্বাধীনতা অর্জিত হতে পারে, তবে রক্তদ্বারা বঙ্গবন্ধুর ও মুক্তি অর্জিত হবে।
অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির ভাষণ
“বাত্যা তাড়িত সাগর পাড়ি দিতে সক্ষম হয়েছি”
‘আজ আমরা ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সমুদ্র পাড়ি দিতে সমর্থ হয়েছি। বিধায়ক দুর্ভাগ্যের অমরা ত্রিশেষে সম্ভাবনাময় মরুর ঊষা সমাগত। তার রজত রেখা দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের দিগন্ত স্বাধীনতার পূর্ণ আলোকে উদ্ভাসিত।’
আমাদের অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত বেতার ভাষণে আবেগ প্রকম্পিত ভাষায় উপরোক্ত আশা প্রকাশ করেন। গত ৭ই ডিসেম্বর তিনি উক্ত বেতার ভাষণ দেন।
তিনি জাতির মহৎ প্রাপ্তির মুহূর্তে দেশবাসীকে গভীর কৃতজ্ঞতা ও অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, আজ আমরা জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় প্রবেশ করেছি। আমাদের বন্ধু প্রতিবেশী গণতন্ত্রের মহান পাদপীঠ, ভারত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ কে স্বীকৃতি দিয়েছেন।
পাক সামরিক জান্তার মুখোশ উন্মোচন করে বিশ্ব জনমত গঠনের জন্য এবং বিশ্ব সমাজের কাছে বাংলাদেশের জনগণের ন্যায্য দাবীকে উপস্থাপন করার ব্যাপারে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আট মাস ব্যাপী “অনলস -প্রয়াসের” প্রশংসা করে তিনি বলেন অনিবার্য বিজয়ের লগ্নে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে আমি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবুর রহমানকে স্মরণ করি। পরম লগ্নে তিনি আজ আমাদের মধ্যে নেই। বর্বর পাকিস্তানি (জানোয়ারদের) কারাগারে তিনি দুঃসহ বন্দী জীবন যাপন করছেন। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের মহৎ সন্তান কি উদ্বিগ্নতার মধ্যে আছেন আমরা জানি না।
প্রত্যয় দৃঢ় কন্ঠে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেন, আমাদের মধ্যে তিনি স্বাধীনতার উদ্দীপনা জাগিয়েছিলেন, বিজয়ের লক্ষ্যে যার আদর্শ আমাদের পথপ্রদর্শক তার স্বপ্ন সার্থক করে তাকে দেখাতে আমরা তাকে আমাদের মধ্যে ফিরে আনবোই। আমরা প্রতিজ্ঞা করছি এই লক্ষ্যে আমরা আমাদের সর্বাত্মক প্রয়াস চালিয়ে যাবই।’
তিনি বিশ্বের স্বাধীনতাপ্রিয় নাগরিকদের গণতন্ত্রের বিজয় এর জন্য গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ কে স্বীকৃতি দানের জন্য আহ্বান জানান। তিনি আশা প্রকাশ করেন যে অচিরেই বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবেন। (অসমাপ্ত)
জয় বাংলা
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাপ্তাহিক মুখপত্র
প্রথম বর্ষ, ৩২শ সংখ্যা, মুজিবনগর, মঙ্গলবার ২৭শে অগ্রহায়ণ,। ১৩৭৮ ১৪ই ডিসেম্বর, ১৯৭১
দিকে দিকে মুক্ত বাংলার জয়ধ্বনি
যশোরসহ মুক্তাঞ্চলের বিভিন্ন জনসভায় রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রীর নীতিনির্ধারণী ভাষণঃ
সর্বত্র জনমনে বিপুল উল্লাস
গোটা বাংলাদেশের মুক্তি যখন আসন্ন, তখন যশোর থেকে ঢাকায় প্রান্তদেশ পর্যন্ত প্রকম্পিত জয় বাংলা’র বিজয় নিনাদে। যশোর ও মুক্তাঞ্চলের অন্যান্য জনসভায় প্রদত্ত ভাষণে রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ স্বাধীনতাকে রক্ষা ও সংহত করার কাজে দেশবাসীকে সজাগ থাকার উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন।
(বিস্তারিত খবর পরবর্তী সংখ্যায়)
প্রধানমন্ত্রীর বেতার ভাষণের পূর্ণ বিবরণ
[ আমাদের গত সংখ্যায় প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন কর্তৃক উদ্দেশ্যে গত ৮ই ডিসেম্বর প্রদত্ত বেতার ভাষণের অংশবিশেষ প্রকাশিত হয়েছে। এখানে তাঁর হিসেবে তার ভাষণের পূর্ণ বিবরণ দেওয়া হলো। ]
দেশবাসী সংগ্রামী ভাইবোনেরা,
পাকিস্তানি সমর নায়কেরা আজ সারা উপমহাদেশে এক সর্বনাশা যুদ্ধ ডেকে এনেছে। বাংলাদেশে তাদের শান্তি ও অপরাধের পরিণতি যে এ পথে ঘটবে গত কয়েক মাস থেকেই তা বোঝা যাচ্ছিল।
একদিকে মুক্তিবাহিনীর হাতে পাকিস্তানি সৈন্যদের লজ্জাজনক বিপর্যয় এবং অন্যদিকে বাংলাদেশের জনগণের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামের প্রতি ভারতের আন্তরিকতাপূর্ণ সমর্থন এই পট-ভূমিকায় পাকিস্তান ভারত কে আক্রমণ করেছে।
উভয়ের শত্রু এক
ভারত ও বাংলাদেশের বিপদ এসেছে একই শত্রুর কাছ থেকে। এর ফলে দুই দেশের মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক নিবিড় হয়েছে। মুক্তিবাহিনীর ও ভারতীয় সৈনিকেরা এখন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করছে- উভয়ের মিলিত রক্তধারায় রঞ্জিত হচ্ছে আমাদের দেশের মাটি। ইতিহাস এই দুদেশের মানুষের জীবনের যে পথ নির্দেশ করেছে এই রক্ত ধার সেই মৈত্রীর বন্ধন রোহিত হলো। ভারতের জনসাধারণ অনেক আগেই আমাদেরকে স্বীকৃতি দিয়েছেন তাদের অন্তরে। এখন তাদের সরকার গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি জানিয়েছেন। বাংলাদেশের সর্বশ্রেণীর জনসাধারণের পক্ষে এ এক বিজয়- বিজয় তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের আর বিজয় তাদের মুক্তিবাহিনীর।
স্বাধীন ও সার্বভৌম জাতি হিসেবে আমাদের কূটনৈতিক স্বীকৃতি লাভ আজ সম্ভব হল অগণিত শহীদের রক্তের বিনিময়ে, মুক্তিবাহিনীর দুঃসাহসিক তৎপরতা, অপূর্ব আত্মত্যাগ ও দুর্ভেদ্য ঐক্যের ফলে। এ বিজয় ভারতের জনসাধারণের ও বিজয় বাংলাদেশের স্বীকৃতির বিষয়ে তাদের সর্বসম্মত অভিপ্রায় আজ বাস্তবে রূপায়িত হলো।
ভারতের স্বীকৃতি দান একটি মহান ঘটনা
স্বাধীন জাতি হিসেবে আমাদেরকে জগৎসভায় সর্বপ্রথম স্বাগত জানিয়েছে ভারত। পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের পক্ষে এটাই স্বাভাবিক। এক কোটি ছিন্নমূল বাঙালির পরিচর্যায় ক্লেশ স্বীকার করে এবং বাংলাদেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার জন্য যুদ্ধের আপদ বহন করে মানবতা ও স্বাধীনতার আদর্শের প্রতি নিষ্ঠার পরিচয় ভারত দিয়েছে, তা বর্তমানকালের এক আশ্চর্য ঘটনা রূপে বিবেচিত হবে।ভারতের এই দৃঢ়তাপূর্ণ সিদ্ধান্তে আমরা আনন্দিত।
আমাদের রাষ্ট্রীয় জীবনের ভিত্তিমূলে এই ঐতিহাসিক অবদানের জন্য আমরা ভারতের জনসাধারণ, পার্লামেন্ট, সরকার ও প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর রাষ্ট্রনায়কোচিত প্রজ্ঞায় বাঙালি জাতি অপরিসীম কৃতজ্ঞতা বোধ করছে। ভারতের স্বীকৃতিদান একটি মহৎ ঘটনা। ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের ভিত্তি হবে পরস্পরের জন্য মৈত্রী ও শ্রদ্ধাবোধ। বিপদের দিনে যুদ্ধের দুর্যোগের মধ্যে ভারতীয় জনসাধারণের সঙ্গে যে সম্পর্ক আমরা প্রতিষ্ঠিত করলাম, সম্পদে ও শান্তির কালে তা অক্ষুন্ন থাকবে এবং আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তা উভয় জাতির স্থায়ী কল্যাণ সাধন করবে।
ভারতের পরে ভুটান স্বীকৃতি দিয়েছে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে। এর জন্য আমরা ভুটানের রাজা ও জনসাধারণের নিকট কৃতজ্ঞ।
বঙ্গবন্ধু সর্বদাই বাঙালীর অন্তরে জাগরুক
বাংলাদেশের মানুষের এই আনন্দের মুহূর্ত ম্লান হয়ে গেছে বিষাদের ছায়ায়। বাংলাদেশের স্বপ্ন যখন আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাস্তবে রূপায়িত হল তখন সে স্বপ্নের দ্রষ্টা বাংলাদেশ জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান শত্রুর কারাগারে বন্দী হয়ে আছেন। দেশবাসীর নিকট অথবা দূরে যেখানেই থাকুন না কেন বঙ্গবন্ধু সর্বদাই জাগরুক রয়েছেন তাদের অন্তরে। যে চেতনা আমাদের অতীতকে রূপান্তরিত করেছে তিনি সেই চেতনার প্রতীক; শাহরুখ কাহিনী ভবিষ্যতে আমাদের জাতিকে যোগাবে ভাব ও চিন্তা। তিনি সেই কাহিনীর অংশ। তবু এই মুহূর্তে তার অনুপস্থিতিতে আমরা সকলে বেদনার্ত।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের নীতি
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে যখন প্রগতিশীল রাষ্ট্রের স্বাগত জানানো উচিত আমাদের নতুন রাষ্ট্রের আদর্শ হলো শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান আন্তর্জাতিক নিরপেক্ষতা এবং সর্বপ্রকার সাম্রাজ্যবাদ উপনিবেশিকবাদের বিরোধিতা করা। আমরা গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী। সাড়ে সাত কোটি মানুষের বাস্তব অস্তিত্ব স্বীকার করে ভারত ও ভুটানের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করার জন্য আমি সকল রাষ্ট্রকে ওপেন করছি।
পশ্চিম পাকিস্তানিদের ধ্বংস ডেকে এনেছে
পশ্চিম পাকিস্তান সরকার যে অমঙ্গলের সূচনা করেছে বাংলাদেশে, পরিণামে তা-ই আজ তাকে ধ্বংস করতে চলেছে। এই অবশ্যম্ভাবী পরিণতি থেকে তার পৃষ্ঠপোষকেরা তাকে বাঁচাতে চেয়েছে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে কিন্তুসে প্রয়াস ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশের সংঘর্ষের মূল কারণ বিবেচনা না করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই উপমহাদেশে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব করেছে, তা মার্কিন সরকারের অন্ধতা ও বিকৃত বিচারবুদ্ধির পরিচায়ক। চীন ও একইধরনের বিচারবুদ্ধি হীনতার পরিচয় দিয়েছে। তাই নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো প্রয়োগ করার সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি বাংলাদেশের মানুষ কৃতজ্ঞ।…..(অসমাপ্ত)
জানোয়ার নিধনের সংগ্রাম চলবে
মুক্ত কালীগঞ্জে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তৃতা
আমাদের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী জনাব কামরুজ্জামান, আওয়ামী লীগ নেতা শ্রী ফনিভূষণ মজুমদার ও জনাব তোফায়েল আহমেদ সমভিব্যাহারে খুলনার মুক্ত এলাকা কালিগঞ্জ পরিদর্শন করেন। তাদের সাথে বাংলাদেশ সরকারের কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মচারী ও কালিগঞ্জ গমন করেন। মন্ত্রী সরকারি কর্মচারীদের সাথে এলাকায় প্রশাসন ব্যবস্থা চালু করা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করে পালনীয় কর্তব্য সম্পর্কে নির্দেশ দেন।
বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কালিগঞ্জ সফর উপলক্ষে এক বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। তিনি ডাকবাংলো এলাকায় লাখো শহীদের রক্তে রঞ্জিত বাংলাদেশের পতাকা উড্ডিন করেন।
জনাব জামান জনসভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে হানাদার বাহিনীর একটি জানোয়ার বাংলাদেশের পবিত্র মাটিতে অবশিষ্ট থাকা পর্যন্ত মুক্তির সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্য জনগণকে আবহাওয়া জানান।
কোন রাষ্ট্রের নাম উল্লেখ না করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন,” বৃহৎ শক্তি তারা তাদের রাজনীতি করে যাক। আমরা আমাদের কাজ করে যাব।”
তিনি শেখ মুজিবের ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গঠনের ওয়াদার কথা জনগণকে স্মরণ করিয়ে দেন এবং মজুদদারী ও কালোবাজারি সম্পর্কে সতর্ক করে দেন।
জনাব জামান ঘোষণা করেন যে জাতীয় সমাজ বিরোধী কাজে লিপ্ত ব্যক্তিদের প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হবে।
বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চলে কতক্ষণ
সম্প্রতি বাংলাদেশের সদ্য মুক্ত কালিগঞ্জ অঞ্চল ঘুরে এসে জনৈক সাংবাদিক একটি প্রভাবশালী বিদেশী পত্রিকায় তার রিপোর্ট প্রকাশ করেন। নিরপেক্ষ সাংবাদিক আমাদের বীর মুক্তিসেনাদের প্রাজ্ঞ নেতৃবৃন্দের এবং জনগণের ভূয়সি প্রশংসা করেন। মুক্তাঞ্চলে বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসন ব্যবস্থার দ্রুত অগ্রগতি এবং বিভিন্ন ত্বরিত-প্রকল্পের বাস্তবায়নে সরকারি কর্মচারীদের আগ্রহও নৈপুণ্য এবং জনগণের সর্বাত্মক সহযোগিতার কথা উল্লেখ করা হয়। ভারতে আশ্রয়প্রাপ্ত শরণার্থীরা মুক্তাঞ্চলে দলে দলে ফিরে যাচ্ছেন বলে রিপোর্টে দাবি করা হয়। তিনি লিখেছেন যে শহরকে রক্ষা করার জন্য পাক ফৌজ ১৬০ টি বড় বড় বিবরঘাঁটি তৈরি করেছিল, যে শহরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার জন্য পাক কর্তৃপক্ষ খান সেনা এবং আনসার মিলিয়ে প্রায় সাড়ে সাতশ জয় করেছিল, সেই শহর কালীগঞ্জ এখন মুক্ত।”
রণবিধ্বস্ত কালীগঞ্জে আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবু হেনা মোঃ কামরুজ্জামান, জননেতা শ্রী ফণী মজুমদার, ছাত্র নেতা জনাব তোফায়েল আহমেদ এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের মধ্যে অর্থ সেক্রেটারী জনাব কে জামান ও আইজি পুলিশ জনাব এম এ খালেক , শত সহস্র স্বাধীন বাঙালির কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে জয় বাংলা স্লোগান দিয়েছিলেন। সেই আনন্দময় মুহূর্ত নিরপেক্ষ সাংবাদিক ও স্লোগান দিয়েছিলেন জয় বাংলা। তিনি বলেন, ইছামতির তীরে মুক্ত বাংলাদেশের শত শত স্বাধীন বাঙালির সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে জয় বাংলা বলে এলাম।
কিছুদিন পূর্বেও দক্ষিণ বাংলাদেশের একটি বিশিষ্ট বাণিজ্যকেন্দ্রে জয়বাংলা শব্দটি উচ্চারণ করলে মৃত্যুদণ্ড অবধারিত ছিল। কালিগঞ্জ ছিল পাকসেনাদের অধিকারে। প্রায় ২৫ হাজার অধিবাসী অধ্যূষিত শহর একেবারে ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল। সাত মাস পর দেশে জনশূন্য কালীগঞ্জে আবার জীবনের জোয়ার অনুভূত হচ্ছে। তিনি লিখেছেন, যারা দূর-দূরান্তে গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন যারা বেশ কয়েক মাইল পায়ে হেঁটে এবং ইছামতি ও কালিন্দী নদী পেরিয়ে ভারতে চলে গিয়েছিলেন তারা দ্রুত ছেড়ে আসা শহরে ফিরে যাচ্ছেন। ফিরে আসছেন মুসলমানরা, ফিরে আসছেন হিন্দুরাও।
কিন্তু যে কালিগঞ্জ তারা ছেড়ে গিয়েছিলেন এ সেই কালিগঞ্জ নয়। তিনি বলেন, এ এক অন্য কালিগঞ্জ একটি বর্ধিষ্ণু থানা শহরের ধ্বংসাবশেষ। মাত্র গোটা শহরের সর্বত্র তারা শত্রু বিবর ঘাঁটি তৈরি করেছিল। প্রত্যেকটি ঘাঁটিতে, প্রত্যেকটি সেনা শিবিরে, প্রত্যেকটি মোড়ে। এমনকি মসজিদেও তারা বিবর ঘাঁটি তৈরি করেছিল। আজিমগঞ্জ এর দিকে মসজিদের উপর তারা শত্রু ঘাঁটি তৈরি করেছিল, প্রস্রাবাগার সহ।
গত ১৯শে নভেম্বর যখন আমাদের বীর মুক্তিসেনা দিক থেকে আক্রমণ শুরু করলেন। তখন কাপুরুষ পাকসেনাদের বীরত্বের পরিচয় পাওয়া গেলো। উক্ত সাংবাদিক লিখেছেন, নাজিম গঞ্জের দিকটা ছেড়ে তারা সরে এলো সেই দিনেই। চলে গেছ
ল পূর্ব ইছামতির পূর্ব পাড়ে। সেখানে বাঙ্কারগুলোতে আশ্রয় নিয়ে শুরু করলো প্রচন্ড গোলাবর্ষণ। সারারাত লড়াই চলল । শনিবার বেলা বারোটা নাগাদ পাক সেনাবাহিনী এবং তাদের সরকারি রাজাকার ও শান্তি কমিটির সদস্যরা কালিগঞ্জ ছেড়ে পালালো। সে কি পলায়ন। ট্রাক এবং বাসে বোঝাই হয়ে বীর সেনা বাহিনীর পশ্চাদপসরণ এত দ্রুত পালাতে হল যে তাদের ট্রেনিং ক্যাম্পের অধ্যক্ষ এক বালুচ অফিসার কে ছেড়ে পালাতে হলো। বেচারা এখন মুক্তিবাহিনীর বন্দি।
সাংবাদিক সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিয়েছেন অবরুদ্ধধ কালীগঞ্জের। তার ভাষায় রেকর্ড? বহু লোক নিহত ও বহু নারী ধর্ষিতা। বহু শূন্য গৃহ লুণ্ঠিত। আমরা যখন কালিগঞ্জ পৌছালাম অসংখ্য মানুষ এগিয়ে এলেন পাকসেনাদের সেই অত্যাচারের বর্ণনা দিতে।
মুক্ত হয়ে যাবার কালীগঞ্জে কি পরিমান লোক ফিরে এসেছেন জানতে চাইলে তাকে কালীগঞ্জের অন্যতম ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান জনাব মোহাম্মদ ইসমাইল গাজী বলেন যারা গ্রামে পালিয়ে গিয়েছেন তাদের শতকরা ৫০ জন, যারা ইন্ডিয়া চলে গিয়েছিলেন তাদের সিকি ভাগ ফিরে এসেছেন,
তিনি লিখেছেন শুধু কি মুসলমানরাই ফিরেছেন পাশ থেকে এগিয়ে দেন বিষ্ণু কুমার দাস। না আমরাও ফিরেছি। জয়বাংলা হিন্দু-মুসলমানের সব্বাইরেই জয় বাংলা। এখানে কারোরই ভয় নেই। আমরা সবাই বাঙ্গালী।
তিনি বলেন এ বিধ্বস্ত মুক্ত অঞ্চলে প্রশাসন ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের ব্যবস্থা করতেই এসেছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর জনাব কামরুজ্জামান। সঙ্গে এসেছিলেন অন্যান্য নেতৃবৃন্দ এবং উচ্চ পদস্থ অফিসার। একটা জনসভা হল কামরুজ্জামান সাহেব এর আগমনের সঙ্গে সঙ্গে। লোক এসে পিলপিল করে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর আশ্বাস দিলেন সবরকম ব্যবস্থা করা হবে। বাংলাকে রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের সকলের।
পাশে বসে কথা বলছিলাম বাংলাদেশ সরকারের অর্থ সচিব জনাব জামান এর সঙ্গে। বললেন এখন বিরাট দায়িত্ব আমাদের। ত্রাণের ব্যবস্থা চাই, নিয়মিত ভালো তেল, নুন সরবরাহের বন্দোবস্ত করতে হবে। ব্যবসা-বাণিজ্য আবার চালু করতে চাই। চাষবাস অবিলম্বে শুরু করে দিতে হবে। বিরাট দায়িত্ব।
ফনি বাবু এবং তোফায়েল কথা বলছিলেন ছাত্র ও যুব নেতাদের সঙ্গে। যাতে তারা নতুন বাংলা গড়ার কাজে প্রত্যেকটি অঞ্চলে নেতৃত্ব দেন। ৭০ বছরের বৃদ্ধ এবং ৩০ বছরের ছাত্রনেতা একসঙ্গে যুব শক্তিকে সংগঠিত করার কাজে লেগেছেন। উক্ত সাংবাদিক আশা প্রকাশ করেছেন এভাবে এই সম্মেলনের কথাই ভাবছিলাম কালিন্দী আর ইচ্ছামতীর সঙ্গমস্থলে। লঞ্চ থেকে দেখতে পাচ্ছিলাম ওদের একটা বড় বাঙ্কার। একশ ষাটটার একটা। মনে হচ্ছিল যদি নবীন ও প্রবীণ নেতৃত্ব বাংলাদেশের যুব শক্তিকে ঠিক পথে চালাতে পারেন তাহলে একশ ষাট হাজার বাংকার গড়েও পৃথিবীর কোন শক্তি ও দেশকে পরাধীন রাখতে পারবে না।
পাক অর্থনৈতিক সঙ্কট চূড়ান্ত পর্যায়ে
(অর্থনৈতিক ভাষ্যকার)
বর্তমানে যুদ্ধের ফলে পাক অর্থনীতিতে যে চাপ সৃষ্টি হয়েছে তা এখন চূড়ান্ত রূপ ধারণ করেছে। কয়েক মাস আগে পাকিস্তানের প্রভাবশালী পত্রিকা পাকিস্তান টাইম বলা হয়েছিল, পাকিস্তানের মোট জাতীয় উৎপাদনের হার দ্রুত অবনতির পথে চলেছে। পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়ন হার ১৯৪৯ সালে যেখানে ছিল শতকরা ৬.৬ ভাগ সেখানে ১৯৭০-৭১ সালে দাঁড়িয়েছে শতকরা ১.৪ ভাগ। পত্রিকাটিতে বলা হয়েছিল, ১৯৭০-৭১ পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা দুর্বৎসর।
বর্তমানে করাচি মর্নিং নিউজ পত্রিকা প্রকাশিত সম্পাদকীয় থেকে জানা যাচ্ছে যে পাকিস্তান তার যুদ্ধের ব্যয় ভার বহন করবার জন্য এখন একটি আনুষঙ্গিক বাজেট পাস করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে। ১৯৭১-৭২ সালে পাক বাজেটে মোট প্রত্যাশিত রাজস্বের পরিমাণ দেখানো হয়েছিল ছ’শত কোটি টাকার কিছু বেশি। এই ছ’শত কোটি টাকার মধ্যে ৩৪০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল প্রতিরক্ষা খাতে অর্থাৎ অর্ধেকের বেশি অর্থ বাজেটে বরাদ্দ করা হয়েছিল সামরিক ব্যয় হিসেবে। কিন্তু মর্নিং নিউজ এর সম্পাদকীয় থেকে বোঝা যাচ্ছে, এই টাকায় পাকিস্তান বর্তমান সামরিক ব্যয় মেটাতে পারছে না। তাই তার প্রয়োজন হচ্ছে একটি আনুষঙ্গিক বাজেট পাশ করবার। ১৯৭০-৭১ সালের বাজেট উত্থাপন করেন ইয়াহিয়ার অর্থনৈতিক উপদেষ্টা এম এম আহমদ। তিনি বাজেট বক্তৃতায় বলেন পাকিস্তান এক অপ্রত্যাশিত সংকটজনক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে চলেছে। পাকিস্তানকে ব্যয় সংকোচন নীতি গ্রহণ করতে হবে। তাঁকে কৃচ্ছ্রসাধন করতে হবে। কিন্তু জুন মাসে পাস করা এই কৃচ্ছ্রসাধনের বাজেট ও পাকিস্তান এখন আর কুলিয়ে উঠতে পারছেনা। আরো অর্থ চাই বাংলাদেশে যুদ্ধ চালাবার জন্য।
পাকিস্তানের অর্থনৈতিক সংকটের চেহারা নানা দিকেই বিশেষভাবে প্রকট হয়ে উঠেছে। পাকিস্তানের স্টেট ব্যাংকের সাধারণ ইন্ডেক্স থেকে দেখা যাচ্ছে যে ১৯৬৫ সালে শেয়ার দর এর সর্বনিম্ন ইন্ডেক্স যা ছিল, তা থেকে বর্তমান ইন্ডেক্স ইতিমধ্যে এসে দাঁড়িয়েছে ১.৫ এর নীচে।
সরকার পক্ষ থেকে বর্তমানে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক সংকট রোধ করবার জন্য “ন্যাশনাল ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাষ্ট”, “পাকিস্তান ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন, ও “করাচী স্টক এক্সচেঞ্জ-এর প্রতিনিধি নিয়ে উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হয়েছে। তাদের বলা হয়েছে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক সংকট রোধের জন্য কি কি ব্যবস্থা সরকার গ্রহণ করতে পারে তার সুপারিশ করার জন্য সরকার বিভিন্ন চেম্বার অব কমার্স কে অনুরোধ করেছে আনুষঙ্গিক বাজেটে কিভাবে অর্থ সংগ্রহ সম্পর্কে উপদেশ দিতে।
যুদ্ধের জন্য পাক সরকারের উপর চেপে বসছে বিরাট ঋণের বোঝা। যে টাকা বাজারে পণ্য উৎপাদনের জন্য নিয়োজিত হতো, তার আরও একটা বিরাট অংশ এখন চলে যাবে যুদ্ধের খাতে। স্থলে পাকিস্তানের পুঁজিবাজারে আরো বিশদভাবে দেখা যাবে মন্দাভাব। সৃষ্টি হবে ব্যবসা-বাণিজ্যে সম্পূর্ণ অচলাবস্থা।
পাক সরকার ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে
বিখ্যাত মার্কিন দৈনিক পত্র ওয়াশিংটন পোস্ট এর এক খবরে প্রকাশ বাংলাদেশ-পাকিস্তান সংকটের সম্মুখীন হয়ে পড়েছে। তাদের সরকার ব্যবস্থা পুরোপুরি বানচাল হয়ে গিয়েছে। সরবরাহ লাইন নষ্ট হবার ফলে প্রায় ৭০ হাজার পাকিস্তানি সৈন্য বাইরে থেকে আর কোন কিছু আনতে পারছে না। এইসব সৈন্যকে এখন কেবল ইপিআই এর বিমান গুলির উপর নির্ভর করতে হচ্ছে। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় এই বিমান সরবরাহ কে যথেষ্ট বলা যায় না।