You dont have javascript enabled! Please enable it!

বঙ্গবন্ধুর চিন্তাধারায় সামাজিক বিপ্লবের

গতি-প্রকৃতি উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য

পূর্বাধ্যায়সমূহে আমরা বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক চিন্তাধারার ইতিহাসিক ও দার্শনিক ভিত্তি এবং তাঁর গৃহীত ও পরিকল্পিত পদক্ষেপগুলাে সম্পর্কে কিছু বিস্তৃত আলােচনা করেছি। তাঁর জীবনের সমগ্র রাজনৈতিক আর্থ-সামাজিক প্রশাসনিক চিন্তাধারা ও কর্মসূচী সম্পূর্ণভাবে প্রতিফলিত হয়েছে তার দ্বিতীয় বিপ্লব’ তথা বাকশাল ব্যবস্থার মধ্যে। কিন্তু অতি দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে, বাকশাল কর্মসূচীকে তিনি বাস্তবায়িত করার কোনােই সময় সুযােগ পাননি। বাংলাদেশের ব্যাপক শােষিত অবহেলিত অজ্ঞ দরিদ্র সাধারণ মানুষ তাই বাকশাল বা দ্বিতীয় বিপ্লব’ সম্পর্কে কোনােই ধারণা নিতে পারেনি এবং বুঝতে সুযােগ পাননি যে, উক্ত ব্যবস্থাগুলাে বাস্তবায়িত হলে। তাদের জীবনে কি ফলাফল প্রতিফলিত হতাে। কিন্তু তথাকথিত শিক্ষিত ও রাজনীতিসচেতন মানুষগুলাে কি কিছু বুঝতে বা ঠাওর করতে পেরেছিলেন। বুঝতে চেষ্টাও কি করেছিলেন ? মােট কথা, বাংলাদেশের মানুষ বঙ্গবন্ধুর চিন্তাধারা ও পরিকল্পিত কর্মসূচীর সুদূরপ্রসারী ফলাফল নির্ণয় করতে পেরেছিলেন কিনা জানি না, তবে সাম্রাজ্যবাদ, পেট্রোডলারী সাম্রাজ্যবাদ ও চৈনিক হঠকারীবাদ এবং তাদের এদেশীয় সেবাদাস এজেন্ট অনুচর রাজনীতিকরা ও শােষকগােষ্ঠী এর ফলাফল ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাদের ফাইনান্স ক্যাপিটালের লীলাখেলা, শােষণ, প্রতিপত্তি ও রাজনৈতিক (পুঁজিবাদী রাজনীতি) আধিপত্যবাদকে বাংলার মাটি থেকে চিরদিনের মতাে ঝেটিয়ে বিদায় দিচ্ছেন, এটাই তারা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তাই তারা হাত-পা গুটিয়ে নীরবে নিভৃতে সুবােধ শিশুর মতাে বসে থাকেনি। তারা রাতের অন্ধকারে ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করতে লাগলাে। এমনি অবস্থায় তারা সামরিক বাহিনীর কতিপয় বিপথগামী উচ্চাভিলাষী সদস্যদের মােটা অংকের টাকায় ভাড়া করে ও ক্ষমতার লােভ দেখিয়ে, তাদের দিয়ে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট সপরিবারে নির্মমভাবে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে এবং তারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কুক্ষিগত করে।

যে বৈপ্লবিক পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে সামজিক বিপ্লবের প্রেক্ষাপট রচনা করে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশে একটি শােষণহীন সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে যাচ্ছিলেন, দেশী বিদেশী প্রতিক্রিয়াশীল প্রতিবিপ্লবী গণবিরােধী সমাজতন্ত্র বিরােধীচক্র সেই বিপ্লবের ধারাকে উল্টোপথে প্রবাহিত করার যাবতীয় কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে থাকে, যার ফলে মাত্র ক’ বছরের মধ্যে ২ জন কোটিপতির স্থলে কয়েক শতাধিক কোটিপতি পরিবারের জন্ম হয়েছে, ভূমিহীন কৃষকের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬৫% ভাগ। জনসাধারণের ঐক্য হয়েছে অবাধ-মুক্ত বা তথাকথিত বহুদলীয় রাজনীতির হােলিখেলায় পর্যদস্ত। জনসাধারণ হচ্ছে শােষিত অবহেলিত লাঞ্চিত। তাদের অধিকাংশের পেটে ভাত নেই, পরনের বস্ত্র নেই , মাথা গোঁজার ঠাই নেই, শিক্ষার সুযােগ নেই, তাদের চিকিৎসার সুযােগ নেই। তারা আজ সর্বশান্ত-সর্বহারা । এটাই হলাে ১৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলাফল; প্রতিবিপ্লবী অভ্যুত্থানের অনিবার্য পরিণতি। কিন্তু প্রকৃত বিপ্লবের অর্থ এ সবের সুষ্ঠুভিত্তিক সমাধান, যে বিপ্লব বঙ্গবন্ধু শুরু করেছিলেন। এ অধ্যায়ে আমরা বঙ্গবন্ধুর চিন্তাধারায় সামাজিক বিপ্লবের অর্থ, এর গতিপ্রকৃতি, পার্টি ও জনগণের সাথে বিপ্লবের কী সম্পর্ক এবং বিপ্লবীদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য কী, সে বিষয়ে আলােচনা করতে চাই। কারণ সামাজিক বিপ্লব ব্যতীত শশাষণহীন সমাজতান্ত্রিক সমাজ কল্পনাও করা যায় না। রাজনৈতিক দর্শন যেমন আর্থ-সামাজিক প্রশাসনিক ও সাংস্কৃতিক গতিপ্রকৃতির দিক নির্দেশ করে, তেমনি বিপ্লব সমাজের মন-মানসিকতার কুপমণ্ডুকতা, সংকীর্ণতা, কুসংস্কার ও কুপ্রথাতে সমূলে উৎপাটিত করে সমাজকে গতিশীল, কল্যাণকর ও প্রগতিমুখী করে তােলে।

রাজনীতি অর্থনীতিকে ব্যাপক মানুষের আকাংখা পূরণের দিকে নিয়ে যায়। কারণ বিপ্লব ও ব্যাপক মানুষ একে অপরের ধারক-বাহক শক্তি; ব্যাপক মানুষের হৃদয়বেদন ও সমষ্টিগত কল্যাণ চিন্তাচেতনা থেকেই বিপ্লবের উত্তরণ ঘটে।  কিন্তু আমাদের দেশে বিপ্লবের অর্থ, এর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য বিষয়ে অনেক ভ্রান্তধারণা প্রচলিত আছে। যেমন, অনেকে মনে করেন, কোন একটি রাজনৈতিক দল বা একটি গােষ্ঠী কিছু সৈন্যসামন্ত সংগ্রহ করে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত কোন রাজনৈতিক দলীয় সরকারকে বা সরকারের গুরুত্বপুর্ণ ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের হত্যা করে একটা বিশৃংখল ও রক্তাক্ত সংঘর্ষের মাধ্যমে সমাজের কোন একটা পরিবর্তন বা ক্ষমতার হাত বদল হলেই তাকে বিপ্লব বলে। আবার অনেকে মনে করেন যে, যা কিছু সমাজে প্রচলিত আছে, আচার-আচরণ, নিয়ম-নীতি, আইন-শৃংখলা ইত্যাদি উৎপাটিত বা ধ্বংস করার নামই বিপ্লব। অর্থাৎ তাদের ধারণাঃ রক্ষপাত, সংঘর্ষ, ধ্বংস বিশৃংখলা ইত্যাদি কার্যক্রমের নাম বিপ্লব; প্রগতিশীল কাজ। তারা  একটু তলিয়ে দেখেন না যে, যারা প্রতিক্ষণ প্রতিনিয়ত সমাজের মঙ্গল, স্বার্থ, সুখ, সমৃদ্ধি ইত্যাদির জন্যে অক্লান্ত পরিশ্রম করে নতুন নতুন সৃষ্টিশীল কাজের মধ্য দিয়ে সমাজকে বাঁচিয়ে রাখছে, চলমান ও সজীব করে রাখছে, সেই শ্রমজীবি মেহনতী মানবগােষ্ঠীর স্বার্থ এ-সব কার্যক্রমের ভেতর আছে কি, নেই। সুতরাং ওগুলাে সবই ভ্রান্তধারণাই শুধু নয়, বিপ্লবের নামে প্রতি-বিপ্লবী কার্যক্রম বা সন্ত্রাসবাদী ও অন্তর্ঘাতমূলক কার্যক্রম দিয়ে বিপ্লবকে কলুষিত করার সামিল। বলাই বাহুল্যঃ তথাকথিত এই বিপ্লবের চিন্তাধারার সাথে সমাজের ব্যাপক শ্রমজীবি মেহনতী মানবগােষ্ঠীর স্বার্থের কোনােই সম্পর্ক নেই।

এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু যথার্থই বলেছেন, ‘বিপ্লব হবে এই বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন, তাদের বৃহত্তর স্বার্থ ও কল্যাণের নিমিত্তে, ভাঙ্গা, ধ্বংস, ক্ষয়, বিশৃংখলা, রক্তপাত, হিংসা কোনােটাই বিপ্লবের নীতি নয়। কারণ সমাজে যারা সৃষ্টি করে, ভাঙ্গা বা ধ্বংস তাদের অভিপ্রায় নয়। যে গড়ে সে জানে গড়ার কী মূল্য। তবে তাদের কল্যাণে যতােটুকু ভাঙ্গার দরকার তারা ততােটুকুই ভাঙ্গতে রাজী, এর বেশি নয়। তাই মনে রাখতে হবে, সামাজিক বিপ্লবের অর্থ রক্তপাত, ধ্বংস ও ক্ষয় নয়। এর অর্থ সামাজিক সার্বিক উন্নতিসাধন অগ্রগতি সাধন’ এটাই প্রগতিশীল চিন্তাধারা। বস্তুতঃ বিজ্ঞানভিত্তিক উৎপাদন, উৎপাদন সম্পর্কের বিজ্ঞানসম্পত বিবর্তন, উৎপাদনােপকরণের উন্নয়ন, যাবতীয় উন্নয়নমূলক ও জনস্বার্থের কার্যক্রমে বিজ্ঞানের বিকাশ ও সুষ্ঠু প্রয়ােগ এবং নিয়ন্ত্রণ বিহীনভাবে অধিকতর নয়া নয়া সম্পদ সৃষ্টিই বিপ্লবের প্রকৃত অর্থ, যার সাথে সমাজের ব্যাপক জনগণ তথা শ্রমজীবি মেহনতী মানবগােষ্ঠীর বৃহত্তর স্বার্থ জড়িত মানুষের সুখ-শান্তি-সমৃদ্ধি তথা সাবির্ক কল্যাণই হলাে বিপ্লবের উদ্দেশ্য আদর্শ ও লক্ষ্য। সেই আদিকাল থেকেই সামাজিক বিপ্লবই সমাজকে এগিয়ে নিয়ে এসেছে এবং এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এবং যাবে। বর্তমান বিংশ শতাব্দি হলাে বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষতার যুগ। প্রগতির যুগ ও কল্যাণের যুগ। তবে শােষণ অত্যাচার বঞ্চনা বৈষম্য -পূর্বের তুলনায় মােটেও কমেনি। সেই দাসপ্রথা থেকে শুরু করে বর্তমানকালের ধনতান্ত্রিক প্রথা পর্যন্ত সামগ্রীকভাবে শোষণ ও অত্যাচার ঠিকই। প্রবহমান রয়েছে। কিন্তু তাই বলে অস্বীকার করার উপায় নেই যে, সেই দাস প্রথা থেকে শুরু করে একটার পর একটা সামাজিক বিপ্লবের ক্ষেত্র অতিক্রম করে যে ধনতান্ত্রিক প্রথার আবির্ভাব ঘটেছে তাতে সমাজে ও মনুষ্যজীবনে মৌলিক পরিবর্তনও এসেছে অধিকতরভাবে। দাসপ্রথা, ভূমিদাস প্রথা বা সামন্ততান্ত্রিক প্রথা থেকে ধনিকপ্রথা ঢের বেশি কল্যাণকর। সামগ্রীকভাবে বিচার করলে সহজেই আমরা বুঝতে পারি যে, দাসপ্রথা আদিম সাম্যবাদী সমাজের অবলুপ্তি ঘটিয়েছে, মানুষের মধ্যে শ্রেণীবিভক্তি, শশাষণ অত্যাচার, বঞ্চনা থেকে মুক্তির সংগ্রামও শুরু হয়েছে, সমাজের ব্যাপক শ্রমজীবি মেহনতী মানবগােষ্ঠীকে সার্বিকভাবে সচেতন করে দিয়েছে। ফলে মানবজাতির সুখ-সমৃদ্ধির ভবিষ্যৎকে উজ্জ্বলতরভাবে সম্প্রসারিতও করেছে। বিপ্লবের লক্ষ্য কোন একটি বিশেষ শ্রেণীর কল্যাণসাধন নয়।

উৎপাদন শক্তির দ্রুততান্নতি এবং উৎপাদন বন্টননীতির সম্পর্কের অগ্রগতি নিশ্চিতকরণই বিপ্লবের ও বিপ্লবীদের লক্ষ্য। একটা কথা সর্বদা স্মরণ রাখতে হবে যে, সমাজের সামগ্রীক অগ্রগতি কল্যাণ উন্নতি তথা উৎপাদনের বিপ্লবে অংশগ্রহণকারী সকল বিপ্লবীরা মূলতঃ শ্রমিক মেহনতী জনতা থেকে আগত স্বভাবতঃই তাদের সমষ্টিগত স্বার্থের অর্থ এই নয় যে, অন্যান্য শ্রেণী তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে। এ জাতীয় বিপ্লবের সকল শক্তিই বিপ্লবসৃষ্ট সমৃদ্ধির সম-অংশীদার। তবে এ কথা সত্য যে, বিপ্লবের সামগ্রীক নেতৃত্বে থাকবে শ্রমজীবি মেহনতী মানবগােষ্ঠী। এরাই হলাে সমাজের বৃহত্তম অংশ, এরা মূলতঃ সর্বহারা শ্রেণী । বিপ্লবের খরস্রোতে এদের তাই হারাবার কিছু নেই। বিপ্লবের সাথে এদের বিশ্বাসঘাতকতা বা হঠকারীতা করার প্রশ্নই ওঠে না। এরাই হলাে বিপ্লবীশ্রেণী। সমাজের প্রভাবশালী, প্রতাপশালী, কৃর্তৃত্বশীল শ্রেণী যখন উৎপাদন বৃদ্ধির পথে বাধা সৃষ্টি করে, উৎপাদনশক্তির স্বভাবগত বিকাশে অনীহা প্রকাশ করে, উপরন্ত এ সবের পথে অন্তরায় সৃষ্টি করতে তৎপর হয়ে ওঠে তখনই সমাজ বিকাশ ও উৎপাদনের অবাধ ও নিয়ন্ত্রণবিহীন বৃদ্ধির স্বার্থেই বিপ্লবের প্রয়ােজন। পুঁজিবাদী বা ধনতান্ত্রিক সমাজে উৎপাদন বৃদ্ধির কথা ঢাকঢােল পিটিয়ে প্রচার করা হলেও মূলতঃ ধনিকশ্রেণী উৎপাদনবৃদ্ধিতে মােটেই আগ্রহী নয়; শিল্পকলকারখানা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধি ও বেকার সমস্যা সমাধানের গালভরা শ্লোগান দিয়ে তথাকথিত শিল্প বিপ্লবের নামে, উৎপাদনের বিপ্লবের নামে ডামাডােল পেটালেও অন্তরালে থাকে তাদের অর্থ আত্মসাত করে সীমাহীন ব্যক্তিসমৃদ্ধি গড়ার উদগ্র অভিলাষ এবং তারা শিল্পায়নের নামে ব্যাংক থেকে মােটা অংকের অর্থ তুলে তার সিংহভাগই আত্মসাৎ করে থাকে; এর একটা অংশ ক্ষমতাসীন সরকারের কর্তাব্যক্তিদের উপঢৌকন দিয়ে থাকে তাদের বিভিন্ন প্রকল্প পাশ ও পরবর্তীতে ব্যাংকের টাকা ফেরৎদানের ঝামেলা থেকে রেহাই পাবার লক্ষ্যে।

এর প্রমাণস্বরূপ আমরা দেখতে পাই যে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর সাম্রাজ্যবাদী শক্তির আশীর্বাদপুষ্ট সামরিক স্বৈরাচারী সরকার তাদের স্বগােত্রীয় শ্রেণীর মাধ্যমে দেশকে পুঁজিবাদীধারায় পরিচালিত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন সরকারী ব্যাংক থেকে শিল্পায়নের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়ে এর সামান্য একটা অংশমাত্র কাজে লাগিয়েছে, বাকী সিংগভাগ টাকাই তারা ভাগবাটোয়ারা করে নিয়েছেন। হাজার হাজার কোটি টাকা এভাবে অনাদায়ী হয়ে রয়েছে যা আদায় করার কোনাে কার্যকরি পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। মাঝে মাঝে যদিও এ ব্যাপারে একটা লােক দেখানাে পদক্ষেপ নেয়া হয় কিন্তু ঐ পর্যন্তই। এসব করা হয় নিজেদের পকেটে কিছু আসার লক্ষ্যে। মূলতঃ নানান কলাকৌশল ও শঠতার। মাধ্যমে কৃষি ও শিল্পক্ষেত্রে উৎপাদন সীমাবন্ধ রাখা, উৎপাদন হ্রাস; কৃষি ও শিল্পের পরিপূর্ণ ব্যবহার না করা, তীব্র বেকার সমস্যা সৃষ্টি করা, কৃত্রিম বাজার সংকট সৃষ্টি করা, খাদ্য ও অন্যান্য দ্রব্যসামগ্রী গুদামজাতকরণের মাধ্যমে খাদ্য ও অন্যান্য দ্রব্যসামগ্রীর সংকট সৃষ্টি করা, বৈজ্ঞানিক ও প্রাকৃতিক উপকরণ বা শক্তিকে উৎপাদন বৃদ্ধিতে না লাগানাে গড়িমসি করা, সন্ত্রাসবাদী ধ্বংসাত্মক বিশৃংখল তৎপরতা সৃষ্টি করা, অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপ সৃষ্টি করা, হিংসাত্মক ও গৃহযুদ্ধ বা যুদ্ধবিগ্রহের পরিবেশ সৃষ্টি করে উৎপাদন শক্তির অপব্যয়, অপচয়, অপব্যবহার ইত্যাদি কার্যকলাপ পরিচালনা করাই পুঁজিবাদী বা ধনতান্ত্রিক প্রথার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য এবং এটাই মূলতঃ এ প্রথার অন্যতম আদর্শও বটে। কায়েমী স্বার্থবাদী শােষকপ্রতিক্রিয়াশীল এই চক্রের কার্যকলাপের হােলিখেলা থেকে মুক্তি পাবার একমাত্র উপায় হলাে শ্রমজীবি মেহনতী শােষিত মানুষের সর্বাত্মক বিপ্লব। এর ফলে উভয় শ্রেণীর দ্বন্দ্বের প্রেক্ষিতে উৎপাদন ব্যবস্থার সাময়িক কিছু ক্ষতি হতে পারে কিন্তু সমাজ বিকাশের অগ্রগতির স্বার্থে কিছু ক্ষয়ক্ষতিকে মেনে নিতে হবে। তবে বিপ্লবীরা প্রতিক্রিয়াশীলচক্রের সাথে দ্বন্দে বা বিপ্লবে লিপ্ত হয়ে নিজেরা ইচ্ছাকৃতভাবে উৎপাদনযন্ত্র ধ্বংস হতে পারে, উৎপাদন হ্রাস পেতে পারে এমনতর ক্ষতিকর কিছু করবে না। মনে রাখতে হবে যে, হঠকারীতা, খামখেয়ালীপনা, স্বেচ্ছাচার, সন্ত্রাস, নিছক রক্তপাত ইত্যাদির অর্থ বিপ্লব নয়। বিপ্লবীরা প্রথমে আঘাত করবে না, প্রতিপক্ষের আঘাতকে প্রতিরােধ করবে মাত্র। স্বাভাবিক যাতাকে প্রসন্নচিত্তে মেনে নেয়াই বিপ্লবীদের ধর্ম, বিপ্লবের ধর্ম ।

আরাে একটা কথা বিপ্লবীদের স্মরণ রাখতে হবে যে, বিপ্লবীরা হলাে সমাজের বৃহত্তম অংশ, প্রতিপক্ষ সে-তুলনায় নিতান্তই নগণ্য। সামাজিক বিপ্লবের স্রোতধারায় এই ক্ষুদ্র অংশ খড়কুটোর মতাে ভেসে যাবে অবশ্যই। বিপ্লবীদের ফসল অর্থাৎ সমাজের সর্বক্ষেত্রের নিয়ন্ত্রণভার বিপ্লবীদের বা শ্রমিক জনতার দখলে। এসে যাবে, তখন যা-কিছু থাকবে সেসবের মালিক হবে এই বিপ্লবীরা তথা শ্রমজীবি মানবগােষ্ঠী। অতএত এই বিপ্লবী জনগােষ্ঠী নিজেদের স্বার্থেই কোনাে প্রকার ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপে লিপ্ত হবে না। আরেকটি কথা স্মরণ রাখতে হবে যে, অবাধ উৎপাদন ব্যবস্থা চালু থাকা অবস্থায় কোনাে হটকারী নেতৃত্বদ্বারা প্ররােচিত হয়ে কোনাে শ্ৰেণীকে উৎখাত করার অর্থই বিপ্লবের অপমৃত্যু। বিপ্লবের ধারা প্রবহমান রাখতে হবে বিপ্লবেরই স্বার্থে। উৎপাদনের স্বার্থে। ব্যাপক মেহনতী মানুষের স্বার্থে। এটাই হলাে বিপ্লবের প্রকৃত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। উপরােক্ত আলােচনা থেকে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ, অন্তর্ঘাত, সন্ত্রাসবাদ, নিছক রক্তপাত, উৎপাদন ব্যাহত করা ও হিংসাকে বিপ্লবের মধ্যে গণ্য করা যায় না। এটা প্রকৃত বিপ্লবীদেরও অভিপ্রায় নয়। এগুলাে হলাে কায়েমী স্বার্থবাদীচক্রের কাজ। এরা জোর-জুলুম, রক্তপাত, হিংসা, উৎপাদন ব্যাহত প্রভৃতি কার্যকলাপের দ্বারা বিপ্লবের স্বাভাবিক স্রোতধারাকে উল্টোখাতে প্রবাহিত করতে চায়। কায়েমী স্বার্থবাদীমহলের এ-সব প্রচেষ্টাকে প্রতিবিপ্লব’ বলা হয়ে থাকে।

এ পদ্ধতিতে যারা সমাজ বিকাশের ধারাকে প্রতিহত করে সমাজকে পেছনে টেনে রাখতে চেষ্টা করে তারাই প্রতিবিপ্লবী । তাই বিপ্লবীরা চাক বা না চাক বিপ্লবকে প্রতিহত ও প্রতিরােধ করার জন্য কায়েমী স্বার্থবাদী এই প্রতিবিপ্লবীরা হিংসা অন্তর্ঘাত ও রক্তপাতের আশ্রয় গ্রহণ করে, গৃহযুদ্ধ বাধিয়ে দেয়। ফলশ্রুতিতে প্রতিবিপ্লবী কার্যকলাপ প্রতিরােধ করার জন্য বিপ্লবীদেরও আত্মরক্ষার জন্যে স্বাভাবিক ও অনিবার্যভাবেই রক্তপাতের মধ্যে নামতে হয়। অর্থাৎ আঘাতের প্রত্যাঘাত করতে অনিবার্যভাবেই রক্তপাতমূলক কার্যকলাপ এসে যায়। তাই দেখা যাচ্ছে যে, বিপ্লব এবং রক্তপাত অবিচ্ছেদ্য। কায়েমী স্বার্থবাদীচক্র যদি ব্যাপক মেহনতী জনগণের মৌলিক মানবাধিকার ও তাদের আশা আকাংখার ক্ষেত্রে রক্তাক্ত ও হিংসাত্মক বাধার সৃষ্টি না করে তাহলে বিপ্লবীদের পক্ষ থেকে বল প্রয়ােগের কোনাে প্রশ্নই ওঠে না বা বিপ্লবীদের পক্ষ থেকে সখ করে হিংসা গৃহযুদ্ধ ও রক্তপাতের আশ্রয় গ্রহণের কোনাে অবকাশ নেই। আবার কোন অত্যাচারী ব্যক্তি বা বিশেষ কোনাে শ্রেণীর বিরুদ্ধেও প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য বিপ্লব সংঘটিত হয় না। সামগ্রীকভাবে সমাজ বিকাশের লক্ষ্যেই বিপ্লব সংঘটিত হয়ে থাকে। রক্তপাত হিংসা ধ্বংস বিশৃংখলা সমাজ বিকাশের অন্তরায়। প্রতিবিপ্লবীদের চাপিয়ে দেয়া হিংসাত্মক রক্তাক্তনীতি প্রতিহত ও প্রতিরােধ করার জন্যে (আত্মরক্ষামূলক) যতটুকু বলপ্রয়ােগ ও রক্তপাতের প্রয়ােজন বিপ্লবীরা ততটুকুই সমর্থন করে। বিভিন্ন ঐতিহাসিক সামাজিক বিপ্লব সেই সাক্ষ্যই বহন করে। ইতিহাস পর্যালােচনা করলে আমরা দেখতে পাই যে, প্রতিবিপ্লবী। প্রতিক্রিয়াশীলচক্রের হিংসাত্মক কার্যকলাপকে প্রতিরােধ করার উপযুক্ত ব্যবস্থাই সেসব ক্ষেত্রে গ্রহণ করা হয়েছে মাত্র। ইসলামী বিপ্লব, মহান রুশ বিপ্লব, ভিয়েতনাম বিপ্লব, চীন বিপ্লব, কোরিয়ান বিপ্লব, কিউবান বিপ্লব, অন্যান্য দেশের সামাজিক বিপ্লব এবং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের বিপ্লব ইতিহাসের ব্যতিক্রম নয়।  ১৯১৭ সালে সােভিয়েত রাশিয়ার মহান সামাজিক বিপ্লবকে এক কথায় বলা যেতে পারে একটি রক্তপাতহীন সফল বিপ্লব।

এই বিপ্লবের পর শ্রমিক শ্রেণীর হাতে যে ক’দিন ক্ষমতা ছিলাে, সে-সময়ের মধ্যে কোন হিংসাত্মক ও রক্তাক্ত কার্যকলাপ সংঘটিত হয়নি। এমন কি এও জানা যায় যে, বিপ্লবে বিজয়ী একদল ক্ষুধার্ত বিপ্লবী হাতের কাছে অতি দামী খাদ্যসামগ্রী পড়ে থাকলেও তা তারা স্পর্শ করেনি। এ থেকে বিপ্লবীদের নির্লোভ ও আত্মসংযমের পরিচয় পাওয়া যায়। পরে অবশ্য দেশী-বিদেশী প্রতিক্রিয়াশীল প্রতিবিপ্লবী ও ধনিক শােষকগােষ্ঠীর হিংসাত্মক ও রক্তাক্ত আক্রমণ শুরু হলে তখন বাধ্য হয়েই বলপ্রয়ােগ করে শ্রমিকশ্রেণী রক্তাক্তপথেই প্রতিক্রিয়াশীল প্রতিবিপ্লবী শশাষকগােষ্ঠীকে পদানত করে সর্বহারাশ্রেণীর একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত করে। মহান রুশ বিপ্লবের গতিপ্রকৃতি লক্ষ্য ইত্যাদি বিষয়ে একে একমাত্র ইসলামী বিপ্লবের সাথেই তুলনা করা যেতে পারে। বাংলাদেশে পাক সামরিক বাহিনী তথা শোষকগােষ্ঠী ও তাদের তাবেদাররা ১৯৭১ সালে বাঙ্গালী জাতির ওপর হিংসাত্মক ও রক্তাক্ত কার্যকলাপ চালিয়ে দিয়েছিলাে, ফলশ্রুতিতে বাঙ্গালী জাতি সর্বাত্মক প্রতিরােধ গড়ে তােলে এবং পরিণামে রক্তাক্ত পথেই বাঙ্গালীর জয় সূচিত হয়। রুশ শ্রমিক জনতা বা বাঙ্গালী জনগণ যদি প্রতিবিপ্লব-প্রতিক্রিয়াশীল আক্রমণের বিরুদ্ধে এ ধরনের পথ গ্রহণ না করতাে, তাহলে অবশ্যই ঐ চক্রের জয় হতাে। অন্যান্য দেশের সমাজতান্ত্রিক বা। আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার বিপ্লবের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযােজ্য।  মানবসমাজের সামগ্রীক অগ্রগতির প্রয়ােজনেই বিপ্লব। বিপ্লবের সাথে তাই শ্রমজীবি মেহনতী মানুষের নিবিড় সম্পর্ক। অতএব সমাজের এই বৃহত্তম শ্রেণীর জনগণের সাহায্য সহযােগিতা সমর্থন ও সক্রিয় অংশগ্রহণ ব্যতীত বিপ্লব সংঘটিত ও সফল হতে পারে না। তাই কোন একটি বিশেষ রাজনৈতিক দল বা সশস্ত্র বাহিনীর ক্ষমতা দখলের নাম বিপ্লব নয় । সমাজের সর্বস্তরের শােষিত মেহনতী মানুষকে তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করা, বিপ্লবী পার্টি গঠন করা, বিপ্লবের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করা ও শিক্ষা দেয়া, সমাজ বিকাশের কি প্রয়ােজন সে-সম্পর্কে তাদের জ্ঞাত করা, সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদ সম্পর্কে জ্ঞান প্রদান, শ্রমজীবি জনতাকে  বিভিন্ন পেশাভিত্তিক শ্রেণীসংগঠনে সংগঠিত করা ইত্যাদি হলাে বিপ্লবের তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক দিক। এর বাস্তবায়ন আমরা দেখতে পাই মহান লেনিনের নেতৃত্বে বিভিন্ন শ্রেণী সংগঠনের এককসত্তা হিশেবে বলশেভিক বা কমিউনিস্ট পার্টি, হােচিমিনের নেতৃত্বে ১৪ টি রাজনৈতিক ও শ্রেণী সংগঠনের এককসত্ত্বা হিশেবে লিবারেশন ফ্রন্ট, মাওসেতুংয়ের নেতৃত্বে বিভিন্ন সংগঠনের এককসত্ত্বা হিসেবে কমিউনিষ্ট পার্টি, কিম ইল সুং, মার্শাল টিটো, ডঃ ফিডেল ক্যাস্ট্রো প্রমুখ বিপ্লবী ব্যক্তিত্বের নেতৃত্বের মধ্যেও বিভিন্ন শ্রেণীসংগঠন ও রাজনৈতিক দলের সম্মিলিত এককসত্ত্বার রাজনৈতিক পার্টির সন্ধান পাওয়া যায়। তদ্রপ বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বিভিন্ন প্রগতিশীল সমাজতান্ত্রিক গণতান্ত্রিক ও স্বাধীনতার সপক্ষীয় পার্টিসমূহের একক প্লাটফরম হিশেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলাে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ’ বা বাকশাল।  

সুতরাং বিপ্লব সংঘটিত ও বিপ্লবকে প্রবহমান রাখার স্বার্থেই বৃহত্তর সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে একক বিপ্লবী পার্টির পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। ঐক্যবিহীন কোন বিপ্লব, আদর্শবিহীন কোন বিপ্লব সফল হতে পারে না। যারা মনে করেন একটা (জনসমর্থনবিহীন) সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মাধ্যমেই বিপ্লব সফল হতে পারে, তারা প্রকৃতই বিপ্লবের অর্থ বােঝেন না। সেক্ষেত্রে তাদের বিপ্লব হঠকারীতায় পর্যবশিত হয়ে পড়ে এবং তারা প্রতিবিপ্লবকেই সুযােগ করে দেয়। প্রতিবিপ্লবের চরিত্র এবং এর পশ্চাতে দেশী-বিদেশী কী ধরনের শক্তিসমূহ কাজ করে থাকে তার প্রমাণ আমরা আমাদের মুক্তি সংগ্রামকালে এবং ১৯৭৫ সালের নির্মম হত্যাকান্ডের সময় দেখেছি। এর প্রমাণ পাওয়া যায় রুশ-চীন ইন্দোনেশিয়া-স্পেন-ফরাসী প্রভৃতি দেশের ইতিহাসেও। দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে দেশে যেসব বিপ্লবের কথা ফলাও করে প্রচার করা হয় বা বিশেষ করে পাকিস্তানের ‘অক্টোবর বিপ্লব’, বাংলাদেশের তথাকথিত ‘আগষ্ট বিপ্লব’, ‘নবেম্বর বিপ্লব’ এর প্রতিবিপ্লবী সামরিক প্রতিক্রিয়াশীলচক্র যেহারে ‘বিপ্লব’ বিপ্লব,’ বলে মাতামাতি করেন, তা আদৌ বিপ্লবের পর্যায়ে পড়ে না। এ সবই হলাে একশ্রেণী বা একটা ভিন্ন দলীয় সরকার বা একই দলীয় সরকারের বিরুদ্ধে অন্য একটি দল গােষ্ঠী বা সরকারের অভ্যন্তরে লুকায়িত একটি শ্রেণী ব গােষ্ঠীর সশস্ত্রপন্থায় ক্ষমতা দখলের বিদ্রোহ। এই সব তথাকথিত বিপ্লবের সাথে উৎপাদনের অগ্রগতি, সমাজ বিকাশ ও শ্রমজীবি মেহনতী সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কোনােই সম্পর্ক নেই। এটা একই শ্রেণীর মধ্যে স্বার্থের সংঘাত বা দ্বন্দ্ব অথবা একটা বিশেষ শ্রেণীর স্বার্থোদ্ধারের অপচেষ্টা বা একটা প্রতিক্রিয়াশীলচক্রের হাত থেকে অন্য আরেকটি প্রতিবিপ্লবী চক্রের হাতে ক্ষমতার হস্তান্তর বা ক্ষমতার হাত বদল বৈ অন্য কিছু নয়। এ সবাই হলাে প্রতিবিপ্লবী কার্যক্রম। প্রকৃতপক্ষে বিপ্লবের অর্থ একটি প্রতিক্রিয়াশীলচক্রের হাত থেকে একটি সাম্যবাদী বিপ্লবীশ্রেণীর হাতে ক্ষমতার হস্তান্তর; প্রতিক্রিয়াশীল ধনতান্ত্রিক শোষণভিত্তিক আর্থব্যবস্থার পরিবর্তে প্রগতিশীল বা সমাজতান্ত্রিক শােষণহীন আর্থসামাজিক ব্যবস্থা প্রবর্তন করাই বিপ্লবের মূল লক্ষ্য। অর্থাৎ সমাজব্যবস্থার গুণগত মৌলিক পরিবর্তন সাধনই বিপ্লবের গতিপ্রকৃতি উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য।  বিপ্লব জনগণ পার্টি এবং গণশ্রেণী সংগঠন পরস্পরের সাথে সম্পৃক্ত একটিকে বাদ দিয়ে অন্যান্যটি কল্পনা করা যায় না।

বিশেষ করে গণশ্রেণী সংগঠনগুলােই হলাে ‘বিপ্লব’ সৃষ্টির মিলনায়তন। বিপ্লবের অর্থ শিক্ষাও বটে। গণসংগঠনগুলাের মাধ্যমে শুধু শ্রমজীবি মেহনতী মানুষগুলােকেই শুধু শিক্ষিত করে তােলা হয় না, বিপ্লবীরাও শিক্ষালাভ করে থাকে। জনসাধারণের শ্ৰেণী বা পেশাভিত্তিক মনমানসিকতা চেনা-জানা, মেহনতী মানুষের সংস্পর্শে এসে একজন বিপ্লবী তাদের প্রতি সহমর্মী ও সহযােগী হয়ে উঠতে পারে। একজন খাঁটি বিপ্লবী হতে হলে জনগণের প্রতি ভালবাসা, মমতা, শ্রদ্ধা, বিপ্লবী জনশক্তির ওপর দৃঢ় বিশ্বাস, বিপ্লবীদর্শনের প্রতি কর্তব্য ও বাস্তবনিষ্ঠা, ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আশাবাদ, সততা, সংযম, সহনশীলতা, অধ্যাবসায়, আত্মত্যাগ, উৎসর্গকৃত হৃদয়, আত্মপ্রত্যয়, দ্রতা, বিনয়ী, দুর্দম সাহস প্রভৃতি অর্জন করতে হবে। এ ব্যতীত পার্টির প্রতি আনুগত্য, নেতৃত্বের প্রতি আস্থাশীল, সহকর্মীদের প্রতি মমত্ববােধ, পার্টির কর্মসূচীর প্রতি নিবেদিত প্রাণ সমর্থন প্রভৃতি গুণাবলীও বিপ্লবীদের অর্জন করতে হয়। এগুলাে ব্যতীত বিপ্লবী হওয়া তাে দূরের কথা, প্রতিক্রিয়ার জন্য ক্রিড়নক হওয়া ছাড়া আর কোন গত্যন্তর নেই। তাই মেহনতী শ্রমজীবি মানুষের গণসংগঠনগণশ্রেণী সংগঠনগুলাের নৈমিত্তিক কাজে পরিপূর্ণভাবে মনােনিবেশ করা বিপ্লবী জীবন বিকাশের একমাত্র শিক্ষা। শুধু বিপ্লবী তত্ত্বচর্চা করলেই চলবে না, বাস্তবে তা প্রয়ােগও করতে হবে। সুতরাং বিপ্লবী হওয়া অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার যদি উপরােক্ত বৈশিষ্ট্যগুলাে অর্জন করা না যায়।  এটা পুরােপুরি বিজ্ঞানের যুগ। বৈজ্ঞানিক সত্যের মতােই সমাজবিপ্লবও নির্ঘাত সত্য। এ প্রসঙ্গে অবশ্য প্রশ্ন থেকে যায়। যেমন সমাজ বিপ্লব যখন বৈজ্ঞানিক সত্য,তাহলে পার্টির মাধ্যমে বিপ্লবী প্রচেষ্টার কী প্রয়ােজন, বিপ্লব আপনা থেকেই ঘটবে না, কোনাে শান্তিপূর্ণ অহিংসপন্থায় বিপ্লব কি সফল হতে পারে না বা স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিপ্লব সম্পন্ন ও সফল হতে কি পারে না? প্রশ্নগুলাে খুবই যুক্তিসঙ্গত সন্দেহ নেই। কিন্তু বিপ্লব অনিবার্য সত্য, এর অর্থ এই নয় যে, ম্যাজিকের মতাে অবলীলাক্রমেই বিপ্লব সাধিত হবে। মনে রাখতে হবে, বিপ্লবের কোন রূপসত্ত্বা নেই, বিপ্লব নিজে কোন কিছুই করতে পারে না বা এর নিজস্ব কোন ইচ্ছাশক্তি নেই। মানুষই হলাে বিপ্লবের ধারক ও বাহক। মানুষই তার প্রয়ােজনে বিপ্লব সৃষ্টি করে। কারণ বিপ্লব ব্যতীত সামাজিক বিকাশ সাধিত হয়নি; হয় না। বিপ্লবই সমাজের চালিকা শক্তি। যেমন একেবারে আদিতে মানবগােষ্ঠী বর্তমান মানবগােষ্ঠীর রূপাকারে ছিলাে না বলে বিজ্ঞানী ডারউইন অভিমত ব্যক্ত করেছেন। বিবর্তনবাদের মধ্য দিয়েই মানুষের রূপ ও আকার পরিগ্রহ করেছে। পবিত্র কোরানও একই ধারণার আভাষ দিয়েছেন।

যেমনঃ “we have created Man into toil and struggle” অর্থাৎ আল্লাহ মানুষকে শ্রম ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। এখানেও তাহলে বিবর্তনবাদের কথা এসে যায়। সুতরাং দেখা যাচ্ছে সংগ্রাম বা বিপ্লবই মানুষের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। অর্থাৎ বিবর্তনবাদই বিপ্লব। সমাজের বিকাশ সাধিত হয়ে থাকে বিবর্তনবাদের ভিত্তিতে। তাই ঐতিহাসিক কারণে তথা মানুষ তাদের প্রয়ােজনেই বিপ্লবের জন্যে প্রচেষ্টা চালাবে বিপ্লবী চেতনায় উদ্বুদ্ধ মানুষকে কোন শক্তি বিপথগামী করতে পারবে না কোনাে বাধাবিপত্তি তাদেরকে এ প্রচেষ্টা থেকে বিরত রাখতে পারবে  এ সব কারণেই বিপ্লব অবধারিত ও অবশ্যম্ভাবী। মনে রাখতে হবে যে, সমাজের উপাদান হলাে মানুষরূপী বস্তু। এ বস্তু জীবন্ত। এ বস্তু বাস্তব চিন্তা ও ধ্যান করতে পারে, পারে সে অনুযায়ী প্রচেষ্টা চালাতে মানুষের চিন্তাধারণা, তার প্রয়ােজনানুযায়ী বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে কাজে প্রতিভাত হবে। এই চিন্তা ও ধ্যানানুযায়ী কাজ না করলে বিপ্লব সাধিত হওয়া তাে দূরের কথা, এ প্রচেষ্টায় সৃষ্টি কায়েমী স্বার্থ সমাজকে পেছনদিকে টেনে নিয়ে সমাজের বিকাশ ও অগ্রগতিকে দাবিয়ে রাখবে। তবে মানুষ যেহেতু তার চিন্তা সম্পর্কে সচেতন, তাই এই অবস্থা চলতে দিতে পারে না। তার বাঁচার তাগিদেই সে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। এটাই এই জীবন্ত বস্তুটির স্বাভাবিক ও প্রকৃতিগত প্রবৃত্তি। 

সাম্যবাদীরা সমাজ বিপ্লবের জন্যে হিংসা-রক্তপাত ও বলপ্রয়ােগের পক্ষপাতি নয়। কোনাে বিপ্লবই তা চায় না। কিন্তু ইতিহাসের শিক্ষা এই যে, কোনকালে কোন বিপ্লবই রক্তপাতহীন, অহিংস ও শান্তিপুর্ণ উপায়ে সমাধা হয়নি। বিপ্লবকে সফল করতে হলে ঐতিহাসিক প্রয়ােজনেই গৃহযুদ্ধ ও বলপ্রয়ােগ কার্যক্রম এসে যায়। এটা সমাজ বিজ্ঞানের একটা নিয়ম। তবে এ নিয়মটাকে শােষকসমাজের চাপিয়ে দেয়া নীতি বলে গণ্য করা হয়। শ্রমজীবি মেহনতী মানুষের বিপ্লবী গতিধারা বাধাপ্রাপ্ত হয় বলেই এটা দ্বন্দ্ব-সংঘাত-গৃহযুদ্ধ-বলপ্রয়ােগ ও রক্তপাতে পর্যবশিত হয়। এটা তাই অবলীলাক্রমে সামাজিক নিয়মনীতিতে পরিণত হয়ে পড়েছে। হিংসা শােষক সমাজের ভিত্তি বলপ্রয়ােগ করেই শােষকগােষ্ঠী তাদের সামাজিক কাঠামাে টিকিয়ে রাখে। এ লক্ষ্যে প্রয়ােজন শ্রেণীসগ্রাম। শ্রেণীসগ্রাম এমনই একটা বিষয় যে, সমাজের বৃহত্তম অংশ তথা শ্রমজীবি মেহনতী শ্রেণী, শােষিত মানবগােষ্ঠী যারা চারিত্রিক প্রকৃতিগত দিক দিয়ে উন্নতিকামী ও প্রগতিশীল, শোষণহীন সমাজে বিশ্বাসী, তাদেরকে সমাজে টিকে থাকতে হলে কায়েমী স্বার্থন্নেষী শোষক শ্রেণীকে উৎখাত করা ব্যতীত বিকল্প কোনাে পথ তাদের সামনে খােলা নেই। এ জন্যেই শ্রেণীসগ্রামের প্রয়ােজন। সমাজে শােষক ও শােষিতশ্রেণী একই সঙ্গে অবস্থান নিলে যেমন শোষিত শ্রেণীর বাচার নিরাপত্তা থাকে না, তেমনি কোন উন্নতিও হতে পারে না। এ কারণেই কোন একটি প্রভাবশালী বা কর্তৃত্বশালী। গােষ্ঠীকে প্রতিহত করার জন্য সর্বাগ্রে প্রয়ােজন এই ব্যাপক শ্রমজীবি মেহনতী। মানবগােষ্ঠীর উপযুক্ত রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জনকরণ। এ রাজনৈতিক ক্ষমতা এমনিতেই অর্জিত হয় না। প্রয়ােজন বল প্রয়ােগের, প্রতিরােধের, গৃহযুদ্ধের, ইস্পাতকঠিন ঐক্যের। পরিণামে সংখ্যালঘু শােষক-প্রতিক্রিয়াশীল-প্রতিবিপ্লবীদের পরাজয় অবধারিত। এই নিয়মে অর্থাৎ শোষক শ্রেণীর বিরুদ্ধে বলপ্রয়ােগ ও পাল্টা ব্যবস্থা নিয়ে শােষকসমাজকে সমূলে উৎপাটিত করে শ্রেণী-শােষণহীন সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।

বিকল্প কোন পথ নেই। এটাই ইতিহাসের শিক্ষা, যার প্রমাণ রয়েছে ইসলামী বিপ্লবে, মহান রুশ বিপ্লবে তথা  সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহের সমাজ বিপ্লব ও শ্রেণীসংগ্রামের ইতিহাসে  শান্তি ও মানবতাবাদের উৎকর্ষ সাধনই বিপ্লবের মূল লক্ষ্য। বিপ্লবী তথা । সমাজতন্ত্রীরা তাই শান্তিকামী ও মানবতাবাদী। সমাজ ও জনগণের শান্তি সুখ। সমৃদ্ধি ও কল্যাণ সাধনই তাদের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। তাদের বিপ্লবী মানবতাবােধ সমাজের সার্বিক কল্যাণে নিবেদিত। অন্যায়, অত্যাচার, শােষণ, উৎপীড়নের বিরুদ্ধে তাই এদের সংগ্রাম। বিপ্লবীরা কাপুরুষ নয়। মানুষের ওপর। অন্যায়ের প্রতিরােধ না করে মৃত্যুকে বরণ করার অর্থ শান্তিপ্রীতি নয়। কোন। কিছুতেই তারা হতাশ হবে না। অন্যায় অবিচার শোষণ ব্যাভিচারের অবসান ঘটিয়ে। সমাজের শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়ােজনবােধে সংগ্রাম চালিয়ে বীরের মতাে। মৃত্যুকে আলিঙ্গন করবে। এ জাতীয় নির্দ্বিধায় জীবনদান করতে আমরা দেখতে পাই ইসলামী বিপ্লবে মহানবীর নেতৃত্বে, তেমনি রুশ বিপ্লবে মহান লেনিনের। নেতৃত্বে এবং অন্যান্য দেশের মহান বিপ্লবে। সেই হাজার হাজার বিপ্লবী শহিদের তৎকালীন বা সমসাময়িককালের সামাজিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে চাওয়ার ও পাওয়ার কিছুই ছিলাে না। ভবিষ্যৎ বংশধরদের সুখীজীবনের সােপান রচনা করতে গিয়েই তারা হাসিমুখে জীবন উৎসর্গ করে গেছেন। তাই ত্যাগ তিতিক্ষা রক্তপাত ব্যতীত প্রকৃত শান্তি প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। কোনাে আদর্শও যা ব্যাপক মানুষের শান্তির দিশারা তা প্রতিষ্ঠিত হয়নি, হয় না, হবে না ত্যাগ তিতিক্ষা ও আত্মত্যাগ ব্যতীত। মানুষ মরণশীল। বিপ্লব ও আদর্শ চিরঞ্জীব। একজন বিপ্লবী শাস্তির আদর্শ তথা সাম্যবাদী আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্যে মৃত্যুকে বরণ করতে দ্বিধা করে না। কারণ সে জানে তাকে অবশ্যই পৃথিবী ছেড়ে একদিন চলে যেতে হবে কিন্তু তার চিন্তা ধ্যান আদর্শ এবং তার বিপ্লবী কমেদ্দিীপনার ইতিহাস রয়ে যাবে, ভবিষ্যৎ মানুষ তা থেকে অনুপ্রাণিত হবে। শােষক-স্বৈরাচারী প্রতিক্রিয়াশীলচক্র ও তাদের দালালগােষ্ঠীর কাছে উপরােক্ত বাণী অর্থহীন। তারা ত্যাগ তিতিক্ষা ও কোন জনহিতকর বিপ্লব ও আদর্শের ধারে কাছে নেই। উপরােক্ত চিন্তাধারায় তারা বিশ্বাসীও নয়। তারা চায় শুধু তাৎক্ষণিক ও জীবনব্যাপী ব্যক্তিসুখ ও ব্যক্তিস্বার্থ ।

তাদের স্বভাবগত বৈশিষ্ট এই যে, এরা চায় তাদের এ সুখ ও স্বার্থ উদ্ধারের জন্য প্রতারণা, শঠতা, প্রবঞ্চনা শােষণ অত্যাচার নির্যাতনের মাধ্যমে ব্যাপক সাধারণ মানুষকে দাবিয়ে রাখতে। সমাজ ও রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের আসনে চিরসমাসীন থেকে প্রভাব প্রতিপত্তি ঠাট ডাট বজায় রাখতে । এদের স্বার্থোদ্ধারের লক্ষ্যেই এরা রক্তপাত হিংসা গৃহযুদ্ধ ধ্বংস ইত্যাদি ক্রিয়াকর্মের পথ অবলম্বন করে। তাই প্রকৃত শান্তিকামী মানবদরদী সমাজতন্ত্রীদের বিপ্লবের পথ অবলম্বন ব্যতীত অন্য কোনাে বিকল্প নেই। শোষণহীন অত্যাচারহীন বঞ্চনাহীন শান্তিবাদী প্রগতিশীল ও কল্যাণধর্মী সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই অনিবার্যভাবে বিপ্লবের অগ্নি স্ফুলিঙ্গ দাউ দাউ করে জ্বলে উঠবে। শােষক প্রতিক্রিয়াশীল – অত্যাচারীর দল সেই বিপ্লবের দাবানলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে। সুতরাং মানবজাতির সামাঙ্গলিক ও চিরাকাংখিত শান্তির জন্য, শশাষণ উৎপীড়ন অত্যাচার থেকে মুক্তিলাভের জন্য এই দুঃখ ও বেদনাদায়ক বাস্তবতাকে মেনে নেয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই।  এ প্রসঙ্গে মনীষী কার্লমার্কসের উক্তিটি বড়ােই তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি বলেছেনঃ “বলপ্রয়ােগ হলাে সেই ধাত্রী, যে নতুন সমাজের জন্মগ্রহণে সাহায্য করে। তাই দুঃখ ও বেদনাদায়ক মনে করে কেউ যদি নতুনের আগমনকে ঠেকিয়ে রাখতে চায় সেটা হবে অন্যায় এবং তা আরাে হবে ধ্বংস ও মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার সামিল।

সৃষ্টি মানুষের স্বভাবজাত প্রবৃত্তির ফল। মেহনতী শ্রমজীবী শোষিত মানুষ বল। প্রয়ােগের আঙ্গংকে নীরবদর্শক হয়ে সৃষ্টির কাজ থেকে বিরত থাকবে না। তাই এ পর্যায়ে রক্তপাত, হিংসা, সংঘাত ও সংঘর্ষের পথ অনুসরণ করা উচিত কিনা, আর বলপ্রয়ােগ ব্যতীত বিপ্লব সম্ভবপর কিনা তা একজন বিপ্লবী সমাজবিজ্ঞানীর নিকট কোন প্রশ্ন নয়। সমাজের নতুন সৃষ্টি, বিকাশ, কল্যাণ ও শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই বিপ্লব ঘটাতে হবে। সেই বিপ্লব যদি হয় রক্তপাতের তাতে আপত্তির কিছু নেই। এটা হলাে শােষক সমাজের চাপিয়ে দেয়া হিংসা প্রতিরােধের অনিবার্য পরিণতি মাত্র । শ্রেণীবিভক্ত সমাজে যেমন প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না, সমাজতন্ত্র, তেমনি শ্রেণী বিভক্ত সমাজের সামাজিক ব্যবস্থায় শ্রেণীসমম্বয়, ঐক্য, ভ্রাতৃত্বসহমর্মিতা-শান্তি ও শৃংখলা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। কারণ সমাজের ধনিকগােষ্ঠীর ধনসম্পদের দম্ভ, শোষণের উদগ্রলালসা ও প্রভাব প্রতিপত্তি বিস্তারের ফলে সমাজে প্রতিহিংসা, বিদ্বেষ ও ঘৃণার সূত্রপাত ঘটে। সমাজ তখন দুটি শ্রেণীতে বিভক্ত হয়ে পড়ে। একটি হলাে শােষক বা ধনিক যারা মােট জনসংখ্যার মাত্র ৫%- ৭% ভাগ। অপরটি হলাে শােষিত বা দরিদ্র যারা মােট জনসংখ্যার ৯৩% ৯৫% ভাগ। তাই এ সমাজে শােষক শােষিতের দ্বন্দ্ব চিরন্তন। এ দ্বন্দ্বভিত্তিক দুটি শ্রেণী সামাজিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে একে অপরের বৈরীশক্তি। একটি শ্রেণীর মুষ্টিমেয় মানুষ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ওপর শাসন শোষণ অত্যাচার হিংসা বলপ্রয়োেগ এবং সর্বপ্রকার প্রতারণা ও শঠতার আশ্রয় গ্রহণ করে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলে ভােগ বিলাসের সঙ্গে জীবনযাপন করবে, আর অপরশ্রেণী শােষিত অত্যাচারিত প্রতারিত হবে, জঠর জ্বালায়, আশ্রয়হীন, স্বাস্থ্যহীন সর্বহারায় পরিণত হয়ে ধুকে ধুকে মরবে, মানবেতর জীবনযাপন করবে—সেই ক্ষেত্রে শ্রেণী সমম্বয়, দেশপ্রেম, মানবপ্রেম, গণতন্ত্র, ব্যক্তিস্বাধীনতা প্রভৃতি গাঁজাখােরি শ্লোগান বৈ আর কিছু নয়। এ সবই বিপ্লবী কার্যক্রমের বাইরে। বিপ্লবের প্রকৃতি এই যে, বিপ্লব সমাজে শ্রেণীসত্ত্বাকে পুরােপুরি অস্বীকার করে সবার জন্যে প্রেম বা দেশপ্রেম, মানবপ্রেম, গণতন্ত্র, এগুলাে প্রতিষ্ঠিত হবে তখন যখন সমাজে কোন শ্রেণী, শোষণ, বঞ্চনা, অত্যাচার, স্বৈরাচার থাকবে না। শ্ৰেণীদ্বন্দ্ব বা শ্রেণীবিভেদ প্রভৃতি সমূলে উচ্ছেদ করাই হলাে বিপ্লবের লক্ষ্য। এ সব না করে যারা সমাজে শ্ৰেণীসমন্বয়, ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব, গণতন্ত্র ও দেশপ্রেমের কথা বলেন তারাই প্রতিবিপ্লবী-প্রতিক্রিয়াশীল শােষক সমাজের সেবাদাস। ‘বিপ্লব’ কথাটা কোনাে শাস্ত্রীয় বিধানের অপরিবর্তনশীল বা ডগমাটিক’ কোন বিষয় নয়।

সামাজিক পরিবেশ—বিশেষতঃ সমাজের পরিবর্তন পরিবর্ধন ধারায় বিপ্লবের নিয়মনীতি ও গতিধারা পরিবর্তনশীল ও সংশােধনশীল। সমাজের যাবতীয় সৃষ্টির দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদী কার্যক্রমের সাথে বিপ্লব সম্পৃক্ত। সুতরাং কোনাে তত্ত্বই চিরস্থায়ী বা চিরন্তন নয়। অবস্থা ও পরিবেশ পরিবর্তনের সাথে তত্ত্বেরও পরিবর্তন স্বাভাবিক। এটাই বৈজ্ঞানিক সত্য। সুতরাং অকেজো বা ব্যাক ডেটেড তত্ত্ব বা আইডিওলজি আঁকড়ে থাকার অর্থই গোঁড়ামির সামিল। সমাজের বাস্তব অবস্থার আলােকে তত্ত্বের উন্নতি ও বিকাশ ঘটাতে হবে। এটাই সৃষ্টিশীল জগত ও বিপ্লবের মূল কথা।  বর্তমান যুগ দ্রুত পরিবর্তন বা বিবর্তনের যুগ। শ্রমজীবি মেহনতী মানবগােষ্ঠী আজ পৃথিবীর সর্বত্রই শ্রেষ্ঠ শক্তি। কতিপয় রাষ্ট্রে শ্রমিকশ্রেণীর শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শ্রমিকশ্রেণীর সংস্থা গড়ে উঠেছে। এক দেশের শ্রমিকশ্রেণীর সাথে অন্য দেশের শ্রমিকশ্রেণীর যােগাযােগ ও সহযােগিতা গড়ে উঠেছে। শ্রমিকশ্রেণীর সাথে নিজেদের একাত্মতা প্রকাশ করছেন সমাজের বুদ্ধিজীবি লেখক সাহিত্যিক তথা গােটা সমাজতন্ত্রীরা। এমন কি সাম্রাজ্যবাদ উপনিবেশবাদের কবল থেকে স্বাধীনতা অর্জন ও রক্ষার জন্য এবং একচেটিয়া পুজিপতিদের ধনিকদের শােষণ ও আগ্রাসন থেকে জাতীয় অর্থনীতিকে মুক্ত করার লক্ষ্যে জাতীয় পাতিবুর্জোয়ারাও শ্রমিকশ্রেণীর সাথে হাত মেলাচ্ছে। ব্যাপক চেতনার উদয় হয়েছে জনসাধারণের মনে শান্তি সমৃদ্ধি ও স্বাধীনতার সপক্ষে। এ সবই সমাজতন্ত্রের জনপ্রিয়তার সাক্ষ্য বহন করে। সুতরাং মেহনতী শ্রমজীবি মানুষের বাস্তব চিন্তাশক্তি ও রাজনৈতিক সচেতনতার প্রেক্ষিতে প্রতিক্রিয়াশীল প্রতিবিপ্লবী শােষকগােষ্ঠী সামরিক অভ্যুত্থান, রক্তাক্তোপায়ে ও গৃহযুদ্ধের আশ্রয় গ্রহণ কোন কোন দেশে নাও নিতে পারে। সেক্ষেত্রে বিপ্লবী পরিবর্তনের জন্যে বিপ্লবীদের কার্যক্রমেও পরিবর্তন আসতে পারে। যে-সব দেশের শ্রমজীবি মেহনতী।

মানুষের ঐক্য প্রবল, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার সম্পর্কে সচেতন এবং ধনিকশ্রেণীর বা পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের প্রধানতম উপাদান সশস্ত্র বাহিনী পাকাপােক্ত বা শক্তিশালী নয়, সেই সব দেশে রক্তপাতহীন ও বলপ্রয়ােগহীন বিপ্লবী পরিবর্তনের সম্ভাবনা অধিক। তাই দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যদি শ্রমিকশ্রেণী একতাবদ্ধ হয় এবং ব্যাপক জনগণের আস্থা অর্জনে সক্ষম হয় তাহলে মুষ্ঠিমেয় শােষক ধনিক প্রতিক্রিয়াশীলচক্রের পক্ষে গৃহযুদ্ধ, সামরিক হস্তক্ষেপ বা বলপ্রয়ােগের নীতি গ্রহণ করার ক্ষমতা থাকবে না। সুতরাং সমাজের জনসাধারণের সার্বিক কল্যাণ সাধনের লক্ষ্যে বলপ্রয়ােগ করা বা বলপ্রয়ােগ নয়, এটা বিপ্লবীদের ভাবনার বিষয় নয়। কারণ বিপ্লবের কোনাে গৎ বাঁধা নিয়ম নেই। সমাজের বাস্তব অবস্থা ও চলমান অবস্থার প্রেক্ষিতেই এর গতিধারা নির্ধারিত হবে। সুতরাং উপরােক্ত পর্যালােচনা থেকে এ সিদ্ধান্তেই আমরা উপনীত হতে পারি যে, বিপ্লবের অর্থ নিছক রক্তপাত হানাহানি, ধ্বংস বা বলপ্রয়ােগ নয়। এর লক্ষ্য বিকাশ। উন্নতি সৃষ্টি  গড়া সমাজ ও ব্যাপক জনগণের সার্বিক কল্যাণ, উৎপাদন বৃদ্ধি, শ্রেণীহীনশোষণহীন বৈষম্যহীনসমাজ প্রতিষ্ঠা, জনগণের মধ্যে ঐক্য-ভ্রাতৃত্ব-সহমর্মিতা-সাম্য-মৈত্রী প্রতিষ্ঠা, অপরের প্রতি ভালােবাসা, সহিষ্ণুতা, শ্রদ্ধাবােধ, উৎসর্গকৃত ও নিবেদিত প্রাণ, সততা, ন্যায়নিষ্ঠা, আত্মপ্রত্যয়, আত্মসংযম, আত্মবিশ্বাস, কর্মনিষ্ঠা, দায়িত্ববােধ, শৃংখলাবােধ, কর্তব্য পরায়ণতা, নিয়মনিষ্ঠা প্রভৃতি গুণাবলীর উত্তরণ ও বিকাশ ঘটিয়ে ‘আমরা সকলে পরের তরে’—এই মহান নীতির মাধ্যমে সমাজের সমষ্টিগত মানুষের সুখ-শান্তি-সম্ভোগ-সমৃদ্ধি-সাম্য-স্বাধীনতা ও মুক্তি আনয়ন ও তা সংহত ও নিশ্চিতকরণই বিপ্লবের প্রকৃত আদর্শ উদ্দেশ্য লক্ষ্য ও গতিপ্রকৃতি। এটাই হলাে বঙ্গবন্ধুর চিন্তাচেতনায়, শিক্ষা ও অভিজ্ঞতায় এবং তার বাস্তব পদক্ষেপের মধ্যে সামজিক বিপ্লবের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য যার উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে তাঁর রাজনৈতিক আর্থসামাজিক প্রশাসনিক ও বিচার ব্যবস্থার দিকদর্শন ও কর্মসূচী।

সূত্র : বঙ্গবন্ধু-দ্বিতীয় বিপ্লবের রাজনৈতিক দর্শন – আবীর আহাদ

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!