বঙ্গবন্ধু প্রবর্তিত গণমুখি বিচার ব্যবস্থার রূপরেখা
প্রচলিত বিচার ব্যবস্থার গতিপ্রকৃতি ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অনুধাবন করে কবি খেদোক্তি করে বলেছেনঃ বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে। বস্ততঃপক্ষে বর্তমান বিচার পদ্ধতিতে বিচারের বাণী ও প্রার্থীর দীর্ঘশ্বাস আদালতের কঠিন ইটের সাথে ধাক্কা খেয়ে গুমরে গুমরে কাঁদে। অবশেষে অসহায় ও দরিদ্র বিচার প্রার্থীর প্রাণ বায়ু শূন্যে মিলিয়ে যায়, তাতে আদালত বা আইনকানুনের কিছুই যায় আসে প্রচলিত বিচার পদ্ধতির সরূপ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু বললেনঃ বাংলাদেশের বিচার ইংরেজ আমলের বিচার। আল্লাহর মর্জি যদি সিভিল কোর্টে কে পড়ে, সেই মামলা শেষ হতে লাগে বিশ বছর। আমি যদি উকিল হই, আমার জামাইকে উকিল বানিয়ে সেই কেস্ দিয়ে যাই। ঐ মামলা ফয়সালা হয়। আর যদি ক্রিমিনাল কেস হয়, তিন বছরের আগে তা শেষ হয় না। এই বিচার ব্যবস্থাকে নতুন করে গড়তে হবে। থানায় ট্রাইবুনাল করার চেষ্টা করছি। সেখানে মানুষ যাতে ন্যূনতম সময়ের মধ্যে বিচার পায়, তার বন্দোবস্ত করছি। বঙ্গবন্ধু গ্রামীন অর্থনৈতিক তথা সামগ্রীক আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও বৈপ্লবিক গণতান্ত্রিক প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণের সাথে সাথে প্রচলিত অবিচারমূলক বিচার ব্যবস্থার জটকে ভেঙ্গে দিয়ে একে গণমুখি, সহজলব্ধ এবং ত্বরিৎ গতিসম্পন্ন করার বৈপ্লবিক কার্যক্রম গ্রহণ করেন। বিচার ব্যবস্থাকে তিনি এমনভাবে ঢেলে সাজাবার প্রয়াসী হলেন যাতে সাধারণ নিরীহ মানুষ হাতের কাছে ত্বরিৎগতিতে ন্যায় বিচার পায় এবং বিচার প্রার্থনা সহজলভ্য হয়ে ওঠে। বলাই বাহুল্য, প্রচলিত বিচার ব্যবস্থা দীর্ঘসূত্রিতায় আকীর্ণ ও হয়রানিমূলক । বর্তমান সমাজ সভ্যতার প্রবহমান কাঠামােসৃষ্ট উদ্ভূত পরিস্থিতির সুযােগে গ্রামবাংলার নিরীহ মানুষকে বিচারের নামে বছরের পর বছর হয়রানি হতে হয়। তাকে উকিল ঠকায়, উকিলের মােহরী ঠকায়, গ্রামের মতলববাজ-মামলাবাজটাউটরা ঠকায়, পেশকার ঠকায়, কোর্ট দারােগা ঠকায়, কেরাণী ঠকায় তথা এই পেশার সকলে মিলে ঠকায়, প্রতারণা করে, শোষণ করে। শোষণ দুর্নীতি ও ঘুষের দুষ্টুগ্রহ চারপাশ থেকে তাকে অক্টোপাসের মতাে বেঁধে ফেলে। বিচার প্রার্থনা করতে এসে অবশেষে এভাবে হয় সে সর্বশান্ত সর্বহারা; ঘরবাড়ি জমাজমি সবকিছু তাকে বিক্রি করতে হয়।
পরিনামে সে অকালে ঝরে পড়ে পৃথিবী থেকে বিচারের নামে অবিচার ও প্রহসনের দুর্বোধ্য-দুর্লংঘনীয় ফাদ থেকে তাকে মুক্তি পেতে হলে ভেঙ্গে ফেলতে হবে দুর্নীতিমূলক, অবিচারমূলক, অথর্ব, নড়বড়ে, পংকিলতায় নিমজ্জিত, লােকঠকানাে, লােক দেখানাে ও শােষণের খোয়াড় এই বিচার ব্যবস্থাকে । ঘুষের আঁড়ত,’ ‘ভূতের আড্ডা’, ও ‘দুষ্টের আডডা হতে বিচারকদের মুক্ত করে নিয়ে আসতে হবে গ্রামের অবারিত প্রান্তরে, মাটির মানুষের কাছে। এ জন্যে বঙ্গবন্ধু বললেনঃ ‘গ্রামবাংলার মানুষ যাতে সুবিচার পায় তার জন্যে বিচার। ব্যবস্থাকে তাদের নাগালের মধ্যে নিয়ে যেতে হবে।’ ধনতান্ত্রিক বা পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় বিচারের মানদন্ড হলাে অর্থ; আইন কানুন নয়। যিনি বিত্তবান তিনি অর্থের জোরে বড় বড় ব্যারিষ্টার উকিল রাখতে পারেন। এ সমাজে অর্থ, রাজনৈতিক-সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও প্রভাব প্রতিপত্তির জোরে বিচারককে প্রভাবিত করা যায়। কোন কোন ক্ষেত্রে বিচারককেও প্রভাবিত করা যায়। বিচারক যদি বাইরের প্রভাবকে এড়িয়ে যান বা কোনাে ক্ষমতাধর ব্যক্তির কথা না শোনেন তাহলে কোন কোন ক্ষেত্রে সেই বিচারককে হয়রানি হতে হয় বা চাকরি থেকে বহিষ্কৃত হতে হয়। এর বহু নজীর এ সমাজে রয়েছে। নিরীহ মানুষের পক্ষে কোনােভাবেই বিচারকে প্রভাবিত করা সম্ভব হয় না ফলে। সুবিচারের সুযােগ হতে সে হয় বঞ্চিত। এ ব্যতীত সুদূর প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে সুদূর মহকুমা, জেলা বা রাজধানীতে গিয়ে জজকোর্ট, হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্টে এসে বিপুল অর্থের শ্রাদ্ধ করা তাদের পক্ষে মােটেও সম্ভব নয়। সেই কারণে গ্রামের বিচার গ্রামে বা থানায় করার মহান লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু বিচার ব্যবস্থার পরিবর্তন সাধনে প্রয়াসী হলেন। সেখানে বিচার থাকবে হাতের নাগালের মধ্যে। অর্থ ও কোনাে প্রকার ক্ষমতার প্রভাব দেখিয়ে বিচার ও বিচারককে প্রভাবিত করার সুযােগ থাকবে। বিচারকার্যে দীর্ঘসূত্রিতা ও শ্লথতার কোনাে অবকাশ থাকবে না। টাউট-বাটপাড় পেশকার কেরানীদের দৌরাত্ম থাকবে না। প্রচলিত বিচার ব্যবস্থায় বিচারকদের ব্রিত ও চাকরি হারানাের ভয় থাকে। এর কারণ এই যে, বর্তমান বিচার ব্যবস্থা প্রশাসনের কব্জায়। আদালতে যিনি বিচারক, তিনিই আবার নির্বাহী প্রশাসক। এ এক অদ্ভূত, কিংভূতকিমাকার, জগাখিচুড়ি ও গোঁজামিলের বিচার পদ্ধতি। নির্বাহী প্রশাসক মূলতঃ রাজনৈতিক বা ক্ষমতাসীন পার্টির রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তিনি রাজনৈতিক সরকারের নিদের্শন পালনে অঙ্গিকারাবদ্ধ, তিনিই যখন আবার বিচারক তখন বিচার নিরপেক্ষ হতে পারে না। ফলে বিচার হয়ে থাকে একতরফা, একদেশদর্শী ও পক্ষপাত দুষ্ঠ । এ জাতীয় বিচার প্রসহসনমূলক বৈ কিছু নয় যা অবিচারেরই নামান্তর।
সেই জন্যে বঙ্গবন্ধু বললেনঃ ‘বিচার বিভাগ হকে সম্পূর্ণ স্বাধীন। বিচার ব্যবস্থাকে স্বাধীন, নিরপেক্ষ, প্রশাসন ও রাজনীতিমুক্ত রাখার জন্যে বঙ্গবন্ধু আমাদের জাতীয় শাসনতন্ত্রে রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতির ২২ নং ধারায় বলে দিলেনঃ রাষ্ট্রের নির্বাহী অঙ্গসমূহ হইতে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ রাষ্ট্র নিশ্চিত করিবেন। এ প্রসঙ্গে বাকশাল গঠনতন্ত্রের (১০) উপধারায় বলা হয়েছে “কোন সরকারি, আধাসরকারী, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, আইনবলে গঠিত সংস্থা ও করপােরেশন প্রভৃতির কর্মচারি সদস্যপদপ্রার্থী হইলে তাকে পূর্ণ সদস্যপদ কিংবা প্রার্থী সদস্যপদ দানের ক্ষমতা জাতীয় দলের চেয়ারম্যানের উপর ন্যস্ত থাকবে, তবে আদালতে বিচারকার্যে নিযুক্ত কোনাে কর্মচারী বা বিচারক আদৌ জাতীয় দলের সদস্য পদ প্রার্থী হইতে পারিবে না।” ৭ই আগষ্ঠ, ১৯৭৫ সাল বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎকারের সময় তিনি বললেনঃ ‘বিচার বিভাগের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ আদালত বা সুপ্রিম কোর্টকে রাজধানীতে বহাল রেখে হাইকোর্ট ডিভিশনকে ৮টি আঞ্চলিক বিভাগে বিকেন্দ্রিকরণের ব্যবস্থা নিয়েছি। তবে সুপ্রিম কোর্টের অধিবেশন বছরে অন্ততঃপক্ষে একবার করে প্রতিটি (বিচার বিভাগীয়) আঞ্চলিক বিভাগে বসবে জেলা আদালতসমূহ বহাল থাকবে। থানাতে থাকবে বিশেষ থানা ট্রাইবুনাল। গ্রাম পর্যায়ে থাকবে শালিস বাের্ড। শালিস বাের্ড গঠিত হবে স্থানীয় মুক্তিযােদ্ধা শিক্ষক ও অন্যান্য গণ্যমান্য ব্যক্তি সমন্বয়ে। সরকার কতৃক শালিস বাের্ডের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হবেন। তবে শালিস বাের্ড থানা প্রশাসনের এখতিয়ারে থাকবে। এইভাবে সুষ্ঠ গতিশীল নিরপেক্ষ স্বাধীন দ্রতগতিসম্পন্ন ও বিকেন্দ্রিক বিচার ব্যবস্থা প্রবর্তন করে সুষ্ঠু ও ন্যায় বিচারকে নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যেই প্রচলিত বিচার ব্যবস্থাকে বিপুলভাবে সংস্কার করার কর্মসূচী নেয়া হয়েছিল। ‘ দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন’—এ মহান লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু প্রচলিত বিচার বিভাগকে পুনর্গঠিত করে বিচারপ্রাপ্তিতে সহজলভ্যতা, ত্বরিৎগতিসম্পন্ন, পুরােপুরি গণমুখি, প্রগতিশীল এবং স্বাধীন সার্বভৌম ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করার যাবতীয় কর্মসূচী হাতে নিয়েছিলেন।
সূত্র : বঙ্গবন্ধু-দ্বিতীয় বিপ্লবের রাজনৈতিক দর্শন – আবীর আহাদ