জয় বাংলা ২৬ নভেম্বর ১৯৭১ তারিখের মূল পত্রিকা
মূল পত্রিকা পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
জয় বাংলা
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাপ্তাহিক মুখপত্র
প্রথম বর্ষ ২৯ সংখ্যা, মুজিবনগর, শুক্রবার ৯ই অগ্রহায়ন, ১৩৭৮ ২৬শে নভেম্বর, ১৯৭১
ঢাকা বিচ্ছিন্ন
মৃত পাকিস্তানে জরুরি অবস্থা
বিমান ভূপাতিতঃ ট্যাংক ধ্বংসঃ এলাকার পর এলাকা মুক্ত (রণাঙ্গন প্রতিনিধি প্রেরিত)
মুক্তিবাহিনী সকল রণাঙ্গনে দুর্বার বেগে এগিয়ে চলেছে। পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের সকল ফ্লাইট বাতিল করা হয়েছে এবং পাকিস্তান জঙ্গী চক্র জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে। ঢাকা শহর এখন কার্যত বাংলাদেশের দখলীকৃত অন্যান্য জেলা থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। ঢাকা জেলার মুন্সিগঞ্জ থানা সহ প্রায় তিন থানায় স্বাধীনতার পতাকা উড্ডীন হয়েছে।
সর্বশেষ প্রাপ্ত খবরে প্রকাশ মুক্তিবাহিনীর মৃত্যুঞ্জয়ী গেরিলা যোদ্ধারা সমগ্র বাংলাদেশের শত্রু সৈন্যদের উপর্যুপরি প্রচন্ড আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছেন।
মুক্তিবাহিনীর অসমসাহসী যোদ্ধারা যশোর, রাজশাহী, রংপুর, সিলেট, চাটগাঁ, নোয়াখালী, কুমিল্লা প্রভৃতি রণাঙ্গনে খান সেনাদের উপর তীব্র থেকে তীব্রতর আঘাত হেনে চলেছে।
আমাদের তরুণরা মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা রেখে গত ২১শে নভেম্বর যশোর ক্যান্টনমেন্টে হানাদার বাহিনীর উপর সামনা সামনি চালিয়ে আক্রমণ করে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করেন। মুক্তিবাহিনীর অপূর্বর রণনৈপুন্য ও সাহসিকতাপূর্ণ আক্রমণ যশোরে পাকিস্তানি সৈন্যদের পাঁচটি মাঝারি ট্যাংক ধ্বংস হয়। একটি পাকিস্তানি বোমারু বিমান হানাদার পদাতিক বাহিনীকে সাহায্য করতে এগিয়ে এলে সেই মোক্ষম মুহূর্তে গেরিলা যোদ্ধাদের বিমান বিধ্বংসী কামানের অব্যর্থ গোলায় পাকিস্তানি বোমারু বিমান ভূপাতিত হয়। এর আগে মুক্তিবাহিনী কক্সবাজার ও নোয়াখালীর পরশুরামে দুইটি এছাড়া মেঘনা নদীতে তিনটি হানাদার বিমান ভূপাতিত করেন। জাহাজ ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছে।
মুক্তিবাহিনী প্রচণ্ড চাপে দক্ষিণের খুলনা- যশোর থেকে উত্তরে রংপুর- সিলেটে পাকিস্তানি সৈন্যদের দখলীকৃত দশটি শক্তিশালী ঘাঁটি সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।
মুক্তিবাহিনীর তীব্র অভিযানের চাপে খুলনা রণাঙ্গনের সাতক্ষীরা, কালিগঞ্জ, ভোমরা ও কলারোয়া; রংপুরের জগদ্দল, অমরখানা, হাতীবান্ধা ও রায়গঞ্জ, যশোরের চৌগাছা এবং সিলেটের জকিগঞ্জ ও সাত গ্রাম এলাকা সম্পূর্ণভাবে আমাদের করায়ত্ত হয়েছে।
সিলেটে মুক্তিবাহিনীর প্রচন্ড আক্রমণের মুখে শত্রুরা এখন শহরে মুখে পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য হচ্ছে।
এদিকে কুষ্টিয়া জেলায় মুক্তি বাহিনীর দুর্জয় অভিযানের মুখে বিপর্যস্ত পাকিস্তানি সৈন্যরা আরো পশ্চাদ্ভাগে ছুটে পালিয়ে যায়। মুক্তিবাহিনী কুষ্টিয়া জেলা ও যশোরের সীমান্তবর্তী সহস্রাধিক বর্গমাইল এলাকা সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত করেছেন।
আমরা বিজয় উৎসব পালন করবো
পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত জাতির প্রতি প্রদত্ত বাণীতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি নজরুল ইসলাম বলেন, পবিত্র রমজান মাসেও হানাদার বাহিনীর বর্বরতায় বাংলাদেশের মুসলমান, হিন্দু নির্বিশেষে অসংখ্য নর নারী নিহত হচ্ছে। গত বছর আমরা ১২ই নভেম্বরের প্রলয়ঙ্করী ঝড়ে নিহত দশ লক্ষ মানুষের মূহ্যমান অবস্থায় ঈদ উৎসব পালন করতে পারিনি। এবারও আমরা ইয়াহিয়ার সৈন্যদের বর্বরতায় নিহত দশ লাখ ভাই বোনের বিয়োগ বেদনা বুকে নিয়ে ঈদের জামাতে শামিল হয়েছি। কিন্তু দুঃখ-কষ্ট যাইহোক এবার ত্যাগের মন্ত্রে আমরা উদ্বুদ্ধ এবং যেকোনো মূল্যে স্বাধীনতার ঘোষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে বদ্ধপরিকর। দেশকে শত্রুমুক্ত করার পরই মাত্র ঈদুল ফতেহ্ বা বিজয়ের ঈদ উৎসব পালন করব এবং সেদিন যে খুব দূরে নয় এই প্রতিশ্রুতি আমি আপনাদেরকে দিতে পারি।
জাগ্রত বাঙালি
বিখ্যাত মার্কিন সাপ্তাহিক নিউজ উইক-এর বিশিষ্ট সাংবাদিক ঢাকা থেকে লিখেছেন যে, সামরিক ও রাজাকার বাহিনীর অত্যাচার বাংলাদেশের মানুষের মনে ভীতির সঞ্চার না করে প্রতিশোধ স্পৃহাকে দৃঢ় করেছে। গত ১৫ই নভেম্বরের সংখ্যায় তিনি এই কথা লিখেছেন। নিউজ উইক এর সংবাদদাতা উল্লেখ করেছেন যে তাকে একজন খুব তথ্য অভিজ্ঞ ও নির্ভরযোগ্য বিদেশি কূটনীতিক বলেছেন পাক সামরিক বাহিনীর বর্বর নীতি অনুসরণ করে চলেছে। তাদের মনের মুক্তিবাহিনীর ভয় এতো প্রবল হয়ে উঠেছে যে, আরে মুক্তিবাহিনীর নিয়োগ (অস্পষ্ট)।(…)
৪৮ ঘণ্টাব্যাপী প্রচন্ড যুদ্ধে ৫৭ জন জানোয়ার হত্যা
(রণাঙ্গন প্রতিনিধি)
বাংলাদেশের মৃত্যুঞ্জয়ী মুক্তি নোয়াখালী জেলার পরশুরাম যোদ্ধারা ৯ই এবং ১০ই নভেম্বর থানায় পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালিয়ে সম্পন্ন থানাকে দখলমুক্ত করেছে। এই প্রচন্ড যুদ্ধ ৪৮ ঘণ্টা স্থায়ী হয়।
মুক্তিবাহিনীর প্রচন্ড আক্রমণের রণাঙ্গনেই ৫৭ জন সৈন্য খতম হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের বলিষ্ঠ কব্জির মারে ভীতসন্ত্রস্ত ৮৪ জন পলায়নপর পাকিস্তানী সৈন্য কে মুক্তিযোদ্ধারা পাকড়াও করে এবং দিশেহারা ২১ জলখানা এবং ২০ জন রাজাকার আত্মসমর্পণ করে।
হায়েনা খানসেনাদের এই বধ্যভূমি থেকে আমাদের অপরাজেয় মুক্তিবাহিনী ২২৫টি স্বয়ংক্রিয় চীনা রাইফেল, ১৯ বাক্স চীনা রাইফেল (৩০৩), ১৮টি হালকা মেশিন গান, ৩৬টি ৩ ইঞ্চি মর্টার, ২৬টি ২ইঞ্চি মর্টার এবং ১১ বেল্ট হালকা মেশিনগানের পেয়েছেন।
পরশুরাম থানা দখলের পর যখন মুক্তিবাহিনী এলাকায় নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার কাজে ব্যস্ত ছিল তখন চারটি হানাদার জঙ্গিবিমান আমাদের অবস্থানের উপর আক্রমণ চালায়। আমাদের অসমসাহসী মুক্তিযোদ্ধারা বীরের মতো হানাদারদের বিমান আক্রমণ প্রতিহত করে।
জনাব সিরাজ নামক এক দুঃসাহসী মুক্তিযোদ্ধা নিজের জীবন বিপন্ন করে মেশিনগানের সাহায্যে একটি বিমান কে ঘায়েল করে ভূপাতিত করার পর অন্য বিমানগুলি পালিয়ে যায়। এই অসম সাহসী মুক্তিযোদ্ধা বিমান ভূপাতিত করতে গিয়ে বীরের মৃত্যুবরণ করেন। তাকে পুরো সামরিক মর্যাদায় সমাহিত করা হয়েছে মুক্ত জন্মভূমির পবিত্র মাটিতে।
স্বাধীনতা লাভের দিন নিকটে
-প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমেদ জাতির উদ্দেশ্যে এক ভাষণে বলেন, অশ্রু রক্তের বিনিময়ে যে স্বাধীনতার জন্য আমরা লড়ছি, সে স্বাধীনতা লাভের দিনটি অতি নিকটে।’ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ২৩শে নভেম্বর রাতে এই ভাষণ প্রচারিত হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন স্বাধীনতার ধারণা অশেষ অর্থবহ। স্বাধীনতার তাৎপর্য নির্ভর করে যুদ্ধাবস্থায় এর জন্য আমরা কি মূল্য দেয় এবং শান্তির সময়ে এর কি ব্যবহার করি তার উপর। তিনি বলেন বাংলাদেশের শহরে ও গ্রামে তরুণেরা যে যুদ্ধে লিপ্ত তা বিদেশী দখলদারকে বিতাড়িত করার সংগ্রাম এবং অসংখ্য সুবিধাভোগের অবসান ঘটানোর সংগ্রাম। তিনি আরো জানান আমাদের আজকের সংগ্রাম সেদিনের সার্থক হবে যেদিন আমরা বঙ্গবন্ধুর প্রতিশ্রুত ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হব। সমাজের যে ভবিষ্যতে আজ বাংলাদেশের জনসাধারণের প্রত্যক্ষ করেছেন, সেখানে সকলের সমানাধিকার ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবন গঠিত হবে এবং উন্নয়ন ও পরিপূর্ণতার সাধারণ লক্ষ্যে উপনীত হবার প্রয়াসে সকলে অংশগ্রহণ করবেন।
প্রধানমন্ত্রী তার বেতার ভাষণে বলেন যে, সামরিক শাসকদের আত্মহত্যার যে ব্যবস্থাই করে থাকুক না কেন, আর এই রকম উপমহাদেশের জন্য যে ব্যবস্থাই বিশেষ বিশেষ রাষ্ট্রের মধ্যে মনঃপুত হোক না কেন বাংলা দেশের জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যবস্থা একটিই -আর তা হলো পূর্ণ স্বাধীনতা। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধ তীব্রতর হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, “ঠিক সময়ে এই উপমহাদেশে তথ্য সংগ্রহের জন্য একটি বিশেষ দল পাঠিয়ে প্রেসিডেন্ট নিক্সন কি উদ্দেশ্য সাধন করতে চান? তার দেশের কূটনীতিবিদ আইনসভা সদস্যরা অবগত নন এমন কি নতুন তথ্য তিনি জানতে ইচ্ছুক? দশ লক্ষ বাঙালিকে সুপরিকল্পিতভাবে হত্যা এবং প্রায় এক কোটি মানুষকে বাধ্য করা সত্তেও পাকিস্তান সরকারকে তার প্রশাসন নিন্দা করেন নি। এখন তথ্য সংগ্রহ পাঠিয়ে কি ফল তারা লাভ করতে চান, তা জানি না।” প্রধানমন্ত্রী বলেন, তবে এতে আমাদের সংকল্পের কোন ব্যত্যয় হবে না। সে সংকল্প হলো দেশকে শত্রুমুক্ত করে নিজেদের অভিপ্রেত সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা।”
ঢাকা বেতার এর স্বীকৃতি
দখলীকৃত ঢাকা বেতার থেকে গত ২২শে নভেম্বর রাত ১১:২০ মিনিটের বুলেটিনে এই সংঘর্ষের বিকৃত খবর পরিবেশন করা হয়। “এই সংঘর্ষে প্রতিপক্ষ কিঞ্চিৎ সাফল্য অর্জন করে।”
কুমিল্লায় ব্যাপক আক্রমণ
মুক্তিবাহিনীর দুর্ধর্ষ বীর যোদ্ধারা পূর্ব রণাঙ্গনের কুমিল্লাতেও সফল অভিযান অব্যাহত রেখেছে। কুমিল্লার হাজিগঞ্জ থানা, ফরিদগঞ্জ, রামাহানপুর, সাহাপুর অঞ্চলে দখলদার সৈন্যদের উপর আক্রমন করে পিছু হটিয়ে দিয়েছেন।
মুক্তিবাহিনী এদিকে খুলনা জেলার বসন্তপুর দখল করেছেন এবং সাতক্ষীরার দিকে এগিয়ে চলার অভিযান অব্যাহত রেখেছেন।
রাজশাহীতে তৎপরতার
রাজশাহী জেলার মিরাজগঞ্জ এবং রামপুরার বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রও এখন মুক্তি বাহিনীর দখলে।
২১ জন সৈন্য বন্দী
কুমিল্লার রণাঙ্গনে আখাউড়া রণাঙ্গনের মুকুন্দ পুর রেলওয়ে স্টেশন ও প্রায় আট বর্গমাইল এলাকা মুক্তিবাহিনীর পাকিস্তানী সৈন্যের কবল থেকে উদ্ধার করেছেন। এ রণাঙ্গনে পাঁচ জন পাকিস্তানী সৈন্য আট জন রাজাকার ও আট জন পাকিস্তানি রেঞ্জার মুক্তিবাহিনীর হাতে বন্দী হয়।
বাংলাদেশের ২৪ বছরের ইতিহাস
জনাব মান্নান কর্তৃক কার্টুন প্রদর্শনীর উদ্বোধন
( কলকাতা প্রতিনিধি প্রেরিত)
বাংলাদেশের কার্টুন শিল্পী সৈয়দ আব্দুল মতিনের ব্যঙ্গচিত্রের একটি একক প্রদর্শনী কলকাতার পার্ক সার্কাস ময়দানে শুরু হয়েছে।
জয়বাংলা সাপ্তাহিক-এর সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি এবং বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও বেতার বিভাগের ভারপ্রাপ্ত পার্লামেন্ট সদস্য জনাব আব্দুল মান্নান প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন। প্রদর্শনীতে যোগদানের জন্য জনাব মান্নান, পার্লামেন্টের সদস্য জনাব জিল্লুর রহমান মিস রাবেয়া আক্তার ডলি মুজিবনগর থেকে কলকাতায় আসেন।
শিল্পী সৈয়দ আব্দুল মতিন বাংলাদেশের ২৪ বছরের সংগ্রামের ইতিহাস কে ছবিতে চিত্রিত করেছেন।
উদ্বোধনী ভাষণে জনাব আব্দুল মান্নান বাংলাদেশের এক কোটি শরণার্থী কে ভারতে আশ্রয়দান এবং ভরণপোষণের ব্যবস্থা এবং বাংলাদেশের সরকারের প্রতি ভারতের সরকার ও জনগণের নৈতিক সহায়তা দানের জন্য গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
পার্লামেন্ট সদস্য জনাব মান্নান বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের সংগ্রামের ইতিহাস বিবৃত করে তিনি আমাদের এই জীবন মরণ সংগ্রামে পৃথিবীর প্রতিটি দেশ এবং জনগণের সর্বাত্মক সমর্থন ব্যাখ্যা করেন। কোন দেশের নাম উল্লেখ না করে তিনি বলেন যে, পৃথিবীর যে কয়টি দেশ আজ পর্যন্ত আমাদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করেনি তাদের সহানুভূতি ও অচিরেই আমরা পাব বলে আশা রাখি। একদিন না একদিন সে সব দেশ তাদের ভুল বুঝতে পারবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
জনাব মান্নান বক্তৃতা প্রসঙ্গে যেসব দেশ আমাদের নৈতিক ও বৈষয়িক সাহায্য দিচ্ছে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে তিনি সেসব দেশ এবং দেশের জনগণের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
প্রত্যয় দৃঢ় কন্ঠে জনাব মান্নান ঘোষণা করেন, সাড়ে সাত কোটি বাঙালি যেকোনো মূল্যে বাংলাদেশের ঘোষিত স্বাধীনতা সংরক্ষণের জন্য শেষ হানাদার বাহিনী নিশ্চিহ্ন না করা পর্যন্ত বীরের মতো লড়েই যাবে। আমরা আমাদের প্রতিটি রক্তবিন্দুর জন্য প্রতিশোধ গ্রহণ করব এবং করছি।
বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মহান উদ্গাতা এবং আমাদের মহান রাষ্ট্রনায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আশু মুক্তির দাবি জানান। তিনি বলেন গণতন্ত্রের মহানায়ক শেখ মুজিবুর রহমানকে কারাগার থেকে মুক্ত করার দায়িত্ব সমগ্র গণতান্ত্রিক বিশ্বের।
তিনি বাংলাদেশ সরকারের ঘোষিত নীতিসমূহের উল্লেখ করে বলেন আমাদের আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা।
জনাব মান্নান আরো বলেন, জল্লাদ ইয়াহিয়া তার পৈশাচিক কাজ কর্ম দ্বারা বিশ্বসভ্যতা, গণতন্ত্র, মানবতা, বিশ্বশান্তি এবং মানবিক মূল্যবোধের প্রতি বিদ্রুপ করেছে। এই জানোয়ারকে নিবৃত্ত করার দায়িত্ব শুধু বাংলার মানুষের নয়, সারা পৃথিবীর মানুষের।
পার্লামেন্ট সদস্য রাফিয়া আক্তার ডলি তার বক্তৃতায় বলেন, বীরের এ রক্তস্রোত ও মাতার অশ্রুধারা প্রত্যক্ষ করে আমাদের আন্দোলনের প্রতি আপাতঃ সহানুভূতিশীল দেশ ও তাদের মতের পরিবর্তন করবেই।
ভারত সরকার ও জনগণের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা জানিয়ে সদস্যা বলেন, ভারত আমাদের আন্দোলনের প্রতি নৈতিক সাহায্য ও সহযোগিতা না করলে আমরা আন্দোলনের এ পর্যায়ে হয়তো উন্নীত হতাম না।
জনাব গাজীউল হক বক্তৃতা প্রসঙ্গে বাংলাদেশের প্রতি সঠিক সমর্থন দানের জন্য প্রত্যেকটি দেশের প্রতি আবেদন জানান।
অনুষ্ঠানে পশ্চিমবঙ্গ ছাত্র পরিষদের সভাপতি শ্রী সুব্রত মুখার্জি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংরক্ষণের সংগ্রামের প্রতি ভারতীয় জনগণের সরকারের একাত্মতার বিষয়ে পুনরায় উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের সংগ্ৰামকে বিশ্বের কোন দেশ কি দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করছে তা দেখে বাংলাদেশের প্রতি ভারতের নীতি প্রণীত হয়নি এবং হবে ও না। ভারত গণতন্ত্রের পূজারী বলে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রতি দৃঢ় সমর্থন জানাচ্ছে এবং জানাবে।
দালাল খতম চলছে চলবে-
ঢাকা, ২৩শে নভেম্বর।- সম্প্রতি একজন বিদেশী সাংবাদিক মিঃ ক্লেয়ার হলিংওয়ার্থ পাকিস্তান সামরিক সরকারের গোপন সূত্র উদ্ধৃত করে বলেছেন, শহর গুলোতে মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যোদ্ধাদের তৎপরতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় এখন দৈনিক কমপক্ষে বিশ জন হানাদার সৈন্য প্রাণ হারাচ্ছে।
মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যোদ্ধারা হানাদার সৈন্য ও তাদের তাবেদার দালালদেরকে যুগপৎ খতম করে চলেছেন।
এবিসি-র (অস্ট্রেলিয়া ব্রডকাস্টিং করপরেশন) এক খবরে মুক্তিবাহিনীর অসম সাহসী বীর যোদ্ধারা গত ১৮ই নভেম্বর দখলীকৃত চাটগাঁ বেতারের জনৈক সহকারে আঞ্চলিক পরিচালক কে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করে। এর আগে ঢাকা বেতারের জনৈক সিনিয়র রেডিও ইঞ্জিনিয়ার কে প্রকাশ্য দিবালোকে পাকিস্তানি সৈন্যদের কড়া টহলদানের মধ্যে গ্রীনরোডের পথের উপর হত্যা করা হয়। এই আক্রমণ কালে ঐ ইঞ্জিনিয়ারের পার্শ্ববর্তী অন্য দুইজনকেও গুরুতররূপে আহত করেন।
গত ১১ই নভেম্বর আমাদের বীর সেনানীরা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দখলকৃত ঢাকা শহরের চারদিকে ব্যাপকভাবে আক্রমণ চালিয়ে কমপক্ষে আটজন বেইমান কুখ্যাত দালালকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছেন।
মুক্তিযোদ্ধারা আর একটি সফল আক্রমণ চালান বায়তুল মোকাররমে। মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের সংবাদ পরিবেশন করে ঢাকা বেতার কেন্দ্র জানাচ্ছে যে, গেরিলা যোদ্ধারা আত্মসমর্পণের বায়তুল মোকাররমের সম্মুখে কতিপয় দালাল দের পার্ক করা মোটর গাড়ির সাথে বোমা লাগিয়ে রাখেন এবং সময়মতো বোমা বিস্ফোরিত হলে উক্ত এলাকায় এক ভয়াবহ দৃশ্যের অবতারণা হয়। এই আক্রমণে ৫ জন নিহত এবং ৩৬ জন গুরুতররূপে আহত হয়। এছাড়া খানসেনা তাবেদারদের কয়েকটি গাড়ি বিনষ্ট হয়।
ঐদিন অপর এক স্থানে মুক্তিযোদ্ধারা দুর্বার আক্রমণ চালিয়ে একজন দক্ষিণপন্থী রাজনীতিবিদসহ অপর তিনজনকে গুলি করে হত্যা করেন।
একই দিনে গেরিলা যোদ্ধারা একটি কলেজ ও একটি সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে বোমা দ্বারা আক্রমণ চালিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির মারাত্মক ক্ষতিসাধন করেন। এখানে উল্লেখযোগ্য পাকিস্তানি জানোয়ার সৈন্যরা এখানে অবস্থান করছিল।
মিথ্যাবাদী রাখাল বালকের পরিণতি
উপকথার মিথ্যাবাদী রাখাল বালকের গল্প সকলেরই জানা। এই মিথ্যাবাদী বালক দিনরাত কেবল চিৎকার করত, বাঘ এসেছে, বাঘ এসেছে। গ্রামবাসীরা ছুটে এসে দেখতো বাঘ আসেনি। বালকটি তাদের সঙ্গে তামাশা করেছে। ফলে তারা বিরক্ত হয়ে চলে যেত। একদিন সত্যি সত্যিই যেদিন বাঘ এলো সেদিন মিথ্যাবাদী রাখাল বাঘ এসেছে, বাঘ এসেছে বলে অনেক চেঁচালো। কিন্তু কেউ এগিয়ে গেল না রক্ষা করতে।
পাকিস্তানের বর্বর জঙ্গী চক্রের নেতা ইয়াহিয়ার অবস্থাও আজ মিথ্যাবাদী রাখাল বালকের মত। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার সময় থেকেই ইয়াহিয়া এবং তার জয়ঢাক গুলো তারস্বরে যাচ্ছে, ভারত পাকিস্তান আক্রমণ করেছে এবং বাঙালির মুক্তিযোদ্ধারা হচ্ছে ভারতীয় চর ও অনুপ্রবেশকারী। ইয়াহিয়া চক্রের চিৎকারে প্রথমদিকে অনেকেই বিভ্রান্ত হয়ে ছিলেন। ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রের নামকরা সরকারি ও বেসরকারি প্রতিনিধিরা এসেছেন ভারত ও পাকিস্তানে। ফিরে গিয়ে তারা বলেছেন, ইয়াহিয়া মিথ্যাবাদী। ভারত কোথাও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালায় নি। বরং পাকিস্তানি হানাদারের অত্যাচারে এক কোটির মতো শরণার্থী ভারতে পালিয়ে এসে ভারতের অর্থনীতির উপর গুরুতর চাপ সৃষ্টি করেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যারা লড়াই করছে, তারা অস্ত্রবলে হানাদার পাকিস্তানি দের কাছে কিছুই নয় এবং তারা সকলেই বাংলাদেশের মানুষ, কেউ ভারতীয় নয়।
কিন্তু ইয়াহিয়ার চিৎকার করা থামেনি। বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিরা বাংলাদেশের ইয়াহিয়া চক্রের অত্যাচারের যে লোমহর্ষক বিবরণ দিয়েছেন, ব্রিটিশ এমপি এবং মার্কিন সিনেটর গণ স্বচক্ষে বাংলাদেশের যে নিষ্ঠুর বর্বরতা প্রত্যক্ষ করে গেছেন, তারপরও পিন্ডি চক্রের ফ্যাসিস্ট বেহায়া খান চিৎকার করে বলছে, ভারত এবং ভারতীয় চরেরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালাচ্ছে। যদি একথা সত্য হয়ে থাকে, তাহলে বেহায়া খানের সেই পেশাদার সৈন্যরা কোথায়, যারা কেবল গুলিবর্ষণের জন্য গুলি চালায় নি? গত একমাস যাবত ভারতীয় অনুপ্রবেশকারীরা ইয়াহিয়ার রাজত্বে যুদ্ধ চালাচ্ছে, আর ইয়াহিয়া ও টীক্কার মত বীরপুঙ্গব জেনারেলরা বসে বসে খেলা দেখছেন, এটা কোন পাগলে বিশ্বাস করবে? এই সেদিনও তো ইয়াহিয়া বড় গলায় হুংকার ছেড়েছে, বিশ্ব জেনে রাখুক আমি যুদ্ধ করব। তা ভদ্রলোক যখন এত বড় যোদ্ধা, তখন ভারতীয় অনুপ্রবেশকারীদের কচুকাটা করতে পারছেন না কেন?
আসলে মিথ্যাবাদী রাখাল বালক এখন ধরা পড়ে গেছে। বিশ্ববাসীর জেনে গেছে ভারতের হাতে নয়, ইয়াহিয়ার নরপশু সৈন্যরা এখন মার খাচ্ছে বাঙালি মুক্তিবাহিনীর হাতে। মার খেয়ে তাই ইয়াহিয়াকে মার হজম করতে হচ্ছে আর লজ্জা ঢাকার জন্য চেঁচাতে হচ্ছে, ভারত তা কে মারছে। হায়রে মিথ্যাবাদী রাখাল বালকের কি করুন শেষ পরিণতি।
ইতিহাস আমাদের পক্ষে
-অধ্যাপক সামাদ
অপরাজেয় বাহিনীর পরাজয়ের কারণ। নেপোলিয়ন ছিলেন বিরাট সেনাপতি। তার বাহিনী ছিল খুবই সুশৃংখল। কিন্তু ইউরোপে তার যুদ্ধ জয়ের পিছনে কেবল তার রণকুশলতা ছিল না। ইউরোপের বিভিন্ন দেশের জনসাধারণ ভাবতো তাদের নিজের দেশের রাজার চাইতে নেপোলিয়ন অনেক ভালো। নেপোলিয়ন তৈরি আইন-বিধি তাদের মঙ্গল করবে। তাই তারা কার্যত সমর্থন করতো নেপোলিয়নকে। কিন্তু রুশরা এমন ভাব দেখায় নি নেপোলিয়ন সম্পর্কে। তারা লড়াই করেছিল জার এর পক্ষ নিয়ে। তারা এই যুদ্ধকে গ্রহণ করেছিল রাশিয়ার স্বাধীনতা যুদ্ধ হিসেবে। রুশ বিপ্লবী নেতা লেলিন নেপোলিয়ন ও জার এর মধ্যকার যুদ্ধকে রাশিয়ার স্বাধীনতা যুদ্ধ হিসেবেই উল্লেখ করেছেন।
গত মহাযুদ্ধে রুশ রণক্ষেত্র হিটলারের বাহিনীর পরাজয়ের কারণ ও ছিল রাশিয়ার ভৌগোলিক পরিবেশ ও রুশ নাগরিকদের দেশ প্রেম। যুদ্ধের ভাগ্য যুদ্ধেই নির্ধারিত হয় একথা অনেক পরিমাণে সত্য হলেও তাই বলতে হয়, একথা বলে পরিমাণে সত্য হলেও তাই বলতে হয়, দূর বিদেশে প্রতিকূল পরিবেশে, দেশ প্রেমিক সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধ করে যুদ্ধে জেতা সহজ নয়। যুদ্ধের ইতিহাস এ শিক্ষাই বিশেষভাবে দিয়ে থাকে।
সেনাপতি ইয়াহিয়া যখন বাঙ্গালীদের উপর পাকবাহিনীকে আক্রমণ চালাতে নির্দেশ দিয়ে ঢাকা পরিত্যাগ করেন, তখন তিনি রাওয়ালপিন্ডি থেকে ঢাকার দূরত্বের কথা চিন্তা করেননি। ভাবতে পারেননি, বাঙ্গালীদের দেশপ্রেমের কথা। তিনি ভেবেছিলেন পাক ফৌজের সামরিক কুশলতা ও শক্তি, কৃষকের জাত বাঙালিকে মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পরাভূত করতে পারবে। সব শেষ হয়ে যাবে মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে। তারামানি কথা ভাববার মূলে আরেকটি কারণ ও ছিল ঃ জুলফিকার আলী ভুট্টো ও আরো অনেক তথাকথিত বামপন্থী তাকে বুঝিয়েছিলো, বাঙালি জাতীয়তাবাদ কেবল বাঙালি মধ্যবিত্ত ও কিছু বাঙালি সরকারি কর্মচারীর ব্যাপার। এদের বাস শহরে। শহরগুলিকে দখলে রাখতে পারে বিশেষ করে ঢাকা শহরের ত্রাসের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই এই আন্দোলনের সব নেতৃত্ব নষ্ট হয়ে যাবে। থেমে যাবে সব আন্দোলন ও প্রতিরোধ। তাদের এই ব্যাখ্যাটাই ছিল ভুল। কারণ বাঙালি জাতীয়তাবাদ ছিল সমগ্র বাঙালি জাতির ব্যাপার। যে জাতীয়তা গড়ে উঠেছে ইতিহাসের ধারায়, নির্দিষ্ট ভৌগোলিক পরিবেশে, বিশিষ্ট সংস্কৃতি, ভাষা ও অর্থনৈতিক স্বার্থকে ঘিরে। এটা কোন আয়াতে বিশেষ শ্রেণীর ব্যাপার নয়- একটা গোটা জাতির ব্যাপার। একটা সমগ্র জাতিই তাই ঝাঁপিয়ে পড়ল যুদ্ধে। তারা তাদের নেতার কথা অনুসারে এগিয়ে এলো মৃত্যুপণ করে।
ভবিষ্যতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস লিখতে গিয়ে ঐতিহাসিকরা বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থান ও বাঙালির দেশপ্রেমের উপর অধিক গুরুত্ব দেবেন। কারণ এই দুটি ঘটনাই নিয়ন্ত্রিত করছে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের ধারাকে।
যুদ্ধ এখনো চলছে। কিন্তু যুদ্ধের গতি কি হবে, তা এখন অনুমান করতে আর অসুবিধা নেই কিছু। এ যুদ্ধের ইতিহাস আজ বাঙালির পক্ষে।
চূড়ান্ত আঘাত ও বিজয় লাভের পবিত্র লগ্নে
জয়বাংলা। বাংলাদেশের জয় হোক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দীর্ঘজীবী হোন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্থায়ী ও জয়ী হোক। সকল রণাঙ্গন থেকে বহু প্রত্যাশিত বিজয়ের খবর আসছে। এ সপ্তাহের জয়বাংলা যখন পাঠকের হাতে পৌঁছাবে তখন আমরা ইনশাআল্লাহ দাবি করতে পারব বাংলাদেশের দখলকৃত এলাকার এক-তৃতীয়াংশের বেশি শত্রুপক্ষের দখলে নেই। সর্বত্র পাকিস্তানি হানাদার সৈন্যেরা মার কাছে। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ, বঙ্গবন্ধুর ত্যাগের মন্ত্রে উজ্জীবিত বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর পূর্ব-পশ্চিম উত্তর-দক্ষিণ সকল রণাঙ্গনে দৃপ্ত পদভরে এগিয়ে যাচ্ছে। এই নিবন্ধ লেখার সময় খবর এসেছে যশোর ক্যান্টনমেন্ট শত্রু মুক্ত হওয়ার পথে। সাতক্ষীরা এখন মুক্ত এলাকা। গোটা খুলনা জেলা অতি দ্রুত মুক্ত এলাকা হতে যাচ্ছে। অন্যদিকে ঢাকার অদূরে মধুপুর মুক্তিবাহিনী আবার শক্তিশালী ঘাঁটি সন্নিবেশ করেছেন। কুমিল্লার পথে মুক্তিবাহিনী এগিয়ে চলেছে। পদ্মা ও মেঘনার বুকে মুজিব নৌবহর সক্রিয়। প্রচন্ড পাল্টা আক্রমণে হানাদারের গানবোট ডুবছে। তাদের হতাহতের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। আকাশপথেও পাকিস্তানি বিমান আক্রমণ সাফল্যের সঙ্গে প্রতিহত করা হয়েছে। ইতিমধ্যেই তিনটি হানাদার বিমান ভূপাতিত হয়েছে। জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে সর্বত্র এখন মুক্তিবাহিনীর আধিপত্য।
এখন প্রশ্ন উঠবে, মাত্র আট মাসে মুক্তি বাহিনীর পক্ষে এত বড় সাফল্য অর্জন সম্ভব হলো কি করে? গত মার্চ মাসে এবং বর্তমান নভেম্বর মাসের পরিস্থিতির মধ্যে গুণগত পার্থক্য কি? আমাদের জবাব, এই গুণগত পার্থক্য যথেষ্ট। গত মার্চ মাসে বিশ্বাসঘাতক ইয়াহিয়া চক্র সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত ও নিরস্ত্র বাঙালিদের উপর আক্রমণ চালিয়েছিল। কিন্তু তখনও দেখা গেছে নিরস্ত্র বাঙালির ঐক্যবদ্ধ অসহযোগ আন্দোলনের মুখে ভীতসন্ত্রস্ত হানাদার বাহিনী বাংলাদেশে অবস্থিত তাদের বড় বড় ক্যান্টনমেন্ট গুলোতে আশ্রয় নিয়েছে এবং আক্রমণ প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। কিন্তু সর্বাধুনিক মার্কিন ও চীনা অস্ত্রে সুসজ্জিত থাকা সত্বেও তারা নিরস্ত্র অথচ ঐক্যবদ্ধ জনগণের সঙ্গে যুদ্ধে পেরে উঠেনি। ফলে সর্বাধুনিক বিমান বাহিনী থেকে নির্বিচার বোমাবর্ষণ দ্বারা তারা আপাতঃ সাফল্য লাভ করেছিল। কিন্তু বর্তমানে অর্থাৎ এই নভেম্বর মাসের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। মুক্তিবাহিনী এখনো অসংগঠিত ও নিরস্ত্র নয়। তাদের হাতে রয়েছে শত্রুর কাছ থেকে দখল করে নেয় এবং বন্ধু রাষ্ট্রসমূহের কাছ থেকে পাওয়া অস্ত্র। তাছাড়া মুক্তিবাহিনী এখন সম্পুর্ন সংগঠিত। তাদের নিজস্ব নৌবহর গঠিত হয়েছে। বিমান আক্রমণ ব্যর্থ করার উপযোগী এবং পাল্টা বিমান আক্রমণ পরিচালনার উপযোগী ব্যবস্থা রয়েছে। সর্বোপরি গোটা বাংলাদেশের মানুষ এখন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ও মুক্তিবাহিনীর পশ্চাতে কাতারবদ্ধ। হানাদারদের সামনে, পেছনে, ডানে, বামে, উপরে, নিচে সর্বত্র মুক্তিবাহিনী। কোথায় যাবে বাছাধনেরা? অন্যদিকে যুদ্ধ করার মত মনোবলোও তাদের নিঃশেষ। গত আট মাস যাবত ক্রমাগত নিরস্ত্র ও নিরীহ জনগণের উপর অত্যাচার চালিয়ে, নারী ধর্ষণ, ব্যাংক লুট, শহরের গুদামে ও অর্থবান বাঙ্গালীদের বাড়িতে ডাকাতির মতো নানাবিধ দুষ্কার্যে লিপ্ত থেকে এদের নৈতিক সাহস এবং মনোবল সম্পূর্ন নিঃশেষ হয়ে গেছে। সুতরাং ঢাকা ও চট্টগ্রামের উপর মুক্তিবাহিনীর চাপ আরো প্রবল হয়ে উঠলে আতঙ্কিত হানাদারেরা প্রায় বিনা যুদ্ধে আত্মসমর্পণ করলে আমরা বিস্মিত হবো না।
তবু, অতি আশাবাদী না হওয়ার জন্য আমরা সকলকে সতর্ক করে দিতে চাই। স্বাধীনতা অর্জনের বড় কথা নয়, এই স্বাধীনতা সংরক্ষণেই সবচাইতে বড় কাজ। স্বাধীনতার যুদ্ধে জয়ী হওয়ার জন্য আমাদের যেমন অত্যন্ত বেশি রক্ত মূল্য দিতে হয়েছে, ভবিষ্যতে স্বাধীনতা সংরক্ষণের জন্য তার চাইতেও বেশী মূল্য দিতে প্রস্তুত থাকতে হবে। আমাদের স্বাধীনতার যুদ্ধে বহু প্রত্যাশিত বিজয় লাভের ও শত্রুর উপর চূড়ান্ত আঘাত হানার এই পবিত্র মুহূর্তে আমরা সর্বান্তকরণে খোদার দরবারে প্রার্থনা জানাই, স্বাধীন বাংলার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের দীর্ঘায়ু ও সুস্থ দেহ স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের জন্য। আমরা শুধু বাংলাদেশকেই শত্রুমুক্ত করবো না, স্বাধীন বাংলার জনককেও শত্রুর বন্দীশালা থেকে মুক্ত করতে পারব-এই দৃঢ় পণ নিয়েই আমাদের বিজয়ের রথ এগিয়ে চলুক পরিপূর্ণ সাফল্যের দিকে।
সমগ্র বাংলাদেশ ব্যাপি মুক্তিবাহিনীর বিজয় অভিযান অব্যাহত
মুক্তি বাহিনীর সদর দপ্তর থেকে প্রাপ্ত খবরে প্রকাশ, চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে সমগ্র বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যোদ্ধারা অতর্কিত আক্রমন চালিয়ে ব্যাপক ভাবে হানাদার জন্য খতম করেন।
ময়মনসিংহে দুর্বার আক্রমণ
গেরিলা যোদ্ধারা ময়মনসিংহ যশোর এলাকায় সরকারি গুদামে আগুন লাগিয়ে দেন। ফলে দখলদারদের আট হাজার মণ পাট ভষ্মিভূত হয়।
ময়মনসিংহ রণাঙ্গনের মুক্তিবাহিনীর ক্রমাগত আক্রমণের মুখে পাকিস্তানি সৈন্যরা সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে। আরো সেনা সরবরাহের জন্য বেতার যোগে ক্যান্টনমেন্টে আবেদন করে শত্রুসৈন্য বার্তা পাঠায়। মুক্তিবাহিনী এই বার্তার গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়।
ময়মনসিংহের একটি এলাকাতে গেরিলা যোদ্ধাদের প্রচন্ড আক্রমণে ৬৮ জন সৈন্য নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। এই সফল আক্রমণে পাকিস্তানি সৈন্যদের চারটি অতিকায় মর্টার, গানবোট ও বিপুল সংখ্যক অস্ত্র-শস্ত্র ও গোলাবারুদ মুক্তিবাহিনী দখল করেন।
নোয়াখালী থেকে জয় বাংলার নিজস্ব প্রতিনিধি জানাচ্ছেন যে, গত ২৯শে অক্টোবর স্বাধীনতাকামী দুঃসাহসিক যোদ্ধারা ফেনীর বিলোনিয়াতে একটি সাফল্যজনক চোরাগোপ্তা আক্রমণ চালিয়ে ১২ জন হানাদারকে নিশ্চিহ্ন করে দেন। এই আক্রমণের হানাদার সৈন্যদের একজন পদলেহী রাজাকারকে জীবন্ত ধরে আনেন।
উক্ত দিন গেরিলা যোদ্ধারা ফুলগাজীতে শত্রুদের উপর ত্রিধারা সাঁড়াশি আক্রমণ চালিয়ে দখলদার সৈন্যদের ৩০ জনকে নিহত করেন। নোয়াপুরে অপর এক আক্রমণে ছয়জন খান সেনাকে নিশ্চিহ্ন করেন এবং একটি বাঙ্কার ধ্বংস করেন।
গত দোসরা নভেম্বর মুক্তিবাহিনীর অসম সাহসী বীর যোদ্ধারা নোয়াখালী রামগঞ্জ থানাধীন সাহাপুরে এক প্রচণ্ড হামলা চালিয়ে তিনজন শত্রু সৈন্যকে নিহত করেন।
যশোরে বিদ্যুৎ সরবরাহ ও রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন
যশোর জেলার চুড়ামনকাটিতে গত ৩রা নভেম্বর বিদ্যুৎস্তম্ভ উড়িয়ে দিয়ে মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যোদ্ধারা সংশ্লিষ্ট এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছেন। মুক্তিবাহিনীর সামরিক দপ্তর এর প্রাপ্ত খবরে প্রকাশ দখলীকৃত বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা খান সেনাদের ওপর প্রচণ্ড চাপ অব্যাহত রেখেছেন।
গত ৩রা নভেম্বর মুক্তিবাহিনীর অসম সাহসী বীর যোদ্ধারা রেললাইন ধ্বংস করে দিয়ে যশোর জেলার চুড়ামনকাটি রেল ব্যবস্থা সম্পূর্ণ রূপে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছেন।
খুলনায় গেরিলা যোদ্ধাদের প্রচন্ড আক্রমণ
গত ১০ নভেম্বর খুলনা জেলার বেত গাছী খানসেনাদের প্রচন্ড সংঘর্ষ হয়। ফলে পাঁচজন প্রতিপক্ষ সৈন্য নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। এর আগে ৮ই নভেম্বর হানাদার সৈন্যরা কৈখালী এলাকায় মুক্তিবাহিনীর ঘাটির উপরে আক্রমণের দুঃসাহস দেখালে আমাদের বীর যোদ্ধারা এর ঘাড় ভাঙ্গা জবাব দেন। ফলে দুইজন শত্রুসৈন্য নিহত এবং বহু সংখ্যক আহত হয়।
গোপালগঞ্জে ৫০ জন শত্রু সেনা নিহত
অন্য এক খবরে প্রকাশ, গত মাসের শেষ সপ্তাহে গোপালগঞ্জ কাশিয়ানী থানাধীন ফোকুরাতে আমাদের দুর্ধর্ষ সৈন্যদের ব্যাপক আক্রমণে ৫০ জনের অধিক খানসেনা ও ১৫ জন রাজাকার প্রাণ হারায় গত ৭ই নভেম্বর শাহপুরায় মুক্তিযোদ্ধারা তিনজন রাজাকার অস্ত্রশস্ত্রসহ বন্দী করেন।
এই কসাইদের হত্যা করতে হবে
যশোরের শত্রুকবলিত এলাকা থেকে প্রাপ্ত খবরে জানা গেছে যে, গত ৮ই নভেম্বর ভোরে যশোর জেলার বাঘারপাড়া থানার অন্তর্গত চৈত্র বাড়ি বাজারে বহু শরণার্থী রাজাকারদের হাতে হতাহত হয়।
খবরে প্রকাশ, বরিশাল ও ফরিদপুর থেকে প্রায় চার হাজার হিন্দু মুসলমান পশ্চিমবাংলার আশ্রয় গ্রহণের উদ্দেশ্য বনগাও সীমান্তের দিকে আসছিল। পথিমধ্যে সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ায় তারা চৈত্র বাড়ি বাজারের স্কুল ময়দানে আশ্রয় নেয়।
৮ই নভেম্বরের দিকে খাজুরা রাজাকার ক্যাম্প থেকে মুসলিম লীগ গুন্ডা ডক্টর ইব্রাহিম এর নির্দেশে একদল রাজাকার শরণার্থীদের ঘিরে ফেলে। তাদের সাথে যোগ দেয় কটুয়াখালির হাবিব, উত্তর চাঁদপুর এর দলিল উদ্দিন মোল্লা, সমীন ও দাউদ, হুলিহট্টের ইন্তাজ শেখ, তাহের ওরফে মটুক, পদ্মবিল নুরুল মীর এবং নরসিংদীপুরের জয়নাল, সদর ও বন্দর প্রমুখ গুন্ডা।
রাজাকার নামধারী এই গুন্ডার দল চারিদিক ঘিরে শরণার্থীদের জনে জনে তল্লাশি করে, তাদের সমস্ত টাকা-পয়সা ও অলংকারাদির ছিনিয়ে নেয় প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা মতে, তারা শরণার্থীদের কাছ থেকে নগদ ও অলংকারাদিতে দু লাখ টাকার মতো ছিনিয়ে নেয়।
অতঃপর গুন্ডারা শরণার্থীদের নিজ নিজ বাড়িতে ফিরে যেতে নির্দেশ দেয়। কিন্তু তারা এই বলে ফিরে যেতে অস্বীকৃতি জানায় স্থানীয় মিলিটারি ও রাজাকাররা তাদের বাড়িঘর ভস্মীভূত করে ফেলেছে এবং তাদের সমস্ত জিনিসপত্র ও গরু-বাছুর পর্যন্ত লুট করে নিয়েছে। সুতরাং তারা বাড়ি ফিরে যাবে না। এরপর গুন্ডারা তাদের ওপর নির্বিচার গুলি চালায়। যার ফলে প্রত্যক্ষদর্শীর মত শতাধিক নিরীহ শরণার্থী প্রাণ হারায়। শেষ পর্যন্ত শরণার্থীরা নিজ নিজ বাড়ি ফিরে যেতে বাধ্য হয়। খবরে প্রকাশ, রাজাকাররা কয়েকটি তরুণ সুদর্শনা শরণার্থী মেয়েকে খাজুরা রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে যায় এবং বর্তমানে তারা সেখানে পূর্বোল্লিখিত গুন্ডা সর্দার ইব্রাহিমের গৃহে আটক রয়েছে।
মুক্তি বাহিনীর আক্রমণে আরও তিনটি বিদেশি জাহাজ ঘায়েল
সম্প্রতি একটি গৃক জাহাজসহ মুক্তিবাহিনীর দুর্জয় নৌসেনাদের আক্রমণে গত চৌঠা থেকে ২১ই নভেম্বরের মধ্যে আরও তিনটি বিদেশি জাহাজ ঘায়েল হয়েছে। এর মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি সরবরাহকারী জাহাজ রয়েছে। মুক্তিবাহিনীর নৌযোদ্ধারা এই জাহাজটিকে গত ৪ঠা নভেম্বর একটি মাইনে সাহায্যে বিধ্বস্ত করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক সাহায্য সংস্থার কর্মচারীরা এই সংবাদ স্বীকার করেছেন। তারা একথাও বলেছেন যে, জাহাজটিতে নাকি জাতিসংঘের পতাকা উড়ছিলো।
মুক্তিবাহিনীর বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকার অভ্যন্তরের যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং নৌযান ধ্বংস করে দেওয়ার ফলে চট্টগ্রাম ও চালনা বন্দরের বিদেশ থেকে পাওয়া বিপুল পরিমাণ সরবরাহ দ্রব্যাদি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। স্বয়ং মার্কিন বৈদেশিক সাহায্য সংস্থার জনপ্রতিনিধি উপরোক্ত তথ্য প্রকাশ করে বলেছেন, বন্দরগুলোতে মাল খালাস করতে না পারার ফলে বহু জাহাজ আটকা পড়ে গেছে এবং পাকিস্তানী সামরিক কর্তৃপক্ষকে দৈনিক ৩ লক্ষ ৭৫ হাজার টাকা ডেমারেজ দিতে হচ্ছে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে যে, বাংলাদেশের দুঃস্থ মানুষদের নাম করে বিদেশ থেকে আনা সাহায্য সামগ্রী পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী আত্মসাৎ করে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের বিরুদ্ধে এবং বাঙ্গালীদের নিধন করার কাজে ব্যবহার করছে।
প্রমাণস্বরূপ, পাক হানাদার বাহিনীর কাছ থেকে এ ধরনের যে সমস্ত বৈদেশিক ও জাতিসংঘের সাহায্য সামগ্রী আমাদের মুক্তিবাহিনী দখল করেছিল ইতিপূর্বে তার ছবিও পত্র পত্রিকায় প্রকাশ করা হয়েছে।
অপর জাহাজটি একটি ব্রিটিশ মালবাহী জাহাজ। জাহাজটি চালনা বন্দরের অদূরে সমুদ্রের বুকে মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধাদের গোলার ঘায়ে ক্ষতিগ্রস্ত অবস্থায় কলকাতায় পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। জাহাজটির নাম সিটি অফ সেন্ট এলবান্স। জাহাজটি চালনা বন্দর থেকে বাংলাদেশের পাট বোঝাই করে নিয়ে যেতে এসেছিল। কিন্তু মুক্তিবাহিনীর নৌসেনাদের আক্রমণে বন্দরে ভিড়তে পারা তো দূরের কথা, গোলার ঘায়ে বিক্ষত অবস্থায় পালাতে পথ পায় নি।
জাহাজটি পোর্ট এবং স্টারবোর্ড উভয় দিকে গোলার ঘায়ে বিরাট বিরাট গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। জাহাজটি এখন মেরামতের জন্য কলকাতার কয়লা ডাক নোঙর করে আছে।
গত ১০ই নভেম্বর সকালে কলকাতা কিং জর্জ ডক থেকে যাওয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিল। কিন্তু ১১ই নভেম্বর চালনা বন্দরের কয়েক মাইল দূরে সমুদ্রের বুকে থাকতেই মুক্তিবাহিনীর নৌযান কর্তৃক আক্রান্ত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের জাহাজ থেকে এমন অবিরল ধারায় গলা ও মেশিনগানের গুলি বর্ষিত হতে থাকে যে, কারো পক্ষে বাইরে বেরিয়ে আক্রমণকারীদের লক্ষ্য করাও সম্ভব হয়নি। ক্যাপ্টেনের আদেশে জাহাজটির মুখ পুনরায় দ্রুত কলকাতার দিকে ঘুরিয়ে নেওয়া হয়। কিন্তু তার মধ্যে আরও কয়েকটি গোলা ষ্টার বোর্ডের দিকে এসে পড়ে। মুক্তিবাহিনীর জাহাজ এরপরও প্রায় ৪৫ মিনিট যাবত্ সিটি অফ সেন্ট এলবানসের পশ্চাদ্ধাবন করে। জাহাজের নাবিকরা নিরাপদ স্থানে আশ্রয় গ্রহণ করায় কেউ আহত হয়নি, শুধু একজন নাবিকের দেহের কয়েক জায়গায় সামান্য ছড়ে যায়।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্য নৌযুদ্ধে গেরিলা বাহিনীর তৎপরতা শুরু হবার পর থেকে এ পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের ১৭টি জাহাজ বাংলাদেশ নৌবাহিনী ডুবিয়ে দিয়েছে।
ঘোলা জলের খেলা
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র মিঃ ব্রে গত ১৬ই নভেম্বর ওয়াশিংটনে বলেছেন সীমান্ত উত্তেজনা হ্রাসের জন্য ভারত ও পাকিস্তান যে কোন ব্যবস্থা গ্রহণে রাজি হলে তাকেই মার্কিন প্রশাসন সমর্থন করবে। কিন্তু বাংলাদেশে প্রশ্নটি নিরাপত্তা পরিষদে নিয়ে যাবার প্রশ্নে মার্কিন মনোভাব কি সে বিষয়ে তিনি সরাসরি মন্তব্য করেননি।
মিস্টার ব্রে তার বিবৃতিতে বলেছেন, স্পষ্টতই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আশা করছে সে পূর্ববঙ্গ সমস্যা সম্পর্কে মতৈক্য হবে, তবে সে বিষয়েও মার্কিন কর্তৃপক্ষ কোনো সূত্র উপস্থিত করবে না।
তিনি আরো বলেছেন যেখানে সম্ভব মার্কিনরা গঠনমূলক ভূমিকা নেবে তবে তা প্রকাশ্যে নেবে।
পাটনায় বাংলাদেশের উপর আলোকচিত্র প্রদর্শনী
বাংলাদেশে পাক-বর্বরতা, বাংলা বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের অগ্রগতি ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের নেতৃবৃন্দের আলোকচিত্রের এক প্রদর্শনীর পাটনা শহরে সম্প্রতি আয়োজন করা হয়।
পাটনার জনসাধারণ বিপুল সংখ্যায় এই প্রদর্শনী দেখতে আসেন। এই প্রদর্শনীতে বাংলাদেশের মানুষ সম্বন্ধে পাটনার অধিবাসীদের জানার ও বোঝবার আগ্রহ পরিলক্ষিত হয় খুবই বেশি। বাংলাদেশের প্রতিবেশী বিহার। তার সাথে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক যোগাযোগ বহুদিনের। পাকিস্তান হবার আগে বিহারের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক যোগাযোগ ও ছিল। বিহার থেকে বহু লোক প্রতিবছর আসতো বাংলাদেশে কাজ করতে। বিহারের সাথে বাংলাদেশের সম্বন্ধে ছিল মধুর। বাংলাদেশ সম্পর্কে তাই বিহারবাসির মনে জানবার আগ্রহ থাকা স্বাভাবিক। আর এই কথাই প্রমাণিত হলো পাটনাতে বাংলাদেশ আলোকচিত্র প্রদর্শনী থেকে। মুজিবনগর থেকে এই প্রদর্শনীর আয়োজন এর কাজে সাহায্য করতে যান অধ্যাপক সামাদ। পাটনাতে একটি সাংবাদিক সম্মেলনে অধ্যাপক সামাদ বলেন, শীঘ্রই বাংলাদেশ সম্পূর্ণরূপে পাক ফৌজের কবল মুক্ত হবে। অর্থনৈতিক দিক থেকে বাংলাদেশের পক্ষে স্বাধীন ভাবে টিকে থাকবার কোন অসুবিধা নেই। বাংলাদেশের সম্পদকে কাজে লাগিয়ে বাংলার মানুষ স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবনযাপন করতে পারবে। পশ্চিম পাকিস্তানের উপর অর্থনৈতিক দিক থেকে বাংলাদেশ নির্ভরশীল ছিল না। বরং বাংলাদেশের সম্পদেই গড়ে উঠেছে পশ্চিম পাকিস্তান।”
মাতম
মুজিবনগরে প্রাপ্ত খবরে প্রকাশ, বাংলাদেশের মৃত্যুঞ্জয়ী মুক্তিবাহিনীর হাতে ইয়াহিয়ার দস্যু বাহিনীর বিপুলসংখ্যক অফিসার নিহত হওয়ার পর সম্প্রতি ভারতের নতুন অফিসার রিক্রুট করা হয়েছে।
কিছুদিন আগে কাশ্মীর সীমান্ত পেরিয়ে মুক্তাঞ্চলে আগত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আর্টিলারির বাঙালি মেজর বলেন যে, যোয়ান ছাড়াও সৈন্য বাহিনীর বিপুলসংখ্যক অফিসার নিহত হওয়ার পর তড়িঘড়ি করে অফিসারকে রিক্রুট করা হয়েছে।
মুক্তাঞ্চলে পালিয়ে আসার আগে এই বাঙালি মেজরকে নিরস্ত্র করে রাওয়ালপিন্ডির সামরিক সদর দপ্তরের অধীনে কেরানীর কাজ করতে দেওয়া হয়েছিল।
এই মেজর বলেন যে, স্বাভাবিক সময় হলেই বারোশ’ যুবকের মধ্যে কমপক্ষে দুই তৃতীয়াংশ সেনাবাহিনীতে যোগদানের অযোগ্য বলে বিবেচিত হতো।
তিনি বলেন পশ্চিম পাকিস্তানের মা-বাবারা ইয়াহিয়ার যুদ্ধ উন্মাদনা শিকার হতে সন্তানের সৈন্যবাহিনীতে যোগদান করার ব্যাপারে তীব্র অনিচ্ছা প্রকাশ করছে।
মেজর বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনীতে যোগদানের ব্যাপারে জাতীয় মনোভাব সম্প্রতি গড়ে উঠেছে।
কারণ ইতিমধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ মুক্তিবাহিনীর হাতে বিপুল সংখ্যায় পশ্চিম পাকিস্তানী জোয়ান অফিসারদের নিহত হওয়ার খবর পেয়ে যাচ্ছে। এজাতীয় মৃত্যুর খবর পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ যাতে জানতে না পারে সে জন্য কঠোর গোপনীয়তা অবলম্বন করা হতো। কিন্তু গোপনীয়তার ধর্ম ভেদ করে বাংলাদেশ থেকে বহু সংবাদ পশ্চিম পাকিস্তানে ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। ফলে সর্বত্র মাতম হয়ে গেছে।
বাঙালি মেজর বলেন যে, এমনকি সেনাবাহিনীর জেনারেলরা পর্যন্ত বাংলাদেশকে যে হারাতে হবে সে ব্যাপারে এখন নিশ্চিত হয়ে গেছে। তাই তাদের পিতৃভূমি পশ্চিম পাকিস্তান রক্ষার জন্য বর্তমানে ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তা ব্যস্ত হয়ে উঠেছে।
তিনি বলেন, সেনাবাহিনীতে নতুন বারোশো অফিসার নিয়োগ এর ফলে একটা ব্যাপারে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, মুক্তিবাহিনীর হাতে অথবা তার কাছাকাছি সংখ্যক অফিসার হতাহত হওয়ায় নতুন অফিসার রিক্রুট করা হয়েছে।
রাতের বেলায় সারা বাংলাদেশে কায়েম হয় মুক্তিবাহিনীর কর্তৃত্ব
ঢাকা থেকে মার্কিন সাপ্তাহিক নিউজ উইক এর বিশেষ প্রতিনিধি সিনিয়র সম্পাদক আর নো দ্য বোরচাগ্রাফ বাংলাদেশের অবস্থা যে বর্ণনা দিয়েছেন, তা খুবই নির্ভরযোগ্য ও বিশ্ববাসীর কাছে তা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা বিশেষ ভাবে তুলে ধরবে। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের উপর এখন মুক্তিবাহিনীর সুদৃঢ় কর্তৃত্ব স্থাপিত হয়েছে। পাকসেনারা এগিয়ে চলেছে ধ্বংসের পথে। সারা বাংলাদেশের এখন এক লাখের ওপর গেরিলা সৈন্য খানসেনাদের খতম করার কাজে নিয়োজিত। চরম আঘাত হেনে শত্রুকে ধরাশায়ী করার সময় আজ সমাগত। সারা বাংলাদেশের মানুষ আজ বলছে আমরা প্রতিশোধ চাই। ঘরে ঘরে আজ সত্যিই দুর্গ গড়ে উঠেছে। অবিচল বাঙালি আজ যুদ্ধ করছে পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য। জয়ের চরম লগ্ন আজ এসে দাঁড়িয়েছে তাদের প্রান্তে। বাঙালি অনুভব করছে বিজয় লক্ষ্মীর হাতছানি।
সাংবাদিক বোরচা লিখেছেনঃ “আমিও লন্ডন ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকার সাংবাদিক করলার কলিং ঢাকা থেকে পাঁচ মাস দূরে মুক্ত অঞ্চলে গিয়েছিলাম। স্বাধীনতা যোদ্ধাদের সদরদপ্তরে আমরা দেখতে পেলাম, যোদ্ধারা প্রকাশ্যে তাদের আস্তানার চারধারে নিজেদের অস্ত্রশস্ত্র পরিষ্কার করছে। ওদের কোন ভয় নেই পাক ফৌজের জন্য। প্রত্যেকে ওরা পরস্পরের সাথে কথা বলছিল সাধারণ কণ্ঠস্বরে। গেরিলা নেতা আবদুল মান্নান আমাদের বলেন জনগণ আমাদের সঙ্গে আছে। আমরা তাই ভয় পাই না। পাক ফৌজ আসছে এই খবর পৌঁছে যায় আমাদের কাছে। যথাসময়ে জনসাধারণ আমাদের হুঁশিয়ার করে দেয় পাক ফৌজ এর আগমন সম্পর্কে। আমরা কেউই এখন পাক ফৌজের কোন আক্রমণের আশঙ্কা করছি না। মান্নানের বয়স ৪৩ বছর। একসময় সরকারি চাকুরে ছিলেন। তিনি বর্তমানে তিনি এই মুক্ত ১৫০০০ এলাকার লোকের শাসন পরিচালক ও গেরিলা নেতা। মান্নান বলেন, পাক সামরিক বাহিনীর এখানে আসবার সাহস নেই। আমরা ইচ্ছা করলে যেকোনো জায়গায় যেতে পারি। দিনের আলোতেই যেতে পারি।
সন্ধ্যায় মান্নানের সাথে ভাত খেতে খেতে আমাদের আরো অনেক কথা হয়। মান্নান বলেন ক’দিন আগে আমরা এক ট্রাক পাক ফৌজকে খতম করেছি। ১৯ জন সৈন্য ছিল ট্রাকে। আমাদের ডুবুরিরা ক্যাপ্টেন কে এম শাহজাহানের নেতৃত্বে সামরিক জলযান ডুবিয়ে দিয়েছে। ২৫ বছর বয়সের কমান্ডো নেতা কথার মধ্যে পাক ফৌজকে বিদ্রুপ করে বলেছেন, ওরা কাপুরুষ। ওদের মতো ভীতু সৈনিকের কথা কল্পনা করা যায় না। আমরা যদি নদীর এপার থেকে একটা ফাঁকা আওয়াজ করি তবে ওরা নদীর অপর পাড়ে যেয়ে আশ্রয় নিতে চায়। আর তখনই ওরা গিয়ে পড়ে নদীর অপর পারে। আমাদের লুকিয়ে থাকা অন্য গেরিলা দলের হাতে। সব খতম হয় ওরা….. গেরিলারা গর্ব করে। বলেন, ক’দিন আগে ওরা ৩১ জন পাক ফৌজ ও রাজাকার কে জ্যান্ত ধরে ফেলেন এবং পরে তাদের গুলি করে মারেন। শত্রুসৈন্যকে বন্দি করে রাখবার মতো
কোন সঙ্গতি নেই। আমাদের তাই গুলি করে মারতে হয় আমাদের যুদ্ধবন্দীদের। তবুও রাখতাম যদি ওরা আমাদের ধৃত বন্ধুদের অমনভাবে গুলি করে হত্যা করত।”
মান্নান আমাদের বুঝিয়ে বলেন গত নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ছিলাম আমরা। কিন্তু ইয়াহিয়া সেই ভোটের বিজয় করে পদদলিত। সামরিক বাহিনী আমাদের উপর চালায় অকথ্য অত্যাচার। আমি এখন মরিয়া হয়ে উঠেছি। শত্রুর অত্যাচার আমাদের করে তুলেছে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আমরা যুদ্ধ করছি পৃথিবীর মানচিত্রে একটি নতুন জাতি একটি নতুন দেশ গড়ার জন্য। নিউজউইকের খ্যাতনামা সাংবাদিক আরো লিখেছেনঃ
“পাকিস্তান সেনাবাহিনী একসময় গোলাবারুদ ও অস্ত্রে গেরিলাদের চাইতে বহুগুন শক্তিশালী ছিল। কিন্তু এখন এই শক্তি ক্ষয়ের পথে। তারা আর এদিক থেকে গেরিলাদের চাইতে উচ্চমানসম্পন্ন নয়। বিশেষ করে পাকিস্তানের ভরসা ছিল আমেরিকার কাছ থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ পাবে। তাই তার অস্ত্র ও গোলাবারুদের ঘাটতি হবে না। কিন্তু আমেরিকার সামরিক সাহায্য বন্ধ করায় পাক রণসজ্জায় দারুন আঘাত লেগেছে।
বাংলাদেশ এখন সব সরকারি কর্মচারী, গ্রামের মোড়ল সকলে গোপনে সাহায্য করছে মুক্তিবাহিনীকে। কমপক্ষে বাংলাদেশের চারভাগের একভাগ অঞ্চলে এখন পুরোপুরি মুক্তিবাহিনীর প্রশাসন চালু হয়েছে। রাতে বাংলাদেশের গ্রাম অঞ্চলের অধিকাংশ জায়গায়ই চলে যায় ছেলেদের অধিকারে। এখন খেয়াঘাটে ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে কদাচিৎ পাক ফৌজ চোখে পড়ে। শহরগুলোর বাইরে সাধারণতঃ পাক ফৌজরা এখন খুব কমই টহল দিয়ে বেড়ায়।
পাক সামরিক বাহিনীর নানা অত্যাচারের কাহিনী আমি শুনেছি। একটি গ্রামে দশ বছরের একটি মেয়ের উপর বলাৎকার করে বার জন পাক সৈন্য। তারপর তাকে হত্যা করে তারা। এক গ্রামে সৈন্যরা গিয়ে দুজন যুবতী মেয়ে দাবি করে। গ্রামবাসী জানায় ফৌজি বড় কর্তা কে। দুজন ফৌজকে ধরে নিয়ে যাবার পর দিন সেনাবাহিনীর লোক এসে পুড়িয়ে দেয় সারা গ্রামটাকেই। ৩৮ জন লোক নিহত হয় এক ফৌজি হামলায়।
যেখানেই আমি গিয়েছি মুক্তিবাহিনীর লোক ও সমর্থকরা সর্বত্রই বলছে শেষ চূড়ান্ত বিজয়ের দিন ঘনিয়ে এসেছে। একটা নদীর খেয়া ঘাটে দেখতে পেলাম একজন পাক-সামরিক কর্মচারী একজন সাধারন লোক কে ছড়ি দিয়ে পেটাচ্ছেন। আমাকে দেখতে পেয়ে মার বন্ধ করেন অফিসারটি। পরে সেই মার খাওয়া লোকটি আমাকে বলেছিলঃ রোজ রোজ এমনি অনেক ঘটনা ঘটে। কিন্তু প্রতিশোধের দিন আসছে। আর সেদিনটা ওদের পক্ষে হবে ভয়ঙ্কর।
(নিউজ উইক, নভেম্বর ২২,১৯৭১)
পাক শাসকদের জ্ঞানোদয় হোক
বাংলাদেশ সমস্যা সম্পর্কে শ্রী গিরি
ভারতের রাষ্ট্রপতি সি ভি ভি গিরি বলেন, “বাংলাদেশের মানুষ ন্যায়ের জন্য লড়ছেন। আমি নিশ্চিত শেষ পর্যন্ত তারা বিজয়ী হবেন।” শ্রী গিরি গত ১৭ই নভেম্বর পশ্চিমবঙ্গের দুটি শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করতে গেলে হাজার হাজার শরণার্থী শ্রী গিরি ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রতীক শেখ মুজিব এর নামের জয়ধ্বনি দিয়ে তাঁকে সংবর্ধনা জানান।
শ্রী শ্রী শ্রী গিরি তার ভাষণে বলেন, আমরা চাই পাকিস্তানি শাসক ও বাংলাদেশের মধ্যে একটা রাজনৈতিক মীমাংসা এবং সেই মীমাংসা অবশ্যই বাংলাদেশের জনগণের পক্ষে সন্তোষজনক মীমাংসা হতে হবে।
এই মীমাংসা যে বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধি ও নেতাদের সঙ্গে করতে হবে, কোনো ক্রীড়ানক দালালের সঙ্গে নয়, পাক সরকারের সেই জবান এখনো হয়নি। তিনি শুধু এই আশায় করতে পারেন যে পাকিস্তানের শাসকরা তাদের নিজেদের স্বার্থেই এটা উপলব্ধি করবেন।
সম্প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর ৬টি দেশ সফরের উল্লেখ করে শ্রী গিরি বলেন, এর ফলে ওইসব দেশের মানুষ ও রাষ্ট্রনায়ক বাংলাদেশের মানুষের সংগ্রামের ন্যায্যতা সম্পর্কে অবহিত হয়েছেন। তিনি আশা প্রকাশ করেন যে, এর ফলে পাকিস্তান বুঝবে যে, বিশ্বজনমত বাংলাদেশের পক্ষে এবং বিশ্বজনমত পাকিস্তান সরকারকে বাধ্য করবে বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ও জনগণের প্রকৃত প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে।
শ্রী গিরি শরণার্থীদের আগামী কয়েক সপ্তাহে কী ঘটে সে জন্য ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করার আবেদন জানান।
তিনি ঘোষণা করেন,’ বিভিন্ন ফ্রন্টের ভারত বহুবিধ সমস্যার সম্মুখীন তা সত্বেও ভারত-বাংলাদেশের শরণার্থীদের সাময়িকভাবে অবস্থানকালে তাদের কষ্ট না হওয়ার জন্য ভারত যেকোনো স্বার্থত্যাগে প্রস্তুত থাকবে।’ তিনি বলেন যে সরকার গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন না, তেমনই এক সরকারের বর্বরোচিত কার্যকলাপের ফলে আপনারা যারা নিজেদের দেশ ছেড়ে চলে আসতে বাধ্য হয়েছেন, তাদের প্রতি তার শ্রদ্ধা ও সহানুভূতি জানাবার জন্যই তিনি এসেছেন।
হুশিয়ার নুরুল আমিন!
হুশিয়ার
জাতিদ্রোহী মীরজাফর বাংলার কুলাঙ্গার পশ্চিম পাকিস্তানের পুঁজিপতি সামন্তবাদী ঔপনিবেশিক শাসনের পা চাটা দালাল খুনি নুরুল আমিন আবার স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করেছে। কুকুরের লেজ বার বছর চোঙায় পড়ে থাকলেও তা সোজা হয় না এবং কুকুরকে ঘৃত ছানা যাই খাওয়ানো হোক না কেন একটা বিশেষ জিনিস দেখলেই সে লোভ সামলাতে পারেনা। নুরুল আমিন একথাগুলোর সারবত্তা পুনর্বার প্রকাশ করেছে।
১৯৭৪ সালের নির্বাচনে বাঙালি জাতি নুরুল আমিনকে ডাস্টবিনে নিক্ষেপ করেছিল, তার জাতিদ্রোহিতা মূলক রাজনীতির চির সমাধি রচনা করেছিল। তারপর দীর্ঘ ১৬/১৭ বছর নুরুল আমিন অজ্ঞাত বনবাসে ছিল আর মাঝে মাঝে দু একটি ভালো কথা বলে জনগণের মন জয় করার প্রয়াস পেয়েছিল। কিছু কিছু মানুষ ভেবেছিল মল যখন পঙ্কিলে পরিণত হতে পারে তখন নুরুল আমিনের মনের পরিবর্তন আসতে পারে। জাতিদ্রোহী নুরুল আমিন তার ফল ও ভোগ করেছে। গত সাধারণ নির্বাচনে বাঙালি জাতি মীরজাফর ও জগৎ শেঠদের কবর দিয়েও সরল বিশ্বাসে নুরুল আমিনকে ভোটে পাশ করে দিয়েছে। নুরুল আমিন সেদিনকার ভোটারদের কি বলেছিল দালাল হামিদুল হকের পত্রিকাগুলো খুললে যে কোন লোক তা দেখতে পারবে। নুরুল আমিন সেদিন ভোটারদের কাছে হাত জোড় করে এই আবেদনেই জানিয়েছিল,’এই বৃদ্ধ বয়সে তোমরা আমাকে আর অপমান করো না। আমি মৃত্যুপথযাত্রী। আমাকে আর একটি বার ভোট দাও। আমি তোমাদের সাথে আর বেইমানি করবোনা।’
তারপর পদ্মা-মেঘনা-যমুনার অনেক পানি গড়িয়েছে। নুরুল আমিন নির্বাচনের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে
অভিনন্দন
জানিয়েছে। পয়লা মার্চ ইয়াহিয়া ভুট্টো চক্র জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য মুলতবি ঘোষণা করে। প্রতিবাদে ঢাকা ছাত্র জনতা রাজপথে নেমে আসেন। বঙ্গবন্ধু হোটেল পূর্বাণীতে বহু সাংবাদিক বিক্ষুব্ধ জনসাধারণের সামনে ঘোষণা করলেন,’কোন কিছুই বিনা চ্যালেঞ্জে যেতে দেওয়া হবে না।’তবে তিনি জানালেন যে পূর্ণাঙ্গ কর্মসূচি ঘোষণার পূর্বে তিনি কয়েকজন নেতা নুরুল আমিন, মাওলানা ভাসানী, আতাউর রহমান খান ও অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদের সঙ্গে আলোচনা করতে চান। তদানুযায়ী তিনি নুরুল আমিনের সঙ্গে আলোচনাও করেছিলেন। ধরে নেয়া যায় সেদিন বঙ্গবন্ধু সাড়ে সাত কোটি বাঙালির পক্ষ থেকে ইয়াহিয়া ভুট্টো চক্রের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন তাতে নুরুল আমিনের ও সায় ছিল। তারপরে নুরুল আমিন প্রকাশ্য বিবৃতি দিয়ে বঙ্গবন্ধুর চার দফা শর্ত পূরণের দাবি জানিয়েছিলেন। এমনকি খোদ রাওয়ালপিন্ডিতে ও খুনিচক্রের নায়ক ইয়াহিয়ার সাথে আলোচনার পর নুরুল আমিন সাংবাদিকদের কাছে বলেছিল,”বাংলাদেশ ক্ষমতা নেওয়ার মতো আজ আর কেউ নেই।”বঙ্গবন্ধুকে বন্দী ও আওয়ামী লীগকে বেআইনি ঘোষণার পর নুরুল আমিন এ কথাগুলো বলেছিল। কিন্তু খুনি নুরুল আমিন যে তখনও সুযোগের অপেক্ষা ছিল তা অনেকেই বুঝতে পারেননি।
সর্বশেষ খবরে প্রকাশ পশ্চিম পাকিস্তানের সাতটি পাঞ্জাব ভিত্তিক রাজনৈতিক দল খুনি নুরুল আমিনকে তাদের দলের পার্লামেন্টারি পার্টির নেতা নির্বাচন করেছে। তার অর্থ নুরুল আমিন মৃত পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে রাজি হয়েছে। এই সাতটি দল হল পিডিপি, পাঞ্জাবি দালাল কাইয়ুম খানের মুসলিম লীগ, পাঞ্জাবি স্বার্থের জিম্মাদার দৌলতানার মুসলিম লীগ, আইয়ুব খানের ফজলুল কাদের মুসলিম লীগ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, মরকাজে জমিয়তে ওলামা প্রভৃতি।
বাংলার ছাত্র তরুণরা যখন নিজেদের স্বাধীনতার জন্য বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিচ্ছেন, বাংলার মা-বোনেরা যখন খান সেনাদের হাতে ইজ্জত দিচ্ছেন তখন নুরুল আমিন গদির মোহে জাতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে সাব্যস্ত করেছে।
নুরুল আমিনের জাতিদ্রোহী তা এই প্রথম নয়। ১৯৪৬ সালে মরহুম হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী যখন স্বায়ত্তশাসিত বাংলা গঠনের চেষ্টা করেছিলেন তখন যে কয়টি মীরজাফর তা বানচাল করতে লেগেছিল নুরুল আমিন ছিল তাদেরই একজন। ১৯৫২ সালে নুরুল আমিন ছাত্র-তরুণদের ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত করে রাষ্ট্রভাষা তথা বাঙালি জাতীয়তাবাদের আন্দোলনকে অংকুরে বিনষ্ট করতে চেয়েছিল। নুরুল আমিনের মুখ্যমন্ত্রীদের আমলে বাংলার সমস্ত (অস্পষ্ট) ছাত্র তরুণে ভরে গিয়েছিল। নুরুল আমিনের নির্দেশের রাজশাহী জেলে রাজবন্দীদের উপর চলেছিল গুলি। বিশেষ করে মহিলারা রাজবন্দীদের উপর নির্যাতনের যে কায়দা-কৌশল নুরুল আমিন প্রয়োগ করেছিল তার জন্য নুরুল আমিন ইতিহাসে কুখ্যাত হয়ে থাকবে। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের পূর্ব রাত্রে নুরুল আমিন ১১০০ আওয়ামী লীগ কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছিল। নুরুল আমিন ১৯৫৪ সালে নান্দাইলে বিক্ষুব্ধ জনতার উপর হাতি চালিয়ে নিরীহ গ্রামবাসীকে নিহত করেছিল। নুরুল আমিন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রথম সাধারণ সম্পাদক বিপ্লবী নেতা শামসুল হককে পাগল করেছিল।
নুরুল আমিনের জানা উচিত গদির মোহে বাঙালির সাথে তার বিশ্বাসঘাতকতা বাঙালি তরুণেরা বরদাস্ত করবে না। তার ক্ষমা নেই। কুখ্যাত মোমেন খানের ভাগ্যই তাকে বরণ করতে হবে। তাকে শিয়াল কুকুরের মত হত্যা করতে বাঙালি তরুণেরা আজ প্রস্তুত হয়ে আছে। হত্যার পর বাংলার মাটিতে ঠাঁই হবে না। সুতরাং হুশিয়ার।
হানাদার বাহিনী দূকুল হারাতে বসেছে
(সামরিক ভাষ্যকার)
পাকহানাদার বাহিনী গভীরতর সংকটের জালে জড়িয়ে পড়েছে। তারা শ্যাম এবং কোন উভয় রক্ষা করতে গিয়ে দু’দিকে খোয়াতে বসেছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে পাক ভারত বিরোধে রূপান্তরিত করার উদ্দেশ্যে তারা পূর্বাঞ্চলের ১৩০০ সীমান্ত বরাবর বিপুল সৈন্য সমাবেশ করেছে। তার ফলে দখলীকৃত এলাকা কার্যতঃ অরক্ষিত হয়ে পড়েছে। এদিকে সমগ্র দখলীকৃত অঞ্চলজুড়ে মুক্তিবাহিনীর মৃত্যু ভাবনাহীন বীর গেরিলা যোদ্ধাদের আক্রমণে হানাদার বাহিনীর মধ্যে ত্রাহি ত্রাহি রব উঠেছে। সমগ্র দখলীকৃত অঞ্চলে ৬০ হাজারেরও বেশি শিক্ষিত গেরিলাযোদ্ধা দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য সংগ্রাম করে চলেছে।
দখলীকৃত অঞ্চলে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৩০ জন সৈন্য মুক্তিবাহিনীর হাতে নিহত হচ্ছে। তাছাড়া নিহত দালাল ও এজেন্টের সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। অথচ সীমান্ত থেকে সৈন্য সরিয়ে দখলীকৃত এলাকার হানাদার সৈন্যদের শক্তি বৃদ্ধি করার পথ ও তাদের জন্য বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তারা ভারতীয় আক্রমণ সম্ভাবনার যে জিগির তুলে বিশ্বজনমতকে তাদের পক্ষে আনতে চেয়েছে দখলীকৃত এলাকায় নিজেদের শক্তি বৃদ্ধির জন্য সীমান্ত থেকে সৈন্য সরিয়ে নিলে তাদের সেই বক্তব্য সম্পূর্ণ ভুয়া বলে প্রতিপন্ন হয়। একথাও প্রতিপন্ন হওয়া যে বাইরে থেকে নয় বাংলাদেশের অভ্যন্তরেই বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম চলছে। আর সেই সংগ্রামে সর্বক্ষেত্রেই মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
বিগত পক্ষকালের ঘটনাবলী থেকে পাক হানাদার বাহিনীর দিশেহারা অবস্থার প্রমাণ পাওয়া যায়। স্বদেশের জনগণেই যেমন মুক্তিযোদ্ধাদের শক্তির এবং মুক্তিযুদ্ধের সাফল্যের প্রধান উৎস তেমনি হানাদার বাহিনীর শক্তি ও সাফল্যের অন্যতম উপাদান পঞ্চমী বাহিনী দালাল গোষ্ঠী। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের কবল থেকে হানাদার বাহিনী তাদের আশ্রিত রাজাকার, এজেন্ট ও দালালদের রক্ষা করতে পারছে না। তার ফলে প্রাণ বাঁচাবার জন্য দলে দলে রাজাকার মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে আত্মসমর্পণ করছে এবং চিহ্নিত পাকিস্তানি দালালরা আত্মগোপন করতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। এর ফলে হানাদারের সমর শক্তির প্রথম “বেজ” টিই প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে।
বিগত পক্ষকালে নতুন করে ব্যাপকভাবে অসামরিক অধিবাসী হত্যা এবং গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়ার ঘটনাবলী থেকে হানাদার বাহিনীর মরিয়া অবস্থান প্রমান পাওয়া যায়। ইয়াহিয়ার গাদা ডাক্তার এ, এমন, মালিককে দখলীকৃত বাংলাদেশের গভর্নর নিযুক্ত করার পর হানাদার বাহিনী অসামরিক অধিবাসীদের যথাসম্ভব নরম ব্যবহারের কৌশল গ্রহণ করেছিল। কারণ তা না হলে বাংলাদেশের স্বাভাবিক অবস্থার কথা বলে বিশ্ব জনমতকে বিভ্রান্ত করা সম্ভব হচ্ছিল না এবং ইসলামী ভ্রাতৃত্ব ও ইসলামী জাতীয়তাবাদের বাংলাদেশের মানুষকেও দলে টানা সম্ভব হচ্ছিল না। তারা বুঝতে পেরেছিল যে শুধু রাজাকার ও এজেন্টদের সাহায্যে মুক্তিযুদ্ধকে দমন করা যায় না। তার জন্য জনসমর্থন প্রয়োজন কিন্তু মূলে কোন কিছু না থাকলে জনসমর্থন পাওয়া যায় না এবং (অস্পষ্ট) নীতিও অব্যাহত রাখা সম্ভব হয় না। হানাদার দখলদার বাহিনীর একেবারে গোড়ার দুর্বলতা এটাই। তাই মুক্তিবাহিনীর আঘাত যেই তাদের পক্ষে অসহনীয় হয়ে উঠেছে অমনি নিরাপরাধ অধিবাসীদের হত্যা করতে শুরু করেছে। আসলে হানাদার বাহিনীর পক্ষে কোনক্রমেই দুকুল রক্ষা করা সম্ভব নয়।
হবু রাজা গবু মন্ত্রী
নুরুল আমিন প্রধানমন্ত্রী হওয়ার এবং ভুট্টো সহকারি প্রধান মন্ত্রী হবার খোয়াব দেখছেন
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বাঙালির ঘৃণ্য দুশমন নুরুল আমিনকে প্রধানমন্ত্রী এবং বাঙালি হত্যার পরিকল্পনার অন্যতম রূপকার জুলফিকার আলী ভুট্টোকে সহকারি প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী করে কেন্দ্রে একটি সরকার প্রতিষ্ঠা করার পরিকল্পনা নিয়েছে।
রাওলাপিণ্ডি থেকে আগত একজন বিদেশী সাংবাদিক এ তথ্য প্রকাশ করেছেন। পিন্ডির তথ্যনির্ভর মহলের সাথে এ সাংবাদিকের গভীর যোগাযোগ রয়েছে। তিনি ২৫শে মার্চ মধ্যরাতে বাংলাদেশের জল্লাদ ইয়াহিয়া বাহিনীর গণহত্যা শুরুর পর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল থেকে পালিয়ে ঢাকার এক গোপন স্থানে আত্মগোপন করেছিলেন।
এই সাংবাদিক বাঙালির চরম দুশমন নুরুল আমিনের সাথে সম্প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের সাক্ষাৎ করেছেন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার খায়েশ নুরুল আমিনের। বিদেশি সাংবাদিক মীরজাফর আমিন কে প্রশ্ন করেন যে, প্রধানমন্ত্রী হওয়া পর্যন্ত বেঁচে থাকবেন বলেও তিনি আশা করেন কিনা?
নুরুল আমিন এ প্রশ্নের উত্তর দেয়নি। ১৯৫৪ সালের বাংলাদেশের নির্বাচনে প্রাদেশিক মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে নুরুল আমিন ডাস্টবিনে নিক্ষেপ হওয়ার পর এই প্রথম একটি পদ পাওয়ার স্বপ্ন দেখছেন।
সিলেটে ৮০ জন রাজাকারের আত্মসমর্পণ
আমাদের নিজস্ব প্রতিনিধি জানাচ্ছেন যে, সম্প্রতি সিলেটের মৌলভীবাজার রণাঙ্গনে গেরিলা যোদ্ধারা সোনামুড়া, সমান ভাগ, জৈন্তাপুর, গোয়ালবাড়ি ও শ্রীবর্দীতে পাকিস্তানি সৈন্য ঘাঁটির উপর প্রচন্ড আক্রমণ চালিয়ে বহু সৈন্যকে হতাহত করেন। রক্ষী চরে গেরিলা যোদ্ধারা জন দখলদার সৈন্যকে খতম করেন।
সুনামগঞ্জ রণাঙ্গনে গত ১৪ ই নভেম্বর স্বাধীনতাকামী তরুণ যোদ্ধারা একটি দীর্ঘ সেতু মাইনের দ্বারা উড়িয়ে দেন। এইসময় বিয়ের দু সাহসিক মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি একটি অগ্রগামী জিপের ওপর চোরাগোপ্তা আক্রমণ চালিয়ে একজন ক্যাপ্টেনসহ পাঁচজন হানাদার কে হত্যা করেন। এদিকে সিলেটের কোন এক এলাকায় দখলদার সৈন্যদের চরম বিপর্যয়ের মুখে হতাশাগ্রস্ত ৮০ জন পদলেহী দালাল রাজাকার প্রচুর অস্ত্রশস্ত্রসহ মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে।
পাকিস্তান দিনদিন একঘরে হয়ে পড়ছে
বৃটেনের বিখ্যাত উদারনৈতিক দৈনিক পত্রিকা গার্ডিয়ানে -এ মন্তব্য করা হয়েছে (৯ই নভেম্বর), যুদ্ধে পাকিস্তানকে একা লড়তে হবে, বিশ্বের কোনো শক্তি তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসতে চাইবে না, আন্তর্জাতিক ঘটনাবলী এখন দ্রুত পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রবাহিত হচ্ছে। যে মার্কিন সাহায্যের উপর পাকিস্তান এত ভরসা করে বসে ছিল, তা এখন বন্ধ হতে গেল। চীন তাকে বন্ধুত্বের বুলি দিয়ে শান্ত করতে চাচ্ছে। পিকিং এর নেতারা গার্ডিয়ান পত্রিকার মতে ইয়াহিয়া সম্পর্কে অস্পষ্ট ভাষায় কথা বলতে আরম্ভ করেছে। যা থেকে বোঝা যায়, তাদের ইয়াহিয়াকে সর্বতোভাবে সমর্থন জানাবার পক্ষে অসুবিধা আছে। চীনারা এখন ইয়াহিয়াকে সমর্থন জানাতে গিয়ে অস্বস্তি বোধ করতে আরম্ভ করেছে। তারা একজন পুরোদস্তুর পাঠান দক্ষিণপন্থী সমরনায়কদের পক্ষে নিতে দ্বিধা দেখাচ্ছেন। পত্রিকাটির ভারত-পাক যুদ্ধ হলে চীন কোনোক্রমেই সেই যুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষে সেনাবাহিনী নিয়ে এগিয়ে আসতে পারেনা।
পাকিস্তান আরও সমর্থন হারাবে
বৃটেনের বিখ্যাত রক্ষণশীল পত্রিকা ডেইলি টেলিগ্রাফে বলা হয়েছে যতক্ষণ ইয়াহিয়া খান বাংলাদেশ সমস্যার একটি যথার্থ রাজনৈতিক সমাধান না চাচ্ছেন, ততক্ষণ তার বন্ধুহীনতা বাড়তে বাধ্য। ইয়াহিয়ার জাতীয় রাজনৈতিক সমাধান না চাইবার জন্য যুদ্ধ বাধার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাবে। কাশ্মীর ও পাঞ্জাব সীমান্তে ইয়াহিয়ার পক্ষে যুদ্ধ শুরুর ব্যাপারে প্রলুব্ধ হওয়া অসম্ভব নয়। রাজনৈতিক সমাধানের নীতি গ্রহণ না করলে ইয়াহিয়া ক্রমশ যুদ্ধের পথেই ধাবিত হবেন। আরবি সহ তার এই যুদ্ধ বাড়ি মনোভাবের জন্য তার উপর আরো বিরূপ হয়ে উঠবে।
ভুট্টোর চীন সফরের লক্ষ্য ব্যর্থ হয়েছে
ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তায় থেকে প্রকাশিত ইংরেজি পত্রিকা “জাকার্তা টাইমস-এ বলা হয়েছে যে ভুট্টোর চীন সফরের লক্ষ্য সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। পত্রিকাটির মতে পাকিস্তানকে চীনের সাহায্যদানের প্রতিশ্রুতিকে ভারত সোভিয়েত (অস্পষ্ট) মুক্তির সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। শুধু ভারত সোভিয়েত (অস্পষ্ট) রাশিয়ার কাছ থেকে যে পরিমাণ সাহায্য করতে সক্ষম হবে পাকিস্তান চীনের কাছ থেকে সেই পরিমাণ সাহায্য পাবে না। এ থেকে এখন মনে করা যায় ভারত উপমহাদেশে কোন বৃহৎ যুদ্ধ সংঘটিত হবে না।
মুক্তি সংগ্রামে প্রবাসী বাঙ্গালীদের অবদান
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা বিভাগের অধ্যক্ষ এবং প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী জনাব রশীদ চৌধুরী প্যারিস থেকে এক চিঠি পাঠিয়েছেন।
আমাদের কাছে প্রেরিত এক চিঠিতে তিনি বলেছেনঃ লাখো বাঙ্গালীর রক্তে রঞ্জিত সন্ত্রস্ত বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকায় আত্মগোপন করে যেসব বাঙালির জীবন রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছেন আমি তাদেরই একজন। গত ছয় মাস আপ্রাণ চেষ্টা করেছি বেরিয়ে আসতে কিন্তু সামরিক সরকার ও দালালদের কড়া পাহারার জন্য তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। এখন যেখানে বেয়োনেটের মুখে স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে আনার চেষ্টায় তথাকথিত সরকার পদে পদে ব্যর্থ সেখানে ১৪ই আগস্ট পালনেরও আপ্রাণ চেষ্টা করা হয়েছে। সেদিন সরকারি বেতার ও কাগজের মারফত রক্তপিপাসু জেনারেল ইয়াহিয়া খান কয়েকজন বাঙালি কবি, শিল্পী, সাহিত্যিককে স্বর্ণপদক ও পুরস্কার দানের কথা ঘোষণা করেছে। জেনে মর্মাহত আমার নামও সেখানে ছিল। যে মুহূর্তে আমার পুরস্কারের কথা ঘোষণা করা হয়েছে সে সময়েও হয়তো জল্লাদদের হাতে বাংলাদেশের
পুরো গ্রাম দাউ দাউ করে জ্বলছিল, নির্মম অত্যাচারের অসহ্য যন্ত্রণায় বাংলার মা-বোনেরা কান্নায় ভেঙে পড়েছে, তাদের মেশিনগানের গুলিতে বহু বাঙালির জীবন ঝরে পড়েছে।
এখনো সেখানে বাঙালিকে পশুর চেয়েও অধমের চোখে দেখা হয়, বাংলায় কথা বলা হয় যেখানে অমার্জনীয় অপরাধ, বাংলার সংস্কৃতি, বাঙালীর জীবন বিপন্ন আর বাংলাদেশ বিদ্রোহের আগুনে তপ্ত সেখানে বাংলার কোন কবি, শিল্পী, সাহিত্যিককে তথাকথিত সামরিক সরকারের সম্মান এক বিদ্রুপ ছাড়া অন্য কিছু নয়। পশু ইয়াহিয়া প্রদত্ত সম্মান আমি ঘৃণার সাথে প্রত্যাখ্যান করলাম।
যদি কোন কবি সাহিত্যিক জীবনে কোনদিন বাংলায় একটি শব্দ লিখে থাকেন, কোন শিল্পীর কন্ঠের স্বর যদি কখনো বাংলার বাতাসে ধ্বনিত হয়ে থাকে, যদি কোন চিত্রশিল্পী সুজলা-সুফলা মায়াময় বাংলা ছবি এঁকে থাকেন তবে বাঙালির তাজা রক্তে রাঙানো হাতের যেকোনো সম্মান গ্রহণ এর পরিবর্তে তাদের ধ্বংস কামনা, সোনার বাংলাকে শোষণমুক্ত করার প্রতিজ্ঞায় হাতে অস্ত্র তুলে নেয়াই প্রকৃত শিল্পীর পরিচয় গুলো মনে করি। আমি গর্বিত বাঙ্গালী বলে, বাংলায় কথা বলে, জয় বাংলা বলে।
আমেরিকায়
আমেরিকার রাইট স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর ডাক্তার এ কে এম আমিনুল ইসলাম ওহিও স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক ভবনে আয়োজিত এক সমাবেশে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা এবং মুক্তি বাহিনীর তৎপরতা সম্পর্কে বিবরণ দান করেন। তিনি আকরল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র শিক্ষক সমাবেশে এবং শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশ সহায়তা সংস্থার এক বৈঠকে বাংলাদেশ পরিস্থিতি বিশ্লেষন করেন।
একটি আজব রহস্য কাহিনী
ভুট্টোর উপর আততায়ীর গুলি
(রাজনৈতিক ভাষ্যকার)
সংবাদ সংস্থার খবর প্রকাশ, ১১ই নভেম্বর জুলফিকার আলী ভুট্টোকে লক্ষ্য করে কতিপয় লোক পিস্তল থেকে কয়েক রাউন্ড গুলি ছুড়েছে। পিপলস পার্টি নেতা ভুট্টো সাহেব অবশ্য প্রাণে বেঁচে গেছেন এবং আহত ও হননি। ভুট্টো যখন লাহোরে এক দন্ত চিকিৎসালয় দাঁতের ব্যথায় চিকিৎসার জন্য ঢুকছিলেন, তখনই তার উপর ছোঁয়া হয় গুলি। যারা গুলি ছোড়ে অনুমান করা হচ্ছে, তারা জামায়াতে ইসলামীর লোক। সারা পশ্চিম পাকিস্তানের জামায়াতে ইসলামীর লোকেরা আজ ভূট্টো বিরোধী হয়ে উঠেছে। এই বিরোধের অন্যতম কারণ পাঞ্জাব ও সিন্ধু প্রদেশের মধ্যে সিন্ধু নদের পানি বন্টন বিরোধ। ভুট্টো বর্তমানে সিন্ধু প্রদেশের দাবি সমর্থন করছেন। ফলে পাঞ্জাবি ও তাদের অর্থপুষ্ট ইসলামপন্থী দলগুলো হয়ে উঠেছে তার বিরোধী। মে ভুট্টো বাঙ্গালীদের বিপক্ষে এনেছিল বিচ্ছিন্নতাবাদের অভিযোগ, প্রাদেশিকতার অভিযোগ, আজ ভুট্টোর ও তার প্রদেশের বিপক্ষেও উঠতে আরম্ভ করেছে একই ধরনের অভিযোগ। পাঞ্জাব না সিন্ধু এই ভুট্টোর সম্মুখে ভীষণ সমস্যা। পাঞ্জাবীদের ধামা ধরে তিনি চেয়েছিলেন, পাকিস্তানের মসনদে আসীন হতে। কিন্তু এখন তার সেই স্বপ্নের গুড়েবালি। কদিন আগে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বলেছিলেন বঙ্গবন্ধুকে ছেড়ে দিলে নাকি তা দেশবাসীই তাকে মেরে ফেলতে চাইবে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, ইয়াহিয়ার এককালীন জিগড়ী দোস্তের প্রাণ তাঁর সম্মুখে বিপন্ন হতে চলেছে।
ভুট্টো লাহোরে দন্ত চিকিৎসালয় যাবার আগে যে বক্তৃতা করেন তাদের তিনি অনেকগুলো আশ্চর্য কথা বলেন। তিনি বোঝাতে চান ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর পাকিস্তানের সামরিক সরকারের সাথে কথা বলতে চান না। দেশে বেসামরিক সরকার অর্থাৎ ভুট্টো সাহেবের সরকার হলে ভারত সেই সরকারের সাথে কথা বলতে চাইবে। তাই পাকিস্থানে এখন বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়া একান্ত প্রয়োজন। এককালীন আগুন খাওয়া নেতা ভূট্টো এখন পরোক্ষভাবে বলছেন, পাক-ভারত আলোচনার মাধ্যমে শান্তির কথা। আর এর জন্য পাকিস্তানে জঙ্গি রাজের অবসানের কথা। কিন্তু তাতে কোন কাজ হবে না। কারণ বাংলাদেশে সমস্যা পাক-ভারত সমস্যা নয়। ভুট্টো সাহেবের সরকার আমলে ও বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে স্বীকার করে না নিয়ে কোন সমস্যার সমাধান চলবে না। কিন্তু সামরিক রাজ্যের বিরুদ্ধে সামান্যতম কথা বলাও আজ পাকিস্তানের হয়ে উঠেছে বিশেষ বিপদজনক। আর তাই ভূট্টোর মতো সুবিধাবাদী বড়লোক বামপন্থী নেতা কে হতে হচ্ছে পিস্তলের গুলির সম্মুখিন। সিন্ধু নদের পানি বিরোধে সামরিক সরকারের পরিবর্তে নিজের দলের ক্ষমতাসীন হওয়ার বাসনা- সবকিছুই ভুট্টোর রাজনৈতিক ভবিষ্যতকে করে তুলেছে অনিশ্চিত। বাঙালিরা চেয়েছিল তাদের ন্যায্য অধিকার। চেয়েছিল পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা। ভুট্টোর ক্ষমতার লোভ ও বাঙালি বিদেশ তাকে চক্রান্ত করে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল সামরিক চক্রের সাথে আজ পাকিস্তানের এই মিচিয়াভেল্লিটি এখন নিজেই হতে চলেছেন, প্রাণ সংশয়কারী চক্রান্তের শিকার। ভুট্টো আজ তার নিজের জালে নিজেই আটকা পড়ার পথে।
অপরদিকে ভুট্টো চরিত্র সম্পর্কে ওয়াকিবহাল মহল গুলিবর্ষণের সার্বিক ঘটনাকেই বানোয়াট বলে মনে করছেন। তাদের ধারণা স্ট্যাষ্ট রাজনীতির ধারক এ জাতীয় একটি ঘটনার পথ দিয়ে তার ক্ষয়িষ্ণু জনপ্রিয়তার তটে বালির বাঁধ সৃষ্টি করতে চেষ্টিত হয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনীতিতে গুলি খেয়ে কেউ শাহাদাত বরণ করে আর কেউ নিক্ষিপ্ত পথভ্রষ্ট গুলিতে জনপ্রিয়তার শিখরে আরোহন করে। লাহোরের কোন আততায়ী ভুট্টোর প্রতি একাধিক গুলিবর্ষণ করেছে কিন্তু তার নশ্বর দেহে একটিও গুলী প্রবিষ্ট হয়নি এমন ধারণা করা মুশকিল। ভুট্টো বিরোধী কোন পার্টির (গুলিবর্ষণকারী কে জামায়াতের লোক বলে সন্দেহ করা হচ্ছে) লোক যদি ভুট্টোকে হত্যার চক্রান্ত করতো তাহলে ভুট্টো প্রাণে বেঁচে গেলেও অন্ততঃপক্ষে আহত হতো, কিন্তু কোনটাই হয়নি।
ভুট্টোর পিতাজি বলে অভিহিত আইয়ুব খানও নির্বাচনে বাজিমাত করার জন্য পেশোয়ারের এক জনসভায় তার প্রতি গুলি নিক্ষেপ এর আয়োজন করেছিল। জনসাধারণকে গুলি নিক্ষেপের ঘটনা বিশ্বাস করানোর জন্য পাকিস্তানের তৎকালীন ঘোষিত লৌহমানব আইয়ুব খান মঞ্চের টেবিলের নিচে ভয়ার্ত চেহারা নিয়ে ঢুকে পড়েছিল।
এই মহলের ধারণা ভুট্টো লাহোরে রাজনৈতিক ঝড়ের সৃষ্টি করতে গিয়ে ধরা পড়ে গেছেন। হায়রে ভুট্টো। ক্ষমতার জন্য কত রকমের ভোলেই না তুমি নিতে পারো।
লাহোরের এক জনসভায় ভুট্টো আর এক গুল ছেড়েছেন। গুলের কারখানা লাহোরে তিনি বলেছেন যে পিকিং সফরকালে তিনি চেয়ারম্যান মাওর সাথে দেখা করেছেন। বিশ্বের এমনকি নির্বোধরাও জানে যে মাওর সাথে যে কোন বিদেশী সাক্ষাৎকারে আন্তর্জাতিক সম্পদের মর্যাদা পেয়ে থাকে। কিন্তু ভুট্টো ইয়াহিয়ার ঘেটুঁ হিসেবে চীনে গেলেন আর চেয়ারম্যান মাওর সাথে দেখা করলেন। কিন্তু চীনা সংবাদ প্রতিষ্ঠান এনসিএন বা পাকিস্তানে ইয়াহিয়া প্রচার বাহন পিপি বা রেডিও পাকিস্তান এমন চাঞ্চল্যকর খবর চেপে গিয়েছেন এমন কথা ভুট্টো লাহোরের লোকদের বোঝাতে চেয়েছেন। জনসাধারণ ভুট্টোর সভার গোলযোগ সৃষ্টির চেষ্টা করলে তা প্রশমিত করার জন্য চেয়ারম্যান মাও তাকে সাক্ষাৎ দিয়েছেন বলে ষ্টান্ট সৃষ্টি করে। ভূট্টো বোধহয় উপলব্ধি করতে পেরেছে লাহোরের সব ধরনের গুলই মারা যায়।
বিশ্বসমাজ ব্যর্থ হলে শরণার্থীদের ফেরার ব্যবস্থা ভারতকেই করতে হবে
(দিল্লি প্রতিনিধি প্রেরিত)
ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী শ্রী জগজীবন রাম এক জনসমাবেশের ঘোষণা করেন যে নিরাপত্তা ও সম্মানের সাথে ভারতে অবস্থানরত শরণার্থীদের বাংলাদেশি ফিরে যাওয়ার পথ প্রশস্ত করতে অপারগ হলে শরণার্থীদের দেশে পাঠানোর জন্য ভারত যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য হবে।
সমাবেশে বক্তৃতা প্রসঙ্গে শ্রী জগজীবন রাম বলেন, ভারত যুদ্ধ চায় না। কিন্তু কেবলমাত্র শরণার্থীদের স্বদেশে ফিরে যাবার সর্ত পুরন হলেই ভারত সীমান্ত থেকে সৈন্য সরাবে।
ভারত আত্মরক্ষার জন্য সৈন্য সমাবেশ করার পর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সুর কিছুটা নরম হয়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
শ্রী জগজীবন রাম বলেন, বহু বিঘোষিত চীন সফর থেকে মিস্টার ভুট্টো খালি হাতে ফিরে এসেছেন।
নিষ্ঠুর নিষ্পেষণেই বাঙ্গালীদের বাধ্য করেছে অস্ত্র ধারণ করতে
মস্কোর প্রভাবশালী রাজনৈতিক সাপ্তাহিক পত্রিকা নিউ টাইমস-এ একজন বিশিষ্ট সোভিয়েত লেখক অভিমত প্রকাশ করেন যে, বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলনের জন্য পাকিস্তান সরকার নিজেই দায়ী।
পত্রিকার সর্বশেষ সংখ্যায় লিখিত এক প্রবন্ধে লেখক মিঃ এ উলানুকী লিখেছেন, পাকিস্তানের নিষ্ঠুর নিষ্পেষণেই জন্ম দিয়েছে স্বাধীন বাংলার দাবি। বাংলাদেশের আন্দোলনের ইতিহাস বিবৃত করে লেখক উলানুকি বলেন ২৫শে মার্চের পূর্ব পর্যন্ত বাঙালিরা শুধু স্বায়ত্তশাসনের চেয়েছিল এর বেশি কিছু নয়। কিন্তু পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর অত্যাচার এর পরিপ্রেক্ষিতে বাঙালিরা বাধ্য হয়েছে অস্ত্র ধারণ করতে এবং মুক্তিবাহিনী গড়ে তুলতে।
সোভিয়েত সংবাদপত্র জগতে প্রথম বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর জন্মবৃত্তান্ত উল্লেখিত হলো এবং তারা পাকিস্তানি বাহিনীর উপর যে প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করেছেন তাও উল্লেখিত হলো। প্রবন্ধকার বর্তমান পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাবার একমাত্র পন্থা হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানকে সক্রিয় রাজনৈতিক জীবনে পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবি করেন।
তিনি লিখেছেন পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ নিজেরাই সমস্যার সৃষ্টি করেছেন। তারা কোনো যুক্তি তর্কের ধার ধারছেন না এবং সমস্যার একটা রাজনৈতিক সমাধানের বাস্তববাদী পক্ষে অগ্রসর হতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছেন। সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের বদলে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ সামরিক সমাধানের ওপর জোর দিচ্ছেন বলে লেখক অভিযোগ করেন।
আওয়ামী লীগের জনসভা
ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সমাজবাদই আমাদের লক্ষ্য
(কলকাতা প্রতিনিধি প্রেরিত)
জনাব মিজানুর রহমান চৌধুরী বলেন ভারতবাসী আমাদের জন্য যা করেছেন তা স্মরণ করলে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে যায়। তারা আমাদের লাখো লাখো ভাই-বোনকে থাকতে দিয়েছেন, খেতে দিয়েছেন সুতরাং শত দুঃখ কষ্টের মধ্যেও আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে তাদের সহানুভূতির কোন অমর্যাদা না হয়।
তিনি বলেন, দুঃখ আমাদের হচ্ছে তাতে কোন সন্দেহ নাই। কিন্তু পশ্চাতে যে সাড়ে ছয় কোটি বাঙ্গালীরে আমরা রেখে এসেছি তাদের দুঃখ কষ্টের কথা স্মরণ করলে আমরা সান্তনা পেতে পারি। সন্ধ্যার পর বাংলাদেশের দখলকৃত এলাকায় আমাদের মা-বোনদের ইজ্জত রক্ষার জন্য, ভাইদের পালিয়ে বেড়াতে হয় প্রাণ রক্ষার জন্য। শত্রুরা আমাদের হাজার হাজার ভাইকে বন্দি করে রেখেছে। সন্ধার পর তাদের আর্তনাদে আল্লাহর আরশ পর্যন্ত কেঁপে উঠে।
তিনি বলেন, চাষী মাঠে চাষ করতে পারে না ঘরে ধান-চাল রাখতে পারেনা, শ্রমিক ভাইয়েরা এখনো নন কো-অপারেশন করে চলেছেন, দিনমজুরদের আর কোনো পথ নেই। এসব কথা চিন্তা করলে আমাদের শত দুঃখেও আমরা সান্তনা পেতে পারি।
জনাব চৌধুরী আবেগজড়িত কণ্ঠে বলেন, বাংলাদেশের লাখো মা-বোন বিধবা হয়েছেন, বোন ভাই হারিয়েছেন। কিন্তু যেভাবে বাংলার মানুষ শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ দিয়ে চলেছেন তাতে আমাদের মাতৃভূমি শত্রুমুক্ত হতে আর বেশী দেরী নাই।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের আজ একমাত্র জাতি আছে তাহলো বাঙ্গালী জাতি। আমরা প্রতিটি শরণার্থীকে দেশে ফিরিয়ে নিতে বদ্ধপরিকর। বাংলাদেশের ইতিমধ্যেই বিরাট এলাকা মুক্ত হয়ে গেছে। যার এলাকার যখনই মুক্ত হবে তখনই তিনি নিজ নিজ বাড়িতে রওনা হয়ে যাবেন।
তিনি বলেন বিশ্বে একটি মাত্র ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র আছে। তা হলো ভারত। আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টো ও তাই। আমরা ইতিমধ্যেই মুক্ত এলাকায় ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সমাজবাদ কায়েমের কাজ শুরু করে দিয়েছি। তিনি প্রতিটি সকল মানুষকে মুক্তি বাহিনীতে যোগদানের আহ্বান জানান।
মিসেস বদরুন্নেসা আহমেদ
সভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মহিলা সম্পাদিকা মিসেস বদরুন্নেসা আহমেদ এম, এল, এ, বলেন যে, যারা আমাদের ভাইকে বোনকে হত্যা করেছে, আমার মা বোনের ইজ্জত নষ্ট করেছে তাদের ক্ষমা নাই। যতদিন বাংলাদেশে একটি ও পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য আছে ততদিন যুদ্ধ চলবেই চলবে। অন্য কোনো দেশ বা জাতি আমাদের সাহায্যে এগিয়ে না আসলেও নিজেদের শক্তির উপর ভর করে আমাদের যুদ্ধ চালাতে হবে এবং তাতে জিততে হবে।
শরণার্থীদের উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, আমাদের সব সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে আমরা ভারতের উপর চিরস্থায়ী বোঝা না হয়ে যাই। তারা আমাদের খেতে দিয়েছেন, থাকতে দিয়েছেন সেজন্য আমাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। তবে আমাদের সবসময় লক্ষ্য থাকবে নিজ মাতৃভূমিতে, নিজ নিজ ঘর বাড়িতে ফিরে যাওয়া।
তিনি বলেন বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করতে হবে- সেজন্য ও যুদ্ধ তীব্রতর করে তুলতে হবে। এজন্য প্রতিটি মা-বোনকেও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুদ্ধে অংশ নিতে হবে, সাহায্য করতে হবে।
তিনি প্রতিটি শরণার্থীকে ভারত সরকারের আইন-শৃঙ্খলা কোন রকমে বিঘ্ন সৃষ্টি না করার আহ্বান জানান।
তিনি বলেন যতদিন বাঙালি থাকবে, বাংলাদেশ থাকবে, ততদিন ভারতের সাথে আমাদের মৈত্রীবন্ধন থাকবে।
ফনী মজুমদার
সভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য ফনী মজুমদার ঘোষণা করেন যে, সেদিন বেশি দূরে নয় যেদিন প্রতিটি শরণার্থী মুজিবের বাংলাদেশে ফিরে যেতে পারবেন। তিনি বলেন ইতিহাসে এই প্রথম বাঙালি জাতি একটা নতুন সত্তা নিয়ে জেগে উঠেছে। আজ বাংলাদেশে কোন হিন্দু নাই, কোন মুসলমান নাই-ওটা তাদের ধর্মমাত্র। আসলে তারা সবাই আজ বাঙালি এবং এটাই তাদের একমাত্র পরিচয়। তিনি বলেন এ পরিচয় যতদিন আমরা শির উঁচু করে থাকতে পারবো ততদিন দুনিয়ার কোন শক্তিই আমাদের পদানত করে রাখতে পারবে না।
বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের অন্যতম সদস্য হিসেবে তার জাতি সংঘের সফরের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে শ্রী ফনী মজুমদার জানান যে, বিশ্বের প্রতিটি বিবেকবান মানুষ ও জাতি আজ বাংলাদেশের সমস্যা অনুধাবন করতে পেরেছেন। তারা আমাদের প্রতি অত্যন্ত সহানুভূতিশীল।
তিনি শরণার্থীদের প্রতি আবেদন জানিয়ে বলেন, তারা যেন ভারতের পরিস্থিতি বোঝা হয়ে থাকার কথা মনেও স্থান না দেন। তিনি বলেন, আমরা পরের দেশে থাকতে আসিনি। আমরা নিজেদের মাতৃভূমিতে ফিরে যাব।
ওবায়দুর রহমান
সভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সমাজসেবা সম্পাদক জনাব কেএম ওবায়দুর রহমান ঘোষণা করেন যে, সেদিন দূরে নয়, যেদিন প্রতিটি শরণার্থী স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে যাবেন। তবে সে বাংলা হবে বঙ্গবন্ধুর বাংলা, ইয়াহিয়ার পাকিস্তানের অংশ নয়।
জনাব ওবায়দুর রহমান ঘোষণা করেন যে, আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগ সরকার ২৫শে মার্চের পর যারা ভারতে এসেছেন তাদের একজনকেও রেখে যাবে না। প্রতিটি মানুষকে নিজ নিজ মাতৃভূমিতে ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন, তাহাদের নিজ নিজ সম্পত্তিতে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করবেন।
জনাব ওবায়দুর রহমান বলেন বঙ্গবন্ধুর অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের পাল্টা উপনিবেশবাদী ইয়াহিয়া টিক্কা চক্রের কুকুররা পিছু হটতে শুরু করেছে। কিন্তু তাদের নির্মূল না করা পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধারা থামবে না।
জনাব আমিরুল ইসলাম বার-অ্যাট-ল’ তার সংক্ষিপ্ত ভাষণে বাংলাদেশ ভলান্টিয়ার সার্ভিস গঠনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য বর্ণনা করেন। তিনি বলেন বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বাংলাদেশে একটা নতুন সমাজ গঠনে সাহায্য করাই তার এই কোরের লক্ষ্য।
জনাব মোঃ শাহ বাঙালি স্বরচিত গান পরিবেশন করেন। সভা শেষে শরণার্থী শিবিরের মেয়েরা ব্রতচারী গান ও নাচ পরিবেশন করে।
নিক্সন এর প্রতি নিউইয়র্ক টাইমস
সম্প্রতি নিউইয়র্ক টাইমসের এক সম্পাদকীয় প্রবন্ধে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে মার্কিন নীতির কঠোর সমালোচনা করা হয় এবং সমস্যার সমাধানের জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে একটা বোঝাপড়া করানোর জন্য ইসলামাবাদের উপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রভাব আরো জোরদার করা দরকার বলে মন্তব্য করা হয়।
উক্ত সম্পাদকীয় প্রবন্ধ অভিযোগ করা হয় যে, ভারত ও পাকিস্তানের সীমান্ত পরিস্থিতি আজ যে এমন সাংঘাতিক পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে তাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনেকখানি দায়ী।
কুত্তা প্রবন্ধ আরও বলা হয় যে সম্প্রতি পাকিস্তানকে দেয়া সামরিক সাহায্যের পরিমাণ কমানোর জন্য আদেশ দেওয়া হয়েছে সেটা খুবই নামমাত্র ব্যবস্থা। কেননা ইসলামাবাদের জঙ্গী শাসকদের অন্যান্য সরবরাহ এবং আদর্শগত সমর্থন জানিয়ে যাবার যে সাংঘাতিক নীতি মার্কিন প্রশাসন গ্রহণ করেছে তার ফলে অবস্থার আরো অবনতি হবে।
যশোরে দুঃসাহসিক আক্রমণে ১৭ জন হানাদার খতম
যশোর ৯ই নভেম্বর- গত ৫ই ও ৬ই নভেম্বর দুঃসাহসিক গেরিলা যোদ্ধারা যশোর শহর ও শহরতলীর অন্ততপক্ষে ১৭ জন খান সেনাকে খতম ও আরো কয়েকজনকে গুরুতররূপে আহত করেছেন।
প্রাপ্ত সংবাদ ও প্রকাশ, গত ৫ই নভেম্বর যশোরে মুক্তিবাহিনী গেরিলারা একদল হানাদার খান সেনাদের উপর চড়াও হয়ে চোরাগোপ্তা আক্রমণ চালান। এই দুঃসাহসিক আক্রমণে দশ জন সদস্য নিহত হয়। একই দিনে শহরের অপর অংশে গেরিলা যোদ্ধাদের অব্যর্থ গুলিতে চার জন পাকিস্তানী সৈন্য প্রাণ হারায়।
গত ৬ই নভেম্বর যশোর শহরের কাছে খননরত একদল দস্যু সৈন্যের উপর গেরিলা যোদ্ধারা ঝাঁপিয়ে পড়েন। সংঘর্ষে তিনজন খানসেনারা নিশ্চিহ্ন হয়। অবশিষ্টরা কোন রকমে পালিয়ে প্রাণ বাঁচায়। ঐদিনেই মুক্তিযোদ্ধারা একই অঞ্চলে একটি পাটের গুদামে আগুন ধরিয়ে দেয়।
লাকসামে মুক্তি বাহিনীর ব্যাপক আক্রমণ
লাকসাম থেকে আমাদের নিজস্ব প্রতিনিধি জানান গত ২৫শে অক্টোবর মুক্তিবাহিনীর অসম সাহসী বীর যোদ্ধারা লাকসাম রাস্তার নিকট বানগোদায় এক চোরাগুপ্তা আক্রমণ চালিয়ে ২১ জন পাকিস্তানী সৈন্য ও রাজাকার নিশ্চিহ্ন করে দেন। এছাড়া গেরিলা যোদ্ধারা পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর তিন টন ওজনের একটি কনভয় ধ্বংস করে দেন। গত ২৬শে অক্টোবর অত্র থানায় গরিবানগা-বানশি সড়কে আরেকটি দুঃসাহসিক অভিযানে ১৭জন সৈন্য ও ২১ জন অবাঙালি রাজাকার মুক্তিবাহিনীর হাতে প্রাণ হারায়।
গত ২৭শে অতঃপর মুক্তিবাহিনীর অসম সাহসী বীর যোদ্ধারা কুমিল্লা লালমাই সড়কের বিজয়পুরে পাকিস্তানি সৈন্যদের আক্রমণ প্রতিহত করে পাল্টা আক্রমণ চালিয়ে ২১ জন খানসেনা খতম ও ১৩ জনকে গুরুতররূপে আহত করেন।
গত ৩১ শে অক্টোবর স্বাধীনতাকামীরা হাজতখোলাতে শত্রু ঘাঁটিতে আক্রমণ চালিয়ে একজন ক্যাপ্টেনসহ ১৫ জন খান সেনা ও রাজাকারকে খতম করেন।
বন্ধুহীন পাকিস্তান
বিলাতের বিখ্যাত দৈনিক ‘দি টাইমস’ পত্রিকার বিশেষ সংবাদদাতা খবর দিয়েছেনঃ চীন পাকিস্তানকে বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের পরামর্শ দিয়েছে এবং ভারতের সাথে যুদ্ধে না জড়াবার জন্য উপদেশ দিয়েছে। চীন আরো বলেছে যে নিরাপত্তা পরিষদের বাংলাদেশ প্রসঙ্গ উত্থাপন সময় এখনো আসেনি।
ভুট্টো সম্প্রতি চীনে গিয়েছিলেন। কিন্তু তার সাথে চীনা নেতাদের আলোচনার পর কোন যুক্ত বিবৃতি প্রকাশ করা হয়নি। এ থেকে বোঝা যায় চীন বাংলাদেশ প্রসঙ্গে তাদের মনোভাব পরিবর্তন করেছে। কারণ চীন একসময় বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে পাকিস্তান বিরোধীদের ও দুষ্কৃতিকারীদের কাজ বলে উল্লেখ করেছিল। কিন্তু চীন এখন অনুধাবন করতে পেরেছে যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পশ্চাতে রয়েছে বিরাট গণসমর্থন। সমস্ত বাঙালি আছে এই স্বাধীনতা যুদ্ধের পিছনে।
অন্যদিকে চীন সবে রাষ্ট্রসঙ্ঘে ঢুকেছে। এই অবস্থায় তারা বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলে সারা বিশ্বে চীনের প্রতি বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হবে।
বিদেশি পর্যবেক্ষকদের মতে চীনের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও নানা পরিবর্তন ঘটছে। চরমপন্থীদের হাত থেকে নেতৃত্ব আসছে মধ্যপন্থী দের হাতে। তাই চীনের বৈদেশিক নীতিতে নমনীয়তা দেখা যাচ্ছে। চীন এশিয়ায় এখন বিশ্ব বিপ্লবের নামে নিজেদের কিছুতেই যুদ্ধবাজ বলে প্রমাণ করতে চায় না।
এশিয়াতে চীন ছিল পাকিস্তানের জঙ্গির একমাত্র সমর্থক। কিন্তু তাদের সমর্থন তিরোহিত হবার ফলে পাকিস্তান বিশেষভাবেই বন্ধুবিহীন হয়ে পড়েছে। পাকিস্তানের পত্রপত্রিকায় এখন কথা বলা হচ্ছে অনেক নরম সুরে।
একদিকে বাংলাদেশের যুদ্ধের মোড় পরিবর্তন, সর্বত্র মুক্তিবাহিনীর জয়যাত্রা, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে বাংলাদেশের মানুষের বিজয় এখন একান্তভাবেই নিশ্চিত হয়ে উঠেছে।
রণাঙ্গনে
সকল ফ্রন্টে মুক্তিবাহিনীর দুর্বার অগ্রগতি
ময়মনসিংহে আরো ২৪ জন খানসেনা খতম
গত ৬ই নভেম্বর জামালপুরের মিলন্দহ- মাহমুদপুর এলাকায় এক সংঘর্ষের পর মুক্তিবাহিনীর হাতে ১২ জন বেইমান হানাদার সৈন্য প্রাণ হারায় এবং ৪ জন সৈন্য গুরুতর আহত হয়। এই সংঘর্ষের সময় একজন তরুন মুক্তিযোদ্ধা অসম সাহস ও শৌর্য-বীর্যের সাথে যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হন। এর আগে গত ২৭শে অক্টোবর অত্র জেলার মুক্তি বাহিনীর সাথে সংঘর্ষে আরও সাত জন্য সৈন্য প্রাণ হারায়।
গত ২৪শে অক্টোবর অস্ত্র জেলার ঈশ্বরগঞ্জ থানায় শত্রু সৈন্যের উপর মুক্তিবাহিনী এক সরাসরি আক্রমণ চালিয়ে পাঁচ জন পাকিস্তানী সৈন্যকে নিহত করেন এবং ১০ জনকে গুরুতর রূপে আহত করেন।
রংপুরে ৮জন রাজাকার আটক
গত ৬ই নভেম্বর রংপুরের করোনাই অঞ্জলি মুক্তিবাহিনী এক সফল আক্রমণ চালিয়ে পাঁচটি রাইফেলসহ আটজন রাজাকারকে বন্দী করেন।
দিনাজপুরে ব্যাপক তৎপরতা
গত ৭ই নভেম্বর দিনাজপুরের গোসাইগঞ্জ হাটে গেরিলা যোদ্ধাদের হাতে একজন পাকিস্তানী সৈন্য নিহত এবং তিনজন গুরুতররূপে আহত হন। এ মাসের গোড়ার দিকে মুক্তিযোদ্ধারা কালিগঞ্জ-ভোটমারি এবং হাত বান্ধা ভোটমারির মধ্যে রেললাইন বিনষ্ট করে হানাদার সৈন্যদের রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছেন।
মেহেরপুরের বিস্তীর্ণ এলাকা মুক্তি বাহিনীর দখলে মুক্তিবাহিনী তিনদিক থেকে অভিযান চালিয়ে মেহেরপুর শহরের আশপাশ এলাকায় অবরুদ্ধ করে ফেলেছে। এছাড়া কুষ্টিয়া জেলার ২৫ বর্গমাইল এখন মুক্তাঞ্চল।
মুক্তিযোদ্ধারা বামন্দি ঘাঁটিতে কুমার খান সেনাদের উপর ত্রিমুখী আক্রমণ চালিয়ে তাদের খলিসাকুন্ডি পর্যন্ত তাড়িয়ে দিতে সক্ষম হন। মেহেরপুরে অবস্থিত পাকিস্তানি সৈন্যদল আটকে পড়েছে এবং মূল ঘাঁটি মিরপুর থেকে তারা এখন সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। গানগানা থানার উত্তর পশ্চিম থেকে মাথাভাঙ্গা নদী পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চল মুক্তি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। এছাড়া তারা ভৈরব নদীর দক্ষিণ পশ্চিম থেকে দর্শনা- মেহেরপুরের উত্তর পর্যন্ত দখল করে নিয়েছেন।
ঢাকায় চার জন নিহত
বিবিসি-র এক খবরে প্রকাশ গত১৪ই নভেম্বর ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ হানাদার পাকিস্তানী সৈন্যদের সাথে মুক্তিবাহিনীর দুর্ধর্ষ গেরিলা যোদ্ধাদের সাথে সারাদিন ব্যাপী বিক্ষিপ্তভাবে প্রচন্ড সংঘর্ষ হয়। এই সংঘর্ষের ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ একজন পুলিশ সহ চারজন্ গুলিতে নিহত হয়। বীর মুক্তিযোদ্ধারা ঢাকা শহরে কয়েকটি শত্রু অবস্থানের উপর বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে হানাদার সৈন্যদেরকে বিব্রত করে তোলেন।
চট্টগ্রামে আরো পাঁচজন বুলেটবিদ্ধ
বিবিসি আরো জানাচ্ছেন যে, বাঙালি গেরিলা যোদ্ধাদের আক্রমণে চট্টগ্রামে মুমূর্ষু অবস্থায় আরো পাঁচজনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
শাহজাদপুরে ব্যাপক তৎপরতা
গত ১০ই নভেম্বর মুক্তিবাহিনীর অসম সাহসী বীর যোদ্ধারা চোরাগোপ্তা আক্রমণ চালিয়ে খানসেনা ও রাজাকারদের ব্যাপক ভাবে ঘায়েল করেন। এছাড়া গেরিলা যোদ্ধারা কাজলদীঘি আক্রমণ চালিয়ে ১২জন শত্রু সৈন্যকে খতম করেন।
গত ৯ই নভেম্বর রংপুর জেলার বাগেশ্বরী এলাকায় মুক্তি বাহিনীর আক্রমণে প্রায় ২০ জন পাকিস্তানী সৈন্য খতম হয়।
বিভিন্ন এলাকায় প্রচণ্ড সংঘর্ষ
আমাদের প্রতিনিধি জানাচ্ছেন নোয়াখালীর ফেনী, পরশুরাম, সুধারাম এবং কুমিল্লার ফতেহা এলাকায় প্রচণ্ড সংঘর্ষ দারুণভাবে মার খায়।
কুমিল্লা শহরে মর্টার আক্রমণ
আমাদের রণাঙ্গন প্রতিনিধি জানাচ্ছেন, গত ২৬ অক্টোবর মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যোদ্ধারা কুমিল্লা কোতোয়ালি থানায় দখলদার সৈন্যদের ঘাঁটির উপর আক্রমণ চালিয়ে ৯ জন সোনাকে খতম করেন এবং ১৩ জনকে গুরুতররূপে আহত করেন।
গেরিলা যোদ্ধাদের অপর একটি দুঃসাহসিক দল নোয়াখালীর পরশুরামের নিকট শত্রু অবস্থানের উপর আক্রমণ চালিয়ে ৭জন দখলদার সৈন্যকে নিশ্চিহ্ন এবং ৯ জনকে গুরুতররূপে আহত করেন। এছাড়া শত্রর একটি বাঙ্কার ধ্বংস করে দেন।
সালদানদীতে ৩৯ জন শত্রু সৈন্য খতম
পূর্ব রণাঙ্গন থেকে আমাদের বিশেষ প্রতিনিধি জানাচ্ছেন যে, গত ১২ই নভেম্বর বাংলা দুঃসাহসিক গেরিলাযোদ্ধারা কুমিল্লার লক্ষ্মীপুর, মন্দাভাগ ও কাইয়ুম পুরে শত্রু অবস্থানের উপর ব্যাপক আক্রমণ চালিয়ে ৯ জন হানাদারকে খতম করেন।