বঙ্গবন্ধুর চিন্তাধারায়- ধনিক ও ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি – সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি
ক. ধনিক ও ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি
সমাজে কারা ধনিক তাদের চিনতে ও বুঝতে আমাদের মােটেই বেগ পেতে হয় না। প্রাত্যহিক জীবনের প্রতি মুহূর্তে-প্রতিক্ষণে ধনিকদের সাথে আমাদের দেখা – সাক্ষাৎ-মেলামেশা হচ্ছে। এ ব্যতীত এরা কে ও কি এবং কিভাবে সমাজে তাদের আগমন ঘটেছে ও ঘটছে তদ্বিষয়ে পূর্বেই আলােচনা করা হয়েছে। অর্থাৎ বৃহৎ বা একচেটিয়া উৎপাদন ক্ষেত্র ও উপায়গুলাের মালিকদেরই এক কথায় ধনিকশ্রেণী বলা যেতে পারে। এই ধনিকশ্রেণী উৎপাদন কার্যে কোনাে শ্রম প্রদান করে না। এরা হলাে মেহনতী শ্রমিকদের শ্রমের ফসলের সিংহস্বত্ত্বভােগী বা পরজীবি। এই হত্ত্ব তারা পেয়ে থাকে ব্যক্তিমালিকানার জোরে। তারা শারীরিকভাবে শ্রম বিনিয়ােগ করে না সত্য, তবে তাদের উৎপাদনের উপায়গুলাে যেমন শিল্প কলকারখানা, জায়গা-জমি ও অন্যান্য পুঁজি বা জিনিসপত্র উৎপাদনকার্যে শ্রমিকদের ওপর ছেড়ে দেয়া হয়। এ ক্ষেত্রে উৎপাদনের উপায়গুলাে হলাে মালিকদের মূলধন বা পুঁজি। তবে পুঁজি কথাটা সাধারণত ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প প্রতিষ্ঠানে বিনিয়ােজিত নগদ অর্থের ক্ষেত্রে আজকাল ব্যবহৃত হয়ে থাকে। মােট কথা একচেটিয়া বৃহদায়তন উৎপাদনের যাবতীয় উপায়গুলাের মালিকদেরকে ধনিকশ্রেণী বলা হয়ে থাকে এবং মূলত এদেরেকেই বলা হয় শোষকগােষ্ঠী। কারণ শ্রমিকদের শ্রম শােষণ করেই এদের যাবতীয় আর্থবৈষয়িক ক্ষেত্রের শ্রী বৃদ্ধি ঘটে থাকে এবং এ প্রক্রিয়ায়ই তাদের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে একচেটিয়া প্রভাব প্রতিপত্তি সৃষ্টি হয়ে থাকে। মানব সমাজে কী প্রক্রিয়ায় এ ধনিক শােষকগােষ্ঠীর আবির্ভাব ঘটেছে বা ঘটে থাকে সে বিষয়ে পূর্বেই আলােচনা করা হয়েছে। তবে ধনতান্ত্রিক শশাষণ কী এবং এর অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি কী এবং কীভাবে তা সমাজের বুকে প্রবাহিত হয়। তদ্বিষয়ে আলােচনার প্রয়ােজন রয়েছে। আমরা জেনেছি যে, আদিম সাম্যবাদী সমাজে ব্যক্তিসত্ত্বা, ব্যক্তিচিন্তা, ব্যক্তিস্বার্থ, ব্যক্তিসম্পদ বলতে কিছুই ছিল না। ফলে ব্যক্তিমালিকানা ব অর্থসম্পদের স্বত্ত্বের প্রশ্নই ছিল না ব্যক্তিমালিকানাই হলাে শোষণ-দুর্নীতি অবিচারের মূল উৎস।
আদিম সাম্যবাদী সমাজের কথা ছেড়ে দিলে এ পর্যন্ত পৃথিবীতে যতাে প্রকার সমাজ ব্যবস্থার উত্তরণ ঘটেছে (একমাত্র বর্তমানকালে সমাজতান্ত্রিক সমাজ বা দেশ ব্যতীত) তার মূলেই রয়েছে শোষণ-দুর্নীতি-প্রতারণা-শঠতা-অবিচারঅত্যাচার নির্যাতন। দাসপ্রথার যুগে শশাষণ ও অন্যান্য বৈশিষ্ট্য ছিলাে ক্রীতদাসরা। পরিশ্রম করে যা কিছু সম্পদ সামগ্রী উৎপাদন করতাে তার একচেটিয়া মালিক ছিল। প্রভু বা মালিকগণ। এর পরেই এসেছে সামন্ততান্ত্রিক ভূমিপ্রথার যুগ। এযুগে ভূমিদাস শ্রমিকরা ছিল উৎপাদকশ্রেণী; উৎপাদিত সম্পদ ভােগ করতাে সামন্তপ্রভু বা মালিকশ্রেণী। প্রচলিত ধনতান্ত্রিক-পুঁজিবাদী সমাজে যে শােষণ ব্যবস্থা চালু রয়েছে তাকে ধনতান্ত্রিক বা পুঁজিবাদী শােষণ ব্যবস্থা বলা হয়। তবে ধনতান্ত্রিক শোষণের প্রক্রিয়া এমনই উন্নততর যে সহজেই এ শােষণের রূপ সাধারণ মানুষ ধরতে পারে। দৃশ্যত অনেক ক্ষেত্রে মনে হয় যে, এ ব্যবস্থা একটি নৈতিকতা বা ন্যায়ের। মানদণ্ডের ওপর প্রতিষ্ঠিত। মূলত এটা সত্য নয়। সুতরাং কাল সময় যুগ ও সমাজ পরিবর্তনের সাথে উৎপাদন প্রণালী ব্যবস্থা ও ক্ষেত্রগুলাের ক্রমবিবর্তন ও ক্রমবিকাশের সাথে শশাষণ ব্যবস্থার রূপ-গতিপ্রকৃতিও বিবর্তিত ও পরিবর্তিত হয়েছে। এখন আমাদের জানতে হবে যে, ধনতান্ত্রিক বা পুঁজিবাদী ও আধাসামন্তবাদী শােষণের উৎস গতিপ্রকৃতি কী এবং সমাজে কিভাবে তা চলছে। মুনাফা বা লাভই হলাে পুঁজিবাদী-ধনতান্ত্রিক সমাজের মূল কথা। তাছাড়া এ দুটি শব্দ আমরা প্রত্যেক কাজের ক্ষেত্রেও ব্যবহার করে থাকি। মুনাফা হলাে প্রকৃত পক্ষে ধনিক সমাজের শােষণের ফল। মুনাফার অর্থ হলাে এই যে, মালিক। (ধনিক বা পুঁজিপতি) তার শিল্প কলকারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য, জায়গা জমি প্রভৃতি উৎপাদন ক্ষেত্রে যে মূলধন-পুঁজি বিনিয়ােগ যতােটা করে তারচে’ সে অধিক আদায় করে। বিনিয়ােগকৃত মূলধন-পুঁজি উঠে এসে বাকী যা উদ্ধৃত্ব বা অতিরিক্ত থাকে। সেটাই হলাে মুনাফা বা লাভ। পুঁজিপতি-মূলধনের মালিক উৎপাদনকার্যে শারীরিক বা কায়িক কোনাে শ্রম প্রদান করে না। তার জায়গা-জমি-মেশিনপত্র, কাঁচামালসহ উৎপাদনের যাবতীয় উপকরণ বা শক্তিসমূহ বা পুঁজি বা মূলধন উৎপাদনকার্যে বিনিয়ােজিত হয়। উৎপাদন শক্তিগুলাে কাজে লাগাবার জন্যে তাকে শ্রমিক নিয়ােগ করতে হয়। শ্রমিকের মােৎপাদিত ফসল বা সম্পদ যখন তার মালিক অন্য কোনাে উৎপাদন ও আর্থিক ক্ষেত্রে বিনিয়ােগ করে তখন তাকে বলা হয় ব্যক্তিপুঁজি।
বর্তমান ধনতান্ত্রিক-পুঁজিবাদী যুগ, ব্যক্তিপুঁজির যুগ। ব্যক্তিপুঁজির বদৌলতে সৃষ্টি হয়েছে একচেটিয়া পুঁজি ও মুনাফার যুগ। একচেটিয়া ব্যক্তিপুঁজির মালিক বা পুঁজিপতিরা পণ্য উৎপাদনকার্যে শুধু শ্রমিকদেরই শশাষণ করছে না, সাথে সাথে ক্রেতা সাধারণের নিকটে তাদের পণ্যসামগ্রীর মাধ্যমে অতিরিক্ত বা বর্ধিত মুনাফা আদায়ের লক্ষ্যে বাজারে (একচেটিয়া পণ্যবাজার) কৃত্রিম সংকট, অধিক সরবরাহ করা, সাময়িকভাবে পণ্যদ্রব্যের মূল্য কমিয়ে দেয়া, কারখানায় লে-অফ ঘােষণা ইত্যাদি কারসাজি করে থাকে। এভাবেই ক্রেতা-জনসাধারণকে পুঁজিপতি ব ধনিকগােষ্ঠী বা মালিকগােষ্ঠী শােষণ করছে। উৎপাদন শক্তিগুলােকে কাজে লাগিয়ে সম্পদ অর্জনের জন্যে যে শ্রমিকদের নিয়ােগ করা হয় সেই শ্রমিকরা তাদের শ্রমের পুরাে, প্রকৃত মূল্য বা পারিশ্রমিক পায় তারা যা পেয়ে থাকে তাহলে তারা যে শ্রমদ্বারা সম্পদ উৎপাদন করে, সেই অনুপাতে পারিশ্রমিকের পরিমাণ অতি নগণ্য। বাকি শ্রমের মুনাফার সবটুকুই চলে যায় মালিক বা পুজিপতির হাতে। পুঁজিপতিরা পুঁজি বা উৎপাদনশক্তিগুলাের মালিক। এগুলাে ব্যতীত শ্রমিকরা তাদের জীবিকার্জন করতে অক্ষম। ফলে শ্রমিকরাও হয়ে পড়ে পুজিপতিদের দেয় দরের দাস। শ্রমিকদের শ্রমবিক্রয়ের ফলে কতাে পরিমাণ মুনাফা বা লাভ হয়ে থাকে তার সাথে শ্রমিকদের কোনােই সম্পর্ক নেই। কারণ পূর্বেই পুঁজিমালিক শ্রমশক্তি ক্রয় করে থাকে। এ পর্যায়ে পুঁজিমালিকই শ্রমশক্তির মালিক। পুঁজিবাদী-ধনতান্ত্রিক সমাজে শ্রমশক্তি একটি বিশেষ পণ্য হিশেবেই পরিগণিত হয়ে থাকে। শ্রমিকরাই তাদের শ্রমশক্তিকে পণ্য হিশেবে পুঁজিপতির কাছে বিক্রয় করে একটা নির্ধারিত মজুরী বা পারিশ্রমিক পায়। শ্রমিকের শ্রমশক্তির গুণগত দিক এই যে, এ পণ্যটি সে তার নিজের মূল্য অপেক্ষা অনেক গুণ বেশি মূল্য সৃষ্টি করে থাকে শ্রমিকরা এই যে মূল্য সৃষ্টি করলাে তার সামান্য একটা অংশমাত্র সে পায়, বাকি বৃহত্তম অংশটি চলে যায় পুঁজিমালিকের হাতে মুনাফা হিশেবে। এটাই হলাে শ্ৰমশােষণ। এ শোষণকে শ্রমিকদের নীরবে সহ্য করতে হয়।
কারণ তাদের সংখ্যানুপাতে পুঁজিমালিকের উৎপাদনশক্তির আয়তন বা ক্ষেত্র অনেক কম। ফলে বেকারত্বের ভয়ে, সংসারের স্বার্থেই তাদেরকে মালিকের অন্যায় অবিচার জুলম অত্যাচার বঞ্চনা শোষণ ও রক্তচক্ষুকে নীরবে সইতে হয়। সুতরাং পরিশ্রম না করেই যে লােক যে অর্থসম্পদ আয় করে তার সমস্তই এ প্রক্রিয়ায় অপরকে—অর্থাৎ মেহনতী শ্রমিককে, অসহায়কে শােষণ করার ফলশ্রুতিতে আসে। প্রথম দৃষ্টিতে পুঁজিমালিকের ন্যায়তঃ পাওনা বলে মুনাফা নামক যে জিনিসটা মনে হয়, আসলেই তা আসে শ্রমিক শােষণের মধ্য দিয়ে। তবে কখনাে কখনাে শ্রমিকের পারিশ্রমিকের হার বৃদ্ধি পায়, বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বােনাস-ভাতা তাদেরকে দেয়া হয়। এর অর্থ এই নয় যে, পুঁজি-মালিক তার মুনাফা থেকে এসব দিচ্ছে—মুনাফা কম নিচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে শ্রমের মূল্য কিঞ্চিৎ বাড়িয়ে একদিকে শ্রমিকদের যেমন আরাে উৎপাদনবৃদ্ধির কাজে পরিশ্রম প্রদান করতে উৎসাহিত করছে, শ্রমিক আন্দোলনকে নিরুৎসাহিত করছে, শ্রমবিপ্লব ও সাম্যবাদী সামাজিক বিপ্লবকে ঠেকিয়ে রাখছে, পাশাপাশি মালিকগণ তাদের পণ্যসামগ্রীর মূল্যও বাজারে চড়া করে দিচ্ছে। সুতরাং শ্রমের মজুরী যা-ই বাড়ানাে হােক না কেন, তা সুদে আসলে বর্ধিতহারে উঠিয়ে নিচ্ছে। অর্থাৎ পুঁজিমালিকরা তাদের অসীম মুনাফা অর্জনের জন্যে শোষণকার্য অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাচ্ছে নানান কলা – কৌশল, ফন্দিফিকির, কারসাজি ও সাধু-অসাধু পন্থায়। এ জন্যেই মনীষী কার্ল মার্কস শ্রমশক্তির ক্রয়-বিক্রয়ের মজুরী নিয়মকে বা প্রথাকে ‘মজুরীদাসত্ব’ বলে। আখ্যায়িত করেছেন। মার্কসীয় দর্শনে ‘মজুরী প্রথা’ বলতে কিছুই নেই। আর নেই ব্যক্তিপুঁজি বা ব্যক্তিমালিকানার অবকাশ। কিন্তু এই প্রচলিত সমাজের মজুরী দাসত্বের নিয়মনীতি ঘুচবে কী করে, কী করে শ্রমশক্তি অপহরণ, শোষণ তথা শ্রমজীবি মেহনতী মানুষের ওপর শোষণ বঞ্চনা বন্ধ হবে ? পূর্বেই আলােচনা করা হয়েছে যে, মালিকশ্রেণী তাদের মালিকানা বা তাদের নিয়ন্ত্রিত উৎপাদন উপায়গুলাে, মূলধন বা পুঁজি পরিচালনা-বিনিয়ােগ বা সম্পদ উৎপাদন কার্যে যে মজুরী দিয়ে শ্রমিকদের শ্রমশক্তি ক্রয় করে থাকে সেই উৎপাদনের উপায়গুলাের মালিকানাস্বত্ব বিলােপ সাধন না করা পর্যন্ত মজুরী দাসত্ব প্রথা ও যাবতীয় শােষণ দুর্নীতিকে দূরীভূত করা। যাবে না যাবেই না। প্রকৃত সমাজতন্ত্রী বা সাম্যবাদীরা বিশ্বাস করেন যে, যেদিন পুঁজি ও উৎপাদন শক্তিগুলাে উৎপাদকশ্রেণী তথা মেহনতী শ্রমজীবি মানুষের সমষ্টিগত মালিকানায় আসবে সেদিন থেকে আর মজুরী দাসত্ব বা শােষণ থাকবে না। শ্রমজীবিরা যা কিছু সৃষ্টি করবে, যা কিছু উৎপাদন করবে—সে সবের মালিকও হবে তারা সমষ্টিগতভাবে।
সুতরাং, ব্যক্তিপুঁজি বা শােষণ সৃষ্টির হাতিয়ার ব্যক্তিমালাকানাস্বত্ব উচ্ছেদ করে সেগুলােকে সমষ্টিগত সামাজিক সম্পত্তিতে পরিণত করা হলেই কেবলমাত্র শ্রমজীবিদের মূল্য, তাদের নিরাপত্তা, শান্তি, কল্যাণ, স্বাধীনতা, ভাগ্যোন্নয়ন ও শোষণমুক্তি নিশ্চিত হতে পারে, সমাজ দেহ থেকে দুর্নীতির কালােছায়া মুছে যেতে পারে বলে বঙ্গবন্ধু দৃঢ় অভিমত ব্যক্ত করেছেন। আমাদের দেশ কৃষিপ্রধান। দেশের শতকরা ৮০ জন লােক কৃষিপেশার সাথে জড়িত। স্বভাবতঃই এদেশে কৃষিশােষণ ব্যবস্থা প্রচলিত আছে। এই কৃষিশশাষণ আমাদের চোখে তাই সহজেই ধরা পড়ে। শােষণের অন্যান্য উপায় যেমন শিল্প – কলকারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য, ঠিকাদারী, ধর্ম ব্যবসা ইত্যাদির শোষণকার্য অতি দ্র ও সুকৌশলে হয় বলে তা সাধারণের চোখে সহজে ধরা পড়ে না। কিন্তু কৃষি শশাষণের শিকার মােট জনসংখ্যার প্রায় ৭০ ভাগ। ক্ষুদে কৃষক, মাঝারি কৃষক বর্গাদার ভূমিহীন কৃষক মজদুর, এরাই এ শোষণের প্রত্যক্ষ শিকার, বিশেষ করে বর্গাদার ভূমিহীন কৃষক-মজদুররাই এ শােষণের নির্মম শিকার। কৃষি শােষণ বা আধাসামন্তবাদী ভূমিব্যবস্থার শােষণের দাপট কতাে প্রখর তা ভাবলে গা শিউরে ওঠে। বাংলাদেশে বর্তমান ভূমিহীনদের সংখ্যা শতকরা প্রায় ৬৫ ভাগে দাঁড়িয়েছে। শতকরা ১৫ ভাগ কৃষকের মাঝারি ও ক্ষুদ্র কৃষিজমি রয়েছে, আর বাকি শতকরা ৫ ভাগ হলাে বৃহৎ ভূমিমালিক, ভূস্বামী ও জোতদার এবং শতকরা ১৫% ভাগ লােক। কৃষি ব্যতীত অন্যান্য পেশায় নিয়ােজিত রয়েছে। ক্ষুদে কৃষক ও ভূমিহীন কৃষকদের একটা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশ বৃহৎ ভূমিমালিক জোতদার বা অনুপস্থিত মালিকদের (যারা অন্যান্য পেশার সাথেও জড়িত) জমি বর্গায় চাষাবাদ করে থাকে। বাকি ক্ষুদে ও ভূমিহীন কৃষক মজুর হিশেবে মাঝারি ও বৃহৎ ভূমিমালিকদের জমিতে নিয়ােজিত রয়েছে। বর্গাদার কৃষক জমির ফসল উৎপাদনের যাবতীয় ব্যয় দায়-দায়িত্ব যেমন চাষ, বীজ, সেচ, সার, ওষুধ ও নিড়াননাসহ যাবতীয় খরচ-খরচার দায়-দায়িত্ব বহন করে থাকে। যেভাবে জমিতে উৎপাদন ভালাে হয় তার ব্যবস্থা ঐ বর্গাদারকেই করতে হয়, কারণ জমিতে উৎপাদন ভাল না হলে ভূমিমালিক পরবর্তী মওসুমে বর্গাদারকে পরিবর্তন করে ফেলতে বাধ্য। এই ভয়ে বর্গাদার কৃষক মাথার ঘাম পায়ে ফেলে। যত্নসহকারে জমিতে অধিক ফসল উৎপাদন করতে সচেষ্ট থাকে। জমিতে উৎপাদিত ফসল বন্টনের ক্ষেত্রে কোথাও আধা-আধি, কোথাও : ভাগ ফসল বর্গাদাররা পেয়ে থাকে।
এই বন্টননীতিতে দেখা যায় যে, বর্গাদার কৃষক যে পরিমাণ শ্রম ও অন্যান্য উপকরণ ব্যয়বার বহন করেছে, তার তুলনায় প্রাপ্ত অংশের পরিমাণ অনেক কম। এর কারণও অবশ্য আছে। বর্গাদার কৃষক যেহেতু একেবারেই দরিদ্র, ফসল উৎপাদনের বৈজ্ঞানিক চাষাবাদ, কলাকৌশল, সময় মতাে বা অর্থের অভাবে ভালাে বীজ, সার, সেচ, ওষুধ, নিড়ােন ইত্যাদি যথাযথ হয় না, ফলে জমিতে ফসল উৎপাদনের পরিমাণ কমে যায়। এ ব্যতীত খরা, অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, বন্যা ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও পােকামাকড়ের আক্রমণে উৎপাদন হলে তার বিনিয়ােগকৃত শ্রম ও অন্যান্য ব্যয়িত উপকরণসমূহের মূল্য সে পায়। অবশ্য এতে মালিকের তেমন কোনাে ক্ষতি হয় না। কারণ যা সে পায়, তা-ই তার লাভ। কারণ একমাত্র ভূমি ব্যতীত তার আর কোনাে উপকরণ এখানে খাটে। যা উৎপাদন হচ্ছে, তার আধাআধি বা সিংহভাগই সে পাচ্ছে। এ ব্যতীত ভূমি। থেকে প্রাপ্ত সম্পদের ওপর মালিক নির্ভরশীল নয়। শহর-বন্দর-গঞ্জ বাজারে রয়েছে ভূমিমালিকদের (বৃহৎ মালিক) শিল্পকারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য, মহাজনী ও অন্যান্য লাভজনক প্রতিষ্ঠান। এভাবেই বর্গাদার কৃষকরা হচ্ছে তাদের বিনিয়ােগকৃত শ্রম ও অন্যান্য উপকরণসমূহের মূল্য থেকে বঞ্চিত। এটাও এক প্রকার শােষণ। আর এ শো ষণের হাতিয়ার হচ্ছে বৃহৎ মালিক-জোতদারদের ব্যক্তি মালিকানাধীন কৃষিজমি। এই কৃষিশশাষণের ব্যবস্থার অপর নাম হচ্ছে আধাসামন্তবাদী ভূমিব্যবস্থা। ভূমিহীন কৃষক-মজদুররা শ্রমিক হিশেবে, দিনমজুর হিশেবে অর্থাৎ মজুরী দাসত্ব প্রথায় বা মজুরী প্রথায় তুলনামূলক বড়াে কৃষক, মাঝারি কৃষক, ক্ষুদে কৃষক, বর্গাদার কৃষকদের অধীনে এবং গ্রামীণ অন্যান্য ছােটো-বড়াে পেশায় তাদের শ্রমশক্তি বিক্রয় করে থাকে। শিল্পশ্রমিকদের জীবনে কিছুটা নিরাপত্তা থাকে, তারা ট্রেড ইউনিয়নের নীতিমালায় আন্দোলন করতে পারে দাবী আদায় করতে পারে। কিন্তু ভূমিহীন কৃষক-শ্রমিক বা কৃষিশ্রমিকদের কোনাে সংগঠন নেই; ট্রেড ইউনিয়ন। সেখানে অচল, তাদের কোনাে দাবী আইনতঃ গ্রহণীয়ও নয়; তারা কৃষিমালিকের ইচ্ছেকে মেনে নিতে বাধ্য হয়। সুতরাং ভূমিহীন কৃষকরা কেমন করে শােষিত বঞ্চিত হচ্ছে তা সহজেই অনুমেয়। অপরদিকে মাঝারি ও ক্ষুদ্র জমির মালিক কৃষকরা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ—সময় মতাে টাকার অভাবে ভালাে বীজ সার সেচ ওষুধ ও অন্যান্য উপকরণ বিনিয়ােগ করতে অনেক ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়।
তারা নিজেরা এবং ভূমিহীন শ্রমিকদের পারিশ্রমিক দিয়ে উৎপাদন কার্য চালায়। এ ব্যতীত খরা অনাবৃষ্টি। অতিবৃষ্টি বন্যা ইত্যাদি দুর্যোগের ফলে উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। ফলে নিজেদের শ্রমশক্তি, শ্রমিকের শ্রমশক্তি ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক ব্যয়ভার বহন করে শেষ পর্যায়ে যে ফসল উৎপাদন হচ্ছে, ঐ সবের তুলনায় উৎপাদন অনেক কম হয়; ফলে বছরের খােরাকপােষ তাতে উঠে আসে না। ফলশ্রুতিতে মাঝারি ও ক্ষুদে কৃষকরা অভাবের তাড়নায় বৃহৎ জমিমালিক ও অন্যান্য পেশার ধনিক পুঁজিপতি মহাজন সুদখােরদের নিকট জমি বিক্রি বা বন্দক রাখতে বাধ্য হয় এবং এ প্রক্রিয়ায় মাঝারি কৃষকরা ক্ষুদ্র কৃষকে এবং ক্ষুদে কৃষকরা ভূমিহীন কৃষকে পরিণত হয়ে পড়ে। এ ব্যতীত মাঝারি ও ক্ষুদে কৃষকদের জমি তাদের পরিবারের মধ্যে উত্তরাধিকারভিত্তিক ভাগ বটোয়ারা হওয়ার ফলেও ক্রমান্বয়ে তার ঐ একই কার্যকারণের ফলশ্রুতিতে ভূমিহীনদের কাতারে শামিল হচ্ছে। এ প্রক্রিয়ায় মুষ্টিমেয় ধনিক-পরজীবি অকৃষক বৃহৎ ভূমিমালিক ও জোতদারদের হাতে দেশের আবাদযােগ্য কৃষিজমি গিয়ে জমা হচ্ছে, এবং কৃষি পেশার সাথে সম্পর্কহীন বা অকৃষক মালিকদের পরােক্ষ নিয়ন্ত্রণে কৃষিব্যবস্থা চলে যাওয়ার ফলে কৃষি উৎপাদন কমে যাচ্ছে। বর্তমানে আমাদের দেশে সামন্ত্রবাদ বা জমিদারী প্রথা নেই সত্য। কিন্তু ঐ। প্রথার বিবর্তিত অবশেষরূপে জোতদারী ও আধাসামন্তবাদী বর্গাপ্রথার ভূমিব্যবস্থা প্রচলিত আছে।
এই আধাসামন্তবাদী ভূমিব্যবস্থার ফলে বাংলার প্রাণ বলে কথিত কৃষককূল শােষিত বঞ্চিত ও দুর্বিপাকগ্রস্ত হয়ে দিন দিন সর্বহারায় পরিণত হচ্ছে। এবং যদি প্রচলিত ভূমিব্যবস্থার গতিধারা ও পরিবেশ অব্যাহতভাবে চলতেই থাকে তাহলে আগামী ২০ বছর পর বাংলাদেশে নতুন করে জমিদারী বা সামন্তবাদী। ভূমিব্যবস্থা এবং সেই সাথে সামন্ততান্ত্রিক রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়ে পড়বে বলে আমাদের মনে আশংকা জাগে। সুতরাং বাংলাদেশের সামগ্রীক আর্থসামাজিক ব্যবস্থার ওপর দৃষ্টিপাত করলে আমরা শশাষণব্যবস্থার প্রধানতম তিনটি প্রবাহ দেখতে পাই। এক: শিল্প কলখানা, দুই: ব্যাংক বীমা ও ব্যবসা-বাণিজ্য এবং তিন: আধাসামন্তবাদী ভূমিব্যবস্থা। উক্ত তিনটি ক্ষেত্রপ্রবাহ থেকে বেরিয়ে এসেছে মূলতঃ দুটি শ্ৰেণী, যথাঃ ধনিকশ্রেণী ও মেহনতী দরিদ্র শ্রেণী। আর পুঁজিপতি জোতদার শ্রেণী থেকে মূলতঃ অবিভূত হয়েছে বণিক বুর্জোয়া মুৎসুদ্দিশ্রেণী। এবং সর্বোপরি প্রশাসনিক আমলা ঠিকাদার মহাজন দালাল ও অন্যান্য সুবিধাবাদী পরজীবিগােষ্ঠীর আর্বিভাব ঘটেছে ধনতান্ত্রিক রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক ব্যবস্থার গর্ভ থেকে। এই হলাে ধনতান্ত্রিক বা পুঁজিবাদী শােষণভিত্তিক আর্থসামাজিক ব্যবস্থার মােটামুটি একটা চিত্র। এই শশাষণভিত্তিক ধনতান্ত্রিক বা পুঁজিবাদী আর্থসামাজিক ব্যবস্থার কবল থেকে সাধারণ শ্রমজীবি কৃষক-শ্রমিক মজদুর জনতাকে মুক্ত করার লক্ষ্যে স্বাধীনতাত্তোরকালে বঙ্গবন্ধু বৃহৎ ব্যক্তিমালিকানাধীন পরিত্যক্ত শিল্পকলকারখানা, বৈদেশিক বাণিজ্য, ব্যাংক বীমা ইত্যাদি জাতীয়করণ করেছিলেন এবং ভূমিব্যবস্থার ব্যক্তিমালিকানার ক্ষেত্রে একটা সীমাবদ্ধতা আরােপের ব্যবস্থা নিয়েছিলেন এবং এ ক্ষেত্রের পরবর্তী বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধনের ব্যবস্থাও রেখেছিলেন। এবং সামগ্রীকভাবে দেশের আপামর গণমানুষের সুখ শান্তি কল্যাণ সমৃদ্ধি শােষণমুক্তি ও সমাজ থেকে সর্বপ্রকার দুর্নীতির মূলােৎপাটন সাধনের লক্ষ্যে ১৯৭৫ সালে ‘বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ বা বাকশাল কর্মসূচী প্রদান করে ধনতান্ত্রিক বা পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে সমূলে উচ্ছেদ করে শােষণহীন সমাজতান্ত্রিক আর্থব্যবস্থার প্রেক্ষাপট রচনা করেছিলেন।
কিন্তু ধনতান্ত্রিক বা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার দেশীয় পুজারীগােষ্ঠী তাদের মুরব্বী আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদের সহযােগিতা নিয়ে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে প্রতিহত করার হীনলক্ষ্যে ১৯৭৫ সালের ১৫ ই আগষ্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে এবং তাদের এজেন্টদেরই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করেছে এবং অধ্যাবধি তারাই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে বসে আছে, তারা তাদের আর্থবৈষয়িক শ্রীবৃদ্ধি করে যাচ্ছে কৃষক শ্রমিক মেহনতী জনতার ওপর অমানবিক শশাষণকার্যের টিমরােলার চালিয়ে দিয়ে। ধনতান্ত্রিক সমাজের শোষকগােষ্ঠীর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের স্বতঃসিদ্ধ রূপ। প্রতিহিংসা জিঘাংসা ও রক্তপাতের হােলিখেলার মাধ্যমে এভাবে আরেকবার প্রকাশিত হলাে। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের সাথে সাথে সমাজতান্ত্রিক পদক্ষেপসমূহও বাংলাদেশ থেকে নির্বাসিত হলাে; প্রতিষ্ঠিত হলাে ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা, যে ব্যবস্থার বদৌলতে মুষ্টিমেয় সুবিধাবাদী পরজীবি শশাষকগােষ্ঠী সীমাহীন অর্থসম্পদের পাহাড় গড়ে তুলছে এবং বৃহত্তর সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষক শ্রমিকসহ সর্বস্তরের মেহনতী মানুষ চরম ক্ষুধা দারিদ্রতা অভাবের নির্মম তিমিরে হাবুডুবু খাচ্ছে, তারা সর্বহারায় পরিণত হচ্ছে, জীবনের সবকিছু থেকে বিতাড়িত হয়ে ধুকে ধুকে মরছে। এটাই হলাে ধনতান্ত্রিক বা পুঁজিবাদী আর্থসামাজিক ব্যবস্থার গতিপ্রকৃতি ও লক্ষ্য।
খ. সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি
যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সমাজের যাবতীয় উৎপাদনােপকরণের ওপর সমাজের সমষ্টিগত মানুষের সমষ্টিগত মালিকানা তথা সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয় তাকেই সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি বলা হয়। অর্থাৎ শোষণের হাতিয়ার ‘ব্যক্তিমালিকানা’কে উচ্ছেদের মধ্য দিয়েই সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়। তাই শোষণহীন সমাজের অপর নামই হলাে সমাজতান্ত্রিক বা সাম্যবাদী সমাজ। এ জন্যে প্রকৃত সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে শোষণভিত্তিক ব্যক্তিমালিকানা স্বীকার করা হয় না। সমাজের সমষ্টিগত মানুষের মালিকানায় উৎপাদন উপকরণসমূহের দায়িত্ব ন্যস্ত হওয়ার ফলে এ সমাজে কেউ কাউকে শােষণ প্রবঞ্চনা করার অবকাশ পায়। সমাজতান্ত্রিক সমাজ-রাষ্ট্রে উৎপাদন ও বন্টন ব্যবস্থা সমাজের ব্যাপক মানুষের কল্যাণের দিকে লক্ষ্য রেখে রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়। এখানে একটি কথা আবারও প্রসঙ্গক্রমে পুনরুল্লেখ করতে হয়। কারণ সমাজতন্ত্র সম্পর্কে অনেকেরই ভুল ধারণা পরিলক্ষিত হয়। তারা মনে করেন যে, সমাজতন্ত্র মানেই প্রত্যেক মানুষের সকল ধনসম্পদের জাতীয়করণ বা রাষ্ট্রীয়করণ বুঝায়। এ কথা সঠিক নয়। শুধুমাত্র উৎপাদনের উপায়সমূহ—যা থেকে মানুষের প্রতি মানুষের শােষণকার্য চলে, সেই উপায়সমূহকে জাতীয়করণ বা সমাজীকরণ বা রাষ্ট্রীয়করণ করা হয় এ কথার অর্থ এই নয় যে, কারাে কোন নিজস্ব সম্পত্তি (Personal Property) থাকবে না। নিজের প্রয়ােজনের বা ব্যবহারের ওপর প্রত্যেকেরই নিজস্ব অধিকার রয়েছে। সমাজতান্ত্রিক সমাজ যতােই অগ্রসর হবে, সমাজের সার্বিক সমৃদ্ধির সাথে সাথে ব্যক্তির নিজস্ব সম্পত্তি ভােগের পরিমাণ ততােই বেড়ে যাবে। প্রত্যেকেরই সুখ-সুবিধা ভােগের লক্ষ্যে প্রত্যেকের নিজস্ব সম্পত্তি ভােগের আনুপাতিক হার ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাবে। এটাই হলাে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির মূল লক্ষ্য। এ সমাজে প্রত্যেকেই সমাজের প্রয়ােজনানুয়ায়ী সম্পদ উৎপাদন করবে এবং প্রত্যেকেই উৎপাদনের ক্ষেত্রে যােগ্যতানুযায়ী অংশগ্রহণের অনুপাতে সম্পদ সামগ্রী ভােগ করবে। ফলে এখানে মুনাফা সৃষ্টির কোনাে অবকাশ নেই।
ধনতান্ত্রিক সমাজের পরবর্তী সমাজই হলাে সমাজতান্ত্রিক সমাজ। ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা হলাে শোষণের চরম রূপ। আর এ শশাষণের শিকার সমাজের শতকরা ৯৫ ভাগ শ্রমজীবী মেহনতী মানুষ। সাথে সাথে শোষক-শােষিতের দ্বন্দ্ব-সংঘাত তথা শ্রেণীসংগ্রামের তীব্রতা শুরু হয়েছে। এ সংগ্রামের অনিবার্য পরিণতি হিশেবে ধনতান্ত্রিক শােষকসমাজের পতন ঘটবে; তদস্থলে এক নতুন আর্থসামাজিক ব্যবস্থা গড়ে উঠবে। সেই ব্যবস্থাই সমাজতান্ত্রিক আর্থব্যবস্থা। আধুনিক সাম্যবাদের প্রবক্তা, সমাজ বিজ্ঞানী মণীষী কার্লমার্কসের মতে সাম্যবাদ তিনটি ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত। যথাঃ ঐতিহাসিক বস্তুবাদ বা দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ, উদ্বৃত্ত মূল্যতত্ত্ব ও ঐতিহাসিক বিবর্তনের ধারা। ইতিহাসের সকল ঘটনাবলীই বিভিন্ন শ্রেণী বা গােষ্ঠীর মধ্যে তথা সমাজের পরস্পরবিরােধী চিন্তাধারায় মানবগােষ্ঠীর মধ্যে দ্বন্দ্ব কলহ সংঘাত অর্থাৎ অর্থনৈতিক সংগ্রামের ফলশ্রুতি। মানবজাতির ইতিহাস হলাে শােষক শােষিতের মধ্যে সগ্রামের ইতিহাস; শ্রেণীসংগ্রামের ইতিহাস। অর্থনৈতিক শােষণকে কেন্দ্র করেই এ সংগ্রামের সূত্রপাত ঘটেছে। এক শ্রেণী চেয়েছে বা চায় শোষণ-পেষণ-অত্যাচার নির্যাতন-প্রতারণা-শঠতা ও অন্যান্য কূটকলাকৌশলের মাধ্যমে সীমাহীন অর্থ সম্পদ ও প্রভাবপ্রতিপত্তি অর্জন করতে, আর অপর শ্রেণী চেয়েছে বা চায় ঐ সব থেকে সার্বিক মুক্তি। ফলে সকল সময়ে সকল সমাজে সৃষ্টি হয়েছে শ্রেণীসংগ্রাম ও শ্রেণীবিভক্ত সমাজ। পৃথিবী ও মানবসভ্যতার ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পেরেছি যে, আদিম সাম্যবাদী সমাজ ব্যবস্থার ধ্বংসস্তুপের ওপর যে সমাজ ব্যবস্থার উত্তরণ ঘটেছিলাে ব্যক্তিসত্ত্বা ব্যক্তিচিন্তা ব্যক্তিস্বার্থ ব্যক্তিসম্পদ ও ব্যক্তিস্বাধীনতার ভিত্তিতে সেই সমাজকে বলা হয়েছে দাসপ্রথার সমাজ। দাসপ্রথার বিবর্তিত পরবর্তী সমাজ ভূমিদাস প্রথা এবং ভূমিদাস প্রথার পরবর্তী সমাজ হলাে সামন্ততান্ত্রিক সমাজ। আর সামন্ততান্ত্রিক সমাজের গর্ভ থেকেই জন্ম নিয়েছে প্রচলিত ধনতান্ত্রিক বা পুঁজিবাদী সমাজ এবং সর্বহারা শ্ৰেণী। সেই দাস প্রথার যুগ থেকে শুরু হয়েছে। মানবজাতির মধ্যে দ্বন্দ্ব ও সংঘাত-সংগ্রাম আন্দোলন ও বিপ্লব; যা এখনাে চলছে। তাই মানবজাতির সহজাত বৈশিষ্ট্যের ইতিহাস হলাে সমাজের পরস্পরবিরােধী মানবগােষ্ঠীর মধ্যে সংগ্রামের ইতিহাস। অর্থনৈতিক ইতিহাস এই শ্রেণী সংগ্রামের ইতিহাস।
মার্কসের উদ্বৃত্ত মূল্যতত্ত্ব’ উৎপাদনকর্মে শ্রমসময় ও শ্রমিকের শ্রমকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। উৎপাদনের স্বাভাবিক অবস্থায় শ্রমের গড় কর্ম দ্বারা একটি দ্রব্যসামগ্রী উৎপাদনে যে-সময় লাগে, সেটাই শ্ৰম সময় এবং উৎপাদন কার্যে যে পরিমাণ “সামাজিকগত প্রয়ােজনীয় শ্রমসময়’ বা ‘Socially necessary Labour-time’—ব্যয় হয় তা-ই দ্রব্যের মূল্য নির্ধারণ করে থাকে। ঐ যে মূল্যের শ্রমতত্ত্ব’, এর ওপরই উদ্বৃত্ত মূল্যতত্ত্ব প্রণয়ন করা হয়েছে। অর্থাৎ মূল্যের শ্ৰমতত্ত্বের ওপর ভিত্তি করেই ‘উদ্বৃত্ত মূল্যতত্ত্ব’ প্রণীত হয়েছে। কারণ উৎপাদনে নিয়ােজিত শ্রমের পরিমান দিয়েই দ্রব্যমূল্য নির্ধারিত হয়। সুতরাং উৎপাদিত দ্রব্যের মূল্যের সবটুকুই শ্রমের প্রাপ্য। ধনতান্ত্রিক সমাজে এ ব্যবস্থা একেবারেই অচল। এ সমাজে শ্রমিক তার মানুপাতে পারিশ্রমিক বা মূল্য পায় না; শ্রম অপেক্ষা অনেক কম পায়। কোন একটি দ্রব্য উৎপাদনে শ্রমিক যে পরিমাণ শ্রম ব্যয় করে থাকে তদূঅপেক্ষা যতােটুকু কম মূল্য পায় এবং শ্রমের মূল্য যা অবশিষ্ট বেশি বা অতিরিক্ত থাকে সেটাকেই ‘উদ্বৃত্ত মূল্যতত্ত্ব’ বা ‘Surplus Value’ বলা হয়ে থাকে। ধনতান্ত্রিক সমাজে ধনিকশ্রেণী বা উৎপাদনােপকরণের মালিকরাই তাদের মালিকানাস্বত্বের জোরে শ্রমিকের শ্রমের এই উদ্বৃত্ত মূল্য একচেটিয়াভাবে ভােগ করে থাকে। সমাজতান্ত্রিক সমাজে উদ্বৃত্ত মূল্য বা মুনাফা বা লাভ বলতে কিছুই নেই। কারণ শ্রমিকরা যে-পরিমাণ শ্রমশক্তি উৎপাদনকার্যে বিনিয়ােগ করবে, সেই শ্রমশক্তিদ্বারা উৎপাদিত দ্রব্যের মূল্যের সবটুকুই শ্রমের প্রাপ্য; শ্রমিকের প্রাপ্য। এ সমাজে উৎপাদনােপকরণগুলাের ওপর ব্যক্তিবিশেষের মালিকানা স্বত্বাধিকার নেই যে ব্যক্তি বা মালিক তার বিনিয়ােগকৃত উৎপাদনােপকরণগুলাের প্রাপ্য দাবী করে। এ সমাজে এর মালিকানা শ্রমজীবী মানুষের সমষ্টিগত বা সামাজিক মালিকানায় ন্যস্ত থাকে। সুতরাং মােৎপাদিত দ্রব্যসামগ্রীর মূল্যে সবটুকুই শ্রমের প্রাপ্য। এটাই হলাে সমাজতান্ত্রিক আর্থব্যবস্থার মূল ভিত্তি। আর ঐতিহাসিক বিবর্তনের বাস্তব অবস্থার ভিত্তিতে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক দর্শন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মানবজাতির সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিবর্তনের গতিধারাকে আদিম সাম্যবাদ, দাস প্রথা, ভূমিদাস প্রথা বা সামন্তবাদ, ধনতন্ত্র বা পুঁজিবাদ, সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদ, এই কয় ভাগে ভাগ করা হয়েছে। শ্রেণীহীন, স্তরহীন, শশাষণহীন, ধর্মহীন, রাষ্ট্রহীন, ব্যক্তিমালিকানাহীন ইত্যাদি অবস্থায় আদিম সাম্যবাদী সমাজ গড়ে উঠেছিলাে।
এ সমাজে সবকিছুই ছিলাে যৌথ বা সমষ্টিগত স্বার্থের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত। পরবর্তীকালে উপজাতীয় সমাজের প্রধান, সমর প্রধান, উৎসব প্রধান, কৃষি প্রধান, বানিজ্যিক প্রধান ও অন্যান্য প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মনে ব্যক্তিসত্ত্বা, ব্যক্তিচিন্তা, ব্যক্তিস্বার্থ, ব্যক্তিসম্পদ ও ব্যক্তিস্বাধীনতার বীজ অংকুরিত হতে থাকে ধনসম্পদের লােভ-লালসা ও ভােগদখলকে কেন্দ্র করে। এ প্রক্রিয়ায় মানবগােষ্ঠীর মধ্যে সম্পদভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থার গােড়াপত্তন হলাে। এ সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলে জীবনযাপনের বিভিন্ন পেশার উদ্ভব ঘটলাে। ফলশ্রুতিতে উৎপাদন প্রণালীর ক্রমবিকাশ ঘটতে লাগলাে। ক্রমান্বয়ে শ্রমবিভাগও শুরু হলাে, শোষণের কার্যক্রম শুরু হলাে, সমাজে প্রভূ ও দাস অর্থাৎ পেট্রেসিয়ানস্ ও প্লেবিয়ানস সৃষ্টি হলাে। সমাজে শ্রেণীসত্ত্বা সৃষ্টি এবং কালক্রমে সমাজ শশাষক-শােষিত এই দু’শ্রেণীতে বিভক্ত হয়ে পড়লাে। অর্থাৎ অর্থনৈতিক শক্তিসমূহের প্রভাবে বিবর্তনের যে উত্তাল জাগরণ সৃষ্টি হয়, তারই ফলশ্রুতিতে মানবসমাজে দাসপ্রথা, সামন্তবাদ, ধনতন্ত্র বা পুঁজিবাদের আবির্ভাব ঘটেছে। অর্থনৈতিক বিবর্তনের বিভিন্ন স্তর বা ধাপগুলাের মধ্যে ধনতন্ত্রের বিলুপ্তির মধ্যে দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হবে সমাজতান্ত্রিক সমাজ। এটাই শােষণজাত সমাজ বিবর্তনের শেষ অধ্যায়। কারণ শ্রেণীসংগ্রামই প্রতিটি অর্থনৈতিক বিবর্তনের ফলশ্রুতি এবং উৎপাদিকা শক্তির বিবর্তনের মধ্য দিয়েই সমাজে এই পরিবর্তন সাধিত হয়। ধনতান্ত্রিক বা পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় উৎপাদনের উপায়সমূহের ওপর ব্যক্তিমালিকানা থাকার ফলে মালিকরা বিনাশ্রমেই শ্রমিকের শ্রমের উদ্বৃত্ত মূল্য আত্মসাৎ করে থাকে। ফলে শ্রমিক ও মালিকের মধ্যে আর্থিক ব্যবধান বাড়তে থাকে ক্রমান্বয়ে। উৎপাদনের বেলায় বিভিন্ন পুঁজিমালিক পারস্পরিক প্রতিযােগিতামূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়লে অপেক্ষাকৃত কমদক্ষ পুঁজিমালিকরা প্রতিযােগিতামূলক বাজার থেকে ছিটকে পড়ে যায়। এই অদক্ষ পুঁজিমালিকরা। অবশেষে শ্ৰমিক-মেহনতী জনতার দলে ভিড়ে যায়। এর ফলে সমাজে নিঃস্ব শ্রমিকদের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে, বেকার সমস্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। এই সুযােগে ধনিক-মালিকগােষ্ঠী শ্রমিকদের নামমাত্র পারিশ্রমিকে তাদের শ্রমশক্তি ক্রয় করে থাকে। শ্রমিকরাও এই নামমাত্র পারিশ্রমিকের বিনিময়ে তাদের শ্রমশক্তি বিক্রয় করতে বাধ্য হয় বেকারত্বের অভিশাপ থেকে রক্ষা পাবার জন্যে।
এ অবস্থায় দেশের যাবতীয় সম্পদ মুষ্টিমেয় লােকের করতলগত হয়ে পড়ে এবং দেশের অগুন্তি দরিদ্র মেহনতী মানুষ চরম দারিদ্রতার ভেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হয় এবং সর্বহারায় পরিণত হয়ে ধুকে ধুকে মরে। অপরদিকে উৎপাদন পদ্ধতির উন্নতির ফলে এবং ব্যক্তিপুঁজিতে সৃষ্ট সমাজে। পণ্যের যােগান বেড়ে যায়, কিন্তু দেশের অধিকাংশ লােক দরিদ্র বলে পণ্যের চাহিদা। বাড়ে না। এর ফলে মজুতপণ্যের পাহাড় জমে ওঠে, বাজারে মন্দাভাব দেখা দেয়, মালিকের উৎপাদনশক্তি অচল হয়ে পড়ে, সমাজে বেকার সমস্যা বৃদ্ধি পায় এবং এভাবে পুরাে সমাজটাই অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের তিমিরে নিক্ষিপ্ত হয় এবং এভাবেই ধসে পড়ে ধনতান্ত্রিক সমাজের ভিত। এই অবস্থায় শ্রমিকশ্রেণী সামাজিক অনাচার ও অব্যবস্থার কবল থেকে মুক্তিলাভের লক্ষ্যে একতাবদ্ধ হয়ে ধনিক বুর্জোয়াশ্রেণীর বিরুদ্ধে এক সর্বাত্তক বিপ্লবে নেমে পড়ে। শোষক এবং শােষিত-এই শ্রেণীসংগ্রামের ফলশ্রুতিতেই সামাজিক বিপ্লব সংঘটিত হয়। এই বিপ্লবে শ্রমিকশ্রেণী ধনতান্ত্রিক সমাজের নিয়মনীতি আদর্শ সবকিছু তছনছ করে দেয়; তাদের একতাবদ্ধ বিপ্লবের ফলে ধনিক শােষক বুর্জোয়াগােষ্ঠীর উচ্ছেদ সাধিত হয় এবং বিপ্লবী শ্রমিকশ্রেণী অতঃপর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে নেয়। এই শিক্ষাই আমরা পেয়েছি মহান রুশ বিপ্লবের ইতিহাস থেকে এবং এভাবেই শ্রেণীহীন ও শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে। আর এই ব্যবস্থার মূল কথা হলােঃ প্রত্যেকে তার সাধ্য-সামর্থানুযায়ী শ্রম বিনিয়ােগের সুযােগ পাবে এবং সেই অনুযায়ী পারিশ্রমিক লাভ করবে।’ এটাই সমাজতন্ত্রের কথা এবং সমাজতন্ত্রের চুড়ান্ত পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত হবে সাম্যবাদ। অর্থাৎ প্রত্যেকে তার সামর্থানুযায়ী কাজ করবে এবং প্রয়ােজনানুযায়ী সে তার প্রাপ্য পাবে’—এটাই হলাে আধুনিক সাম্যবাদী সমাজের মূল দর্শন। পূর্বেই আলােচনা করা হয়েছে যে, যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় যাবতীয় উৎপাদনের উপায়সমুহের ওপর রাষ্ট্রীয় বা জনগণের সমষ্টিগত মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয় সেই ব্যবস্থাকে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বলা হয়ে থাকে। তাই সমাজতান্ত্রিক আর্থব্যবস্থা উন্নয়নের দায়িত্ব রাষ্ট্রের ওপরই ন্যস্ত হয়ে থাকে। রাষ্ট্র সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে দেশে অর্থনৈতিক গতিধারা পরিচালনা করার লক্ষ্যে, ধনতান্ত্রিক আর্থব্যবস্থার তথাকথিত স্বয়ংক্রিয় মূল্যবােধকে বিলােপ করে সমাজতান্ত্রিক আর্থব্যবস্থার নীতি গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নের জন্যে একটি কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা কমিশন গঠন করে তার ওপর দায়িত্ব অপর্ণ করে।
উৎপাদনােপকরণসমুহের বিলিবন্টন ও দ্রব্যসামগ্রী উৎপাদন এই কমিশন পূর্বনির্ধারিত জাতীয় পরিকল্পনা মাফিক ঘটায়। তাই এখানে ব্যক্তি উদ্যোগের কোনাে অবকাশ নেই। এই আর্থব্যবস্থায় সমাজে কোন দ্রব্যসামগ্রী কখন কিভাবে কোথায় এবং কি পরিমাণ উৎপাদন করতে হবে সে-বিষয়ে কমিশন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকে। সমাজতান্ত্রিক আর্থব্যবস্থায় মুনাফা বলতে কিছু নেই। শ্রমিকরা যা-ই উৎপাদন করবে তার সবটুকুই তারা ভােগ করবে, মধ্যস্বত্ত্ব বলতেও কিছু নেই। কিন্তু ধনতান্ত্রিক আর্থব্যবস্থায় মুনাফা সৃষ্টির লক্ষ্যে উৎপাদনধারা পরিচালিত হয়ে থাকে, ধনিক-মালিকশ্রেণী শ্রমিকদের উপার্জিত সম্পদ পরজীবি হিসেবে ভােগ করে থাকে। এবং এ মুনাফা লাভ করে থাকে মালিকশ্রেণী, শ্রমিক শ্রেণী নয়। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক সমাজে উৎপাদনধারা পরিচালিত হয়ে থাকে সমাজেরই প্রয়ােজনে, ফলে এখানে ব্যক্তিগতভাবে কেউ মুনাফা অর্জন ও এককভাবে তা ভােগ করতে পারে না। তাই সমাজতান্ত্রিক আর্থব্যবস্থায় উৎপাদনােপকরণসমূহকে পরিকল্পনা কমিশনের সুপারিশে সমাজের ব্যাপক মানুষের নিত্যপ্রয়ােজনীয় দ্রব্যসামগ্রী। উৎপাদনকার্যে নিয়ােজিত করা হয়। এ ব্যবস্থায় কোন কোন ক্ষেত্রে মুনাফার হার কমে গেলেও সমাজের কল্যাণের দিকে লক্ষ্য রেখে বিনিয়ােগ বৃদ্ধি করা হয়। যেমন স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, রাস্তা ঘাট, নর্দমা-পয়ঃপ্রণালী, বিশ্রামাগার, স্বাস্থ্যনিবাস প্রভৃতি ক্ষেত্রে কোন প্রকার সরাসরি মুনাফা অর্জনের সম্ভাবনা নেই। কিন্তু সমাজের বৃহত্তর স্বার্থে ও কল্যাণে এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের সার্বিক স্বার্থে। সমাজতান্ত্রিক সমাজের এই সকল ক্ষেত্রে প্রভূত মূলধন বা পুঁজি খাটাতে হয়। ধনতান্ত্রিক সমাজে উৎপাদন-বিলিবন্টন ও ভােগের মধ্যে সামঞ্জস্যহীনতা প্রবলভাবে পরিলক্ষিত হয় উৎপাদন ব্যবস্থা ব্যক্তিমালিকানায় পরিচালিত হওয়ার কারণে। এ অবস্থায় সমাজে বাণিজ্যিকচক্রের আবির্ভাব ঘটে থাকে এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উঠানামা ঘটে। এই উঠানামার ফলশ্রুতিতে সমাজে ব্যাপক আকারে কর্মহীনতার পরিবেশ সৃষ্টি হয়। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সমাজের সকল অর্থনৈতিক কর্মকান্ড সরকারের কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা কমিশনের নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হয় বলে উৎপাদন ও ভােগের মধ্যে কোনাে সামঞ্জস্যহীনতা সৃষ্টি হতে পারে না। এর ফলে যেমন একদিকে বাণিজ্যিক চক্রের প্রভাব দূর হয়, অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতিধারা অব্যাহত থাকে এবং অপরদিকে সকল কর্মক্ষম মানুষের কর্মসংস্থান নিশ্চিত হয়ে দেশ থেকে কর্মহীনতা দূরীভূত হয়।
এই প্রক্রিয়ায় অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতিধারা প্রবহমান থাকে। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মুক্ত ও অবাধ প্রতিযােগিতামূলক কর্মকান্ডের নামে অপব্যয়মুলক উৎপাদন ও একচেটিয়া প্রভাব-কর্তৃত্বের কোনাে সুযােগ নেই। এ ব্যতীত শ্রমিকগণ শিল্প-কলকারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষি ও অন্যান্য উৎপাদনমূলক ব্যবস্থাপনায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের সুযােগ পায়। ফলে তাদের কর্মোদ্দীপনা বৃদ্ধি পায়, উৎপাদন বৃদ্ধি পায় এবং অর্থনৈতিক ক্রমােন্নয়নের গতিধারা প্রবাহিত হয়। বঙ্গবন্ধু বলেছেনঃ ‘ব্যক্তিমালিকানাই শোষণের হাতিয়ার’। ধনতান্ত্রিক সমাজে উৎপাদনের উপায়সমূহ কতিপয় লােকের ব্যক্তিমালিকানায় থাকায় তারা শ্রমিকদের শ্রমশক্তিকে শােষণ করে থাকে। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক সমাজে উৎপাদনের উপায়সমূহকে সমাজীকরণ করা হয়; ফলে মুনাফামূলক উৎপাদন বন্ধ হয়, সমাজে শোষক শােষিত থাকে না, কোনাে শ্রেণী সৃষ্টি হতে পারে না। এটাই শোষণহীন। শ্রেণীহীন সমাজ—শান্তির সমাজ। পক্ষান্তরে ধনতান্তিক সমাজ হলাে শোষণ বঞ্চনা অত্যাচার শঠতা প্রতারণা অবিচার ব্যভিচার অশান্তির সমাজ; বৈষম্য অবৈধ প্রভাব প্রতিপত্তি ও অসুদোপায়ে অর্জিত সীমাহীন ব্যক্তিসম্পদ ও ধােকাবাজীর সমাজ। সমাজতান্ত্রিক সমাজে যার যার প্রতিভা-প্রজ্ঞা-মণীষা তথা যােগ্যতার ভিত্তিতে কাজের সংস্থান ঘটে, অপরদিকে ধনতান্ত্রিক বা পুঁজিবাদী সমাজে অর্থসম্পদ, আত্বীয়তা ও অন্যান্য অবৈধ প্রভাব প্রতিপত্তির জোরে যােগ্যতাহীন ব্যক্তির কাজের সংস্থান হয়ে থাকে। এ সব কারণে নিরীহ ও যােগ্যতর ব্যক্তি তাদের অধিকার হারায়।
সমাজতান্ত্রিক সমাজে আত্বীয়তা নির্ভর করে মানবিক মূল্যবােধের ভিত্তিতে, অপরদিকে ধনতান্ত্রিক সমাজে আত্বীয়তা-সহমর্মিতা নির্ণিত হয় অর্থসম্পদের মাপকাঠিতে। এ সমাজে যার যতাে বেশি অর্থসম্পদ আছে তার মানসম্মান ততাে বেশি। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক সমাজে মানসম্মান তারই বেশি যার প্রতিভা ও কর্মদক্ষতা বেশি। ধনতান্ত্রিক সমাজে শিল্প কলকারখানা নির্মাণ ও উৎপাদন ব্যবস্থায় ব্যক্তিপুঁজি বিনিয়ােজিত হওয়ার ফলে পুঁজি মালিক তার আসল মুল্য ও মুনাফা অত্যাধিক উচ্চমূল্যে উঠিয়ে নিতে আগ্রহী। এ কারণেই মালিক শ্রমিকদের শােষণ করে থাকে এবং পণ্যসামগ্রীর দাম বাড়িয়ে ক্রেতাসাধারণকেও শোষণ করে থাকে, তার বিনিয়ােগকৃত পুঁজি বা মূলধনের স্বার্থে। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক সমাজে শিল্পায়নের জন্যে শেয়ারভিত্তিক যৌথ তহবিলে সংগৃহীত মূলধন বা পুঁজি বিনিয়ােজিত হয়। বিনিয়ােজিত পুঁজির মুনাফার প্রয়ােজন এখানে নেই। কারণ যৌথভাবে সকলে মিলে যা উৎপাদন করবে তা ভােগ করার অধিকারও তাদের। ফলে শোষণের কোনাে অবকাশ এখানে নেই। সুতরাং যে সমাজে শােষণ-প্রতারণা নেই সেই সমাজই শান্তির সমাজ। সমাজতান্ত্রিক সমাজ। এই সমাজেই কেবলমাত্র ব্যাপক জনগণের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার নিশ্চয়তা থাকে। এর ফলে সমাজের প্রতিটি মানুষ তার প্রতিভা ও যােগ্যতা বিকাশের জন্যে সমান সুযােগ সুবিধা লাভ করতে পারে— ধনতান্ত্রিক সমাজে নয়। এটাই হলাে বঙ্গবন্ধুর চিন্তাধারায় সমাজতান্ত্রিক আর্থব্যবস্থার গতিপ্রকৃতি ও লক্ষ্য। এবং এ লক্ষ্যেই তিনি দ্বিতীয় বিপ্লব’ তথা বাকশাল কর্মসূচী প্রদান করেছেন।
সূত্র : বঙ্গবন্ধু-দ্বিতীয় বিপ্লবের রাজনৈতিক দর্শন – আবীর আহাদ