You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ বা বাকশালের

কাঠামাে প্রকৃতি উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য

গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ ও লক্ষ্যকে একটি জাতীয়ভিত্তিক সম্মিলিত সর্বদলীয় সর্বশ্রেণী ও সর্বস্তরের তথা বিভিন্ন পেশাভিত্তিক জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল সরকার ও একক রাজনৈতিক প্লাটফরমের নীতিমালায় একত্রিত ও সুসমন্বিত করে প্রকৃত জনগণতান্ত্রিক শােষণহীন সমাজতান্ত্রিক সােনার বাংলা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাঙ্গালী জাতির স্বাধীনতাকে সুসংহত ও মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে এবং বাংলাদেশকে একটি আত্মমর্যাদাশীল সুখীসমৃদ্ধ জাতিরাষ্ট্রে বিশ্বমানচিত্রে প্রতিষ্ঠিত করার মহান উদ্দেশ্যে একটি বৈপ্লবিক রাজনৈতিক আর্থসামাজিক প্রশাসনিক সাংস্কৃতিক কর্মসূচী ও দিকদর্শন বঙ্গবন্ধু কর্তৃক গৃহীত ও উদ্ভাবিত হয় ১৯৭৫ সালের প্রথমার্ধে অর্থাৎ বিশেষ করে চিরশােষিত চিরলাঞ্ছিত চিরবঞ্চিত চিরভাগ্যাহত চিরদরিদ্র চিরদুখী অধিকারহারা মেহনতী শ্রমজীবি বৃহত্তর সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙ্গালীর ‘গণতান্ত্রিক একনায়কতান্ত্রিক শাসন ও তাদের মৌলিক মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা তথা রাজনৈতিক আর্থসামাজিক মুক্তির লক্ষ্যে যে রাজনৈতিক প্লাটফরম—সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানের উদ্ভব ঘটেছিলাে বঙ্গবন্ধুর সার্বিক আদর্শের ভিত্তিতে সেটাই হলাে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ’ বা বাকশাল। এই বাকশালের কর্মসূচীকেই বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব’— অর্থনৈতিক মুক্তির বিপ্লব হিশেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। বাকশালের রাজনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে প্রকৃত গণতন্ত্র’ তথা শােষিতের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাকরণ এবং শশাষণের কালােহাতকে চিরদিনের মতাে উৎখাত করার কার্যকরি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিলাে। বাকশাল-বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ’-এর শব্দগুলাের বাংলা এবং ইংরেজী লিখনের (Bangladesh Krishak-Shramik-Awami League) যােগফলের সমষ্টিভিত্তিক শিরােনাম হলােঃ বাকশাল (BKSAL)।  বাকশালের রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক দর্শন ও কর্মসূচী বঙ্গবন্ধু কোনাে বিদেশী রাষ্ট্র বা বিশেষ কোনাে ইজম’ থেকে আমদানী করেননি। তবে যে যে প্রক্রিয়া একটি জনগণতান্ত্রিক সাম্যবাদী শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রযােজ্য তা বিশ্বের ঐতিহাসিক বিশেষ প্রেক্ষাপট থেকে শিক্ষা গ্রহণ বা তা থেকে অনুপ্রাণিত হতে বাধা নেই। যেমন ইসলামের মহানবী আদিম সাম্যবাদী সমাজের ইতিহাস থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে কুসংস্কারাচ্ছন্ন সামন্তবাদী স্বৈরতান্ত্রিক শাসন শােষণ অত্যাচার লাঞ্ছনার লেলিহান শিখায় পােড়-খাওয়া আরবীয় সমাজের বুকে ইসলামী সাম্যবাদী বিপ্লবের উত্তরণ ঘটিয়ে ছিলেন।

তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর চিন্তাধারা আদর্শ ও লক্ষ্য বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে খেলাফতে রাশেদীন’ নামক একক দলীয় ইসলামী শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলাে। তেমনি আধুনিক মার্কসীয় সাম্যবাদ আদিম সাম্যবাদ ও খেলাফতের ইসলামী সাম্যবাদ ব্যবস্থার অনুপ্রেরণায় গড়ে উঠেছে। এখানেও ইসলামের মতাে গণতান্ত্রিক একদলীয় শাসন ব্যবস্থাকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।  সাম্যবাদী চিন্তাধারার নিদর্শন আমাদের বাঙ্গালী আদিম সমাজ, উপজাতীয় বা কৌম সমাজ, ঐতিহ্যবাহী একান্নবর্তী বা যৌথ পরিবারভিত্তিক সমাজ; ইংরেজ আমলে বিপ্লবী তীতুমীর, হাজী শরিয়তউল্লাহ, দুদুমিয়া, ফকির মজনুশাহ প্রমুখ বিপ্লবীদের নেতৃত্বে সমবেত হাজার হাজার বাঙ্গালী কৃষক মেহনতী জনতার সমাজ ও তাদের রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক চিন্তাধারার মধ্যে আমরা দেখতে পাই। আমাদের মহান শিক্ষক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলার ঐতিহাসিক ঐতিহ্যবাহী সাম্যবাদী সমাজ, বাংলার সাম্যবাদী বিপ্লবীদের আদর্শ, মহানবী ও ইসলামের খেলাফতে রাশেদীন ও মার্কসীয় সাম্যবাদ থেকে শিক্ষা গ্রহণ ও অনুপ্রাণিত হয়ে এবং নিজের বাস্তব অভিজ্ঞতা, চিন্তাধারা, বাঙ্গালী জাতির প্রতি অকৃত্রিম ভালােবাসার আলােকে বাঙ্গালী জাতির আশা আকাংখা, মন-মানসিকতা, সামাজিক ভৌগােলিক পরিবেশ ইত্যাদির আলােকে এবং জাতির বৃহত্তর সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের রাজনৈতিক অধিকার ও তাদের মৌলিক মানবাধিকার তথা জনগণের প্রকৃত গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠা, সমাজদেহ থেকে শােষণ-বঞ্চনাঅবিচার- হিংসা- অত্যাচার-প্রতারণা চিরতরে উৎপাটিত করার লক্ষ্যে বাকশালের রাজনৈতিক আর্থসামাজিক প্রশাসনিক ব্যবস্থার উদ্ভাবন করেছেন। এ বিষয়ে সন্দেহের কোনাে অবকাশ নেই। এ প্রসঙ্গে আমার এক প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেনঃ ‘কারাগারের অন্ধপ্রকোষ্ঠে বসে বসে আমি মানবসভ্যতার ক্রমবিকাশের ইতিহাস, বিশেষ করে আমার বাঙ্গালী সমাজের আদি ইতিহাস, কৌম ও জয়েন্ট ফ্যামিলি ব্যবস্থা, বিপ্লবী মহাপুরুষদের কার্যক্রম, ইসলাম ও মার্কসবাদ পর্যালােচনা করেছি। …..আমি নিজে একটি মধ্যবিত্ত কৃষক পরিবার থেকে এসেছি, দেখেছি কৃষক জনতা কিভাবে শােষিত বঞ্চিত হয়। শ্রমিক মেহনতী মানুষের সাথে মিশেছি; অন্যান্য পেশার মানুষদেরও দেখেছি, কিভাবে তাদের শ্রম শােষিত হয়, কিভাবে আমার সাধারণ মেহনতী শ্রমজীবি মানুষ অধিকারহারা হচ্ছে, কে বা কারা কিভাবে তাদের শাসন শোষণ করছে; দাবিয়ে রাখছে। ………এ জন্যে আমি জীবনভর শােষিত বঞ্চিত অত্যাচারিত দুখী মেহনতী মানুষের রাজনৈতিক তথা আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার ও তাদের আর্থসামাজিক বা মৌলিক মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যে সংগ্রাম করেছি, জেল খেটেছি। অমানুষিক জুলম-নির্যাতন ভােগ করেছি। বুঝেছি, প্রচলিত গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রভাবাধীন শােষণভিত্তিক সমাজকাঠামােই তাদের সকল দুর্দশা ও দুর্গতির মূল কারণ।

এ কারণেই আমি জনগণের প্রকৃত গণতন্ত্র এবং একটি শােষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্যে বাকশাল বা দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি দিয়েছি। আমার অভিজ্ঞতা চিন্তাশক্তি ও শিক্ষা আমাকে শিখিয়েছে যে কেবলমাত্র গণতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে দিয়েই আমার সাধারণ মানুষের সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিত হতে পারে। আমি তাই আমার কৃষক-শ্রমিক ও অন্যান্য পেশাজীবি মানুষের প্রকৃত প্রতিনিধিত্বশীল শাসন প্রতিষ্ঠার জন্যে বাকশাল করেছি। এদেশের মানুষ রক্ত দিয়ে, জীবন দিয়ে, ত্যাগ তিতিক্ষা দিয়ে, সীমাহীন দুঃখ-কষ্ট লাঞ্চনা সহ্য করে আমার নির্দেশিত পথে সংগ্রাম করেছে, আমার চাওয়া-পাওয়ার অনেক বেশিই আমাকে দিয়েছে। আমিও তাই আমার জীবনের সবকিছু, এমন কি আমার জীবনটাকে তাদের কল্যাণে উৎসর্গ করার সংকল্প নিয়ে বাকশাল বা দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচী দিয়েছি। এ পথ ব্যতীত বাংলার সাধারণ দীনদুখী মানুষের সার্বিক মুক্তি আসতে পারে না।’ ‘বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক-আওয়ামী লীগ’ বলতে আমরা কি বুঝি ? বাংলাদেশ’ বলতে আমরা আমাদের মাতৃভূমিকে বুঝি। ‘কৃষক’ বলতে গ্রামবাংলায় বসবাসরত কৃষিপেশার সাথে সম্পৃক্ত বৃহৎ ভূঃস্বামীকৃষক, মাঝারি কৃষিজমির মালিক-কৃষক, ক্ষুদে কৃষক, বর্গাদার বা ভাগচাষী ও ভূমিহীন কৃষক-মজদুরদের বুঝায়। এ ব্যতীত কৃষিকাজের সাথে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য পেশার লােকজনকেও বুঝায়। ‘শ্রমিক’ বলতে গ্রামাঞ্চলের বিভিন্ন কুটির শিল্প, গঞ্জ-নগর-বন্দর ও শহরাঞ্চলের ছােটো-মাঝারি-বৃহৎ শিল্পকলকারখানা, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান তথা সরকারী, আধাসরকারী, স্বায়ত্বশাসিত সংস্থা, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ও বেসরকারী বা ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানসমূহের শ্রমিক কর্মচারীদের বুঝায়।  ‘আওয়ামী’ বলতে কৃষক-শ্রমিক-কর্মচারি-মজদুর ব্যতীত অন্যান্য নাগরিক যারা সরকারি বেসরকারি স্বায়ত্বশাসিত সংস্থার বিভিন্ন কলকারখানা শিল্প-বাণিজ্যিক ও অন্যান্য কর্মক্ষেত্রে নিয়ােজিত আছেন, যেমন গ্রাম-শহরাঞ্চলের উচ্চবিত্ত, উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণী যথা, ভূঃস্বামী, জোতদার, মহাজন, ফড়িয়া, দালাল, ঠিকাদার, বৃহৎ ও ক্ষুদ্র শিল্পকলকারখানা—বাণিজ্যিক সংস্থার মালিক কর্মকর্তা, সরকারি, আধাসরকারী ও স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানসহ সামরিক আধাসামরিক ও অন্যান্য আইন-শাসন প্রয়ােগকারী সংস্থা এবং আদালতসমূহের উচ্চপদস্থ আমলা কর্মকর্তা বিচারকদের বুঝায়। এ ব্যতীত শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবি সম্প্রদায়, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সাহিত্যিক-সাংবাদিক-শিল্পী, আইনজীবি, রাজনীতিক প্রভৃতি তথাকথিত বিশিষ্ট ও সৌখিন পেশার লােকজনকে, এক কথায় গােটা জনগণকেই বুঝায়।  ‘লীগ’ বলতে উপরােক্ত শ্ৰেণীসমূহের সমন্বিত প্লাটফরম প্রতিনিধিত্বশীল রাজনৈতিক সংগঠন বা রাজনৈতিক সংঘকে বুঝায়। বঙ্গবন্ধু বাঙ্গালী জাতিকে উপরােক্ত তিনটি শ্রেণীতে চিহ্নিত ও বিবেচিত করে সবাইকে অর্থাৎ ১০০% ভাগ জনগােষ্ঠীকে বাকশালের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। সর্বশ্রেণী সম্মিলিত জাতীয় রাজনৈতিক দল বাকশালের মধ্যে শােষক-শােষিতকে পৃথক পৃথকভাবে বিভক্ত ও চিহ্নিত করা হয়নি।

বৃহৎ ধনিক থেকে সর্বহারা ভিক্ষুককে রাজনৈতিকভাবে সমাধিকারের ভিত্তিতে বাকশালের পতাকাতলে টেনে নেয়া হয়েছে। আমরা জানি, শতকরা ৯৫ ভাগ দীনদুখী সর্বহারা শােষিত মেহনতী মানুষ আর বাকি শতকরা ৫ ভাগ শােষক ধনিক মানুষের মন – মানসিকতা, দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তাধারা এক হ’তে পারে না। এদের প্রাত্যহিক কার্যক্রমও এক নয়। মূল কথা হলাে, শােষক-শশাষিতের দৃষ্টিভঙ্গি, মানসিকতা সবকিছুই হয় পরস্পরবিরােধী। শশাষক-শােষিতের সমাজে এই দুই শ্রেণীর সহাবস্থান শান্তির নয়; হিংসাদ্বেষ, সংঘাত-সংঘর্ষ, রেষারেষি ইত্যাদিতে এ সমাজ পরিপূর্ণ। বঙ্গবন্ধু তার উদার ও বিশাল মনে এ প্রশ্ন ঠাই দেননি। সকলকেই তিনি নিজের মনে করে আপন করে নিয়েছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন কোনাে মানুষই জন্মগতভাবে শােষকশােষিত নয়; প্রচলিত রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক সিস্টেমের বেড়াজালে ও শিকারে আবদ্ধ হয়ে মানুষের জীবনের গতিপথ নির্ণিত হয় মাত্র। সুতরাং মানুষ দায়ী নয়, সমাজ ব্যবস্থাই দায়ী। এই চিন্তাধারায় সমৃদ্ধ বঙ্গবন্ধু প্রচলিত রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক ব্যবস্থাকে তথা শােষণবাদী সমাজকে ভেঙ্গে শশাষণহীন দুর্নীতিমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বাংলার সমগ্র জনগােষ্ঠীকে বাকশালের পতাকাতলে জড়াে করেছেন। এভাবে বিশেষ করে তথাকথিত শােষক ধনিক সম্ভ্রান্তশ্রেণীকে তাদের মনমানসিকতা পরিবর্তনের সুযােগ দিয়েছেন তবে এ কথাও তিনি জানতেন যে, ‘চোরা নাহি শােনে ধর্মের কাহিনী’। এদের মানসিকতা সহজে পরিবর্তন হওয়া সম্ভব নয়। এরা শিক্ষিত, অতি ধূর্ত, সম্পদশালী ক্ষমতাশালী। এরা তাদের ব্যক্তি বা শ্ৰেণীস্বার্থের প্রশ্নে খুবই সজাগ এবং এরা পরস্পরভাবে নানা আত্মীয়তার ডােরে আবদ্ধ। এরা সীমাহীন ব্যক্তি ও পরিবারগত সুখ-সম্ভোগ ও প্রাচুর্যময় জীবন থেকে একটুও নিচে নামতে রাজী নয়; সমাজের ব্যাপক মানুষের কল্যাণ-শান্তি-সমৃদ্ধির লক্ষ্যে নিজেদের সামান্যতম স্বার্থ উৎসর্গ করতে রাজী নয়। সমাজের সমষ্টিগত বা ব্যাপক মানুষের ভাগ্যোন্নয়ন শান্তি-সমৃদ্ধি তাদের কাম্যও নয়। শোষকগােষ্ঠী সম্পদের লােভ-লালসা ও মােহে অন্ধ। সীমাহীন সুখ শান্তি সমৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে হেন কোনাে পন্থা নেই যা তারা ব্যবহার করে না। নিজেদের কায়েমী স্বার্থ বজায় রাখার জন্যে এরা রক্তপাত গৃহযুদ্ধ অত্যাচার নির্যাতন প্রতারণা শঠতা হিংসার আশ্রয় নিয়ে থাকে।

সমাজের বুকে অবৈধ প্রভাব প্রতিপত্তি, ঠাটডাট, শানশওকাত বজায় রাখতে এরা সর্বদা তৎপর। সমাজের আর দশজন সাধারণ মানুষের দুঃখ দারিদ্রতা ও দুর্দশার ভাগ এরা নিতে রাজী নয় বা ঐ সব থেকে সাধারণ মানুষের মুক্তিও তাদের কাম্য নয়; বরঞ্চ কীভাবে সাধারণ মানুষকে কোণঠাসা করে, দাবিয়ে রেখে তাদের ওপর বাহাদুরি শাসন শােষণ করা যায়; তাদেরকে প্রতারণা ও শঠতার জালে আবদ্ধ করে তাদের শ্রমােপার্জিত সম্পদ অপহরণ করে সমাজের বুকে অর্থসম্পদের ক্ষমতায় নিজেদেরকে শ্রেষ্ঠ করা যায়, এ লক্ষ্যেই চলে তাদের যাবতীয় কার্যক্রম। সুতরাং শােষকশ্রেণী বা সমাজের শতকরা ৫ ভাগ ধনিকগােষ্ঠী জাতীয় দল বাকশাল বা দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচিতে বিশ্বাসী নয়। তাই হয় তাদেরকে তাদের মানসিকতা পরিবর্তন করে সাধারণ মানুষের ভাগ্যকে নিজেদের ভাগ্যের সাথে মেশাতে হবে, অথবা তাদেরকে রাজনৈতিকভাবে উচ্ছেদের যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। বাকশাল ব্যবস্থার মধ্যে এ জাতীয় কার্যক্রমের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। কারণ সমাজের মাত্র ৫% ভাগ ভাগ্যবান ধনিক শােষকদের স্বেচ্ছাচারিতার ওপর শতকরা ৯৫ ভাগ সাধারণ মানুষের ভাগ্যকে নিয়ে চিনিমিনি খেলা বা ধ্বংস করার পথে ছেড়ে দেয়া যায় না। বঙ্গবন্ধু সমাজের মুষ্টিমেয় মানুষের তথাকথিত ব্যক্তিস্বাধীনতার নামে। ব্যক্তিস্বেচ্ছাচারিতা-স্বৈরাচার, ব্যক্তিস্বার্থ, ব্যক্তিভাগ্যোন্নয়নের বা ব্যক্তিসম্পদের সীমাহীন উন্মলােভ-লালসার যূপকাষ্ঠে যাতে সমাজের বৃহত্তর সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ দীনহীন শ্রমজীবি মেহনতী মানুষের জীবনের আশা-আকাংখা, স্বপ্নসাধ ও তাদের মৌলিক মানবাধিকার বলি না হয়, তাদের রাজনৈতিক অধিকার খর্বিত না হয়, তারা স্বৈরতান্ত্রিক শাসন শােষণে পতিত না হয়, সেই ব্যবস্থাই নিয়েছিলেন বাকশাল কর্মসূচীর মধ্যে। সূতরাং বাকশাল ব্যবস্থার মধ্যে কোনাে ব্যক্তি-গােষ্ঠী বিশেষের শাসন ও ভাগ্যোন্নয়নের কোনােই অবকাশ নেই। এখানে একক ব্যক্তি-গােষ্ঠী বিশেষের একচেটিয়া নেতৃত্ব ও প্রভাব প্রতিষ্ঠারও সুযােগ নেই। বাকশাল বিভিন্ন পেশাভিত্তিক জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল যৌথ-নেতৃত্বের রাজনৈতিক প্লাটফরম। এই প্লাটফরম থেকে আগত সরকারও হবে পেশাভিত্তিক জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল সরকার, গণতান্ত্রিক সরকার, যার লক্ষ্য একটি শোষণহীন দুর্নীতিমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠাকরণ।  জাতীয় ঐক্যই বাকশালের প্রধানতম হাতিয়ার। জাতীয় ঐক্যের বলে বলিয়ান হয়ে আমরা যেমন আমাদের জাতীয় স্বাধীনতাকে ছিনিয়ে এনেছিলাম, ঠিক  একইভাবে স্বাধীনতাকে জাতীয় অর্থনৈতিক মুক্তির মাধ্যমে সংহত ও অর্থবহ করে তােলার বিপ্লবে ঐ জাতীয় ঐক্য অপরিহার্য। আর জাতীয় আর্থসামাজিক মুক্তি ও সমৃদ্ধি কেবলমাত্র সাম্যবাদের মধ্য দিয়েই অর্জিত হতে পারে; অন্য কোনাে পথে নয়।

সাম্যবাদী সমাজে প্রত্যেক কর্মক্ষম মানুষ তার সামর্থানুযায়ী বা যােগ্যতানুযায়ী কাজ করবে এবং প্রত্যেকে তার প্রয়ােজনানুযায়ী প্রাপ্য পাবে।  সাম্যবাদী সমাজে মুনাফা সৃষ্টির কোনাে অবকাশ নেই। মুনাফা’ হলাে ব্যক্তিমালিকানাধীন ক্ষেত্রের যাবতীয় ব্যয় মিটিয়ে যে লভ্যাংশ বেরিয়ে আসে সেটাই মুনাফা এবং স্বত্ত্বাধিকারী হলাে ব্যক্তিবিশেষ বা মালিক বা মুনাফা অর্জনকারী ক্ষেত্রের মালিক। কিন্তু সমষ্টিগত মালিকানাধীন ক্ষেত্রের যা কিছু মুনাফা ফসল লাভ, তার মালিক উৎপাদন কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণকারী সমষ্টিগত জনগােষ্ঠী। অর্থাৎ সমষ্টিগত মানুষের ভাগ্যোন্নয়ন মৌলিক মানবাধিকার একমাত্র সাম্যবাদী সমাজ ব্যবস্থায় সম্ভব, অন্য কোনাে পথে নয়। আমাদের স্মরণ রাখতে হবে যে, সাম্যবাদের জাতশত্রু আন্তর্জাতিক পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তির দেশীয় সেবাদাস, এজেন্ট, একচেটিয়া পুঁজিপতি-শিল্পপতি, উঠতি ধনিক শােষকগােষ্ঠী ও তাদের সহায়তাকারী রাজনীতিক-আমলা-জেনারেল ও অন্যান্য কায়েমী স্বার্থবাদীচক্র সমাজের ক্ষমতার মূল কেন্দ্রে। রাষ্ট্রীয় আইন কানুন প্রশাসন, সামরিক শক্তি ধর্ম ও সম্পদ তাদের নিয়ন্ত্রণে যাবতীয় প্রচার মাধ্যমও তাদের নিয়ন্ত্রণে। যে কোনাে কৌশল অবলম্বন করে তারা জনচেতনা জাগরর্ণ, সামাজিক বিপ্লব তথা সাম্যবাদকে প্রতিহত করতে বদ্ধপরিকর। সুতরাং এরাই হলাে সাম্যবাদের বিরুদ্ধশক্তি। এই বিরুদ্ধশক্তি বা শােষক প্রতিক্রিয়াশীল শাসক শক্তিকে প্রতিরােধ ও প্রতিহত করার একমাত্র কার্যকরি হাতিয়ার হচ্ছে বৃহত্তর সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমজীবি মেহনতী শােষিত মানবগােষ্ঠীর ইস্পাতকঠিন ঐক্য। আর এই জাতীয় ঐক্য কেবলমাত্র তাদের সমষ্টিগত কল্যাণভিত্তিক একটি বিপ্লবী রাজনৈতিক প্লাটফরম বা সংগঠনের মাধ্যমে সংহত ও নিশ্চিত হতে পারে। বাকশাল হলাে এই জাতীয় ঐক্য বিনির্মাণের সেই কার্যকরি রাজনৈতিক প্লাটফরম। এ ব্যতীত সমষ্টিগত মানুষের প্রকৃত গণতান্ত্রিক অধিকার শাসন ও আর্থসামজিক কল্যাণও নির্ভর করে ঐক্যভিত্তিক কর্মপ্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে। যেমন, আমাদের বাঙ্গালী সমাজের অবলুপ্তপ্রায় একান্নবর্তী বা যৌথপরিবার ব্যবস্থা আদিম সাম্যবাদী সমাজের চিন্তাচেতনা ও ধ্যানধারণার ভিত্তিতে গড়ে উঠেছিলাে। এর মূলে। ছিলাে পারিবারিক ঐক্য ও সহমর্মিতাবােধ।

সেই সামাজিক ব্যবস্থার নানান বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে আজকে আমরা যে সমাজ ব্যবস্থায় বসবাস করছি সেই সমাজব্যবস্থার মধ্যে এখনাে সাবেক একান্নবর্তী বা যৌথ পরিবার ব্যবস্থার রেশ ক্ষুদ্রায়তনে বিরাজ করছে; জাতিগত, সাম্প্রদায়িক, গােষ্ঠী বা শ্রেণীগতভাবে আমরা কেবল যার যার স্বার্থে বিভক্ত হয়ে পড়েছি মাত্র। তাই বৃহত্তর বাঙ্গালী জাতিকে একটি পারিবারিক ঐক্য সম্প্রীতির দর্শন-কাঠোমায় নিয়ে আসতে হলে সংকীর্ণ ব্যক্তি স্বার্থকে সর্বাগ্রে বিসর্জন দিতে হবে। যেমন আমরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলােতে সংকীর্ণ ব্যক্তিস্বার্থকে বিসর্জন দিতে পেরেছিলাম জাতীয় স্বার্থের প্রয়ােজনে। আমরা বাঙ্গালী এমন একটি জাতি, যে জাতির মানুষগুলাে পরস্পরের সাথে যে কোনােভাবেই হােক আত্মীয়তা ও সহমর্মিতায় আবদ্ধ। যার ফলে মােটামুটি আমাদের চিন্তাচেতনা, ধ্যানধারণা, আশা-আকাংখা-আমাদের ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতি শিল্পকলা কৃষ্টি ও মানষ্প্রবৃত্তি একটি অভিন্ন ধারায় আবহমানকাল ধরে চলে আসছে। বাঙ্গালী এমনি একটি আবেগপ্রবণ ও বৃহৎ মনের অধিকারী জাতি, যার ফলশ্রুতিতে আমাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতি সহমর্মিতা সৌহার্দ্য ভ্রাতৃত্ববােধ ও ঐক্য গড়ে উঠতে সময় লাগে না। যদিও এই বাংলাদেশে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী সম্প্রদায়, ধনী দরিদ্র তথা শ্রেণী বিদ্যমান; শােষক শোষিত সমাজের বুকে বসবাস করছে, তবুও বাঙ্গালী বৃহত্তর জাতিগত স্বার্থে হৃদয় দিয়ে তাড়িত হয় সহজে। তাদের মধ্যে ঐক্য গড়ে ওঠে, ভুলে যায় ধর্ম ও শ্রেণীর ভেদাভেদ। আমাদের মুক্তিযুদ্ধও পূর্বাপর আন্দোলন-সংগ্রামই এ কথার প্রমাণ বহন করে। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের শাসনের বিরুদ্ধে হাজী শরিয়তউল্লাহ, দুদুমিয়া, তিতুমীর, ফকির মজনুশাহ প্রমুখ বিপ্লবীদের নেতৃত্বে কৃষক সাধারণের ঐক্যবদ্ধ সগ্রামের কাহিনী শুনেছি। ভারতের সিপাহী বিদ্রোহের মধ্যে মূলতঃ স্বাধীনতা সংগ্রামের ইস্পাত কঠিন ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসও আমরা দেখেছি। এ ব্যতীত সুভাষ চন্দ্র বসু, চিত্তরঞ্জন দাস, শরৎচন্দ্র বসু, শহীদ সােহরাওয়ার্দী, আবুল কাশেম ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বাঙ্গালী জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হতে আমরা দেখেছি। ঐক্যবদ্ধ জাতির সংগ্রাম কোনােকালে কোনাে যুগে ব্যর্থ হয়নি। ভবিষ্যতেও হবে না। 

জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্যে চাই সঠিক গতিশীল নিবেদিতপ্রাণ নেতৃত্ব। আর নেতৃত্বের অভাবেও জাতীয় ঐক্য গড়ে উঠতে পারে না। মহামতি লেনিন, মাওসেতুং, হােচিমিন, যোশেফ ব্রোজ টিটো, কিম ইল সু, ফিডেল ক্যাস্ট্রোসহ অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশের নেতৃত্বের সঠিকতা-দূরদর্শিতার ফলে সামন্তবাদ সাম্রাজ্যবাদ উপনিবেশবাদ নয়া-উপনিবেশবাদ পুঁজিবাদের স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ও বল্গাহীন শােষণ থেকে ঐ সব দেশের জনগণ মুক্তিলাভ করেছে। এবং জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব সফল হয়েছে। তেমনি এর জ্বলন্ত প্রমাণ রয়েছে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে। বঙ্গবন্ধুর গতিশীল যায় । যৌথ পরিবার ব্যবস্থার সূত্রপাতের ইতিহাস পর্যালােচনা করতে গিয়ে আমাদের মনে হয় যে, প্রামবাংলার প্রাচীন স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম সমবায় ব্যবস্থার যুগের মতােই ছিলাে যৌথ পরিবার ব্যবস্থার অবস্থান। অথবা বলা যেতে পারে, প্রাচীন স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম সমবায় ব্যবস্থার ধ্বংসস্তুপের মধ্য দিয়েই যৌথ পরিবার’ ব্যবস্থার সূত্রপাত ঘটেছে। তবে বাংলার ঐ ঐতিহ্যবাহী স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামসমবায় ব্যবস্থা স্মরণাতীতকাল থেকে শুরু করে একেবারে হাল আমলের ইংরেজ শাসনের পূর্ব পর্যন্ত ক্ষীণ হয়ে টিকে ছিলাে।

উনবিংশ শতাব্দির গােড়ার দিকে প্রখ্যাত বৃটিশ ঐতিহাসিক রাজপুরুষ চার্লস্ মেটকাফ উপমহাদেশের গ্রামাঞ্চল সম্পর্কে লিখেছিলেনঃ “গ্রাম সম্প্রদায়গুলাে হচ্ছে ছােটো ছােটো প্রজাতন্ত্র । তাদের যা কিছু প্রয়ােজন সবকিছুই তাদের আছে, গ্রামের বাইরে কোনাে সম্পর্ক নেই বললেই চলে। পৃথিবীতে সবকিছুই যেখানে নশ্বর, সেখানে এগুলাে যেনাে চিরস্থায়ী। একের পর এক রাজবংশ ও শাসন ব্যবস্থার পতন হয়েছে। বিপ্লবের পর বিপ্লব সংঘটিত হয়, হিন্দু পাঠান মােগল মারাঠা শিখ ইংরেজরা ক্রমান্বয়ে একের পর এক রাজক্ষমতা দখল করে—তবুও গ্রামসম্প্রদায়গুলাে অপরিবর্তিত থেকে যায়। যদি কখনাে তারা লুটতরাজ ও ধ্বংসকার্যের শিকার হয়ে পড়ে, আক্রমণকারী শক্তি যদি অপ্রতিরােধ্য হয়ে উঠে। তাহলে তারা নিকটবর্তী কোনাে বন্ধুগ্রামে পালিয়ে যায় । ঝড় বয়ে যাওয়ার পর আবার তারা ফিরে এসে নিজেদের কাজকর্ম শুরু করে। যদিও লুটতরাজ ও হত্যাকান্ড কয়েক বছর জুড়ে চলে তবুও শান্তি স্থাপনের পর গ্রামবাসী ফিরে আসে এ থেকে আমরা বুঝতে পারি, ঐ স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামসমবায় ব্যবস্থা হয় একটি বৃহৎ বংশসমন্বয়ে বা একাধিক বংশ বা গােত্রসমন্বয়ে একক পরিবার ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিলাে। অর্থাৎ আদিম সাম্যবাদী কৌম সমাজকেই এ ক্ষেত্রে আমাদের মনে পড়ে। অতীত যৌথপরিবার সমাজের পরিবারের সকল কর্মক্ষম নারী পুরুষ একটি অভিন্ন মঙ্গলাদর্শে উজ্জীবিত হয়ে যে যেভাবে পারতাে উৎপাদন ও অন্যান্য ক্ষেত্রে যার যার যােগ্যতানুযায়ী শ্রম প্রদান করতাে এবং তাদের উৎপাদিত ফসল পরিবারের যৌথ তহবিলে জমা হতাে। পরিবার সর্দার বা প্রধানকর্তা প্রত্যেকটি সদস্য সদস্যার প্রয়ােজনের দিকে লক্ষ্য রেখে সকলে মৌলিক চাহিদা পূরণ করতাে। কর্ম অক্ষমদের কোনােমতেই অবহেলা ও বঞ্চিত করা হতাে না। আত্মীয়তা ও সহমর্মিতার কারণে তাদেরকেও অন্যান্য সকলের মতাে সম-অধিকার প্রদান করা হতাে।

পরিবার প্রধান ও অন্যান্য শাখাপ্রধানরা পরিবারের সচেতন সকলে সর্বসম্মত রায়ে মনােনীত হতাে। পরিবারের কোনাে সদস্যের ব্যক্তি মালিকানাধীন সম্পদ থাকতাে না। সবকিছুই ছিলাে যৌথ মালিকানায়। অর্থাৎ পরিবার ব্যবস্থা গণতান্ত্রিকবােধ ও আর্থবৈষয়িক সাম্যতার ভিত্তিতে গড়ে উঠেছিলাে। এটাই বাংলার নিকটাতীতের সমৃদ্ধশালী সাম্যবাদী ব্যবস্থার নিদর্শন। হাজী শরিয়তউল্লাহ, পীর দুদুমিয়া, ফকির মজনুশাহ, তিতুমীর প্রমুখ বিপ্লবী পুরুষদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ছিলাে আরাে গতিশীল ও বৈপ্লবিক। অর্থাৎ ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে বৃহত্তর সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। সুতরাং বাংলার ইতিহাসের মধ্যে প্রচ্ছন্নভাবে ভাস্বর হয়ে আছে সাম্যবাদের নিদর্শন। এ ব্যতীত আমাদের প্রতিটি বাঙ্গালী সংসার-পরিবারে — একক বা যৌথ উপার্জনশীল সংসারে সাম্যবাদী। আর্থব্যবস্থার কর্মকান্ড সুষ্ঠুভাবে পালিত হচ্ছে।  বঙ্গবন্ধু বাংলার ঐতিহ্যবাহী যৌথ পরিবার, বাংলার সাম্যবাদী বিপ্লবীদের কার্যক্রম, ইসলাম ও মার্কসবাদ এবং নিজের বাস্তব অভিজ্ঞতা ও চিন্তাচেতনার আলােকে বাকশাল ব্যবস্থার মাধ্যমে বাংলাদেশে একটি জাতীয় সাম্যবাদী গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার বৈপ্লবিক কর্মসূচী প্রদান করেছেন; এ কথাটাই আমাদের সর্বাগ্রে স্মরণ রাখতে হবে। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধুর একটি উক্তি উল্লেখ করতে হয়। ১৯৭৩ সালে সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে একটি ছাত্রযুবক সমাবেশে ভাষণদানকালে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন- “আমি চাই ন্যায় বিচার-ইনসাফ। আমি চাই শোষণহীন সমাজতান্ত্রিক সমাজ। চাই উমরি শাসন ও সমাজ ব্যবস্থা।’ হযরত উমরকে টেনে এনে প্রকারান্তরে তিনি ইসলামের খেলাফতে রাশেদীনের কথাই বলতে চেয়েছেন। কারণ ইসলামের প্রকৃত গণতান্ত্রিক সাম্যবাদী ব্যবস্থা হযরত উমরের শাসনামলেই পূর্ণভাবে বাস্তবায়িত হয়েছিলাে। তিনিই সর্ব প্রথম শােষণের প্রধানতম হাতিয়ার ভূমি ব্যবস্থাকে তথা উৎপাদন ব্যবস্থাকে জাতীয়করণ করে জনগণের মালিকানায় পর্যবশিত করেছিলেন। তিনিই সর্বপ্রথম বায়তুলমাল প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। খেলাফত শাসিত অঞ্চলের প্রতিটি মানুষ (মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে) রেশনিং প্রথায় বায়তুলমাল থেকে খাদ্য বস্ত্র ও অন্যান্য দ্রব্যসামগ্রী পেতাে স্বয়ং খলিফাও একইভাবে সব কিছু গ্রহণ করতেন। খলিফা বা খলিফার মনােনীত প্রতিনিধিরা তাদের দায়িত্ব পালনের জন্যে কোনাে বেতন-ভাতাদি পেতেন। খেলাফতের কোনাে কর্মশালা মহাসদন বা সচিবালয় ও আমলা বাহিনী ছিলাে । ছিলাে না স্থায়ী বেতনভুক কোনাে সৈন্য বাহিনী। আপাতকালীন বা জরুরী ভিত্তিতে বা আভ্যন্তরীণ বহিঃশত্রুর আক্রমণের প্রেক্ষিতে তাৎক্ষণিকভাবে। স্বেচ্ছাসেবী আনসার বা জনগণের সমন্বয়ে স্বেচ্চাভিত্তিক সৈন্যবাহিনী গড়ে উঠতাে।

শান্তি শৃংখলা স্থাপনের পর আপনা-আপনি তা বিলুপ্ত হয়ে যেতাে। খলিফা ও প্রতিনিধিরা সকলের সর্বসম্মতিক্রমে বা চােটে নির্বাচিত হতেন। সমাজে প্রভু দাস  বলতে কিছুই ছিলাে না। ক্রীতদাস বেলালকে মুক্ত করে এনে মহানবী তাকে প্রথম মােয়াজ্জিন পদে নিয়ােগ করেছিলেন। মানুষের মধ্যে কোনাে শ্রেণী ছিলাে না। খলিফা উমরের জেরুজালেমের পথে তাঁর উঠের চালকের সাথে পালাক্রমে উঠের পিঠে সওয়ার হওয়ার কাহিনীও আমরা জানি। এ ব্যতীত দুঃস্থ রুগ্ন দরিদ্র-অনাহারী পরিবারে খলিফা উমর স্বয়ং নিজে কাঁধে করে খাদ্যসামগ্রী পৌছে দিতেন। নিজপুত্রের অপরাধের কঠিন শাস্তি তিনি নিজ হাতে দিয়েছিলেন, কোনাে দ্বিধা সংকোচ করেননি। দুর্ভিক্ষের সময় তার পরিবারের সদস্যরা বায়তুলমাল থেকে অতিরিক্ত দ্রব্যসামগ্রী নিয়ে আসার জন্যে অনুরােধ করলে উমর তা প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন বায়তুলমাল জনগণের, আমার নয়; অতিরিক্ত গ্রহণ করা আমার অন্যায়। এ ব্যতীত হযরত উমর প্রায়শঃই বলতেন সুদূর ফোরাতের কূলে একটি কুকুরও যদি না খেতে পেরে মারা যায় তার জন্যে আমাকে আল্লাহর নিকট জবাবদিহি হতে হবে। এ ব্যতীত দুর্ভিক্ষ ও দুর্যোগের কালে জনগণের জীবন বাঁচানাের জন্যে হযরত উমর সমস্ত শরিয়াতি আইন-কানুন স্থগিত রেখেছিলেন। চুরি বা চৌর্যবৃত্তির অপরাধে হস্তকর্তনের বিধান তিনি বাতিলও করে দিয়েছিলেন। এভাবেই সাম্যবাদী ব্যবস্থার বাস্তবায়ন আমরা দেখতে পাই খেলাফতে। রাশেদীনের মধ্যে। উপরােক্ত ঐতিহাসিক ঘটনাবলী থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে বঙ্গবন্ধু ইসলামের একদলীয় খেলাফত ব্যবস্থার মতাে বাঙ্গালী জাতির একক জাতীয় দল বাকশালের রাজনৈতিক প্রশাসনিক ও আর্থসামাজিক কর্মসূচী প্রদান করেছেন। পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে, প্রচলিত বহুদলীয় রাজনীতির গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা মূলতঃ মুষ্টিমেয় ধনিক শােষক সুবিধাবাদী তথা কায়েমী স্বার্থান্বেষী চক্রের শাসন শশাষণকার্য বাধ্যবাধকতাহীন বা ফ্রিস্টাইলভাবে চালিয়ে যাওয়ার কার্যকরি হাতিয়ার। এ জাতীয় বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা আধুনিক ধনতান্ত্রিক-পুঁজিবাদী সমাজ রাষ্ট্রসমূহে একটি আদর্শ রাজনৈতিক ব্যবস্থা হিশেবে গণ্য করা হয়ে থাকে। ইংরেজ শাসক-শােষকগােষ্ঠী ওয়েস্টমিনিষ্টার ধাচের যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রচলন করেছিলেন, তার মধ্যে মূল লক্ষ্য ছিলাে শােষণ ও বহুদলীয় রাজনৈতিক কর্মকান্ডের ফলে যাতে বৃহত্তর সংখ্যাগরিষ্ঠ অজ্ঞ দুর্বল শােষিত মেহনতী শ্রমজীবি মানুষের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হতে না পারে। কারণ শ্রমজীবি শােষিতের ঐক্যের মধ্যেই শােষক সমাজের মৃত্যুবাণ নিহিত ।

বৃটিশ বাণিজ্যিক পুঁজিপতি ও শিল্পপতিগােষ্ঠী শাসিত সাম্রাজ্যবাদের এই বহুদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা তাদের আশ্রিত উপনিবেশগুলাের উঠতি শােষক ধনিক গােষ্ঠীকেও আকৃষ্ট করে। ফলে এই সমস্ত অঞ্চলে বা দেশে ব্যঙ্গের ছাতার মতাে বহুদলীয় রাজনৈতিক সংগঠনগুলাে গড়ে ওঠে সাম্রাজ্যবাদের পৃষ্ঠপােষকতাও মদতের যুপকাষ্ঠে। কারণ এ সমস্ত অঞ্চল বাংলাদেশের দেশের মেহনতী শোষিত মানবগােষ্ঠী ধীরে ধীরে তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠেছিলাে। তাদের জাগ্রত চেতনা যাতে ভবিষ্যতে বৃহত্তর ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন বা বিপ্লবের ক্ষেত্র সৃষ্টি করতে না পারে তার জন্যে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি তাদের অনুচর ও সেবাদাসদের দিয়ে বহুদলীয় রাজনৈতিক কর্মকান্ড চালিয়ে শােষিত মেহনতী মানবগােষ্ঠীকে বিভক্ত করে রাখার পন্থা অবলম্বন করে। এবং এই সব রাজনৈতিক দলসমূহকে মােটা অংকের চাঁদা দিয়ে থাকে। এর মূলে সাম্রাজ্যবাদ আরেকটি লক্ষ্য হাসিলের ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে, সেটি হলাে কমিউনিজম বা সমাজতন্ত্রকে প্রতিরােধকরণ। আধুনিক সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহ কীভাবে কমিউনিজমকে প্রতিরােধ করার জন্যে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে থাকে তার সুন্দর বিবরণ রয়েছে প্রখ্যাত রেড চায়না’ গ্রন্থে। বর্ণিত আছে যে, সাম্রাজ্যবাদী শক্তি কমিউনিজমকে প্রতিহত করার লক্ষ্যে নানাভাবে যে বিপুল অর্থ অপব্যয় করে থাকে, সেই অর্থের একটি অংশও যদি উন্নয়নশীল দরিদ্র রাষ্ট্রসমূহের উন্নয়নের কাজে ব্যয় করা হতাে তাহলে কমিউনিজমের নামগন্ধ থাকতাে না। কিন্তু তারা এ পথ অবলম্বন না করে যে ভাবে প্রতিনিয়ত কমিউনিজমের জুজুর ভয় প্রচার করছে এবং তা প্রতিহত করার জন্যে নানান সন্ত্রাসবাদী ও অন্তর্ঘাতমূলক এবং নির্যাতনমূলক কর্মকান্ড দেশে দেশে চালিয়ে যাচ্ছে, নানান অপকর্মে ঢালাওভাবে অর্থ অপব্যয় করছে; মেহনতী মানবগােষ্ঠীকে শশাষণ করছে, তাতে করে দেশে দেশে কমিউনিজম বিপ্লবই ত্বরান্বিত হচ্ছে।

যতাে বাকরুদ্ধভাবে তারা কমিউনিজমের ওপর আঘাত হানছে। ততােটুকু গতিতে কমিউনিজম এগিয়ে আসছে। এ প্রসঙ্গে বিজ্ঞানের একটি থিয়ােরী প্রণিধানযােগ্য যথাঃ ‘Every action has got its own equal and opposite reaction’. মেহনতী শোষিত মানুষের মধ্যে যেমন কোনাে শ্রেণী নেই, দ্রুপ শােষক সমাজে শোষকের মধ্যেও তেমনি কোনাে শ্রেণী নেই। দেশকাল-অঞ্চলভেদে শােষিত মানুষের মধ্যে যেমন কোনাে পার্থক্য নেই তেমনি সাম্রাজ্যবাদী পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের শাসক-শােষক বা উপনিবেশিক ধনতান্ত্রিক দেশের শাসক-শােষকের মধ্যেও কোনাে পার্থক্য নেই; একে অপরের স্বার্থের খুঁটি হিশেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। বর্তমান উন্নত ও উন্নয়নশীল যে সকল রাষ্ট্রে বহুদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থার তথাকথিত গনতন্ত্র প্রচলিত আছে তা শােষক ধনিক সমাজের স্বার্থকেই মূলতঃ রক্ষা করে চলেছে। ফলে এ সকল রাষ্ট্রের মেহনতী শােষিত মানবগােষ্ঠী বহুদলীয় রাজনীতির টানাপােড়েনের গােলক ধাধায় নিপতিত হয়ে নানান দলের নেতৃত্বে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। বর্তমান ধনতান্ত্রিক পুঁজিবাদী বিশ্বে নানান ধরনের তথাকথিত গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রচলিত আছে। যেমনঃ রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসন, সংসদীয় শাসন, রাজতান্ত্রিক ও সামরিক শাসন। এ সকল শাসন ব্যবস্থার মাধ্যমে মূলতঃ  সংহত হচ্ছে ধনিক-কায়েমী স্বার্থন্বেষী শ্রেণীর একচেটিয়া শাসন-শােষণ ও প্রভাকপ্রতিপত্তি তবে এ সব দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে শ্রমজীবি মেহনতী শােষিত মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে প্রগতিশীল বামপন্থী বা সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলও পাশাপাশি গড়ে উঠেছে। কিন্তু তাদের মধ্যেও রয়েছে নানা মত-পার্থক্য বা তাত্ত্বিক কোন্দল। ফলে একই সময়ে সমাজতন্ত্রের নামে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের আবির্ভাব ঘটে থাকে। এই অবস্থার প্রেক্ষিতে শােষিত মেহনতী মানবগােষ্ঠী নানান বিভ্রান্তিতে ভােগে। মুক্তির লক্ষ্য সকলের এক হলেও বহুদলীয় রাজনীতির খপ্পরে পড়ে তারা মুক্তির পথ হারিয়ে ফেলে; তারা বিভক্ত হয়ে পড়ে ফলে শােষিত মেহনতী মানুষের একক রাজনৈতিক দল গড়ে উঠতে পারে না, পারে না তারা রাষ্ট্রীয় শাসন ক্ষমতায় আরােহন করতে।

অপরদিকে সমাজতান্ত্রিক বা বামপন্থী পার্টিসমূহের নেতৃত্ব নিয়েও প্রশ্ন দেখা দেয়। অনেক ক্ষেত্রে এ সব পার্টির নেতৃত্ব সমাজতন্ত্রের নামে জান কোরবান করার বুলি আউড়ে থাকলেও এদের চলাফেরা, আচার, ব্যবহার, আচরণ, শানশওকাত ও কার্যকলাপ দেখে সন্দেহ করার অনেক কারণ রয়েছে যে, এরা মূলতঃ সমাজতন্ত্রী কিনা। সাম্রাজ্যবাদ ও ধনতান্ত্রিক শােষকগােষ্ঠীর এজেন্ট কিনা। কারণ শােষকরা। তাদের স্বার্থে সমাজতন্ত্রের নাম ভাঙ্গিয়ে অনেক ক্ষেত্রে তাদের সেবাদাস রাজনৈতিক টাউট নেতাদের দিয়ে রাজনৈতিক দল সৃষ্টি করে থাকে এবং এসব দলনেতারা সমাজতন্ত্রের ভুল ব্যাখ্যা প্রদান করে নানান হঠকারী ও অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপ চালিয়ে সমাজতন্ত্রকে সন্ত্রাসবাদ হিশেবে চিহ্নিত করে সাধারণ শােষিত মেহনতী মানুষকে সমাজতন্ত্র সম্পর্কে নিরুৎসাহিত করে থাকে।  বাংলাদেশে স্বাধীনতা-উত্তরকালে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), সিরাজ শিকদারের সর্বহারা পার্টি, আবদুল হক, তােয়াহা, নগেন, মতিন, আলাউদ্দিন, টিপু, কাজী জাফর প্রমুখ নেতৃবৃন্দ সাম্যবাদী রাজনীতির নামে যে সব সন্ত্রাসবাদী। অন্তর্ঘাতমূলক গণবিরােধী ও হত্যার রাজনীতি চালিয়ে এসেছেন তাতে করে সাম্যবাদ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা আরাে ঘােলাটে হয়ে পড়েছে। সুতরাং তাদের কার্যকলাপেই তারা প্রমাণ করেছেন যে তারা সত্যিকারের সাম্যবাদী নন। তাই এ সব নেতৃবৃন্দের সম্পর্কে যদি বলা হয় যে, তারা সাম্রাজ্যবাদ ও দেশীয় পুঁজিবাদের পেইড এজেন্ট তথা পেন্টাগনপন্থী কমিউনিষ্ট’ তাহলে বােধকরি সত্যের অপলাপ করা হবে না। সুতরাং এ জাতীয় সমাজতন্ত্রীদের রাজনীতির হােলিখেলা দেখে নিরূপন করা সত্যিই দূরুহ যে কারা প্রকৃত সমাজতন্ত্রী এবং সমাজতন্ত্র মূলতঃ কী! প্রচলিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ট দরিদ্র মেহনতী শােষিত মানবগােষ্ঠী কেবলমাত্র প্রতিনিধি বা শাসক নির্বাচনের একটা ভােটাধিকার প্রয়ােগের সুযােগ পেয়ে থাকে মাত্র । বহুদলীয় নির্বাচনের প্রতিযােগিতায় মূলতঃ বিপুল অর্থই প্রার্থীর জয়লাভকে নির্ধারণ করে থাকে। সে ক্ষেত্রে বিত্তহীন সাধারণ দরিদ্র জনসাধারণ বা তাদের প্রতিনিধি অর্থের প্রতিযােগিতায় অবতীর্ণ হতে একেবারেই অক্ষম।

অপরদিকে যাবতীয় জাতীয় নির্বাচন হয়ে থাকে বিভিন্ন দলভিত্তিক প্রতিযােগিতার মাধ্যম। দরিদ্র জনসাধারণের পক্ষে কোনাে দলের মনােনয়নই পাওয়া ভার, কারণ অনেক ক্ষেত্রে প্রার্থীকে তার দলের তহবিলে ও নেতাকে বিপুল পরিমাণ চাদা বা ঘুষও দিতে হয়, নইলে দলের মনােনয়ন পাওয়া দুষ্কর। তাই দরিদ্র লােকের পক্ষে নির্বাচনীয় প্রতিযােগিতায় অবতীর্ণ হওয়া একেবারেই অসম্ভব। তারা শুধু পারে ভােট দিতে, বিক্রয় করতে যা অনিবার্যভাবে চলে যায় বিত্তশালী প্রভাবশালী প্রার্থীর পক্ষে। অনেক সময় তারা তাদের ভােট দিতেও পারে না; ভােটকেন্দ্রে যাওয়ার আগেই দেখা যায় যে তাদের ভােট দেয়া হয়ে গেছে। আবার অধিকাংশ দিনমজুর বা ভােটারদের একটা বিরাট অংশ নির্বাচনে ভােট দিতে কেন্দ্রেও উপস্থিত হয় না, তাদেরকে পেটের ধান্দায়ই ব্যস্ত থাকতে হয়; কিন্তু দেখা যায় যে অনুপস্থিত ভােটারদের ভােটও প্রভাবশালী প্রার্থীর পক্ষে দেয়া হয়ে গেছে। এ ব্যতীত অন্যান্য জালিয়াতি ও কারচুপি তাে হয়ে থাকেই। সুতরাং বিভিন্ন রাজনৈতিক বা নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ বা সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরা নির্বাচনে জয়লাভ করলে দেখা যাবে যারা নির্বাচিত হয়ে আইন ও প্রশাসনিক ক্ষমতার কেন্দ্রে অধিষ্ঠিত হলেন তারা প্রায় সকলেই ধনিকশ্রেণী থেকে আগত। তাই স্বাভাবিকভাবেই রাষ্ট্রীয় আইন কানুন প্রশাসন, বিচার ব্যবস্থা এবং অন্যান্য সবকিছু তাদেরই স্বার্থে গড়ে ওঠে এবং ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এটাই হলাে পুঁজিবাদী বা বহুদলীয় গণতন্ত্রের অনিবার্য ফলশ্রুতি। ফলে এখানে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন প্রতিষ্ঠা ও আর্থসামাজিক নিরাপত্তার কোনােই নিশ্চয়তা নেই। এখানে শাসন ক্ষমতা যেমন মুষ্টিমেয় লােকের হাতে তেমনি আর্থ-বৈষয়িকসামাজিক- সাংস্কৃতিক-শিক্ষানীতি ও এর গতিপ্রকৃতি নির্ধারিত হয়ে থাকে তাদেরই হাতে । সুতরাং প্রচলিত তথাকথিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বদৌলতে ধনিকগােষ্ঠী আরাে ধনী হচ্ছে, শােষিত দরিদ্র জনসাধারণ আরাে শােষিত-নিঃস্ব হচ্ছে; সর্বহারায় পরিণত হচ্ছে। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক বা সাম্যবাদী ব্যবস্থায় মুষ্টিমেয় মানুষের শাসন শোষণ ও প্রতিপত্তির অবকাশ নেই। কারণ ব্যাপক সাধারণ জনগণের শাসন ও তাদের বৃহত্তর কল্যাণ নিশ্চিতকরণই সমাজতন্ত্রের মূল লক্ষ্য—এ সমাজে শােষকগােষ্ঠীকে, কায়েমী স্বার্থবাদী সুবিধাভােগীদের রাজনৈতিকভাবে উচ্ছেদ সাধন করা হয়ে থাকে।

বঙ্গবন্ধু তাই বহুদলীয় প্রতারণামূলক রাজনীতি বা মুষ্টিমেয় শোষক ধনিক শ্রেণীর গণতন্ত্রের জট ভেঙ্গে দিয়ে বৃহত্তর সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মেহনতী দরিদ্র শােষিত মানবগােষ্ঠীকে শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করার রাজনৈতিক-গণতান্ত্রিক পদ্ধতি ও তাদের আর্থবৈষয়িক সার্বিক কল্যাণ-তথা শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সাম্যবাদী কর্মসূচী প্রদান করেছিলেন বাকশাল ব্যবস্থার উদ্ভাবন ঘটিয়ে। বাকশাল ব্যবস্থায় জনগণের ভােটাধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। এবং যাতে প্রতিটি নির্বাচনে সমস্ত ভােটাররা ভােটপ্রদান এবং তাদের পেশাভিত্তিক প্রতিনিধিরা নির্বাচনে প্রার্থী হিশেবে প্রতিযােগিতা করতে পারে তার ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। বিভিন্ন পেশাভিত্তিক জনপ্রতিনিধিরা যাতে শাসন ক্ষমতায় ও অন্যান্য পরিচালনা পরিষদে যেতে পারে তার জন্যে স্থানীয় গ্রাম সমবায়, থানা পরিষদ ও অন্যান্য জাতীয় নির্বাচনে প্রতিটি ক্ষেত্রে জাতীয় দল বাকশাল একই আসনে একাধিক প্রার্থীকে মনােয়ন দেবে। ফলশ্রুতিতে নির্বাচন প্রতিযােগিতায় অধিকতর যােগ্য প্রার্থীরা অংশগ্রহণের সুযােগ পাবে। সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিটি প্রার্থীর নির্বাচনী ব্যয় যথা প্রার্থীর প্রচার-পরিচিতি ইত্যাদি ক্ষেত্রের ব্যয় বহন করবে। কোনাে প্রার্থীই প্রকাশ্যে বা গােপনে অর্থ দিয়ে ভােটারদের প্রভাবিত করলে সেই প্রার্থীর প্রার্থীপদ বাতিল করে দেয়া হবে। তাই অর্থ দিয়ে যাতে ভােটারদের প্রভাবিত করা না হয় তার জন্যে পূর্বাহ্নেই প্রত্যেক প্রার্থীকে তার অর্থের তহবিলের হিশেব দাখিল করতে হবে। জাতীয় দল ও সরকার এ বিষয়ে কার্যকরি পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।  এ পদ্ধতিতে কোনাে প্রার্থী টাকা-পয়সা ও অন্যান্য প্রভাব খাটিয়ে ভােটারদের প্রভাবিত করার সুযােগ পাবে না। তাছাড়া পেশাভিত্তিক নির্বাচনের ফলে প্রার্থীর আয়-উপার্জন ও অর্থের সূত্রের পরিমাপ করা মােটেই দুরুহ নয়। ফলে নির্বাচনে জয়লাভ কেবলমাত্র প্রার্থীর চরিত্র ও সার্বিক যােগ্যতার মাপকাঠিতে নির্ধারিত হবে। এভাবে ক্ষমতার প্রতিটি কেন্দ্রে স্বাভাবিকভাবেই জনগণের বৃহত্তর সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের প্রকৃত মােগ্য সৎ নিষ্ঠাবান প্রতিনিধিরা বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় যেতে পারবে। এবং এর ফলে বিভিন্ন পরিচালনা পরিষদে ও ক্ষমতার কেন্দ্রে তাদের নিরঙ্কুশ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়ে সবকিছু সরাসরি তাদের অনুকূলে এসে যাবে। অর্থাৎ এ প্রক্রিয়ায় গ্রামীণ শতকরা ৮০% ভাগ জনগণের প্রতিনিধিরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসে যাবে, অর্থাৎ এতােকাল যারা ছিলাে শশাষিত অবহেলিত নিগৃহীত দুর্বল, তারাই এভাবে ক্ষমতার মূল কেন্দ্রে এসে যাবে। এ ব্যতীত বিভিন্ন পরিষদে পেশাভিত্তিক প্রতিনিধি থাকার ফলে কোনাে বিশেষ পেশার প্রাধান্য বা প্রভাব কার্যকর হবে না । তবে এক্ষেত্রে কৃষক শ্রমিক পেশাজীবিদের প্রাধান্য অবশ্যই থাকবে, যেহেতু তারাই হবে সংখ্যাগরিষ্ঠ। এভাবেই প্রকৃত জনগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে, এ বিষয়ে সন্দেহের কোনােই অবকাশ নেই। এটাই হলাে বঙ্গবন্ধুর বাকশাল সৃষ্টির মূল লক্ষ্য।

সুতরাং যে সকল মহল বাকশাল ব্যবস্থাকে স্বৈরতান্ত্রিক, একদলীয়, গণতন্ত্র হত্যাকারী ও ব্যক্তিশাসন প্রতিষ্ঠার হাতিয়ার হিশেবে চিহ্নিত করেন এবং নানান কুৎসা ও অপপ্রচার চালান সেই সব মহলকে বাকশাল সৃষ্টির পটভূমিকা ইতিহাস ও পদ্ধতি-প্রক্রিয়া ভালােভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে অনুরােধ করি। প্রকৃত কথা হলাে, বিরুদ্ধ মহলও জানে যে এ ব্যবস্থা ব্যতীত বৃহত্তর জনগণের সার্বিক কল্যাণ আসতে পারে না। তবুও তারা বাকশালকে গালিগালাজ করেন, নানান অপপ্রচার চালান এই জন্যে যে, তারাই শােষক-প্রতিক্রিয়াশীল চক্র ও সাম্রাজ্যবাদ পুঁজিবাদের এজেন্ট, সেবাদাস, অনুচর। বাকশাল ব্যবস্থা বাস্তবায়িত হলে তাদের মৃত্যু অবধারিত হয়ে। যাবে, স্বেচ্ছাচারী-স্বৈরাচারী শাসন-শােষণ প্রভাব ও সুবিধাবাদী কার্যকলাপ চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে। এটাই তাদের ভয়। ফলে তারা আদাজল খেয়ে একযােগে দেশী – বিদেশী প্রভূদের ইংগীতে বাকশালের বিরুদ্ধে গােয়েবলসীয় অপপ্রচারে লিপ্ত হয়েছেন, নানান ষড়যন্ত্রের চোরাগলিতে অবস্থান নিয়েছেন।  তাছাড়া একটি ভূমিষ্টমাত্র শিশুকে অপবাদ দিয়ে কী আনন্দ পাওয়া যায় তা আমাদের বােধগম্য নয়। বাকশাল হলাে সেই ভূমিষ্ঠমাত্র শিশু। এর পূর্ণ বাস্তবায়ন হতে পারেনি ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রকারী খুনীদের অপকীর্তির ফলে। তাই একে নিয়ে নানান রঙে ঢঙে মাঠ সরগরম করার একটি মাত্রই অর্থ হয়, আর তাহলাে নিয়ন্ত্রণহীন ও স্বেচ্ছাচারমূলক ব্যক্তি ও কায়েমী স্বার্থবাদী গােষ্ঠীর স্বার্থকে বজায় রাখার ষড়যন্ত্রের মাধ্যম জনগণকে ধােকা দেয়ার অপচেষ্টা মাত্র। প্রকৃতপক্ষে বাকশালকে অপবাদ দিয়ে, গালিগালাজ করে স্বার্থান্বেষী কুচক্রীমহল একদিকে যেমন তাদের শােষক প্রতিক্রিয়াশীল শ্ৰেণীচরিত্রের বৈশিষ্ঠ্যকে উন্মােচন করছেন অপরদিকে জনগণের আশা-আকাংখাকে ধুলিস্মাৎ করার ষড়যন্ত্র করছেন। তাই যারা বাকশালকে গালি দিয়ে এর বিরােধীতা করেন তারা প্রকৃতপক্ষে জনগণেরই স্বার্থকে বিরােধীতা। করেন। অতএব বাকশাল বিরােধীরা জনগণের শত্রু। প্রচলিত বহুদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সৃষ্ঠ তথাকথিত গণতান্ত্রিক শাসন, আর্থসামাজিক, প্রশাসনিক ও বিচার ব্যবস্থাকে পর্যালােচনা করলে সহজেই বুঝা যায় যে, এর বদৌলতে বৃহত্তর সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ জীবনের সর্বক্ষেত্রে বঞ্চিত শােষিত নিগৃহীত ও প্রতারিত হচ্ছে; নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর হচ্ছে। এটাই হলাে বহুদলীয় গণতন্ত্র বা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ফলশ্রুতি। এখানে প্রতিক্ষণে দরিদ্র অসহায়ের হাহাকার ও ক্রন্দন রােল নীরবে নিভৃতে আকাশে মিলিয়ে যাচ্ছে। এখানে কারাে প্রতি কারাে দায়িত্ব কর্তব্য পালনের ফুরসৎ নেই, সকলেই নিজ নিজ ব্যক্তিস্বার্থ নিয়েই ব্যস্ত।

এ সমাজে অর্থই বড়াে, অর্থই এখানে আত্মীয়তা বন্ধুত্ব-সম্প্রীতি ইত্যাদি সম্পর্ক নির্ণয় করে থাকে। এখানে যে যতােখানি ক্ষমতা পায় তার চেয়েও বেশি সে তার স্বার্থ উদ্ধারের কাজে ব্যবহার করে থাকে। এখানে চলে সীমাহীন ব্যক্তিভাগ্যোন্নয়নের স্বেচ্ছাচার প্রতিযােগিতা। সাধারণ মানুষের ও সমাজের সার্বিক। মঙ্গল কোন পথে আসতে পারে, তা শশাষক সমাজের বিবেচ্য বিষয় নয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকান্ডের মধ্যে পড়ে জনগণ বুঝতে পারে না, কে তাদের শত্রু কে তাদের বন্ধু । এই রাজনৈতিক দাবা খেলার গােলক ধাঁধার মারপ্যাচের শিকারে পরিণত হয়ে জনসাধারণ নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে পারে না। ফলে তারা বিচ্ছিন্ন ও বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক শিবিরে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে। তাদের মধ্যে তাই বৃহত্তর ঐক্য গড়ে উঠতে পারে না, ফলশ্রুতিতে রাজনীতি যেমন কোনাে স্থিতিশীল সাংগঠনিক সত্তায় গড়ে উঠতে পারেনি তেমনি রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক পরিবেশও স্থিতিশীলভাবে গড়ে উঠতে পারেনি। আর এই অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে শশাষকগােষ্ঠী এবং তাদের নিত্যসঙ্গী তাবেদার আমলাদালাল গােষ্ঠী জনগণের ওপর স্বৈরাচারী শাসন শােষণ ও ব্রাশনের স্টিমরােলার চালিয়ে যাচ্ছে। রাজনীতির অস্থিতিশীল পরিবেশের সুযােগ গ্রহণ করে প্রশাসনের সর্বক্ষেত্রে স্থায়ীভাবে জেঁকে বসেছে শক্তিশালী আমলাতন্ত্র এবং আর্থবৈষয়িক ক্ষেত্রে মুষ্টিমেয় শশাষক সুবিধাবাদী চক্রের প্রতিযােগিতামূলক কর্মকান্ডে সৃষ্টি হয়েছে মুক্ত অর্থনীতির হােলিখেলা। ফলে রাষ্ট্রীয় আইন-কানুন, ক্ষমতা-সুযােগসুবিধা-সামরিক বাহিনী, এমন কি দেশের যাবতীয় উৎপাদন ব্যবস্থা এবং অর্থসম্পদ গুটিকতক ধনিক সুবিধাবাদী ক্ষমতালােভী সৌভাগ্যবানদের করায়ত্বে চলে যাচ্ছে। ফলে দেশের কল্যাণকামী রাজনীতিকরা হতাশ হয়ে পড়ছে আমলাতন্ত্র ও মুক্ত অর্থনীতির দৌরাত্ম দেখে। আর মাঝখানে সাধারণ মেহনতী শ্রমজীবি মানুষ নীরবদর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে, যাবতীয় অন্যায় অবিচার শাসন শােষণের শিকারে পরিণত হয়ে ধুকে ধুকে মরছে, ভাগ্যের ওপর নিজেদেরকে সঁপে দিয়ে বসে আছে। আমলাতন্ত্র ও মুক্ত অর্থনীতির পৃষ্ঠপােষক প্রবক্তা ধারক-বাহক কারা ? এর উত্তরে বলা যায়ঃ বহুদলীয় রাজনীতির প্রবক্তা, শোষকগােষ্ঠীর এজেন্ট ও রাজনীতিকরাই। কারণ আমলাতন্ত্রের ক্ষমতা ও মুক্ত অর্থনীতির বা সম্পদের হােলিখেলায় তারাই অংশগ্রহণ করতে পারে, যাদের পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক শক্তি। আর এদের আগমন ঘটেছে রাজনৈতিক ও অর্থবৈষয়িক দিক থেকে। ক্ষমতাশালী ও বিত্তবান পরিবার হতে।

তাই এরা একে অপরের স্বার্থে পরিপূরক শক্তি বা এরা একই কায়েমী স্বার্থবাদী সুবিধাবাদী শ্রেণী যারা পরােক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে আন্তর্জাতিক পুঁজিবাদী শক্তির এজেন্ট-সেবাদাস। এই পরিস্থিতিতে, প্রতিযােগিতামূলক রাজনৈতিক ও অর্থবৈষয়িক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণে অক্ষম হয়ে এক শ্রেণীর রাজনীতিকরা হতাশাগ্রস্ত হয়ে চলে গেছেন তথাকথিত আন্ডারগ্রাইন্ডে ও অতিবাম শিবিরে। এরা নিজেদেরকে বিপ্লবী বলে প্রচার করতে ভালােবাসেন। এদের মধ্যেই কেউ আবার অতিবিপ্লবী। এদের লক্ষ্য,  প্রচলিত সবকিছুকে অস্বীকার করা, আঘাত করা, ধ্বংস করা। এরা রক্তপাতমূলক ও হিংসাত্মক পন্থায় ক্ষমতায় যেতে চান। জনগণের মতামত ও ক্ষমতাকে এরা তােয়াক্কা করেন না। ভাবেন বন্দুকের নলই সকল ক্ষমতার উৎস’। এ দর্শন তারা আমদানী করেছেন চৈনিক হঠকারী অতিবিপ্লবী রাজনীতি থেকে। এরা ক্ষমতাসীন শাসক ও শােষক-ধনিকগােষ্টীকে হঠাৎ করে উৎখাত করার জন্যে নানান প্রকার অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা, বিশেষ করে জ্বালাও-পােড়াও-মারাে’ নীতিতে সম্পদ ধ্বংস ও রক্তপাতমূলক কার্যকলাপে লিপ্ত হন। এরা উড়ােচিঠি ও টেলিফোনে নানান ভয়ভীতি এবং গলাকেটে জীবননাশের হুমকী দিয়ে ধনীলােকদের নিকট থেকে মােটা অংকের অর্থ অপহরণের কাজে লিপ্ত হন। ফলশ্রুতিতে তাদের রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ সন্ত্রাসবাদ, দস্যুতা ও হঠকারীতার শামিলে পরিণত হয়েছে। এই তথাকথিত বিপ্লবীদের রাজনৈতিক চিন্তাধারা জনগণের কাছে সুস্পষ্ঠ তাে নয়ই বরং তাদের কাছে এই রাজনীতি গ্রহণযােগ্যও নয়। এর সুযােগ গ্রহণ করে শােষকগােষ্ঠীর এজেন্ট রাজনীতিকরা সমাজতন্ত্রের ওপর সমস্ত দোষ চাপিয়ে দিয়ে সমাজতন্ত্রকে সন্ত্রাসবাদী, ধ্বংসকারী হত্যাকারী ও দস্যুবৃত্তির দর্শন বলে চালিয়ে দিয়ে মানুষকে হতাশার তিমিরে ডুবিয়ে দিয়ে নিজেদের পথকে প্রশস্ত করে চলেছে। ফলে না-খাওয়া দুখী শােষিত মানুষ আজকাল সমাজতন্ত্র ও বিপ্লবের নাম শুনলে মুখ ফিরিয়ে নেয়। তারা সমাজতন্ত্র বা সামাজিক বিপ্লবকে বুঝতে চায় না, বরং বিরােধীতা করে প্রচলিত শােষক সমাজের রীতিনীতি ও ধর্মের মধ্যে সান্ত্বনা খুঁজে নিতে চায়। এভাবেই ঐ তথাকথিত সমাজতন্ত্রী, বিপ্লবী, যাদের শােষক প্রতিক্রিয়াশীলচক্রের পেইড এজেন্ট বলাই শ্রেয়, তাদের হঠকারী কার্যকলাপের মধ্যে দিয়ে তারা সমাজতন্ত্র বা সামাজিক বিপ্লবের পথকে কর্দমাক্ত করেছেন, বারােটা বাজিয়ে ছেড়েছেন।

তথাকথিত এই বিপ্লবীদের কার্যকলাপ দেখে জনসাধারণের মনে এ ধারণারই সৃষ্টি হয়েছে যে, যা ভাগ্যে আছে তাই হবে, য আছে তা-ই থাক; ও সবের মধ্যে যেয়ে লাভ নেই। ফলে তারা হাত-পা গুটিয়ে শােষকসমাজের কার্যকরি দাওয়াই ভাগ্যের লিখন’কেই মেনে নেয়। কোন সগ্রাম-আন্দোলন-বিপ্লব নয়; শান্তিপূর্ণ উপায়ে তারা তাদের অধিকার পেতে চায়।  কিন্তু শােষকসমাজে যে শান্তি নেই, পুঁজিবাদী শােষক সমাজই যে শান্তি হননের সমাজ এবং এ সমাজে শান্তিপূর্ণ উপায়ে যে শােষিত মেহনতী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না, এই সহজ কথাটা ঐ সব একচেটিয়া চিহ্নিত সমাজতন্ত্রী-বিপ্লবীরা জনসাধারণকে বুঝাতে ব্যর্থ হয়েছেন। জনগণকে তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন না করে, প্রচলিত পুঁজিবাদী ও আধাসামন্তবাদী সমাজে তারা প্রকৃতই কী পাচ্ছে, সে বিষয়ে তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ না করে তাদের পক্ষে যতােই শ্লোগান ও সমবেদনা বা প্রচেষ্টা চালানাে হােক না কেননা তাতে তারা সাড়া দেয় না, এ কথাটাও এ সব তথাকথিত বিপ্লবীরা বুঝতে চান না। এ অবস্থায় জনগণকে অজ্ঞতার অন্ধকারে রেখে বিপ্লবীরা যে কার্যকলাপে লিপ্ত হন তাতে তাদের কার্যকলাপ সমাজে প্রতিবিপ্লবী কার্যক্রমে পর্যবশিত হয়ে পড়ে; প্রকারান্তরে এর ফলে সামাজিক পরিবেশ শােষক প্রতিক্রিয়াশীলচক্রের পক্ষে, তাদেরই স্বার্থে। চলে যায়। তাই আমাদের দেশের তথাকথিত বিপ্লবীদের ক্রিয়াকান্ড বিশ্লেষণ করলে বুঝা যায় যে, এরা সমাজতান্ত্রিক সামাজিক বিপ্লব সম্পর্কে যেমন কোন শিক্ষা নিতে পারেননি তেমনি পারেননি জনগণের মনমানসিকতা ও সামাজিক পরিবেশগত পরিস্থিতিকে বুঝতে। প্রকৃতপক্ষে তাদের উদ্দেশ্য হলাে বিশৃঙ্খলা ও রক্তাক্ত কার্যকলাপের মধ্যে দিয়ে রাতারাতি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল এবং নিজেদের শাসন শশাষণ প্রভাবকে প্রতিষ্ঠিত করা, তাতে জনগণের অবস্থা যা-ই হােক না কেনাে। পুঁজিবাদী শােষক সমাজের ধারক বাহকদের কার্যকলাপ ও চিন্তাধারার সাথে এ প্রক্রিয়ার তথাকথিত বিপ্লবীদের কার্যকলাপ ও চিন্তাধারার মিল রয়েছে বলে বিজ্ঞমহল মনে করেন। যেহেতু সাধারণ মেহনতী শােষিত মানুষ মুক্তি পেতে চায় সেহেতু তাদের মুক্তির গালভরা শ্লোগান দিয়ে, সমাজতন্ত্রের নামাবলী জড়িয়ে, সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের মধ্য দিয়ে তারা ক্ষমতার কেন্দ্রে যেতে চান। এই হঠকারী অতিবিপ্লবী, রাতারাতি ক্ষমতায় আরােহণকারী বিপ্লবীদের তাই শোষকশ্রেণীর ছদ্মবেশী এজেন্ট বলাই শ্রেয়।

ঐ সব বিপ্লবী সমাজতন্ত্রীরা দিনের বেলায় সমাজতন্ত্রের জন্যে মাঠ গরম করেন, জান কোরবান করেন এবং রাতের বেলায় ধনিক শােষক শাসকদের সঙ্গী হয়ে লাল-নীল সুরা ও অন্যান্য আসক্তি নিয়ে মৌজ করেন। ঐ সব সমাজতন্ত্রীদের পেন্টাগণপন্থী কমিউনিষ্ট’ হিশেবে আখ্যায়িত করাই যুক্তিযুক্ত।  প্রকৃতই সমাজতান্ত্রিক সামাজিক বিপ্লব কি ও এর গতিপ্রকৃতি উদ্দেশ্য লক্ষ্য কি এবং বিপ্লবী কারা ও তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্টই বা কি, এসব সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর চিন্তাচেতনা-ধ্যানধারণা কি, সে বিষয়ে এই গ্রন্থের শেষ অধ্যায়ে বিশদভাবে আলােচনা করা হয়েছে। এ ব্যতীত আমাদের দেশের তথাকথিত একচেটিয়া সমাজতন্ত্রীরা জনসাধারণকে সমাজতন্ত্র সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা দিতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। ফলশ্রুতিতে শশাষক ও তাদের দালালগােষ্ঠী জনসাধারণকে এ বলে বুঝিয়ে থাকে যে, সমাজতন্ত্র মানে রক্তাক্ত সংগ্রাম—সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ, কারাে কোনােই স্বাধীনতা থাকে না; ধর্ম ও গণতন্ত্র বলতে কিছু থাকে না, কারাে কোনাে ব্যক্তিসম্পদ থাকে না’ সবকিছু জাতীয়করণ করে সমাজতন্ত্রীরা তাদের হাতে নিয়ে যাবে; সমাজতন্ত্রীদের স্বৈরতান্ত্রিক একনায়কত্ব শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় ইত্যাদি। কারাে  কোনাে ব্যক্তিসম্পদ থাকে না’—এ কথাটাই বিরুদ্ধবাদীরা জোরেশােরে প্রচার করে। থাকে কারণ সম্পদ হারানাের ভয় যে কোনাে লােককেই বিচলিত করে থাকে। সমাজতন্ত্রের শত্রুরা সাধারণ মানুষের এই সেন্টিমেন্টে আঘাত দিয়ে থাকে যাতে তারা সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিতশ্রদ্ধ হয়ে ওঠে। এ কথাটা সত্য যে প্রত্যেকটি মানুষের কম বেশি ব্যক্তিসম্পদ রয়েছে। শােষিত নিঃস্ব বা ফকিরকেও একেবারে সর্বহারা বলা যায় না। কৃষক শ্রমিক মেহনতী মানুষের কিছু না কিছু ব্যক্তিসম্পদসম্পত্তি রয়েছে। এদেরকে বলা হয় লুমপেন প্রােলেতারিয়েত। এদেরকে খাওয়া পরা আশ্রয় চিকিৎসা ও শিক্ষার নিশ্চয়তার প্রতিশ্রুতি যতােই দেয়া হােক না কেন, তারা তাদের ঐ সামান্যতম সম্পদ-সম্পত্তির লােভ-লালসা পরিত্যাগ করতে কিছুতেই রাজী নয়, সম্পদ সম্পত্তি তাদের মনকেও আকৃষ্ট করে থাকে যদিও ঐ। সামান্যতম সম্পদ সম্পত্তিতে তাদের কোনােই মৌলিক প্রয়ােজন মিটছে না ।

সুতরাং সমাজতন্ত্র সম্পর্কে সাধারণ মানুষ বলতে গেলে একেবারেই অজ্ঞ অথচ এ কথা সত্য যে সমাজতন্ত্রের মধ্যেই কিন্তু তাদের সার্বিক মুক্তি ও ভাগ্যোন্নয়ন নিহিত। সমাজতন্ত্র সম্বন্ধে তারা অজ্ঞ ও আপাতঃ শঙ্কিত হলেও সমাজতান্ত্রিক জীবনব্যবস্থাই তাদের কাম্য। সমাজতন্ত্র মানে ব্যক্তিসম্পদ হারানাের ঝুঁকি, এই যে তাদের আপাতঃ চিন্তাধারা বা শঙ্কা, এর জন্যে দায়ী সমাজতন্ত্রের তথাকথিত সােল-এজেন্টরাই। এ কথা শুনতে অনেকেই অভ্যস্থ নন। অথচ এটাই বাস্তবসত্য। কারণ তারা জনগণকে বুঝাতে ব্যর্থ হয়েছে যে, সমাজতন্ত্র মানে। ব্যক্তিসম্পদ ব্যক্তিমালিকানার একেবারে বিলােপ নয়; শোষণের প্রক্রিয়া বা উপায়গুলােকে সমূলে উৎপাটন সাধন করা মাত্র। তারা জনগণকে বুঝাতে পারেননি। যে, উৎপাদনের যাবতীয় উপায়গুলাে বা জাতীয় উৎপাদন ব্যবস্থার মালিক হচ্ছে সমাজের মুষ্টিমেয় ভাগ্যবান ব্যক্তি, উৎপাদন ব্যবস্থা ব্যক্তিমালিকানায় নিয়ন্ত্রণ হয়। বলেই উৎপাদকশ্রেণী; মেহনতী মানুষ তাদের প্রকৃত পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, তারা মালিকের দ্বারা শােষিত-প্রতারিত হচ্ছে। এই মুষ্টিমেয় ভাগ্যবান শােষকদের রাজনৈতিকভাবে উচ্ছেদ সাধন করে, তাদের সীমাহীন সম্পদ বা শশাষণের যাবতীয় উপায়গুলােকে ব্যক্তিমালিকানা থেকে রাষ্ট্রীয় বা জনগণের সমষ্টিগত মালিকানায়। আনায়নই সমাজতন্ত্রের লক্ষ্য। এর অর্থ এই নয় যে সকলের সবকিছু জাতীয়করণ করা হয়। প্রত্যেক মানুষের প্রয়ােজনীয় ব্যবহার্য জিনিসপত্র ও সম্পত্তির ওপর। অবশ্যই প্রত্যেকের অধিকার রয়েছে। সমাজতান্ত্রিক সমাজ যতােই বিকশিত হবে, অগ্রসর হবে, সমৃদ্ধ হবে, ব্যক্তি বিশেষের সম্পত্তির পরিমাণ, ভােগের পরিমাণ ততােই বৃদ্ধি পাবে অর্থাৎ প্রতিটি লােকের সুখ-সুবিধা ভােগের জন্যে তার  ব্যক্তি সম্পত্তি ক্রমাগতভাবে বর্ধিত করাই সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির মূল লক্ষ্য। সমাজতান্ত্রিক আর্থ ব্যবস্থায় সমাজের কর্মক্ষম প্রতিটি মানুষ তার যােগ্যতা সামর্থ্য। ও প্রতিভানুযায়ী বা সমাজের চাহিদার প্রয়ােজনানুযায়ী সম্পদ উৎপাদন করবে এবং প্রতিটি মানুষ তার প্রয়ােজনানুযায়ী আনুপাতিকহারে তা ভােগ করার অধিকার পাবে। সুতরাং মুনাফা সৃষ্টির অবকাশ এখানে নেই। সমাজের প্রয়ােজনানুযায়ী সম্পদ সৃষ্টি হবে, মুনাফা অর্জনের জন্যে নয়। 

এ ব্যতীত প্রতিটি মানুষের রাজনৈতিক স্বাধীনতা তথা সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার গণ্ডিতে যাবতীয় রাজনৈতিক-প্রশাসনিক ক্ষমতার কেন্দ্রে যাওয়ার জন্যে যাবতীয় নির্বাচনী প্রতিযােগিতায় সরাসরি অংশগ্রহণের অধিকার রয়েছে। সমাজতান্ত্রিক সমাজের সার্বিক কল্যাণের লক্ষ্যে মত প্রকাশের স্বাধীনতা, ধর্ম পালন ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা তথা অন্যান্য মৌলিক মানবাধিকারের নিশ্চয়তা প্রদান করাই সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য।  বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটভূমিকা ও অবস্থা পর্যালােচনা করলে আমরা দেখতে পাই যে, এখানে বহুদলীয় বা বহু পথমতের রাজনীতির টানাটানি হানাহানি, ডানপন্থী বা পুঁজিবাদীদের ডিগবাজী ও ছল প্রতারণা এবং বামপন্থী বা সমাজতন্ত্রীদের হঠকারীতা ও সমাজতন্ত্র সম্পর্কে অজ্ঞতা এবং উগ্ৰসাম্প্রদায়িক প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের ধর্মতান্ত্রিক উদ্ভট রাজনীতির হােলিখেলার কারণে এদেশের বুকে কোনাে স্থিতিশীল সুষ্ঠ আদর্শবাদী বা প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল গড়ে উঠতে পারেনি। বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটিই মাত্র গণভিত্তিক রাজনৈতিক দল, সেটি আওয়ামী লীগ। ব্যাপক গণমুখি হয়েও দলটি নির্ভরশীল ছিলাে সম্পূর্ণভাবে বঙ্গবন্ধুর একক ব্যক্তিত্ব ইমেজ ও নেতৃত্বের ওপর। বিভিন্ন শ্রেণী বা বিভিন্ন পথমতের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে এই সংগঠনটি। এই সংগঠনের অভ্যন্তরে যেমন রয়েছে উঠতি ধনিক শােষক-সুবিধাবাদী প্রতিবিপ্লবী গােষ্ঠী, তেমনি রয়েছে সমাজতন্ত্রী – শোষিত-সর্বহারা বিপ্লবী শ্রেণী । ফলে দলের মধ্যে রয়েছে কোন্দল দ্বন্দ্ব সংঘাত। এটা মূলতঃ শ্রেণী-দ্বন্দ্ব, দলের নেতৃত্ব দখলের কোন্দল ও দ্বন্দ্ব।  স্বাধীনতা পূর্বকালীন বিভিন্ন সময়ে নেতৃত্বের কোন্দলে পড়ে ও ব্যক্তিস্বার্থ। উদ্ধারের জন্যে অনেকেই আওয়ামী লীগ থেকে সরে গেছেন বা ঝরে গেছেন। তেমনি স্বাধীনতাত্তর কালেও এই সংগঠনের অনেক উপনেতা, পাতিনেতা ও কর্মীরা রাজনৈতিক আর্থসামাজিক প্রশাসনিক ক্ষেত্রে নানান কোন্দলে পড়েন বা দলত্যাগ করেন। এমনটি হওয়ার কারণ কি?  আওয়ামী লীগ একটি ঐতিহ্যবাহী সংগ্রামী জাতীয়তাবাদী সংগঠন, সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারা এ সংগঠনের অন্যতম মূল লক্ষ্য হলেও প্রয়ােজনীয় প্রশিক্ষিত ক্যাডার বা কর্মীবাহিনী ছিলাে না। কৃষক শ্রমিক ফ্রন্টে এ সংগঠনের শক্তিশালী বেইস ছিলাে না বা নেই। দলটি গড়ে উঠেছিলাে পাকিস্তানী মুসলিমলীগ ও সামরিকবাহিনীর গণবিরােধী স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ও তাদের আশ্রিত শ্রেণীভুক্ত একচেটিয়া পশ্চিম পাকিস্তানী কায়েমী স্বার্থবাদী শােষকগােষ্ঠীর বল্গাহীন শােষণ এবং বৈষম্যমূলক কার্যকলাপ থেকে এদেশের সাধারণ মানুষের রাজনৈতিক, আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক সার্বিক মুক্তির লক্ষ্যে। এ সংগঠনের ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদী চিন্তাচেতনা ও সংগ্রামী ভূমিকা এবং এদেশের শােষিত-অত্যাচারিত মানুষের মৌলিক রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার আপােষহীন সংগ্রামী ভূমিকা পালনের কারণে সর্বস্তরের জনগণ আওয়ামী লীগের পতাকাতলে জড়াে হয়েছিলাে।

বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর প্রদৃপ্তপ্রখর ব্যক্তিত্ব, সাংগঠনিক কর্মদক্ষতা, তার সীমাহীন ত্যাগ-তিতিক্ষা, বিপ্লবী কর্মোদ্দীপনা, আপােষহীনসগ্রাম, লােভলালসাহীনতা এবং বাঙ্গালী জাতির প্রতি অকৃত্রিম মমত্ববােধ, ভালােবাসা, গভীর দেশপ্রেম ও তাঁর মন্ত্রমুগ্ধ জলদগম্ভির বক্তৃতা, বিশাল উদার মনপ্রাণ ইত্যাদি বাঙ্গালী জাতিকে আলােড়িত আন্দোলিত ও চেতনাদৃপ্ত-উজ্জীবিত করে তােলে। জনগণের মনে বাঙ্গালী জাতীয়তা-স্বকীয়তা ও আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের অগ্নিসংকল্প ক্রমান্বয়ে ফুরিত হতে থাকে। এ সব কারণে এ দেশের চিরশােষিত বঞ্চিত মানুষ বঙ্গবন্ধুর মাঝে তাদের জীবনের আশা আকাংখার স্বপ্ন খুঁজে পায়; তারা বিপুলভাবে তার নেতৃত্বের প্রতি আস্থাশীল হয়ে আওয়ামী লীগের পতাকাতলে জড়াে হয়ে পড়ে।  অপরদিকে এদেশের উঠতি ধনিকগােষ্ঠী পশ্চিম পাকিস্তানের একচেটিয়া ধনিক পুঁজিপতি শিল্পপতি তথা কায়েমী স্বার্থবাদী শােষকগােষ্ঠীর সাথে আর্থবৈষয়িক ও অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রতিযােগিতায় টিকতে না পেরে তাদের একটি বিরাট অংশ ভবিষ্যতের সােনালী স্বপ্নে বিভাের হয়ে আওয়ামী লীগের সাথে প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষভাবে সম্পর্ক স্থাপন করে। এমনি করে সর্বস্তরের মানুষ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে। জনগণের ঐক্যকে পাথেয় করে বঙ্গবন্ধু অগ্রসর হতে থাকেন। তার বদ্ধমূল ধারণা ছিলাে, বাঙ্গালী জাতিকে তথা বাংলাদেশকে পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক-শােষকদের কবল থেকে প্রথমে স্বাধীন করে, মুক্ত বাংলার মাটিতে অর্থনৈতিক মুক্তি তথা সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করবেন। তাই তাে আমরা দেখতে পাই স্বাধীনতার্জনের সাথে সাথেই তিনি শোষণহীন সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিশেবে শােষণের প্রধানতঃ হাতিয়ার বৃহৎ ব্যক্তিমালিকানাধীন এবং যাবতীয় উপায়গুলােকে জাতীয়করণ করে জনগণের সমষ্টিগত মালিকানায় ন্যস্ত করলেন। বাংলার বৃহত্তর সংখ্যাগরিষ্ঠ দীনদুখী মেহনতী শােষিত বঞ্চিত অবহেলিত মানুষের আশা-আকাংখা সম্যকভাবে উপলব্ধি করে, নিজের লালিত ও উদ্ভাবিত সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারা ও রাজনৈতিক-আর্থসামাজিক প্রশাসনিক কর্মসূচীর আলােকে বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে এবং পরিশেষে সেই সব কর্মসূচীসমূহকে বাস্তবায়িত করার চূড়ান্ত পদক্ষেপ নিলেন বাংলাদেশ-কৃষক

শ্রমিক-আওয়ামী লীগ’ বা বাকশালের মাধ্যমে। আওয়ামী লীগ যেহেতু বিভিন্ন শ্রেণী পথ ও মৃতের রাজনৈতিক মানসিকতার সমন্বিত সংগঠন তথা মােটামুটি পেটি বুর্জোয়াগােষ্ঠীর নেতৃত্বের সংগঠন সেহেতু এ সংগঠন দিয়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। সম্ভব ছিলাে না। বঙ্গবন্ধু জানতেন, বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদকে হঠানাের জন্যে একা ভারতীয় কংগ্রেসের পক্ষে সম্ভব নয় বলেই ভারতীয় মুসলিম লীগের প্রয়ােজন হয়ে পড়েছিলাে। তাই তিনি মুসলিম লীগ করেছেন এবং পাকিস্তানের আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। পাকিস্তান সৃষ্টির পর মুসলিম লীগ শাসক শােষকগােষ্ঠীর স্বৈরাচারী শাসন-শােষণের ক্রিয়াকলাপ প্রত্যক্ষ করে তিনি বুঝলেন যে, বাংলার মানুষের স্বাধীনতা ও অর্থনৈতিক মুক্তি মুসলিম লীগের নেতৃত্বে পাকিস্তান কাঠামাের মধ্যে অর্জিত হওয়া সম্ভব নয়। এ কারণে মুসলিম লীগ ত্যাগ করে, সাম্প্রদায়িক রাজনীতি পরিহার করে, বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী চিন্তাচেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত করেন।  আওয়ামী লীগের মাধ্যমে স্বাধিকার থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন করার পর তিনি বুঝলেন যে, স্বাধীন বাংলাদেশে শোষণহীন, প্রকৃত গণতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা আওয়ামী লীগ দ্বারা সম্ভব নয়। কারণ এ জাতীয় বহু শ্রেণীভিত্তিক এবং পথ ও মতের রাজনৈতিক সংগঠন দিয়ে পৃথিবীর কোথাও কোনকালে কোন দেশে গণতন্ত্র-সমাজতন্ত্রকে কল্পনাও করা যায়নি। এ ক্ষেত্রে এসে অনুপ্রাণিত হলেন খেলাফতে রাশেদীন, মার্কসবাদ ও লেনিনের কর্মযজ্ঞ থেকে। এ ব্যতীত বাংলার ঐতিহাসিক সাম্যবাদী সমাজ ও সাম্যবাদী বিপ্লবীদের কর্মোদ্দীপনা থেকেও অনুপ্রাণিত হলেন। সৃষ্টি করলেন জাতীয় রাজনৈতিক প্লাটফরমঃ বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ’ বা বাকশাল। সুতরাং বাকশাল হলাে, শােষণহীন গণতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার একটি বৈপ্লবিক জাতীয় প্লাটফরম—সমাজের সর্বশ্রেণী সর্বস্তর ও সর্বদলীয় সর্ব পেশাভিত্তিক জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল জাতীয় সংগঠন। এখানে ব্যক্তি গােষ্ঠী বা শ্রেণীস্বার্থ ও দ্বন্দ্ব সংঘাতের কোনাে অবকাশ নেই। বাংলার দীন-দুঃখী-শােষিতবঞ্চিত-অবহেলিত শ্রমজীবি মেহনতী মানুষ তথা বৃহত্তর সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগােষ্ঠীর প্রকৃত গণতান্ত্রিক শাসন ও তাদের মৌলিক মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার রাজনৈতিক সংগঠন এই বাংলাদেশ-কৃষক-শ্রমিক-আওয়ামী লীগ’ বা বাকশাল। 

সূত্র : বঙ্গবন্ধু-দ্বিতীয় বিপ্লবের রাজনৈতিক দর্শন – আবীর আহাদ

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!