You dont have javascript enabled! Please enable it!

বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রীয় চার মৌলনীতি

বাঙ্গালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুদীর্ঘ সুমহান রাজনৈতিক জীবনের চিন্তাচেতনা, ধ্যানধারণা, আদর্শ ও লক্ষ্য তার গৃহীত রাষ্ট্রীয় চার মৌলনীতিমালার মধ্যে প্রােতিত ও প্রতিফলিত হয়েছে। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা এই চার মৌলনীতিমালা সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে তার রাজনৈতিক, আর্থসামাজিক, প্রশাসনিক, বিচার ব্যবস্থা ও সাংস্কৃতিক দিকদর্শন, গতিপ্রকৃতি ও কর্মসূচি। কোন কোন চিন্তাবিদ এই চার নীতিমালার সমন্বিত চিন্তাদর্শনকে ‘মুজিববাদ’ বলে অভিহিত করেছেন। এই চার নীতিমালার আদর্শ ও লক্ষ্যে অনুপ্রাণিত হয়ে, উজ্জীবিত হয়ে বাঙ্গালী জাতি এক সর্বোচ্চ ত্যাগ তিতিক্ষার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে পাকিস্তানী শাসন শােষণ ও সাম্রাজ্যবাদের শােষণ প্রতিপত্তি থেকে মুক্ত করেছে।  স্বাধীন বাংলাদেশে গণতন্ত্র হলাে বাঙ্গালীর ব্যাপক গণমানুষের রাজনৈতিক জীবনবােধের চাবিকাঠি; সমাজতন্ত্র হলাে আর্থবৈষয়িক সাম্যতার ভিত্তিতে সকল মানুষের মৌলিক মানবাধিকার ও শােষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার নিশ্চিত হাতিয়ার এবং জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা হলাে বাঙ্গালীর জাতীয় ঐক্য সাম্য মৈত্রী সম্প্রীতি সহমর্মিতা ভ্রাতৃত্ব সহনশীলতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবােধ ভালােবাসা প্রতিষ্ঠার উজ্জীবনিশক্তি। বঙ্গবন্ধু প্রবর্তিত বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ’ বা বাকশাল বা দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচির ভিত্তিও হলাে এ চার মৌলনীতিমালা। এখানে চার মৌলনীতিমালাকে কার্যকরভাবে সুসংহত ও সুসংরক্ষিত করা হয়েছে। শশাষণহীন গণতান্ত্রিক সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে উক্ত চার মৌলনীতিমালার বিকল্প কোন দার্শনিক বৈশিষ্ট্য আছে কিনা তা আমাদের জানা নেই। নিম্নে বঙ্গবন্ধুর চার রাষ্ট্রীয় মৌলনীতিমালার ওপর সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ দেয়া হলাে।

ক. গণতন্ত্র

ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে গণতন্ত্রের উদ্ভব ঘটেছিলাে প্রাচীন গ্রীসের এথেন্সনগরীতে খৃষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দিতে । গ্রীক নগররাষ্ট্রের কোন একটির) কর্ণধার বা চিন্তাবিদ নামে খ্যাত সােলন সর্বপ্রথম গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার রূপকাঠামাের রীতিনীতির প্রচলন করেন। সােলনের আবির্ভাবের প্রায় একশত বছর পরে কেলিস্থিনিস এবং তৎপরবর্তীতে থেসিয়াস শাসনতান্ত্রিক কাঠামাের মধ্য দিয়ে নগররাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা আইনানুগ স্বীকৃতি লাভ করে।  গ্রীস পরিভাষা ‘Demos’ (জনগণ) ও ‘Kratos’ (ক্ষমতা) থেকেই। ‘Democracy’ বা গণতন্ত্র শব্দের উৎপত্তি ঘটেছে। সাধারণার্থে—যে ব্যবস্থায় গণের ক্ষমতা স্বীকৃত বা প্রতিষ্ঠিত হয় তাকেই ‘গণতন্ত্র’ বলা হয় । কিন্তু গ্রীস নগররাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে প্রকৃতার্থে গণতন্ত্র বলা যায় না। নগররাষ্ট্রের প্রভাবশালী ব্যক্তিরাই ঐ গণতন্ত্রের সুফল ভােগ করতাে। ‘জনগণ’ বলতে যে সমাজের সর্বস্তরের সম্মিলিত মানবগােষ্ঠীকে বুঝায়, সেই জনগণের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার কোনােই ব্যবস্থা সেখানে ছিলাে না। তৎকালীন সমাজের জনগণের ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ সমাজের দাস—ভূমিদাস বা দার্শমিক তথা সর্বহারা জনসাধারণের নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া বা ভােটপ্রদান করা বা শাসন পরিষদে কোনােভাবে অংশগ্রহণ করার কোনােই অধিকার ছিলাে না। নগররাষ্ট্রের রাজা বা কর্ণধাররা উত্তরাধিকারভিত্তিক শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতেন। নগররাষ্ট্রের শাসনকার্য সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার জন্য রাজার অধীনে একটি নির্বাচিত পরিষদ গঠন করা হতাে। এ পরিষদে সমাজের সামন্তপ্রভূ, সম্ভ্রান্ত কৃষক, জোতদার, পুরােহিত ও অন্যান্য প্রভাবশালীগােষ্ঠীর লােকেরাই কেবলমাত্র নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া ও ভােটপ্রদানের অধিকার পেতাে। সুতরাং নগররাষ্ট্রের ‘গণতন্ত্র’ গণতান্ত্রিক নীতিমালার আলােকে গণতন্ত্রই নয়। এটাকে সংখ্যালঘু প্রভাবশালী শরীফসম্প্রদায়ের গণতন্ত্র বা রাজার রাজতান্ত্রিক ‘গণতন্ত্র’ বলাই অধিকতর যুক্তিযুক্ত। এটাকে আবার আরেকার্থে সামরিক গণতন্ত্র’ বলা যেতে পারে। ঐ রাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের প্রচলন বর্তমানেও মধ্যপ্রাচ্যের কতিপয় মুসলিম রাষ্ট্রে দেখতে পাওয়া যায়।  ‘প্রকৃত গণতন্ত্র বলতে আমরা কী বুঝি? বিভিন্ন রাজনৈতিক-আর্থসামাজিক দৃষ্টিতে বিভিন্ন চিন্তাবিদ মণীষী গণতন্ত্রের বিভিন্ন ব্যাখ্যা বা মতবাদ বা সংজ্ঞা দিয়েছেন। তবে এ সংজ্ঞাটাতেই গণতন্ত্রের মূল লক্ষ্য বা দিকদর্শন বা বিশ্লেষণ সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। যথাঃ যে রাজনৈতিক ব্যবস্থায় জনগণের বৃহত্তর সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের বৃহত্তর রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক কল্যাণের নিমিত্তে তাদের জন্যে, তাদের দ্বারা, তাদের দিয়ে গঠিত সরকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তাদের শাসন ও মৌলিক-মানবাধিকার নিশ্চিত হয়, সেই রাজনৈতিক ব্যবস্থাকেই প্রকৃত গণতন্ত্র বলা যায়।

এ ব্যবস্থা ব্যতীত গণতন্ত্রের প্রকৃতই আর কোন সংজ্ঞা আছে কিনা তা আমাদের জানা নেই। এক কথায়, যে শাসন ব্যবস্থায় জনগণের সার্বভৌম রাজনৈতিক ক্ষমতা ও তাদের মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিত হয়, সেই শাসন ব্যবস্থাকেই গণতন্ত্র বলা হয়ে থাকে। আব্রাহাম লিংকনের মতবাদের মধ্যেও গণতন্ত্রের প্রতিফলন ঘটেছে, অপরদিকে মার্কস-লেনিনের মতবাদের মধ্যে তথা সাম্যবাদের মধ্যে গণতন্ত্রের পূর্ণ প্রতিফলন ঘটেছে বলে বঙ্গবন্ধু মনে করতেন। এ কারণেই তিনি বাকশাল ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে সাম্যবাদের অনুপ্রেরণায় প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ। করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু বাঙ্গালী জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে, সুদীর্ঘকাল বিভিন্ন আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জাতিকে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের বেদীমূলে ঐক্যবদ্ধ করে একটি অকৃত্রিম বা প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জীবনপণ সংগ্রাম করেছেন। তাই স্বাভাবিকভাবেই স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় শাসনতান্ত্রিক মৌলনীতিমালায় গণতন্ত্রকে সর্বাগ্রে অন্যতম প্রধান দিকদর্শন হিসেবে মর্যাদা দিয়েছেন। আমাদের দেশে, তথা উন্নত বা উন্নয়নশীল পুঁজিবাদী দেশে রাজনীতির দৃষ্টিতে গণতন্ত্রের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাই যে, পঞ্চদশ শতাব্দির শেষধাপে বৃটিশের সামন্তবাদী রাজতান্ত্রিক শক্তি ও বাণিজ্যিক পুঁজিবাদী শক্তির মধ্যকার পারস্পরিক দ্বন্দ্ব সংঘাত, প্রভাব-প্রতিপত্তি ও সংঘর্ষের অনিবার্য পরিণতিতে তৎকালীন সামন্তবাদী বৃটিশ রাজার মুভুপাতের মধ্য দিয়ে ও তাদের পরাভূত করে বাণিজ্যিক পুঁজিবাদী শক্তি রাষ্ট্রীয় শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় ক্রোমত্তয়েলের নেতৃত্বে। এই বাণিজ্যিক পুঁজিবাদী গােষ্ঠীর শাসকরা অতঃপর বৃটেনের শাসনতান্ত্রিক ক্ষমতার কেন্দ্রস্থল ও বাণিজ্য-শিল্পসমৃদ্ধ নগরী ওয়েস্টমিনিস্টারে সংসদীয় গণতন্ত্রের নামে পুঁজিবাদী ধনিকশ্রেণীর শাসন ব্যবস্থা তথা গণতন্ত্র প্রবর্তন করে। যে ব্যবস্থা বা পদ্ধতিতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার প্রতিনিধি বা জনগণের প্রতিনিধি বা পার্লামেন্ট নির্বাচনের কার্যপ্রণালী গ্রহণ করা হয়, তাতে প্রাচীন গ্রীসের নগররাষ্ট্র ও তৎকালীন অধুনালুপ্ত সামন্তবাদী রাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের আকৃতিগত বিবর্তন ব্যতীত গুণগত কোন পরিবর্তন এই ওয়েস্টমিনিস্টার ধাঁচের গণতন্ত্রে প্রতিফলিত হয়নি। নগররাষ্ট্রের রাজা ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের এবং সাবেক সামন্তবাদী রাজতান্ত্রিক সমাজের রাজপরিবারবর্গ, রাজন্যবর্গ, সামন্তপ্রভূ, জমিদার, লর্ড ও অন্যান্য প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মতােই এই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ধনিক পুঁজিপতি-বাণিজ্যিক বুর্জোয়াগােষ্ঠীর একচেটিয়া শাসন-শােষণকার্য ও প্রভাব-প্রতিপত্তিকে সংহত ও সংরক্ষণ করা হয়।

অর্থাৎ সাবেক সমাজের মতাে এ সমাজের সম্রান্ত শ্রেণীস্বার্থকেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থাকেই এ গণতন্ত্রের মাধ্যমেও পাকাপােক্ত করা হয়। সেই থেকে বর্তমানকাল পর্যন্ত নানান বিবর্তনের মধ্য দিয়ে সেই গণতন্ত্রের আকৃতিগত ও গুণগত রূপ বিভিন্ন উন্নত ও উন্নয়নশীল পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে প্রচলিত হয়ে আসছে। এই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে ‘পুঁজিবাদী গণতন্ত্র’ বলা হয়েছে। আবার এ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ছত্রছায়ায় বিভিন্ন দেশে পুঁজিবাদী-সামরিক গণতন্ত্রকেও আমরা প্রঅক্ষ করে আসছি। যেমন : দক্ষিণ কোরিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, বার্মা, সিংগাপুর, বাংলাদেশ। (১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্ট থেকে), পাকিস্তান, নেপাল, ইরাক, তুরস্ক, জর্ডান, মরক্কো, কুয়েত, বাহরাইন, কাতার প্রভৃতি আফ্রো-এশিয়া এবং ইয়ােরাে-ল্যাটিন আমেরিকার রাজতান্ত্রিক-পুঁজিবাদী সামরিক শাসনযুক্ত রাষ্ট্রসমূহও। প্রকৃতপক্ষে পুঁজিবাদী গণতন্ত্রের মধ্যেই নিহিত রয়েছে সমাজের ধনিক-বণিক-শিল্পপতি বেসামরিক আমলাতন্ত্র ও সামরিক বাহিনীর শাসন শােষণ প্রভাব প্রতিপত্তি। গণতন্ত্রের বর্তমান অন্যতম পীঠস্থান নামে খ্যাত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় আভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে মার্কিন ধনিক-বণিক-শিল্পপতিপুঁজিপতি পেন্টাগণ ও সামরিক শিল্প-কমপ্লেক্স (Military Industrial Complex)-এর প্রবল প্রভাব প্রতিপত্তি রয়েছে। আর অন্যান্য তথাকথিত গণতান্ত্রিক দেশের অবস্থার কথা না-ই বা বললাম। মােট কথা বিশ্বের যে সকল রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক বলে স্বীকৃত বা প্রতিষ্ঠিত সেই রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতি নির্ধারিত হয়ে থাকে সংখ্যালঘু ধনিকশ্রেণীর মাধ্যমে। সুতরাং বিশ্বে বর্তমানে প্রচলিত গণতন্ত্রকে প্রকৃতার্থে গণতন্ত্র বলা যায় না। অর্থাৎ পুঁজিবাদী পদ্ধতিতে জনগণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। একমাত্র সমাজতান্ত্রিক পদ্ধতির মধ্যেই প্রকৃত গণতন্ত্র নিহিত।  পুঁজিবাদী বা ধনতান্ত্রিক সমাজে গণতন্ত্রের বহিঃপ্রকাশ ঘটে থাকে কেবলমাত্র নির্বাচনানুষ্ঠানের মধ্যে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় বিপুল অর্থের ছড়াছড়িতে। ফলে মুষ্টিমেয় ধনিক ভাগ্যবান ব্যতীত সমাজের বৃহত্তর সংখ্যাগরিষ্ঠ দরিদ্র মেহনতী মানবগােষ্ঠী নির্বাচনপ্রার্থী হিসেবে ভােটযুদ্ধে অবতীর্ণ হতে পারে না। দরিদ্র-মেহনতী মানবগােষ্টী শুধু পারে ভােট দিতে এবং তাদের ভােটগুলােও প্রভাবশালী ধনিক প্রার্থীর পক্ষে গিয়ে পড়ে। কোন কোন ক্ষেত্রে তাদের ভােট আগে থেকেই শক্তিশালী প্রার্থীর ভােটবাক্সে জমা হয়ে যায় কিন্তু তাদের করার কিছুই থাকে না। এই হলাে প্রচলিত গণতন্ত্রের বাস্তবসত্য রূপ। এ গণতন্ত্রই আমরা পেয়েছি।

উত্তরাধিকার ভিত্তিতে বৃটিশের কাছ থেকে পুঁজিবাদী বা ধণতান্ত্রিক বিশ্বে এ জাতীয় গণতন্ত্রই একটি আদর্শনীয় ব্যবস্থা বলে স্বীকৃত হয়েছে। পাকিস্তানের ২৫ বছরের শাসনামলে—এমন কি ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডের পর থেকে এখন পর্যন্ত আমরা পুঁজিবাদী গণতন্ত্রের আরেক রূপ সামরিক গণতন্ত্রকে দেখেছি এবং দেখছি। সামরিক আইন-বিধি বহাল রেখে নামমাত্র ঘােষণার মাধ্যমে সামরিক আইন প্রত্যাহার করে বা সামরিক আইনবিধিকে বেসামরিক বিধিতে রূপান্তরিত করে (প্রকারান্তরে সামরিক আইনের ছত্রছায়ায়) মৌলিক গণতন্ত্র, তথাকথিত প্রেসিডেন্ট ও সংসদীয় গণতন্ত্রের নামে টাউট বাটপাড়ির গণতন্ত্রের নামে ধনিক আমলা, সামরিক আমলা তথা বুর্জোয়াগােষ্ঠীর শাসন শােষণ ব্যবস্থা চালু রাখা হয়েছে। এ জাতীয় ব্যবস্থাকে চালু । করেছেন পাকিস্তানের রাজনীতিতে ইস্কান্দার মির্জা, আইয়ুব খান, ইয়াহিয়া খান এবং বাংলাদেশের রাজনীতিতে মােশতাক-জিয়া-এরশাদ। অর্থাৎ যতােকাল পুঁজিবাদ বা ধনতান্ত্রিক সমাজ বহাল থাকবে, ততােকাল সামরিক গণতন্ত্র বা বুর্জোয়া গণতন্ত্র বহাল থাকবে। আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ, এমন কি তথাকথিত শিক্ষিত মানুষও গণতন্ত্র বলতে কেবলমাত্র নির্বাচন বা ভােটাভুটিকেই বুঝে থাকেন। তারা প্রচলিত গণতান্ত্রিক কাঠামাের মধ্যে হাবুডুবু খান, কিন্তু মূলত ‘প্রকৃত গণতন্ত্র’ কী তা তারা বুঝতে সুযােগ পান না বা বুঝতে চেষ্টাও করেন না। শুধুমাত্র ভােটাভুটিই যে গণতন্ত্র নয় তা তারা তলিয়েও দেখেন না। স্বাধীন বাংলাদেশে বা তারও পূর্বে এ দেশে যে ক’টি সাধারণ নির্বাচন হয়েছে বা যে পদ্ধতিতে বর্তমানে দেশ পরিচালিত হচ্ছে সেক্ষেত্রে প্রকৃত গণতন্ত্র’ একেবারেই অনুপস্থিত। সাধারণ নির্বাচনে কোন একটি রাজনৈতিক দল বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করলে বা নির্বাচনে জয়ী হলেই যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলাে এমনটি ভাবা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। ভেবে দেখতে হবে মােট জনসংখ্যার বা আসন লাভকারী রাজনৈতিক দলটি মােট প্রদত্ত ভােটের কতাে পার্সেন্ট ভােট পেলাে। ধরা যাক, দেশের মােট ভােটারের ৭০% ভাগ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলাে। এই ৭০% ভাগ ভােট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী ১৫/২০ রাজনৈতিক দলের মধ্যে বিভক্ত হলাে এবং বিজয়ী দলটি দেখা গেলাে ঐ ৭০% ভাগ ভােটের মধ্যে এককভাবে ৩০% ভাগ ভােট পেয়েছে এবং দলটি সরকার গঠন করেছে।

সুতরাং নির্বাচনে বিজয়ী দলটি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করে সরকার গঠন করতে সমর্থ হলেও তাকে গণতন্ত্রের বিজয় বা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলাে বলে চালিয়ে দেয়া যায় না। দেখা যাচ্ছে যে মােট ভােটারের ৩০% ভাগ অনুপস্থিত, ৭০% ভাগের মধ্যে ৪০% ভাগের সমর্থনও নেই, অথচ ৭০% ভাগের মধ্যে ৩০% ভাগ ভােট পেয়ে বিজয়ী দলটি যে সরকার গঠন করলাে সেই সরকার সংখ্যালঘু জনগণের সরকার বৃহত্তর সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের সমর্থন সেই সরকারের পেছনে নেই। সুতরাং এখানে। গণমানুষের প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিফলিত হয়নি। এ ব্যতীত দেখতে হবে, সরকারী নীতিতে কোন শ্রেণীর কল্যাণ হচ্ছে। যদি দেখা যায় যে সরকারী নীতির বদৌলতে মুষ্টিমেয় মানুষ আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছে, আর ব্যাপক জনগণ দরিদ্র থেকে। দরিদ্রতর হচ্ছে, তাহলে সেই সরকার বৃহত্তর জনগােষ্ঠীর সমর্থনপুষ্ট সরকার হলেও সেটাকে গণতান্ত্রিক (ব্যাপক জনগণের শাসন ব্যবস্থা বলা যায় না। সুতরাং প্রচলিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অভিজ্ঞতা থেকে আমরা বুঝতে পেরেছি যে সংখ্যালঘুদের গণতন্ত্র বা শাসন ব্যবস্থায় সমাজের মুষ্টিমেয় মানুষ ধনে-সম্পদে, বিত্ত-বৈভবে, প্রভাব-প্রতিপত্তিতে ফুলেফেঁপে উঠছে আর তাদের স্বাধীন যথেচ্ছাচার ও স্বেচ্ছাচারিতার কার্যকলাপের যজ্ঞে বলি হচ্ছে, শাসিত শােষিত হচ্ছে সমাজের বৃহত্তর সংখ্যাগরিষ্ঠ মানবগােষ্ঠী।  এই গণতন্ত্র, সংখ্যালঘুদের গণতন্ত্র, শােষকের গণতন্ত্র, শােষন বঞ্চনা অত্যাচার প্রতারণা ও দারিদ্রতা সৃষ্টির গণতন্ত্র তথা পুঁজিবাদী ৰা ধনতান্ত্রিক গণতন্ত্র – এই তথাকথিত গণতন্ত্রের জন্যে ৩০ লক্ষ বাঙ্গালী রক্ত দেয়নি, বাংলাদেশ স্বাধীন। হয়নি। এই দেশ মুষ্টিমেয় সুবিধাবাদী বর্ণচোরা, শঠ, প্রবঞ্চক, প্রতারক, ধনিক পুঁজিপতি এবং উৎপাদনের সাথে সম্পর্কহীন মধ্যস্বত্বভােগী ভাগ্যবানদের দেশ নয়, এই দেশ কোটি কোটি অন্নহীন, বস্ত্রহীন, দীনদুখী, শ্রমজীবি, মেহনতী মানুষেরও দেশ; তাদেরই সীমাহীন ত্যাগ-তিতিক্ষায় অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশ। তাদেরও এদেশে মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে। কিন্তু প্রচলিত পুঁজিবাদী বা শশাষণবাদী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জাতাকলে পিষ্ঠ হয়ে তাদের বৃহত্তর গণমানুষের মৌলিক মানবাধিকার পদদলিত হচ্ছে। এই তথাকথিত গণতন্ত্রের ইতিহাসইতিহ্য, রাজনৈতিক-আর্থসামাজিক প্রশাসনিক বিচার ব্যবস্থা ও নৈতিকতার বাস্তব অবস্থা-তাৎপর্য সম্যকভাবে হৃদয়ঙ্গম করেই বঙ্গবন্ধু প্রচলিত গণতন্ত্রের জট ভেঙ্গে দিয়ে প্রকৃত গণতন্ত্রের উত্তরণ ঘটাতে সচেষ্ট হন, যে গণতন্ত্র হবে সমাজের বৃহত্তর সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের তথা ৯৫% ভাগ জনগণের গণতন্ত্র –‘শােষিতের গণতন্ত্র – যে গণতন্ত্রের ভিত্তিতে ব্যাপক জনগণের শাসন ও তাদের বৃহত্তর কল্যাণ নিশ্চিত হয়।

তবে প্রশ্ন আসবে প্রচলিত গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে কেননা বঙ্গবন্ধু অনেকগুলাে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিলেন? এর উত্তরে বলা যায় যে, প্রচলিত গণতন্ত্রেরও উত্তরণ বা নির্বাচন তথা সাধারণ নির্বাচনও গত কয়েক যুগের মধ্যে বাঙ্গালীর জীবনে আসেনি এবং এ ব্যতীত জনসাধারণ নির্বাচনকেই গণতন্ত্র বলে ভাবতে অভ্যস্থ ছিলাে বা নির্বাচনের প্রতি তাদের টান ছিলাে অপরিসীম। ফলে এ কারণেই বঙ্গবন্ধুও সাধারণ নির্বাচন তথা প্রচলিত গণতন্ত্রের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে জনগণকে বুঝাতে চেয়েছিলেন যে, এ গণতন্ত্রের মাধ্যমে তারা কী পেয়েছে বা পেতে পারে। তাই তিনি প্রচলিত গণতন্ত্রের মধ্য দিয়েই অকৃত্রিম গণতন্ত্রের সঠিক উত্তরণের লক্ষ্যে এবং সেই লক্ষ্যের সােপান সৃষ্টি করে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ’ বা বাকশাল পদ্ধতির উদ্ভব ঘটিয়ে ছিলেন। বাকশালের রাজনৈতিক, আর্থসামাজিক, সাংস্কৃতিক, প্রশাসনিক ও বিচার ব্যবস্থার মধ্য প্রকৃত গণতন্ত্র, শােষিতের গণতন্ত্র তথা ব্যাপক জনগণের গণতান্ত্রিক একনায়কত্ব’ প্রতিষ্ঠার পথ রচনা করেছিলেন। এ লক্ষ্যে যাবতীয় প্রশাসনিক কেন্দ্রে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্যে প্রশাসনকে গণতান্ত্রিকতার ভিত্তিতে বিকেন্দ্রিকরণ করে জনগণের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বাকশাল আলােচনাকালে এ বিষয়ে বিশদালােচনা করা হয়েছে।

খ, সমাজতন্ত্র

সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদ এমন একটা রাজনৈতিক আর্থসামাজিক ব্যবস্থা যেখানে সমাজের ব্যাপক মানুষের প্রকৃত গণতান্ত্রিক শাসন-কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সমাজের উৎপাদনের যাবতীয় উপকরণ ও সম্পদের মালিক সমাজের সমষ্টিগত গণমানুষ; যেখানে শােষণের কোনাে অবকাশ নেই, মানুষের মধ্যে কোনাে শ্রেণী বা স্তর নেই, সাম্প্রদায়িক বা ধর্মীয় পক্ষপাত নেই, সমাজের প্রত্যেকটি মানুষ একই পরিবারভূক্ত। প্রতিটি মানুষ তার প্রতিভা বিকাশের পূর্ণ সুযােগ লাভ করবে যােগ্যতার ভিত্তিতে, অর্থের বা অন্য কোনাে প্রতিপত্তির ভিত্তিতে নয়। প্রত্যেক মানুষ তার জন্মধিকারের ভিত্তিতে যাবতীয় রাজনৈতিক অধিকার ভােগ করবে। প্রত্যেক কর্মক্ষম মানুষ তার যােগ্যতা বা সামর্থনুযায়ী রাষ্ট্রীয় প্রশাসনিক ও উৎপাদনকার্যে শ্রম বিনিয়ােগ করবে এবং প্রত্যেক মানুষ তার প্রয়ােজনানুযায়ী সম্পদসামগ্রী বা শ্রমমূল্য তথা প্রয়ােজনীয় মৌলিক অধিকার ভােগ করবে। অর্থাৎ প্রকৃত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই সমাজতান্ত্রিক বা সাম্যবাদী ব্যবস্থার দিকনির্দেশ রচনা করে বা সমাজতন্ত্র বা সাম্যাবাদের মধ্যেই নিহিত রয়েছে প্রকৃত জনগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। এক কথায়ঃ সংকীর্ণ ব্যক্তিসত্তা, ব্যক্তিচিন্তা, ব্যক্তিস্বার্থ, ব্যক্তিসম্পদ, ব্যক্তিস্বাধীনতা, ব্যক্তিক্ষমতার স্থলে সমাজের সমষ্ঠিগত মানবগােষ্ঠির স্বার্থ, আর্থিক উন্নতি, গণতান্ত্রিক শাসন ক্ষমতা, স্বাধীনতা কল্যাণ-সমৃদ্ধি অর্জণের মাধ্যমে প্রত্যেক মানুষের মৌলিক মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা যে ব্যবস্থায় নিশ্চিত ও সংহত হয় সেই ব্যবস্থাকে সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদ ব্যবস্থা বলা হয়। এর অর্থ এই নয় যে, কোনাে মানুষের নিজস্ব সম্পত্তি বা স্বাধীনতা থাকবে না। প্রত্যেক মানুষ যােগ্যতার ভিত্তিতে অর্জিত সম্পত্তির উপর তার নিজের মালিকানা পূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত করার অধিকার পাবে এবং তার প্রতিভা বিকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা সে ভােগ করবে। সুতরাং সমাজতান্ত্রিক বা সাম্যবাদী সমাজে নিজস্ব সম্পত্তি বা ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার নেই এ কথা সত্য নয়। একটা মানুষ যদি তার যােগ্যতার ভিত্তিতে কাজ পায়, প্রয়ােজনানুপাতে তার যাবতীয় মৌলিক অধিকার পায় এবং রাষ্ট্রীয় প্রশাসনিক ক্ষমতায় বা সাম্যবাদী দর্শনের ভিত্তিতে যাবতীয় রাজনৈতিক স্তরে নিজের মতামত প্রদানের স্বাধীনতা পায় বা প্রতিভা বিকাশের স্বাধীনতা পায় তাহলে সেই মানুষের জীবনে আর কী চাই ? সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদ মানুষের এ অধিকারসমূহকে নিশ্চিত ও সুসংহত করে। তবে সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদ কোনাে ডগমা’ নয়। এ ব্যবস্থা।

দেশ-কাল-সমাজভেদে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে। সােভিয়েত রাশিয়া, পূর্ব। ইয়ােরােপীয়, চীন প্রভৃতি সমাজতান্ত্রিক সমাজে যেমন সমাজতন্ত্র একই পদ্ধতিতে বা নিয়মে প্রতিষ্ঠিত হয়নি, প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তার ভৌগােলিক-সামাজিক-আর্থিক ও মানুষের মানসজাত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে।  বাঙ্গালী জাতির আশা-আকাংখা, মনমানসিকতা, সামাজিক-সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক-আর্থসামাজিক ও ভৌগােলিক পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্য বিধান করে বঙ্গবন্ধু এখানে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দিকদর্শন প্রদান করেছেন। এখানে মানুষের ওপর মানুষের শােষণের কালােহাত ভেঙ্গে দেয়ার জন্যে ধাপে-ধাপে উৎপাদন উপকরণ বা উৎপাদন সম্পর্ক সমাজীকরণের কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে। প্রাথমিক স্তরে, শােষণের প্রধানতম হাতিয়ার ভূমিব্যবস্থাকে সংস্কার করার পরিকল্পনা হিসেবে পরিবার প্রতি ১০০ বিঘা জমি রাখার সিলিং বেঁধে দেয়া হয়েছে, উদ্বৃত্ত বা খাস জমি ভূমিহীনদের মধ্যে বন্টনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে জমির সিলিং আরাে কমিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। তারপর এমন একটা পর্যায়ে আসতাে যখন ভূমিব্যবস্থা জাতীয়করণ করে সমবায় ভিত্তিতে চাষাবাদের ব্যবস্থা করা হবে। এর পূর্বে ব্যক্তিমালিকানাধীন জমিকে বৃহ্য-ক্ষুদ্র খামারের অধীনে ন্যস্ত করে সমবায়ভিত্তিতে চাষাবাদের ব্যবস্থা হতাে। এ ব্যতীত শােষণের অন্যতম বৈশিষ্ট্য বৃহৎ শিল্পকলকারখানা, পরিত্যক্ত সম্পত্তি, রাষ্ট্রীয় বাণিজ্য বা যাবতীয় বৈদেশিক বাণিজ্য ব্যাংক বীমা ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান, যােগাযােগ ব্যবস্থা, পাট-চামড়া-চা ও অন্যান্য সম্পদ জাতীয়করণ করা হয়েছে। এখানে সমাজতন্ত্রের তত্ত্ব হঠাৎ করে বাস্তবায়িত করা সম্ভবপর নয় বিধায় সীমিত ব্যক্তিমালিকানা খাতকে বহাল রাখা হয়েছে। যে ব্যক্তিমালিকানা খাতে শশাষণের কোন সুযােগ নেই বা শশাষণকার্য যাতে চলতে না পারে তার জন্যে প্রয়ােজনীয় রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। মূলতঃ রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক ব্যবস্থার মতাে আর্থ-বৈষয়িক বা মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সাম্যতার নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে বাংলাদেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা প্রদান করেছেন, এ সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা তার নিজস্ব চিন্তাচেতনার ফসল – আমদানীকৃত নয়।

গ. জাতীয়তাবাদ

জাতীয়তাবাদ এমন একটা ব্যাপক গণচেতনার উজ্জীবনশক্তি বা আদর্শ যাতে অনুপ্রাণিত হয়ে বাঙ্গালী জাতি সীমাহীন আত্মত্যাগ রক্ত জীবন-মৃত্যু-দুঃখবেদনা শােকসন্তাপ-কষ্ট-অত্যাচার-নির্যাতন ও লাঞ্ছনা সহ্য করে জাতীয় স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে একটি সশস্ত্র বিপ্লবের মধ্য দিয়ে হানাদার বর্বর পাকবাহিনী ও তাদের প্রভূশক্তিসমূহকে পরাভূত করে মাতৃভূমিকে মুক্ত করে এনেছে। আর সেই জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতেই জাতির অর্থনৈতিক মুক্তি সংগ্রাম তথা একটি শোষণহীন সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার বিপ্লব সম্পন্ন হতে পারে বলেই বঙ্গবন্ধু তার চার রাষ্ট্রীয় মৌলনীতিমালার মধ্যে জাতীয়তাবাদকে স্থান দিয়েছেন। জাতীয় ঐক্য সাম্যমৈত্রী-ভ্রাতৃত্ব-শৃংখলা-সম্প্রীতি-সহমর্মিতা, পারস্পরিক ভালােবাসা শ্রদ্ধাবােধ ও সামাজিক সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সােপানই হলাে জাতীয়তাবাদ। এ ব্যতীত জাতীয় স্বাধীনতা স্বকীয়তা অহংবোেধ ও সার্বিক স্বার্থ কল্যাণ সমৃদ্ধি সুসহংত সংরক্ষিত ও প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। জাতীয়তাবাদ এমন একটা চেতনাদৃপ্ত শক্তি যা অন্য কোনাে রাষ্ট্র বা জাতির প্রভুত্ব। প্রভাব আধিপত্য ও ভীতিকে পরােয়া করে না।  জাতীয়তাবাদের ঐতিহাসিক পটভূমিকা উদ্ভব এবং এর গতিপ্রকৃতি লক্ষ্য না। জানলে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ কি এবং কেননা তা অনুধাবন করা দুরূহ বিধায় এ বিষয়ে যৎকিঞ্চিত আলােকপাত করা হলাে। জাতীয়তাবাদের ইতিহাস পর্যালােচনা করতে গিয়ে আমরা জানতে পেরেছি যে, আদিমকালে বিভিন্ন উপজাতির অগ্রসরমান ব্যক্তিকেন্দ্রিক সম্পদভিত্তিক জনগােষ্ঠী জীবনযাপনের নিরাপত্তা ও তাদের অপহরণকৃত ব্যক্তিসম্পদকে ব্যক্তিমালিকানায় ভােগদখলে রাখার লক্ষ্যে আদিম সমষ্টিগত চিন্তা ও সাম্যবাদী সমাজের গন্ডি থেকে বেরিয়ে এসে অন্যত্র একটি নিরাপদ ভৌগােলিক অঞ্চলে বসবাস করতে শুরু করে। আদিম সাম্যবাদী সমাজে বসবাসরত মানবগােষ্ঠির নির্দিষ্ট কোনাে আবাসভূমি বা আবাসস্থল ছিলাে না। এবং সে-সমাজে ব্যক্তিসত্ত্বা, ব্যক্তিচিন্তা, ব্যক্তিস্বার্থ, ব্যক্তিসম্পদ ও ব্যক্তিস্বাধীনতার কোনই অবকাশ ছিলাে না। তাই ব্যক্তিকেন্দ্রিক ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বার্থের ধারক বিশেষ মানবগােষ্ঠী তথা উপজাতীয় প্রধান, সমরপ্রধান, উৎসবপ্রধান, বাণিজ্যপ্রধান, কৃষকপ্রধান, কুটিরশিল্পপ্রধান ও অন্যান্য প্রভাবশালীগােষ্ঠীর লােকদের অন্যত্র বসবাসের প্রয়ােজন দেখা দেয়। কারণ আদিসমাজে ফিরে গেলে তাদের অর্জিত ধনসম্পদ সমাজের সমষ্টিগত মানুষের মালিকানায় দিয়ে দিতে হতাে।

এভাবে বিভিন্ন উপজাতি থেকে আগত একই চিন্তাধারণার লােকদের আগমন ঘটতে থাকে নতুন ও নিরাপদ। সামাজিক কাঠোমাের মধ্যে। এই সম্পদশালীগােষ্ঠী নিজেদের নিরাপত্তার জন্যে নিজেদের মধ্যে থেকে এবং আদি সমাজের মধ্য থেকে শক্তিমান সাহসী লােকদের সম্পদের লােক দেখিয়ে বা পারিশ্রমিকের বিনিময়ে লােকজন ক্রয় করে এ সমাজে একটি শক্তিশালী লাঠিয়াল বা সমরবাহিনী গড়ে তােলে।  কালক্রমে স্থানীয় উপজাতি ও ভিনউপজাতি থেকে আগত লােকজন একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে একই চিন্তাচেতনা ও আর্থবৈষয়িক ব্যবস্থা নিয়ে বহুকাল যাবত একত্রে বসবাস করার ফলে তাদের মধ্যে ভাবের আদান-প্রদান, আচার-ব্যবহার, ভাষা-সংস্কৃতি বিশ্বাস আত্মীয়তা সখ্যতা সম্প্রীতি সহমর্মিতা প্রভৃতি একই দৃষ্টিভঙ্গিতে গড়ে ওঠে। একইভাবে মানস ও সামাজিক রীতিনীতি গতিপ্রকৃতি পরিবেশ গড়ে ওঠে। একইভাবে তাদের মধ্যে পরােক্ষ রক্তসম্পর্কের ভিত্তিতে – পেশাগত বা একই চিন্তাধারার ভিত্তিতে জাতিসত্ত্বার উদ্ভব ঘটে। জাতীয়তাবােধের উন্মেষ ঘটতে থাকে। আর এ জাতিসত্ত্বার গর্ভ থেকেই কালক্রমে রাষ্ট্রসত্ত্বার আবির্ভাব ঘটে এক একটি অগ্রসরমান অঞ্চলকে কেন্দ্র করে। প্রাচীন গ্রীসের নগররাষ্ট্র, রােমের ট্রামভাইরেক্ট পদ্ধতি ও অন্যান্য অগ্রসরমান মানবগােষ্ঠীর বসবাস অঞ্চলে রাষ্ট্রসত্ত্বা একই নিয়মে আবির্ভূত হয়েছিলাে বলে আমরা জানতে পারি। সুতরাং জাতি ও জাতীয়তাবাদের কনসেপ্ট বা চিন্তাচেতনার ইতিহাস অতি প্রাচীন। তবে সত্যিকারার্থে জাতীয়তাবাদের সুষ্ঠু চিন্তাধারার উন্মেষ ঘটেছে উনবিংশ শতাব্দির প্রথম ধাপ থেকে। ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলােকে একইভাবে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদকেও বিচার বিশ্লেষণ করতে হবে। তবে এ কথাটা আমাদের স্মরণ রাখতে হবে যে, প্রাচীনকালে জাতিসত্ত্বার উন্মেষ ঘটেছিলাে ব্যক্তিচিন্তা ব্যক্তিসম্পদের সীমাহীন লােভ-লালসা শশাষণ ও প্রভাব প্রতিপত্তি টিকিয়ে রাখার লক্ষ্যে। আর বর্তমানে জাতীয়তাবাদের লক্ষ্য হয়ে দাড়িয়েছে বিদেশী কোনাে রাষ্ট্র বা অন্য কোনাে জাতির শাসন শােষণ আধিপত্য সম্প্রসারণ থেকে জাতীয় স্বাধীনতা স্বকীয়তাকে মুক্তকরণ এবং নিজেদের শাসন প্রতিষ্ঠাকরণ । তবে বিভিন্ন জাতির মধ্যে জাতীয়তাবাদী চিন্তাচেতনা, ধ্যান-ধারণা প্রভৃতি নির্ভর করে জাতির আশা-আকাংখা-রাজনৈতিক-আর্থসামাজিক-সাংস্কৃতিক ভাবধারা ও জাতীয় নেতৃত্বের কার্যকলাপের ওপর। সেই নেতৃত্বের কার্যক্রমের ফলে জাতি দেশী-বিদেশী শাসক শােষকদের কবলে পতিত হতে পারে অথবা শশাষণহীন সমাজও প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। আধুনিক জাতি বা জাতীয়তাবাদ মূলতঃ এ সব প্রেক্ষাপটের প্রেক্ষিতে গড়ে উঠেছে বা উঠছে। আমরা জানি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মানবগােষ্ঠী বাংলাদেশের মাটি ও ধনসম্পদের টানে এদেশে আগমন করেছে। কালক্রমে স্থানীয় ও বহিরাগত জনগােষ্ঠী এখানে নানাভাবে মিলেমিশে গিয়েছে।

তাদের পারস্পরিক বিশ্বাস আচার-ব্যবহার, আদান প্রদান, চলাফেরা, উঠাবসা, সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান ব্রত ধর্মবিশ্বাস ভাষা-সাহিত্য কৃষ্টি-সংস্কৃতি, সামাজিক রীতিনীতি, সম্পর্ক-সম্বন্ধ – আত্মীয়তা প্রভৃতি স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়াদি গড়ে উঠে কালক্রমে সর্বস্বীকৃতরূপ পরিগ্রহের মধ্য দিয়ে বাঙ্গালী জাতিসত্ত্বার উদ্ভব ঘটেছে।  ঐতিহাসিক নানান বিবর্তনের প্রক্রিয়ায়, যুগ যুগ ধরে অজস্র ঘটনাপ্রবাহের বাস্তব ফলশ্রুতিতে আবহমান বাংলার শাশ্বত চিরায়ত ঐতিহ্যের যে সুবিশাল ক্ষেত্র বা পটভূমি সৃষ্টি হয়েছে, তারই চেতনার বহিঃপ্রকাশ হলাে বাঙ্গালী জাতিসত্ত্বা বা জাতীয়তাবাদ। আমাদের ঐতিহ্য ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি সামাজিক মূল্যবােধ ও জাতীয় মানসের উত্থান এবং বাঙ্গালী জনগােষ্ঠীর মধ্যে সম্প্রীতি সহমর্মিতা-সহনশীলতা ভ্রাতৃত্ববােধ তথা বাঙ্গালী মানসের গণতান্ত্রিকবােধ ও অহংবােধ আমাদের সাম্য মৈত্রী ঐক্যকে বলিয়ান ও সংহত করেছে। তবে এ সবই হলাে হালামলের কথা। এর পূর্বে বাঙ্গালীর স্বতন্ত্র জাতিসত্ত্বা থাকলেও স্বতন্ত্র জাতি বা জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটেনি বললেই চলে। তবে জাতির কোনাে কোনাে ব্যক্তিত্ব যে জাতীয় স্বাতন্ত্রতা প্রতিষ্ঠার জন্যে প্রচেষ্টা চালাননি— তাও বলা যাবে না। ক্ষীণ কার্যক্রম বা প্রচেষ্টা যুগে যুগে চলেছে, বাঙ্গালী জাতিসত্ত্বার চিন্তাচেতনার ক্ষীণপ্রকাশ ঘটেছে। কিন্তু বিদেশী শক্তির দানবীয় থাবার ফলে তা বিকশিত হতে পারেনি। সুপ্তভাবেই বাঙ্গালীত্বের ধারা প্রবাহিত হয়ে এসেছে।  বহু শতাব্দির পরাধীনতার গ্লানি, অপমান, বিদ্রোহ ও সগ্রামের উত্তাপ এবং ১৯৪৭ সালে তথাকথিত ধর্মভিত্তিক জাতিতত্ত্বে পাকিস্তান সৃষ্টির প্রহসন এবং পাকিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলের স্বৈরাতান্ত্রিক শাসন-শােষণ, অত্যচার, নির্যাতন, অবিচার বৈষম্যমূলক আচরণ প্রভৃতি ধর্মের নামে চালিয়ে যেতে থাকলেও পূর্ব পাকিস্তানে বাঙ্গালী জাতিসত্ত্বা ও জাতিগত চেতনার জাগরণ ঘটতে থাকে। অবশ্য এর পূর্বে ভারত-পাকিস্তান প্রস্তাবের পাশাপাশি বাঙ্গালী জাতির স্বাতন্ত্রতার প্রশ্ন তুলে হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী ও শরশ্চন্দ্র বসু বৃহত্তর স্বাধীন বাংলাদেশের প্রস্তাব তুলে ধরেছিলেন। এর পূর্বে বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলনের মধ্য দিয়েও বাঙ্গালী। জাতীয়তাবাদের জাগরণ ঘটেছিলাে। কিন্তু তৎকালীন ভারতীয় নেতৃত্ব, সাম্রাজ্যবাদী বৃটিশ এবং শােষক ধর্মীয় নেতাদের কূটকৌশলে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ সুফল লাভ করতে পারেনি। পরবর্তীতে দ্বি-জাতিতত্ত্বের ধূম্রজালে বা ধর্মীয় গােড়ামীর শৃংখলে আবদ্ধ হয়ে এদেশেরই নেতৃত্বের অদূরদর্শিতা ও ব্যক্তিস্বার্থের বলির পাঠায় বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ ম্লান হয়ে যায়।  

ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের বাঙ্গালীরা অতিসম্প্রতি প্রত্যক্ষ করতে লাগলাে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক-শােষকদের স্বৈরাচারী শাসন শােষণের কার্যক্রম ও চেহারা। আর ঐ স্বৈরাচারী শাসন শােষণ বঞ্চনার শিকারে নিপতিত হয়ে জাতি বুঝতে লাগলাে তারা কি হারিয়েছে। এরপর তারা মুক্তির পথ খুঁজতে লাগলাে। আর তাদের মুক্তির পথ বাতলে দিতে এগিয়ে এলেন ছাত্র যুবনেতা শেখ মুজিবুর রহমান। তিনিই সর্বপ্রথম পাকিস্তানী শাসক শশাষকদের বিরুদ্ধে সােচ্চার হয়ে ওঠেন। ১৯৪৮ সালের ১ লা জানুয়ারী ঢাকার লালবাগে পাঞ্জাবী সৈন্যরা বাঙ্গালী পুলিশের ওপর নির্মম হত্যাকাণ্ড চালানাের প্রতিবাদে যে আন্দোলন গড়ে ওঠে তার নেতৃত্ব প্রদান করেন শেখ মুজিব। ঐ প্রতিবাদ আন্দোলনের মধ্যে ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্কের এক জনসভায় ছাত্রনেতা শেখ মুজিব তার অগ্নিক্ষরা বক্তৃতায় দ্ব্যর্থহীনভাষায় ঘােষণা করেনঃ ‘আপনাদের অত্যাচার নির্যাতন বন্ধ করুন। বাঙ্গালী হত্যার বিচার করুন, নইলে এই দেশে আপনাদের থাকতে দেয়া যাবে কিনা তা আমাদের ভাবতে হবে। ঐ জনসভায় তিনি সর্বপ্রথম মুসলিম লীগের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ ঘটান। অন্যান্য ছাত্র যুবনেতারা – সাধারণ ছাত্রজনতাও তাকে অনুসরণ করলাে। এভাবেই বাঙ্গালীত্বের জাগরণ সূচিত হলাে। ১৯৪৮ সালের ৪ ঠা জানুয়ারী মুজিবের নির্দেশে ও পৃষ্ঠপােষকতায় “ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে বাঙ্গালী জাতিসত্ত্বার স্ফুরণ ঘটলাে। | বাঙ্গালী জাতিসত্ত্বার ফ্রণ আরাে চেতনাদৃপ্ত হলাে বিশেষ করে ১৯৪৮ সালে যখন আমাদের মাতৃভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি-কৃষ্টির ওপর পাকিস্তানী শাসক শশাষকগােষ্ঠীর প্রভূপুরুষ গভর্নর জেনারেল মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ স্বয়ং আঘাত হানেন। সেই আঘাতের জবাব-প্রতিঘাত ও প্রতিশােধের জ্বালা এবং জাতীয়তাবােধের ঐতিহাসিক ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ জাতীয় মান-মর্যাদা-সম্রমে অনুপ্রাণিত ও উজ্জীবিত হয়ে বাঙ্গালী নতুন করে ভাবতে শুরু করে। বাঙ্গালীর জাতীয় অহংবােধ ক্রমান্বয়ে জাগ্রত হতে হতে এমন একটা পর্যায়ে উপনীত হয় যখন জাতিগত আশাআকাংখা-স্বার্থ প্রতিষ্ঠিত করা এবং বিদেশী শাসন শােষণ পীড়ণ থেকে নিজেদের মুক্ত করার একটিই মাত্র পথ খােলা থাকে তাহলাে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার তথা জাতীয় স্বাধীনতা অর্জন। জাতীয় স্বাধীনতা ও জাতীয় মুক্তির মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে শত অত্যাচার-নির্যাতন-নিপীড়ন সহ্য করে, ত্রিশলক্ষ বাঙ্গালীর বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বাঙ্গালী জাতি প্রাণপ্রিয় জাতীয় স্বাধীনতাকে অবর্ণনীয় বেদনা ও সীমাহীন জয়ােল্লাসের মধ্য দিয়ে বিশ্বমানচিত্রে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এই যে জাতিগত সংগ্রামের বিজয়, এটাই হলাে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের ফলশ্রুতি। এই যে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের ঐতিহাসিক উজ্জীবন, এটা হঠাৎ করে একদিনে একটি ঘটনার কারণে উথিত হয়নি। এর পেছনে রয়েছে বহু যুগের সংগ্রামী পটভূমিকা ও ২৩ বছরের নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম।

আর এই ২৩ বছরের সগ্রামের উদ্গাতা-প্রাণপুরুষ হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চ ঢাকার কার্জন হলে আয়ােজিত সমাবর্তনানুষ্ঠানে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল, পাকিস্তানের জাতির জনক উর্দুভাষী (যে উর্দুভাষা পাকিস্তানের জনসংখ্যার মাত্র ৪% লােকের ভাষা) মােহম্মদ আলী জিন্নাহ পাকিস্তানের ৫৬% ভাগ জনগণের মাতৃভাষা বাংলাকে উপেক্ষা করে তাদের ওপর উর্দুভাষ চাপিয়ে দিয়ে এদেশের জনগণকে নতুন করে উপনিবেশিক শাসনশােষণের জাঁতাকলে পিষ্ট করার হীনলক্ষ্য সদর্পে ঘােষণা করলেনঃ উর্দু, একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। আর সঙ্গে সঙ্গেই এদেশের ছাত্র-যুবক-জনতার কণ্ঠস্বর সংগ্রামী শেখ মুজিব বজ্রকণ্ঠে প্রতিবাদ জানিয়ে বলে উঠলেনঃ ‘না, না! বাংলাই হবে রাষ্ট্রভাষা।’ সেই সাথে তার অনুসারী ছাত্র যুবক-জনতাও প্রতিবাদে সােচ্চার হয়ে উঠলাে। এভাবেই মাতৃভাষাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদের প্রথম সাংগঠনিক বিস্ফোরণ ঘটলাে, বাঙ্গালীর স্বকীয়তার প্রকাশ ঘটলাে। আর এর পূর্ণাঙ্গতার রূপ পরিগ্রহ করলাে ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারী পাকিস্তান সরকারের নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গন—বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষায় প্রতিষ্ঠিত করার আন্দোলনে রফিক, জব্বার, বরকত, সালাম, শফিকসহ নাম-না-জানা শহীদদের আত্মাহুতির মধ্য দিয়ে। রাষ্ট্রভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নেতাও ছিলেন শেখ মুজিব । তিনি তখন এ আন্দোলনের কারণে কারাগারে বন্দী। সহকর্মীদের আইনভঙ্গ আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়ার নির্দেশ দিয়ে তিনি কারাগারে আমরণ অনশন ধর্মঘটে অংশগ্রহণ করেন। এ আন্দোলনের চাপে নত হয়ে শাসকগােষ্ঠী বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। এভাবেই বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের প্রাথমিক বিজয় সূচিত হলাে। তাই বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ হলাে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ। আর এর সাথে যুক্ত বাংলার শাশ্বত চিরায়ত আচার-ব্রত, সামাজিক-সাংস্কৃতিক-আত্মিক পেক্ষাপট তথা জাতীয় স্বকীয়তা ও আত্মশাসনের দুর্দমনীয় স্পৃহা বা বিদেশী শাসন-শােষণ ও মােড়লিপনা থেকে সার্বিক মুক্তির আকাংখা। অর্থাৎ বাঙ্গালী জাতির স্বাধীনতা বা আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার, অর্থনৈতিক মুক্তি এবং বাংলা ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিল্পকলা-কৃষ্ঠির সার্বিক স্বাধীন সমন্বিত প্রেক্ষাপটে প্রােথিত বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ। বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদে উজ্জীবিত হয়ে ষাটের দশকে বাঙ্গালী হৃদয়ের পরম পূজ্য কবিগুরু রবীন্দ্রনাথকে হটিয়ে উর্দু-ফার্সী কবি ইকবালকে এখানে প্রতিষ্ঠিত করার শাসক-শােষক ও তাদের তাবেদার গােষ্ঠীর ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে বাঙ্গালী ছাত্র-যুবকবুদ্ধিজীবী-জনতা সংগ্রাম করেছে। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে তথাকথিত ‘ইসলামী কবি’ বানানাের হীনপ্রচেষ্টার বিরুদ্ধে বাঙ্গালী প্রতিবাদ করেছে।

এই দুই মহান মানবতাবাদী কবি, সাম্যের কবি তাদের কবিতা-সংগীতলেখনীতে বাঙ্গালী জাতিকে আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিশেবে পৃথিবীর সামনে তুলে ধরেছিলেন, বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী চিন্তাচেতনাকে জাগিয়ে তুলেছিলেন। তাই শাসকগােষ্ঠী এই দুই মহান কবিকে বাঙ্গালীমানস থেকে মুছে ফেলার জন্যে প্রকারান্তরে তাদেরকে অপদস্ত ও হেয় প্রতিপন্ন করার জন্যে নানান অপপ্রয়াস চালিয়ে ছিলাে। এ ব্যতীত বিপ্লবী ক্ষুদিরাম, সূর্যসেন, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, কবি সুকান্ত, শরবসু, সােহরাওয়ার্দী, ফজলুল হক, নেতাজী সুভাষ বসু-ইতিহাসের নবাব সিরাজদৌল্লা, মােহন লাল, মীরমদন, মীরকাশিম প্রমুখ বিপ্লবী বাঙ্গালী চেতনার পুরুষদের প্রতি শাসক-শােষকগােষ্ঠীর সীমাহীন অবজ্ঞা ও ঘৃণার দৃষ্টি কাজ করেছিলাে। কারণ তাদের জীবন দর্শন ও কার্যক্রমের মধ্যে বাঙ্গালীত্বের বহি:প্রকাশ তথা বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের প্রকাশ ঘটেছিলাে। বাঙ্গালী জাতি জাতীয় দুর্যোগে তাদের জীবন থেকে অনুপ্রেরণা লাভ করে থাকে। বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের পূর্ণপ্রকাশ ঘটে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে। তিনিই বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের উদ্গাতা। তাকে কেন্দ্র করেই বাঙ্গালী জাতি নতুন উদ্যমে, নতুন চেতনায় নিজেদের ঠিকানার সন্ধান লাভ করে। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু বাঙ্গালী জাতির স্বাধিকার বা স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যে ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবীর আন্দোলন শুরু করেন তার মধ্যে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের প্রসন্ন প্রকাশ ঘটে। শাসক-শােষকগােষ্ঠী ৬ দফার বিরুদ্ধে অন্ত্রের হুমকী প্রদান করে। ৬ দফার দাবী প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে বাঙ্গালীজাতির মধ্যে বিপুল উৎসাহ ও বৈপ্লবিক মনােভাব সৃষ্টি হতে থাকলে শাসক-শােষকগােষ্ঠী বাঙ্গালীর দাবীকে, আন্দোলনকে বানচাল করে দেশবাসীর দৃষ্টি ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার লক্ষ্যে তারা ১৯৬৬ সালের ৮ই মে বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তান প্রতিরক্ষা আইনের ক্ষমতাবলে গ্রেফতার করে কারান্তরালে নিক্ষেপ করে। অবশেষে তাঁর বিরুদ্ধে কুখ্যাত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ফেদে বাঙ্গালীর স্বাধিকার এবং জাতীয়তাবাদী জাগরণকে চিরতরে নিস্তব্ধ করে দিতে অপচেষ্টায় মেতে উঠলে বাঙ্গালী জাতির মধ্যে প্রবল বিদ্রোহ দানা বেঁধে ওঠে এবং তা অবশেষে প্রবল গণ-অভ্যুত্থানের রূপ নেয় এবং এভাবেই বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের মহাজাগরণ সূচিত হলাে। বাংলাদেশের টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত ৬৮ হাজার গ্রাম থেকে শ্লোগান উঠলােঃ জেগেছে জেগেছে বাঙ্গালী জেগেছে, তােমার আমার ঠিকানা পদ্মা – মেঘনা-যমুনা, তােমার দেশ আমার দেশ বাংলাদেশ, জেলের তালা ভাঙবাে শেখ মুজিবকে আনবাে, আগরতলা মামলা তুলে নাও, জয়বাংলা’ ইত্যাদি।

১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক বিজয়ের মধ্য দিয়ে ‘জয়বাংলা’ শ্লোগান আমাদের জাতীয় শ্লোগানে পর্যবশিত হলাে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের বিজয় মানে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের বিজয়। কিন্তু নির্বাচনের রায় বানচাল করে দিতে শাসকগােষ্ঠী নানান তালবাহানার আশ্রয় নিলে বাঙ্গালী জাতি বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। চারদিক থেকে শ্লোগান উঠলােঃ পাকিস্তানকে লাথি মারাে বাংলাদেশ স্বাধীন করাে, মুজিব তুমি এগিয়ে চলাে আমরা আছি তােমার সাথে, বীর বাঙ্গালী অস্ত্র ধরাে বাংলাদেশ স্বাধীন করাে। ১৯৭১ সালের ১লা মার্চ থেকে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক অসহযােগ আন্দোলন শুরু হলাে। ২৫ শে মার্চ পাকবাহিনী বাঙ্গালী জাতিকে চিরতরে খতম করার লক্ষ্যে বাঙ্গালী জাতির। ওপর অতর্কিতে ঝাপিয়ে পড়লে তৎক্ষণাৎ বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করেন। বাঙ্গালী জাতি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে নির্দেশে ও নামে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নেয়। এভাবে জাতীয়তবাদের অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে রক্তাক্ত বিপ্লবের। পথ বেয়ে বাঙ্গালী জাতি মাত্র ৯ মাসের মধ্যে পাকবাহিনীকে পরাজিত করে জাতীয় স্বাধীনতার রক্তিম সূর্যকে ছিনিয়ে আনে।

এভাবেই ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন আন্দোলন ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ সমৃদ্ধশালী ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, আর ‘জয়বাংলা’ শ্লোগান ও বঙ্গবন্ধু’ই হলাে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের স্বারক-প্রতীকসত্ত্বা। বাংলাদেশের জাতীয় স্বাধীনতা অর্জনের পর জাতীয়তাবাদী চেতনার সম্প্রসারণ ঘটলাে সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে জাতীয় সংবিধানের মধ্যে স্বীকৃতি দেয়ার মাধ্যমে। অর্থাৎ বলা যায় জাতীয়তাবাদের সার্বিক চেতনাকে উপরােক্ত বৈশিষ্ট্যের মধ্যে প্রবাহিত করে দেশ গঠনের বা স্বাধীনতাকে অর্থবহ করার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু জাতীয়তাবাদকে শক্তিশালী হাতিয়ার হিশেবে প্রতিষ্ঠিত করে অর্থনৈতিক মুক্তিসংগ্রামের সােপান সৃষ্টি করেছিলেন। এ কারণেই গণতন্ত্র তাে বটেই, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার মধ্য দিয়ে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদকে আরাে শক্তিশালী, সমৃদ্ধশালী পরিবর্ধন ও শ্রীবৃদ্ধি করা হয়েছে। এই জাতীয়তাবাদের চেতনাদৃপ্ত শক্তিকে জাতীয় অর্থনৈতিক মুক্তির বিপ্লবের প্লাটফরম বাকশাল’ এর অন্যতম প্রধান হাতিয়ার হিশেবে গ্রহণ করা হয়েছে। | বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদকে চির প্রবহমান করার লক্ষ্যে শােষিত বঞ্চিত দীন-দুঃখী মেহনতী বাঙ্গালীকে একটি একক তথা সর্বশ্রেণী বা সর্বপেশাভিত্তিক জাতীয় রাজনৈতিক দলে একীভূত করে তাদের জন্যে, তাদের দ্বারা এবং তাদের দিয়ে গঠিত সরকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তাদেরই ‘গণতান্ত্রিক একনায়কত্ব’ শাসন প্রতিষ্ঠা। তথা একটি শােষণহীন সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার যাবতীয় রাজনৈতিক, আর্থসামাজিক , প্রশাসনিক ও বিচার বিভাগীয় বৈপ্লবিক কর্মসূচি বঙ্গবন্ধু গ্রহণ করেছিলেন এবং বঙ্গবন্ধু নির্দেশিত পথেই কেবল বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী চেতনাকে সুপ্রতিষ্ঠিত, সংরক্ষিত ও সুসংহত করা সম্ভব বলে আমরা মনে করি।

ঘ, ধর্মনিরপেক্ষতা

ধর্মনিরপেক্ষতা হলাে পবিত্র কোরান, ইসলাম, গণতন্ত্র ও আধুনিক বিজ্ঞানভিত্তিক সাম্যবাদের অন্যতম প্রধান শিক্ষা। অতএব ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয় বা নাস্তিকতাবাদ নয়। ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থঃ প্রচলিত সকল ধর্মের প্রতি সহনশীলতা, সকল ধর্মের পবিত্রতা সংরক্ষণ এবং কোনাে ধর্মের প্রতি পক্ষপাত, কারাে ধর্মের ওপর হস্তক্ষেপ বা ধর্ম নিয়ে রাজনৈতিক ব্যবসা—ছলচাতুরী, জুয়াখেলা, প্রতারণা, শঠতা, বাড়াবাড়ি, হানাহানি, অন্যায়, জুলুম, শশাষণ ইত্যাদি নয়। সামাজিক সাম্য মৈত্রী ঐক্য ভ্রাতৃত্ব সম্প্রীতি সহমর্মিতাবােধ, শৃংখলা প্রতিষ্ঠা-সংরক্ষণ ও সংহত  করাই হলাে ধর্মনিরপেক্ষতার লক্ষ্য। প্রতিটি ধর্ম তার অনুসারীদের অস্থি-মজ্জারক্ত-মাংস ও চিন্তা-চেতনা, মন-মানসিকতার সাথে এমনভাবে মিলেমিশে গেছে যে, মানুষ তার সুখ-শান্তি, দুঃখ-কষ্ট-অভাব-দারিদ্রতা, অসংগতি-হতাশা ইত্যাদি যাবতীয় ক্ষেত্রে ধর্মকেই আশ্রয়স্থল মনে করে। ধর্মের মধ্যেই মানুষ ইহজাগতিক ও পারলৌকিক যাবতীয় শান্তির লক্ষ্যেই সান্ত্বনা খুঁজে নিতে চায়। প্রত্যেক মানুষ যাতে তার শান্তির লক্ষ্যে সান্ত্বনা পাওয়ার জন্যে নিজ নিজ ধর্ম বিশ্বাস-আচারঅনুষ্ঠান-ব্রত স্বাধীনভাবে পালন করতে পারে সেটাই হলাে ধর্মনিরপেক্ষতার অন্যতম মূল লক্ষ্য। তবে ধর্মকে কোনাে অবস্থাতেই রাষ্ট্রীয় শাসনতন্ত্র ও জাতীয় রাজনীতিতে টেনে আনা যাবে না। মনে রাখতে হবে, এই বাংলাদেশ কোনাে ধর্মীয় সম্প্রদায় তথা এককভাবে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খৃষ্টানের নয়। সকল ধর্মভিত্তিক সম্প্রদায়ের লােকদের সম্মিলিত একক মাতৃভূমি এই বাংলাদেশ। সম্মিলিতভাবে আমরা এদেশকে পাকিস্তানের শাসন-শােষণ থেকে মুক্ত করেছি। আর এর মূলেই এ সম্মিলিত সংগ্রামের মূলেই ছিলাে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ। ধর্মনিরপেক্ষতার চিন্তাচেতনা ধ্যান-ধারণা ও আদর্শই কেবলমাত্র বিভিন্ন ধভিত্তিক সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্য-সাম্য-মৈত্রী-সহযােগিতা-সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্ববােধ সৃষ্টি করতে পারে, যেমন করেছিলাে ১৯৭১ মুক্তিযুদ্ধকালে। জাতীয় ঐক্যই হলাে। জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক। ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শে একতাবদ্ধ জাতিকে কোনাে শক্তিই পরাজিত করতে পারে না। জাতির সম্মিলিত কর্মপ্রচেষ্টার ভিত্তিতেই কেবলমাত্র একটি সমৃদ্ধশীল জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।

এই পেক্ষাপটে বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতির মূল বৈশিষ্ট্য হলাে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা। তবে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শই একটি শ্রেণীহীন, স্তরহীন, শােষণহীন, বিবাদহীন গণতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদী সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অন্যতম প্রদান ভূমিকা পালন করে থাকে। এ বিষয়ে সন্দেহের কোনাে অবকাশ নেই। ধর্ম যেহেতু মানবসমাজে সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক জাতিসত্ত্বার ধ্যান-ধারণার উন্মেষ ঘটিয়ে জাতীয় সার্বিক ঐক্য ও জাতীয়তাবাদকে ক্ষুন্ন করে, যার প্রমাণ আমরা পেয়েছি ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের সৃষ্ট পাকিস্তান কাঠামাের মধ্যে। পাকিস্তান কাঠামাের মধ্যে ধর্মের নামে স্বৈরতান্ত্রিক শাসন-শােষণ-বৈষম্য-অত্যাচার-নির্যাতন নিপীড়ন-ব্যভিচার-বর্বরতা-পৈশাচিকতা-প্রতারণা-শঠতা, ইত্যাদি জঘন্য কার্যকলাপ। বাঙ্গালী জীবনের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে যার প্রতিবাদে বিক্ষোভে প্রতিরােধে অপমানের প্রতিকারে আমরা ভাষাভিত্তিক একই ভৌগােলিক জাতীয়তাবাদের আদর্শে উদ্বুদ্ধ ও উজ্জীবিত হয়ে, শত অত্যাচার-নির্যাতন-রক্তপাত-জীবনপাত ও ত্যাগতিতিক্ষার মধ্য দিয়ে চাপিয়ে দেয়া এক সর্বাত্মক যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদকে পদদলিত করে বাংলাদেশকে মুক্ত করেছি। এই বিদেশী শাসন শোষণ থেকে মুক্ত বাংলাদেশে যেহেতু বিভিন্ন ধর্মভিত্তিক সম্প্রদায় একসাথে সবাস করছে সেহেতু রাজনৈতিক বা রাষ্ট্রীয় শাসনতান্ত্রিক নীতিমালায় একটি বিশেষ ধর্মকে বা ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে প্রশ্রয় দিলে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা নিদারুণভাবে ক্ষুন্ন হতে বাধ্য। এতে করে জাতীয় ঐক্য, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হয়ে পড়বে বিপন্ন। পরিণামে ধর্মকে কেন্দ্র করে দেশ একটি গৃহযুদ্ধ হানাহানি মারামারি ও হিংসা-বিদ্বেষের তিমিরে হাবুডুবু খাবে, বিদেশী কোনাে শক্তি এর সুযােগে দেশকে গ্রাস করে ফেলবে। সুতরাং দেশ-জাতি ও স্বাধীনতার সার্বিক সংরক্ষণ সংহতি সমৃদ্ধি ও কল্যাণের লক্ষ্যে ধর্মনিরপেক্ষতাকে প্রতিষ্ঠিত করা ব্যতীত অন্য কোন গত্যন্তর নেই।  তাছাড়া ধর্মভিত্তিক জাতি বা রাষ্ট্র কস্মিনকালে কোথাও হয়নি বা হলেও স্থায়ী হয়নি। এমন কি খােদ আরববিশ্বে একই ভাষা, একই সংস্কৃতি, সাহিত্য, কৃষ্টি, শিল্পকলা আচার-ব্যবহার পােশাক-পরিচ্ছদ-সর্বোপরি একই ধর্ম, একই সামাজিক অর্থনৈতিক, একই ভৌগােলিক জলবায়ু প্রভৃতি বৈশিষ্ট্যের মধ্যে লালিত-পালিত ও একই মন-মানসিকতার ঐতিহ্যে বন্ধনে আবদ্ধ থাকার পরও আরব বিশ্বের জনগণ একটি অভিন্ন জাতি-রাষ্ট্র-শাসন ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারেনি। কোনােকালে পারবে কিনা তাতে সন্দেহ রয়েছে।

আরব তথা মুসলিম বিশ্বের বকধার্মিক গোড়া শাসক-শােষকদের শাসিত তথাকথিত ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র বা শাসন ব্যবস্থার পাশাপাশি অন্যান্য মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জনাব্যুষিত রাষ্ট্র যেমন-ইরাক, সিরিয়া, মিশর, তুরস্কো, লেবানন, আলজেরিয়া, নাইজেরিয়া, আফগানিস্তান, ইয়েমেন (উত্তর), ইন্দোনেশিয়া, ফিলিস্তিন, বাংলাদেশ (বঙ্গবন্ধুর আমলে) প্রভৃতি রাষ্ট্রে ধর্মনিরপেক্ষতাকে গ্রহণ করেছে। সুতরাং ধর্মভিত্তিক জাতি বা রাষ্ট্র প্রগতিশীল। মানবসমাজে পুরােপুরি অচল বলে প্রমাণিত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরানের কতিপয় বাণী উল্লেখ করতে হয়। যেমন ঃ যার ধর্ম। তার তার কাছে; ধর্মের ব্যাপারে কোনাে জবরদস্তি নেই; কোন ধর্ম সঠিক, কোন ধর্ম বেঠিক তা নির্ণয়ের ভার একমাত্র আল্লাহর ওপর এবং মুসলমান, খৃস্টান, ইহুদী, পলিথিস্ট, সেবিয়ান, মেজিয়ানস, স্ক্রিপচার্স এবং অন্যান্য এবং যিনি এক আল্লাহ ও শেষ বিচারের দিনে বিশ্বাস করেন তাদের কোনাে ভয় নেই, নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদেরকে পুরস্কৃত করবেন।’ এভাবে পবিত্র কোরান ধর্মনিরপেক্ষতার সপক্ষে বক্তব্য রেখেছেন। মহানবীর শাসনের ১০ বছর এবং খেলাফতে রাশেদীনের শাসন ব্যবস্থার মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি পুরােপুরি মেনে চলা হয়েছিলাে। অই সামাজিক সাংস্কৃতিক ও রাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থার মধ্যে ধর্মকে টেনে আনা কোনাে প্রকারেই যুক্তিযুক্ত নয়। শোষণহীন সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বার্থেই। ধর্মনিরপেক্ষতাকে ধরে রাখতে হবে। সুতরাং উপরােক্ত কারণেই বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের শাসনতান্ত্রিক মৌলনীতিমালার মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতাকে সযত্বে স্থান দিয়েছেন। তবে ব্যক্তিজীবনে যে কেউ যে কোনাে ধর্মকর্ম পালন করতে পারবে, কেউ কারাে ধর্মের প্রতি আঘাত বা অবজ্ঞা প্রদর্শন করতে পারবে না, বা কোনাে ধর্মীয় সম্প্রদায় কর্তৃক অন্য কোনাে সম্প্রদায় আক্রান্ত না হয় তার জন্যে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কঠোর বিধিনিষেধ আরােপ করা হয়েছে। কারণ ধর্মনিরপেক্ষতার মধ্যেই নিহিত রয়েছে প্রকৃত গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্রের বীজ।  উপরােক্ত রাষ্ট্রীয় চার মৌলনীতিমালা পৃথক পৃথকভাবে বিশ্লেষণ করে আমরা বুঝতে পেরেছি যে, এই চারটি মৌলনীতি—প্রত্যেকটি প্রত্যেকটির সাথে সুসম্বন্ধ ও সুসংঘবদ্ধ। একটাকে বাদ দিয়ে অপর ক’টি মূল্যহীন। এই চার মৌলনীতির সুসম্বন্ধ ও সুমন্বয়ের মাধ্যমেই বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক, আর্থসামাজিক, প্রশাসনিক দর্শন ও কর্মসূচি প্রণীত হয়েছে। আর এই দর্শন কর্মসূচি বাস্তবায়িত করার জাতীয় প্লাটফরম হিশেবে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ’ বা বাকশাল সংগঠনের উদ্ভব হয়েছে। 

সূত্র : বঙ্গবন্ধু-দ্বিতীয় বিপ্লবের রাজনৈতিক দর্শন – আবীর আহাদ

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!