বঙ্গবন্ধুর একটি বিশেষ সাক্ষাৎকার
আবীর আহাদ ঃ বঙ্গবন্ধু, আপনার রাজনৈতিক চিন্তাধারার মূলনীতি বা লক্ষ্য কি?
বঙ্গবন্ধু – আমার রাজনৈতিক চিন্তাচেতনা ধ্যান ও ধারণার উৎস বা মূলনীতিমালা হলাে গণতন্ত্র সমাজতন্ত্র জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা। এই চার মূলনীতিমালার সমন্বিত কার্যপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে একটি শােষণহীন সমাজ তথা আমার দেশের দীন দুখী শশাষিত বঞ্চিত শ্রমজীবি মেহনতী মানবগােষ্ঠীর মৌলিক মানবাধিকার ও তাদের সমষ্ঠিগত প্রকৃত গণতান্ত্রিক একনায়কতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠাকরণই আমার রাজনৈতিক চিন্তাধারার একমাত্র লক্ষ্য। আবীর আহাদঃ বঙ্গবন্ধু, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র কি একযােগে বা পাশাপাশি চলতে পারে। বঙ্গবন্ধু যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা আমাদের দেশে প্রচলিত আছে তাকে সংখ্যালঘু ধনিক শােষকদের গণতন্ত্র বলাই শ্রেয়। এর সাথে সমাজতন্ত্রের বিরােধ দেখা দেয় বৈকি। তবে ‘গণতন্ত্র’ চিনতে ও বুঝতে আমরা ভুল করি। কারণও অবশ্য আছে। আর তাহলাে শােষকসমাজ গণতন্ত্র পূর্ণভাবে বিকাশলাভ করুক তা চায় না। এবং গণতন্ত্রকে কিভাবে নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার হাতিয়ারে পরিণত করা যায়—এখানে চলে তারই উদ্যোগ আয়ােজন। এভাবেই প্রকৃত গণতন্ত্রকে ধামাচাপা দিয়ে রাখা হয়েছে। সাধারণ অজ্ঞ জনগণই শুধু নয় তথাকথিত শিক্ষিত সচেতন মানুষও প্রচলিত আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থায় গণতন্ত্রকে সঠিকভাবে বুঝতে অক্ষম। এঁরা ভাবে যে, ভােটাভুটিই হলাে গণতন্ত্র । একটু তলিয়ে দেখে না প্রাপ্তবয়স্ক মােট জনসংখ্যার কতাে পার্সেন্ট লােক ভােট দিলাে, কোন শ্রেণীর লােকেরা নির্বাচনী প্রতিযােগিতায় অবতীর্ণ হলাে, কারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় গেলাে, ক্ষমতাসীনরা কোন পদ্ধতিতে তাদের শাসন করছে, সাধারণ জনগণ কতােটুকু কী পাচ্ছে। সুতরাং আমি আমার অভিজ্ঞতার আলােকে বলছি—প্রচলিত গণতন্ত্রের বদৌলতে সমাজের মাত্র ৫% ভাগ লােকের বা প্রভাবশালী ধনিকশ্রেণীর স্বৈরাচারী শাসন ও বল্গাহীন শােষণকার্য পরিচালনার পথই প্রশস্ত হচ্ছে। অর্থাৎ প্রচলিত গণতন্ত্রের মারপ্যাচে সমাজের নিম্নতম সংখ্যালঘু জনগােষ্ঠীর শাসন ও প্রভাব প্রতিপত্তি, সর্বপ্রকার দুর্নীতি শােষন অবিচার অত্যাচার ও প্রতারণায় সমাজের সর্ববৃহত্তম অজ্ঞ দুর্বল মেহনতী কৃষক-শ্রমিক সাধারণ মাগােষ্ঠীর (শতকরা প্রায় ৯৫ ভাগ) মৌলিক মানবাধিকার ও তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব হচ্ছে। তারা বঞ্চিত হচ্ছে। প্রকৃত গণতন্ত্র’ বলতে আমি এমন একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে বুঝি, যে ব্যবস্থায় জনগণের বৃহত্তর সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের বৃহত্তর কল্যাণের নিমিত্তে তাদের জন্যে, তাদের দ্বারা এবং তাদের স্বশ্রেণীভুক্ত নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দিয়ে গঠিত সরকার প্রতিষ্ঠার ভেতর দিয়ে তাদেরই প্রকৃত শাসন ও আর্থসামাজিক মৌলিক অধিকার সংরক্ষিত হয়।
কিন্তু এই ব্যবস্থা প্রচলিত গণতান্ত্রিক উপায়ে অর্জিত হতে পারে না। কারণ প্রচলিত গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে চলে অর্থ সম্পদের অবাধ ও মুক্ত প্রতিযােগিতা। এ ক্ষেত্রে দরিদ্র জনসাধারণের পক্ষে এ জাতীয় আর্থপ্রতিযােগিতায় অবতীর্ণ হওয়া কোনাে প্রকারেই সম্ভব নয়। একমাত্র সমাজতান্ত্রিক পদ্ধতিই এদেরকে রাজনৈতিক প্রতিযােগিতায় অংশগ্রহণের কার্যকরি নিশ্চয়তা দিতে পারে তাদের আর্থসামজিক মৌলিক মানবাধিকার ও তাদের প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। এ জন্যে আমি মনে করি প্রকৃত গণতন্ত্রের আরেক নাম সমাজতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্রের মধ্যেই প্রকৃত গণতন্ত্র নিহিত। তবে জনগণের গণতান্ত্রিক চেতনাবোধ হতেই সমাজতন্ত্রের উত্তরণ ঘটে। এ জন্যেই আমি গণতান্ত্রিক উপায়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলেছি। আমি মনে করি প্রকৃত গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্রের ভেতর কোনাে বিরােধ নেই। আবীর আহাদ : বঙ্গবন্ধু, আপনার চার মূলনীতিমালার উৎস কি? অনেকে বলে থাকেন আপনার গৃহীত চারটি মূলনীতি নাকি পশ্চিমা ধনতান্ত্রিক বিশ্বের ইতিহাস সভ্যতা ও ঐতিহ্য থেকে উথিত। তবে এগুলাে আপনার মূলনীতি হয় কী করে—একটু খুলে বলবেন কি? বঙ্গবন্ধু : এ জাতীয় প্রশ্নই আমি আশা করেছিলাম। আমার গৃহীত চারটি মূলনীতি ইতিহাস সভ্যতা ও ঐতিহ্যের ফসল বৈকি। এগুলাে আমার নিজসৃষ্ট দর্শন নয়। তবে এগুলাে পশ্চিমা ধনতান্ত্রিক বিশ্ব থেকে উখিত তা যেমন সত্য নয়তেমটি ওগুলাের আবিষ্কারক বা সৃষ্টিকর্তা বলতে নির্দিষ্ট কোনাে ব্যক্তিমানুষের একক কোনাে কৃতিত্বও নেই। নানান ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে এগুলাে সমাজের বুকে উঠে এসেছে তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে। তবে ব্যক্তির দ্বারাই এ সব তত্ত্ব সমাজে প্রয়ােগ হয়ে থাকে সমাজের বাস্তব অবস্থার প্রেক্ষাপটে বলে আমি মনে করি।
এ প্রেক্ষিতে মরগান থেকে তােমাকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি ঃ Objective conditions govern the thinking process of man- wote 71697 বাস্তব অবস্থাই মানুষের চিন্তাধারাকে নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত করে থাকে। …. আদিকালে প্রাকৃতিক নৈসর্গিক প্রতিকূল অবস্থা ও বিরাটকায় হিংস্র জীবজন্তুর আক্রমণ থেকে ক্ষুদ্র দলবদ্ধ মানবগােষ্ঠী নিজেদের অস্থিত্ব বজায় রাখার তাগিদে সংঘবদ্ধভাবে চলাফেরা, আহার-বিহার ও বসবাস করতে বাধ্য হয়। তৎকালীন প্রাকৃতিক সামাজিক পরিবেশে একার পক্ষে বিচ্ছিন্নভাবে ব্যক্তিসত্তা ও ব্যক্তিস্বাধীনতা নিয়ে জীবন নির্বাহ করা একেবারেই সম্ভব ছিলাে না। ফলে ব্যক্তিচিন্তা ব্যক্তিস্বার্থ বা ব্যক্তিসম্পদের ভােগদখল বা ব্যক্তিলােভ-লালসার কোনাে অবকাশ ছিলাে না। প্রাকৃতিক পরিবেশগত সামাজিক কারণেই তারা সমষ্টিগত বা যৌথভাবে তাদের প্রাত্যহিক কার্যপ্রণালী সম্পাদন করতাে। এই সব প্রাকৃতিক বাস্তব অবস্থার প্রেক্ষিতে তাদের মধ্যে এ সামাজিক স্তরে তাই শ্ৰেণীসত্তার উদ্ভব ঘটেনি। খাদ্য ও সামান্য আনুষঙ্গিক জীবননির্বাহের সামগ্রীর পরিমাণ এতােই নগণ্য ছিলাে যে, তা দিয়ে জীবন রক্ষাই করা ছিলাে দুরুহ। ফলশ্রুতিতে বাড়তি বা উদ্বৃত্তসম্পদ বলতে কিছুই ছিলাে না। কারণ ব্যক্তিমালিকানাই (যে ব্যক্তিমালিকানাকে হাতিয়ার করে শােষণের পথ রচিত হয়।) হলাে সকল প্রকার দুর্নীতি ও শোষণের প্রধানতম উপায় সেই ব্যক্তিমালিকানাই ছিলাে এ স্তরে অজানা।
খাদ্য সংগ্রহ করার লক্ষ্যে ও নানান প্রতিকূল পরিবেশ থেকে নিজেদেরকে নিরাপদে রাখার লক্ষ্যে তারা যাযাবর জীবনযাপন করতাে। তাই তাদের নির্দিষ্ট আবাসভূমি বা রাষ্ট্র ছিলাে না। এ স্তরে তাদের মনে আল্লাহ বা ধর্ম বলতে কিছুই ছিলাে না। অর্থাৎ আদিমকালে মানুষের মধ্যে কোনাে শ্রেণী স্তর শােষণ রাষ্ট্র ও ধর্ম ছিলাে অজানা, অজ্ঞাত। এই যে সামাজিক স্তর –এটাকেই ইতিহাসে ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে আদিম সাম্যবাদী সমাজ হিশেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কালক্রমে মানবগােষ্ঠী বেঁচে থাকার তাগিদে সীমাহীন কঠোর প্রচেষ্টা চালিয়ে নানান কলাকৌশল ও হাতিয়ারের সাহায্যে প্রাকৃতিক প্রতিকূল পরিবেশ ও হিংস্র জীবজন্তুকে প্রতিহত করার ব্যবস্থা করতে সক্ষম হতে থাকে এবং খাদ্যসহ অন্যান্য দ্রব্যসামগ্রী সংগ্রহ ও উৎপাদন করার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হওয়ার সাথে সাথে মানবগােষ্ঠীর জীবনযাত্রার মান উন্নত হতে থাকে। সেই সাথে অবাধ ও মুক্ত প্রেমলীলার ফলে জনসংখ্যা দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং বাড়তি জনসংখ্যা উৎপাদন কার্যে নিয়ােজিত হওয়ার ফলশ্রুতিতে এ স্তরে প্রয়ােজনাতিরিক্ত সম্পদ সৃষ্টির পরিবেশ গড়ে ওঠে। এ সামাজিক পরিবেশে বাড়তি সম্পদকে কেন্দ্র করে ও প্রত্যক্ষ রক্তের সম্পর্ককে ভিত্তি করে ‘আদিম সাম্যবাদী সমাজ’ কালক্রমে উপজাতীয় সমাজে প্রবেশ করে। তবে এ সামাজিক স্তরে আদিম সাম্যবাদী সমাজের সবই গৃহীত হতে দেখা যায়। তবে এ স্তরে তাদের মধ্যে গণতান্ত্রিক চেতনাবােধের উন্মেষ ঘটে। উপজাতীয় পারিবারিক সমাজ পরিচালনার জন্যে উপজাতীয় বয়ােজষ্ঠ্য বা শক্তিশালী বা জ্ঞানীব্যক্তিকে সর্বসম্মতিক্রমে উপজাতীয় প্রধান’ হিশেবে নির্বাচিত করা হয় । পরবর্তীকালে উপজাতীয় সমাজের বিস্তৃতি ঘটলে উপজাতীয় লাঠিয়াল বাহিনী প্রধান বা সমরপ্রধান, উৎসব প্রধান, শিকার প্রধান, কৃষি প্রধান ও অন্যান্য প্রধান ব্যক্তিদের নির্বাচিত করা হয়। উপজাতীয় প্রধানের সার্বিক তত্ত্বাবধানে সমাজের প্রতিটি সদস্য –
সদস্যাদের যাবতীয় দায়-দায়িত্ব সম-অধিকারের ভিত্তিতে সম্পাদন করা হতাে। সকলের আয়-রােজগার উপজাতীয় তহবিলে জমা হতাে। এখানেও কেউ কাউকে শােষণ করতে পারতাে না—সেই পরিবেশও তখনাে পর্যন্ত সৃষ্টি হয়নি। যৌথ বা সমষ্টিগত চিন্তায় ছিলাে তারা আচ্ছন্ন। কিন্তু কালক্রমে উপজাতীয় প্রধান বা সমরপ্রধান, উৎসব প্রধান ও অন্যান্য শক্তিশালী ব্যক্তিদের মনে উপজাতীয় সমষ্টিগত বাড়তি সম্পদের ভােগ-দখলকে কেন্দ্র করে লােভ-লালসা ও সমাজের বুকে প্রভাব প্রতিপত্তি সংহত করার সংকীর্ণ ব্যক্তিস্বার্থ ব্যক্তিসত্তা ব্যক্তিচিন্তা ব্যক্তিসম্পদ ও ব্যক্তিস্বাধীনতার বীজ অংকুরিত হতে থাকে এবং এভাবেই উপজাতীয় সাম্যবাদী সামাজিক কাঠামােয় প্রচন্ড ধস্ নেমে আসে। কালক্রমে, শক্তিশালী জ্ঞানী বা সমাজ প্রধানদের কৌশল, অত্যাচার, নির্যাতন, ফন্দিফিকির ও প্রতারণার শিকার হয়ে সমাজের বৃহত্তম অজ্ঞ দুর্বল মানবগােষ্ঠী তাদের অধীনে দাস হিশেবে পরিণত হতে থাকে। এভাবেই মানবসমাজ দাস প্রথার যুগে প্রবেশ করে। আর এই দাস প্রথাভিত্তিক সমাজের গর্ভ হতেই অর্থাৎ প্রভূদের কারসাজিতেই মানব সমাজের বুকে প্রত্যক্ষ শ্রেণীসত্তা, অত্যাচার, উৎপীড়ন, শােষণ, বঞ্চনা, প্রতারণা, দুর্নীতি, ইত্যাদি প্রথমবারের মতাে আইনসম্মত হয়ে পড়ে এবং এগুলােকে আরাে সাংগঠনিক উপায়ে কার্যকরি করার লক্ষ্যে ধর্ম, আইন কানুন, রাষ্ট্র, পুলিশ বা নিরাপত্তা বাহিনী প্রভৃতির উদ্ভব ঘটে। এ জাতীয় অসংগতি, শশাষণ, দুর্নীতি, অত্যাচার, নির্যাতন, ব্যভিচার, বৈষম্য, অবিচার, রাষ্ট্রীয় স্বৈরাচার, ধর্মীয় প্রতারণা, কুসংস্কার এবং এর ধারক-বাহক সামন্তবাদী ধনতান্ত্রিক সমাজের শাসক। শশাষকগােষ্ঠীর কবল থেকে মানবজাতির সার্বিক মুক্তির লক্ষ্যে মহানবী ও মণীষী কালমার্কস সাম্যবাদী সমাজ বিপ্লবের যে দিকদর্শন ও আহবান প্রদান করে গেছেন, তার মধ্যে নতুন তেমন কিছু নেই—তা আদিম অকৃত্রিম সাম্যবাদী সমাজ ব্যবস্থারই বিবর্তনগত, গুণগত বা কাঠামােগত বৈজ্ঞানিক প্রতিফলন বৈ কিছু নয় । তেমনি আমিও সাম্যবাদের ইতিহাস ঐতিহ্য এবং আমার দেশের মানুষ ও সমাজের প্রয়ােজনে চিন্তাভাবনা করে দেখলাম, সাম্যবাদী সমাজ বিপ্লব ব্যতীত আমার দেশের সাধারণ মানুষের সার্বিক মুক্তি আসতে পারে না।
আর সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্তই হচ্ছে জনগণের গণতান্ত্রিক চেতনাবোেধ যে চেতনাবােধ বস্তুতঃ নির্ভর করে ধর্মনিরপেক্ষ মনােভাব, সাম্যবাদী আর্থসামাজিক পরিবেশ, জনগণের ইস্পাতকঠিন ঐক্য তথা জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শকে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিশেবে চিহ্নিত করেছি। আবীর আহার অনেকে বলেন, ‘বাকশাল’ হলাে একদলীয় বা আপনার স্বৈরতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠার একটি অপকৌশল—এ সম্পর্কে আপনি পরিষ্কার মতামত দিন। বঙ্গবন্ধু ও সাম্রাজ্যবাদের অবশেষ পুঁজিবাদী সমাজসভ্যতা ও শােষক পরজীবিদের দৃষ্টিতে ‘বাকশাল’ তাে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা হবেই! কারণ বাকশাল কর্মসূচীর মধ্য দিয়ে আমি সাম্রাজ্যবাদের প্রতিনিধি বহুজাতিক পুঁজিবাদী শশাষক, তাদের সংস্থাসমূহের লগ্নিকারবার এবং তাদের এদেশীয় সেবাদাস, এজেন্ট, উঠতি ধনিক গােষ্ঠীর একচেটিয়া শশাষণ ও অবৈধ প্রভাবপ্রতিপত্তি-দুর্নীতি-প্রতারণার সকল বিষদাঁত ভেঙ্গে দেবার ব্যবস্থা করেছি। এ জন্যে তাঁদের আঁতে ঘা লাগছে, বাকশাল ও আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার করে বেড়াচ্ছে। সাম্রাজ্যবাদীশক্তি শাসকরা এদেশে গােপনে অর্থ যােগান দিয়ে তাদের সেবাদাস ও এজেন্টদের মাধ্যমে সমাজতান্ত্রিক কার্যক্রমকে বানচাল করতে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। তারা বিভিন্ন পত্র পত্রিকা, সভাসমিতি, এমন কি ধর্মীয় অনুষ্টানের মধ্য দিয়ে আমার সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে লিপ্ত হয়েছে। কলকারখানা, অফিস-আদালত, শিল্প-প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন থানায় তাদের ভাড়াটিয়া চরদের দিয়ে অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা চালাচ্ছে। বিভিন্নস্থানে অগ্নিসংযােগ, লুটতরাজ, গণহত্যা, অসামাজিক কার্যকলাপ ও সাম্প্রদায়িক তৎপরতা চালাচ্ছে। প্রতিদিন তাদের ষড়যন্ত্রের খবরা-খবর আমার কানে আসছে। প্রচলিত গণতান্ত্রিক বৈষম্য, শােষণ-দুনীতিভিত্তিক সমাজকে, দেউলিয়া আর্থসামাজিক ব্যবস্থা, জরাজীর্ণ প্রশাসন ও অবিচারমূলক বিচার ব্যবস্থাকে সমূলে উৎপাটিত করে একটি শােষণহীন দুর্নীতিহীন বৈষম্যহীন ও প্রকৃত গণতান্ত্রিক সাম্যবাদী সমাজ বিপ্লবের পথ রচনা করেছি। এই সমাজ বিপ্লবে যারা বিশ্বাসী নন, তারাই বাকশাল ব্যবস্থাকে একদলীয় স্বৈরশাসন ব্যবস্থা বলে অপপ্রচার করছেন। কিন্তু আমি এ সকল বিরুদ্ধবাদীদের বলি, এতােকাল তােমরা মুষ্টিমেয় লােক, আমার ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ দুখী মেহনতী মানুষকে শাসন ও শােষণ করে আসছে।
তােমাদের বল্গাহীন স্বাধীনতা ও সীমাহীন দুর্নীতির মধ্য দিয়ে ব্যক্তিসম্পদের পাহাড় গড়ে তােলার অবাধ ও মুক্ত প্রতিযােগিতার হােলিখেলায় আমার দুখীমানুষের সব আশা – আকাংকা-স্বপ্ন-সাধ ধুলায় মিশে গেছে। দুখী মানুষের ক্ষুধার জ্বালা ব্যথা বেদনা হতাশা ক্রন্দন তােমাদের পাষাণ হৃদয়কে একটুও গলাতে পারেনি। বাংলার যে স্বাধীনতা তােমরা ভােগ করছাে, এই স্বাধীনতা, এই দেশ, এই মাটি ঐ আমার দুখী মেহনতী মানুষের সীমাহীন ত্যাগ-তিতিক্ষা, আন্দোলন সংগ্রাম এবং জীবন মৃত্যুর বিনিময়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে; সেখানে তােমাদের অবদান কতােটুকু আছে, নিজেদের বুকে একবার হাত দিয়ে চিন্তা করে দেখাে। বরং অনেক ক্ষেত্রে স্বাধীনতার বিরােধীতা করেছে। বিদেশী শাসক-শােষকদের সহায়তা করেছে। নিজের ঘরে থেকে ভাইয়ের ঘর পুড়িয়েছে, মানুষকে হত্যা করেছে। বােনদের লাঞ্চিতা করেছে, আরাে কিনা করেছে ? এ সব কিছু করেছে শুধুমাত্র ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধারের ঘৃণ্য লক্ষ্য। আমার দেশের মাত্র ৫ পার্সেন্ট লােক ৯৫ পার্সেন্ট লােককে দাবিয়ে রাখছে, শাসন শােষণ করছে। বাকশাল করে আমি ঐ ৯৫% ভাগ মানুষের স্বাধীনতা, গণতান্ত্রিক শাসন ও অর্থনৈতিক মুক্তির ব্যবস্থা করেছি। এতােকাল ৫% ভাগ শাসন করেছে, এখন থেকে করবে ৯৫% ভাগ। ৯৫% ভাগ মানুষের সুখদুঃখের সাথে ৫% ভাগকে মিশতে হবে। আমি মেশাবােই। এ জন্যে বাকশাল করেছি। এই ৯৫% ভাগ মানুষকে সংঘবদ্ধ করেছি তাদের পেশার নামে, তাদের বৃহত্তর কল্যাণে, তাদের একক দল বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ’ বা বাকশালে। সুতরাং মূলতঃ বাকশাল হচ্ছে বাঙ্গালীর সর্বশ্রেণী সর্বস্তরের গণমানুষের একক জাতীয় প্লাটফরম, রাজনৈতিক সংস্থা, একদল নয়। এখানে স্বৈরশাসনেরও কোনাে সুযােগ নেই। কারণ বাঙ্গালী জনগােষ্ঠীর সম্মিলিত বা সমষ্টিগত শাসন ব্যবস্থায় কে কার ওপর স্বৈরশাসন চালাবে ? প্রত্যেক পেশার নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে শাসন পরিষদ গঠিত হবে। কোনাে পেশা বা শ্রেণী অন্য পেশার লােকদের ওপর খবরদারী করতে পারবে না। যে কেউ যিনি জনগণের সার্বিক কল্যাণের রাজনীতিতে, জাতীয় সমৃদ্ধির ও উৎপাদনের রাজনীতিতে তথা সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার রাজনীতিতে বিশ্বাসী, তিনি এই জাতীয় দলে ভিড়তে পারবেন।
যারা বাকশালকে একদলীয় ব্যবস্থা বলেন, তাদের স্মরণ করতে বলি, ইসলামে কটি দল ছিলাে ? ইসলামী ব্যবস্থায় একটি মাত্র দলের অস্তিত্ব ছিলাে, আর তা হলাে ‘খেলাফত’ তথা খেলাফতে রাশেদীন। মার্কসবাদও একটি মাত্র দলের অনুমােদন দিয়েছে। চীন রাশিয়া কিউবা ভিয়েতনাম ও অন্যান্য ইসলামী রাষ্ট্রে কতটি করে দল আছে ? সৌদি আরব ও অন্যান্য ইসলামী রাষ্ট্রে কতটি করে দল আছে ? এই সব ইসলামী রাষ্ট্রসমূহকে বাদ দাও, ওখানে মহানবীর ইসলাম নেই। বস্তুতঃ প্রকৃত গণতন্ত্র বা সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বার্থেই একটি একক জাতীয় রাজনৈতিক সংস্থা থাকা বাঞ্চনীয়। একটি জাতীয় কল্যাণের অভীন্ন আদর্শে, ব্যাপক মানুষের সার্বিক মুক্তির লক্ষ্যে একটি মাত্র রাজনৈতিক সংস্থার পতাকাতলে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। কিন্তু বহুদলীয় তথাকথিত গণতান্ত্রিক প্রতিযােগিতায় কোনােভাবেই জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করা সম্ভব নয়। প্রকৃত গণতন্ত্র, জনগণের গণতন্ত্র, কল্যাণের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়; সেখানে বহুদলে জনগণ বহুধা বিভক্ত হতে বাধ্য। আর বিচ্ছিন্ন বিভক্ত পরস্পর বিরােধী রাজনৈতিক দলের দ্বন্দ্বসংঘাত হিংসা-বিদ্বেষ ও হানাহানির রাজনীতি দিয়ে জাতির বৃহত্তর কল্যাণ ও সমৃদ্ধি কোনােভাবেই অর্জিত হতে পারে না। ইতিহাস সে সাক্ষ্য দেয় না। আমার দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাও তাই বলে। আবীর আহাদ বঙ্গবন্ধু, বাকশালের মূল লক্ষ্য বা এর কর্মসূচী সম্পর্কে কিছু বলুন। বঙ্গবন্ধুঃ বাকশালের মূল লক্ষ্য তাে আগেই বিশ্লেষণ করেছি। তবে এক কথায় আমি যা বুঝি তাহলােঃ একটি শােষণহীন দুর্নীতি মুক্ত সমাজ ও শােষিতের গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠাকরণ । বাকশাল কর্মসূচীকে আমি প্রধানতঃ তিনটি ভাগে ভাগ করেছি। এক: রাজনৈতিক, দুই: আর্থসামাজিক, তিন: প্রশাসনিক ও বিচার ব্যবস্থা।
এক: রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনায় প্রত্যেক পেশাভিত্তিক লােকদের জাতীয় দল বাকশালে’ অন্তর্ভুক্ত করার ব্যবস্থা রেখেছি। এবং পর্যায়ক্রমে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রত্যেকটি নির্বাচনী এলাকায় জাতীয় দলের একাধিক প্রার্থীদের মনােনয়ন দেয়া হবে। জনগণ তাদের মধ্য থেকে একজনকে নির্বাচিত করবেন। প্রেসিডেন্ট জনগণের ভােটে নির্বাচিত হবেন। জাতীয় দলের সদস্য যে কেউ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন। প্রেসিডেন্ট পদাধিকার বলে জাতীয় দলের চেয়ারম্যান হবেন। প্রেসিডেন্ট জাতীয় সংসদের আস্থাভাজন একজনকে প্রধানমন্ত্রী নিয়ােগ করবেন। প্রেসিডেন্ট প্রধানমন্ত্রীর সাথে পরামর্শ করে মন্ত্রীদের নিয়ােগ করবেন। সংসদ সদস্যদের দুই তৃতীয়াংশের অনাস্থায় প্রেসিডেন্টকে অপসারিত করতে পারবেন। মন্ত্রিসভা প্রেসিডেন্ট ও জাতীয় সংসদের কাছে দায়ী থাকবেন। স্থানীয় থেকে সর্বোচ্চ পর্যায়ের সর্বস্তরে জনগণের প্রতিনিধিত্ব প্রত্যক্ষভাবে বজায় থাকবে ……..
দুই: আর্থসামাজিক ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে বাধ্যতামূলক বহুমুখি গ্রাম-সমবায় প্রকল্প। এর মাধ্যমে গ্রামীণ আর্থব্যবস্থার উন্নয়ন বা স্বনির্ভর-স্বাধীন গ্রামীণ ব্যবস্থা, বিশেষ করে ভূমিসংস্কারের প্রয়ােজনীয় ও কার্যকরি ব্যবস্থার মাধ্যমে ভূমিহীন কৃষকদের পূণর্বাসন তথা কৃষকদের হাতে জমি হস্তান্তর, উৎপাদন বৃদ্ধি ও সাম্যভিত্তিক বন্টন ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ। ভারী শিল্প-কলকারখানা, পরিত্যক্ত সম্পত্তি, বৈদেশিক বাণিজ্য, ব্যাংক, বীমা, যােগাযােগ ব্যবস্থা ইত্যাদি জাতীয়করণ করে জনগণের যৌথ শেয়ার মূলধনে নতুন নতুন কৃষিজাত শিল্প ও অন্যান্য শিল্প কলকারখানা ও সংস্থা প্রতিষ্ঠা। সীমিত ব্যক্তিমালিকানাকে উৎসাহদানের ব্যবস্থা রয়েছে। তবে ব্যক্তিমালিকানাধীন সংস্থাসমূহ যাতে জনসাধারণ ও তাদের শ্রমিকদের সােষণ করতে না পারে তার ব্যবস্থা থাকবে। | তিন: প্রশাসনিক কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, করপােরেশন ও বিভাগগুলাের পুনর্বিন্যাস ও পুনর্গঠন তথা মাথাভারী প্রশাসনের উচ্ছেদ সাধন। ……. প্রশাসনিক ক্ষেত্রে জেলা গভর্নর’ ও থানা প্রশাসনিক প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে দেশের সকল মহকুমাকে জেলায় উন্নীত করা হয়েছে। প্রশাসনিক জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রিতার কারণে ইউনিয়ন পরিষদ, মহকুমা ও বিভাগীয় প্রশাসনকে তুলে দেয়া হচ্ছে। জেল ও থানাগুলাে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা পরিচালিত হবে। গ্রাম সমবায় পরিষদ সদস্যদের ভােটে থানা পরিষদ গঠিত হবে। তবে থানা পরিষদের প্রশাসক চেয়ারম্যান ও জেলা গভর্নর জনগণের প্রত্যক্ষ ভােটে নির্বাচিত হবেন। থানা প্রশাসক চেয়ারম্যানরা এবং জেলা গভর্নররা জনগণ, স্ব-স্ব পরিষদ ও প্রেসিডেন্টের কাছে দায়ী থাকবেন। সরকারি কর্মচারীরা থানা প্রশাসক/ চেয়ারম্যান এবং জেলা গভর্নরদের নিকট দায়ী থাকবেন। গ্রাম সময় পরিষদ থানা পরিষদের কাছে, থানা পরিষদ জেলা পরিষদের কাছে দায়ী থাকবে। গ্রাম সমবায় পরিষদ, থানা পরিষদ, জেলা পরিষদ –এরপরেই থাকবে জাতীয় সরকার। এভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক প্রশাসনিক কাঠামাের মধ্যে জাতীয় সরকারের প্রশাসনিক ক্ষমতাকে বিপুলভাবে বিকেন্দ্রিকরণ করে প্রশাসনকে জনগণের দ্বারপ্রান্তে পৌছে দেয়ার ব্যবস্থা নিয়েছি। প্রশাসনিক আমলাতন্ত্র, ষ্টিলফ্রেম গতানুগতিক বা টাইপড চরিত্রকে ভেঙ্গে গুড়াে করে দেবার ব্যবস্থা নিয়েছি। সরকারি কর্মচারিরা এখন থেকে জনগণের সেবক।
বিচার বিভাগের ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টকে রাজধানীতে বহাল রেখে হাইকোর্ট বিভাগকে আটটি আঞ্চলিক বিভাগে বিকেন্দ্রিকরণের ব্যবস্থা নিয়েছি। তবে সুপ্রিম কোর্টের অধিবেশন বছরে অন্ততঃ একবার করে প্রতিটি আঞ্চলিক বিভাগে (হাইকোর্ট বিভাগে) বসবে। জেলা আদালতসমূহ বহাল থাকবে। প্রতিটি থানাতে থাকবে একাধিক বিশেষ ট্রাইবুনাল। প্রত্যেক আদালতে যেকোনাে মামলা ৩ থেকে ৬ মাসের মধ্যে মীমাংসা করতে হবে। গ্রামে থাকবে একাধিক শালিস বাের্ড। ‘শালিস বাের্ড’ গঠিত হবে স্থানীয় মুক্তিযােদ্ধা শিক্ষক ও গন্যমান্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে । শালিস বাের্ড চেয়ারম্যান থাকবেন সরকার নিয়ােজিত বিচার বিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেটরা। এভাবে সুষ্ঠু, ন্যায় ও দ্রুততর গণমুখি বিচারকার্য সম্পন্ন করার লক্ষ্যে বিচার বিভাগের ক্ষমতাকে বিকেন্দ্রিকরণ করা হয়েছে। আবীর আহাদঃ বঙ্গবন্ধু, অনেকে বলেন, আপনি নাকি কোন একটি শক্তির চাপের মুখে বা তাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বাকশাল কর্মসূচী দিয়েছেন এবং এ ব্যবস্থা নাকি সাময়িককালের জন্যে করেছেন—এ বিষয়ে আপনি অনুগ্রহ করে কিছু বলবেন কি? বঙ্গবন্ধু ও কারাে প্রেসার বা প্রভাবের নিকট আত্মসমর্পণ বা মাথা নত করার অভ্যাস বা মানসিকতা আমার নেই। এ কথা যারা বলেন, তারাও তা ভালাে করেই জানেন। তবে, অপপ্রচার করে বেড়াবার বিরুদ্ধে কোনাে আইন নেই, তাই উনারা এ কাজে আদাজল খেয়ে নেমেছেন। করুন অপপ্রচার। আমি স্বজ্ঞানে বিচারবিশ্লেষণ করে, আমার অভিজ্ঞতার আলােকে, আমার দীনদুখি মেহনতী মানুষের আশা-আকাংখা বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যে আমি বাকশাল কর্মসূচী দিয়েছি। আমি যা বলি, তা-ই করে ছাড়ি। যেখানে একবার হাত দেই সেখান থেকে হাত উঠাই না। বলেছিলাম, এদেশকে মুক্ত করে ছাড়বাে, মুক্ত করেছি। বলেছি, শােষণহীন দুর্নীতিমুক্ত সমাজতান্ত্রিক বাংলা গড়বাে, তা-ই করে ছাড়বাে, ইনশাল্লাহ। কোনাে কিন্তু-টিন্তু নাই, কোনােই আপােষ নাই। আবীর আহাদ। বঙ্গবন্ধু, বাকশাল বিরােধীমহল অর্থাৎ ঐ ৫% জন, রা সংখ্যায় অতি নগণ্য হলেও তাদেরই হাতে রয়েছে বিপুল সম্পদ। তাদের সাথে রয়েছে আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদী শক্তির যােগসাজশ। তাদের পেইড এজেন্টরাই রয়েছে প্রশাসনিক ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতার কেন্দ্রে।
তাদের কায়েমী স্বার্থের ওপর আপনি আঘাত হানতে যাচ্ছেন, এ অবস্থায় তারা চোখ মেলে মুখ গুজে বসে থাকবে বলে কি আপনি মনে করেন। তারা তাদের অবস্থান নিরাপদ ও সংহত করার জন্যে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে না। বঙ্গবন্ধুঃ আমি জানি তারা বসে নাই। ষড়যন্ত্র চলছে। প্রতিদিনই ষড়যন্ত্রের উড়াে খবর আমার কাছে আসে। সাম্রাজ্যবাদ ও তার পদলেহীরা এসব ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। গােপন পথে অঢেল অর্থ এ কাজে লাগাবার জন্যে বাংলাদেশে আসছে। সুকৌশলে আমাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপ চলছে। অপপ্রচার চলছে। আমি জাতির বৃহত্তর কল্যাণে এ পথে নেমেছি। জনগণ সমর্থন দিচ্ছে। তাই ষড়যন্ত্র করে, বাধার সৃষ্টি করে, হুমকী দিয়ে আমাকে নিবৃত করা যাবে না। আমার কাজ আমি করে যাবােই। হয়তাে শেষ পর্যন্ত ওরা আমাকে মেরে ফেলতে পারে। পরােয়া করি না। ও মৃত্যু আমার জীবনে অনেকবার এসেছে। এ্যাসিডেন্টলি আজো আমি বেঁচে আছি। অবশ্যই আমাকে মরতে হবে। তাই মৃত্যু ভয় আমার নেই। জনগণ যদি বােঝে আমার আইডিয়া ভালাে, তাহলে তারা তা গ্রহণ করবে। আমার কর্মসূচী বাস্তবায়ন করবে। আমার একটা বড়াে সান্ত্বনা আছে, যুদ্ধের সময় আমি জনগণের সাথে থাকতে পারিনি। জনগণ আমারই আদেশ ও নির্দেশে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছে। আজকের এই শােষণমুক্ত সমাজতন্ত্র বা অর্থনৈতিক মুক্তির বিপ্লবে আমি যদি নাও। থাকি, তাহলে আমার দৃঢ়বিশ্বাস আমার বাঙ্গালীরা যে কোনাে মূল্যে আমার রেখে যাওয়া আদর্শ ও লক্ষ্য একদিন বাংলার বুকে বাস্তবায়িত করে ছাড়বে, ইনশাল্লাহ। এ প্রসঙ্গে কবিগুরু থেকে তােমাকে উদ্ধৃতি দিচ্ছিঃ “উদয়ের পথে শুনি কার বাণী ভয় নাই ওরে ভয় নাই, নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।” ধন্যবাদ।
সূত্র : বঙ্গবন্ধু-দ্বিতীয় বিপ্লবের রাজনৈতিক দর্শন – আবীর আহাদ