You dont have javascript enabled! Please enable it! যুদ্ধের ধারণা- পাকিস্তান বিনা যুদ্ধে ভূখণ্ড খালি করে দিত তাহলে ভারতীয়রা বিনা আয়াসে বিশাল অঞ্চল দখল করে নিত - সংগ্রামের নোটবুক

যুদ্ধের ধারণা

একটি বড় ফ্রন্টে প্রতিরক্ষার ধারণা পাকিস্তানের জন্মের পর ভারতের একতরফা যােদ্ধা-মনােভাব মােকাবেলায় কোনাে স্থায়ী সামরিক কৌশল গ্রহণ করা হয়নি। একটি কার্যকর প্রতিরক্ষা ধারণা উদ্ভাবনে বিভিন্ন গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। এসব গবেষণায় বিবেচ্য বাস্তব উপাদানগুলাে সামরিক বিশেষজ্ঞদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রভাবিত করেছে। নিম্নবর্ণিত বিষয়গুলাে বিবেচনায় রাখা হতাে :

ক) পাকিস্তানের ভৌগােলিক গভীরতা কম। তাই ক্লাসিক্যাল ধারণা অনুযায়ী একটি নির্দিষ্ট সময় অন্তর হামলা চালানাের জন্য শত্রুকে ভেতরে ঢুকতে দেয়া যায় না। উদাহরণস্বরূপ, রুশরা শহর বন্দর জ্বালিয়ে দিয়ে এবং সেখান থেকে পিছু হটে শত্রুকে ফাদে ফেলার জন্য ভূখণ্ডের ভেতরে নিয়ন্ত্রণ রেখে (এলওসি) প্রতিষ্ঠা করার সুযােগ দেয়। এ কৌশলে তারা শত্রুকে ভেতরে প্রবেশ করতে দেয় এবং ফাদে ফেলে তাদের ধ্বংস করে। নেপােলিয়ন এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানদের তারা এভাবে ফাঁদে ফেলে পরাজিত করেছিল। পাকিস্তান যদি এভাবে বিনা যুদ্ধে ভূখণ্ড খালি করে দিত। তাহলে ভারতীয়রা বিনা আয়াসে বিশাল অঞ্চল দখল করে নিত। অধিকাংশ জনগােষ্ঠী ও শিল্প কেন্দ্র, সড়ক ও রেল যােগাযোেগ এবং নদ-নদী সীমান্ত এলাকার কাছাকাছি। আমরা শত্রুর ক্ষতি সাধন এবং তাদের রক্ত ঝরানাে ছাড়া এগুলাে খালি করে দিতে পারি না। জাতীয় সেনাবাহিনী সীমান্তে অথবা সীমান্তের ওপারে লড়াই করে। আমাদের দেশের প্রতি বর্গমাইল ভূখণ্ড পবিত্র এবং প্রতিরক্ষার উপযুক্ত। এটা মনে রাখা উচিত যে, কেবলমাত্র দখলদার সেনাবাহিনীই এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উপেক্ষা করতে পারতাে। পশ্চিম পাকিস্তানে লাহাের, কাসুর, শিয়ালকোট অথবা বাহুওয়ালনগর এবং পূর্ব পাকিস্তানে খুলনা, যশাের, রাজশাহী, দিনাজপুর, সিলেট অথবা কুমিল্লার মতাে যে কোনাে শহর হারানাের ফলে জাতীয় মনােবল এবং জনগণের মনস্তাত্ত্বিক প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে তা বিবেচনায় রাখতে হবে। পাকিস্তানে বিশাল সীমান্ত, অসংখ্য রাস্তাঘাট, বিস্তৃত এলাকা এবং অদ্ভুত ক্রিয়াশীল পরিবেশ রয়েছে। বস্তুত ভূখণ্ড রয়েছে পর্যাপ্ত। তবে সৈন্য সংখ্যা খুবই নগণ্য। এ জন্য আমাদেরকে সীমান্ত রক্ষা করতে হয় এবং এ কাজ যে কোনাে বিচারে বিরাট। সুতরায় পুঁথিগত সামরিক শিক্ষা অনুযায়ী কার্যকরভাবে প্রতিরক্ষা সংগঠন করা একজন আত্মরক্ষাকারীর পক্ষে দুরূহ ব্যাপার। 

অতএব, পাকিস্তান সেনাবাহিনী পারস্পরিক সহায়তাদানকারী বিভিন্ন স্তরভিত্তিক প্রতিরক্ষামূলক লড়াইয়ের একটি সামরিক মতবাদ গ্রহণ করে। এ প্রতিরক্ষা মতবাদে শত্রুকে ছিন্নভিন্ন এবং তাকে দুর্বল করে দেয়া এবং মূল শক্তি নিয়ে আমাদের ভূখণ্ডের অভ্যন্তরে হামলা করার আগে তাদের সর্বোচ্চ ক্ষতিসাধনের বিষয় বিবেচনা করা হয়। প্রাথমিকভাবে, যতদূর সামনে যাওয়া যায় ততদূর সামনে গিয়ে অনুপ্রবেশ পথগুলােতে প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করতে হবে। অগ্রবর্তী অবস্থানের পতন হলে পরবর্তী প্রতিরক্ষা লাইনে পিছু হটে আসতে হবে এবং মধ্যবর্তী প্রতিরক্ষা লাইনের পতন ঘটলে চূড়ান্ত লড়াইয়ের জন্য শক্ত ঘাঁটি ও দুর্গে অবস্থান গ্রহণ করতে হবে। পূর্ব পাকিস্তানে এ প্রতিরক্ষা মতবাদ প্রয়ােগ করা হয়। এ মতবাদ অনুযায়ী সামরিক বিবেচনায় যতটুকু সামনে এগিয়ে গিয়ে প্রধান প্রধান অনুপ্রবেশ পথগুলােতে প্রাথমিক প্রতিরক্ষা ব্যুহ গড়ে তােলা হয়। হিলি, চৌগাছা, বেনাপোেল, আখাউড়া ও কুমিল্লা ছিল এ ধরনের প্রাথমিক প্রতিরক্ষা ব্যুহ। সীমান্ত চৌকি নয়; প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম প্রতিবন্ধকতার ভিত্তিতে অগ্রবর্তী প্রতিরক্ষা লাইন স্থাপন করা হয়।

শুধু পূর্ব পাকিস্তানে নয়; বর্তমানে পশ্চিম পাকিস্তানেও যুদ্ধ পরিচালনায় শক্ত ঘাটি ও দুর্গভিত্তিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা চালু রয়েছে। পূর্ব থেকে নির্ধারিত শহর ও বন্দরে স্থাপিত শক্তঘাটি ও দুর্গের ভিত্তিতে আমরা প্রতিরক্ষামূলক তৎপরতা চালাই। শক্তঘাঁটিগুলাের মধ্যে পারস্পরিক যােগাযােগ নাও থাকতে পারে। তাই টহলদান, মাইন স্থাপন ও রেকির মাধ্যমে এসব ফাঁক-ফোকর পূরণ করা হয়। শক্তঘাটি হচ্ছে মূলত লড়াইয়ের সেই ঘাটি যেখান থেকে শক্রর ওপর হামলা এবং তাদের সৈন্য ও সমরাস্ত্রের প্রভূত ক্ষতিসাধন করা হয়। এ প্রক্রিয়ায় শত্রুর তৎপরতা মন্থর হয়ে পড়ে এবং তখন তারা পশ্চাদ্ভাগে তাদের যােগাযােগ লাইন রক্ষায় সৈন্য মােতায়েনে বাধ্য হয়। শক্র হয়রানিতে পড়ে এবং তাদের নিয়ন্ত্রণ রেখা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফাঁকফোকরে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা এবং শত্রুর নিয়ন্ত্রণ রেখা বিচ্ছিন্ন করার জন্য শক্তঘাঁটি থেকে অভিযান পরিচালনা করা হয়। আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে অপেক্ষাকৃত একটি ক্ষুদ্র সেনাবাহিনীকে তুলনামূলকভাবে একটি বিশাল এলাকা রক্ষা করতে হয় বলে এ মতবাদ এখনাে বহাল রয়েছে। প্রয়ােজনীয় সৈন্য বণ্টনের মাধ্যমে পাশ কাটিয়ে যাওয়া শত্রুকে লাঞ্ছিত করার কৌশল ডিভিশনাল কমান্ডার গ্রহণ করতে পারেন। ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ সার্বিক ধারণা, প্রয়ােগ এবং তা বাস্তবায়নে জেনারেল হেড কোয়ার্টার্সের ভূমিকা : ঐতিহাসিক ও ভৌগলিক কারণে পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে সশস্ত্র বাহিনীর অধিকাংশ মােতায়েন রাখা হতাে পশ্চিম পাকিস্তানে এবং পূর্ব পাকিস্তানে রাখা হতাে ডিভিশন আকারের একটি বাহিনী।

সশস্ত্র বাহিনীর এরূপ বিন্যাসের কারণেই এ ধারণার জন্ম হয়েছিল যে, পশ্চিম পাকিস্তানের ওপর পূর্ব পাকিস্তানের নিরাপত্তা নির্ভর করে অথবা ‘পূর্ব পাকিস্তানের যুদ্ধ করা হবে পশ্চিম পাকিস্তানে।’ এ ধারণার অনুবাদ করলে এ অর্থই দাঁড়ায় যে, ভারতের সঙ্গে যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নিতে হবে পশ্চিম রণাঙ্গন থেকে এবং এ রণাঙ্গন থেকে হামলা চালিয়ে ভারতের গুরুত্বপূর্ণ ভূখণ্ড দখল করতে হবে। অন্যদিকে, পূর্ব রণাঙ্গন আত্মরক্ষামূলক বা সীমিত লড়াই চালিয়ে যাবে এবং অধিকাংশ ভারতীয় সৈন্যকে ব্যস্ত রাখতে এবং পশ্চিম রণাঙ্গনে যতক্ষণ যুদ্ধের ফয়সালা না হয় ততক্ষণ ভারতীয় সৈন্যদের সেখানে আটকে রাখতে হবে। বিশদ গবেষণা ও বিস্তারিত পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর এ ধারণা গৃহীত হয় এবং ১৯৭১ সালে যুদ্ধ শেষ হওয়া নাগাদ এটাই ছিল আমাদের সামরিক কৌশলের প্রধান স্তম্ভ। এ ধারণার আওতায় পূর্ব পাকিস্তানে ভারতের সঙ্গে আমাদের লড়াই হয় এবং লড়াইয়ের পরিকল্পনা বিচ্ছিন্ন ছিল না। বরং তা ছিল সার্বিক কৌশলের একটি অপরিহার্য অংশ। উভয় রণাঙ্গনের যুদ্ধ পরিকল্পনা ছিল পরস্পরের পরিপূরক ও পরস্পর নির্ভরশীল। জেনারেল হেড কোয়ার্টার্স উভয় রণাঙ্গনের যুদ্ধ নিয়ন্ত্রণ করতাে। সেনাবাহিনীর প্রধানের অধীনে কর্মরত সিজিএস ছিলেন সামরিক তৎপরতায় সমন্বয় সাধন এবং যুদ্ধ পরিকল্পনার সফল বাস্তবায়নের জন্য দায়ী। যথারীতি একে অপরকে সহায়তা দানের লক্ষ্যে যুদ্ধ পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। বিচ্ছিন্নভাবে যে কোনাে তৎপরতা চালানাে হলে বিপর্যয় নেমে আসতে পারতাে।

পূর্ব পাকিস্তান ভূখণ্ডটি ভারত পরিবেষ্টিত। সুতরাং ইস্টার্ন গ্যারিসন ছিল ভারতের। মুঠোর মধ্যে। খােলা ছিল শুধু আকাশ ও সমুদ্র পথ। যুদ্ধের শুরুতে এ দুটি পথও বন্ধ হয়ে যায়। যুদ্ধে নিয়ােজিত একটি সেনাবাহিনীর জন্য শক্রর হাতে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ার চেয়ে ভয়ংকর পরিস্থিতি আর কিছু হতে পারে না। ভেতর থেকে অবরােধ ভেঙে দিয়ে অবরুদ্ধ বাহিনী মূল ফ্রন্টের সঙ্গে যােগদানে ব্যর্থ হলে মূল ফ্রন্টকে বাইরে থেকে চূড়ান্ত আঘাত হেনে শত্রুকে অবরােধ প্রত্যাহারে বাধ্য করতে হবে নয়তাে অবরােধ ভেঙে ফেলতে হবে। অবরােধ ভাঙা সম্ভব না হলে অবরুদ্ধ বাহিনীর ধ্বংস সময়ের ব্যাপার মাত্র। এ রকম ভুরি ভুরি নজির ইতিহাসে রয়েছে। এগুলাের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হচ্ছে, ১৯৪১ সালে ইউক্রেনের যুদ্ধ, স্টালিনগ্রাদ, সিঙ্গাপুর, ক্রিট, মালয়, সিনাই, গোলান মালভূমি এবং সাম্প্রতিকালের অপারেশন ডেজার্ট স্টর্ম। এসব ঘটনায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে সরকার অথবা হাই কমান্ডের নির্দেশ ছাড়াই সামরিক কমান্ডারগণ আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিয়েছেন। তারা নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করেছেন। অন্যদিকে, আমরা আলাপ-আলােচনার মাধ্যমে এবং প্রেসিডেন্টের সুনির্দিষ্ট নির্দেশ ও সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল হামিদ ও গভর্নর মালিকের পরামর্শে আত্মসমর্পণ করেছি। 

এটা মােটামুটিভাবে গৃহীত হয়েছিল যে, ভারতের সঙ্গে লড়াইয়ে সার্বিক ধারণা অনুযায়ী ভারতীয় সৈন্যরা পূর্ব পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বড় ধরনের হামলা শুরু করলে এবং পশ্চিম পাকিস্তানে পাকিস্তানি বাহিনীকে পদানত করতে লড়াইয়ে লিপ্ত হলে পশ্চিম রণাঙ্গনে শক্রর সঙ্গে শক্তির একটি আনুপাতিক ভারসাম্য রক্ষায় ইস্টার্ন গ্যারিসনকে অধিকাংশ ভারতীয় সৈন্যদের ব্যস্ত এবং তাদেরকে এখানে আটকে রাখতে হবে। এর সঙ্গে সৈন্য ও সমরাস্ত্রের শ্রেষ্ঠত্ব অথবা সমতার সুযােগে পশ্চিম পাকিস্তানের এলিট রিজার্ভ ফোর্স ক্ষিপ্র ও তীব্র হামলা শুরু করবে এবং ভারতের স্পর্শকাতর ও কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূখণ্ড দখল করবে এবং এভাবে সামরিক ভারসাম্য পাল্টে দেবে। (উঁচু মানের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সাজোয়া ডিভিশনের সমন্বয়ে এলিট স্পেশাল রিজার্ভ ফোর্স গঠন করা হয়েছিল এবং সাজোয়া ডিভিশনের নেতৃত্বে ছিলেন চৌকস অফিসারগণ। রিজার্ভ ফোর্সকে যথাযথভাবে ব্যবহার করা হলে যুদ্ধের চেহারাই পুরােপুরি পাল্টে যেত)। ফলে হৃত ভূখণ্ড পুনর্দখলে ভারতীয়রা পূর্ব রণাঙ্গন থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে পশ্চিম রণাঙ্গনে মােতায়েন করবে। সে ক্ষেত্রে অবরুদ্ধ ইস্টার্ন গ্যারিসনের ওপর থেকে চাপ উঠে যাবে। এ সময়ে পরাশক্তির হস্তক্ষেপে একটি যুদ্ধবিরতি হবে এবং পরবর্তী দর কষাকষির জন্য অধিকৃত ভারতীয় ভূখণ্ড ধরে রাখতে হবে। নিম্নোক্ত হিসাব-নিকাশের ভিত্তিতে এ কৌশলগত ধারণা গৃহীত হয় :

(ক) ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ হবে তীব্র, ভয়াবহ ও স্বল্পকাল স্থায়ী। বিশ্ব শক্তি এ  অঞ্চলে তাদের রাজনৈতিক, কৌশলগত ও অর্থনৈতিক স্বার্থে দু’এক সপ্তাহের মধ্যে একটি যুদ্ধবিরতির ব্যবস্থা করবে।

খ)  পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান উভয় অংশে যুদ্ধের পক্ষে জনগণের বিপুল সমর্থন পাওয়া যাবে।

(গ) চীনের প্রকাশ্য হুমকি মােকাবেলায় ভারতকে চীন সীমান্তে সৈন্য মােতায়েনে বাধ্য হতে হবে এবং চীনা হুমকিতে ভারত পূর্ব পাকিস্তানে হামলায় সংযত হবে।  ইন্টার্ন গ্যারিসনকে চরম প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে এক অসম্ভব যুদ্ধে লড়াই করতে হয়েছে ১৯৭১ সালের যুদ্ধে। বাঙালিরা বিদ্রোহ করে এবং পরাশক্তির সহানুভূতির পাল্লা তাদের প্রতি ঝুঁকে পড়ে। চীনারা আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপে অনীহা প্রকাশ করে। এ কারণে সামরিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা ছিল প্রচণ্ডভাবে ভিন্ন। ইস্টার্ন গ্যারিসন ক্ষমতালিলুদের চক্রান্তের বেড়াজালে আটকা পড়ে। প্রদেশে বিদ্রোহ যুদ্ধে নতুন মাত্রা যােগ করে। আমরা জনসমর্থন হারিয়ে ফেলি। রাজনৈতিক ও সামরিক মিশন বাস্তবায়ন এবং বাঙালি বিদ্রোহ ও বহিঃশক্তি ভারতীয় সেনাবাহিনীর হুমকি মােকাবেলায় পূর্ব পাকিস্তানে নিয়ােজিত সৈন্য ছিল মুষ্টিমেয়। সামরিক বিশেষজ্ঞদের হিসাব অনুযায়ী, কেবলমাত্র বিদ্রোহ দমনেই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আড়াই থেকে তিন লাখ সুশিক্ষিত ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সৈন্য মােতায়েনের প্রয়ােজন ছিল। বহিঃশক্তির হুমকি মােকাবেলায় সৈন্য মােতায়েনের পরিমাণ হওয়া উচিত ছিল আরাে অনেক বেশি। উদাহরণস্বরূপ, কাশ্মীরি মুজাহিদদের দমনে ভারত ৭ লাখ সৈন্য মােতায়েন করেছে। কিন্তু এক বিশাল দায়িত্ব পালনে ইন্টার্ন। গ্যারিসনের ছিল মাত্র তিনটি অর্ধসজ্জিত দুর্বল ডিভিশন। নিয়মিত সৈন্য ছিল ৩৪ হাজার এবং আরাে ১১ হাজার ছিল সিভিল আর্মড ফোর্সের সদস্য। ইস্টার্ন গ্যারিসনের কোনাে ভারী ট্যাংক, ভারী ও মাঝারি পাল্লার আর্টিলারি ও ট্যাংকবিধ্বংসী গান ছিল না। বিএএফ’র অস্ত্রশস্ত্রের মধ্যে ছিল থ্রি নােট থ্রি রাইফেল।

চোরাচালান দমন উপযােগী ৪টি গানবােট ছিল। চট্টগ্রামে একটি ক্রুজার ছিল। কিন্তু। আমার প্রতিবাদ সত্ত্বেও তা প্রত্যাহার করা হয়। আমাদের বিমান বাহিনীতে ছিল। এক স্কোয়াড্রন সেকেলে এফ-৮৬ স্যার জেটের একটি বহর। এয়ার মার্শাল রহিম। খানের নির্দেশে পূর্ব সতর্কীকরণ রাডার পশ্চিম পাকিস্তানে সরিয়ে নেয়া হয় এবং সি১৩০ পরিবহন বিমানটিও প্রত্যাহার করা হয়। অন্য দিকে, ভারতীয়রা মােতায়েন করে ১২ ডিভিশন সৈন্য, একটি প্যারা ব্রিগেড ও ৩৯ ব্যাটালিয়ন বিএসএফ। অস্ত্রশস্ত্র ও সাজ-সরঞ্জামের দিক থেকে প্রতিটি বিএসএফ ব্যাটালিয়ন ছিল নিয়মিত পদাতিক ব্যাটালিয়নের মতাে সুসজ্জিত। ব্রিগেড ও ব্যাটালিয়নে সংগঠিত হাজার হাজার মুক্তিযােদ্ধা ভারতীয় নিয়মিত ফরমেশনের সঙ্গে একীভূত হয়। লাখ লাখ বাঙালি বিদ্রোহী আমাদের বিরুদ্ধে সক্রিয় ছিল। ভারতীয়রা ব্যবহার করেছিল সােভিয়েত নির্মিত এসইউ-৭ ও মিগ-২১ জঙ্গিবিমানের ১৭টি স্কোয়াড্রন। এসব সর্বাধুনিক জঙ্গীবিমান ৪টি বিমানঘাটি ও বিমানবাহী রণতরী ‘বিক্রম’ থেকে উড়ে আসতে। আগরতলায় নিয়ােজিত ছিল ১২২টি হেলিকপ্টার। এছাড়া, ভারতীয়দের ছিল বিমানবাহী রণতরী ও প্রচুর যুদ্ধজাহাজের সমন্বয়ে একটি টাস্কফোর্স।

সৈন্যের অনুপাত ছিল মারাত্মকভাবে অকিঞ্চিকর, ইস্টার্ন গ্যারিসনে এলাকার তুলনায়। ৪৫ হাজার সৈন্যকে আড়াই হাজার মাইল স্থল সীমান্ত এবং ৫শ’ মাইল সমুদ্রসীমা রক্ষায় লড়াই করতে হয়েছে। ১৯৪০ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ওয়েস্টার্ন ফ্রন্টে ৪শ’ মাইল রক্ষায় ইঙ্গ-ফ্রাঙ্কো বাহিনী ১১১টি ডিভিশন মােতায়েন করে। অর্থাৎ এ ফ্রন্টের প্রতি সাড়ে তিন মাইলের জন্য ছিল একটি করে ডিভিশন। তাবুকে ৩০ মাইলের একটি ভূখণ্ড রক্ষার দায়িত্বে ছিল অস্ট্রেলীয় বাহিনীর ২৪ হাজার সৈন্য। তারপরও বলা হয়েছিল যে, এ ভূখণ্ড রক্ষায় যথেষ্ট সৈন্য মােতায়েন করা হয়নি। মিসরের আল-আমিনে দ্বিতীয় দফা লড়াইয়ে ৪০ মাইলের একটি এলাকা রক্ষায় মার্শাল রােমেল ২৭ হাজার জার্মান ও ৫০ হাজার ইতালীয় সৈন্য মােতায়েন করেছিলেন। | খুবই সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল তখন পাকিস্তানের ওয়েস্টার্ন গ্যারিসন। এ গ্যারিসনকে কেবলমাত্র ভারতের সঙ্গে ১ হাজার ৬শ’ মাইল সীমান্ত রক্ষা করতে হয়েছে। ইরান ও আফগানিস্তানের মতাে মুসলিম দেশগুলাে থাকায় ওয়েস্টার্ন। গ্যারিসনের পশ্চাদ্ভাগ ছিল নিরাপদ। এ গ্যারিসনে ছিল ১২ ডিভিশন সৈন্য এবং আরাে ছিল ক্ষিপ্রগতিসম্পন্ন কয়েকটি সাজোয়া ডিভিশনের সমন্বয়ে গঠিত এলিট রিজার্ভ ফোর্স। এছাড়া ছিল বিমান ও নৌবাহিনীর পূর্ণ শক্তি। সুপ্রিম কমান্ডার জেনারেল ইয়াহিয়ার অধীনে তিন বাহিনীর তিনজন প্রধান এবং আরাে অনেক জেনারেল, অ্যাডমিরাল ও এয়ার মার্শাল ছিলেন। ওয়েস্টার্ন গ্যারিসন জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থনও পেয়েছে। অর্থনৈতিক শক্তিও তাদের পেছনে ছিল। পূর্ব পাকিস্তানে। ভারতের অর্ধেক সমর শক্তি নিয়ােজিত ছিল। এ অবস্থায় জেনারেল টিক্কার অধীনস্থ এলিট রিজার্ভ ফোর্স পরিকল্পনা অনুযায়ী চূড়ান্ত হামলা শুরু করতে পারলেই যুদ্ধের  মােড় ঘুরে যেত। এলিট রিজার্ভ ফোর্সের পরিকল্পিত হামলার ওপরই ভারতের সঙ্গে যুদ্ধের জয় পরাজয় প্রত্যক্ষভাবে নির্ভরশীল ছিল। রিজার্ভ ফোর্সের সফল অভিযান পরিচালনায় অক্ষমতা, সংখ্যার দিক থেকে হীনবল ও অর্ধসজ্জিত ইন্টার্ন গ্যারিসনের ভাগ্য বিপর্যয় ঘটায় এবং পশ্চিম পাকিস্তানে সামরিক তৎপরতায় বিরূপ প্রভাব পড়ে। যুদ্ধ পরিচালনায় ওয়েস্টার্ন গ্যারিসনের ভূমিকাই ছিল মুখ্য।

প্রতিরক্ষা ধারণার মূল কথা ছিল যে, সময়মতাে ও কার্যকরভাবে এ ধারণা প্রয়ােগ করতে হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে, সময়মতাে ও কার্যকরভাবে এ ধারণা কাজে লাগানাে হয়নি। ইয়াহিয়া খান ৩ ডিসেম্বর বিলম্বিত যুদ্ধ শুরু করেন। মাত্র কয়েক দিনের যুদ্ধে তিনি সাড়ে ৫ হাজার বর্গমাইল ভূখণ্ড হারান। তিনি যুদ্ধ শুরু করতে ১৩ দিন বিলম্ব করেন। এ ফাকে ভারতীয় সেনাবাহিনী ইস্টার্ন ফ্রন্টে তাদের অবস্থা সংহত করার জন্য যথেষ্ট সময় পেয়ে যায়। সাড়ে ৫ হাজার বর্গমাইল ভূখণ্ড দখল করার পর ওয়েস্টার্ন ফ্রন্টে সামরিক ভারসাম্য ভারতীয়দের অনুকূলে চলে যায়। ভারতীয়রা মারালার প্রতি হুমকি সৃষ্টি করে এবং রেতি বিচ্ছিন্ন করার লক্ষ্যে অবস্থান গ্রহণ করে। করাচি বাদবাকি পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সুবিধাজনক অবস্থানে থেকেও ওয়েস্টার্ন গ্যারিসন শােচনীয় অবস্থায় পতিত হয়। টিক্কার মানসিক দুর্বলতার জন্য বহুল প্রত্যাশিত হামলা ইপ্সিত ফলাফল অর্জনে ব্যর্থ হয়। ইস্টার্ন গ্যারিসন এক বিস্তৃত সেনাবাহিনী হিসেবে লড়াই করে। এ গ্যারিসনকে এর নিজের হাই কমান্ড। পরিত্যাগ করেছিল। ইস্টার্ন গ্যারিসনের আত্মসমর্পণ সকল পক্ষ-মুজিব, ভুট্টো, ইয়াহিয়া ও পরাশক্তিগুলাের মনঃপূত হয়। কি চমৎকার পরিকল্পনা! মুজিব স্বাধীন বাংলাদেশের এবং ভুট্টো খণ্ডিত পাকিস্তানের নেতা হিসেবে আবির্ভূত হবেন। অধিকতর বিপর্যয় ঘটার আগে পশ্চিম পাকিস্তানকেও রক্ষা করতে হবে। পশ্চিম পাকিস্তান রক্ষায় ইস্টার্ন গ্যারিসনের এ অসম্মানকে ক্ষুদ্র মূল্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এক গভীর চক্রান্ত কার্যকর করা হয়। পশ্চিম পাকিস্তান রক্ষা পায়। তবে খড়গ পতিত হয় ইন্টার্ন গ্যারিসনের মাথার ওপর। দাবার ছকে শুধু পূর্ব পাকিস্তানের নয়; পশ্চিম পাকিস্তানের রণাঙ্গনেও পরাজয় ঘটেছে। পতনে টিক্কার ভূমিকা সুদূরপ্রসারী প্রতিক্রিয়া ও পরিণাম ডেকে এনেছে। পাকিস্তান ভাঙার পেছনে তার ভূমিকা ভুট্টো অথবা ইয়াহিয়ার চেয়ে কোনাে অংশেই কম নয়। এমন কুৎসিত ও কলঙ্কিত ভূমিকা পালন করার পরও তাকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চিফ অভ স্টাফ পদে নিযুক্তি দেয়া হয়। হামুদুর রহমান কমিশন তার কার্যকলাপ এড়িয়ে যায় এবং কমিশন তাকে হাজির হওয়া থেকে অব্যাহতি দেয়। 

সূত্র : দ্য বিট্রেয়াল অভ ইস্ট পাকিস্তান – লে. জে. এ. এ. কে. নিয়াজি (অনুবাদ)