You dont have javascript enabled! Please enable it!

জেনারেল আবদুল হামিদ খানের রিপাের্ট

জেনারেল নিয়াজিকে আমি ভালাে করেই চিনি। তিনি আমার অধীনে দীর্ঘদিন বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছেন। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর থেকে তিনি ‘টাইগার’ নামেই পরিচিত। জেনারেল নিয়াজি আমাদের সেনাবাহিনীতে সর্বাধিক পদকপ্রাপ্ত অফিসার। ১৯৭১-এ জেনারেল টিক্কা খানের স্থলাভিষিক্ত করা হয় তাঁকে পূর্ব পাকিস্তানের জটিল ও কঠিন পরিস্থিতি মােকাবেলায়। একজন বাস্তববাদী সৈনিক ও বৈরি পরিস্থিতিতে দায়িত্ব পালনে সক্ষম জেনারেল নিয়াজি অপকট, সৎ, দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ও নিবেদিত। প্রচণ্ড চাপ ও বৈরি পরিবেশে সৈন্য পরিচালনার সামর্থ্য তার রয়েছে। তিনি ১৯৭১-এর এপ্রিল থেকে পূর্ব পাকিস্তানে সংকট মােকাবেলা করেছেন এবং মাত্র দু’মাসে বিদ্রোহীদের পরাজিত করেন এবং পূর্ব পাকিস্তানের মাটিতে ছদ্মবেশে লড়াইরত বিএসএফ ও ভারতের নিয়মিত সৈন্যদের ভারতে তাড়িয়ে দেন। এ অভিযান অত্যন্ত দ্রুতগতিতে ও সাহসিকতার সঙ্গে পরিচালনা করা হয়। এতে কৌশলগত দক্ষতা, নিপুণ পরিকল্পনা ও কঠোর শ্রমের প্রতিফলন ঘটেছে। জেনারেল নিয়াজির পরিকল্পনা ছিল সুষ্ঠু এবং আমি ও প্রেসিডেন্ট উভয়ে এ পরিকল্পনা অনুমােদন করেছিলাম পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা এবং পাকিস্তানের ভূখণ্ডে বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠার সুযােগ না দেয়ার জন্য। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের যুদ্ধ ও ঘটনাবলীকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখা যেতে পারে না। দেশের অধিকাংশ সামরিক শক্তি ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে এবং পশ্চিম রণাঙ্গনের বিজয় পূর্ব। রণাঙ্গনের বিজয় নিশ্চিত করতে পারত। অভ্যন্তরীণ আইন-শৃখলা বিশেষ করে যােগাযোেগ রুট ও বড় বড় শহর রক্ষা এবং দেশের অভ্যন্তরে বিদ্রোহী তৎপরতা মােকাবেলায় নিয়ােজিত বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তাদানে জেনারেল নিয়াজির তিনটি পদাতিক ডিভিশন অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করেছে। এ তিনটি ডিভিশন অবিচল সাহস, অদম্য উৎসাহ, চরম আত্মত্যাগ ও নিষ্ঠার সঙ্গে লড়াই করেছে গােলন্দাজ সহায়তার ঘাটতি এবং কার্যত বিমান বাহিনীর ছত্রছায়া না থাকা সত্ত্বেও শত্রুর পঞ্চম বাহিনীর অবিরাম গােলযােগের মুখে।

ইতিহাসে এমন নজির খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তারা শত শত যুদ্ধবিমান ও হেলিকপ্টার এবং ট্যাংক ও গােলন্দাজ বাহিনীর সমর্থপুষ্ঠ ১২ ডিভিশন ভারতীয় সৈন্যের সঙ্গে লড়াই করেছে। এ প্রচণ্ড প্রতিকূলতা সত্ত্বেও ‘টাইগার’ নিয়াজির নেতৃত্বে, আমাদের বীর ও নিবেদিত প্রাণ সৈন্যরা অস্ত্র সমর্পণের নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত লড়াই অব্যাহত রেখেছে। ‘টাইগার’ তাঁর সৈন্যদের শেষ রক্ত বিন্দু ও শেষ বুলেট দিয়ে লড়াই চালিয়ে যাবার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রেসিডেন্টের নির্দেশ এবং আমার পরামর্শে তাকে আত্মসমর্পণ করতে হয়েছে। পূর্ব রণাঙ্গনে সামরিক নয়, রাজনৈতিক বিপর্যয় ঘটেছে। এ রাজনেতিক বিপর্যয়ের বীজ বপন করা হয় বহু বছর আগে। রাজনৈতিক কারণে পূর্ব পাকিস্তানে অসন্তোষ দানা বেধে ওঠে। পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক অসন্তোষের জন্য ১৯৭১ সালে জেনারেল নিয়াজি ও তার বীর সিপাহী এক কথায় গােটা সেনাবাহিনীকে চরম মূল্য দিতে হয়েছে। ইস্টার্ন গ্যারিসনের সাহসিকতা, দক্ষতা ও কর্তব্যনিষ্ঠা পরিস্থিতিকে পাল্টে দিতে পারে নি। | একটি উজ্জ্বল ক্যারিয়ারের দ্রুত পরিসমাপ্তি ঘটে, আত্মসমর্পণের নির্দেশ পালন করায়। জেনারেল নিয়াজির মতাে সর্বোত্তম ফিল্ড কমান্ডার আমি কখনাে দেখি নি এবং এমন একজন কমান্ডারের সঙ্গে আমার আর কোথাও কাজ করার সৌভাগ্য হয়। নি। আমি তার সর্বাঙ্গীণ সাফল্য কামনা করি এবং একথা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, তিনি তথাকথিত বহু দেশপ্রেমিকের চেয়ে দেশের জন্য অনেক বেশি আত্মত্যাগ করেছেন।

আবদুল হামিদ খান

জেনারেল

এপ্রিল ১৯৭২

গােপনীয়

অবিলম্বে সদর দপ্তর ইন্টার্ন কমান্ড ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট ফোন : ২৫১ ৭২১/আর/এআই

১৫ এপ্রিল ১৯৭১

কমান্ডার, ১ ডিভিশন। কমান্ডার সিএএফ কমান্ডার, ১৪ ডিভিশন এসিসি পিএএফ কমান্ডার, ১৬ ডিভিশন। ওসি সিডাে, বিএন ডিজি, ইফকাফ

ওসি ৬০৪ এফআইইউ কমান্ড ইপি লগ এরিয়া ওসি, ৭৩৪ এফআইসি কনসেপ

২৭ জিএল সেকশন সদর দপ্তর, এমএলএ জোন ‘বি’। ডেট আইএসআই জিএস ব্রাঞ্চ

এ্যাস্টাবলিশমেন্ট ব্রাঞ্চ সদর দপ্তর, ডেফ কয়।

ইনফো অভ্যন্তরীণ ডিস্ট্রিক্ট

বিষয় : শৃখলা-সৈন্য

১. আমি এসে পৌছানাের পর থেকে সৈন্যদের লুটতরাজ, অগ্নিসংযোেগ ও

হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার ভুরি ভুরি খবর পাচ্ছি। সম্প্রতি ধর্ষণের খবরও পাওয়া যাচ্ছে এমনকি পশ্চিম পাকিস্তানিরাও রেহাই পাচ্ছে না। ১২ এপ্রিল দু’জন পশ্চিম পাকিস্তানি মহিলাকে ধর্ষণ করা হয় এবং আরাে দু’জনকে ধর্ষণ করার চেষ্টা করা হয়। শােনা যাচ্ছে যে, প্রত্যাবর্তনকারী পরিবারের মাধ্যমে লুষ্ঠিত মালামাল পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠানাে হচ্ছে। আমি আরাে খবর পাচ্ছি যে, এসব জঘন্য কর্মকাণ্ডের সঙ্গে অফিসাররাও জড়িত রয়েছেন। উপর্যুপরি নির্দেশ দেয়া সত্ত্বেও কমান্ডারগণ এ চরম বিশৃঙ্খলাপূর্ণ পরিস্থিতি মােকাবেলায় ব্যর্থ হয়েছেন। আমার ধারণা, ইউনিট ও সাব-ইউনিটের ওসি এবং ওএসসি’গণ এসব অপরাধ গােপন করেছেন ও প্রশ্রয় দিচ্ছেন।

৩.  আমি সকল কমান্ডারকে হুঁশিয়ার করে দিচ্ছি যে, অবিলম্বে এসব জঘন্য তৎপরতা বন্ধ এবং নির্মূল করা না হলে লড়াইয়ের সামর্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলা ভেঙে পড়বে। এটা একটা সংক্রামক ব্যাধি এবং আপনাদেরকে এ সমস্যার বিরূপ প্রতিক্রিয়া ও সূদুরপ্রসারী পরিণাম সম্পর্কে পুরােপুর সচেতন হতে হবে। নয়তাে একদিন তা আমাদের মা-বােন এবং আমাদের নিজস্ব লােকজনের জন্য বুমেরাং হয়ে দেখা যাবে। ইতিহাসে এমন বহু নজির রয়েছে যে, লুটতরাজ ও ধর্ষণের লিপ্ত হওয়ায় যুদ্ধে সৈন্যদের পরাজিত হতে হয়েছে।

৪. অতএব, আমি সৈন্যদেরকে নির্দেশ দিচ্ছি যে, প্রত্যেককে সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে হবে। নয়তাে শাস্তি পেতে হবে তাদেরকে। বিশৃঙ্খলা, অসদাচার ও অর্থনৈতিকতাকে কঠোরহস্তে নির্মূল করা হবে। এ ধরনের হীন কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার দায়ে দোষী প্রমাণিত হলে অফিসারসহ সকলকে কঠোর দণ্ড ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হবে। আমি আমার সৈন্যদেরকে ভবঘুরে এ সদস্যতে পরিণত হতে দেব না। এ ধরনের লােকের প্রতি কোনাে সহানুভূতি ও করুণা প্রদর্শন করা হবে না।

৫.  আমি কমান্ডারদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, আমাদের একটি মহান মিশন রয়েছে এবং আমরা আমাদের লক্ষ্য থেকে কখনাে অনেক দূরে। কোনাে বাধাই আমাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে আমাদেরকে বিরত রাখতে পারবে না। তবে বিশৃঙ্খলাই কেবল আমাদের ক্ষতি করবে।

৬. আমি রণাঙ্গনের প্রতিটি সৈনিককে শৃঙ্খলার একটি মূর্ত প্রতীক ও উদাহরণ হিসেবে দেখতে চাই। আমি অফিসারদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, তাদের সম্মান ও আচরণের একটি বিধি রয়েছে এবং অদ্রলােক ও অফিসার হিসেবে তারা এ আচরণ বিধি মেনে চলবেন। এ প্রদেশের জনগণের মন জয় এবং আমাদের লক্ষ্য অর্জনে এ আচরণ বিধি মেনে চলা খুবই জরুরি।

৭. এ নির্দেশ পূর্ব পাকিস্তানে নিয়ােজিত সব গােয়েন্দা সংস্থা, এমপি ও এসএসজিদের ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রয়ােজন।

স্বাক্ষর

লে. জেনারেল কমান্ডার, ইন্টার্ন কমান্ড

(আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি)

গােপনীয়

গােপনীয় ব্যক্তিগত

অবিলম্বে সদর দপ্তর, ইস্টার্ন কমান্ড ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট টেলিফোন : ২১০ (মিলিটারি) ০০৫/ আর / জিএস (অপারেশন)

১৮ এপ্রিল, ১৯৭১

কমান্ডার, ৯ ডিভিশন। কমান্ডার, ১৪ ডিভিশন কমান্ডার, ১৬ ডিভিশন কমান্ডার, ইপি লগ এরিয়া,

ইনফো। অভ্যন্তরীণ

(অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ব্রাঞ্চ)

বিষয়

ফিল্ডে শৃংখলা

আমি আপনাদেরকে বেশ কয়েকটি চিঠি লিখেছি এবং আশা করি, আপনারা আমার চিঠির বিষয়বস্তু আপনাদের অধীনস্থ সব অফিসারের কাছে পৌছে দিয়েছেন। আমি বুঝতে পারছি যে, এত দ্রুত ফলাফল পাওয়া যাবে না। যা হােক, এটা আমার জন্য খুবই বিরক্তিকর যে, ফিন্ডে কিছু মৌলিক ভূল হচ্ছে। এগুলাে রােধ ও সংশােধন করা প্রয়ােজন। কমান্ডার ও অফিসারগণ এসব দোষ-ক্রটির প্রতি নজর না দিলে আমরা কেবল সৈন্য ও অফিসারদের যুদ্ধের জন্য ক্ষতিকর বদভ্যাসেই উৎসাহিত বিষয়াদি এবং ফিল্ড শৃংখলায় বিশেষভাবে মনােযােগ দেবে।

কয়েকটি ইউনিটে সাম্প্রতিক সফরকালে আমার এ ধারণা হয়েছে যে, যুদ্ধে শৃঙ্খলার যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। মনে হয়েছে অফিসার ও সৈন্যরা যে সেনাবাহিনীর গৌরববাজ্জ্বল ঐতিহ্য থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছেন। আমি যা দেখেছি সেগুলাে সংশােধন করার জন্য আমি বিষয়গুলাে আপনাদের নজরে আনতে চাইক. যুদ্ধ কৌশল ও যুদ্ধ অনুশলীনের অভাব। খ. অফিসার ও সৈনিকরা পুরােপুরি ভুলে গেছে যে, তারা যুদ্ধের মাঠে রয়েছে।

সুতরাং তাদেরকে পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে থাকতে হবে। ১৯৭১ সালের ১১ এপ্রিল। আমি আমার সম্মেলনে বলেছিলাম যে, সর্বস্তরের সৈন্যকে এফএসএমও-সহ সজ্জিত থাকতে হবে এবং সারাক্ষণ যথাযথভাবে অস্ত্র বহন করতে হবে। যৌক্তিক কারণে শিরস্ত্রাণসহ পােশাকে মিল থাকতে হবে। জেনারেল। পদমর্যাদার অফিসার ছাড়া অন্যান্য সকলকে ফিল্ডে একই রকম পোশাকে। সজ্জিত হতে হবে। সকল পর্যায়ের সেনাদের এফএসএমও (প্যাকসহ অথবা প্যাকবিহীন) পরিধান করতে হবে। তাদেরকে স্টিল হেলমেট পরতে হবে এবং ব্যক্তিগত অস্ত্র বহন করতে হবে। কমান্ডারের অধঃস্তন অফিসারদের মানচিত্র, বাঁশি, নােট বুক, কম্পাস, বাইনােকুলার, পয়েন্টার প্রভৃতি সামগ্রী বহন করতে হবে। অফিসে অথবা বিশ্রামকালে বেসামরিক পােশাক পরিধান করা যাবে। রণাঙ্গনে পিক ক্যাপ (উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সামরিক টুপি) পরা যাবে না।

গ. প্রতিরক্ষাকালে অথবা স্থায়ী অবস্থানে সর্বক্ষণ যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে না। কোনাে নতুন অবস্থান দখল করা মাত্র সেখানে যথাযথ প্রতিরক্ষা ও প্রতিরােধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আকস্মিক হামলা অথবা অনুপ্রবেশ সম্পর্কে সদা সতর্ক থাকতে হবে। একটি নতুন অবস্থানে পৌছা মাত্র তৎক্ষণাৎ প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং যুদ্ধ অনুশলীন অনুযায়ী প্রহরা চৌকি স্থাপন করতে হবে। গুচ্ছ‘ভাবে চলাফেরা করার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। মর্টারের গােলাবর্ষণে ইতােমধ্যে এরকম চলাফেরা ক্ষয়ক্ষতির কারণ হয়ে দাড়িয়েছে। মনে হচ্ছে আমরা সড়ক নির্ভর হয়ে পড়েছি এবং পায়ে চলাফেরা করতে ভুলে গেছি। আমরা কদাচিৎ দেশের ভেতর স্বচ্ছন্দে চলাফেরা করছি। অনুসনিন্ধৎসু, গুরুত্ব অনুধাবনের ক্ষমতা ও আক্রমণাত্মক মনােভাবের অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। আমি এগুলাের ওপর জোর দিচ্ছি এবং আশা করছি যে, অধঃস্তন কমান্ডারগণ এমনভাবে কাজ করবেন যাতে উর্ধ্বতন কমান্ডারদের মিশনে সহায়ক হয়। পরস্পরের মধ্যে একবার যােগাযোেগ হলে তা অবশ্যই বজায় রাখতে হবে এবং কঠোরভাবে মেনে চলতে হবে। চ, অবহেলা দেখানাে হচ্ছে অস্ত্রশস্ত্রের পরিচর্যায় । অস্ত্রশস্ত্রগুলাে পরিষ্কার রাখতে হবে, তেল দিতে হবে এবং যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত রাখতে হবে। তেল ও পরিষ্কার করার মাল-মসল্লার কোনাে অভাব নেই। | দু, সৈন্যরা বৈরী আবহাওয়ায় টিকতে পারছে না এমন ধারণা করা হচ্ছে। সকল সেনাকে যে কোনাে ধরনের আবহাওয়ার জন্য মানসিক ও শারীরিকভাবে অবশ্যই তৈরি হতে হবে। আবহাওয়া কখনাে কখনাে যুদ্ধে ও রণাঙ্গণে আশীর্বাদ হয়ে দেখা দেয়। সেনাদের প্রতি মনােযােগে শিথিলতা প্রদর্শন করা যাবে না। চরম প্রতিকূল অবস্থায়ও যথাযথ বিশ্রাম ও স্বস্তির ব্যবস্থা করতে।

জ. মূল যােগাযােগের প্রতি যথেষ্ট মনােযােগ দেয়া হচ্ছে না। আমার এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই যে, এমন অনেক দুর্বলতা রয়েছে যেগুলাে অবশ্যই আপনাদের নজরে আসবে। বর্তমানে আমরা অসংগঠিত বিদ্রোহী ও অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে লড়াই করছি। তবে আমাদেরকে একটি অত্যন্ত সুসংগঠিত শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। এটা খুবই জরুরি যে, সকল পর্যায়ের কমান্ডারদের অবশ্যই আনুগত্যের ওপর জোর দিতে হবে এবং নির্দেশ মেনে চলতে হবে। যুদ্ধের মেজাজ পুরােপুরি বজায় রাখার এবং যুদ্ধ প্রস্তুতি নিশ্চিত করার এটাই হচ্ছে একমাত্র উপায়।

 লে. জে, কমান্ডার (এ. এ. কে. নিয়াজি)

গােপনীয়

একটি গােপনীয় দলিল প্রকাশ এ. টি. চৌধুরী কর্তৃক, দৈনিক ডন, ২৩ ও ২৬ জুলাই ১৯৮৬ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এখনাে প্রকাশ করার সময় হয়নি! এ রিপাের্টের লক্ষ্য হচ্ছে, বিভিন্ন সূত্র থেকে সংগৃহীত ও সমর্থিত-অখণ্ডণীয় প্রমাণের ভিত্তিতে একটি মিথ্যা নাটকের রহস্য উন্মােচন করা। একটি গণতান্ত্রিক সরকার জাতীয় ইতহািসের একটি অবিস্মরণীয় ও ক্ষমাহীন ঘটনা সম্পর্কে জনগণকে অন্ধকারে রেখেছিল। এ সরকার এ ঘটনা তদন্তে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিশন গঠন করেছিল। কিন্তু গােপন রাখা হয়েছে এ কমিশনের রিপাের্ট। জনগণের কাছে দায়বদ্ধ একটি গণতান্ত্রিক সরকার কেন এমন করতে গেল, এর রহস্য উদঘাটন করা প্রয়ােজন।

তদানীন্তন সরকার হামুদ-উর-রহমান কমিশনের রিপাের্ট পরিবর্তন অথবা এ রিপােটের সমালােচনা না করে দুতিন দশকের জন্য এ রিপাের্ট প্রকাশের ওপর। নিষেধাজ্ঞা আরােপ করে এটা সচিবালয়ের মােহাফেজখানায় তালাবদ্ধ করে রাখতে পারত। কারণ তখন আবেগ ছিল তুঙ্গে এবং পরিস্থিতি ছিল উথাল-পাতাল। পরিস্থিতির দোহাই দিয়ে এ রিপাের্ট প্রকাশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরােপ করলে তাতে খুব এটা দোষ হতাে না। সব গণতান্ত্রিক দেশেই এমন করা হয়। অভিজ্ঞতা। থেকে দেখা গেছে যে, সকল গণতান্ত্রিক দেশে ঐতিহাসিক দলিলগুলাে গােপন রাখা। হয় এবং একটি নির্দিষ্ট সময় অতিবাহিত হওয়ার পর এগুলাে প্রকাশ করা হয়। কারণ তখন ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের জীবিত থাকার সম্ভাবনা থাকে কম। ততদিনে জনগণের আবেগও প্রশমিত হয়ে আসে এবং ঘটনার বস্তুনিষ্ঠতা সম্পর্কে চ্যালেঞ্জ করার মতাে ইতিহাসবিদ ও প্রত্যক্ষদর্শীও খুব একটা উপস্থিত থাকেন না।

জনগণের নির্বাচিত সাবেক সরকার যেসব কাজ করছে সেগুলাের মধ্যে রয়েছে :

(ক) কমিশনের রিপাের্টে দোষী প্রমাণিত কয়েকজন জেনারেলকে কোর্ট মার্শালে বিচার করার পরিবর্তে তাদেরকে অবসরে পাঠায় এবং অন্যান্যদের রাষ্ট্রদূত হিসেবে বিদেশে কূটনৈতিক দায়িত্বে নিয়ােগ করে। অপরাধ ও ভুলের জন্য শাস্তি না দিয়ে কয়েকজনকে দেয়া হয় পুরস্কার।

( খ) বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ অংশ বাদ দিয়ে সংক্ষিপ্ত আকারে জনসমক্ষে এ রিপাের্ট প্রকাশ করা হয়। যে অংশ বাদ দেয়া হয়েছে সেখানে রয়েছে পরাশক্তিসহ কয়েকটি বিদেশি শক্তির পাঠাননা অতি গােপনীয় বার্তা অথবা গােপনীয় সরকারি দলিল। নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলাে জাতীয় স্বার্থে সংরক্ষণ করা উচিত ছিল। যুক্তিসঙ্গত পথ পরিহার করে পিপিপি সরকারের কর্তাব্যক্তিরা হামুদ রিপাের্টকে শুধু প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সম্পত্তিতেই পরিণত করে নি, তারা এ রিপাের্টকে একপেশে, সংক্ষিপ্ত ও পক্ষপাতমূলক আখ্যায়িত করে সমালােচনাও করেছে। রিপাের্টটিকে অপর্যাপ্ত দেখতে পেয়ে ভুট্টোর লােকজন তাদের নেতাকে ছাড়া অন্য কাউকে দোষারােপ করতে পারে নি। এ কমিশন গঠনের সময় ভুট্টো এর সীমারেখা বেঁধে দিয়েছিলেন এবং তদন্তের পরিধি সংকুচিত করেছিলেন।  বিশ্বস্ত সূত্রের ভিত্তিতে জানা গেছে যে, তদন্ত কমিশনকে সামরিক বিপর্যয়ের মধ্যেই তাদের তদন্ত সীমাবদ্ধ রাখার এবং আত্মসমর্পণের জন্য দায়ী রাজনৈতিক ঘটনাবলী চাপা দেয়ার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। বিচারপতি হামুদ-উর-রহমান ঢাকার অনাকাঙিক্ষত পতনের পূর্বের পরিস্থতিকে সামগ্রিকভাবে বিচারের জন্য। তদন্তের পরিধি বিস্তৃত করার সুপারিশ করেছিলেন বলে শােনা যায়। এখানে উদ্দেশ্য। ছিল পরিষ্কার।  এই উদ্দেশ্যের প্রতিফলন ঘটেছে কমিশন গঠনেও। এ বিষয়ে কোনাে সন্দেহ নেই যে, এ কমিশনের নেতৃত্ব দিয়েছেন এমন একজন বিচারপতি যার সততা সম্পর্কে সন্দেহ করার কোনাে সুযােগ নেই। তবে এ-কথাও ভুলে গেলে চলবে না যে, তিনি ছিলেন জন্মগতভাবে একজন পূর্ব পাকিস্তানি। পূর্ব পাকিস্তান আলাদা হয়ে যাওয়ায় তিনি অবশ্যই মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন। তদন্তে তাঁর এ মানসিক দুর্বলতার প্রতিফলন ঘটা বিচিত্র নয়। তদন্ত কমিশনে কোনাে নিরপেক্ষ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও সুযােগ্য কোনাে সামরিক বিশেষজ্ঞকেও রাখা হয় নি। তবে একথা সত্য যে, তদন্ত কমিশন পরবর্তীকালে তদন্ত কার্যে দু’জন সামরিক উপদেষ্টা নিয়ােগ করেছিলেন।

কিন্তু তাদের নিয়ােগ বিতর্কের ঊর্ধ্বে ছিল না। সামরিক উপদেষ্টা হিসেবে যে দু’জনকে নিয়ােগ করা হয় তাদের একজন হলেন লে. জেনারেল আলতাফ কাদির এবং অন্যজন হলেন মেজর জেনারেল কোরেশী। মেজর জেনারেল কোরেশী ‘পাকিস্তান আর্মি’ নামে একটি বই লিখেছেন। তার সঙ্গে তদানীন্তন সরকারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল এবং সরকার তাকে খুব বিশ্বাস করতাে। তদানীন্তন সরকার হামুদ-উর-রহমান কমিশনের শর্তাবলী সীমিত করে দেয়ায় এটাই প্রমাণিত হয় যে, এ কমিশনের রিপাের্টকে সরকার তার মন মতাে করে তৈরি। করাতে চেয়েছিল। তদানীন্তন সরকার বিশ্বের বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্রের ব্যবচ্ছেদ এবং সামরিক বিপর্যয়ের রাজনেতিক পটভূমি গােপন রাখতে চেয়েছিল। এটা দুঃখজনক যে, তদন্ত কমিশন সরকারের এ হীন উদ্দেশ্যে নীরবে সায় দিয়েছে এবং ভুট্টোর হুকুম শিরােধার্য করেছে। নির্ভরযােগ্য সূত্র থেকে জানা গেছে যে, রিপাের্টে ক্ষমতা দখলকারী’ হিসেবে ইয়াহিয়ার বিচারের সুপারিশ করা হয়েছিল। তবে কমিশন ইয়াহিয়াকে অসময়ে আত্মসর্মপণের নির্দেশদান এবং পাকিস্তানের বিরাট ট্রাজেডির জন্য দায়ী করে বিচারের সুপারিশ করে নি। একথা সত্য যে, ইয়াহিয়া খান প্রেসিডেন্ট আইউবকে হটিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন। এটা তার যত বড় দোষ তার চেয়ে হাজার গুণ বড় দোষ হচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানে বিপর্যয়ে তার বিশ্বাসঘাতকতাপূর্ণ ভূমিকা। ইয়াহিয়াকে ছাড় দিয়ে সুপারিশ করা হলেও তথাকথিত দেশপ্রেমিকরা তার বিচারের চেষ্টা করে নি। এসব দেশপ্রেমিকরা পুরনাে পাকিস্তানের ধ্বংস্তুপের ওপর নতুন পাকিস্তান  গড়তে চেয়েছিলেন।

প্রশ্ন হচ্ছে, মূল খলনায়কে কেন অব্যাহতি দেয়া হলাে? এটা কি এ জন্য যে, তার বিচার হলে মূল নায়কদের মুখােশ উন্মােচিত হবে এবং প্যান্ডােরার বাক্স খুলে যাবে? [ এ বিয়ােগান্ত নাটকের প্রধান প্রধান চরিত্রের উল্লেখ করতে গিয়ে ভুট্টোর একজন জীবনীকার অত্যন্ত স্পষ্টভাবে বলেছেন যে, “১৯৭১-এর বিপর্যয়ের জন্য ইয়াহিয়া, মুজিব ও ভুট্টো দায়ী। তিনি আরাে বলেছেন, অনেকের মতে, এ তিন জনের মধ্যে ভুট্টো ছিলেন সবচেয়ে চতুর রাজনীতিক। তার কার্যকলাপের পরিণাম উপলব্ধি করার মতাে যথেষ্ট শিক্ষা ও জ্ঞান তাঁর ছিল। সুতরাং এ বিয়ােগান্ত ঘটনার সিংহভাগ দায়িত্ব অবশ্যই তাকে গ্রহণ করতে হবে। (ভুট্টো : আ পলিটিক্যাল বায়ােগ্রাফি : সালমান তাসির) ভুট্টো কেন হামুদ-উর-রহমান কমিশনের রিপাের্টে গােপন করেছিলেন তা উপরের উক্তি থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ভুট্টোর জীবনী লেখক সালমান তাসির আরেক জায়গায় লিখেছেন, “ভুট্টো এ রিপাের্ট প্রকাশে কখনাে সাহস পান নি। কারণ যেসব রাজনৈতিক কার্যকলাপ ও ভ্রান্তিতে দেশ ভেঙে গেছে তিনি সেগুলােতে অত্যন্ত গভীরভাবে জড়িত ছিলেন। হ্যা, তিনি তাই ছিলেন। কমিশন যে পরিস্থিতিতে কাজ করছিল সে পরিস্থিতিতে ভুট্টোর অনুকূলে চূড়ান্ত রিপাের্ট দেয়া ছাড়া কমিশনের গত্যন্তর ছিল না। কমিশন চূড়ান্ত রিপাের্টে ভুট্টোর ভূমিকা এড়িয়ে যায় এবং মুজিব ও ইয়াহিয়াকে দোষারােপ করে। নিজের দোষ প্রকাশ পাবার ভয়ে ভুট্টো গােপনে রিপাের্টটি প্রকাশ করেছিলেন। | ঢাকার পতন ঘটার আগে ভুট্টো প্রকাশ্যে ঘােষণা করেছিলেন যে, দেশে তিনটি শক্তিশালী পক্ষ রয়েছে। এগুলাে হচ্ছে আওয়ামী লীগ, সেনাবাহিনী ও পিপিপি । পিপিপিকে একটি একক শক্তিতে পরিণত করার জন্য এ ত্রিভুজ শক্তিকে ভেঙে দেয়ার প্রয়ােজন ছিল।

ক্ষমতার একক উত্তরাধিকারী হিসেবে পিপিপি’র আবির্ভাবের জন্য তা ভেঙ্গে দিতে হয়েছে। ১৯৭১ সালের মার্চে এ তিনটি শক্তির দুটি যখন সংঘর্ষে লিপ্ত হয় তখনই এ প্রক্রিয়া শুরু হয়। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে অবশিষ্ট পাকিস্তানের ক্ষমতার লাগাম ধরার জন্য ভুট্টোকে আমন্ত্রণ জানানাে হলে এ প্রক্রিয়া চূড়ান্ত রূপ লাভ করে। ক্ষমতায় বসেই তিনি ক্ষমতার অন্যান্য কেন্দ্র ধ্বংস অথবা অন্তত সেগুলােকে দুর্বল করার জন্য উঠে-পড়ে লাগেন। এ লক্ষ্য অর্জনের তিনি দুটি বিষয়ে মনােযােগ নিবদ্ধ করেন। একটি হচ্ছে যুদ্ধবন্দি এবং অন্যটি হচ্ছে হামুদ-উর-রহমান কমিশন। তিনি ৯৩ হাজার যুদ্ধবন্দির সাথে ৪৫ হাজার ছিল সৈন্য এবং বাদবাকিরা বেসামরিক লােকজন। এ সত্যকে কখনাে তুলে ধরা হয় নি। | হামুদ-উর-রহমান কমিশন যত সত্য প্রকাশ করেছে, গােপন করেছে তার চেয়েও বেশি। ভুট্টো এ কমিশনের রিপাের্ট সম্পর্কে এমন একটা ধারণা দিতেন যে, একটি টাইম বােমা রয়েছে তার কাছে। তিনি যাদের ভয় পেতেন তাদের মাথার ওপর ডেমােক্লিসের তরবারির মতাে এ রিপাের্ট ঘােরাতেন এবং যাদের পুষতেন তাদের মাথার ওপর

সরদার ফারুক আহমেদ খান লেঘারি

প্রেসিডেন্ট, ইসলামি প্রজাতন্ত্র পাকিস্তান

প্রেসিডেন্টের সচিবালয়, ইসলামাবাদ

বিষয় : পেনশন পুনরুদ্ধার জেনারেল অফিসার্স

জনাব,

১. পত্র-পত্রিকায় সম্প্রতি আপনার একটি বিবৃতি পাঠ করে অনুপ্রাণিত হয়ে আমি

এ আবেদন পেশ করছি। আপনার বিবৃতিতে আপনি বলেছেন যে, ইসলামের মৌলিক শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আপনি আপনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। আমি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের কাছে ন্যায়বিচার পাবার আশায় কলম তুলে নিয়েছি। আমি জানি যে, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ও সমুন্নত রাখাই প্রেসিডেন্টের মুখ্য দায়িত্ব। অন্যায়ের প্রতিবিধান করাই ইসলামের শিক্ষা। আমি আপনার কাছে আবেদন করতে আরাে অনুপ্রাণিত হয়েছি একারণে যে, প্রায় সিকি শতাব্দি আগে পূর্ব পাকিস্তানে বিপর্যয় ঘটেছে এবং ইতােমধ্যে বহু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা প্রকাশিত হয়েছে।

২. ১৯৭১ সালে জাতীয় ট্রাজেডি এবং পূর্ব পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার পরিণামে আমাকে ১৯৭৫ সালের ৫ মে সেনাবাহিনী থেকে অপসারণ করা হয় এবং আমাকে আমার কষ্টার্জিত পেনশন থেকে বঞ্চিত করা হয়। আমাকে পেনশন থেকে বঞ্চিত করায় শুধু আমাকেই নয়, একই সাথে আমার গােটা পরিবার এবং আমার আত্মীয় স্বজন যারা আমার আর্থিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল তাদেরকেও চরম দুর্ভোগ পােহাতে হয়েছে। এক প্রশাসনিক নির্দেশে কোনাে কারণ না দেখিয়ে আমাকে সার্ভিস থেকে অপসারণ করা হয়। আমি কোর্ট মার্শাল গঠন করার সুপারিশ করেছিলাম। কিন্তু আমার এ সুপারিশ গ্রহণ করা হয় নি। কোর্ট মার্শাল গঠন করা হলে গােটা যুদ্ধ পরিচালনায় হাই কমান্ডের ত্রুটি-বিচ্যুতি এবং অনেক অপ্রিয় সত্য প্রকাশিত হয়ে পড়তাে। হাই কমান্ড। এবং আরাে অনেকে তখন থেকে যারা সুখে-স্বাচ্ছন্দে দিন কাটাচ্ছে, তাদের সমষ্টিগত ভুলের মাশুল দিতে হয়েছে কেবল আমাকে একা। আমাকে এককালীন একটি পেনশন দেয়া হয়। এ পেনশন এতই সামান্য যে, তা কোনােক্রমেই নিয়মিত পেনশনের পরিপূরক নয় এবং একজন অবসরপ্রাপ্ত জেনারেলের মর্যাদা ও অধিকারের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।

৩.  প্রিয় প্রেসিডেন্ট, মুখােশধারীদের চেহারা আড়াল করার জন্য বহু নির্দোষ লােকের মতাে আমাকেও শাস্তি দেয়া হয়েছে। তবে এসব নির্দোষ লােক তাদের জীবদ্দশায় পুনর্বাসিত হয়েছেন। এজন্যই আমি আপনার কাছে ন্যায়বিচার প্রার্থনা করছি। আমাকে অজ্ঞাত ও অশ্রুত কারণে শাস্তি দেয়া হয়েছে।

৪. আমি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের কাছে সুবিচারের আশায় কিছু ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছি :

ক) আমি কোর্ট মার্শালের মুখােমুখি হতে চেয়েছিলাম। কোর্ট মার্শাল গঠন করা হলে সত্য প্রকাশিত হতাে এবং প্রকৃত অপরাধীরা ধরা পড়ে যেত। কিন্তু আমাকে কোর্ট মার্শালের মুখােমুখি হতে দেয়া হয় নি। তারা আমার বিরুদ্ধে কোনাে অভিযােগ আনতে পারে নি। কোট মার্শাল গঠন করা হলে যুদ্ধের শুরুতেই কেন পশ্চিম পাকিস্তান ব্যর্থ হয়েছিল, সেই সত্য উন্মােচিত হতাে এবং অন্যদিকে, এ সত্যও ফুটেও উঠতাে যে, ভারতীয় সৈন্যদের সঙ্গে আমাদের শক্তির অনুপাত ১০ ১ হওয়া সত্ত্বেও ইস্টার্ন কমান্ড প্রায় এক বছর অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে লড়াই করেছে। পশ্চিম রণাঙ্গনে উভয় পক্ষের শক্তির অনুপাত ছিল ১ ১।

খ)  ইসলামের ইতিহাসে এই প্রথমবার শত্রুর সঙ্গে আমাদের সৈন্য ও সম্পদে সমতা ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানে আমাদের জন্য পরিস্থিতিও ছিল অনুকূল। সার্বিক পরিকল্পনা অনুযায়ী সৈন্যরা তাদের অবস্থান গ্রহণ করে। সার্বিক জাতীয় পরিকল্পনার মূল বিষয়বস্তু ছিল, পূর্ব পাকিস্তানের যুদ্ধ করা হবে পশ্চিম পাকিস্তানে। ” সীমিত সম্পদ ও সৈন্য থাকায় ইন্টার্ন গ্যারিসনের ভূমিকা ছিল শুধু টিকে থাকা। অন্যদিকে মূল ও চূড়ান্ত লড়াই হবে পশ্চিম রণাঙ্গণে। কারণ অধিকাংশ সম্পদ ও সৈন্য ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। এছাড়া পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ ছিল অনুগত, পশ্চাদ্ভাগ ও পার্শ্বভূমি ছিল নিরাপদ। এবং গােটা নৌ ও বিমান বাহিনীও নিয়ােজিত ছিল সেখানে।

গ) আমাদের সুবিধামতাে ও পছন্দসই সময়ে যুদ্ধ শুরু করেও পশ্চিম রণাঙ্গনে আমরা শত্রু ভূখণ্ড দখল করার পরিবর্তে নিজেদের সাড়ে ৫ হাজার বর্গমাইল আয়তনের ভূখণ্ড হারাই। মাত্র ১০ দিনের লড়াইয়ে পশ্চিম রণাঙ্গনে আমাদের। এ বিপর্যয় সামরিক দিক থেকে অগ্রহণযােগ্য, অবিশ্বাস্য ও ক্ষমার অযােগ্য।

ঘ) পক্ষান্তরে, চরম প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ইস্টার্ন গ্যারিসন সীমিত সম্পদের সাহায্যে অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে সঙ্গে মিশন সম্পন্ন করে। কিন্তু আমাদের হাই কমান্ড অত্যন্ত অনুকূল অবস্থায় থেকেও মনােবল হারিয়ে ফেলে এবং  পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান গ্যারিসনের সর্বনাশ ডেকে আনে। পশ্চিম পাকিস্তানকে বিপর্যয় থেকে রক্ষা করার স্বার্থে আমাদেরকে পূর্ব পাকিস্তান পরিত্যাগ এবং শত্রুর কাছে আত্মসমর্পণের চরম গ্লানি মেনে নিতে হয়। যাদের ভুলে ও ব্যর্থতায় পশ্চিম পাকিস্তানে বিপর্যয় ঘটেছে তাদের সবাই ছাড়া পেয়ে গেছে। অনেককেই সার্ভিসে রাখা হয় এবং পদোন্নতি দেয়া হয়। কাউকে কাউকে লােভনীয় চাকরিও দেয়া হয়। কাউকে কোনাে প্রশ্ন করা হয় নি। কারাে বিরুদ্ধে কোনাে তদন্ত হয় নি। কিন্তু আমি জেনারেল নিয়াজি অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে ন্যস্ত সব দায়িত্ব সম্পন্ন করেও অন্যান্যদের ভুলের জন্য শাস্তি পেয়েছি কেবল একা। সেনাবাহিনী প্রধান হিসেবে জেনারেল টিক্কা খান এক বিবৃতিতে বলেছিলেন | যে, জেনারেল নিয়াজিকে কোর্ট মার্শালে বিচার করা সম্ভব নয়। কারণ তার  বিরুদ্ধে কোনাে উল্লেখযােগ্য অভিযােগ নেই।  চ) হামুদ-উর-রহমান কমিশনের রিপাের্ট হচ্ছে একটি অতি গােপনীয় দলিল।

কিন্তু এ রিপাের্টের অংশবিশেষ বিভিন্ন পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। এ রিপাের্টের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলাে হচ্ছে :

(১) ১৯৭১ সালে বিপর্যয়ের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়। কিন্তু বলির পাঁঠা বানানাে হয় কেবল আমাকে। আত্মসমর্পণ করা হয় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের নির্দেশে। পশ্চিম পাকিস্তানে শশাচনীয় পরাজয়ের আংশকায় প্রেসিডেন্ট এ নির্দেশ দিয়েছিলেন। ‘পিপিপি’র ৭-সদস্যের একটি কমিটির সুপারিশে এ রিপাের্ট গােপন রাখা হয়।

(৪) এ রিপাের্টের কোনাে আইনগত ভিত্তি নেই এবং বাস্তবায়নের জন্য কোনাে | নির্বাহী আদেশ দিয়ে তা অনুমােদন করা হয় নি। হামুদ-উর-রহমান কমিশনের টার্মস অভ রেফারেন্স ছিল সীমিত (বিপর্যয়ের সব দিক তদন্তের অন্তর্ভুক্ত করা হয় নি)। জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে ক্ষমতা দখলকারী’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। জেনারেল ইয়াহিয়া ছিলেন সংকটের প্রধান স্থপতি। তিনি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবর্তে সামরিক অভিযানের নির্দেশ দিয়েছিলেন। পাকিস্তানের ব্যবচ্ছেদ ঘটানাের জন্য জেনারেল ইয়াহিয়াকে দোষারােপ করা হলেও তিনি দুটি পেনশন ভােগ করেন (প্রেসিডেন্ট ও সি ইন সি) এবং সরকারি খরচে তাকে চিকিৎসার জন্য পাঠানাে হয় বিদেশে। মৃত্যুর পর তাঁকে পূর্ব সামরিক মর্যাদায় দাফন করা হয়। অন্যদিকে, আমাকে পেনশন থেকে  বঞ্চিত করা হয়। কারণ মাত্র দু’মাস সময়ে আমি

(১) পূর্ব পাকিস্তানে সরকারি কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করি। পূর্ব পাকিস্তানের দায়িত্ব কেউ নিতে চান নি। আমার আগে দু’জন সিনিয়র জেনারেল ব্যর্থ হয়েছিলেন।

(২) জীবন যাত্রা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনি।

(৩) গেরিলা ও ভারতীয় অনুচরদের উচ্ছেদ করি । এর আগে তাদের মনােবল ছিল খুব উঁচু এবং হামলা করার সামর্থ্য রাখত তারা। আমিই হচ্ছি সেই জেনারেল যার সৈন্যরা দু’মাসের কম সময়ে বস্ত্র অভিযানে গেরিলাদের পরাজিত করে।

(৪) জেনারেল ফজল মুকিম তার বইয়ে আমাদের সাফল্যকে একটি অলৌকিক ঘটনা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। শত্রুদেরকে কোণঠাসা করা হয় এবং পরে তাদের উচ্ছেদ করা হয়। এ অভিযানে নিয়মিত সৈন্য ছিল ৩৪ হাজার এবং বেসামরিক সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য ছিল আরাে ১১ হাজার। সব মিলিয়ে মােট ৪৫ হাজার। সামরিক বিশেষজ্ঞদের মতে, স্থানীয় জনগণের পূর্ণ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ৩ লাখ সৈন্যের প্রয়ােজন ছিল। (জ) ১৯৭১ সালে মে নাগাদ সামরিক ও রাজনেতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসে। এটা ছিল একটি রাজনেতিক নিষ্পত্তির আদর্শ সময়। কিন্তু রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের বেদিতে পাকিস্তানের ৪৫ হাজার সৈন্যকে কোরবানি করা হয় এবং পূর্ব পাকিস্তান পরিত্যাগের অশুভ ইচ্ছায় রাজনৈতিক নিষ্পত্তির এ সুযােগ হারানাে হয়। পূর্ব পাকিস্তানকে একটি সরকারবিহীন অবস্থায় পরিত্যাগের অশুভ লক্ষ্য অর্জনে এ পরিকল্পনা করা হয়। ভারতীয়রা জয়লাভ করলে এবং নিয়াজি যুদ্ধে পরাজিত হলেই কেবল পূর্ব পাকিস্তানকে সরকারিহীন অবস্থায় পরিত্যাগ করা সম্ভব। কিন্তু জান্তা যখন। দেখতে পেল যে, আমি রণাঙ্গনে পরাজিত হব না তখন আমাকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেয়া হয়। আমি এ নির্দেশ পালনে অস্বীকার করায় আমাকে পশ্চিম পাকিস্তানে বিপর্যয়ের কথা শােনানাে হয়। তারা দরিদ্র পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ এবং ধনী পশ্চিম পাকিস্তান শাসন করার সিদ্ধান্ত নেয়। ঝ) সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আবদুল হামিদ খান ১৯৭১ সালের মে মাসে ভারতের মাটিতে যুদ্ধ সম্প্রসারণে আবার পরিকল্পনা পর্যালােচনা করেন এবং এ পরিকল্পনাকে সুষ্ঠু ও কার্যকর বলে অভিমত দেন।কিন্তু সরকারি নির্দেশে আমার পরিকল্পনা পরিত্যক্ত হয়। তখন আমার প্রতি সরকারি নির্দেশ ছিল : ভারতের সঙ্গে প্রকাশ্যে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া যাবে না। ভারতীয় ভূখণ্ডে আমাদের সৈন্যরা প্রবেশ করতে পারবে না এবং ভারতীয় ভূখণ্ডে গােলাবর্ষণও করা যাবে। 

(২) শক্তি প্রয়ােগে ভারতীয়দের পূর্ব পাকিস্তানে অনুপ্রবেশ রােধ করতে হবে। (ঞ) ১৯৭১-এর ১৩ ডিসেম্বর আমি “শেষ ব্যক্তি ও শেষ বুলেট” অবশিষ্ট থাকা পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাবার চূড়ান্ত নির্দেশ দিই। এ নির্দেশের অর্থ ছিল লড়াই করে মৃত্যুবরণ করা। কোনাে অফিসার অথবা সৈন্য এ নির্দেশ মেনে নিতে দ্বিধা করেন নি। সবাই ইতিবাচক সাড়া দিয়েছিলেন। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের নির্দেশে এ নির্দেশকে আত্মসমর্পণের নির্দেশে পরিবর্তন করতে হয়।সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল হামিদ ও পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ডা. মালিক আমাকের আত্মসমর্পণে রাজি করান। ডা. মালিক আমাকে বলেছিলেন যে, আত্মসমর্পণে বিলম্ব করলে পশ্চিম পাকিস্তানে যুদ্ধে আরাে বিপর্যয় ঘটবে। তারা যে-কোনাে মূল্যে পশ্চিম পাকিস্তানে যুদ্ধ বিরতি কামনা করছিল। ভীতি ও চাপ এমন মাত্রায় পৌছে যে, সরকার পশ্চিম পাকিস্তান রক্ষায় পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে দিতে অধীর হয়ে ওঠে। সুতরাং আমাদের মূল ঘাঁটি পশ্চিম পাকিস্তানকে ছিন্নভিন্ন হওয়া এবং ওয়েস্টার্ন গ্যারিসনকে অধিকতর হামলা থেকে রক্ষায় আমি আমার সুনাম, আমার উজ্জ্বল ক্যারিয়ার এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মহান ঐতিহ্যকে বিসর্জন দেই এবং ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আত্মসমর্পণে রাজি হই। সেসময় আমরা কোথাও পরাজিত হই নি এবং কোথাও কোথাও আমরা ভারতীয়দের চেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে ছিলাম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে মােতায়েন জাপানি বাহিনীর ভাগ্যেও একই ঘটনা ঘটেছিল। পর্যাপ্ত নৌ ও বিমান সহায়তা এবং মিত্র বাহিনীর তুলনায় সামরিক ও কৌশলগতভাবে অধিকতর সুবিধাজনক অবস্থানে থেকেও জাপানের ৫৮ ডিভিশন সৈন্য আত্মসমর্পণ করেছিল। হিরােশিমা ও নাগাসাকিতে আনবিক বােমা নিক্ষিপ্ত হওয়ায় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে মােতায়েন জাপানি কমান্ড তাদের মাতৃভূমিকে অধিকতর ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষায় নিঃশর্তভাবে মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। প্রিয় প্রেসিডেন্ট, সবচেয়ে উধ্বতন সেনা কর্মকর্তা হিসেবে আমার দুটি গুরুত্বপূর্ণ সীমাবদ্ধতা ছিল যুদ্ধ পরিচালনার ক্ষেত্রে। একটি হচ্ছে, জাতীয় লক্ষ্য যা পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষায় সরকার নির্ধারণ করেছিল এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে সামরিক বরাদ্দ। আমাকে যে সম্পদ দেয়া হয়েছিল সেগুলাে ৩টি বাহিনীর মধ্যে বিতরণ করা হয়। এ সম্পদের হিসাব থেকে এটাই নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হবে যে, যে কোনাে মানদণ্ডে ইন্টার্ন গ্যারিসনের সাফল্য সন্তোষজনক।

একটি

পাকিস্তান (ক) পদাতিক ডিভিশন ৩টি (দুটি ডিভিশনের ভারী অস্ত্র ছিল না) খ) ট্যাংক রেজিমেন্ট ১টি রেজিমেন্ট

(৩ স্কোয়াড্রন এম-২৪ মডেলের ট্যাংক,

৭৫ মিলিমিটার কামান সজ্জিত) গ) বিমান বাহিনী এক স্কোয়াড্রন (পুরানাে মডেলের এফ-৮৬) ঘ) বিমান ক্ষেত্র। ঙ) নৌবাহিনী ৪টি গানবােট ভারত ক) পদাতিক ডিভিশন ১২টি ডিভিশন (পূর্ণাঙ্গ ডিভিশন) খ) ট্যাংক রেজিমেন্ট ৬ টি রেজিমেন্ট (১৮ স্কোয়াড্রন, ১০৫ মিলিমিটার

কামান সজ্জিত এবং নৈশকালে চলাফেরায় সক্ষম) গ) বিমান বাহিনী । ১৪ স্কোয়াড্রন (এফজিএ) ঘ) বিমান ক্ষেত্র ৩টি, একটি বিমানবাহী রণতরী ঙ) নৌবাহিনী ভারতীয় নৌবাহিনীর অধিকাংশ যুদ্ধজাহাজ

নােট ১৯৭১-এর মার্চ থেকে মুক্তি বাহিনীর ছদ্মবেশে বিদ্রোহীদের। সহায়তাদানকারী নাশকতামূলক তৎপরতায় লিপ্ত ভারতীয় সৈন্যদের এ হিসাবের মধ্যে ধরা হয় নি। স্থানীয় জনগণ শুধু আমাদের প্রতি বৈরীই নয়, তারা আমাদের সঙ্গে লড়াই করেছে। ৬। শত্রু বাহিনীর কমান্ডার, বিদেশি প্রচার মাধ্যম এবং আমাদের নিজস্ব হাই।

কমান্ডও পূর্ব পাকিস্তান গ্যারিসন এবং এ গ্যারিসনের কমান্ডারের প্রশংসা না। করে পারে নি। এসবের কিছু হচ্ছে :“দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একজন প্রবীণ সৈনিক, লম্বা-চওড়া, সুঠাম ও আত্মবিশ্বাসে তিনি বলীয়ান। সৈনিকদের জেনারেল হওয়ার সুনাম তার। রয়েছে। তিনি প্রাণবন্ত একজন মানুষ।” (ইন্ডিয়ান আর্মি আফটার ইন্ডিপেনডেন্স, পৃষ্ঠা ৪৩৮)। ‘প্রদীপ্ত নিয়াজিকে সৈনিকদের জেনারেল হিসেবে চিত্রিত করা হয়।” (দ্য লিবারেশন অভ বাংলাদেশ, মেজর জেনারেল সুখবন্ত সিং) “চৌকস গার্ড অভ অনার প্রদান করায় অ্যাডমিরাল মাউন্টব্যাটেন এ মেজরের প্রশংসা করেন এবং তাঁর কৃতিত্বপূর্ণ যুদ্ধের রেকর্ড সম্পর্কে খোঁজখবর নেন। ১৯৪৩ সালে বিলাতে প্রেরিত সরকারি চিঠি-পত্র তার কথা উল্লেখ করা হয় এবং কোহিমার জঙ্গলে অসাধারণ বীরত্ব ও নেতৃত্ব।

প্রদর্শনের জন্য তাকে মিলিটারি ক্রস’-এ ভূষিত করা হয় । (ফৌজি আকবর, ২৫ মে ১৯৪৬) “পূর্ব পাকিস্তানে শত্রুর সর্বশেষ চ্যালেঞ্জ মােকাবেলায় আপনি এবং আপনার কমান্ডের সৈন্যরা যে বিস্ময়কর সাহস প্রদর্শন করেছেন তাতে আমি গভীরভাবে অভিভূত। (সি.-ইন-সি, ইয়াহিয়া ২৯ নভেম্বর ১৯৭১) “পূর্ব পাকিস্তানে প্রচণ্ড প্রতিকূলতার মুখে আমাদের সশস্ত্র বাহিনী যে বীরত্বপূর্ণ লড়াই করেছে তা অদম্য সাহসের একটি মহাকাব্য এবং ইসলামের সৈনিকদের সর্বোচ্চ ঐতিহ্যের স্মারক হিসেবে ইতিহাসে লিপিবদ্ধ থাকবে।” (১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১-এ জেনারেল ইয়াহিয়ার ভাষণ) ‘বিলে তাঁর মতাে লােক খুব কমই আছে।’ মার্কিন গােয়েন্দা সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে এ শিরােনামে এক খবরে বলা হয় যে, জেনারেল নিয়াজি ও তার সৈন্যদের প্রতিরােধ যুদ্ধের ইতিহাসে নজিরবিহীন। সরবরাহ থেকে পুরােপুরি বঞ্চিত কোনাে সেনাবাহিনী এমন অতুলনীয় বীরত্বের সঙ্গে এত দীর্ঘদিন লড়াই করে নি।” (স্টার স্পেশাল, ওয়াশিংটন, ডিসেম্বর ১৯৭১) মেজর থেকে পরবর্তী পদগুলােতে আমার দ্রুত পদোন্নতি হয়েছে এবং উপমহাদেশ বিভক্তির আগে ও পরে উভয়কালে অবধারিতভাবে বিশেষ দায়িত্ব ও মিশনের জন্য আমাকে বাছাই করা হতাে। এসব মিশন শেষে প্রশংসা ও পদক দুটিই পেতাম আমি। আমি সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ পদকপ্রাপ্ত অফিসার এবং নিম্নবর্ণিত রের্কড অনুযায়ী আমি আমার সমান বয়স ও একই সার্ভিস গ্রুপে বিশ্বের যে কোনাে সেনাবাহিনীর যে কোনাে অফিসারের সঙ্গে নিজেকে সহজেই তুলনা করতে পারি :

ক) দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ (১) এমসি (মিলিটারি ক্রস)। ভারত থেকে প্রেরিত ব্রিটিশ সরকারি চিঠিপত্রে। আমার কৃতিত্বের কথা উল্লেখ করা হয়। সাহসিকতা, দক্ষতা, সহিষ্ণুতা ও নিষ্ঠার জন্য প্রশংসাপত্রও প্রদান করা হয়। (ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে কোনাে ভারতীয় অফিসারের জন্য এরূপ পদক ও প্রশংসাপত্র লাভ একটি বিরল ঘটনা)  দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আসামে এক দ্বন্দ্ব যুদ্ধে হাতাহাতি লড়াইয়ে আমার হাতে একজন জাপানি মেজর নিহত হয়। এ ঘটনার পর আমাকে ‘টাইগার’

খেতাব দেয়া হয়। এ খেতাব পরিণত হয় আমার ডাক নামে। লেফটেন্যান্ট থেকে আমাকে সরাসরি মেজর পদে পদোন্নতি দেয়া হয়। (পাকিস্তানে যুদ্ধ পরিচালনায় কৃতিত্বের জন্য আমাকে ‘তারিক বিন-জিয়াদ’ নামে ডাকা হতাে।) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমি একটি রাজপুত রেজিমেন্টের দায়িত্বে ছিলাম। আমার রেজিমেন্ট আমাকে ‘অমর সিং রাঠোর’ নামে ডাকতাে। পাকিস্তান অপারেশন সিন্ধুতে পঙ্গপাল দমন অভিযানে সাফল্যের জন্য আমাকে “সিতারা ইখিদমত’ পদকে ভূষিত করা হয়। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে কৃতিত্বের জন্য আমি হিলাল-ই-জুরাত’ খেতাব পাই।। ১৯৭১ সালের যুদ্ধে আমাকে ‘হিলাল-ই-জুরাত’ এবং ‘সিতারা-ই-পাকিস্তান পদকে ভূষিত করা হয়। (আমি দু’বার ‘হিলাল-ই-জুরাত’ খেতাবে ভূষিত হওয়ার দুর্লভ সম্মানের অধিকারী হয়েছি)। পদক আমার বুকে ২৪টি পদক শােভা পেয়েছে (সেনাবাহিনীতে আমার চেয়ে বেশি পদক আর কেউ পান নি) আমার ব্যর্থতা এটাই যে, আমি ভাগ্যান্বেষী, তােষামােদকারী, স্বার্থপর, উচ্চাভিলাষী ও ষড়যন্ত্রকারী চক্রের কোনাে অংশীদার হতে পারি নি। যা সত্য তাই বলেছি আমি এবং সত্য কথা বলতে কখনাে দ্বিধা করি নি। আমি ক্ষমতার রাজনীতি এবং সম্পদ কুক্ষিগত করে রাখাকে ঘৃণা করেছি। আমি আমার সিনিয়র ও জুনিয়র উভয়ের প্রতি ছিলাম অনুগত। আমি একথা বিনা দ্বিধায় বলতে পারি যে, অন্য যে কোনাে লােকের চেয়ে আমার দেশ ও | দেশের সশস্ত্র বাহিনীর কল্যাণে বেশি কাজ করেছি আমি। অফিসার ও জিসিও উভয়কে আমি কমিশন প্রদানের ক্ষমতা রেখেছি। এ ধরনের ক্ষমতা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়কও ভােগ করেন নি। আমি সিতারা-ই-জুরাত পর্যন্ত বীরত্বপূর্ণ খেতাব প্রদান করতে পারতাম। কাউকে পদক প্রদানের বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন সরকার প্রধান। কিন্তু আমাকে এ বিরল ক্ষমতা প্রদান করা হয়। এটা ছিল আমার প্রতি সরকারের আস্থার নিদর্শন। আমার ওপর সরকারের এ বিশ্বাস ছিল যে, কাউকে পদক প্রদানের ক্ষেত্রে আমার বিবেচনা হবে সন্দেহের অতীত। এ ধরনের ক্ষমতা আর কোনাে কমান্ডিং জেনারেল ডােগ করেছেন কিনা তা আমার জানা নেই

১০। জনাব, আত্মসমর্পণের নির্দেশ পেয়ে (১৩ ডিসেম্বর ১৯৭১ আমি আত্মসমর্পণের নির্দেশ পাই, তবে আমি আত্মসমর্পণ দলিলে সই করি ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১-এ) সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে আমি আমার দেশের আর্থিক সম্পদ রক্ষায় ঢাকার ব্যাংকগুলাে থেকে নগদ অর্থ (বিদেশি মুদ্রাসহ) ও স্বর্ণ সরিয়ে ফেলি। আমি তখন এসব অর্থ-কড়ি ও স্বর্ণ নিয়ে কোনাে নিরপেক্ষ দেশে পালিয়ে গেলে সেখানে আমাকে বাধা কে দিত? রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহণের নজির আধুনিক সমাজে কোনাে বিরল ঘটনা নয়। আমি ইচ্ছে করলে রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহণ করতে পারতাম। অন্যান্য। জেনারেলদের জীবন মানের তুলনায় আমি হত দরিদ্র জীবন যাপন করছি। আমি আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর এবং ভারতে একজন যুদ্ধবন্দি হয়ে বসবাসের অসম্মান থেকেও রেহাই পেতে পারতাম। আমি কর্নেল মােহাম্মদ খানের তত্ত্বাবধানে সকল নােট জ্বালিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করেছিলাম।

১১. কিন্তু সংকটকালে চৌর্যবৃত্তি এবং সৈন্য ও জনগণকে ত্যাগ করা নিয়াজির ধর্ম নয়। হেলিকপ্টারে করে ঢাকা থেকে পালিয়ে যাবার পরিবর্তে আমি আমার সৈন্যদের নিয়ে আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নেই। পশ্চিম পাকিস্তানি ও বিহারিদের জীবন রক্ষায় সকল সম্পদ ব্যবহার করেছি। নয়তাে তাদের হাজার হাজার লােককে মেরে ফেলা হতাে। আমাদের মা-বােনদের ধর্ষণ করে কলকাতায় পতিতালয়ে পাঠানাে হতাে। ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিদ্রোহী ও ভারতীয়রা যা করেছিল তারা তাই করতাে এবং চূড়ান্তভাবে আমার সৈন্যদেরকে মুক্তিবাহিনীর করুণার ওপর ছেড়ে দিতে হতাে। এক পর্যায়ে জেনারেল মানেকশ হুমকি দেন যে, আত্মসমর্পণ দলিল চূড়ান্ত না হলে এবং তাতে আমি স্বাক্ষর না দিলে তিনি মুক্তি বাহিনীকে লেলিয়ে দেবেন। আমি তার হুমকিতে বেসামরিক লােকজনের নিরাপত্তার কথা ভেবে আত্মসমর্পণে রাজি হই। আমার সঙ্গে আলােচনা করে জেনেভা কনভেনশন অনুসারে সব ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। দুঃসময়ে আমি আমার প্রাণপ্রিয় সৈন্যদের পরিত্যাগ করি নি। কিন্তু ইতিহাসে এমন প্রচুর নজির রয়েছে যেখানে দুঃসময়ে পৃথিবী খ্যাত জেনারেলগণ তাদের সৈন্যদের পরিত্যাগ করেছেন। জামায় পরাজিত হয়ে মহাবীর হ্যানিবল তার সৈন্যদের ছেড়ে গিয়েছিলেন। ফরাসি বীর নেপােলিয়ন দু’বার তার সৈন্যদের পরিত্যাগ করেছিলেন। একবার মিশরে এবং আরেকবার রাশিয়ায়। ১৯৭১ সালের মার্চে লে. জেনারেল ইয়াকুব খান পদত্যাগ করেন এবং পূর্ব পাকিস্তানে তার সৈন্যদের ত্যাগ করেন।

১২.  জনাব প্রেসিডেন্ট, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে রাজনৈতিক ও সামরিক বিপর্যয়ের জন্য যারা দায়ী তাদের কারাে কোনাে ক্ষতি হয় নি। এখানেই ঘটনার শেষ নয়। তাদের প্রত্যেককে অবসর গ্রহণের পর লােভনীয় চাকরি দেয়া হয়। কিন্তু ৪০ বছরের চাকরি জীবনে আমার কষ্টার্জিত পেনশন থেকে আমাকে ও আমার পরিবারকে বঞ্চিত করার কোনাে যুক্তিগত কারণ আমার বােধগম্য নয়। প্রকৃত অপরাধীদের আড়াল করা এবং তাদেরকে রক্ষায় পূর্ব পাকিস্তানে বিপর্যয়ের জন্য আমাকে বলির পাঠা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। শেষ দিন পর্যন্ত এ বিরাট ট্রাজেডিতে যে কয়জন শীর্ষ ব্যক্তি জড়িত ছিলেন তাদের প্রাপ্ত সুযােগ-সুবিধার একটি বর্ণনা নিচে দিচ্ছি ;

ক) জেনারেল ইয়াহিয়া খান দুটি পেনশন এবং বিদেশে সরকারি খরচে চিকিৎসা সুবিধা লাভ। এ নীতিনির্ধারক, চক্রান্তকারী ও ওয়াদা খেলাপকারীকে একজন বীরের সম্মান ও সুযােগ-সুবিধা দেয়া হয়।

থ)  জেনারেল আবদুল হামিদ জেনারেল ইয়াহিয়ার ডান হাত। কার্যত সি-ইনসি’কে পেনশন মঞ্জুর করা হয় এবং সরকারি ব্যয়ে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানাে হয়। লে. জেনারেল পীরজাদা প্রেসিডেন্টের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার। তিনি যুদ্ধে কখনাে একটি গুলির আওয়াজও শােনেন নি। ইয়াহিয়ার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেন তিনি এবং তার বিরুদ্ধাচরণকারীদের সঙ্গে হাত মেলান। তাকে পূর্ণ পেনশন দেয়া হয়।

গ) লে. জেনারেল গুল হাসান : তিনিও পাকিস্তানের কোনাে যুদ্ধে একটি গুলির আওয়াজ শোনেন নি। তথাপি তিনি আরােহণ করেন শীর্ষ পদে। তাকে পূর্ব পাকিস্তান গ্যারিসনের দায়িত্ব গ্রহণের প্রস্তাব দেয়া হয়। কিন্তু তিনি অস্বীকৃতি জানান। সব জেনারেলই পূর্ব পাকিস্তানে বদলি এড়িয়ে যান। আমি ছিলাম সিনিয়রিটির তালিকায় দ্বাদশ। এত জুনিয়ার জেনারেল হওয়া সত্ত্বেও পূর্ব পাকিস্তান গ্যারিসন কমান্ড করার জন্য আমাকেই নির্বাচন করা হয়। প্রেসিডেন্ট আমার চেয়ে সিনিয়র জেনারেলদের তৎপরতা ও দক্ষতা মূল্যায়ন করে সন্তুষ্ট হতে না পেরে আমাকেই এ পদের জন্য উপযুক্ত বিবেচনা করেন। পশ্চিম পাকিস্তানে সকল শর্তই ছিল আমাদের অনুকূলে। কিন্তু ডিভিশন ও কোর পরিচালনায় চিফ অভ জেনারেল স্টাফ জেনারেল গুল হাসানের ব্যর্থতায় পশ্চিম রণাঙ্গনে আমাদের বিপর্যয় ঘটে। তিনি পূর্ব পাকিস্তানে শক্তি বৃদ্ধি ও সাজ-সরঞ্জাম পাঠানাের জন্য আমার কাছে সুচিন্তিতভাবে মিথ্যা বার্তা পাঠান। তিনি পেশাগতভাবে আমার পদাবনতি ঘটাতে চেয়েছিলেন। তিনি ছিলেন ঐসব লোেকদের একজন যারা আমাকে পরাজিত দেখতে চেয়েছিলেন এবং পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ক্ষমাহীন ব্যর্থতা সত্ত্বেও তাঁকে সেনাবাহিনী প্রধান পদে নিযুক্তি দেয়া হয়। তবে ভুট্টো তাকে অপসারণ করেন। তিনি তাকে পূর্ণ পেনশন দিয়েছিলেন এবং তাকে রাষ্ট্রদূত হিসেবে বিদেশে পাঠানাে হয়।

ঙ) এয়ার চিফ মার্শাল রহিম ১৯৭১-এর যুদ্ধে বিমান বাহিনী পরিচালনায় তিনি চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি ও তাঁর বিমান বাহিনী আত্মগােপন করে। এ সুযােগে ভারতীয় বিমান বাহিনী পশ্চিম পাকিস্তানের আকাশে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। তিনি অবসর গ্রহণ করেন এবং পূর্ণ পেনশন পান। এছাড়া, তাকে রাষ্ট্রদূতও করা হয়। লে. জেনারেল জাহানজেব আরবাব তার জিওসি তাকে পূর্ব পাকিস্তানে একটি ব্রিগেডের কমান্ড থেকে অপসারণ করেন এবং লুটতরাজ ও অগ্নিসংযােগের অভিযােগে বিচারের জন্য তাঁকে পশ্চিম পাকিস্তানে ফেরত পাঠান। তদন্তে তিনি দোষী সাব্যস্ত হন। তা সত্ত্বেও তিনি ব্রিগেডিয়ার থেকে মেজর জেনারেল এবং পরে লে. জেনারেল পদে উন্নীত হন। অবসর নেয়ার পর তিনি পূর্ণ পেনশন পান। মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী ; ১৯৭১-এর মার্চে সামরিক অভিযানের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জেনারেল ফরমান আলী। এ অভিযান এত নিষ্ঠুর ও ভয়ঙ্কর ছিল যে, আওয়ামী লীগের সঙ্গে আপােসের সব রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। তিনি ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় জাতিসংঘ প্রতিনিধির সঙ্গে যােগাযােগ করেন এবং প্রেসিডেন্ট, আমার নিজের এবং গভর্নরের অনুমােদন ও সম্মতি ছাড়া জাতিসংঘ প্রতিনিধির। কাছে একটি অতি গােপনীয় বার্তা হস্তান্তর করেন। তিনি আমাদের না জানিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধান ও রুশদের সঙ্গে ঘনিষ্ট যােগাযােগ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি তার ভাগিনার মাধ্যমে তার স্ত্রীর কাছে ৮০ হাজার টাকা (১৯৭১ সালে এটা অনেক টাকা) পাঠিয়েছিলেন। তাঁর ভাগিনা ছিলেন হেলিকপ্টারের একজন পাইলট। এ ঘটনা জানানাে হয়। কিন্তু কোনাে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় নি। তাকে ফেীজি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান করা হয় এবং এরপর তিনি মন্ত্রীও হন। তিনি এখন প্রচুর অর্থের মালিক। যা দেখে অনেকেই জ্ব কুচকাচ্ছেন। মেজর জেনারেল তাজামুল হােসেন কোর্ট মার্শালে তার বিচার হয় এবং তাকে শাস্তি দেয়া হয়। কিন্তু সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আসলাম বেগের

পরামর্শে তাকে মুক্তি দেয়ার পর তাঁর পেনশন পুনর্বহাল করা হয়। ঝ). আরাে দু’জন অফিসারের পেনশন পুনর্বহালের ঘটনা উল্লেখযােগ্য। সেগুলাে।

হচ্ছে : কর্নেল খানজাদা তিনি দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধকালে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যােগ দেন। তার শাস্তি হয়, কিন্তু ফিল্ড মার্শাল আইউব খান তার পেনশন | মঞ্জুর করেন। মেজর জেনারেল আকবর খান : ১৯৫১ সালে রাওয়ালপিন্ডি ষড়যন্ত্র মামলায় তিনি দোষী সাব্যস্ত হন। কিন্তু তাঁর পেনশন মঞ্জুর করা হয়। ১৯৭২ সালে। ভুট্টো তাকে মন্ত্রী নিযুক্ত করেন।

১৩.  উপরােক্ত উদাহরণ থেকে দেখা যাচ্ছে যে, অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত অফিসারদের পেনশন দেয়া হয়েছে। কিন্তু কোনাে অপরাধে অভিযুক্ত হওয়া ছাড়াই আমি পেনশন থেকে বঞ্চিত হচ্ছি।

১৪। যাদের সিদ্ধান্তে আমার অনশন বন্ধ হয়েছে এবং যার জন্য আমি ও আমার সন্তানরা কষ্ট ভােগ করেছি তার কিছুটা বিবরণ আপনার কাছে পেশ করেছি। সুপ্রিম কমান্ডার হিসেবে যে কোনাে অন্যায়ের প্রতিবিধান করার সর্বোচ্চ ক্ষমতা আপনার রয়েছে। ন্যায়বিচারের মূল স্তম্ভ হচ্ছে যে, আপনি একজনকে যে সুবিধা দেবেন, অন্যান্যদের একই সুবিধা দিতে হবে। এটা হচ্ছে সাম্যের বিধান এবং এর কোনাে ব্যতিক্ৰম কাম্য নয়। প্রত্যেকের জন্য বিচারের একই মানদণ্ড থাকতে হবে। আইন মন্ত্রণালয় অথবা পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতির কাছে বিষয়টি পাঠানাে হলে তারা সাম্যের আইনকে অগ্রাহ্য করবেন না। ইসলাম ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করেছে এবং ন্যায়বিচারকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছে এবং ইসলাম মজলুম মানবজাতির ত্রাণকর্তা

হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এ জন্যই বিশ্বে ইসলামের প্রসার ঘটেছে।  

১৫। আমি কি এ কারণে দুর্ভোগ পােহাব যে, আমি কেন্দ্র থেকে এক হাজার

মাইল দূরে বিচ্ছিন্ন একটি রণাঙ্গনে যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছি যেখানে সামরিক বিবেচনার চেয়ে রাজনৈতিক বিবেচনা প্রাধান্য পেয়েছে। যেখানে যুদ্ধ শুরু হওয়ার অনেক আগে পূর্ব পাকিস্তান পরিত্যাগের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তান সংকটের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষভাবে জড়িত প্রত্যেকে যেখানে

হয় পুরােপুরি পুনর্বাসিত নয়তাে পেনশন অথবা গুরুত্বপূর্ণ চাকরি পেয়েছে?

১৬। জনাব প্রেসিডেন্ট, পূর্ব পাকিস্তানের শেষ কমান্ডারকে কি বাকি জীবন

দৈন্যের মধ্যে কাটাতে হবে এবং তার সন্তান-সন্ততিকে দুর্ভোগ পােহাতে হবে এবং তারা কি বসবাসের অযােগ্য গৃহে বসবাস করবে? নিম্নোক্ত কারণগুলাের জন্য কি এ জেনারেল ও তার পরিবারকে শাস্তি দেয়া হবে :

ক)  যেখানে ইতােমধ্যেই দু’জন জেনারেল ব্যর্থ হয়েছিলেন এবং সেনাবাহিনীর হাল ধরার জন্য কেউ ছিল না সেখানে পূর্ব পাকিস্তানের নেতৃত্ব গ্রহণ

খ)  সামরিক অভিযান ও বিশৃঙ্খলার জন্য দায়ী ব্যক্তিরা যেখানে পশ্চিম পাকিস্তানে চলে এসেছিলেন সেখানে চরম প্রতিকূলতার ভেতর পূর্ব

পাকিস্তানে এগারাে মাস পাকিস্তানের পতাকা উড্ডীন রাখা।

(গ) হাজার হাজার পশ্চিম পাকিস্তানি এবং লাখ লাখ বিহারিকে গণহত্যার মুখে ঠেলে না দেয়া এবং হাজার হাজার নারীদের ধর্ষিতা ও পতিতালয়ে বিক্রি হতে না দেয়া এবং সৈন্যদেরকে নেতৃত্ব দানের জন্য আত্মসমর্পণের পর কমান্ড পরিত্যাগ না করা।

ঘ)  যেখানে আমি খুব সহজে পালাতে পারতাম সেখানে পালিয়ে না গিয়ে। আত্মসমপর্ণ দলিলে স্বাক্ষরের গ্লানি বহন এবং ভারতে যুদ্ধবন্দি শিবিরে বিড়ম্বিত জীবন-যাপন।

ঙ) সর্বোচ্চ পদকপ্রাপ্ত অফিসার হওয়ায়।

চ) নিরপেক্ষ আইন থেকে বঞ্চিত হওয়ায়।

ছ) বছরের পর বছর শােষণ বঞ্চনা থেকে উথিত একটি রাজনৈতিক বিপর্যয় এবং রাজনৈতিক বিপর্যয়ের পরিণতি হিসেবে সামরিক বিপর্যয়। (নিয়াজি

একজন কাপুরুষ এবং অনেকের কৃতদোষে ফলভােগী ব্যক্তি)।

১৭। একজন সৈনিকের জন্য এটাই সবচেয়ে বড় পুরস্কার যে তার সি.ইন.সি। বার্ষিক প্রতিবেদনে তার যুদ্ধক্ষেত্রে কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন।

১৮। জনাব প্রেসিডেন্ট, কারাে প্রতি বিদ্বেষ থেকে আমি আপনার কাছে এ আবেদন করি নি। আমার প্রতি যে অন্যায় করা হয়েছে তা স্পষ্ট করে তুলে ধরার জন্যে কারাে কারাে নাম উল্লেখ করতে হয়েছে। আমি ইসলামী প্রজাতন্ত্র পাকিস্তানের নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের কাছে ন্যায়বিচার চাই। আমার প্রতি দু’দশকের বেশি অন্যায় করা হয়েছে। লে. জেনারেল হিসেবে আমি ৪ বছর দায়িত্ব পালন করেছি। আমাকে লে. জেনারেল হিসেবে অবসর দিয়ে এবং পূর্ব থেকে কার্যকর পেনশন মঞ্জুর করলেই আমার প্রতি এ যাবৎ যে। অন্যায় করা হয়েছে তার পরিসমাপ্তি ঘটবে। আপনি আমার প্রতি এতটুকু সুবিচার করলে আমি আপনার কাছে চির-কৃতজ্ঞ থাকবাে। আমার সৈন্যরা যেখানে প্রচণ্ড প্রতিকূলতার ভেতর বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করছিল সেখানে আমি তার চেয়ে ভালাে নেতৃত্ব কিভাবে দিতে পারতাম। সকল পর্যায়ের কমান্ডে চমৎকার নেতৃত্ব থাকার কারণেই কেবল তা সম্ভব হয়েছে। এখানে আমি কয়েকটি উদাহরণ দিচ্ছি : কামালপুর চৌকিতে আমাদের এক তরুণ কাপ্টেন ভারতের একটি ব্রিগেডকে ২১ দিন ঠেকিয়ে রেখেছিল। তরুণ ক্যাপ্টেন আহসান মালিকের চৌকিতে ছিল ৭৫ জনের একটি কোম্পানি। ৭৫ জনের মধ্যে ছিল ৩৯ জন। নিয়মিত সৈন্য এবং বাদবাকি ৪৫ জন মুজাহিদ। অন্যদিকে ভারতের ৩ হাজার সৈন্যের সেই ব্রিগেডে ছিল ১৮টি ফিল্ড গান ও ১৮টি মর্টার । প্রতিদিন অন্তত দুবার শত্রু বিমান ক্যাপ্টেন মালিকের চৌকিতে বােমাবর্ষণ করেছে। তাতেও পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের অবস্থান ধরে রাখে।  (খ) হিলিতে একটি পাকিস্তানি ব্যাটালিয়ন (৯শ’ সৈন্য) ভারতের একটি পদাতিক ডিভিশন ও একটি ট্যাংক ব্রিগেডকে (৩ রেজিমেন্ট ট্যাংক) ২০ দিন প্রতিরােধ করেছিল। ভারতের এ পদাতিক ডিভিশনে ছিল ৫ ব্রিগেড। (১৫ ব্যাটালিয়ন) সৈন্য। এ ব্যাটালিয়নকে ৪০ মাইল দূরে বগুড়ায় কিছু  হটার নির্দেশ দেয়া হয়। যথারীতি নিরাপদে তারা পিছু হটে আসে। হিলিতেও দিনে দু’ বার বিমান হামলা হতাে।

(গ) বগুড়ায় ট্যাংক রেজিমেন্টের দফাদার সারােয়ার আত্মসমর্পণে অস্বীকৃতি।

জানান এবং তাঁর একটি মাত্র ট্যাংক নিয়ে গােলাবর্ষণ করতে করতে ভারতের অবস্থানের ভেতর ঢুকে পড়েন। তার ট্যাংক ধ্বংস হয়ে গেলে তিনি বেরিয়ে আসেন এবং ব্যক্তিগত অস্ত্র নিয়ে শত্রুর ওপর ঝাপিয়ে পড়েন। খণ্ড-বিখণ্ড হওয়া নাগাদ তিনি যুদ্ধ করেছিলেন। ভারতীয় সৈন্যরা। দিক পরিবর্তনে বাধ্য হয় এবং দফাদার সারােয়ারকে সামরিক মর্যাদায়। দাফন করা হয়।

ঘ)  আমাদের আরেকজন সৈন্যকে ভারতীয়রা সামরিক মর্যাদার দাফন করে। তাঁর সাহসিকতায় শক্ররাও অভিভূত হয়ে পড়েছিল। বছরের পর বছর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ হয়। লাখ লাখ সৈন্য এতে অংশ নেয়। কিন্তু এ যুদ্ধে মাত্র একজন সৈন্য শক্রর হাতে সামরিক মর্যাদায় সমাহিত হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছিল। এ ভাগ্যবান ব্যক্তি ছিলেন একজন ব্রিটিশ সার্জেন্ট। তিনি ওয়েস্টার্ন ডেজার্টে জার্মান সৈন্যাধ্যক্ষ ফিল্ড মার্শাল রােমেলকে হত্যা করতে। গিয়ে নিহত হন। আমি মাত্র ৪৫ হাজার সৈন্য নিয়ে যুদ্ধ করেছি এবং ভারতের সঙ্গে ২৬ দিন প্রকাশ্য যুদ্ধ হয়। এ সময়ে ভারতীয়রা আমাদের ৪

জন বীর যােদ্ধাকে সামরিক মর্যাদায় দাফন করে।

২০। সাহস, দক্ষতা ও কর্তব্য নিষ্ঠার এমন উদাহরণ আর কাছে কিনা সন্দেহ। যে সৈন্যরা এমন প্রবাদ প্রতিম বীরত্ব প্রদর্শন করেছে এবং শক্রর হাতে সামরিক মর্যাদায় সমাহিত হওয়ার দুর্লভ গৌরব অর্জন করেছে, তাদের রণণৈপুণ্য ও আত্মত্যাগের পেছনে কি তাঁদের কমান্ডারের কোনাে অবদান নেই? পূর্ব পাকিস্তানের কমান্ডার হিসেবে আমার সম্মান পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হলে। আমার প্রতি শেষ অবিচারের অবসান ঘটবে। অন্যদের ভুল ও পাপের। প্রায়শ্চিত্ত থেকে আমি মুক্তি চাই।

আপনার একান্ত অনুগত, লে. জেনারেল (অব.)

এ. এ. কে. নিয়াজি। তারিখ : ২৩ এপ্রিল, ১৯৯৫

১, শামি রােড, লাহাের ক্যান্টনমেন্ট

পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের পছন্দ না হলে, উপরােক্ত পত্রের উত্তর দেয়ার প্রয়ােজন নেই। 

সূত্র : দ্য বিট্রেয়াল অভ ইস্ট পাকিস্তান – লে. জে. এ. এ. কে. নিয়াজি (অনুবাদ)

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!