শেষ কথা
পূর্ব পাকিস্তানের যুদ্ধ হচ্ছে এক বীরত্বগাঁথা যুদ্ধ। কিন্তু আত্মসমর্পণে প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্তে একেবারে ধূলিসাৎ হয়ে যায় এ বীরত্ব। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপিত পােলিশ অথবা রুশ প্রস্তাব গ্রহণ করে সেনাবাহিনীকে আত্মসমর্পণের অসম্মান থেকে রক্ষা করা যেত। কিন্তু সেসময় যারা রাষ্ট্রের কর্ণধার ছিলেন তারা তাদের কায়েমী স্বার্থে জাতীয় সম্মান বিসর্জন দিয়েছেন। ক্ষমতাসীনরা “পূর্ব পাকিস্তানের যুদ্ধ পশ্চিম পাকিস্তানে করা হবে”- এই পরিকল্পপনার ভিত্তিতে কাজ না করে কাজ করেছেন পূর্ব পাকিস্তানকে সরকারবিহীন অবস্থায় পরিত্যাগে গৃহীত এম. এম, আহমেদ পরিকল্পনার ভিত্তিতে। এভাবে তারা ক্ষমতার দুটি কেন্দ্র-আওয়ামী লীগ ও সেনাবাহিনীকে শিক্ষা দিয়েছেন। আওয়ামী লীগকে হটানাে হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশ দিয়ে এবং সেনাবাহিনীর মাথা অবনমিত করা হয়েছে ইস্টার্ন কমান্ডকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিয়ে। খণ্ডিত পাকিস্তানে ভুট্টোর নিরংকুশ ক্ষমতা লাভের জন্যই এ দুটি কাজ করা হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তান গ্যারিসন যে দৃঢ়তা, সহনশীলতা ও নিষ্ঠা প্রদর্শন করেছে তা হচ্ছে তাদের দেশপ্রেম ও বীরত্বের প্রমাণ। তারা মূল ভূখণ্ড থেকে ১ হাজার মাইল দূরে লড়াই করেছে, সরকারি কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে এবং পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্ত পুনরুদ্ধার করেছে। এটা ছিল ১২ ডিভিশন সৈন্য, ৩৯ ব্যাটালিয়ন বিএসএফ, শত শত জঙ্গিবিমান ও নৌ বলে বলীয়ান এক বিশাল বাহিনীর সঙ্গে দুর্বল, ক্ষুদ্র ও বিচ্ছিন্ন একটি বাহিনীর অসম লড়াই। শক্তির ভারসাম্য না থাকা সত্ত্বেও ইস্টার্ন কমান্ড স্থানীয় বৈরি জনগােষ্ঠী, গেরিলা যুদ্ধ ও ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। এমন এক ভূখণ্ডে আমাদেরকে একটানা দীর্ঘ ৯ মাস লড়াই করতে হয়েছে যে ভূখণ্ডের সঙ্গে রয়েছে সাড়ে তিন হাজার মাইল ব্যাপী বৈরি ভারতীয় সীমান্ত। ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত সৈন্যদেরকে একটি রাজনৈতিক বিপর্যয়কে সামরিক বিজয়ে রূপান্তরিত করার নির্দেশ দেয়া হয়। সৈন্যরা সংক্ষিপ্ততম সময়ের মধ্যে এ লক্ষ্য অর্জন করে।
তারা ১৯৭১ সালের মে নাগাদ মুক্তি বাহিনী গেরিলাদের পূর্ব পাকিস্তানের মাটি থেকে বিতাড়িত করে এবং দেশের দুটি অংশের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠায় রাজনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণে সরকারকে সক্ষম করে তােলার জন্য উল্লেখযােগ্যভাবে পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। পূর্ব পাকিস্তানে বিদ্রোহ মােকাবেলায় কোনাে সার্বিক জাতীয় কৌশল ছিল না। হাই কমান্ড পূর্ব পাকিস্তানে অর্জিত আমাদের প্রাথমিক সফলতাকে কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়। অন্যদিকে, শত্রুরা এ সময়ের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে। তারা শান্তি বিনষ্ট, গেরিলা যুদ্ধ সংগঠন এবং বাংলাদেশ সৃষ্টির একটি পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হয়। দেশ ও সশস্ত্র বাহিনীর ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ভারতের অপপ্রচারে। অসৎ উদ্দেশ্যে জান্তা এসব বানােয়াট ও অতিরঞ্জিত সংবাদ খণ্ডন করে নি। ফলে বিশ্ব এগুলাে বিশ্বাস করে ফেলে। অযােগ্যতা অথবা জঘন্য অপরাধে লিপ্ত থাকার জন্য পূর্ব পাকিস্তান থেকে যেসব দুরাচার কমান্ডার ও অফিসারকে ফেরত পাঠানাে হয়েছিল, শক্রর অপপ্রচারে তারা খুবই সন্তুষ্ট হয়। রাজনৈতিক ও সামরিক চক্রের পূর্ণ সহযােগিতা ও পরামর্শে তারা ইন্টার্ন কমান্ডের ওপর তাদের ব্যর্থতা ও অপরাধ চাপিয়ে দেয়। আমরা ভারতে যুদ্ধবন্দি থাকাকালে তারা মাঠ ফাকা পেয়ে যায়। তাই তারা তাদের ইচ্ছামতাে গল্প শুনিয়েছে জাতিকে এ সংকটে সম্পৃক্ত লােকজন উপস্থিত না থাকায় অপপ্রচার চালানাের সুযােগ পায় তারা। চক্রান্তকারীরা ইস্টার্ন কমান্ডের সঙ্গে প্রতারণা করে এবং আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেয়। পূর্ব পাকিস্তানে কোনাে উত্তরাধিকারী সরকার না রাখার জন্যই তারা একাজ করে। ভুট্টোর অপকর্ম আড়াল করে রাখার জন্য যুদ্ধবন্দি ও বেসামরিক লােকজনকে ভারতের বন্দি শিবিরে পচিয়ে মারার চক্রান্ত করা হয়। জনগণের কাছে মিথ্যা বলা হয় এবং সশস্ত্র বাহিনীর কাছে গােপন রাখা হয় সত্য।
সত্য ষড়যন্ত্রের বেড়াজালে আটকা পড়ে। পশ্চিম পাকিস্তানে করার কথা ছিল পূর্ব পাকিস্তানের লড়াই। পশ্চিম রণাঙ্গনে পদাতিক বাহিনীতে ভারতের সঙ্গে সমতা, সাজোয়া বাহিনীতে শ্রেষ্ঠত্ব এবং সর্বাধিনায়কের আওতায় যুদ্ধ পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণে সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর তিন জন প্রধান থাকা সত্ত্বেও ষড়যন্ত্রকারীরা এতই ভেঙে পড়ে যে, তারা বিমান বাহিনীর পূর্ণ শক্তি ব্যবহার করে নি এবং যথাযথভাবে পরিকল্পিত হামলা চালায় নি। আক্রমণকারী হিসেবে পশ্চিম পাকিস্তান ভূখণ্ড দখল করার পরিবর্তে সাড়ে ৫ হাজার বর্গমাইল ভূখণ্ড হারায়। পক্ষান্তরে, আমরা শত্রুকে পূর্ব রণাঙ্গন থেকে পশ্চিম রণাঙ্গনে সৈন্য সরিয়ে নেয়ার সুযােগ না দেয়াসহ আমাদের প্রতিটি মিশনে সফল হই। পশ্চিম পাকিস্তানে আমাদের নৌবাহিনী দৃশ্যপট থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়। পাকিস্তানে নৌবাহিনীর সদর দপ্তর করাচি আক্রান্ত হয়। কিন্তু আমাদের নৌবাহিনী আক্রমণকারী শত্রুর ওপর একটি গুলিও ছেড়ে নি। প্রেসিডেন্টের অনুমােদন ছাড়া জাতিসংঘ প্রতিনিধির কাছে মেজর জেনারেল ফরমানের বার্তা হস্তান্তর, মার্কিন, সােভিয়েত, ফরাসি ও ব্রিটিশ প্রতিনিধিদেরকে পূর্ব পাকিস্তানের দায়িত্বভার গ্রহণের জন্য তার অনুরোেধ, আমার অনুমতি ছাড়া রুশ ও ভারতীয় সেনা প্রধানের সঙ্গে তার যােগাযােগ এবং পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধবিরতির পর প্রেসিডেন্ট ভবনের ওপর জঙ্গি বিমান নিয়ে এয়ার মার্শাল রহিম খানের উডড্ডয়ন ইত্যাদি ঘটনাগুলাে ভুট্টোকে ক্ষমতা আনার পরিকল্পিত অভুথানের এক একটি অংশ। যুদ্ধক্ষেত্রে পরাজিত না হয়েও অন্যের ব্যর্থতা ও দোষের জন্য যখন একজন সৈনিককে আত্মসমর্পণের মতাে অসম্মানের মুখােমুখি হতে হয় তখন তা তার জন্য মৃত্যুর চেয়েও পীড়াদায়ক আমাদের শাসক এবং জেনারেল হেড কোয়ার্টার্সে অবস্থানরত স্বার্থপর অফিসাররা ইন্টার্ন কমান্ডের সব অফিসার ও সৈন্যদের ওপর এ অসম্মান চাপিয়ে দেয়।
১৩ ডিসেম্বর আমি শেষ ব্যক্তি জীবিত থাকা পর্যন্ত শেষ বুলেট’ দিয়ে লড়াই চালিয়ে যাবার নির্দেশ দেই। আমার এ নির্দেশ ছিল সৈন্যদের জন্য একটি মৃত্যু পরােয়ানা। কিন্তু সৈন্যরা আমার নির্দেশ মেনে নেয় এবং তারা “লাব্বায়েক’ জবাব দেয়। ওয়েস্টার্ন গ্যারিসনকে তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করার স্বার্থে আমরা সকলেই জীবিত থাকা পর্যন্ত শেষ বুলেট দিয়ে লড়াই চালিয়ে যেতে ইচ্ছুক ছিলাম। নতুন করে কোনাে সৈন্য পাঠানাে হয় নি আমাদের সৈন্য ঘাটতি পূরণে। তাই হতাহত সৈন্যদের স্থান পূরণে নিয়মিত সৈন্যদের সঙ্গে সিএএফ’র সংমিশ্রণ ঘটিয়ে আমরা আমাদের লড়াই করার শক্তি উল্লেখযােগ্যভাবে বৃদ্ধি করি। সহায়ক অস্ত্রশস্ত্র, সার্ভিস ও সিএএফ’র চমৎকার বিন্যাস ঘটিয়ে আমরা আমাদের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্র সংকুচিত করি। আমরা দু’মাসেরও কম সময়ে রুশ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্থানীয় গেরিলাদের পরাজিত করি। আমাদের এ সাফল্য অলৌকিকতার চেয়ে কম ছিল না। বিশেষজ্ঞদের মতে বিদ্রোহ দমন অভিযানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আড়াই থেকে তিন লাখ সৈন্যের প্রয়ােজন ছিল। অথচ আমরা মাত্র ৪৫ হাজার সৈন্য মােতায়েন করে এ কঠিন কাজ সম্পন্ন করেছি। আমাদের সৈন্যদের গেরিলা যুদ্ধের কোনাে অভিজ্ঞতা অথবা প্রশিক্ষণ ছিল না। শুধু মুক্তিবাহিনী নয়, স্থানীয় জনগণও আমাদের বিরুদ্ধে লড়াই করছে এবং বেসামরিক সরকার বলতে কিছুই ছিল না। আমরা গেরিলাদের দেশ থেকে উৎখাত করেছিলাম এবং তাদেরকে কোণঠাসা করে রেখেছিলাম। আমাকে সীমান্তে থামার নির্দেশ এবং পিছু হটে যাওয়া গেরিলাদের ধাওয়া করতে ভারতে প্রবেশে বাধা দেয়া না হলে আমি তাদের ধ্বংস করতে পারতাম। কারণ ভারতীয় বাহিনী সেসময় আমাদের পক্ষ থেকে আকস্মিক হামলা মােকাবেলায় মােটও প্রস্তুত ছিল না। শুরুতেই বিদ্রোহ নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত এবং পাকিস্তান অখণ্ড এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনী অপরাজেয় থাকতে পারত। মুক্তিবাহিনীর ছদ্মাবরণে ভারতীয়রা আমাদের ভূখণ্ডে লড়াই করেছিল। তাই মুক্তিবাহিনীকে পশ্চাদ্ধাবনে আমাদের ভারতে প্রবেশের যুক্তি ছিল রাজনেতিক, সামরিক ও নৈতিকভাবে সঠিক। জান্তার মনঃপুত না হওয়ায় তারা আমাকে ভারতে প্রবেশের অনুমতি দেয় নি।
এক কথায় জান্তার লক্ষ্য ছিল ভারতকে বিজয়ী হতে দেয়া। ভারতীয়রা মুক্তিবাহিনী এবং চোরাগুপ্তা হামলার মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের মাটিতে বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়ে তাদের লক্ষ্য অর্জনে পূর্ব পাকিস্তানে আগ্রাসন চালানাের সিদ্ধান্ত নেয়। ভারতীয়রা ১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বর তাদের আগ্রাসন শুরু করে এবং ঢাকা দখলের জন্য তারা চতুর্দিকে থেকে আমাদের ভূখণ্ডে প্রবেশ করে। তারা ১২ দিনে ঢাকা দখলের পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু আমরা তাদেরকে সীমান্তে অথবা সীমান্তের আশপাশে নিশ্চল করে রাখি এবং ১৩ দিন তারা কোণঠাসা হয়ে থাকে। কিন্তু ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর জেনারেল ইয়াহিয়া পশ্চিম রণাঙ্গনে বিলম্বিত, অপরিকল্পিত ও অপরিণামদর্শী হামলা শুরু করলে অঘােষিত যুদ্ধ প্রকাশ্যে যুদ্ধে রূপ নেয়। ২১ নভেম্বর থেকে যে লড়াই সীমান্তে সীমাবদ্ধ ছিল তা দ্রুত দেশের অভ্যন্তরে ছড়িয়ে পড়ে। প্রকাশ্য যুদ্ধ শুরু হলে ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরে স্বাক্ষরিত প্রতিরক্ষা চুক্তির আওতায় সােভিয়েতে ইউনিয়ন ভারতের পক্ষে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। আমাদেরকে রাতে অথবা প্রতিকূল আবহাওয়ায় চলাচলে বাধ্য করে এবং আমাদের প্রয়ােজনীয় সকল উপকরণ ধ্বংস করে দেয় ভারতীয় বিমান বাহিনী। তা সত্ত্বেও আমরা তাদের জান-মালের অবিশ্বাস্য ক্ষতিসাধন করি, তাদেরকে আরাে এক সপ্তাহ আটকে রাখি সীমান্তে এবং আমাদের সুবিধাজনক ভূখণ্ডে তাদেরকে নিয়ে আসতে সক্ষম হই। ভারতীয় বাহিনী আমাদের শক্তঘাঁটি ও দুর্গের কাছাকাছি এসে থেমে যায়। তখনাে তারা ছিল ঢাকা থেকে বহু দূরে এবং পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন। এ অবস্থায় ভারতীয় সেনাবাহিনী বিরাট এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে এবং তাদের সংযােগ ছিন্ন হয়ে যায় তাদের যােগাযােগ ব্যবস্থা ছিল খুবই নাজুক। অন্যদিকে, আমাদের দুর্গ ও শক্তঘাটিতে সবকিছুই ছিল অক্ষত। আর্টিলারি ও অন্যান্য সমরাস্ত্র সরবরাহে ঘাটতি ছিল না। এছাড়া আমাদের মধ্যে সমন্বয়েরও কোনাে অভাব ছিল।
আমি পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করে আত্মসমর্পণ দলিলে সই করার অপমান এবং ভারতের কাছে যুদ্ধবন্দি হওয়ার দুর্ভাগ্য এড়াতে পারতাম। আমার অধীনে হেলিকপ্টার ছিল এবং পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করার মতাে সময়ও ছিল। আমি আমার প্রয়ােজন মতাে অর্থ নিয়ে যে কোনাে নিরপেক্ষ অথবা বন্ধু দেশে হেলিকপ্টারে করে চলে যেতে পারতাম। আমার অনুপস্থিতিতে পশ্চিম পাকিস্তানি বেসামরিক লােকজন ও বিহারি এবং সৈন্যদের অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পােহাতে হতাে। তাই আমি ঢাকায় থেকে যাবার সিদ্ধান্ত নেই। একজন সৈনিক ও একজন কমান্ডার হিসেবে সৈন্যদের সঙ্গে অবস্থান করা ছিল আমার কর্তব্য। আমি সৈন্যদের সঙ্গে আত্মসমর্পণের অপমান এবং শক্রর হাতে বন্দি হওয়ার দুর্ভাগ্যের অংশীদার হই। চরম প্রতিকূলতার মধ্যে বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করেছে আমার সৈন্যরা। তাদের কোনাে বিশ্রাম অথবা স্বস্তি ছিল না। তাদের চারদিকেই ছিল শত্রু। এ পরিস্থিতিতেও তাদের মনােবল ছিল অনেক উঁচু। ইতিহাসে এমন নজির খুব কমই আছে যেখানে একটি ক্ষুদ্র বাহিনী তাদের মূল ঘাঁটি থেকে বহু দূরে দূরতিক্রম্য বাধা-বিপত্তির ভেতর এত দীর্ঘদিন এমন বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করেছে। নেতৃত্বে অভাবনীয় যােগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন আমার অধিকাংশ কমান্ডারই। কিন্তু ভুট্টো ও তার ক্রীড়নকদের অপপ্রচারে তাদের এ বীরত্বপূর্ণ উপাখ্যান ফিকে হয়ে যায় এবং নেতিবাচক ধারণার সৃষ্টি হয়। ভুট্টো সৎ হলে এবং তার অসৎ উদ্দেশ্য না থাকলে তিনি হামুদুর রহমান কমিশনের তদন্ত কাজের পরিধি বিস্তৃত করতে পারতেন। কমিশনের তদন্তের আওতা সম্প্রসারিত করা হলে রাজনৈতিক ঘটনাবলী তদন্তের আওতাভুক্ত হতাে। লে. জেনারেল গুল হাসান ছিলেন সেসময় চিফ অভ আর্মি স্টাফ। ভুট্টো তদন্ত কমিশনের পরিধি সংকুচিত করায় তিনি প্রতিবাদ করেন নি। কারণ তিনি ভালাে করেই জানতেন যে, সীমিত গণ্ডির ভেতর তদন্ত পরিচালনা করা হলে ইন্টার্ন গ্যারিসনের ওপর পূর্ণ দায়-দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়া সম্ভব হবে। ভুট্টোর তল্পিবাহক হতে গিয়ে তিনি তার বিবেক, নীতি-আদর্শ সবকিছু বিকিয়ে দেন।
ভুট্টো মন্ত্রিসভার একটি সাব-কমিটি হামুদুর রহমান কমিশনের রিপাের্ট এক নজর দেখার সুযােগ পেয়েছিলেন। এ রিপাের্ট দেখে কমিটি এটাকে ‘পক্ষপাতমূলক’ বলে আখ্যায়িত করেছে এবং চরত্র হননের একটি প্রয়াস’ বলে সমালােচনা করেছে। ভুট্টোর দলের লােকজন এ রিপাের্টকে একপেশে, সংক্ষিপ্ত ও অপর্যাপ্ত হিসেবে উল্লেখ করেছে। একথাও উঠেছে যে, কমিশন তাদের তদন্তের পুরােপুরি অথবা আংশিকভাবেও একটি প্রচলিত তদন্ত কমিশনের রীতি-নীতি অনুসরণ করে নি। শুধু তাই নয়, পরবর্তীকালে ভুট্টো ও টিকা এ তদন্ত কমিশনের রিপাের্ট পুরােপুরি বদলে ফেলেন যাতে কোনাে প্রামাণ্য দলিল অবশিষ্ট না থাকে। রাজনৈতিক বিপর্যয়ের পুরাে দায়িত্ব ইস্টার্নকমান্ডের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়। ইস্টার্ন কমান্ডের ওপর রাজনৈতিক ও সামরিক উভয় ব্যর্থতা চাপিয়ে দেয়ার পেছনে কাজ করেছেন জেনারেল ইয়াহিয়া জেনারেল হামিদ, গুল হাসান, টিক্কা ও ফরমান। ক্ষমতায় যাবার জন্য ভুট্টোর পাকিস্তান দ্বিখণ্ডিত করার প্রয়ােজন ছিল। এ প্রয়ােজন। পূরণে তৎকালীন সরকার ও সেনা সদর দপ্তর ন্যাক্কারজনক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। আওয়ামী লীগের কাছে বাংলাদেশ ছেড়ে দিয়ে ভুট্টো তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দী মুজিবের হাত থেকে নিষ্কৃতি পান এবং সেনাবাহিনী যাতে কখনাে তার প্রতি একটি হুমকি হয়ে দেখা দিতে না পারে সেজন্য তিনি ইস্টার্ন কমান্ডের আত্মসমর্পণের পেছনে কলকাঠি নাড়েন। ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে তিনি ক্ষমতায় আসেন এবং তার ক্ষমতার ভিত্তি মজবুত করার জন্য তিনি শেখ মুজিবকে মুক্তি দেন এবং ৪৫ হাজার যুদ্ধবন্দি ও ৪৭ হাজার বেসামরিক লােকজনকে ভারতের বন্দি শিবিরে দীর্ঘকাল ফেলে রাখার বন্দোবস্ত করেন। যুদ্ধবন্দি ও বেসামরিক লােকজন দেশে ফিরে এলে ভুট্টোর কারসাজি ও অপকর্ম ফাঁস হয়ে যেত। সিমলা গিয়ে ভুটো পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিদের দেশে প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে আলােচনা করতে অস্বীকৃতি জানান। সেনাবাহিনীকে ঘৃণা করতেন তিনি। সিমলা গিয়ে তিনি যে উক্তি করেন তাতে তার এ উৎকট মানসিকতা প্রকাশ পেয়েছে। তিনি আমাদেরকে ব্রিটিশের কামানের খােরাক হিসেবে আখ্যায়িত করেন। ভুট্টো তড়িঘড়ি করে বাংলাদেশ স্বীকৃতি দিয়ে বাংলাদেশ ও কায়েদে আযমের পাকিস্তানের পুনরেকত্রীকরণের সম্ভাবনা নস্যাৎ করে দেন।
ইস্টার্ন কমান্ডের তৎপরতাকে নিম্নোল্লেখিত পর্যায়ে বিচার করতে হবে : পর্যায় ১ ১৯৭১ সালের মে নাগাদ বিদ্রোহীদের পরাজিত করে পূর্ব পাকিস্তানের
সীমান্ত পুনরুদ্ধার এবং বিদ্রোহীদের ভারতীয় ভূখণ্ডে বিতাড়িত করা। এ সাফল্যকে টিক্কার সমর্থকরাও একটি অলৌকিক ঘটনা হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।
পর্যায় ২: পূর্ব পাকিস্তানের একটি ভূখণ্ড দখল করে সেখানে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় গেরিলাদের সহায়তাদানকারী ভারতীয়দের প্রচেষ্টা নস্যাৎ।
পর্যায় ৩ : পরােক্ষ যুদ্ধে ব্যর্থ হয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী ২১ নভেম্বর প্রকাশ্য যুদ্ধ শুরু করে। পরিকল্পনা অনুযায়ী তারা ১২ দিনে পূর্ব পাকিস্তান দখল করতে চেয়েছিল। কিন্তু ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত তারা সীমান্তেই লড়াই চালাচ্ছিল। এ সময়ের মধ্যে তারা কোনাে উল্লেখযােগ্য ভূখণ্ড দখল নিতে পারে নি।
পর্যায় ৪ : আমাদের পরামর্শ উপেক্ষা করে ৩ ডিসেম্বর পশ্চিম রণাঙ্গনে বিলম্বিত
লড়াই শুরু করা। পশ্চিম রণাঙ্গনে বিপর্যয়ে আমার অবস্থান আরাে বেসামাল হয়ে ওঠে। তা সত্ত্বেও আমার সৈন্যরা লড়াই চালিয়ে যেতে থাকে এবং ভারতীয় সৈন্যদের সীমান্তে আরাে এক সপ্তাহ আটকে রাখে। ভারতীয়রা তাদের লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয় এবং ঢাকা রক্ষায় চূড়ান্ত লড়াইয়ের অবস্থানে আমার সৈন্যদের পিছু হটে আসতে দেখে ভারতীয়রা পর্যন্ত তাজ্জব বনে যায়। ফরমান ও কাজী মজিদের মতাে চক্রান্তকারীদের চক্রান্ত সত্ত্বেও আমার সৈন্যরা দৃঢ় প্রতিরােধ গড়ে তােলে এবং আমি ঢাকাসহ আমার সকল দুর্গ রক্ষায় প্রস্তুত ছিলাম। ইয়াহিয়া পােলিশ ও রুশ প্রস্তাব গ্রহণ করে না করে আমাকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন। ভুট্টো পাকিস্তান ও পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর ওপর অসহনীয় অপমান ও অসম্মান চাপিয়ে দেন।
আমাকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেয়া না হলে দীর্ঘদিন আমি পূর্ব পাকিস্তান রক্ষা করতে পারতাম। কারণ ভারতীয়রা ছিল এলােমেলাে অবস্থায়। অন্যদিকে, আমরা তখনাে প্রধান প্রধান শহর, সমুদ্র বন্দর ও বিমান বন্দর নিয়ন্ত্রণ করছিলাম। ঢাকার বাইরে আমাদের প্রতিরক্ষা অবস্থানে হামলা করার জন্য তাদেরকে নতুন করে সৈন্য আনতে হতাে। এতে তাদের সময় লাগত প্রচুর। যশাের ও ময়মনসিংহ ছাড়া আমার অন্যান্য দুর্গগুলাে ভারতের ১১টি ডিভিশনকে ঠেকিয়ে রাখছিল এবং তাদেরকে দীর্ঘদিন আটকে রাখাও সম্ভব ছিল। এতে ভারতীয়দের অবিশ্বাস্য ক্ষয়ক্ষতি হতাে। ঢাকা দখল করতে হলে পূর্ণ শক্তি নিয়ােগ করতে হতাে তাদের। ইন্টার্ন গ্যারিসন পরাজিত হয় নি। আমার সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে এবং পশ্চিম পাকিস্তান রক্ষায় আমাকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করা হয়। ব্যাপক ক্ষমতা দিয়ে একটি নয়া কমিশন গঠন করা অপরিহার্য, ১৯৭১ সালের বিপর্যয় সম্পর্কে সত্য উদঘাটন করতে হলে। নজিরবিহীন প্রতিকূলতা ও অসম্ভব বাধা-বিপত্তির মধ্যে ইস্টার্ন কমান্ড কিভাবে ন্যস্ত দায়িত্ব সম্পন্ন করেছে এবং অন্যদিকে, সকল উপায় ও সম্পদ এবং সুবিধাজনক অবস্থানে থেকেও মাত্র ১০ দিনের লড়াইয়ে ওয়েস্টার্ন কমান্ড কেন সাড়ে ৫ হাজার বর্গমাইল ভূখণ্ড হারিয়েছে তা খুঁজে বের করার জন্য একটি সামরিক মহড়ার আয়ােজন করা হােক। এ মহড়ায় বিচারক হিসেবে উপস্থিত থাকবেন সেনাবাহিনী প্রধান। এ মহড়ায় দুটি বাহিনী অংশগ্রহণ করবে। একটি বাহিনীর নেতৃত্ব দেবেন টিক্কা খান, গুল হাসান ও তাদের অনুসারীরা এবং আরেকটি দলে থাকবাে স্বয়ং আমি এবং আমার অফিসারগণ। এ মহড়া হবে খুবই আকর্ষণীয়। এ থেকে অনেক কিছু শেখা যাবে। এতে চেয়ারে উপবিষ্ট হয়ে যারা যুদ্ধের নীতি নির্ধারণ করেন তাদের সঙ্গে রণাঙ্গনে সশরীরে অংশগ্রহণকারী জেনারেলদের মৌলিক পার্থক্য ফুটে উঠবে।
সূত্র : দ্য বিট্রেয়াল অভ ইস্ট পাকিস্তান – লে. জে. এ. এ. কে. নিয়াজি (অনুবাদ)