You dont have javascript enabled! Please enable it! শুক্কুর কারাগারে বেসামরিক জীবন - সংগ্রামের নোটবুক

বেসামরিক জীবন

যখন আমি রাওয়ালপিন্ডিতে অবস্থান করছিলাম তখন আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, আমি কোনাে কমিশনের কাছ থেকে ন্যায়বিচার পাব না। তাই আমি সামরিক আদালত গঠনের প্রস্তাব করি। সামরিক আদালত থেকেই ন্যায়বিচার পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। চার্জ গঠন করা হয়। কিন্তু ডেপুটি জজ এডভােকেট-জেনারেল (ডিজেএজি) সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল টিক্কা খানকে জানান যে, অভিযােগগুলাে খুবই দুর্বল এবং আমি সহজেই খালাস পেয়ে যাব। এজন্য আমাকে সেনাবাহিনী। থেকে অপসারণ করা হয়। ডিজেএজি আমার সঙ্গে এক সাক্ষাতে এ কথা স্বীকার করেছেন। টিক্কা খান আমাকে এক পক্ষকালের মধ্যে বাসা ছেড়ে দেয়ার নির্দেশ দিতে লাহাের সদর দপ্তরের স্টেশনকে নির্দেশ দেন। আমার নিজের কোনাে বাড়ি ছিল না এবং কোনাে বাড়ি কেনা অথবা ভাড়া নেয়ার মতাে অর্থও ছিল না। সুতরাং ৪০ বছরের চাকরি জীবনে আমার যা কিছু ছিল সবকিছু বিক্রি করে দিতে হয়। আমি ভীষণ আঘাত পাই। যা প্রতিকার করা যায় না তা মেনে নিতে হয়। সুতরাং আমি লাহােরে লরেন্স রােডে আমার এক আত্মীয়ের বাসায় উঠি। স্ত্রী ও মেয়েকে পাঠিয়ে দিই ছেলের বাসায়। আমার ছেলে তখন সেনাবাহিনীর একজন মেজর  বাড়ি নির্মাণের জন্য এক খণ্ড জমি বিক্রি করে দিই। চল্লিশ বছর চাকরি করে এ পুরস্কারই আমি পেয়েছিলাম। আমার প্রাণনাশের চেষ্টা করা হয়। সম্ভবত ভুট্টোর নির্দেশে এ হামলা করা হয়।  প্রখ্যাত রাজনীতিক ও আইনজীবী মিয়া মাহমুদ আলী কোরেশী এক পর্যায়ে আমার সঙ্গে যােগাযােগ করেন। আমি যেসব কাগজপত্র সঙ্গে করে নিয়ে যাই সেগুলাে তিনি মনােযােগ দিয়ে দেখেন এবং আমার সব কথা শুনে তিনি বলেন, “আপনার মামলা খুবই জোরালাে। তবে ভুলবশত আপনাকে শাস্তি দেয়া হয়েছে।” আমি তখন তাকে জানালাম যে, আমি উন্মুক্ত বিচার চাই যাতে মূল অপরাধীদের চিহ্নিত করা যায়। হামুদ-উর-রহমান কমিশনকে সক্রিয় করে তােলা সম্ভব হয় নি। এ কমিশনের সীমাবদ্ধতা থাকায় এবং সরকার, সেনাবাহিনী ও প্রশাসন ভুট্টো ও টিক্কার কথায় ওঠা-বসা করায় আমি তাদের কাছ থেকে ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করি নি। উন্মুক্ত বিচার হলে সত্য উঘাটিত হততা এবং প্রকৃত অপরাধীদের খুঁজে বের করা যেত। আইনজীবী মাহমুদ আলী কোরেশী আমাকে বলেছিলেন “আমি আপনার মামলা নিয়ে লড়বাে এবং আমি আপনার কাছ থেকে কোনাে পয়সা নেব না।

আপনার কোনাে দোষ না থাকা সত্ত্বেও আপনি যথেষ্ট দুর্ভোগ ভােগ করেছেন।” জনাব কোরেশী আমার মামলা নিয়ে অগ্রসর হবার আগেই ইন্তেকাল করেন। তার মৃত্যুতে আমি আমার একজন মহৎ বন্ধু ও অভিভাবককে হারাই। আবদুল কাইউম খান আমাকে একদিন টেলিফোন করেন এবং বলেন যে, কিছু রাজনৈতিক বিষয়ে আলােচনা করার জন্য তিনি আমার বাসায় আসছেন। তিনি আমাকে কাইউম মুসলিম লীগে যােগদানের জন্য আমন্ত্রণ জানান। তাকে আমি বললাম, ‘খান লালা, আপনি ভুট্টো সরকারের একজন মন্ত্রী। সুতরাং তার প্রতি আপনার দুর্বলতা থাকাই স্বাভাবিক। অন্যদিকে আমি তার বিপক্ষে। এ কারণে বিভিন্ন প্রশ্নে আপনার সঙ্গে আমার মতবিরােধ হতে পারে। আমি চাই না আপনার সঙ্গে আমার মতবিরােধ হােক। তিনি তখন বললেন, “রাজনীতিতে যােগদানের প্রস্তাব একটি ছলনা মাত্র। পাকিস্তানের বেসামরিক সশস্ত্র বাহিনীর কমান্ডারের পদ। গ্রহণে আপনাকে প্রস্তাব দিতে স্বয়ং ভুট্টো আমাকে পাঠিয়েছেন।’ আমি বললাম, ‘খান লালা, এ পদ খুবই লােভনীয়। তবে আমি আবারাে ‘না’ বলছি, ভুট্টো আমাকে ঘৃণা করেন। আমি কোর্ট মার্শাল গঠন করতে বলেছিলাম। কিন্তু তিনি যথাযথ অভিযোেগ গঠন করতে পারেন নি। আমি আবার ইউনিফর্ম পরিধান করলে তিনি আমার বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোেগ আনতে পারেন এবং দোষী সাব্যস্ত করে ফাসিও দিতে পারেন। অতএব, আমি ভুট্টোর এ লােভনীয় প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করছি।’ পরবর্তী সময়ে ভুট্টো আমাকে তলব করেন এবং বলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানে। রাজনৈতিক নয়, সামরিক বিপর্যয় ঘটেছে- একথা প্রকাশ্যে ঘােষণা করা হলে, আমাকে কূটনৈতিক দায়িত্ব দেয়া হবে। আমি সরাসরি প্রত্যাখ্যান করি এবং বলি। যে, এটা একটি রাজনৈতিক পরাজয় এবং সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার জন্য। তিনি এ সামরিক বিপর্যয়ের পরিকল্পনা করেছিলেন। তিনি আমাকে আবার ভেবে দেখতে বলেন। অন্যথায় তিনি আমাকে দেখে নেবেন বলেন। আমি তাকে ‘চেষ্টা’ করার কথা বলে বাসায় ফিরে আসি। ভুট্টো তার হুমকি বাস্তবায়ন করেছিলেন।

তিনি আমার চিফ অভ স্টাফ ব্রিগেডিয়ার বাকির সিদ্দিকী ও আমাকে বলির পাঁঠা বানান। পুরাে সেনাবাহিনী থেকে মাত্র আমাদের দু’জনকেই অপসারণ করা হয় এবং পেনশন থেকে আমাদের বঞ্চিত করা হয়। প্রকৃত অপরাধীদের হয় পদোন্নতি নয়তাে কূটনৈতিক দায়িত্ব দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়। জেনারেল ইয়াহিয়া, হামিদ, পীরজাদা, মিঠা, ওমর প্রমুখকে পূর্ণ সুযােগ সুবিধা দিয়ে অবসরে পাঠানাে হয় এবং সামরিক মর্যাদা তাকে দাফন করা হয়। গুল হাসান সেনাবাহিনী প্রধান হন। ইয়াকুবকে রাষ্ট্রদূত করা হয়। টিক্কা খানও সেনাবাহিনী প্রধান হন। রাজনীতিতে যােগদান রাজনীতিতে যােগদানে আমার কোনাে আগ্রহ ছিল না কারণ আমি একজন সৈনিক। কিন্তু ভুট্টো আমার বিরুদ্ধে এমনভাবে বিষােদগার ও মিথ্যা প্রচারণা চালাতে থাকেন যে, আমি আমার সম্মান বাঁচানাের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হই। ভুট্টোর মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য রাজনৈতিক প্লাটফর্ম একটি সর্বোত্তম জায়গা হওয়ায় আমি রাজনীতিতে যােগদান করি।  লাহােরের দিল্লী গেইটে আমি প্রথম ভাষণ দেই। জনগণ আমার ভাষণকে অভিনন্দন জানায়। পরদিন মাওলানা নূরানী ও মাওলানা আবদুল সাত্তার খান নিয়াজি আমার বাসভবনে আসেন এবং আমাকে জমিয়ত উলেমা-ই-পাকিস্তানে (জেইউপি) যােগাদানের আমন্ত্রণ জানান। আমি এ দু’জন খ্যাতিমান আলেমের সান্নিধ্যে আসতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করি। আমি মাওলানা আবদুল সাত্তার খান নিয়াজিকে আগে থেকেই চিনতাম এবং একজন সৎ ব্যক্তি হিসেবে তাকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতাম। আমি বিশ্বাস করতাম যে, তিনি আমাকে সঠিক পথে পরিচালনা করবেন। মাওলানা নূরানীও ছিলেন অত্যন্ত উঁচু মানের মানুষ এবং ইসলাম সম্পর্কে ছিল তার গভীর জ্ঞান। সুতরাং আমি জেইউপিতে যােগদান করি।

আমি মিয়ানওয়ালি থেকে ভাখারে যাই। ফিরে আসার পথে মাওলানা মুফতি মেহমুদের ছেলে মাওলানা ফজলুর রহমান আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তিনি আমাকে তার সঙ্গে ডেরা ইসমাইল বা যেতে অনুরােধ করেন। মুফতি মেহমুদ সেখানে মাহফিলে ওয়াজ করবেন। মুফতি সাহেবকে আমি চিনতাম এবং গভীর। শ্রদ্ধা করতাম। এজন্য আমি ডেরা ইসমাইল খাঁ যাই। ১৯৭৭-এ গঠিত হয় পিএনএ এবং রাজনৈতিক দলের প্রধানদের গ্রেফতার করা। হয়। আমি তখন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে থাকি। কোনাে কোনাে দিন আমাকে দূর-দূরান্তে দৈনিক ৮টি পর্যন্ত জনসভায় ভাষণ দিতে হয়েছে। পিএনএ আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে এবং ভুট্টোর গাত্রদাহ শুরু হয়। ১৯৭৭ সালে নির্বাচনী জনসভায় জনগণ আমাকে দেখে মর্দে মুজাহিদ, মর্দে গাজী- জেনারেল নিয়াজি, জেনারেল নিয়াজি’ প্রভৃতি শ্লোগান দিত। শহর ও গ্রামে যেখানে অবসরপ্রাপ্ত সৈনিকদের জোটে সদস্যপদ দেয়া হতাে আমি ছিলাম সেখানে ভীষণ জনপ্রিয়। পাঞ্জাব ও উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ সফর করার পর আমাকে করাচি যেতে বলা হয়। করাচিতে আমার প্রথম সমাবেশে প্রায় ১৫ লাখ লােক সমবেত হয়। পাকিস্তানে কোনাে রাজনৈতিক সমাবেশে আর কখনাে এত লােক হয় নি। লােকজন আমাকে বহু প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে। আমি তাদের প্রশ্নের জবাব দেই এবং আমার জবাবে তাদেরকে সন্তুষ্ট বলে মনে হয়। আমি বললাম যে, সত্য উঘাটনের সর্বোত্তম উপায় হচ্ছে গণ আদালত। ইয়াহিয়া, ভুট্টো ও টিক্কা এবং আমাকে তলব করা হােক। জনগণ আমাদেরকে প্রশ্ন করবে। উপস্থিত লােকজনের ভেতর থেকে মনােনীত বিচারকদের একটি প্যানেল রায় দেবে এবং তাদের রায়ে যারা দোষী সাব্যস্ত হবে তাদের শাস্তি হবে। ভুট্টো এ ধরনের একটি গণ আদালতে হাজির হতে অস্বীকৃতি জানান।  করাচির মালিরে একদিন এক জনসভা ছিল। পিপিপি’ও একইদিন পাশেই আরেকটি জনসভা আহ্বান করে।

হাফিজ পীরজাদা এ জনসভায় ভাষণ দেবেন। পীরজাদা বক্তৃতা দেয়া শুরু করলে আমিও বক্তৃতা শুরু করি। আমার কণ্ঠ শুনে পীরজাদার জনসভার সব লােক আমার জনসভায় এসে পড়ে। তখন বলতে গেলে তার সভাস্থল ফাঁকা। পিপিপি’র হাতে গােনা কয়েকজন কট্টর কর্মী ও আয়ােজক ছাড়া মাঠে আর কেউ ছিল না। রাগে-ক্ষোভে গজরাতে গজরাতে পীরজাদা সভাস্থল ত্যাগ করেন এবং পিপিপি’র জনসভা পণ্ড হয়ে যায়। করাচি থেকে আমি হায়দারাবাদে যাই। সমাবেশের আগে একটি মিছিল বের হয়। আমি তাতে নেতৃত্ব দিই। শহর ও আশপাশের লােকজন সমাবেশে হাজির হয়। সকল রাস্তাঘাট ও বাড়ির ছাদ লােকে লােকারণ্য। হায়দরাবাদ ছিল সেদিন জনসমুদ্র। ভুট্টোর টনক নড়ে। সেদিন রাতেই লতিফাবাদে মেজর সাকিবের বাসভবন থেকে আমাকে গ্রেফতার করা হয় এবং মেজর সাকিবসহ আমাকে শুকুর কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়।  মেহমুদ আজম ফারুকী ও অধ্যাপক গফুর আহমেদ করাচিতে আমাকে সহায়তা করেন। অধ্যাপক গফুর আমার কাছে অনুপ্রেরণার এক উৎস হিসেবে প্রমাণিত হন। করাচিতে তিনি সারাক্ষণ আমার সঙ্গে থাকতেন এবং আমাদের মাঝে বন্ধুত্ব হয়। জনাব ফারুকী ও অধ্যাপক গফুর উভয়ে আমাকে এত ভালােবেসে ফেলেন যে, লাহােরে এলে তারা আমার সঙ্গে দেখা না করে যেতেন না। এমনকি কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। হবার পরও তারা তা করেছেন। গ্রেফতার হবার আগে আমি করাচি কারাগারে আটক পিএনএ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাই। কারা কর্তৃপক্ষ আমাকে পূর্ণ সম্মান প্রদান করে। আমার জন্য ফটক খুলে দেয়া হয়। একমাত্র ডিপিআইপি’রাই এ সুযােগ পেয়েছে থাকে।  একইভাবে শুকুর কারাগারে পৌছলেও আমাকে জেলার ও ডেপুটি জেলার অভ্যর্থনা জানান এবং আমার সম্মানে গেইট খুলে দেয়া হয়। ভুট্টোর আমলে কারা কর্তৃপক্ষের জন্য আমাকে সম্মান দেখানাে ছিল সত্যিই বিপজ্জনক জেলার ও ডেপুটি জেলার  অফিসে আমাকে চা পান করান এবং আমাকে যেখানে থাকতে হবে সেখানে তারা উভয়ে পথ দেখিয়ে দেখিয়ে নিয়ে যান।

শুক্কুর কারাগার

কারাগারে আমাকে ক্যাটাগরি-‘এ’তে রাখা হয়। মীর আলী আহমেদ তালপুর ছাড়া অন্যান্য রাজনীতিকদের রাখা হয় ‘বি’ শ্রেণীতে। মীর আলী আমার মতাে প্রথম শ্রেণীর মর্যাদা লাভ করেন। তিনি আমার পাশের পক্ষে থাকতেন। সব দলের নেতারাই ছিলেন কারাগারে। এসব নেতার মধ্যে ছিলেন জেইউপি’র ফরিদুল হক, হক্কানী সাহেব ও দোস্ত মােহাম্মদ ফায়েজী, জেইউআই’র মাওলানা আমরুতী, জামায়াতে ইসলামীর অধ্যাপক গফুর ও মাহমুদ আজম ফারুকী, তেহরিক-ইইশতেকলালের সালেহ মােহাম্মদ মান্ধখেল, জিয়ে সিন্ধের জনাব পালিজো ও আবু বকর জারদারী ও মুসলিম লীগের বােস্তান আলী হােতি। আমরা একসঙ্গে আবার খেতাম এবং একসঙ্গে নামায আদায় করতাম। জেইউপি’র মাওলানা হক্কানী নামাজে ইমামতী করতেন। লে. জেনারেল জাহানজেব আরবাব ছিলেন সিন্ধুর সামরিক আইন প্রশাসক। একদিন শুনলাম তিনি কারাগার পরিদর্শনে আসছেন। কর্তৃপক্ষ তার পরিদর্শনের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আমি জেলারকে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি আরবাবের পরিদর্শনকে কিভাবে দেখছেন। তিনি আমাকে বললেন, ‘আপনাকে সত্য বলতে কি স্যার, এসব পরিদর্শন হচ্ছে খামােখা। প্রকৃতপক্ষে, কয়েদী অথবা কারাগারের স্টাফদের ব্যাপারে তাদের কোনাে আগ্রহ নেই। আমরা কারাগারে যেসব সামগ্রী তৈরি করি সেগুলাের ব্যাপারে তারা নির্দেশ দিতে আসেন।’ আমি তাকে বললাম, আপনি তাকে বলুন যে, আমি এখানে আছি এবং তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তাতে কি হবে? আমি জবাব দিলাম, তিনি আসবেন না। কারণ লুটতরাজ ও দুর্নীতির জন্য তাকে আমি পূর্ব পাকিস্তানে থেকে ফেরত পাঠিয়েছিলাম।’ আরবাবকে এ বার্তা জানানাে হয় এবং তিনি কারাগার পরিদর্শনে তার কর্মসূচি বাতিল করেন। জিয়ার ক্ষমতা দখল আমি ছাড়া সকল রাজবন্দি মুক্তি পান, সামরিক আইন জারি করা হলে। কয়েকদিন পর একজন সেনা কর্মকর্তা আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেন।

তিনি আমাকে বলেন, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল জিয়াউল হক নির্দেশ নিয়েছেন যে, আপনাকে মুক্তি দানের আগে তিনি আপনার কাছ থেকে এ মুচলেকা চান যে, আপনি আর রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করবেন না। আমি বললাম, বস, আমার তাে  কোনাে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নেই এবং আমি রাজনীতি বুঝি না। আমি কারাগারে। এসে দেখতে পাচ্ছি যে, আমি রাজনীতির কানাকড়িও জানি না। আমি উৎপীড়ক। ভুট্টোর বিরুদ্ধে জনগণকে সাহায্য করার জন্য রাজনীতিতে যােগদান করেছি। তার। পতন ঘটেছে এবং রাজনীতিতে আমার আর কোনাে আগ্রহ নেই। তবে সরকারকে মুচলেকা দানের ব্যাপারে আমার জবাব হচ্ছে না’। এটা আমার নীতিবিরুদ্ধ। আমার যা পছন্দ আমি তাই করি এবং আমার ওপর কারাে খবরদারি আমি মেনে নেব না।’ জিয়াউল হকের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় আমাকে কারাগারে পড়ে থাকতে। হয়। আমাকে শুকুর কারাগার থেকে লাহােরে গৃহবন্দি অবস্থায় স্থানান্তর করা হয়। জিয়াউল হক বললেন, ‘ভুট্টোর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা রুজু করা হলে আপনি কি তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবেন?’ আমি বললাম, ‘তাকে মুক্তি দেয়া হলে সাক্ষ্য দেব। নয়তাে না। কেউ আমার পরম শত্রু হলেও তার পিঠে ছুরি মারার নীতিতে আমি। বিশ্বাসী নই।’  জিয়াউল হকের সঙ্গে দ্বিমত হওয়ার তার আমলে আমাকে আরাে ৬ মাস কারাগারে থাকতে হয়। ভুট্টোর আমলে ছিলাম তিন মাস। জিয়াউল হকের আমলে। তিন মাস ছিলাম কারাগারে এবং বাকি তিন মাস গৃহবন্দি।

শুকুর কারাগারে ভুট্টো

ভুট্টোকে  শুকুর কারাগারে আনা হয় সামরিক আইন জারির পর। আমি তখন। সেখানেই। এটা ছিল আমার জন্য একটি স্মরণীয় ঘটনা। তিনি আমাকে দেখেই এগিয়ে আসেন এবং আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। বললেন, “নিয়াজি, আপনার প্রতি। রুঢ় হওয়ায় আমি সত্যিই দুঃখিত। আমাকে ভুল পরামর্শ দেয়া হয়েছিল।’ আমি। তাকে আমার কক্ষে নিয়ে যাই এবং এক কাপ গরম কফি দেই। এরপর আমরা আলাপ করতে শুরু করি। তাকে উদ্বিগ্ন মনে হয় নি। তিনি বললেন, ‘নিয়াজি আপনি ফিরে গেলে আমরা একসঙ্গে কাজ করবাে। আমি বললাম, ‘জনাব ভুট্টো, এ কী। করে সম্ভব? আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা এবং আমরা কম-বেশি একে অপরের শত্রু। তিনি বললেন, ‘নিয়াজি আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছিলাম এবং সংশােধনের। চেষ্টাও করেছিলাম। কিন্তু আপনি আমার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন। যখন আপনি আমার কাছে প্রথম দিন এসেছিলেন, সেদিন আমি প্রথম প্রস্তাব দিয়েছিলাম এবং বলেছিলাম যে, আপনাকে স্বীকার করতে হবে যে, এটা একটি সামরিক বিপর্যয়। এবং এজন্য সেনাবাহিনী দায়ী। আমি আপনাকে কূটনৈতিক দায়িত্ব দিচ্ছি। কিন্তু আপনি বললেন, এটা একটি রাজনৈতিক পরাজয়। দ্বিতীয় বার আমি আপনার কাছে। কাইউম খানকে পাঠিয়েছিলাম। তিনি আপনাকে পাকিস্তানের বেসামরিক সশস্ত্র বাহিনীর কমান্ড গ্রহণ করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু আপনি এ প্রস্তাবও নাকচ করে দেন। তিনি আরাে বললেন, ‘আমি আপনার সার্ভিস রেকর্ড দেখেছি এবং আপনি পূর্ব পাকিস্তানে কিভাবে যুদ্ধ করেছেন তা পর্যালােচনা করেছি। অতি সামান্য সম্পদ নিয়ে আপনি এক বিরাট দায়িত্ব পালন করেছেন। জেনারেল হেড কোয়ার্টার্সে পাঠানাে আপনার বার্তা আমি পাঠ করেছি। এসব বার্তা পাঠে এ ধারণাই হয় যে, বার্তা প্রেরক অত্যন্ত সাহসী, অভিজ্ঞ, ধৈর্যশীল ও একজন নিষ্ঠাবান ব্যক্তি। আমি টিক্কার পরে আপনাকে সেনাবাহিনী প্রধান পদে নিযুক্ত করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আপনি আমার কাছে ধরা দেন নি।’ আমি বললাম, আমি আপনাকে বিশ্বাস করতে পারি নি। তাই আপনার কাছে যাই নি।

তিনি আমাকে প্রশ্ন করলেন, আপনি এখনাে কারাগারে কেন?’ আমি জবাব দিলাম, “জিয়া আমাকে রাজনীতি ছাড়ার মুচলেকা দিতে বলেছিলেন, কিন্তু আমি মুচলেকা দেই নি। তাই আমি এখানে। আমি তাকে পাল্টা প্রশ্ন করলাম, এখন আপনি বলুন, আপনি আমাকে কারাগারে পাঠিয়েছিলেন কেন?’ তিনি বললেন, আপনি আমাদের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠছিলেন। আপনার সমাবেশে জনতার ভিড় এবং আপনার ভাষণ পিএনএ’র আন্দোলনে নতুন গতি সঞ্চার করছিল। পিএনএ’র আন্দোলনেকে দুর্বল করার জন্যই আমরা আপনাকে গ্রেফতার করি।’ ভুট্টোকে শুকুর কারাগার থেকে সরিয়ে নেয়া হয় সন্ধ্যায়। তিনি কারাগারের ডাক্তার (সাবেক সেনা কর্মকর্তা) এর মাধ্যমে আমার কাছে একটি বার্তা পাঠান বার্তায় তিনি বলেন, ‘আমাকে কফি পান করাননার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আপনার সঙ্গে আমার হৃদ্যতাপূর্ণ আলােচনা আমার চিন্তার খােরাক যুগিয়েছে। কারাগার থেকে মুক্তি পেলে একত্রিত হব আমরা। আমি আপনার সঙ্গে সব ভুল বােঝাবুঝির অবসান ঘটাব।’ আমার মতবিরােধ ছিল ভুট্টোর সঙ্গে তাকে মােটেও পছন্দ করতাম না আমি। কিন্তু তাকে ফাঁসি দেয়ায় আমি খুব দুঃখ পাই। এ ধরনের মৃত্যু তার হওয়ার কথা ছিল না। অন্তত জিয়ার মতাে একজন ক্ষমতাদখলকারীর হাতে নয় । জিয়া না ছিলেন একজন দক্ষ জেনারেল, না ছিলেন একজন দক্ষ প্রশাসক। তাছাড়া তিনি। দেশেরও কোনাে কল্যাণ করতে পারেন নি। তিনি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন। কিন্তু তিনি তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেন নি। তিনি ইসলাম নিয়ে কিছু রং তামাশা করেছিলেন। জেনারেল জিয়া দেশে কালাশনিকভ রাইফেল ও হেরােইনের সংস্কৃতি চালু করেন। তার আত্মীয় স্বজনদের ধনী হওয়ার সুযােগ দেন এবং ভারতের কাছে সিয়াচেন ছেড়ে দেন। 

সূত্র : দ্য বিট্রেয়াল অভ ইস্ট পাকিস্তান – লে. জে. এ. এ. কে. নিয়াজি (অনুবাদ)