আত্মসমর্পণ এবং যুদ্ধবন্দি শিবির নং ১০০
আত্মসমর্পণ জেনারেল মানেকশ আমাদেরকে জানান যে, একটি ভারতীয় প্রতিনিধি দল আত্মর্পণের দলিলপত্র চূড়ান্ত করার জন্য ঢাকা আসছে। বিশাল পাখা ঝাপটে একটি ভারতীয় হেলিকপ্টার ঢাকা বিমান বন্দরে চক্কর দিতে থাকে। একটু পরেই হেলিকপ্টারটি অবতরণ করে। মেজর জেনারেল জ্যাকব, চিফ অভ স্টাফ, ইন্ডিয়ান ইস্টার্ন কমান্ড, তার প্রতিনিধি দল নিয়ে হেলিকপ্টার থেকে বের হয়ে আসেন। পাকিস্তানি সিওএস ব্রিগেডিয়ার বাকির সিদ্দিকী বিমান বন্দরে তাদের অভ্যর্থনা জানিয়ে ইস্টার্ন কমান্ডের সদর দপ্তরে নিয়ে আসেন। ভারতীয় প্রতিনিধি দল এসেছিলেন যুদ্ধবিরতির শর্তাদি নিয়ে আলােচনা করার জন্য। তবে তারা আলােচনা করা ছাড়াই আত্মসমর্পণের একটি খসড়া দলিল সঙ্গে করে নিয়ে আসেন। ব্রিগেডিয়ার বাকিরের অফিসে জ্যাকবের সঙ্গে তার প্রাথমিক আলােচনা হয়। প্রস্তাব উথাপনের পর বাকির এ বিষয়ে আমার সঙ্গে কথা বলেন। আমি ব্রিগেডিয়ার বাকিরকে জেনারেল জামশেদ, ফরমান এবং অ্যাডমিরাল শরীফ এবং উর্ধ্বতন পাকিস্তানি সেনা ও নৌ কর্মকর্তাদের সঙ্গে পরমার্শ করার নির্দেশ দেই। ভারতীয় প্রতিনিধি দল আমাদেকে হুমকি দেয়, যে আমরা তাদের শর্তে রাজি না হলে হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আশ্রয়গ্রহণকারী স্থানীয় অনুগত লােকজন ও আমাদের বেসামরিক অফিসারদের মুক্তিবাহিনীর হাতে তুলে দেয়া হবে এবং মুক্তিবাহিনী তাদের হত্যা করবে। ভারত ও বাংলাদেশের ‘যৌথ কমান্ড’ শব্দের ব্যবহার এবং আত্মসমর্পণের স্থান ও ধরন সম্পর্কে আমাদের আপত্তি সত্ত্বেও ভারতীয় প্রতিনিধি দলের এ হুমকিতে আমরা তাদের শর্তে আত্মসমর্পণে রাজি হই।
জেনারেলদের মধ্যে একমাত্র ফরমানের আচরণ নাটকীয়ভাবে বদলে যায়। সংকটকালে তিনি যে দুর্বলতা প্রদর্শন করেছিলেন তা মিলিয়ে যেতে থাকে। তার চোখ মুখ থেকে ভীতি ও হতাশা দূর হয়ে যায়। ৫ জন গভর্নরের সামরিক উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করায় এবং ২৫ মার্চের নিষ্ঠুর সামরিক অভিযানে জড়িত থাকায় তার প্রতি বাঙালিদের ক্রোধ ও ঘৃণা জন্ম নেয়। বাঙালিরা তার অপরাধের জন্য তাকে শাস্তি দিতে চেয়েছিল। তাকে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী করা হয়। বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের তালিকা একটু বাড়িয়ে দেখানাে হয়। কারণ এ তালিকায় যাদের নাম ছিল তাদের কেউ কেউ তখনাে জীবিত ছিলেন। একটি প্রচণ্ড ভীতি গ্রাস করায় ফরমান চেয়েছিলেন পালাতে। বাঙালিরা যে কোনাে মূল্যে প্রতিরােধ গ্রহণের শপথ নেয়। আমি ভারতীয় প্রতিনিধি দলকে আমার অফিসে ডেকে পাঠাই সামান্য আলাপআলােচনার পর ঊর্ধ্বতন পাকিস্তানি কর্মকর্তাগণ ভারতীয় প্রস্তাব মেনে নিতে সম্মত হওয়ায় ভারতীয় প্রস্তাবে বেসামরিক লােকজনের নিরাপদ হেফাজতের ব্যবস্থা না থাকায় আমি ব্যক্তিগতভাবে অসন্তুষ্ট হই এবং উদ্বিগ্ন হয়ে উঠি। ১৪ ডিসেম্বর গভর্নর পদত্যাগ করায় এবং বেসামরিক কর্মকর্তাগণ হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের নিরাপদ এলাকায় আশ্রয় নেয়ায় সামরিক কমান্ডার ও বেসামরিক প্রশাসক হিসেবে আমার ওপর বেসামরিক লােকজনের নিরাপত্তা রক্ষার গুরুদায়িত্ব ন্যস্ত হয়। তাই আমি তাদের রক্ষা এবং পশ্চিম পাকিস্তানে তাদের নিরাপদে পৌছে দেয়ার কোনাে চেষ্টা বাকি রাখিনি। আমি জ্যাকবের কাছে দুটি শর্ত পেশ করি। প্রথম শর্ত ঢাকা এলাকায় পর্যাপ্ত ভারতীয় সৈন্য এসে পৌছানাের আগ পর্যন্ত পাকিস্তানি সৈন্যরা নিজেদের আত্মরক্ষা ও বেসামরিক লােকজনকে রক্ষায় তাদের ব্যক্তিগত অস্ত্র বহন করতে পারবে। দ্বিতীয় শর্ত : পাকিস্তানি বেসামরিক লােক, বেসামরিক কর্মকর্তা ও স্টাফদের বেসামরিক বন্দির মর্যাদা দিতে হবে এবং সৈন্যদেরকে যেখানে রাখা হবে, তাদেরকেও রাখতে হবে সেখানেই।
জ্যাকব প্রথম শর্তে রাজি হন তাৎক্ষণিকভাবে তবে আপত্তি করে বলেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থানরত বাঙালিদের সঙ্গে বিনিময় না হওয়া পর্যন্ত বেসামরিক লােকজনকে বাংলাদেশেই অবস্থান করতে হবে। আমি ভেবে দেখলাম যে, ভারতীয় সেনাবাহিনী ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব উভয়ের পক্ষ থেকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বেসামরিক লােকজনের নিরাপত্তার ফয়সালা ছাড়া পরবর্তী আলােচনা হবে অর্থহীন। আমার অনমনীয় মনােভাবের কারণে জ্যাকব আমাদের পূর্বশর্ত নিয়ে তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলতে বাধ্য হন। টেলিফোন দীর্ঘ কথাবার্তার পর এ বিষয় নিষ্পত্তিতে জ্যাকবকে তার বিবেচনা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা দেয়া হয়। বেসামরিক লােকজনের নিরাপত্তা সংক্রান্ত জটিতা দূর হওয়ার পর বিষয়টির সুরাহা হয়। প্রতিনিধি দলের বাঙালি সদস্য এতে আপত্তি করে কিন্তু অগ্রাহ্য হয় তার আপত্তি। এ সময় বহু ঊর্ধ্বতন ভারতীয় ও বাঙালি কর্মকর্তা এবং সাংবাদিক ঢাকা এসেছিলেন। আলােচনা ভেঙে গেলে তাদের যুদ্ধবন্দি হওয়ার ঝুঁকি ছিল। কারণ তখনাে লড়াই চলছিল। যুদ্ধের আচরণ বিধি ও পেশাগত নৈতিকতা অনুযায়ী প্রতিনিধি দলকে কেবল নিরাপত্তা দেয়া হতাে, অননুমােদিত ব্যক্তিদের নয়। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের ধারণা সম্পর্কেও আপত্তি জানিয়েছিলাম আমরা। আমি এভাবে আত্মসমর্পণ করতে চাইনি। তাই আমাদের আলােচনায় অচলাবস্থায় দেখা দেয়। ভারতীয়রা অনমনীয় অবস্থান গ্রহণ করে। তারা অনুগত লােকজনকে হত্যার হুমকি দেয়। সত্যি সত্যি তখন বহু তরুণকে জবাই করা হয়। আমাদেরকে বলা হয় যে, সব বেসামরিক লােকজনকে মুক্তিবাহিনীর হাতে তুলে দেয়া হবে। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের বিষয়ে পূর্ব পাকিস্তানের বেসামরিক প্রশাসনের সঙ্গে আলােচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া যেত। কিন্তু তারা পদত্যাগ করে নিরপেক্ষ এলাকায় আশ্রয় নেন। কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক উভয় সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে আমাকে পরিত্যাগ করায় আমাকেই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। এরপর মেজর জেনারেল জ্যাকব ও ব্রিগেডিয়ার বাকির সিদ্দিকী পূর্ব নির্ধারিত এলাকায় বেসামরিক লােকজনকে একত্রিতকরণ এবং অন্যান্য সেক্টরে মােতায়েন সৈন্যদের এক জায়গায় নিয়ে আসা এবং তাদেরকে ওয়াগার দিকে নিয়ে যাবার মতাে অন্যান্য প্রশাসনিক সমস্যাগুলাের খুঁটিনাটি বিষয়ে আলােচনা শুরু করেন।
ঢাকার আশপাশে অবস্থানরত সৈন্য, বেসামরিক কর্মকর্তা, বেসামরিক লােকজনও তাদের পরিবারবর্গকে একত্রিত করা ছিল সবচেয়ে কঠিন কাজ। সিভিল এভিয়েশন, পিআইএ, কাস্টমস ও কেন্দ্রীয় সরকারের অন্যান্য কর্মকর্তাদের ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় সরিয়ে আনতে হবে। শহরে পরিস্থিতি বিভ্রান্তিকর । মুক্তিবাহিনী তখন খুবই সক্রিয়। তারা বেসামরিক লােকজনের ওপর হামলা চালাচ্ছে। আমার চিফ অভ স্টাফ ব্রিগেডিয়ার বাকির দিন-রাত পরিশ্রম করে এসব লােককে সরিয়ে আনেন এবং ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় এনে একত্রিত করেন। ঢাকা থেকে আমাদের প্রস্থানের তিন দিনের মধ্যে এ কাজ শেষ করা হয়। বিহারি ও অন্যান্য অনুগত লােকজনের অবস্থা ছিল হৃদয়বিদারক। তাদেরকে গণহত্যার মুখে রেখে যাওয়ায় তাদের কান্না ও আহাজারিতে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। গণহত্যার খবর আসছিল। অনুগত তরুণ পূর্বপাকিস্তানিদের লাইনে দাঁড় করিয়ে মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তাদের হত্যা করেছে। সাবেক এমএনএ মৌলভী ফরিদ আহমেদসহ অন্যান্যদের হত্যা করে ঢাকার রাজপথে তাদের লাশ টানা-হেঁচড়া করা হয়। আমরা ভারতীয়দের বললাম যে, এসব ঘটনা চুক্তির প্রকাশ্য লংঘন। কিন্তু ভারতীয়রা আমাদের হাতে দড়ি পরাবার জন্য এসব ঘটনাকে ব্যবহার করছিল। ভারতীয় যুদ্ধবিমানের ব্যাপক বােমাবর্ষণে ৬ ডিসেম্বর থেকে আমাদের এফ-৮৬ স্যাবর জেটের বহর অকেজো হয়ে পড়ে। বিধ্বস্ত হয়ে যায় রানওয়ে। এয়ার কমােডর ইনাম জঙ্গিবিমানগুলােকে ব্যবহারােপযােগী নয় বলে ঘােষণা করেন। পাইলটদেরকে তাদের জীবন বাঁচানাের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেয়া হয়। বন্দিত্ব বরণের জন্য রয়ে যান কেবল এয়ার কমােডর ইনাম। আর্মি এভিয়েশনের হেলিকপ্টারগুলাে শিশু, নারী ও আহতদের নিয়ে বার্মা হয়ে পাকিস্তানে চলে যায়।
আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয় ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর। মেজর জেনারেল ফরমান ও অ্যাডমিরাল শরীফ এ অনুষ্ঠান প্রত্যক্ষ করেন। আমি কাঁপা হাতে আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করি। তখন আমার অন্তরে উথিত ঢেউ দু’চোখ বেয়ে অশ্রু হয়ে গড়িয়ে পড়ে। অনুষ্ঠানের একটু আগে একজন ফরাসি সাংবাদিক এগিয়ে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এখন আপনার অনুভূতি কী, টাইগার?’ জবাবে বললাম, “আমি অবসন্ন।’ অরােরা আমার পাশেই ছিলেন। তিনি মন্তব্য করলেন, এক চরম বৈরি পরিবেশে তাঁকে এক অসম্ভব দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। কোনাে জেনারেলই এ পরিস্থিতিতে এর চেয়ে ভালাে করতে পারত না। আমাকে যে দুর্ভাগ্য বরণ করতে হয়েছে তাতে আমার কোনাে হাত অথবা ইচ্ছা ছিল না। পশ্চিম পাকিস্তান রক্ষায় প্রেসিডেন্ট আমাকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিলে আমি বিচলিত হয়ে পড়ি। তখন আমার সামনে দুটি পথ খােলা ছিল। এক: পশ্চিম পাকিস্তানকে হারানোের ঝুঁকি নেয়া অথবা দুই আমার সুনাম, আমার ক্যারিয়ার, আমার ভবিষ্যৎ ও পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর মহান ঐতিহ্যকে বিসর্জন দেয়া। পশ্চিম পাকিস্তান রক্ষায় প্রেসিডেন্টের নির্দেশে আমি শেষােক্ত পথই বেছে নেই। আমি চরম বিশৃঙ্খল ও সমস্যাসংকুল একটি দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলাম। দু’জন সিনিয়র জেনারেল বিভিন্ন অজুহাতে এ দায়িত্ব গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান। বিদ্রোহের আলামত স্পষ্ট হয়ে ওঠা মাত্র একজন পদত্যাগ করেন এবং আরেকজন পরিস্থিতিকে জটিল করে তােলেন। সেনাবাহিনীর এ তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ পদ গ্রহণ করার সময় সিনিয়রিটিতে আমি ছিলাম দ্বাদশ। তবু আমাকেই দায়িত্ব দেয়া হয়। এতে আমি আরাে বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠি। কিন্তু আমি আমার সম্মানকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে জাতীয় স্বার্থে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করি। যুদ্ধ জয়ের আনন্দে আত্মহারা ছিল তখন বাঙালিরা। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের পর তবু তাদের অনেকেই আমার কাছে এগিয়ে আসেন এবং বলেন, “আমরা নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায় আরাে প্রতিনিধিত্ব এবং উন্নয়নের জন্য আরাে বরাদ্দ চেয়েছিলাম। তবে এ ঘটনা আমরা চাইনি।” অনেকেই সত্যি সত্যি খুব মর্মাহত ও বেদনার্ত বলে মনে হয়েছে। কয়েক ঘণ্টা আগেও তারা আমাদের রক্তের জন্য পিপাসার্ত ছিল। কিন্তু মুহূর্তে তারা বদলে যায়। তাদের দেখে মনে হয়েছে, আমাদের প্রতি তাদের যেমন ঘৃণা রয়েছে তেমনি রয়েছে মমত্ববােধও। আমি তাদের বললাম, “বহু রক্ত ঝরেছে। এখন আর অনুতপ্ত হয়ে লাভ নেই। আমরা আমাদের নেতাদের দাবার ঘুটি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছি। নেতারা ক্ষমতায় যাবার জন্য রক্তপাতের পথ বেছে নিয়েছেন। রােমান সম্রাটরা যেভাবে মল্লযােদ্ধাদের লড়াই দেখতেন, আমাদের নেতারা ঠিক সেভাবে যুদ্ধক্ষেত্রের বাইরে দাঁড়িয়ে এ রক্তপাত দেখে তৃপ্ত হয়েছেন। যুদ্ধে ফলাফল যাই হােক, বিজয়ী হবেন তারাই।” আমি বাঙালিদের সাফল্য কামনা করি এবং আশা প্রকাশ করি যে, আমাদের কালে না হলেও আমাদের নাতি-পুতিদের কালে হলেও এ ক্ষত নিরাময় হবে এবং বন্ধুত্ব ও ভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে দুটি দেশের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে উঠবে।
সামরিক ও বেসামরিক সকল পাকিস্তানিদের সরিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয় ভারতীয় ও পাকিস্তানি প্রতিনিধি দলের মধ্যে ব্যাপক আলাপ-আলােচনার পর স্থির করা হয় যে, পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিদের ট্রেনযােগে ওয়াগাহ সীমান্তে নিয়ে যাওয়া হবে। আমি পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রথমে বেসামরিক লােকজন, তাদের পরে বেসামরিক সশস্ত্র বাহিনী ও পুলিশ এবং সবার পরে সশস্ত্র বাহিনীকে পাঠানাের নির্দেশ দেই। সব সৈন্য নিরাপদে ভারত সীমান্ত অতিক্রম করার পর তিন বাহিনীর সিনিয়র অফিসারগণ রওনা দেবেন। বেসামরিক লােকজনকে নিয়ে প্রথম ট্রেনটি এগিয়ে যেতে থাকে। হঠাৎ করে ট্রেনের গন্তব্যস্থল পরিবর্তন করা হয় এবং এলাহাবাদের দিকে ট্রেন যেতে থাকে আনন্দ হতাশায় পরিণত হয়। ভুট্টো নিঃশর্তভাবে শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দেন। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, মুজিব ছিলেন পাকিস্তানের হাতে একটি তুরুপের তাস শেখ মুজিব, পাকিস্তানের শিবিরে আটক হাজার হাজার বাঙালি সৈন্য, ভারতীয় যুদ্ধবন্দি এবং ভারতের স্পর্শ কাতর ভূখণ্ড ফিরােজপুর হেডওয়ার্কস পাকিস্তানের হাতে থাকায় ভারতের সঙ্গে যুদ্ধবন্দি বিনিময়ে পাকিস্তান ছিল একটি শক্তিশালী অবস্থানে। কিন্তু ভুট্টো কলমের এক খোচায় পাকিস্তানের এ শক্তিশালী অবস্থানকে তছনছ করে দেন। শেখ মুজিবকে মুক্তি দেয়ার পর পাকিস্তান দর কষাকষিতে দুর্বল অবস্থানে এসে দাঁড়ায়। ভুট্টো ছিলেন খুবই চতুর। কোন্ ঘটনা তাকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রত্যাবাসনে ব্যাঘাত ঘটায়? শেখ মুজিবকে ব্যবহার করে ভারত ও বাঙালিদের কাছ থেকে সর্বাধিক সুবিধা আদায়ের সুযােগ তার ছিল। তাছাড়া, তিনি আমাদের হাতে থাকলে আন্তর্জাতিক চাপে দ্রুত সংকট নিষ্পত্তিও হতে পারত। ভুট্টো কেন তাড়াহুড়াে করে মুজিবকে ছেড়ে দিতে গেলেন? ইরানের শাহ পাকিস্তানে আসার কথা ছিল। তিনি শেখ মুজিবকে ভবিষ্যতে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের একটি সম্পর্ক রাখার ব্যাপারে রাজি করানাের চেষ্টা করতেন। কিন্তু তাকে সে সুযােগ দেয়া হয় নি। শাহ পাকিস্তান এসে পৌছানাের আগেই মুজিবকে লন্ডনগামী বিমানে তুলে দেয়া হয়। | ‘অপদস্থ ইস্টার্ন কমান্ডের যুদ্ধবন্দিদের ভুট্টো দেশে ফিরিয়ে নেবেন, তবে অবিলম্বে নয়। এজন্য মুজিবকে কোনাে বােঝাপড়া ছাড়াই মুক্তি দেয়া হয়েছে এবং ভুট্টো সফলতার সঙ্গে রাজনৈতিক ব্যর্থতার দায় ইয়াহিয়া এবং সামরিক বিপর্যয়ের দায় নিয়াজির ওপর চাপিয়ে দেয়া নাগাদ যুদ্ধবন্দিদের ভারতেই থাকতে হবে।
(সৈয়দ আলম রাজা, ঢাকা ডেবাকেল পৃষ্ঠা-১১১)
ভুট্টো ইস্টার্ন কমান্ডের সৈন্য সংখ্যা ৪৫ হাজার থেকে বাড়িয়ে ৯৬ হাজার পর্যন্ত উল্লেখ করতেন এবং সিমলা চুক্তিতে এ সংখ্যা ১ লাখ বলে উল্লেখ করা হয়। ইতিহাসে একটি দেশের প্রেসিডেন্ট তার নিজ দেশের ভাগ্য বিড়ম্বিত সৈন্যদের সম্পর্কে এমন মিথ্যাচার করেছেন কিনা সন্দেহ। ভুট্টোর এ মিথ্যাচার গুল হাসান অথবা টিক্কা কেউই সংশােধন করেননি। ইস্টার্ন কমান্ডে পাকিস্তানের নিয়মিত বাহিনীর সৈন্যছিল মাত্র ৩৪ হাজার। রেঞ্জার্স, স্কাউট, মিলিশিয়া ও বেসামরিক পুলিশ মিলিয়ে আরাে ছিল ১১ হাজার। সব মিলিয়ে ইস্টার্ন কমান্ডে সশস্ত্র সদস্য ছিল ৪৫ হাজার। নৌ ও বিমান বাহিনীর সদস্য, ইস্টার্ন কমান্ডের সদর দপ্তর, সামরিক আইন প্রশাসকের কার্যালয়, ডিপাে, প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউট, ওয়ার্কশপ ও ফ্যাক্টরি প্রহরায় নিয়ােজিত ব্যক্তি, নার্স, মহিলা ডাক্তার, পাচক, ধােপা, নাপিতসহ হিসাব করলে এ সংখ্যা বড় জোর ৫৫ হাজারে পৌছে। কিন্তু কোনাে অবস্থাতেই ৯৬ হাজার অথবা ১ লাখ হয় না। ৪৫ হাজারের বাইরে যাদেরকে হিসাবে ধরা হয় তারা হচ্ছে বেসামরিক কর্মকর্তা, কর্মচারি এবং মহিলা ও শিশু। ভারতীয়রা যেখানে ইস্টার্ন কমান্ডে নিয়ােজিত তাদের সৈন্য সংখ্যা ১২ ডিভিশনের স্থলে ৮ ডিভিশন বলে উল্লেখ করছে, সেখানে ভুট্টো আমাদের সৈন্য সংখ্যাকে ৪৫ হাজার থেকে বাড়িয়ে ৯৬ হাজার বলে উল্লেখ করতেন। ইস্টার্ন কমান্ড ও এ কমান্ডের সৈন্যদের বিদ্রুপ করা যদি উদ্দেশ্য হয়ে থাকে তাহলে সে উদ্দেশ্য অর্জিত হয় নি। এটা গােটা জাতিকে বিদ্রুপ করার শামিল এবং ভারতীয় অপপ্রচারকে জোরদার করার একটি প্রচেষ্টা মাত্র। ভারতীয়রা দাবি করছে যে, তারা ৯৬ হাজার সৈন্যের একটি বিরাট বাহিনীকে পরাজিত করেছে। ভুট্টো ইস্টার্ন কমান্ডের সৈন্য সংখ্যা বাড়িয়ে বলে ভারতের দাবিকেই প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছেন। এটা মনে রাখতে হবে যে, পশ্চিম পাকিস্তানে প্রেসিডেন্ট ও সরকার প্রধান হিসেবে জেনারেল ইয়াহিয়া সকল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন, সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আবদুল হামিদ নয়। অন্যদিকে, পূর্ব পাকিস্তানে আমার হাই কমান্ড ও প্রাদেশিক সরকার আমাকে পরিত্যাগ করে। এজন্য বেসামরিক ও সামরিক উভয় বিষয়ে আমাকের একাই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। গভর্নর তখনাে তার পদে বহাল থাকলে প্রাদেশিক সরকার প্রধান ও প্রেসিডেন্টের প্রতিনিধি হিসেবে তাকেই আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করতে হতাে, সৈন্যদের কমান্ডার হিসেবে আমাকে নয়। পশ্চিম পাকিস্তানে ইয়াহিয়া প্রয়ােজনীয় সব দলিলে স্বাক্ষর করেছেন; ভারপ্রাপ্ত সি-ইন-সি হিসেবে সেনাবাহিনী প্রধান অথবা চিফ অভ জেনারেল স্টাফ নয়।
সেনাবাহিনীর যুদ্ধবন্দি ও বেসামরিক লােকজনকে ভারতের বিভিন্ন জায়গায় ক্যাম্পে নেয়া হয় লে. জেনারেল সগৎ সিং আমাকে জানান যে, ২০ ডিসেম্বর সিনিয়র অফিসারদের কলকাতা নেয়া হবে। তবে ভারতীয়রা রাও ফরমান আলীকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রেখে যেতে চেয়েছিল। ৫ জন গভর্নরের সামরিক উপদেষ্টা থাকায় প্রতিটি কাজ-কর্মে তার হাত ছিল এবং তিনি নির্বাচন পরিচালনা ও জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিতে চূড়ান্ত ভূমিকা পান করেছেন। বস্তুতপক্ষে, ফরমান ক্ষমতা হস্তান্তরে বাধা সৃষ্টিতে সহায়তা করেছিলেন। তার ভূমিকায় বাঙালিরা ক্রুদ্ধ হয়। ২৫ মার্চের সামরিক অভিযানের পরিকল্পনা ও পরিচালনায় তার বিরাট ভূমিকা ছিল। বাঙালিরা তাকে ক্ষমা করতে প্রস্তুত ছিল না। আমি তখন জোর দিয়ে বললাম যে, জেনারেল মানেকশ’র প্রদত্ত আশ্বাস অনুযায়ী কোনাে পাকিস্তানি সৈন্যকে তদন্তের জন্য ভারতীয়দের কাছে হস্তান্তর করা যাবে না। কথিত আচরণ সংক্রান্ত যে কোনাে তদন্ত রিপাের্ট সিদ্ধান্তের জন্য একটি পাকিস্তানি আদালতে পেশ করতে হবে। একইভাবে, গােয়েন্দা ও নিরাপত্তা সংস্থায় কর্মরত কোনাে কর্মকর্তাকেও আটক করার অনুমতি দেয়া হয় নি। আমাদের সঙ্গে আল-বদর ও আল-শামসের কয়েকজন সদস্যও ছিল। তারা যুদ্ধে আমাদের সহায়তা করেছে। এজন্য বাঙালিরা তাদের খুঁজছিল। আমাদেরকে কলকাতার পথে রওনা দিতে হবে ২০ ডিসেম্বর সকালে। আমি তাই আমার কমান্ড পােস্ট এলাকায় যাই। সেখানে গিয়ে দেখি যে, কয়েকজন পশ্চিম পাকিস্তানি বেসামরিক লােকজনকে জড়াে করা হয়েছে। আমি তখন তাদেরকে জানাই যে, প্রেসিডেন্টের নির্দেশে আমাদেরকে অস্ত্র সমর্পণ করতে হয়েছে। আমি আরাে বললাম যে, পশ্চিম পাকিস্তানকে রক্ষার জন্য প্রেসিডেন্ট এ নির্দেশ দিয়েছেন। আমি নিজে, মেজর জেনারেল ফরমান, অ্যাডমিরাল শরীফ, এয়ার কমােডর ইনামুল হক, ব্রিগেডিয়ার বাকির সিদ্দিকী, ব্রিগেডিয়ার এসএস কাসিম, আমাদের এডিসি ও ব্যাটম্যানগণ ক্যারিবু হেলিকপ্টারে কলকাতার উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করি। আমি ফরমানের এডিসি পরিচয় দিয়ে আমার পিআরও মেজর সিদ্দিক সালিমকেও সঙ্গে নেই। বাঙালি ও ভারতীয় উভয়েই তাকে খুঁজছিল আমি তাকে তাদের হাতে ছেড়ে দিতে চাই নি। বাংলাদেশের সামরিক গভর্নর লে. জেনারেল সগৎ সিং ঢাকা বিমান বন্দরে আমাদের বিদায় জানান। আমরা কলকাতা দমদম বিমান বন্দরে। অবতরণ করি। হেলিপ্যাড থেকে দুটি স্টাফ গাড়ি আমাদের নিয়ে ফোর্ট উইলিয়ামে আমাদের আবাসিক কোয়ার্টারের উদ্দেশে যাত্রা করে।
আমাদের আবাসিক কোয়ার্টারটি ছিল একটি নবনির্মিত তিন তলা ভবন। বেশ পরিচ্ছন্ন, সাজানাে-গােছানাে। একটি কক্ষকে ডাইনিংরুমে পরিণত করা হয়। এখানে সকল অফিসারগণ খাওয়া-দাওয়া করতেন। আমাদেরকে সিপাহীর রেশন দেয়া হতাে। ভারতীয় পাচকরা রান্না করত। তবে পরিবেশন করতে আমাদের নিজস্ব আর্দালি। ব্যায়াম, বই পড়া ও রেডিও শােনা প্রভৃতি সময় কাটানাের নিয়মিত রেওয়াজে পরিণত হয়। আমরা রেডিওতে শুনতে পেলাম যে, ভুট্টো দেশের দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন। ফরমান রেডিওতে এ সংবাদ শুনে মন্তব্য করল, যে। কিছুদিন বিলম্বে অ্যুথান ঘটেছে। কিছুক্ষণ পর মেজর জেনারেল নজর, মেজর জেনারেল এম, এইচ, আনসারী ও মেজর জেনারেল কাজী মজিদ আমাদের সঙ্গে যােগ দেন। মেজর জেনারেল জামশেদ তখনাে এসে পৌছান নি। কর্নেল খারা কলকাতায় আমাদের দেখাশােনা করতেন। উদ্বিগ্ন হয়ে তার কাছে জামশেদ সম্পর্কে জানতে চাই। তিনি তখন আমাকে জানান যে, জামশেদ প্রশাসনিক বিষয়াদিতে সহায়তা করার জন্য এখনাে ঢাকা রয়েছেন। তিনি সুস্থ আছেন এবং উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনাে কারণ নেই। আমি পরে জানতে পারি যে, তিনি ঢাকায় নেই। কলকাতায় একটি নির্জন সেলে আটক রয়েছেন। আমার অনুমতি ছাড়া তাকে কারাগারে নেয়া হয়।
যুদ্ধবন্দি শিবির নং ১০০
আমাদেরকে কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম থেকে জব্বলপুরে ১শ’ নম্বর শিবিরে নেয়া হয়। এ শিবিরটি জেনারেলদের শিবির হিসেবে পরিচিত ছিল। আমাদের ব্যাটম্যানগণ আমাদের সঙ্গেই রইল। কিন্তু আমাদের এডিসিদের জন্য আরেকটি জায়গায় সরিয়ে নেয়া হয়। ব্রিগেডিয়ার বাকির সিদ্দিকী ও ব্রিগেডিয়ার কাসিমকে বেরিলিতে এবং মেজর সিদ্দিক সালিককে এডিসিদের সঙ্গে স্থানান্তর করা হয়। ফরমানের ওপর আবার শ্যেনদৃষ্টি পড়ে। ভারতীয়রা তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করতে চাইল। আমি কর্নেল খারাকে ডেকে পাঠালাম এবং কড়া ভাষায় তার কাছে প্রতিবাদ জানাই। আমি তাকে বললাম যে, জেনেভা কনভেনশন ও ঢাকা সমঝােতার আলােকে ফরমানকে আটক ভারতীয় প্রস্তাব চুক্তির একটি সুস্পষ্ট লংঘন এবং এতে জিজ্ঞাসাবাদের নামে প্রতিশােধ গ্রহণ ও হয়রানির আশঙ্কা রয়েছে। খারা আমাকে জানান যে, মুজিব মুক্তি পাবার পর বাঙালিরা ফরমানকে তাদের হাতে হস্তান্তরের জন্য প্রবলভাবে দাবি করছে। বাঙালি স্বার্থের বিরুদ্ধে বাড়াবাড়ি করায় তারা যুদ্ধাপরাধী হিসেবে তার বিচার করতে চায়। ১৪ ডিসেম্বর ফরমানের অফিস থেকে উদ্ধারকৃত ডায়েরির কথাও তিনি উল্লেখ করেন। এ ডায়েরিতে ফরমান নিজ হাতে লিখেছিলেন, “শ্যামল মাটিকে রক্তে লাল করে দেয়া হবে।” আমি পাকিস্তানে ফিরে আসার পর ভুট্টোর সঙ্গে এক সাক্ষাকারকালে তিনি আমাকে এ ডায়েরি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলেন। | ফরমান দাবি করেছেন যে, তিনি শক্তি প্রয়ােগের বিরােধিতা করেছেন। কিন্তু ২৫ মার্চের সামরিক অভিযানের পরিকল্পনা ও পরিচালনায় তার সক্রিয় সংশ্লিষ্টতা থেকে বােঝা যাচ্ছে যে, তিনি শক্তি প্রয়ােগের বিরােধিতা করেন নি। ফরমান কখন সরকারি নীতির সঙ্গে দ্বিমত পােষণ করেন নি। সুতরাং আমরা একথা বলতে বাধ্য যে, তিনি সরকারি নীতি ও কার্যক্রমকে সমর্থন করেছেন। তাকে পূর্ব পাকিস্তান সম্পর্কে একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে বিচেনা করা হতাে। সরকার তার মতামতের মূল্য দিত এবং তার পরামর্শ ও সুপারিশ অনুযায়ী কাজ করতাে। পূর্ব পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হওয়ার দায় থেকে তিনি নিজেকে কখনাে মুক্ত করতে পারবেন না।
আমি ভারতীয়দের বােঝানাের চেষ্টা করলাম যে, ২৫ মার্চ অথবা কথিত বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডে ফরমানের সংশ্লিষ্টতা সত্ত্বেও চুক্তি অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে কোনাে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় না। পাকিস্তান সরকারই তার ভাগ্যের ফয়সালা করবে। আমি জেনারেল অরােরাকে তার প্রতিশ্রুতি রক্ষার বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য কর্নেল খারাকে অনুরােধ করি। খারা চলে গেলেন। তিনি কয়েক ঘণ্টা পর আবার ফিরে এসে জানান যে, ফরমানকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নেয়া হচ্ছে না। আমি ফরমানকে একথা জানানাের পর তিনি ভীষণ খুশি হন এবং আমার ভূয়সী প্রশংসা করেন। তিনি বললেন, ‘স্যার, আমাকে সাহায্য করায় আমি আপনার প্রতি গভীরভাবে কৃতজ্ঞ। আশা করি, আমরা পাকিস্তানে ফিরে যাবার পর আপনি আমাকে এভাবেই সাহায্য করবেন।’ আমি প্রতিশ্রুতি দেই। তবে আমি ঘূর্ণাক্ষরেও জানতাম না যে, পাকিস্তানে ফিরে যাবার পর তাকে পুরস্কৃত করা হবে। পাকিস্তানে তার আমার সাহায্যের প্রয়ােজন হয় নি। যে লােকটি তার দেশ ও সেনাবাহিনীকে অবর্ণনীয় দুর্দশায় ফেলেছে সেই লােকটিকেই বিপুলভাবে পুরস্কৃত করা হয়। প্রথমে তাকে জেনারেল হেড কোয়াটার্সে চাকরি দেয়া হয় এবং তরে তাকে ফেীজি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান করা হয়। আরাে পরে তিনি মন্ত্রীও হয়েছিলেন। ভারতীয় সেনাবাহিনীর কয়েকটি ইউনিটের ব্যাচেলর কোয়ার্টারে আমাদের থাকার জায়গা হয় প্রত্যেক অফিসারকে একটি করে কোয়ার্টার দেয়া হয়। প্রতিটি কোয়ার্টারে ছিল একটি বেডরুম, পাশে বাথরুম এবং একটি বৈঠকখানা। সামনে একটি বারান্দাও ছিল। ভবনটি সদ্য নির্মাণ করা হয়েছে এবং সাজ-সজ্জা ছিল। চমৎকার। বাড়তি ছিল কিছু রুম। আমরা এসব রুমের একটিকে মসজিদ, আরেকটিকে মেস বানানাের এবং আরেকটি কোয়ার্টার আমাদের চাকর-বাকরদের থাকার জন্য ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেই। খাবার ছিল একঘেয়ে। ভাত, চাপাতি, শাক-সবজি, ডাল এবং মাঝে মাঝে মাংস। আমাদের শিবির ঘেরাও করে রাখা হয় প্রায় ৫০ গজ উচু কাঁটাতারের বেড়া। দিয়ে যাতে কেউ ভেতরে প্রবেশ অথবা ভেতর থেকে বের হতে না পারে। শিবিরের চার কোণায় ৪টি ত্রিশ ফুট উঁচু প্রহরা চৌকি ছিল। ওগুলােতে সার্চলাইট ছিল এবং রাত হলেই চারদিকে আলাে করে এগুলাে জ্বলে উঠতাে। একজন টহলদার পাঞ্জাবি সৈন্য একটি এ্যালসেশিয়ান কুকুর সঙ্গে নিয়ে চব্বিশ ঘণ্টা শিবির এলাকায় টহল দিত। এটা ছিল ভেতরের নিরাপত্তা ব্যুহ। বাইরে আকেটি নিরাপত্তা ব্যুহ ছিল। তাতেও এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য মােতায়েন করা হয়। এভাবে নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়।
জেনারেল জামশেদ কিছুদিন পর আমাদের সঙ্গে যােগ দেন। আমাদের এডিসি ও দু’জন ব্রিগেডিয়ার ছাড়া কলকাতায় আমরা যারা একসঙ্গে ছিলাম তারা আবার এখানে একত্রিতই হই ।প্রশাসনিক ও অন্যান্য বিষয়ের জন্য আমাদের শিবির সরাসরি একজন স্টেশন কমান্ডারের আওতায় ন্যস্ত করা হয়। স্টেশন কমান্ডার ছিলেন মেজর জেনারেল পদ্ম। শিখ ক্যাভালরি অফিসার জেনারেল পদ্ম ছিলেন খুবই স্মার্ট, বুদ্ধিমান ও সহানুভূতিশীল। তার মর্যাদাপূর্ণ আচার-আচরণে আমাদের কাছে বন্দিশালার পরিবেশও সহনীয় ও বন্ধুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। শিবিরের কমান্ডার ছিলেন একজন মেজর। মেডিকেল কোরের একজন ক্যাপ্টেন শিবিরের প্রয়ােজনীয় চিকিত্সা সামগ্রী সরবরাহ করতেন। চিকিৎসার পর্যাপ্ত সুযােগ ছিল এবং কেউ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে জব্বলপুর সিএমইচ-এ পাঠানাে হতাে। আমাদের কেউ কেউ জব্বলপুর সিএমএইচ-এ গিয়েছেন। তবে কেউ কখনাে ভর্তি হন নি অথবা সেখানে। অবস্থান করেন নি। মােট কথা, শিবিরের স্টাফদের ব্যবহার ছিল চমৎকার এবং তাদের আচরণ ও কথাবার্তায় কখনাে ঔদ্ধত্য ও বাড়াবাড়ি প্রকাশ পায় নি। আমরা রুটিনমাফিক জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ি কিছুদিন অতিবাহিত হওয়ার পর। বিপদে ও দুঃসময়ে আল্লাহকে মানুষ বেশি স্মরণ করে। তাই আমরা নিয়মিত নামাজ আদায় করতাম। জেনারেল আনসারী নামাজে ইমামতি করতেন। বন্দি হওয়ার আগেও আমি নিয়মিত নামাজ পড়তাম। তবে বন্দি জীবনে আমি নামাজ ও কোরআন তেলােয়াতে পুরােপুরি আত্মনিবেদেন করার সুযােগ পাই। আমরা রুমে ব্যায়াম করতাম এবং শিবির চত্বরে হাঁটাহাঁটি করতাম। এতে আমাদের উদ্বেগ কিছুটা প্রশমিত হতাে। আমরা প্রচুর বই-পত্র ও ম্যাগাজিন পড়তাম। এগুলাে হয় কিনতে হতাে নয়তাে স্টেশনের লাইব্রেরি থেকে ভাড়া করে আনতে হতাে। নিয়মিত দৈনিক পত্রিকাও পড়তাম। পত্রিকা পড়ে আমরা বর্তমান পরিস্থিতি এবং বিশ্বের নানা খরব জানতে পারতাম। সময় যেমন কাটতেই চাইত না। নগদ টাকার পরিবর্তে টোকেন দেয়া হত আমাদেরকে। প্রতি মাসে আমি বেতন হিসেবে ১৪০ রুপি পেতাম । এ অর্থ ছিল খুবই সামান্য। কিন্তু ভাগ্য বিড়ম্বিত জীবনে। এ সামান্য অর্থ বিরাট উপকারে আসত। আমরা এ অর্থ দিয়ে বই-পুস্তক, লেখার উপকরণ ও খাবার-দাবার কিনে খেতাম। আমাদের কেনাকাটার জন্য একজন ভারতীয় হাবিলদারকে নিযুক্ত করা হয়। এ হাবিলদার প্রতিদিন আমাদের কাছে আসত এবং বাজার থেকে আমাদের যা কিছু প্রয়ােজন হতাে সেগুলাে সে কিনে আমাদের কাছে পৌছে দিত।
বন্দিত্তের মেয়াদ বাড়তে থাকে এবং আশু মুক্তির কোনাে সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছিলাম না । নিকটাত্মীয় ও বন্ধুবান্ধব থেকে দূরে থাকায় চিঠিপত্রই ছিল তাদের সঙ্গে যােগাযােগ রক্ষার একমাত্র উপায়। আমরা চিঠি পেলে এবং চিঠি লিখে খুবই সান্ত্বনা পেতাম। আপনজনদের কাছ থেকে পাওয়া চিঠি পড়ে যে আনন্দ পেতাম। তার সঙ্গে অন্য কোনাে আনন্দের তুলনা খুঁজে পেতাম না। এসব চিঠিতে থাকতাে সান্ত্বনা ও ভালােবাসার পরশ। তাই চিঠিগুলাে বার বার পড়তাম। প্রথমদিকে ভারতীয়রা আমাদেরকে লেখার উপকরণ সরবরাহ করত। কিন্তু পরে এ সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেলে গাঁটের পয়সা দিয়ে আমাদেরকেই এগুলাে নিতে হতাে। প্রতিদিনই আমাদের চিঠিপত্র সংগ্রহ করা হতাে এবং আমরা চিঠি পাবার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম। চিঠিগুলাে সেন্সর করা হতাে এবং মাঝে মধ্যে চিঠির মূল কথাও কেটে বাদ দেয়া হতাে। আমি প্রচুর চিঠি পেয়েছি। কোনাে কোনােটি ছিল তিক্ত এবং কোনাে কোনােটি ছিল উৎসাহব্যাঞ্জক। উৎসাহব্যাঞ্জক চিঠিগুলাে আমাকে সাহস ও দৃঢ়তার সঙ্গে বন্দি জীবনের দুর্বিষহ যন্ত্রণা মােকাবেলা করার প্রেরণা যােগাতাে। আমি সংক্ষিপ্ত করে হলেও প্রতিটি চিঠির উত্তর পাঠাতাম। বিদেশ থেকেও খাদ্যদ্রব্য, উপহার সামগ্রী ও চিঠি আসতাে। পার্সেলগুলাের মধ্যে থাকতাে।
চকোলেট, টফি, শেভ করার সাজ-সরঞ্জাম, সুগন্ধি প্রভৃতি। পাকিস্তান ও বিদেশ থেকে চিঠিপত্রের মাধ্যমে সান্ত্বনা ও উৎসাহ না পেলে ভারতে আড়াই বছরের বন্দি জীবন হতাে দোযখের মতাে। ভারতীয় কূটনীতিক ও ভারতপন্থী মুসলমানরা অন্যান্য শিবিরে উদ্দেশ্যমূলক প্রচারণা চালাচ্ছিল। জুনিয়র পাকিস্তানি অফিসারগণ এসব প্রচারণাকে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করে। আমাদের অফিসারগণ বৈরি মনােভাব প্রদর্শন করায় ভারতীয়দের পক্ষে তাদের মগজধােলাই করা সম্ভব হয়নি। আমাদের সৈন্যরাও একই মনােভাব প্রদর্শন করে। তাই আমাদের মাঝে ভারতীয়দের পক্ষে গােয়েন্দাগিরি করার লােক তৈরি করা সম্ভব হয় নি। ভারতীয় কর্মকর্তা ও রেডক্রসের প্রতিনিধিগণ আমাদের শিবির পরিদর্শন করতে আসতেন। তবে ভারতীয় কর্মকর্তাদের সফর আমাদের কাছে স্বস্তিদায়ক না হলেও রেডক্রস প্রতিনিধি দলের সফর ছিল আমাদের কাছে আশীর্বাদস্বরূপ রেডক্রস প্রতিনিধি দল ভারতীয়দের সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ আচরণ করতেন এবং পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিদের ওপর ভারতীয়রা কোনাে জুলুম বা বাড়াবাড়ি করছে কিনা সে বিষয়ে লক্ষ্য রাখতেন। তাদের কাছে কোনাে অভিযােগ করা হলে তারা সঙ্গে সঙ্গে তার প্রতিকার করতেন তারা বন্দি জীবনে পাকিস্তানি সৈন্যদের আচরণের প্রশংসা করেছেন। এক পর্যায়ে ভারতীয়রা শিবিরের চারদিকে একটি দেয়াল তৈরি করতে শুরু করে। আমি প্রতিবাদ জানাই। কিন্তু আমাকে জানানাে হয় যে, আমার নিরাপত্তার জন্যই এ দেয়াল নির্মাণ করা হচ্ছে। জেনারেল পদ্ম আমাকে জানান যে, পাকিস্তান সরকার আমাকে হত্যা করার জন্য দু’জন ঘাতক পাঠিয়েছে। কলকাতায় জামশেদ নামে একজন পাকিস্তানিকে ভারতীয় গােয়েন্দারা আটক করেছে। জামশেদ স্বীকার করেছে যে, আমাকে হত্যা করার জন্য তাকে এবং আরাে একজনকে পাঠানাে হয়েছে। এজন্য ভারতের জেনারেল হেড কোয়ার্টার্স আমার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য নিরপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণে জেনারেল পদ্মকে নির্দেশ দিয়েছে। শিবিরের চারদিকে ছিল প্রচুর গণ ঝােপ-ঝাড়।
এগুলাের আড়ালে যে কোনাে ব্যক্তি টেলিস্কোপিক রাইফেল নিয়ে লুকিয়ে থাকতে পারে। এ দেয়াল নির্মাণের পর আমি বাইরে বের হওয়া মাত্র শিবিরের বাইরের কয়েকটি চৌকিকে সতর্ক করে দেয়া হতাে এবং সৈন্যরা পরিখায় প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান গ্রহণ করত সশস্ত্র টহল দল প্রতিদিন ভােরে শিবিরের আশপাশের এলাকায় অনুসন্ধান চালাতাে। লাহােরে ফিরে আসার পরও দু’বার আমার প্রাণনাশের চেষ্টা করা হয়। মেজর জেনারেল শাহ বেগ সিংকে মেজর জেনারেল পদ্মর স্থলাভিষিক্ত করা হয়। শাহ বেগ ব্রিগেডিয়ার থাকাকালে ঢাকায় তার সঙ্গে আমার দেখা হয়। তিনি ছিলেন খুবই বন্ধুবৎসল এবং তিনি হিন্দুদের বিরুদ্ধে তার ঘৃণা প্রকাশ করেন। তিনি খােলাখুলি অভিযােগ করে যে, শিখদেরকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক করে রাখা হয়েছে এবং তাদেরকে এমনভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা হয়েছে যেন তারা পূর্ব পাঞ্জাবেও সংখ্যাগরিষ্ঠ হতে না পারে। প্রথম মনে হয়েছিল যে, তিনি আমার সঙ্গে চাতুরি করেছেন। কিন্তু পরে আমি বিশ্বাস করি যে, তিনি যা বলেছেন তাতে কোনাে খাদ ছিল না। তিনি আমাকে খালিস্তানসহ গােটা পাঞ্জাবের একটি মানচিত্র দেখান। জেনারেল শাহ বেগ সিং অমৃতসরে স্বর্ণমন্দিরে ভারতীয় সৈন্যদের অভিযানে সন্ত ভিন্দ্রানওয়ালের সঙ্গে নিহত হন ইতােমধ্যে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতেও বেশকিছু পরিবর্তন ঘটে। লে. জেনারেল গুল হাসানকে সেনাবাহিনী প্রধান করা হয় যদিও তাকে পদোন্নতি দেয়া হয়েছিল। তার সিনিয়র সকল জেনারেল অবসর গ্রহণের আবেদন করেন।
শুধুমাত্র গুল হাসানের সিনিয়র টিক্কা খান তার অধীনে কাজ করার জন্য রয়ে গেলেন। এটা এক নজিরবিহীন ঘটনা। মনে রাখা প্রয়ােজন যে, গুল হাসান পূর্ব পাকিস্তানের দায়িত্ব গ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন এবং চিফ অভ জেনারেল স্টাফ হিসেবেও তার ভূমিকা সন্তোষজনক ছিল না। তিনি ইস্টার্ন কমান্ডে একটি প্রতারণাপূর্ণ বার্তা পাঠিয়েছিলেন। এবং জেনারেল ইয়াহিয়াকে পরিস্থিতি সম্পর্কে একটি ভুল ধারণা দিয়েছিলেন। শাহ বেগ আমাকে জানিয়েছিলেন যে, ভারতীয় গােয়েন্দা সংস্থার মতে এটা একটি অস্থায়ী ব্যবস্থা এবং টিক্কা খানকে পরবর্তীতে গুল হাসানের স্থলাভিষিক্ত করা হবে। আমি তার কথা বিশ্বাস করি নি, কারণ গুল হাসান ভুট্টোকে ক্ষমতায় আসতে সহায়তা করেছেন। কিন্তু ভারতীয়দের ধারণা কত সঠিক! এ থেকে এটাই প্রতীয়মান হচ্ছে যে, পাকিস্তানি নাগরিকরা যতটুকু ভেতরে যেতে না পারে ভারতীয়রা তার চেয়েও বেশি ভেতরে ঢােকার ক্ষমতা রাখে। দৃশ্যত তারা ভুট্টোর অভিপ্রায় সম্পর্কে সচেতন ছিল, কারণ বিশ্বাসঘাতকদের বিশ্বাসঘাতকতায় যারা লাভবান হয় তারাও বিশ্বাসঘাতকদের বিশ্বাস করে না। ভুট্টো গুল হাসানের বিশ্বাসঘাতকতাপূর্ণ কার্যকলাপে লাভবান হয়েছিলেন এবং তার এসব কার্যকলাপ সম্পর্কে জ্ঞাত ছিলেন। তাই ভুট্টো একজন বিশ্বাসঘাতক সবসময়ই বিশ্বাসঘাতক”-এই বহুল প্রচলিত প্রবাদ অনুযায়ী কাজ করেন। সেনাবাহিনী প্রধান। হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের কিছুদিন পরই অত্যন্ত অসম্মানজনকভাবে গুল হাসানকে সেনাবাহিনী থেকে বিদায় করে দেয়া হয়।
সূত্র : দ্য বিট্রেয়াল অভ ইস্ট পাকিস্তান – লে. জে. এ. এ. কে. নিয়াজি (অনুবাদ)