You dont have javascript enabled! Please enable it! 1969.02.23 | প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের সিদ্ধান্ত | দৈনিক পাকিস্তান - সংগ্রামের নোটবুক

সম্পাদকীয়
দৈনিক পাকিস্তান
২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯
প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্ত

গত একুশে ফেব্রুয়ারী এক বিশেষ বেতার ভাষণে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ঘোষণা করিয়াছেন, আগামী নির্বাচনে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করিবেন না। তিনি বলিয়াছেন, এই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত এবং অপরিবর্তনীয় প্রেসিডেন্টের এই সিদ্ধান্ত পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাসে অনন্য, নজীরবিহীন। রাষ্ট্র পরিচালনায় দশ বৎসর সক্রিয় ভূমিকা পালন করার পর প্রেসিডেন্ট স্বেচ্ছায় রাজনীতি হইতে দূরে সরিয়া দাঁড়াইতে মনস্থ করিয়াছেন। স্পষ্টতঃ দেশের স্বার্থ এবং জাতির ভবিষ্যতকে তিনি দলগত এবং ব্যক্তিগত অভিরুচির উপর স্থান দিয়াছেন। প্রেসিডেন্টের এই বলিষ্ঠ সিদ্ধান্ত বিরোধী মহলেও অভিনন্দন লাভ করিয়াছে।
দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্তের তাৎপর্য অপরিসীম। গত কয়েক মাস ব্যাপী প্রাপ্ত গণবিক্ষোভের ফল যে সব আভ্যন্তরীণ সমস্যা স্পষ্টভাবে জাতির সামনে উঠিয়া আসিয়াছে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সে সব সমাধানের আন্তরিক আগ্রহ প্রেসিডেন্টের বিশেষ বেতার ভাষণের মধ্যে নিহিত। দেশের রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনকল্পে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব গত ১৭ই ফেব্রুয়ারী সর্বদলীয় বৈঠক আহ্বান করিয়াছিলেন। ডাক- নেতাদের দাবীর পরিপ্রেক্ষিতে বৈঠকের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সরকার জরুরী অবস্থার অবসান ঘোষণা করিয়াছেন এবং দেশরক্ষা আইনে ধৃত রাজবন্দীদের মুক্তি দেওয়া হইয়াছে। গণতান্ত্রিক সংগ্রাম কমিটির অঙ্গদলগুলি প্রেসিডেন্টের এই আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন। কিন্তু শেখ মুজিবর রহমান, মাওলানা ভাসানী, জনাব ভুট্টো, এয়ার মার্শাল আসগর খান, জেনারেল আজম এবং জাস্টিস মুরশিদ বিভিন্ন প্রশ্নে এই বৈঠকে যোগদান করিতে অসম্মতি জ্ঞাপন করেন। নেতৃবর্গ যে সব দাবী উত্থাপন করেন সেগুলির মধ্যে ছিল ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার’, ছাত্র সমাজের ১১-দফা এবং অন্যান্য বিষয়। সরকার গতকাল এই মামলা প্রত্যাহার করিয়া লইয়াছেন। আলোচনা বৈঠক অনুষ্ঠানের জন্য প্রেসিডেন্ট আইয়ুব প্রতিবন্ধকতা সমূহ দূর করিতে সচেষ্ট হইয়াছেন। আগামী নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট কর্তৃক অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত এই প্রচেষ্টাকে বিশেষ আন্তরিকতা দান করিয়াছে।
আমরা আশা করি, দেশের সামনে যে রাজনৈতিক সঙ্কট উপস্থিত হইয়াছে তাহা নিরসনকল্পে দলমত নির্বিশেষ সকল নেতাই উদ্যোগ গ্রহণ করিবেন। গত কয়েক মাস ধরিয়া সারা দেশ অশান্ত। ছাত্র বিক্ষোভ ও গণ- বিক্ষোভ দেশের এক প্রান্ত হইতে অপরপ্রান্ত পর্যন্ত কাঁপাইয়া তুলিয়াছে। ছাত্র সমাজ, কৃষক, শ্রমিক বুদ্ধিজীবী এক কথায় দেশের সকল স্তরের মানুষ আন্দোলনে শরীক হইয়াছে। লাঠি, গুলি বর্ষণ, কারফিউ, অগ্নি সংযোগ, ঘেরাও প্রভৃতি ঘটনা নিত্য নৈমিত্তিক হইয়া দাঁড়াইয়াছে। এই সময়ের মধ্যে বহু অমূল্য জীবন নষ্ট হইয়াছে, বহু সম্পত্তির ক্ষতি সাধিত হইয়াছে এবং সর্বোপরি সৃষ্টি হইয়াছে এক সার্বিক সংশয়ের আবহাওয়া। এই পরিস্থিতি কোনক্রমেই কাহারও কাম্য হইতে পারে না।
বর্তমান পরিস্থিতির মধ্য দিয়া সকলের জন্য যে রাজনৈতিক শিক্ষা সুস্পষ্ট হইয়া উঠিয়াছে তাহা হইল, গণ-অসন্তোষ এবং জনমনের বিক্ষোভকে পাশ কাটাইয়া দেশে স্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করা অসম্ভব কাজ। সভা, শোভাযাত্রা, বিক্ষোভ ও ধর্মঘট এ-কথা প্রমাণ করিয়াছে যে জনগণ যেমন গণতান্ত্রিক অধিকার কামনা করেন তেমনি সমাজের বিভিন্ন স্তরে দানা বাধিয়া উঠা অর্থনৈতিক বৈষম্যেরও অবসান চাহেন। কাজেই আমরা আশা করি নেতৃবৃন্দ গোড়া ধরিয়া সকল সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণ করিবেন। এই জন্য সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তিত দৃষ্টিভঙ্গী এবং উদার মনোভাব লইয়া অগ্রসর হইবার প্রয়োজনীয়তা রহিয়াছে। শাসক ও শাসিতের চিরাচরিত মনোভাব পরিত্যাগ করিয়া আজ গণমুখী দৃষ্টিভঙ্গী লইয়া বিচার করিতে হইবে মানুষ কি চায়, এবং কেন বিক্ষোভ প্রদর্শন করিতেছে। দেশের সকল স্তরের মানুষের ভাগ্যকে স্পর্শ না করিলে কোন পরিবর্তনই দেশে স্থায়ী শান্তিপূর্ণ আবহাওয়া সৃষ্টি করিতে পারিবে না। বর্তমানের ব্যাপক গণ আন্দোলন এই শিক্ষাই তুলিয়া ধরিয়াছে যে সাধারণ মানুষ সন্তুষ্ট না হইলে, তাহাদের অভাব অভিযোগ দূর না হইলে নতুনভাবে অশান্তি সৃষ্টি হইবে। এবং তাহার মাত্রা এখনকার সকল কিছুকে ছাড়াইয়া যাইতে পারে।
আমরা মনে করি, প্রস্তাবিত আলোচনা বৈঠকের সাফল্যের জন্য সকল দলমতের প্রতিনিধিদের উপস্থিতি একান্তভাবে প্রয়োজন। আন্দোলনের মাধ্যমে জনগণ তাহাদের ইচ্ছা ব্যক্ত করিয়াছেন। ইহার পরিপ্রেক্ষিতে নেতৃবৃন্দ যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন বলিয়া আমরা আশা করি। দেশের মানুষ আত্মত্যাগের বিনিময়ে নিজেদের দাবী-দাওয়া সকলের সামনে তুলিয়া ধরিয়াছেন। ছাত্র সমাজ এই আন্দোলনে পালন করিয়াছে অগ্রণী ভূমিকা। বর্তমান পরিস্থিতি জনগণের সার্বভৌমত্ব-নতুন করিয়া তুলিয়া ধরিয়াছে। প্রেসিডেন্টের ঐতিহাসিক ভাষণের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা আশা করি, দেশে স্বাভাবিক অবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে।

সুত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু: পঞ্চম খণ্ড ॥ ষাটের দশক ॥ চতুর্থ পর্ব ॥ ১৯৬৯