You dont have javascript enabled! Please enable it!

পরিকল্পিত বিপর্যয়

পূর্ব পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন করে দেয়ার ক্রমাগত ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত প্রকাশ করার কোনাে ইচ্ছা আমার নেই। আমি অবশ্যই বলব যে, দেশ শাসন ও নীতি-নির্ধারণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের বৈধ অধিকার থেকে পূর্ব পাকিস্তানিদের বঞ্চিত করা ছিল পাকিস্তানের সকল শাসকের একটি অভিন্ন নীতি। সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের শাসন করার গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অনুযায়ী ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল মেনে নেয়া হলে। পাকিস্তান ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারত। ঐ নির্বাচনে মুজিবের বিজয়ে ইয়াহিয়া ও ভুট্টো নাখােশ হন। কারণ নির্বাচনের পর এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, ইয়াহিয়াকে প্রেসিডেন্ট পদ ছাড়তে হবে এবং ভুট্টোকে বসতে হবে বিরােধী দলীয় নেতার আসনে যা তার আকাক্ষার পরিপন্থি। তাই ইয়াহিয়া ও ভুট্টো এক হন এবং ভুট্টোর নিজ শহর লারকানায় উভয়ে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। এ ষড়যন্ত্র ‘লারকানা ষড়যন্ত্র’ হিসেবে পরিচিত। এম, এম, আহমেদ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য এ ষড়যন্ত্র করা হয়। অনির্দিষ্টকালের জন্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত এবং কূটবুদ্ধি, হুমকি, চক্রান্ত ও সামরিক শক্তি প্রযােগের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে বাধা সৃষ্টি করা ছিল এম. এ. আহমেদ পরিকল্পনার লক্ষ্য। এ লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য পূর্ব পাকিস্তানকে একটি উত্তাধিকারী সরকারবিহীন অবস্থায় পরিত্যাগের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন শুরু হওয়ার তারিখ ঘােষণা করার পর মেজর জেনারেল ওমর এ আধবেশন বর্জন করার জন্য রাজনীতিকদের ওপর চাপ প্রয়ােগ করতে থাকেন। তিনি অধিবেশন বর্জনের যুক্তি হিসেবে বলতেন যে, পূর্ব পাকিস্তান আন্তর্জাতিক চক্রান্তকারীদের এটি আখড়ায় পরিণত হয়েছে। সুতরাং পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে দিতে হবে। শেষ টায় পােলিশ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় পূর্ব পাকিস্তান পরিত্যাগে তার পরিকল্পনা সফল হয়। মি. সাজ্জাদ হায়দার তখণ ভারতে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত রাশিয়া ও ভারত ১৯৭১ সালের আগস্টে প্রতিরক্ষা চুক্তি করার পর তিনি পাকিস্তান সরকারকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেছিলেন যে, ভারত তার মিত্র রাশিয়ার সহায়তায় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং ইস্টার্ন গ্যারিসনকে গ্রাস করার জন্য বিপুল সৈন্য সমাবেশ ঘটাচ্ছে।

মি. হায়দার এ হুশিয়ারি দেয়ার পর তাকে অযথা ভীতি ছড়াতে নিষেধ করা হয়। এরপর তিনি ভারতীয়দের ইচ্ছে সম্পর্কে রিপাের্ট পাঠাতে শুরু করলে তাকে তুরস্কে বদলি করা হয়। আমি এম, এম, আহমেদ পরিকল্পনার বিষয়বস্তু জানতে পারি পূর্ব পাকিস্তানের তদানীন্তন চিফ সেক্রেটারি জনাব মােজাফফর হােসেনের কাছ থেকে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের পর তাকে গভর্নর হাউস থেকে সরিয়ে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে আসা হয় । প্রচণ্ড রাগে ও ক্ষোভে তিনি বলে ফেলেন যে, শেষ পর্যন্ত এম, এম, পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলাে। প্রবীণ রাজনীতিক জাফর আহমেদ আনসারী আমার সঙ্গে এক বৈঠকে এ ধরনের একটি পরিকল্পনার অস্তিত্ব ছিল বলে স্বীকার করেন। জনাব এম, এম. আহমেদের এক ডজন পরিকল্পনার মধ্য থেকে এ পরিকল্পনা বেছে নেয়া হয়। এ পরিকল্পনার লক্ষ্য ছিল ইয়াহিয়াকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পদে অধিষ্ঠিত রাখা এবং ভুট্টোকে প্রধানমন্ত্রী হতে দেয়া। লারকানা ষড়যন্ত্র ছাড়াও ভুট্টো ও তার লােকজন আরাে বহু চক্রান্ত করে। এসব ষড়যন্ত্রের একটি হচ্ছে ভুট্টো, লে. জেনারেল গুল হাসান ও এয়ার মার্শাল রহিম খানের মধ্যকার ষড়যন্ত্র। কথা দেয়া হয় যে, ভুট্টো প্রধানমন্ত্রী হলে চিফ অভ। জেনারেল স্টাফ লে. জেনারেল গুল হাসানকে সেনাবাহিনী প্রধান বানানাে হবে এবং এয়ার মার্শাল রহিম খানকে বিমান বাহিনী প্রধান হিসেবে পুনঃ নিয়ােগ দেয়া হবে। এক অভ্যুত্থান প্রচেষ্টায় এ ষড়যন্ত্রের কিঞ্চিত বাস্তবায়ন করা হয়। ইয়াহিয়াকে ক্ষমতা হস্তান্তরে চাপ দেয়া হলে তিনি অস্বীকৃতি জানান। তখন এয়ার মার্শাল রহিম। খান তার জঙ্গিবিমান নিয়ে প্রেসিডেন্ট ভবনের ওপর চক্কর দিতে থাকেন। জেনারেল গুল হাসান তার স্মৃতিকথায় স্বীকার করেছেন যে, আমাদের আত্মসমর্পণের পর এয়ার মার্শাল রহিম খানের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ কথাবার্তা হয়। ভুট্টো জেনারেল টিক্কার সঙ্গেও  ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিলেন। জুনিয়র অফিসার জেনারেল গুল হাসান সেনাবাহিনী। প্রধান হলে ২১ জন সিনিয়র জেনারেল ও বিগ্রেডিয়ার অবসর গ্রহণ করলেও টিক্কা। অবসর গ্রহণ করেন নি। পূর্ব পাকিস্তানে বিপর্যয়ের জন্য টিক্কাই মূলত দায়ী। ২৫ মার্চের নৃশংস সামরিক অভিযানের জন্য তাকে ‘কসাই’ খেতাব দেয়া হয় । পাকিস্তানের পুরাে যুদ্ধ পরিকল্পনা বানচাল করে দেয়ার জন্য দায়ী হওয়া সত্ত্বেও তাকে সেনাবাহিনী প্রধান পদে নিযুক্তির আশ্বাস দেয়া হয়। আমি এসব ষড়যন্ত্রের। কথা অনেক পরেও জানতে পারি নি।

১৯৭৪ সালে আমি ভারতের বন্দি দশা থেকে ফিরে এসে পূর্ব পাকিস্তানে বিপর্যয়। সম্পর্কে রিপাের্ট তৈরিকালে জেনারেল হেড কোয়ার্টার্সের বিভিন্ন সূত্র থেকে জানতে পারি যে, একটি গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে ইস্টার্ন কমান্ডকে উৎসর্গ করা হয়েছে এবং বিপর্যয়ের জন্য ইস্টার্ন কমান্ডের সিনিয়র কমান্ডারদের বলির পাঠা বানানাে হয়েছে। এ বই লেখার সময় আমি যখন বিভিন্ন লােকের সঙ্গে আলােচনা ও যােগাযােগ শুরু করি তখন আমার সন্দেহ দৃঢ় বিশ্বাসে পরিণত হয়। আমি যাদের সঙ্গে আলাপ করেছি তারা আমাকে জানিয়েছেন যে, সুচিন্তিতভাবে ইন্টার্ন কমান্ডের সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে এবং হাই কমান্ডের একটি গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই তা করা হয়েছে। ভারতের জব্বলপুরে ভারতীয় মেজর জেনারেল শাহ বেগ সিংয়ের কাছ থেকেও আমি এই কথা শুনেছি। তিনি আমাকে বলেছিলেন, “আপনার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে, স্যার। তারা এ বিপর্যয়ের সব দোষ আপনার ও আপনার কমান্ডের ওপর চাপিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।” আমার মতে নিম্নলিখিত ঘটনাবলী প্রমাণ করছে যে, পূর্ব পাকিস্তানের পতন ছিল। একটি সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের ফল :

মে ১৯৭১: আমাকে পর্যুদস্ত ও পিছু হটে যাওয়া গেরিলাদের পশ্চাদ্ধাবনে ভারতের প্রবেশের অনুমতি দেয়া হয় নি যদিও রাজনৈতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে ভারতে প্রবেশ করা ছিল সবদিক থেকে যুক্তিযুক্তি। ভারতীয়রা তখন আমাদের ভূখণ্ডে প্রবেশ করেছিল এবং আমাদের ভূখণ্ডে গােলাবর্ষণ করছিল। আমাকে ভারতে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হলে অংকুরেই বিদ্রোহ নস্যাৎ হয়ে যেত এবং পাকিস্তান ঐক্যবদ্ধ থাকতাে।

সেপ্টেম্বর ১৯৭১: লারকানা ও এম, এম, আহমেদ পরিকল্পনার পরবর্তী ঘটনা। শত্রুদের নতুন করে সৈন্য সমাবেশ সম্পর্কে আমাকে আমার চিফ অভ স্টাফের ব্রিফিং। সব যােগাযােগ কেন্দ্র রক্ষা এবং সীমান্ত বন্ধ করে দেয়ার পরামর্শ। মূল দায়িত্ব সংশােধন করার ক্ষেত্রে কোনাে লিখিত নির্দেশ না দেয়া। সাধারণ ক্ষমা ঘােষণা এবং একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া শুরু করার ব্যাপারে আমার সুপারিশ বাস্তবায়ন না করা।

অক্টোবর ১৯৭১। সেনাবাহিনী প্রধানের পূর্ব পাকিস্তান সফর। আমার কৌশলগত পরিকল্পনা অনুমােদন। সেনাবাহিনী প্রধান বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠার সুযােগ না দেয়ার এবং ভূখণ্ড না হারানাের ওপর জোর দেন। আমাকে দেশের অভ্যন্তরে ও সীমান্তে সামরিক তৎপরতা অব্যাহত রাখার নির্দেশ দেয়া হয়। 

নয়াদিল্লীতে নিযুক্ত আমাদের রাষ্ট্রদূত সাজ্জাদ হায়দার ভারতের আসন্ন হামলা সম্পর্কে বার বার সতর্ক করায় তাকে তুরস্কে বদলি।

জেনারেল হেড কোয়ার্টার্স সব পর্যায়ে বিদ্রোহ দমন তৎপরতায় আমাকে রিজার্ভ সৈন্য ব্যবহারের নির্দেশ দেয়। এতে আমি চরম সংকটে পড়ে যাই। প্রতিশ্রুত অতিরিক্ত সৈন্য না পাঠানাে। ট্যাংক, গােলন্দাজ, ইঞ্জিনিয়ার্স ও সাজসরঞ্জামের ঘাটতি পূরণ না করা। এতে যুদ্ধ পরিচালনায় সমস্যা দেখা দেয়। গভর্নর মালিক আওয়ামী লীগের বাদবাকি এমএনএ-দের সরকারের অন্তর্ভুক্ত করার এবং পলাতক এমএনএ-দের আসন পূরণে নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তাব দেন। কিন্তু তার এ প্রস্তাব অগ্রাহ্য করা হয়।

১৫ নভেম্বর ১৯৭১: মেজর জেনারেল জামশেদ ও আমার চিফ অভ স্টাফ পূর্ব পাকিস্তানে মােতায়েনকৃত হালকা ডিভিশনগুলােকে আর্টিলারি, ট্যাংক ও অন্যান্য সাজ-সরঞ্জাম সরবরাহ করে এগুলােকে পূর্ণাঙ্গ ডিভিশনে রূপান্তরিত করার জন্য সেনাবাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের অনুরােধ করেন। কিন্তু এ অনুরােধে কর্ণপাত করা হয় নি। সেনাবাহিনী প্রধানের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কোথাও কোনাে ঘাটতি পূরণ করা হয় নি। এতে ভারতীয় হামলা মােকাবেলায় পূর্ব পাকিস্তানে মােতায়েনকৃত সৈন্যরা খুবই দুর্বল বলে প্রতীয়মান হয়।

১৯ নভেম্বর ১৯৭১: খবর পাওয়া গিয়েছিল যে, ভারতীয় সেনাবাহিনী ঈদের দিনে পূর্ণাঙ্গ হামলা শুরু করার পরিকল্পনা করছে। পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষায় ৮টি ব্যাটালিয়ন, ১১১ পদাতিক ব্রিগেড এবং একটি ইঞ্জিনিয়ার রেজিমেন্ট পাঠানাের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। ১১১ ব্রিগেড পাঠাননার পরিকল্পনা বাতিল করা হয় এবং এ ব্রিগেডকে ইয়াহিয়ার বিরুদ্ধে সামরিক অভ্যুত্থানের জন্য রাওয়ালপিন্ডিতে রেখে দেয়া হয়। পরবর্তী ৪ দিনে মাত্র ২টি ব্যাটালিয়ন ঢাকা এসে পৌছে। বাদবাকি ব্যাটালিয়নের বরাদ্দ বাতিল করা হয়। ঢাকা প্রতিরক্ষায় বরাদ্দকৃত সৈন্যরা কখনাে এসে পৌছে নি।

২১ নভেম্বর ১৯৭১: ভারতীয়রা পূর্ব পাকিস্তানে হামলা করে। শুধুমাত্র ভাইস চিফ অভ জেনারেল স্টাফকে এ সংবাদ দেয়ার জন্য খুঁজে পাওয়া যায়। চিফ অভ জেনারেল স্টাফ গুল হাসান খুব ভালােভাবেই অবগত ছিলেন যে, ঈদের দিনে ভারত হামলা করবে। এ কথা জেনেও তিনি লাহােরে ঈদ উদযাপন করছিলেন।

২২ নভেম্বর ১৯৭১; প্রেসিডেন্ট ও সেনাবাহিনী প্রধান শিকারের জন্য শিয়ালকোটে চলে যান এবং জেনারেল হেড কোয়ার্টার্সে ব্রিফিং-এ যােগদান করতে অস্বীকৃতি জানান। প্রেসিডেন্টের জঘন্য উক্তি, “আমি পূর্ব পাকিস্তানের জন্য দোয়া ছাড়া আর কি করতে পারি?”

পাকিস্তান আক্রান্ত। কিন্তু ভারতীয় আগ্রাসন বন্ধে নিরাপত্তা পরিষদের যাবার ব্যাপারে প্রেসিডেন্টের কোনাে উদ্যোগ নেই। পরিকল্পনা অনুযায়ী পশ্চিম রণাঙ্গনে যুদ্ধও শুরু করা হয় নি। পরিকল্পনা ছিল যে, ‘পূর্ব পাকিস্তানের যুদ্ধ করা হবে পশ্চিম পাকিস্তানে।’

২২ নভেম্বর ১৯৭১ থেকে ২ ডিসেম্বর ১৯৭১: কোনাে কূটনৈতিক অথবা রাজনৈতিক উদ্যোগ নেই। অথবা ঘাটতি পূরণ করে পূর্ব। পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা জোরদার করারও উদ্যোগ নেই। ভুট্টো লাহাের বিমানবন্দরে এক বিবৃতিতে বলেন যে, “পাকিস্তান ভারতীয় আগ্রাসনের বিষয়টি নিরাপত্তা পরিষদের উত্থাপন করতে যাবে না। সম্ভবত এটাই একমাত্র উদাহরণ যেখানে আগ্রাসনের শিকার একটি দেশ নিরাপত্তা পরিষদে যেতে চায় নি।

৩ ডিসেম্বর ১৯৭১: পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডকে পূর্বাহ্নে অবহিত করা ছাড়া ভারতের ওপর পশ্চিম রণাঙ্গনে স্থল হামলার পরিবর্তে বিমান হামলা।

৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ : নিরাপত্তা পরিষদে পােল্যান্ডের প্রস্তাব উত্থাপন। এ প্রস্তাবে যুদ্ধ বিরতি ও রাজনৈতিক মীমাংসার আহ্বান জানানাে হয়। কিন্তু পাকিস্তান ও প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে।

৫ ডিসেম্বর ১৯৭১: জেনারেল হেড কোয়ার্টার্স আমাদেরকে পূর্ব পাকিস্তানে শত্ৰু-বাহিনীকে ব্যস্ত রাখতে পরামর্শ দেয় যাতে তারা পশ্চিম রণাঙ্গনে ছুটে যেতে না পারে। এজন্য আমাকে যুদ্ধবিরতি নাগাদ শক্রদের মােকাবেলায় দিনাজপুর, রংপুর, খুলনা প্রভৃতি জায়গায় পর্যান্ত সৈন্য মােতায়েন রাখতে হয়েছে। এসব জায়গায় সৈন্য মােতায়েন করায় রাজশাহী সেক্টরে লড়াইয়ে আমার পরিকল্পনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আমাকে জেনারেল হেড কোয়ার্টার্স থেকে জানানাে হয়েছিল যে, শিগগির চীনা সহায়তা আসছে। এটা ছিল একটি প্রহসন। আমাদেরকে বিভ্রান্ত করার একটি অপচেষ্টা। 

৬ ডিসেম্বর ১৯৭১: এয়ার মার্শাল রহিম খানের নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান বিমান বাহিনী ভারতের বিরুদ্ধে। ছিল নিষ্ক্রিয়। জেনারেল টিক্কা খান পরিকল্পনা অনুযায়ী হামলা চালান নি। ভারতীয় নৌবাহিনী করাচি নৌঘাটি আক্রমণ করে। কিন্তু আমাদের নৌবাহিনী কোনাে তৎপরতা চালায় নি।

৭ ডিসেম্বর ১৯৭১: গভর্নর হাউস থেকে প্রেসিডেন্টের কাছে একটি জরুরি বার্তা পাঠিয়ে বলা হয় যে, ইস্টার্ন ফ্রন্ট পতনের মুখে। প্রকৃত ঘটনা ছিল যে, তখনাে ইস্টার্ন ফ্রন্টের পতন ঘটার কোনাে সম্ভাবনা ছিল না। যশাের থেকে পিছু হটে ব্রিগেডিয়ার হায়াত ও মঞ্জুর দুটি ভারতীয় ডিভিশনকে খুলনা ও কুষ্টিয়ায় তাড়িয়ে নিয়ে যান। শত্রুর দ্বিতীয় কোর সংযােগ হারিয়ে ফেলে এবং এর ডিভিশনগুলােকে তাদের লক্ষ্যস্থল থেকে বহুদূরে তাড়িয়ে দেয়া হয়। সিলেট, ভৈরব, ময়নামতি, ফরিদপুর, চট্টগ্রাম, চালনা, খুলনা, দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া, নাটার, রাজশাহী প্রভৃতি যুদ্ধের শেষ দিন পর্যন্ত আমাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। হিলিতে প্রচণ্ড লড়াই চলছিল এবং পশ্চিম দিকে লড়াইয়ে আমাদের অগ্রগতি হচ্ছিল যে, ইস্টার্ন কমান্ডের বিপর্যয় ঘটছে। কিন্তু বাস্তবতা ছিল পুরােপুরি বিপরীত। আমরা তখনাে তীব্র লড়াই চালাচ্ছিলাম। অন্যদিকে, ওয়েস্টার্ন গ্যারিসনের পতন ঘটেছিল অথবা পতন ঘটতে যাচ্ছিল। পশ্চিম রণাঙ্গনে ভারতকে অবাধে সমুদ্র, অন্তরীক্ষ ও স্থলে হামলা চালানাের সুযােগ দেয়া হয়। পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি সম্পর্কে জেনারেল হেড কোয়ার্টার্স ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের কাছে যেসব রিপাের্ট পাঠানাে হয় আমি ছিলাম সে ব্যাপারে পুরােপুরি অজ্ঞ।

৮ ডিসেম্বর ১৯৭১: জেনারেল হেড কোয়ার্টার্স থেকে আমার কাছে একটি বার্তা পাঠিয়ে বলা হয় যে, চীনাদের তৎপরতা শুরু হয়েছে। কিন্তু তা ছিল সম্পূর্ণ মিথ্যা। ভারতীয় আগ্রাসন সম্পর্কে জাতিসংঘকে অবহিত করতে এত সময় কেন লাগল তাও একটি দুর্বোধ্য রহস্য। পশ্চিম রণাঙ্গনে হামলা ব্যর্থ হওয়ার পর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ভুট্টোকে ৮ ডিসেম্বর জাতিসংঘে পাঠানাের সিদ্ধান্ত নেন। ভুট্টো তিন দিনে নিউইয়র্কে পৌঁছেন। সেখানে গিয়েই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। (তার অসুখে কোনাে ডাক্তার ডাকা হয়নি। বেনজির ভুট্টোও ছিলেন একই হােটেলে। তিনিও তার পিতাকে দেখতে যান

৯ ডিসেম্বর ১৯৭১ : রাও ফরমান ঢাকাকে একটি উন্মুক্ত নগরী হিসেবে ঘােষণা করার প্রস্তাব করেন। এ প্রস্তাব ছিল তার নিজেকে রক্ষা, ইন্টার্ন কমান্ডকে দোষারােপ এবং ঢাকার অভ্যন্তরে ও বাইরে মােতায়েন আমার সেনাদের একটি অনিশ্চয়তায় ফেলে দেয়ার আরেকটি চক্রান্ত। এ প্রস্তাবে প্রকারান্তারে সকল অবাঞ্ছিত শক্তিকে এগিয়ে আসার আমন্ত্রণ জানানাে হয় এবং বুঝানাে হয় যে, একটি গুলি ছোড়ার ক্ষমতাও আমার নেই। এটা ছিল আমার সৈন্যদের মনােবল ভেঙে দেয়ার একটি সুচতুর চক্রান্ত। ফরমান এ প্রস্তাব দিয়ে প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন যে, পূর্ব পাকিস্তান অরক্ষিত। | গভর্নর হাউস থেকে পাঠানাে আরেকটি বার্তায় প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরামর্শ দেয়া হয়। আমি দ্বিমত পােষণ করি এবং গর্ভনরের মাধ্যমে প্রেসিডেন্টের কাছে একই বার্তায় শেষ দিন পর্যন্ত লড়াই করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করি। কিন্তু প্রেসিডেন্ট আমাকে গভর্নরের নির্দেশ মেনে নিতে বলেন। প্রেসিডেন্ট রাজনৈতিক সমাধানসহ যে কোনাে মীমাংসায় পৌছার ক্ষমতা গভর্নরের ওপর ন্যস্ত করেন। পূর্ব পাকিস্তান সংকটে রাজনৈতিক মীমাংসা করা গভর্নরের পক্ষে সম্ভব ছিল না। কারণ মুজিব ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানে বন্দি।

১০ ডিসেম্বর ১৯৭১। গভর্নর যুদ্ধবিরতি, ক্ষমতা হস্তান্তর ও পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যদের পশ্চিম পাকিস্তানে প্রত্যাবাসনের একটি প্রস্তাব জাতিসংঘ প্রতিনিধির কাছে হস্তান্তরে প্রেসিডেন্টের অনুমতি কামনা করেন। প্রেসিডেন্টের অনুমােদন ছাড়াই ফরমান এ অতি গােপনীয় বার্তা জাতিসংঘ প্রতিনিধির কাছে হস্তান্তর করেন। জাতিসংঘ প্রতিনিধি এ বার্তা তৎক্ষণাৎ জাতিসংঘে পাঠিয়ে দেন। ফরমান ঢাকা ও পূর্ব পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণভার গ্রহণ করার জন্য ফ্রান্স, ব্রিটেন, সােভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের কালজেনারেলদের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি তাদের সঙ্গে যােগাযােগও করতেন। তিনি জাতিসংঘ ও চীনা প্রতিনিধি দলকেও একই আহ্বান জানান। ফরমান আমাকে অথবা গভর্নরকে না জানিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধানের সঙ্গেও যােগাযােগ করেছিলেন। একইভাবে, আমাকে অথবা গভর্নরকে অবহিত না করে তিনি উপরে উল্লেখিত বার্তা জাতিসংঘ প্রতিনিধির কাছে হস্তান্তর করেন। রুশ কাল-জেনারেলের সঙ্গে তার যােগাযােগ সম্পর্কেও আমাদের দু’জনকে অন্ধকারে রাখা হয়।

১১ ডিসেম্বর ১৯৭১: সেনাবাহিনী প্রধান আমাকে গভর্নরের নির্দেশ মেনে নিতে বলেন। সােজা কথা, আমাকে আত্মসমর্পণ করতে হবে। আত্মসমর্পণের ক্ষেত্রে সৈন্যদের নিরাপত্তা ও অস্ত্রশস্ত্র ধ্বংস করার প্রশ্ন ওঠে।

ফরমান আগের দিন জাতিসংঘ প্রতিনিধির কাছে যে বার্তা হস্তান্তর করেছিলেন পরদিন সকালে রুশ কাল-জেনারেল ফরমানের কাছে টেলিফোন করে জানান যে, তার সরকার এ বার্তায় বর্ণিত শর্তাবলী মেনে নিয়েছে। রুশ কলেটে ফরমানকে আশ্রয় ও নিরাপত্তা দান এবং নিরাপদে পশ্চিম পাকিস্তানে পৌছে দেয়ার প্রস্তাব করা হয়।

১২ ডিসেম্বর ১৯৭১ : চিফ অভ জেনারেল স্টাফ লে. জেনারেল শুল হাসান আমাকে আরেকটি মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে পশতুতে বলেছিলেন, উত্তর দিক থেকে পীত এবং দক্ষিণ দিক থেকে শ্বেতাঙ্গরা আসছে। আমাকে ৩৬ ঘন্টা টিকে থাকার নির্দেশ দেয়া হয়। বলা হয় যে, এরপরই উত্তর দিকে থেকে চীনা এবং দক্ষিণ দিক থেকে মার্কিন সাহায্য আসবে। এটা ছিল একটি ডাহা মিথ্যা। আমি কখনাে বলি নি যে, আমার পক্ষে লড়াই চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। প্রতিটি বার্তায় আমি শেষ পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাবার সংকল্প ব্যক্ত করেছিলাম। আমার ওপর দোষ চাপানাের জন্য আবার চালাকি করা হয়। আমি তখন টেলিফোনে গুল হাসানকে বলেছিলাম, দয়া করে আমার সঙ্গে আর মিথ্যা কথা বলবেন না। আমি সাহায্য চাই নি এবং আমার সাহায্যের প্রয়ােজনও নেই। আমি আপনাকে পশ্চিম রণাঙ্গনের প্রতি লক্ষ্য রাখার অনুরােধ করছি। এ রণাঙ্গনেই আমাদেরকে বিজয়ী হতে হবে। আমি আমার দিকটা দেখছি।’ এরপর তিনি আমার সঙ্গে কথা বলতে চাইতেন না।

মেজর জেনারেল কাজী মজিদ যুদ্ধ পরিকল্পনা অনুযায়ী ঢাকায় পিছু হটে আসেন নি।

১৩ ডিসেম্বর ১৯৭১ : জেনারেল হেড কোয়ার্টার্সের কাছে পাঠানাে বার্তায় আমি জানাই যে, ‘ঢাকা দুর্গের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সুসংগঠিত এবং আমি লড়াই চালিয়ে যেতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।’ আমি বিদেশি প্রচার মাধ্যমের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে ঘােষণা করি যে, ‘আমার লাশের ওপর দিয়ে ভারতীয় ট্যাংককে ঢাকায় আসতে হবে। সেদিন রাতে আরেকটি বার্তায় আমি জানাই যে, আমি চূড়ান্ত লড়াইয়ের জন্য সুরক্ষিত এলাকায় অগ্রসর হচ্ছি।’ আমি শেষ ব্যক্তি জীবিত থাকা পর্যন্ত লড়াই করে যাবার নির্দেশ দেই। ফরমান আমাকে অথবা গভর্নরকে না জানিয়ে হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালকে একটি আন্তর্জাতিক নিরাপদ অঞ্চল হিসেবে ঘােষণা করার প্রস্তাব দেন।

রাত ১৩/১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১: আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিয়ে প্রেসিডেন্টের পক্ষ থেকে পাঠানাে একটি অশ্রেণীভুক্ত উন্মুক্ত বার্তা। আমার অজ্ঞাতে গভর্নরের পক্ষ থেকে রাও ফরমান আলী যে বার্তা পাঠান প্রেসিডেন্ট তার জবাবে আমাকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন। যােগাযােগ করে সেনাবাহিনী প্রধান অথবা মেজর জেনারেল পীরজাদা কাউকেই পাওয়া যায় নি। জেনারেল গুল হাসান কোনাে কিছুই না জানার ভান করেন। অথচ তিনি ছিলেন চিফ অভ জেনারেল স্টাফ এবং সামরিক গােয়েন্দা ও সিগনালস অধিদপ্তরের মহাপরিচালক। গভর্নর মালিক ও তার মন্ত্রিসভা পদত্যাগ করে। আমি আত্মসমর্পণ করতে চাই নি বলেই আমার ওপর চাপ প্রয়ােগ করার জন্য তিনি পদত্যাগ করেন। দৃশ্যত আত্মসমর্পণের দলিলে সই করা থেকে বিরত থাকার জন্যই তিনি এ উদ্যোগ নেন।

১৫ ডিসেম্বর ১৯৭১: রাশিয়ার সমর্থনে পােল্যান্ড জাতিসংঘে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করে। এ প্রস্তাবে শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং প্রাথমিকভাবে ৭২ ঘণ্টা যুদ্ধ। বিরতির কথা উল্লেখ করা হয়। জেনারেল হামিদের একান্ত সচিব ব্রিগেডিয়ার জানজুয়া আমার চিফ অভ স্টাফ ব্রিগেডিয়ার বাকির সিদ্দিকীকে জানান যে, উপরে উল্লেখিত বার্তাটি পাঠানাে হচ্ছে। আমি জেনারেল হেড কোয়ার্টার্সের কাছে পাঠানাে এক বার্তায় জানাই যে, “আমি শেষ পর্যন্ত লড়াই করতে প্রস্তুত।” জেনারেল হামিদ ও এয়ার মার্শাল রহিম ১৪ ডিসেম্বর জেনারল হেড কোয়ার্টার্স থেকে পাঠানাে বার্তা অনুযায়ী কাজ করার জন্য টেলিফোনে নির্দেশ দেন। তারা আমাকে স্মরণ করিয়ে দেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানের নিরাপত্তা বিপন্ন। | ফরমান রাশিয়ার মাধ্যমে ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধানের কাছে বার্তা পাঠানাের চেষ্টা করেন। আমি যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হই এবং আমার সৈন্য ও অনুগত পাকিস্তানিদের নিরাপত্তা দাবি করি।

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ : ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধান আত্মসমর্পণের প্রস্তাব দিয়ে বার্তা পাঠান। আমি তার প্রস্তাব সেনাবাহিনী প্রধানের কাছে পাঠাই। তিনি এ প্রস্তাবে সম্মত হন এবং আত্মসমর্পণ করতে বলেন। আমি শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিয়ে পাকিস্তান ও সশস্ত্র বাহিনীর সম্মান রক্ষা করার জন্য প্রেসিডেন্টের কাছে একটি বার্তা পাঠাই। প্রেসিডেন্ট বার্তায় লিখেন ‘এনএফএ (আর কোনাে যুদ্ধ নয়)। আমি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলতে চাইলাম। তবে তাকে পাওয়া যায় নি। সেনাবাহিনী প্রধানের সঙ্গে যােগাযােগ করতে পারি নি। জেনারেল পীরজাদা তখন স্কোয়াশ খেলছিলেন। তিনি টেলিফোনে আমার সঙ্গে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

পােলিশ প্রস্তাব গ্রহণ করার পরিবর্তে ইস্টার্ন কমান্ডের ওপর আত্মসমর্পণ করার অসম্মান চাপিয়ে দেয়া। এভাবে পূর্ব পাকিস্তানকে একটি উত্তরাধিকারী সরকারবিহীন অবস্থায় পরিত্যাগ করার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হয়।

করে সেনাবাহিনী প্রধান অথবা মেজর জেনারেল পীরজাদা কাউকেই পাওয়া যায় নি। জেনারেল গুল হাসান কোনাে কিছুই না জানার ভান করেন। অথচ তিনি ছিলেন চিফ অভ জেনারেল স্টাফ এবং সামরিক গােয়েন্দা ও সিগনালস অধিদপ্তরের মহাপরিচালক। গভর্নর মালিক ও তার মন্ত্রিসভা পদত্যাগ করে। আমি আত্মসমর্পণ করতে চাই নি বলেই আমার ওপর চাপ প্রয়ােগ করার জন্য তিনি পদত্যাগ করেন। দৃশ্যত আত্মসমর্পণের দলিলে সই করা থেকে বিরত থাকার জন্যই তিনি এ উদ্যোগ নেন।

১৫ ডিসেম্বর ১৯৭১: রাশিয়ার সমর্থনে পােল্যান্ড জাতিসংঘে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করে। এ প্রস্তাবে শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং প্রাথমিকভাবে ৭২ ঘণ্টা যুদ্ধ। বিরতির কথা উল্লেখ করা হয়। জেনারেল হামিদের একান্ত সচিব ব্রিগেডিয়ার জানজুয়া আমার চিফ অভ স্টাফ ব্রিগেডিয়ার বাকির সিদ্দিকীকে জানান যে, উপরে উল্লেখিত বার্তাটি পাঠানাে হচ্ছে। আমি জেনারেল হেড কোয়ার্টার্সের কাছে পাঠানাে এক বার্তায় জানাই যে, “আমি শেষ পর্যন্ত লড়াই করতে প্রস্তুত।” জেনারেল হামিদ ও এয়ার মার্শাল রহিম ১৪ ডিসেম্বর জেনারল হেড কোয়ার্টার্স থেকে পাঠানাে বার্তা অনুযায়ী কাজ করার জন্য টেলিফোনে নির্দেশ দেন। তারা আমাকে স্মরণ করিয়ে দেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানের নিরাপত্তা বিপন্ন। | ফরমান রাশিয়ার মাধ্যমে ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধানের কাছে বার্তা পাঠানাের চেষ্টা করেন। আমি যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হই এবং আমার সৈন্য ও অনুগত পাকিস্তানিদের নিরাপত্তা দাবি করি।

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ : ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধান আত্মসমর্পণের প্রস্তাব দিয়ে বার্তা পাঠান। আমি তার প্রস্তাব সেনাবাহিনী প্রধানের কাছে পাঠাই। তিনি এ প্রস্তাবে সম্মত হন এবং আত্মসমর্পণ করতে বলেন। আমি শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিয়ে পাকিস্তান ও সশস্ত্র বাহিনীর সম্মান রক্ষা করার জন্য প্রেসিডেন্টের কাছে একটি বার্তা পাঠাই। প্রেসিডেন্ট বার্তায় লিখেন ‘এনএফএ (আর কোনাে যুদ্ধ নয়)। আমি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলতে চাইলাম। তবে তাকে পাওয়া যায় নি। সেনাবাহিনী প্রধানের সঙ্গে যােগাযােগ করতে পারি নি। জেনারেল পীরজাদা তখন স্কোয়াশ খেলছিলেন। তিনি টেলিফোনে আমার সঙ্গে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

পােলিশ প্রস্তাব গ্রহণ করার পরিবর্তে ইস্টার্ন কমান্ডের ওপর আত্মসমর্পণ করার অসম্মান চাপিয়ে দেয়া। এভাবে পূর্ব পাকিস্তানকে একটি উত্তরাধিকারী সরকারবিহীন অবস্থায় পরিত্যাগ করার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হয়।

জানুয়ারি ১৯৭২ থেকে ১৯৭৪ পর্যন্ত : পূর্ব পাকিস্তানের পতন ঘটার পর ভুট্টোর বিদ্বেষপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি প্রকটভাবে ধরা পড়ে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী সিমলায় ভুট্টোর অবস্থানকালে সবকিছু তদারকির জন্য জনাব মােহাম্মদ ইউনুসকে দায়িত্ব দেন। তিনি লিখেছেন | ‘দ্বিতীয় দিন তিনি (ভুট্টো) ক্রুদ্ধ হয়ে বলেন, আমি যুদ্ধ বন্দিদের মুক্ত করার জন্য এখানে আসি নি। এই যুদ্ধবন্দিরা এমন এক ভূখণ্ডে জন্ম নিয়েছে সেখানকার লােকজন শত শত বছর ধরে ব্রিটিশের কামানের খােরাক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। পাকিস্তানের জন্য দু’এক লাখ লােকের মৃত্যুতে কি আসে যায়?

তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায়, ভুট্টো যুদ্ধবন্দিদের দেশে ফিরিয়ে আনতে না গেলে তিনি কেন সিমলা গিয়েছিলেন। তিনি সেখানে গিয়ে কি অর্জন কররেন? তথাকথিত সিমলা চুক্তির আওতায় কাশ্মীরের যুদ্ধবিরতি রেখাকে নিয়ন্ত্রণ রেখায় পরিবর্তন করা হয়। ১৯৭১ সালের যুদ্ধে ভারতীয়রা আজাদ কাশ্মীরে যেসব চৌকি দখল করেছিল সেগুলাে থেকে ভারতীয় সেন্য প্রত্যাহার করা হয় নি। এ চুক্তিতে কাশ্মীরে ও কাশ্মীরী জনগণের ভাগ্যে সীলমােহর মেরে দেয়া হয়। দুটি দেশের প্রতিনিধিদলের। মধ্যে নয়, দু’জন ব্যক্তির মধ্যে এ সমঝােতা হয়। দু’জন প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকের আগে। দুটি দেশের প্রতিনিধি দলের মধ্যে যে আলােচনা হয় তা ছিল একটি আইওয়াশ। সিমলা থেকে প্রত্যাবর্তনের পর ভুট্টোর চাটুকাররা দাবি করেন যে, ভুট্টো তাদের। মধ্যকার একান্ত বৈঠকে মিসেস গান্ধীকে বশীভূত করেছেন। কিন্তু ফলাফল থেকে দেখা গেছে যে, মিসেস ইন্দিরা গান্ধীই ভুট্টোকে বশীভূত করেছেন। ভুট্টো খালি হাতে সিমলা থেকে ফিরে আসেন। তিনি যুদ্ধবন্দি এবং পশ্চিম পাকিস্তানের হৃত সাড়ে ৫ হাজার বর্গমাইল ভূখণ্ড ও আজাদ কাশ্মীরের চৌকিগুলাে মুক্ত করা ছাড়াই দেশে ফেরেন।

ইন্দিরা গান্ধী ও ভুট্টো উভয়েই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানে আগ্রহী ছিলেন।

বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের অর্থ হচ্ছে ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের কফিনের শেষ পেরেক ঠুকে দেয়া। ইন্দিরা গান্ধী ও ভুট্টো বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের এক দেশে পরিণত হওয়ার যে কোনাে সম্ভাবনাকে উপড়ে ফেলতে চেয়েছিলেন। পাকিস্তান যতক্ষণ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দিত ততক্ষণ বাংলাদেশের যে কোনাে ভবিষ্যৎ সরকার অথবা জনগণ পুনরেকত্রীকরণের চেষ্টা করতে পারতাে। ভুট্টো যুদ্ধবন্দিদের ভারত থেকে ফিরিয়ে আনার আগেই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে চেয়েছিলেন। | বাংলাদেশের জাতিসংঘে প্রবেশের বিরুদ্ধে চীন নিরাপত্তা পরিষদে তার ভেটো ক্ষমতা প্রয়ােগের হুমকি দেয়। পাকিস্তানের জনগণ ছিল স্বীকৃতি দানের বিপক্ষে। ভুট্টো ইসলামী শীর্ষ বৈঠকের আয়ােজন করেন। বাংলাদেশকে দাওয়াত দেয়া হয়। মুজিব বেঁকে বসলেন। তিনি বললেন, পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দিলে

তিনি লাহােরে ইসলামী শীর্ষ সম্মেলনে যােগদান করবেন না। মুসলিম দেশগুলাের চাপের মুখে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া হয়। মুজিব সদর্পে ওআইসি সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন।

ভুট্টো যুদ্ধবন্দিদের ফিরিয়ে আনতে চান নি। তিনি যুদ্ধবন্দিদের ফিরিয়ে আনতে চাইলে আমরা অনেক আগেই ফিরে আসতে পারতাম । ভুট্টোর হাতে ৪টি তুরুপের তাস ছিল। একটি হচ্ছে, মুজিব। মুজিবের বিনিময়ে যুদ্ধবন্দিদের ফিরিয়ে আনা। যেত। কিন্তু তাকে নিঃশর্তভাবে মুক্তি দেয়া হয়। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, ২ লাখ বাঙালি। এসব বাঙালির মধ্যে জেনারেল, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, নারী ও শিশু ছিল। যুদ্ধবন্দিদের বিনিময় করা যেত এদের সঙ্গে। কিন্তু তাদেরকেও নিঃশর্তভাবে যেতে দেয়া হয়।

তৃতীয় তুরুপের তাস ছিল ভারতীয় যুদ্ধবন্দি এবং চতুর্থটি হচ্ছে ফিরােজপুর হেডওয়ার্ক। এ হেডওয়ার্কের কাছাকাছি পৌছে গােটা ফিরােজপুর ও আশপাশের এলাকা করে দেয়া যেত প্লাবিত, ভারতীয় যুদ্ধবন্দি ও ফিরােজপুরের সঙ্গে যুদ্ধবন্দিদের বিনিময় করা যেত। কিন্তু ভুট্টো ভারতীয় যুদ্ধবন্দিদের নিঃশর্তভাবে মুক্তি দেন। | সিমলায় ভুট্টো মিসেস গান্ধীর সঙ্গে পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিদের ভারতে দীর্ঘদিন আটক রাখার বন্দোবস্ত করেন। আমাদেরকে মুক্তি দেয়া না হলে চীন জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদ লাভের বিরুদ্ধে ভেটো প্রয়ােগের হুমকি দেয়। চীনের এ হুমকির পর ভারত ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় আমাদেরকে। ভুট্টো আমাদেরকে ফিরিয়ে আনেন নি। চীনের প্রশংসনীয় ভূমিকায় আমরা দেশে ফিরতে পেরেছিলাম। | ‘এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়ােজন যে, ভুট্টো যুদ্ধবন্দিদের ফেরত দেয়ার প্রশ্নে ভারতের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি আদায় করা ছাড়াই পশ্চিম পাকিস্তানে বন্দি মুজিবকে মুক্তি দেন। নতুন রাষ্ট্র গঠনে মুজিবের ঢাকা উপস্থিতি ছিল অপরিহার্য এবং ভারতীয়দের কাছে তার প্রয়ােজন ছিল এত বেশি যে, ভুট্টো মুজিবকে মুক্তি দানের বিনিময়ে পাকিস্তানি সৈন্যদের প্রত্যাবসান দাবী করলে তিনি তাদের মুক্তি নিশ্চিত করতে পারতেন। সেক্ষেত্রে ৯৫ হাজার যুদ্ধবন্দিকে দীর্ঘদিন অসহনীয় দুর্ভোগ পােহাতে হতাে না। কার্যত ভুট্টো মুজিবকে নিঃশর্তভাবে মুক্তি দানে আগ্রহী ছিলেন যাতে মুজিব নিজের ঘর (বাংলাদেশ) গােছাতে পারেন। এছাড়া তার আগ্রহ ছিল বাংলাদেশকে স্বীকার করা।

শামিম আখতার, ডন, ২৭ অক্টোবর, ১৯৯৩

নােটস

১. মােহাম্মদ ইউনুস : পার্সন, প্যাট্রিয়ট অ্যান্ড পলিটিক্স। 

সূত্র : দ্য বিট্রেয়াল অভ ইস্ট পাকিস্তান – লে. জে. এ. এ. কে. নিয়াজি (অনুবাদ)

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!