You dont have javascript enabled! Please enable it! ঢাকা বৃত্ত সম্পর্কে ভুল ধারণা ও ভারতীয় পরিকল্পনা - সংগ্রামের নোটবুক

ঢাকা বৃত্ত সম্পর্কে ভুল ধারণা ও ভারতীয় পরিকল্পনা

ঢাকা বৃত্ত সম্পর্কে ভুল ধারণা পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা নদী ঢাকার নিচে একত্রিত হয়েছে এবং এগুলাে গঠন করেছেএকটি অসম ত্রিভুজের দুটি বাহু। এ ত্রিভুজের তৃতীয় বাহু ছিল উত্তরাঞ্চলে যেখানে কোনাে প্রতিবন্ধকতা ছিল না। ঢাকার এ এলাকা এবং এর উপকণ্ঠকে ভারতীয়রা তিনটি নদীর নামের আদ্যাক্ষর অনুসারে পিবিএম বা ঢাকা বৃত্ত বলে অভিহিত করতাে। আমি যে বিষয় নিয়ে আলােচনা করতে চাই তা হচ্ছে ভারতীয়দের ধারণা অনুযায়ী পিবিএম এলাকায় আমার সৈন্য মােতায়েন করা উচিত ছিল কিনা। এ ভুল ধারণা সম্পর্কে মন্তব্য করার আগে ভারতীয়দের মনে এধরনের প্রশ্ন কিভাবে জন্ম নিল তা খুঁজে বের করা প্রয়ােজন। ভারতীয়দের ধারণা অনুযায়ী পিবিএম-এর অভ্যন্তরে সৈন্য মােতায়েন করলে আমার ওপর ন্যস্ত দায়িত্বের একটিও আমি বাস্তবায়ন করতে পারতাম না এবং বিনা যুদ্ধে শত্রুদের কাছে আমাকে হার মানতে হতাে। আমি কিভাবে ভারত থেকে পূর্ব পাকিস্তানে মুক্তিবাহিনীর অনুপ্রবেশের রুটগুলাে বন্ধ করতাম? যােগাযােগ কেন্দ্র, ঘাট, সেতু ও ফেরিঘাটের মতাে রুটগুলাে আমাকে ভােলা রাখতে হয়েছে। আমরা সীমান্তে উপস্থিত না থাকলে কিভাবে আন্তর্জাতিক সীমান্ত পুনরুদ্ধার করা যেত এবং সেখানে কিভাবে নিরাপত্তা বজায় রাখা সম্ভব হতাে? প্রদেশের তিন-চতুর্থাংশ এলাকা থেকে সরে এলে আমরা কিভাবে সকল বিভাগীয় জেলা ও মহকুমা সদর দপ্তর ও থানা নিয়ন্ত্রণে রাখতাম? অথবা আমরা কিভাবে বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠায় এবং ভারতীয় ঢাকা ত্রিভূজের অভ্যন্তরে অবস্থান করলে অথবা আমরা যেখানে ছিলাম সেখানে অবস্থান না করলে এসব কোনাে কিছুই করা সম্ভব ছিল না। সর্বোপরি, আমাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক সীমাবদ্ধতা ছাড়া আরাে বহু সমস্যা ছিল যেগুলাে হতাে আরাে জটিলতর। আমাদের উপযুক্ত সরবরাহ। ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থা ছিল না। আমরা এডহক ব্যবস্থা এবং অস্থায়ী ভিত্তিতে কাজ করেছি। আমরা যুদ্ধ ও বাঁচার জন্য হাতের কাছে যা পেয়েছি সেগুলাের ওপরই অধিকাংশ ক্ষেত্রে নির্ভর করেছি।

বিরাট এলাকা নিয়ন্ত্রণে থাকার জন্যই আমরা তা করতে পেরেছি। পিবিএম এলাকার ভেতরে সীমিত থাকলে আমরা গােটা বাহিনীর জন্য পর্যাপ্ত টাটকা রেশন সংগ্রহ করা দুরূহ হতাে। তখন আমাদেরকে পুরনাে ও শুষ্ক রেশনের ওপর বেঁচে থাকতে হতাে। টাটকা খাবারের ঘাটতির কারণে অপুষ্টির শিকার ও অর্ধভুক্ত সৈন্যদের নানারকম রােগ-বালাই দেখা দিত। হাজার হাজার উর্দুভাষী লােক নিরাপত্তার জন্য এ এলাকায় ভীড় জমাত এবং তাদের জন্য খাদ্য সরবরাহ করা এক কঠিন সমস্যা হয়ে দেখা দিত। শত্রুরা খাদ্য সরবরাহের রুটগুলাে বন্ধ করে দিত। ক্ষুধা, চিকিৎসা ও পয়ঃপ্রণালীর অভাবে একটি মহামারী দেখা দিতে পারত এবং আমার সৈন্যসহ লােকজন মশা-মাছির মতাে মারা যেত তখন তাদেরকে যথাযথভাবে কবর দেয়াও একটি সমস্যা হয়ে দাঁড়াত। পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা (পিবিএম) নদীর ভিত্তিতে প্রতিরক্ষার ধারণা খুবই বিতর্কিত। এ বিষয়টি জটিলতর করতে আবেগ একটি বিরাট ভূমিকা পালন করেছে। ভারতীয়রা তাদের বােকামি ও ব্যর্থতা, তাদের হাই কমান্ডের অদক্ষতা, তাদের ক্রটিপূর্ণ পরিকল্পনা এবং অত্যন্ত অনুকূল পরিবেশ সত্ত্বেও তাদের ফিল্ড কমান্ডারদের নিম্নমানের তৎপরতা আড়াল করার অশুভ উদ্দেশ্যে তারা এ পিবিএম। ধারণার কথা উল্লেখ করেছে। ভারতীয়রা তাদের জনগণকে বুঝানাের চেষ্টা করেছে। যে, ১৯৬৫ সালের পর থেকে তাদের সশস্ত্র বাহিনীর তৎপরতার মান বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৭১ সালের যুদ্ধকে যথাযথভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে, বাইরের শক্তির সহায়তা ছাড়া ভারত তার নিজের শক্তিতে এ লড়াইয়ে বিজয়ী হতে পারতাে না। তাদেরকে এ সহায়তা দিয়েছে আমার হাই কমান্ড যারা ভারতীয়দের মতাে পাকিস্তান ভাঙতে চেয়েছিলেন।

ঢাকা ত্রিভুজ ধারণাকে এর সত্যিকার পরিপ্রেক্ষিতে যথাযথভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা হয় নি। মেজর জেনারেল ফজল মুকিম, মেজর সিদ্দিক সালিক ও মেজর জেনারেল ফরমান আলীর মতাে কিছু পাকিস্তানি লেখক ও ভারতীয়দের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে বলছেন যে, পিবিএমই ছিল আমার অবরুদ্ধ ইন্টার্ন কমান্ডের লড়াইয়ের একমাত্র কৌশল। তবে তাদের কথা বলার সাহস নেই যে, ইস্টার্ন গ্যারিসনের স্বল্পসংখ্যাক ক্লান্ত, অবসন্ন ও অর্ধসজ্জিত সৈন্য শক্রদেরকে কেবল ঠেকিয়েই রাখে। নি, তাদেরকে তাদের কোনাে মিশনও পূরণ করতে দেয় নি। পক্ষান্তরে, চলাচলের সুযােগ এবং উভয় পার্শ্ব ও পশ্চাৎভাগ আশংকামুক্ত এবং নিজেদের ইচ্ছামতাে উদ্যোগ গ্রহণ করার ও যুদ্ধে জয়লাভের প্রতিটি সুবিধা থাকা সত্ত্বেও ওয়েস্টার্ন গ্যারিসন যুদ্ধে বিজয়ী হতে পারে নি। কিন্তু এটা বিবেচনায় আনা হচ্ছে না। কান। দেয়া হচ্ছে ভারতীয়রা উদ্দেশ্যমূলকভাবে যে ভুল ধারণা প্রচার করছে তার ওপর। ভারতীয়দের এ প্রচারণায় বিভ্রান্ত হওয়ার আগে কেউ প্রাসঙ্গিক পয়েন্টগুলাে তলিয়ে দেখছে না। ১৯৬৫ ও ১৯৭১ সালের যুদ্ধে অগ্রবর্তী প্রতিরক্ষা বিন্যাস অনুসরণ করা হয় এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে এখনাে এলাকার অভ্যন্তরে প্রতিরক্ষা ও অগ্রবর্তী প্রতিরক্ষা বিন্যাস অনুসরণ করা হচ্ছে। এক কথায়, আমরা পুরােপুরি আমাদের জাতীয় ভূখণ্ড ও শহর, নগর, যােগাযােগ কেন্দ্র, বন্দর প্রভৃতি রক্ষা করছি। এটা হচ্ছে ব্রিটিশদের কাছ থেকে পাওয়া একটি প্রতিরক্ষা ধারণা। পাকিস্তান ও ভারত উভয়েই উত্তরাধিকার সূত্রে এ ধারণা লাভ করেছে। অগ্রবর্তী অবস্থান গ্রহণের অন্যতম কারণ। হচ্ছে ভৌগলিক সীমাবদ্ধতা। পাকিস্তানের এ সীমাবদ্ধতা থাকায় কোনােক্রমেই শত্রুকে দেশের ভেতরে ঢােকার সুযােগ দেয়া সম্ভব নয়। রাশিয়ার মতাে বড় বড় দেশগুলাে শক্রকে ভেতরে ঢােকার সুযােগ দিতে পারে। কারণ এসব দেশের ভেতরে প্রচুর জায়গা আছে। সেজন্য তারা শত্রুকে ভেতর ঢোকার সুযােগ দিয়ে তাদের। ধ্বংস করতে পারে। সীমান্তের কাছে অবস্থিত শহর, যােগাযােগ কেন্দ্র ও রাস্তাঘাটের পতন হলে তাতে একটি বিরাট বিরূপ মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টি হয়। চীনের সঙ্গে ১৯৬২ সালের যুদ্ধে ভারত সেলায় প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করে। কিন্তু বােমদিলা ছিল প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করার উপযুক্ত জায়গা। ভারতীয় মন্ত্রিসভা ও সে-দেশের জনগণ লড়াই ছাড়া জাতীয় ভূখণ্ড ছেড়ে দেয়ার কৌশলগত ধারণা মেনে নিতে পারে নি। | ইস্টার্ন গ্যারিসনকে একটি জটিল লড়াই করতে হয়েছে। একদিকে, তাকে লড়াই করতে হয়েছে ভূখণ্ডের ভেতরে বিদ্রোহীদের সঙ্গে এবং অন্যদিকে, বহিঃশক্তি ভারতের বিরুদ্ধে। আমাকে পূর্ব পাকিস্তান রক্ষার রাজনৈতিক মিশন দেয়া হয়। এ মিশনের উল্লেখযােগ্য দিক ছিল, মুক্তিবাহিনীর হাতে কোনাে ভূখণ্ডের পতন হতে না দেয়া এবং পূর্ব পাকিস্তানের ভূখণ্ডে ভারতকে বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠায় বাধা দেয়া।

পশ্চিম রণাঙ্গনে শক্রর সঙ্গে শক্তির ভারসাম্য রক্ষার স্বার্থে পূর্ব রণাঙ্গনে অধিক ভারতীয় সৈন্যকে ব্যস্ত রাখার সামরিক মিশনেও আমাকে শৃঙ্খলিত করা হয়। পূর্ব ও পশ্চিম রণাঙ্গন ছিল পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত। কারণ উভয় রণাঙ্গনের লড়াই নিয়ন্ত্রণ করেছে জেনারেল হেড কোয়ার্টার্স। পশ্চিম রণাঙ্গনে আমাদের ছিল ৫টি সাজোয়া ডিভিশন এবং অন্যদিকে, ভারতের ছিল মাত্র ৩টি। এছাড়া, পশ্চিম রণাঙ্গনই যুদ্ধ শুরু করেছিল। তাই আক্রমণনাত্মক তৎপরতার মাধ্যমে তাদের ইঙ্গিত বিজয় অর্জন করা উচিত ছিল। বাঙালিদের সমর্থন দানে ভারতকে বিরত রাখতে এবং আমাদের সম্ভাব্য দখলীকৃত ভূখণ্ড ছেড়ে দেয়ার বিনিময়ে ভারতকে চুক্তি স্বাক্ষরে তারা বাধ্য করতে পারতাে। এভাবে পাকিস্তানকে ঐক্যবদ্ধ রাখা যেত। আমার ওপর ন্যস্ত দায়িত্ব আমি পালন করি। আমি ভারতীয় সেনাবাহিনীর ১২ ডিভিশন পদাতিক সৈন্য, ৩৯ ব্যাটালিয়ন বিএসএফ, কয়েক স্কোয়াড্রন ট্যাংক, ১৭ স্কোয়াড্রন জঙ্গিবিমান ও ভারতীয় নৌবাহিনীর একটি বিরাট অংশকে পূর্ব রণাঙ্গনে ব্যস্ত রাখি এবং পশ্চিম রণাঙ্গনে ভারতের বিপরীতে আমাদের ভারসাম্য রক্ষা করি । কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, ওয়েস্টার্ন গ্যারিসন তাদের ওপর ন্যস্ত দায়িত্ব পালন করতে পারে নি। ঢাকা ত্রিভুজ নিয়ে পর্যালােচনা করলে আমরা দেখব যে, ঢাকা বিভাগের একটি ক্ষুদ্র অংশ নিয়ে এ ত্রিভুজ গঠিত হয়েছে। ঢাকা বিভাগের এক বৃহৎ অংশ এবং আরাে তিনটি বিভাগ-চট্টগ্রাম, খুলনা ও রাজশাহী হচ্ছে এ ত্রিভুজের বাইরে। আমি কি চট্টগ্রাম (সমুদ্র বন্দর) ও বিভাগীয় সদর দপ্তর, পার্বত্য চট্টগ্রাম, চালনা (সমুদ্র বন্দর),খুলনা (সমুদ্র বন্দর) ও বিভাগীয় সদর দপ্তর, যশাের, ফরিদপুর, রাজশাহী (বিভাগীয় সদর দপ্তর), হিলি, সৈয়দপুর, নাটোর, পাবনা, বেড়া, রংপুর, বগুড়া, সিলেট, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, বরিশাল, চাঁদপুর, টেকনাফ ও নােয়াখালী ছেড়ে দিতে পারতাম? ঢাকা ও এর আশপাশের অঞ্চল ছাড়া পূর্ব পাকিস্তানের বাদবাকি অংশ ছিল এ ত্রিভুজের বাইরে। এসব জায়গা থেকে সৈন্য প্রতাহারের অর্থ ছিল লড়াই করা ছাড়া অথবা একটি গুলি খরচ করা ছাড়া পূর্ব পাকিস্তানের তিন-চতুর্থাংশ জায়গা ছেড়ে দেয়া। তখন যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই শেষ হয়ে যেত। একইভাবে, পশ্চিম রণাঙ্গনে মারা (হেডওয়ার্ক), শিয়ালকোট, পাসরুর, নারােয়াল, জাফরওয়াল, শকরগড়, ওয়াগা (হেডওয়ার্ক), বেদিয়ান (হেডওয়ার্ক), কাসুর, রাওয়ালনগর, রেতি, ধারকি, ওমরকোট, মিরপুরখাস, চর ও বাদিনের মতাে সীমান্ত শহর ও নগরগুলাে ছেড়ে আমরা নদ-নদীর পেছনে হটে আসতে পারি নি। আমরা যা পশ্চিম রণাঙ্গনে করতে পারি নি, পূর্ব-রণাঙ্গনে আমরা তা কিভাবে করতে পারি? একই দেশে ও একই সেনাবাহিনীতে দু’রকম মানদণ্ড কেন? 

নির্দেশ ছাড়া সৈন্য প্রত্যাহারে পুরাে যুদ্ধ পরিকল্পনাই শুধু ক্ষতিগ্রস্ত হতাে না, তা হতে বিপর্যয়কর এবং কোর্ট মার্শালযােগ্য অপরাধ। অদূরদর্শী হলে ঢাকা ত্রিভুজের ভেতর সৈন্য প্রত্যাহার করে আমি আমার প্রতিরক্ষা এলাকার আয়তন সীমিত করতে পারতাম। বিরাজমান পরিস্থিতির আলােকে এটাও বিবেচনায় রাখতে হবে যে, ঢাকা ত্রিভূজের ভেতরে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়তে হলে আমাকে আমার ভারী অস্ত্রশস্ত্র, ট্যাংক ও গােলাবারুদের একটি বড় অংশ পেছনে ফেলে আসতে হতাে। এটা হতে ভারতীয়দের জন্য একটি আশীর্বাদ। আমি এ ত্রিভুজে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়লে ভারতের ১২ ডিভিশন সৈন্যের বেশির ভাগ উদ্বৃত্ত হয়ে পড়ত। মুক্তিবাহিনী ও বাঙালি  ভিন্নমতাবলম্বীদের সহায়তায় তিন থেকে চার ডিভিশন ভারতীয় সৈন্যই এ ত্রিভুজে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে অবরুদ্ধ ও আটক করে ফেলতে পারত এবং ভারত তার উদ্বৃত্ত ৭/৮ ডিভিশন সৈন্য, অধিকাংশ সমরাস্ত্র ও বিএসএফ ব্যাটালিয়ন, বিমান ও নৌ বাহিনীর একটি বৃহৎ অংশ অতি সহজে পশ্চিম রণাঙ্গনে সরিয়ে নিতে পারত। সেক্ষেত্রে ভারতীয়রা বড় ধরনের জটিলতা ছাড়া পশ্চিম পাকিস্তান গ্রাস করার অবস্থায় উন্নীত হতাে। নদী পারাপার ভারতীয় পদাতিক বাহিনীর জন্য কষ্টসাধ্য হয়ে দেখা দিতে পারত। তবে বিমান ও হেলিকপ্টারে সৈন্য পরিবহন করে তারা সে বাধাও অতিক্রম করতে পারত। আমাদের বিমান বাহিনী যেখানে ছিল ক্ষুদ্র ও নিশ্চল এবং সৈন্য চলাচল ছিল রুদ্ধ সেখানে আমাদের পক্ষে ভারতীয় সৈন্য পরিবহনে বাধা দেয়া সম্ভব হতাে না। বিমান বাহিনীর পরিপূর্ণ আধিপত্য, স্থানীয় জনগণের সহায়তা, ছত্রী সেনা অবতরণের সুযােগ এবং উত্তর দিক থেকে নিরাপদে এগিয়ে আসার সুবিধা ভারতীয়দের এমন এক অবস্থানে নিয়ে যেত যেখানে ঢাকা ত্রিভুজকেন্দ্রিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা শুধু অকার্যকরই নয়, ইস্টার্ন গ্যারিসনের সৈন্যদের জন্য একটি মরণ ফাঁদও হতাে। অধিকাংশ নদীর উৎপত্তিস্থল হচ্ছে ভারত। সেখান থেকে পরে নদীগুলাে পূর্ব পাকিস্তানে প্রবেশ করেছে। এজন্য ভারতীয়রা নদী পাড়ি না দিয়েই পূর্ব পাকিস্তানের গভীর অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে পারত। শুধুমাত্র ঢাকায় প্রবেশ করার জন্য নদী অতিক্রম করতে হতাে। তবে এ কাজও তারা বিমানের ছত্রছায়ায় উভচর যান ও জাহাজ এবং স্থানীয় মাঝি-মাল্লাদের সহায়তায় সম্পন্ন করতে পারত। শক্তি প্রয়ােগই ছিল ভারতীয়দের নদী পাড়ি দিয়ে ঢাকায় প্রবেশে বাধা দেয়ার সর্বোত্তম উপায়। তাদেরকে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন এবং ঢাকা থেকে দূরে রাখার মানে ছিল নদীর বিপরীত পাশে অবস্থান নিয়ে ভারতীয়দের আটকে রাখা।

একজন মানুষের মতাে একটি সেনাবাহিনীও ঘুরে না দাঁড়ালে সে শত্রুর আঘাত থেকে যথাযথভাবে তার পশ্চাৎভাগ রক্ষা করতে পারে না। ঘুরে দাঁড়াতে গেলে সাময়িকভাবে ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়। পেছনে হামলার ভয়ে মস্তিষ্ক খুবই উদ্বিগ্ন। হয়ে ওঠে। উল্লেখিত নদ-নদীর বাইরে সৈন্য মােতায়েন করায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী সারা দেশে ছড়িয়ে যায় এবং ভারতীয় সেনাবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীকে ছিন্নভিন্ন করে দেয়া সম্ভব হয়। তখন আমি সামনাসামনি ভারতীয়দের ওপর হামলা করতে পেরেছি। এ পরিস্থিতিতে আমাদের উভয়পার্শ্ব ও পশ্চাৎভাগ রক্ষায় পর্যাপ্ত সৈন্যের প্রয়ােজন দেখা দেয় নি। তাই আমি আমার পশ্চাঙ্গ রক্ষা এবং ভারতীয় সেনাবাহিনী থেকে মুক্তিবাহিনী ও বাঙালি ভিন্নমতাবলম্বীদের বৃহদাংশকে বিচ্ছিন্ন রাখার জন্য বড় বড় নদীগুলাে ব্যবহার করি। পক্ষান্তরে, ঢাকা ত্রিভুজকেন্দ্রিক প্রতিরক্ষা ব্যুহ গড়ে তােলা হলে তা মরণফাঁদে পরিণত হতাে যা ভারতীয়দের জন্য আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিত।

অনুগত জনগণ বিশেষ করে উর্দুভাষী স্থানীয় বিহারীদের জীবন ও সম্পত্তি রক্ষা। করা ছিল ইস্টার্ন কমান্ডের অন্যতম দায়িত্ব। আমরা এ দায়িত্ব পালনে সক্ষম হই। নয়তাে জাতিগত নিধন চলতাে। | বেলুচিস্তান অভিযানকালে ভুট্টো পিএনএ নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল জিয়াউল হকের কাছে জানতে চেয়েছিলেন শান্তিকালীন অবস্থানে সৈন্যদের ফিরিয়ে আনতে কত সময় লাগবে। তাকে তখন জানানাে হয়েছিল যে, কমপক্ষে ৪৫ দিন সময় লাগবে। বেলুচিস্তানে ছিল মাত্র ৩ থেকে ৪শ’ কট্টর গেরিলা। অন্যদিকে, পূর্ব পাকিস্তানে ছিল লাখ লাখ মুক্তিবাহিনী, ১২ ডিভিশন ভারতীয় সৈন্য এবং হাজার হাজার সশস্ত্র বাঙালি। বেলুচিস্তানে সৈন্যদেরকে অভিযান চালাতে হয়েছে কেবল শহরগুলােতে। সৈন্য চলাচলে কোনাে বাধা-বিঘ্ন। ছিল না। সকল যােগাযােগ ব্যবস্থা ছিল অক্ষুন্ন। পক্ষান্তরে, পূর্ব পাকিস্তানে সৈন্যদেরকে নােয়াখালী, চালনা, খুলনা, যশাের, ফরিদপুর, রাজশাহী, হিলি, দিনাজপুর, বগুড়া, রংপুর, সৈয়দপুর, সিলেট, ময়মনসিংহ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, পার্বত্য চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম, টেকনাফ ও কক্সবাজারসহ অন্যান্য বহু শহরে অভিযান চালাতে হয়েছে। সকল যােগাযােগ ছিল অবরুদ্ধ। কোনাে যানবাহন, বিমান ও নৌ সহায়তা ছিল না। এমনকি সৈন্য প্রত্যাহারকালে আমাদের নিরাপত্তা রক্ষায় কোনাে দূরপাল্লার কামান অথবা ট্যাংকও ছিল না। পাঞ্জাব, বেলুচিস্তান ও সিন্ধুতে অগ্রবর্তী অবস্থানে মােতায়েন সৈন্যদের কেউ যদি নদীর পেছনে অথবা নদী বরাবর প্রত্যাহার করার পরিকল্পনা করে তাহলে তা হবে খুবই হাস্যকর একটি অনুশীলন। এমন পরিকল্পনা কেউ করতে পারে না। যার কোনাে দায়িত্ব নেই তার পক্ষে সমালােচনা করা খুবই সহজ। | ‘নিয়াজি শুধুমাত্র ঢাকা অথবা তিনটি প্রধান শহর অথবা ৯টি বড় শহর রক্ষায়ও তার কমান্ডকে কেন্দ্রীভূত করতে পারেন নি। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনী অবশিষ্ট পূর্ব পাকিস্তান দখল এবং বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠা করতে পারত। ডিভিশন ও ড্রিগেডগুলাে বিধ্বস্ত হতে পারত। এনিয়ে জাতিসংঘে কোনাে হৈ-চৈ হতাে না।’

(মেজর জেনারেল শওকত রিজা, দ্য পাকিস্তান আর্মি ১৯৬৫-৭১)

প্রতিরক্ষা লাইন

ভারতীয়রা আমার প্রতিরক্ষা পরিকল্পনার সমালােচনা করেছে এবং বলছে যে, ঢাকা। ত্রিভুজে আমার সৈন্য প্রত্যাহার করা উচিত ছিল। মেজর জেনারেল ফজল মুকিম ও ফরমান ভারতীয়দের এ যুক্তি সমর্থন করেছেন। ফরমান তার বই হাউ পাকিস্তান গট ডিভাইডেড’-এর ১১৩ পৃষ্ঠায় স্ববিরােধিতার পরিচয় দিয়েছেন এবং লিখেছেন, ‘তিনটি প্রতিরক্ষা ব্যুহ ছিল। তিনি আরাে লিখেছেন, ‘নদ-নদীর প্রতিবন্ধকতা পর্যন্ত এগিয়ে গিয়ে সৈন্য মােতায়েনের মাধ্যমে মধ্যবর্তী বৃত্তাকার প্রতিরক্ষা লাইন ও নিকটবর্তী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সংমিশ্রণ ঘটিয়ে পূর্ব পাকিস্তানকে ভালােভাবে রক্ষা করা যেত। এরপর শক্রর অগ্রাভিযানে বিলম্ব ঘটিয়ে ঢাকার নিকটবর্তী প্রতিরক্ষা অবস্থানে পিছু হটে আসা যেত।’ কমান্ডারদের ওপর ন্যস্ত দায়িত্বের ওপর সৈন্য মােতায়েন নির্ভর করছে। কিন্তু জেনারেল ফরমান আলী আমাদের প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা সম্পর্কে সমালােচনার সময় এ বিষয়টি বিবেচনায় আনেন নি। ফরমেশনগুলােকে তাদের অপারেশনের সীমানা নির্ধারণ করে দিতে হয়। প্রয়ােজন হলে অগ্রবর্তী প্রতিরক্ষা অবস্থানের (এফডিএল) সীমানাও চিহ্নিত করতে হয় । শক্রদের অগ্রযাত্রায় বিলম্ব ঘটানােতে আমার পরিকল্পনা সফল হয় এবং যশাের ছাড়া অন্যান্য শহর পরিত্যাগ না করেই আমরা শত্রুদের আটকে ফেলি অথবা থামিয়ে দেই। ফরমানের মধ্যবর্তী প্রতিরক্ষা লাইন এবং আমার শক্ত প্রতিরক্ষা লাইনের মধ্যে কোনাে বড় ধরনের পার্থক্য নেই।

ঢাকা বৃত্ত সম্পর্কে ফরমান

মেজর জেনারেল ফরমান তার বইয়ে লিখেছেন : “একজন পূর্ব পাকিস্তানির দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার করলে আমরা দেখব যে, এ প্রতিরক্ষা ধারণা ভয়াবহ যেখানে একজনকে একটি বিরাট অংশ অর্থাৎ পূর্ব। পাকিস্তানের একটি ব্যাপক অংশ শত্রুর কাছে সমর্পণ করতে হবে। বিশুদ্ধ রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও এ ধারণা সঠিক যে, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের জীবন, বাড়িঘর এবং মহিলাদের সন্ত্রম পশ্চিম পাকিস্তানিদের মতােই পবিত্র।” এখানে তিনি বুঝতে পারলেন যে, সীমান্ত থেকে সৈন্য প্রত্যাহার এবং ঢাকা ত্রিভুজ রক্ষায় তার নিজের মতবাদ নীতিগতভাবে অগ্রণযােগ্য। একথা স্বীকার করেও তিনি নির্লজ্জের মতাে তার ধারণাকে সমর্থন করছেন।

একটি বিশেষ সময়

অস্ত্রশস্ত্র, সৈন্যবল, বিমান ও নৌ শক্তিতে অধিকতর শক্তিশালী এবং স্থানীয় জনগণের সমর্থনপুষ্ট শক্রর মুখে সৈন্য প্রত্যাহার করা খুবই কঠিন কাজ। জেনারেল হেড কোয়ার্টার্স থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের নির্দেশ আসতে হতাে। ২১ নভেম্বর ভারতীয় হামলা শুরু হওয়ার পর সৈন্য প্রত্যাহার অসম্ভব হয়ে ওঠে। কারণ সৈন্যরা তখন ব্যস্ত ছিল যুদ্ধে। বিপরীতক্রমে, শান্তিকালীন পরিস্থিতিতেও কোনাে প্রকার বাধা ছাড়া রাজশাহী থেকে একটি ডিভিশনকে সকল সাজ-রঞ্জাম ও অস্ত্রশস্ত্রসহ ঢাকায় প্রত্যাহারে সময় লাগতে পনেরাে থেকে কুড়ি দিন। 

ঢাকার প্রতিরক্ষা

জেনারেল জামশেদ ছিলেন ঢাকা দুর্গের সার্বিক দায়িত্বে। ১৯৭১ সালের অক্টোবর। থেকে প্রতিরক্ষা ব্যুহ তৈরির কাজ শুরু হয়। ৭ ডিসেম্বর জেনারেল জামশেদের সভাপতিত্বে ঢাকার প্রতিরক্ষা পর্যালােচনায় একটি বৈঠক হয়। পূর্ব দিক থেকে তাৎক্ষণিক একটি হুমকির সম্ভাবনা ছিল। হিসাব করে দেখা যায় যে, ঢাকায় হামলার প্রস্তুতি গ্রহণে শক্রর অন্তত দু’সপ্তাহ সময় লাগবে। জেনারেল জামশেদ নতুন করে । দায়িত্ব বণ্টন করেন। ৩৬(এ) ডিভিশনের ৯৩(এ) ব্রিগেডকে মিরপুর ব্রিজ, ১৪ পদাতিক ডিভিশনকে নরসিংদী, ৯৩ (এ) ডিভিশনের বাদবাকি অংশকে নারায়ণগঞ্জ । এবং কর্নেল ফজলে হামিদের নৃেতৃত্বে ৩১৪(এ) ব্রিগেডকে মুন্সীগঞ্জের প্রতিরক্ষায়। নিয়ােজিত করা হয়। টঙ্গীসহ ক্যান্টনমেন্টের দায়িত্ব দেয়া হয় ব্রিগেডিয়ার কাসিমকে। ব্রিগেডিয়ার বশীর নগরীর প্রতিরক্ষার দায়িত্বে থেকে যান। মূল পরিকল্পনায় ঢাকা রক্ষার দায়িত্ব ন্যস্ত করা হয়েছিল ৫৩ ব্রিগেডের ওপর। জেনারেল হেড কোয়ার্টার্সের নির্দেশে ৫৩ ব্রিগেডকে বিদ্রোহ দমনে ঢাকার বাইরে সরিয়ে নেয়া হলে আমি ঢাকার প্রতিরক্ষার জন্য ফরমেশনগুলাের অতিরিক্ত সৈন্যদের নিয়ােজিত। করি।

আমি ৪টি স্তরে ঢাকার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার বিন্যাস ঘটিয়েছিলাম । (১২ নং মানচিত্র দেখুন)। পরিকল্পনা ছিল যে, সুরক্ষিত এলাকায় চূড়ান্ত যুদ্ধ হবে। শহরের । অভ্যন্তরে অথবা আশপাশে অবস্থান গ্রহণের মধ্য দিয়ে শহরগুলাে রক্ষার পরিকল্পনা। করা হয় না। যতটুকু দূরে সম্ভব ততটুকু দূরে শহরগুলাে রক্ষায় অবস্থান গ্রহণ করা। হয় যাতে শহরগুলাে শত্রুর গােলাবর্ষণের বাইরে থাকে। তবে সামরিক বিবেচনাকেই। অগ্রাধিকার দেয়া হয় এবং সর্বশেষ লড়াই হয় শহরের ভেতরে ও আশপাশে। পশ্চিম পাকিস্তানে আমরা ওয়াগাহ্, ঘাভিন্দি ও কাসুর এলাকায় সৈন্য মােতায়েন করে লাহাের রক্ষা করেছি। লাহরের ভেতরে কোনাে নিয়মিত সৈন্য রাখা হয় নি।

আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধে একটি প্রয়ােজনীয় দিক হচ্ছে, শত্রুকে তার সৈন্য চলাচল ও পরিবহনের সুযােগ না দেয়া। পাল্টা হামলা, শত্রুর অবস্থান অবরােধ, গেরিলা। কৌশল অবলম্বন এবং প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম প্রতিবন্ধকতার সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে এ লক্ষ্য অর্জন করা যেতে পারে। শত্রুকে সুরক্ষিত প্রতিরক্ষা অবস্থানে হামলা। চালানাের জন্য প্ররােচিত করার আগে তাকে দুর্বল করে দেয়া যেতে পারে এবং এরপর শত্রু ক্লান্ত বিশৃঙ্খল ও হতােদ্যম হয়ে পড়লে তার ওপর চূড়ান্ত আঘাত হানতে হবে। কোথাও অবস্থান নেয়ার সময় এ বিষয়গুলাে বিবেচনায় আনতে হবে যেন শক্রর ওপর চূড়ান্ত হামলা করা যায় । | প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান গ্রহণকালে শত্রুকে ধােকা দেয়ার কৌশল, হিসাব মতাে। কার্যকর গােলাবর্ষণ, নির্ভরযােগ্য যােগাযােগ এবং এক জায়গা থেকে আরেক । জায়গায় সৈন্য চলাচলের জন্য সুষম পকিল্পনাই হচ্ছে একমাত্র রক্ষাকবচ। প্রাকৃতিক। ও কৃত্রিম বাধাগুলাের উপযুক্ত ব্যবহার, সেনা-পরিচালনা, গােলাগুলি ও যােগাযােগ, সৈন্যদের যুদ্ধ করার আগ্রহ ও দক্ষ নেতৃত্বই যুদ্ধের ফলাফল নির্ধার করে। 

শক্রর সম্পদ ও অভিপ্রায় এবং আমার ওপর অর্পিত দায়িত্বের সীমারেখা বিবেচনায় রেখে আমি পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা প্রস্তুত করি। আমি আমার কমান্ডারদের শুধু শক্রর হামলা ব্যর্থ করার দায়িত্বই নয়, শত্রুকে আমাদের শক্ত অবস্থানের কাছে প্ররােচিত করে নিয়ে আসা এবং সেখানে তাদেরকে লড়াইয়ে। জড়িয়ে ফেলা এবং এভাবে শত্রুকে পরস্পরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন এবং ঢাকা থেকে দূরে রাখার দায়িত্ব অর্পণ করি।  ঢাকার আশপাশের এলাকা ছিল প্রতিরক্ষার জন্য খুবই উপযােগী। এটা ছিল অনেকটা ইংরেজি ‘ইউ’ অক্ষরের মতাে। ঢাকার দু’পাশে ও পেছনে নদী । নারায়ণগঞ্জ শহর হচ্ছে এই ইউ’র মধ্যে। এটি ঢাকা প্রতিরক্ষা লাইনের প্রশস্ততা বৃদ্ধি করেছে। এবং পেছনের দিক রক্ষা করছে। উত্তরাঞ্চলে রয়েছে চতুর্থ বাহু। এখানে কোনাে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা নেই। এ গােটা প্রতিরক্ষা এলাকার আশপাশে পুকুর, খাল-বিল ও বিচ্ছিন্ন ক্ষেত-খামার ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। এছাড়া রয়েছে ঘন গাছপালা ও সবজি ক্ষেত যেগুলাে প্রতিরক্ষা অবস্থানকে আড়াল করে। রাখতে সহায়তা দেয়। সিমেন্ট ও ইট পাওয়া না যাওয়ায় স্থানীয় মাল-মসল্লা দিয়ে বাংকার তৈরি করা হয়। অধিকাংশ বাড়িঘর পাকা হওয়ায় সেগুলােকে সুরক্ষিত অবস্থানে পরিণত করা সহজ ছিল। পারস্পরিক সহায়তাদানকারী অবস্থানগুলাের মধ্যে পর্যাপ্ত ফাক ছিল এবং ব্যাটালিয়ন থেকে ওপরের দিকে ফরমেশনগুলােতে রিজার্ভ সৈন্য রাখা হয় এবং এ প্রতিরক্ষা এলাকার অভ্যন্তরে চলাচলের সর্বোচ্চ সুবিধা ছিল।  অবস্থানগুলােতে কোথাও ছিল এক কোম্পানি সৈন্য, কোথাও বা এক ব্যাটালিয়ন। বিকল্প অবস্থান এবং শক্রর অবস্থানভেদ করার মতাে অবস্থানও তৈরি করা হয়। এক কথায় এটা ছিল একটি চৌকস প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা।

প্রতিরক্ষায় আমরা ব্যাপকভাবে গুপ্ত বন্দুকধারী (স্নাইপার) ব্যবহার করি। তাদের দায়িত্ব ছিল কমান্ডার ও তাদের সিগনালারদের তুলে নিয়ে আসা। কমান্ডার আক্রান্ত হলে হামলায় বিপর্যয় ঘটতে পারে। একইভাবে, সিগনালার আক্রান্ত হলে সিনিয়র ও জুনিয়র অফিসারদের সঙ্গে কমান্ডারের যােগাযােগ ব্যাহত হয়।  আমার উভয় পার্শ্ব থেকে প্রয়ােজনের ক্ষেত্রে ক্ষতিসাধন হামলার জন্য সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্রও ব্যবহার করি। পরিকল্পনা করা হয়, আক্রমণকারী ইউনিট বা সাবইউনিটগুলাে আকস্মিকভাবে আক্রান্ত হলে পিছিয়ে আসবে। পার্শ্বদেশ থেকে গােলাগুলিতে ক্ষতিগ্রস্ত না হলে আক্রমণকারী সৈন্যরা তাদের লক্ষ্যস্থলে এগিয়ে যাবে। এ লক্ষ্যস্থলে পরিকল্পনা অনুযায়ী আক্রমণকারী সৈন্যরা আর্টিলারি ও মর্টারের গােলাবর্ষণ অব্যাহত রাখবে। শত্রুরা আমাদের পরিখায় পৌছে গেলে আমরা আমাদের নিজেদের আর্টিলারি ও মর্টারের সাহায্যে আমাদের নিজস্ব পরিখায় গােলাবর্ষণ করব। আমাদের সৈন্যদের তাতে কোনাে ক্ষতি হবে না। কারণ তাদের মাথার ওপরে থাকবে দুর্ভেদ্য আচ্ছাদন। হতাহত হবে কেবল শত্রুপক্ষ। আমাদের গােলাবর্ষেণেও শক্ররা জীবিত থাকলে আমরা বেয়নেটের সাহায্যে পাল্টা হামলা চালিয়ে তাদেরকে উচ্ছেদ অথবা ধ্বংস করব। আমাদের বেয়নেট চার্জ বরাবরই সফল হয়েছে।

মরুময় অথবা উন্মুক্ত দেশের মতাে পূর্ব পাকিস্তানের কোনাে সমান্তরাল রেখায় প্রতিরক্ষা অবস্থানগুলাে গড়ে তােলা হয়নি। সর্পিল রেখায় একটি বৃত্তাকারে প্রতিরক্ষা অবস্থানগুলাে বিন্যাস করা হয়। এগুলাে ছিল অনেকটা জালের গ্রন্থির মতাে। প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা এবং ভৌগলিক কারণে ঢাকার বাইরে মধ্যবর্তী প্রতিরক্ষা লাইনে শত্রুকে ট্যাংকের সমর্থনপুষ্ট হয়ে অন্তত এক কোম্পানি সৈন্য নিয়ে অধিকাংশ হামলা চালাতে হতাে। অনুরূপভাবে গােলন্দাজ সহায়তা নির্দিষ্ট অবস্থান পর্যন্ত সীমিত থাকতাে। আমাদের সৈন্যদের মাথার ওপরে শক্ত আচ্ছাদন থাকায় কামানের গােলাবর্ষণ কার্যকর হতাে না। ঘটনাক্রমে শত্ৰু কোনাে অবস্থান দখল করে নিলেও তারা গভীরে প্রবেশ করতে পারত না। কারণ অব্যবহিত পেছনের অবস্থান অথবা পার্শ্ববর্তী অবস্থানে এসে তাদেরকে থেমে যেতে হতাে। আমরা চোরা ফাঁদ, বাঁশের ফলা ও খাদের ব্যাপক ব্যবহার করেছিলাম। আমাদের অবস্থানের সামনে ও আশপাশের কিছু কিছু এলাকা প্লাবিত করা হয় এবং প্রয়ােজন হলে আরাে এলাকা প্লাবিত করার ব্যবস্থা রাখা হয়। এটা ছিল শত্রুর ট্যাংক, যানবাহন ও পদাতিক সৈন্যের বিরুদ্ধে একটি উত্তম প্রতিরােধক। অবস্থানগুলাে আড়াল করে রাখা হয় এবং ধোকা দেয়ার জন্য নকল ট্যাংক, যানবাহন ও অস্ত্রশস্ত্রের অবস্থান প্রস্তুত করা হয়। বুলডােজার, ট্রাক্টর, ট্রাক, ট্রলি, ওয়াগান, জিপ ও নৌকা সংগ্রহ করা হয় এবং বালির বস্তা দিয়ে সেগুলােকে ভ্রাম্যমান শক্ত ঘাঁটিতে পরিণত করা হয়। এগুলােকে প্রতিরক্ষা অবস্থানগুলােয় যে কোনাে ফাঁক-ফোকর পূরণ, প্রয়ােজনে যে কোনাে এলাকার শক্তি বৃদ্ধি, পাল্টা হামলা এবং পাল্টা অনুপ্রবেশে সৈন্য পরিবহনে ব্যবহার করা যেত। এছাড়া, রসদ সরবরাহ এবং হতাহতদের অপসারণের কাজে লাগানাে। যেত। আমাদের গােলাবারুদ ও রেশন এবং ক্ষুদ্র অস্ত্রশস্ত্রের কোনাে অভাব ছিল না। টঙ্গী-ডেমরা এলাকায় আমাদের একটি দুর্বল ট্যাংক স্কোয়াড্রন মােতায়েন ছিল। আমাদের পর্যাপ্ত তিন ইঞ্চি ব্যাসের মর্টার, প্রচুর ১০৬ রিকয়েললেস রাইফেল, সিক্স পাউন্ডারগান এবং বিপুল পরিমাণ ট্যাংক-বিধ্বংসী স্বল্পপাল্লার অস্ত্র ছিল। এছাড়া, আমাদের একটি এএ রেজিমেন্টও ছিল।  আমার প্রচুর সিনিয়র এনসিও, জেসিও অফিসার ছিল, সুতরাং আমার কমান্ড কাঠামাে ছিল খুবই ভালাে অবস্থায়। উদাহরণস্বরূপ, জিসিও (জুনিয়র কমিশন্ড অফিসার)-গণ সেকশন এবং সেকেন্ড-ইন কমান্ড হিসেবে লেফটেন্যান্টসহ ক্যাপ্টেনগণ প্লাটুনের নেতৃত্বে ছিলেন। আমি ছাড়া আরাে তিনজন মেজর জেনারেল, একজন এ্যাডমিরাল, একজন এয়ার কমোেডর এবং বেশ কয়েকজন ব্রিগেডিয়ার ছিলেন। মােটের ওপর, দুর্ভেদ্য না হলেও ঢাকায় আমার প্রতিরক্ষা ছিল খুবই শক্তিশালী এবং এখানে একটি আদর্শ প্রতিরক্ষা অবস্থানের সব উপাদান বিদ্যমান ছিল। চারটি বিন্যাসে ঢাকার প্রতিরক্ষা পুনর্গঠন করা হয়। সেগুলাে হচ্ছে :

বাইরের প্রতিরক্ষা

(১) বেড়া-পাবনা লাইন ১৬ ডিভিশন।

(২) মধুমতী রিভার লাইন ৯ ডিভিশন।

(৩) পুরনাে ব্ৰহ্মপুত্র লাইন ৯৩ ব্রিগেড।

(৪) আশুগঞ্জ-দাউদকান্দি-চাঁদপুর লাইন ১৪/৩৯ ডিভিশন।

মির্জাপুর-জয়দেবপুর-নরসিংদী ও মানিকগঞ্জ লাইনভিত্তিক ঢাকা ত্রিভুজ। ঢাকা নগরীর বহিঃস্থ প্রতিরক্ষা সাভার, মিরপুর, টঙ্গী, ডেমরা ও নারায়ণগঞ্জ লাইন। ক্যান্টনমেন্ট ও নগরীর সুরক্ষিত এলাকা।

ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে ঢাকা প্রতিরক্ষার জন্য নিম্নোক্ত সেনাদের পাওয়া যায় : এডহক স্কোয়াড্রন অভ ট্যাংকস

৫০ আর্টিলারি (৬ এলএএ রেজিমেন্ট, প্রচুর গােলাবারুদসহ সব কামান অক্ষত, হেড কোয়ার্টার্স আর্টিলারি)

৭০০ ইঞ্জিনিয়ার্স (বিভিন্ন ইউনিটের পশ্চাঙ্গ রক্ষাকারী পক্ষ, এক ব্যাটালিয়ান হিসেবে হেড কোয়ার্টার্স ইঞ্জিনিয়ার্স।

৫০০ সিগনাল (৩ ব্যাটালিয়ন ইউনিট)

২,০০০ পদাতিক (৩১ বালুচ, ৩৩ পাঞ্জাব, সাবেক ৯৩ (এডহক। ব্রিগেড, দুই কোম্পানি কম একটি কমান্ডাে ব্যাটালিয়ন) ৪,৫০০ মাগুরা সেক্টরের জন্য সৈন্য

| ৯০০ সার্ভিসেস (অস্ত্র ও সরবরাহ প্রতিষ্ঠা ওয়ার্কসপ)

১,০০০ নেভি (মেরিনস)।

৫০০ এয়ার কমান্ডাে (পিএএফ)

৫০০ ইপকাফ

৪,৫০০ মুজাহিদ

১,৫০০ রাজাকার

৭০০ পশ্চিম পাকিস্তানি পুলিশ

২,৫০০ শিল্প নিরাপত্তা সেনা

১,৫০০ ইস্টার্ন কমান্ড ও ৩৬ ডিভিশনের সদর দপ্তর

৯,০০০

৩০,৩৫০ ঢাকা সেক্টরের দায়িত্বে ছিলেন মেজর জেনারেল জামশেদ, যিনি ছিলেন একজন সাহসী জেনারেল। তিনি দুটি মিলিটারি ক্রস ও সিতারা-ই-জুরাত পদক লাভ করেন। প্রতিটি অক্ষ দেখাশােনা করতেন একজন ব্রিগেডিয়ার। সাব-ইউনিটগুলাে কমান্ড করতেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল এবং প্লাটুনগুলাে মেজর অথবা ক্যাপ্টেন।

শত্রুরা ঢাকা পৌছার আগে ১৩/১৪ ডিসেম্বরের মাঝরাতে আমরা আত্মসমর্পণের নির্দেশ পাই। ১৬ ডিসেম্বর দুপুরে শক্রর প্রথম দলটি আমাদের সঙ্গে যােগাযােগ করে। এ সময় আত্মসমর্পণের খুঁটিনাটি বিষয় চূড়ান্ত করা হচ্ছিল। ঢাকায় হামলা চালাতে শত্রুদেরকে আরাে দু’সপ্তাহ প্রস্তুতি নিতে হতাে। ভারতীয়রাই এ কথা স্বীকার করেছে। আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেয়া না হলে আমি দীর্ঘদিন ঢাকা রক্ষা করতে পারতাম।

ভারতীয়রা এতাে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে ছিল, এত বাজেভাবে সম্পৃক্ত ছিল যে, তারা কোনাে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় জড়াে হওয়ার মতাে অবস্থায় ছিল না। ভৈরব সেতু আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকায় তারা ট্যাংক ও কামান আনতে পারছিল না। ঢাকার কাছে তাদের প্রায় সাড়ে চার ব্রিগেড সেনা ছিল। তবে তাদের কোনাে ট্যাংক ও কামান ছিল না। সুতরাং ঢাকার সঙ্গে তাদের মােকাবিলা করার কোনাে আশা ছিল । । যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে ভারতীয়রা আমাদের হাতে চরমভাবে নাজেহাল হতাে।

ভারতীয় পরিকল্পনা এবং তার বাস্তবায়ন ভারতীয় সামরিক পরিকল্পনা সঠিক মূল্যায়নের ভিত্তিতে নয়, আগে থেকে অনুমানের ভিত্তিতে প্রণয়ন করা হয়। তাদের পরিকল্পনায় অসংখ্য ত্রুটি-বিচ্যুতি ও ভুল-ভ্রান্তি ছিল। তারা ভূ-প্রকৃতি, যােগাযােগ ব্যবস্থা এবং পাকিস্তানি সৈন্যদের লড়াই করার সামর্থ্য বিবেচনায় আনতে ব্যর্থ হয়। স্থানীয় জনগণের পূর্ণ সমর্থন, স্থানীয় সম্পদের ওপর পূর্ণ আধিপত্য, আমাদের সম্পর্কে সর্বশেষ তথ্য, অনুকূল পরিবেশ এবং সবকিছুতেই শ্রেষ্ঠত্ব থাকায় তারা তাদের লড়াই করার সামর্থ্য এবং দ্রুত বিজয় অর্জনে তাদের সম্ভাবনা সম্পর্কে অতি আশাবাদী হয়ে ওঠে।

তাদের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক পরিকল্পনা ছিল তাদের সামরিক পরিকল্পনা এবং এর বাস্তবায়নের চেয়ে অনেক বেশি অগ্রসর। মিসেস গান্ধী পাকিস্তানকে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে সক্ষম হন। তিনি শরণার্থী সমস্যাকে কার্যকরভাবে ব্যবহার করেন এবং রাশিয়ার সঙ্গে একটি প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষর করেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া পশ্চিম রণাঙ্গনে অদূরদর্শীভাবে ভারতের ওপর হামলা শুরু করলে ইন্দিরা গান্ধী প্রকাশ্যে রাশিয়াকে ভারতের পক্ষে যুদ্ধে অংশগ্রহণে সফল হন। রুশরা বিশেষ টহল বিমান, অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ও বিষাক্ত গ্যাস ব্যবহার করে। | ভারতের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দ্বি-জাতি তত্ত্বকে ভুল প্রমাণ করা। ভারতীয়রা তিনটি পর্যায়ে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় তাদের তৎপরতা পরিচালনা করে। সেগুলাে হচ্ছে :

১) বিদ্রোহ

২) পরােক্ষ যুদ্ধ

৩) প্রকাশ্য যুদ্ধ 

বিদ্রোহ আমাদের সৈন্যদের বিশৃঙ্খল ও ক্লান্ত করার লক্ষ্যে ভারতীয়রা ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট। ও ইপিআর-এর বিদ্রোহে সমর্থন দেয়। প্রাথমিকভাবে তারা বিদ্রোহ উস্কে দিতে সফল হয়। তবে তা ছিল ক্ষণস্থায়ী। তাদের পরিকল্পনায় ত্রুটি থাকায় তা ব্যর্থ হয়। তারা আমাদের সামর্থ্য, দৃঢ়তা ও প্রস্তুতিকে অবজ্ঞা করে। কমান্ড গ্রহণ করার পর।

আমি ক্ষিপ্র আক্রমণ ও উপর্যুপরি অভিযানের মাধ্যমে বিদ্রোহী ও গেরিলাদের উচ্ছেদ করার নির্দেশ দেই। দু’মাসের মধ্যে আমরা পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্ত পুনরুদ্ধার এবং বিদ্রোহীদের ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য করি । ১৯৭১-এর মে মাসে আমরা ফিরে আসি স্বাভাবিক অবস্থায়।

পরােক্ষ যুদ্ধ

বিদ্রোহ তৎপরতা ব্যর্থ হওয়ায় ভারতীয়রা বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় একটি ভূখণ্ড দখলের পরিকল্পনা করে। ওদের একজন জেনারেল মন্তব্য করেন যে, প্রতিটি গেরিলা একজন করে সৈন্য হত্যা করলে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ধ্বংস হয়ে যাবে। ভারতীয় বাহিনী ও মুক্তিবাহিনী বেসামরিক লােকজনের ছদ্মাবরণে বহু নাশকতামূলক। তৎপরতা চালিয়েছে এবং রাস্তাঘাট ও রেল যােগাযােগ ধ্বংস করেছে। এছাড়া, তারা আড়াই হাজার মাইলব্যাপী সীমান্ত বরাবর সীমান্তের ওপার থেকে গােলাবর্ষণ করে বিদ্রোহীদের সমর্থন দিয়েছে এবং ফরমেশন আকারে হামলা চালিয়েছে। বিলােনিয়ায় এক বিগ্রেড ভারতীয় সৈন্যের হামলা ব্যর্থ করে দেয়া হয়। তাদের হামলায় আবার বিশৃঙ্খলা ও সমন্বয়হীনতা দেখা দেয়। তারা সুশৃংখলভাবে হামলা চালালে এবং তাদের অভিযান সুসমন্বিত হলে আমাদের প্রচুর প্রাণহানি ঘটতাে। বস্তুত, নভেম্বরের মধ্যে ভারতের পরােক্ষ যুদ্ধ নিঃশেষ হয়ে যায়।

প্রকাশ্য যুদ্ধ

ভারতের সামরিক পরিকল্পনায় সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীকে সমন্বিত করা হয়। আমাদের কোনাে নৌবাহিনী না থাকায় এবং বিমান বাহিনীর এক স্কোয়াড্রন পুরনাে এফ-৮৬ অকেজো হয়ে যাওয়ায় ভারতীয় নৌ ও বিমান বাহিনীর কোনাে করণীয় ছিল না। তবে ভারতীয় নৌ ও বিমান বাহিনী স্থল যুদ্ধে সহায়তা দিয়েছে প্রচুর। এছাড়া, তাদের বিমান বাহিনী ফেরি, ক্ষুদ্র সেতু ও নৌকা ধ্বংসে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেছে। মূলত এ লড়াই ছিল স্থলযুদ্ধ। এ যুদ্ধে ভারতের ১২টি পদাতিক ডিভিশন অংশগ্রহণ করে। নভেম্বরের শুরুতে সৈন্য মােতায়েনে ভারতের প্রকাশ্যে যুদ্ধের অভিপ্রায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তবে সৈন্য মােতায়েন যুদ্ধে কোনাে অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। তাদের পরিকল্পনা ছিল সকল অনুপ্রবেশ পথে বহিঃস্থ লাইনে চারদিক থেকে এগিয়ে আসা। এতে তারা যুদ্ধের একটি নীতি লংঘন করে। তারা একমাত্র প্রধান সড়ক এবং উত্তর থেকে দক্ষিণ ও পূর্ব থেকে পশ্চিমে একমাত্র রেলপথের সীমাবদ্ধতা আমলে আনে নি। এছাড়া, তাদের পার্শ্বভাগ রক্ষার এবং এক সেক্টর থেকে আরেক সেক্টর অথবা এক সাব-সেক্টর থেকে আরেক সাব-সেক্টরে চলাচলের কোনাে সামর্থ্যও ছিল না। তারা দৃশ্যত এলাকায় ভৌগলিক অবস্থাও অগ্রাহ্য করেছিল । দু’টি ক্ষেত্রে এলাকার ভৌগলিক অবস্থা আক্রমণকারীদের পক্ষে ছিল। এক, নদী এবং আরেক হচ্ছে ঢাকা অভিমুখী ময়মনসিংহ সড়ক। পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় সব নদ-নদীর উৎসই হচ্ছে ভারত। সুতরাং হেলিকপ্টারে করে ভারতীয়দের নদী পাড়ি দেয়ার প্রয়ােজন ছিল না। তারা নিজেদের ভূখণ্ড থেকে রওনা দিয়ে সােজা পূর্ব পাকিস্তানের গভীর অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে পারতাে। এছাড়া তারা উত্তর দিকের। বিপদমুক্ত মহাসড়ক ধরেও এগিয়ে আসতে পারতাে। কিন্তু এ দু’টি সুযােগ তারা। কাজে লাগায় নি। লক্ষ্য বজায় রাখা হচ্ছে যুদ্ধের একটি অন্যতম মূল নীতি এবং ভৌগলিক অবস্থা হচ্ছে একটি মুখ্য উপাদান। ভারতীয়দের প্রতি স্থানীয় সমর্থন ছিল পর্যাপ্ত। মুক্তিবাহিনী তাদেরকে রাস্তাঘাট চিনিয়ে দিয়েছে এবং আমাদের ব্যাংকারসহ যাবতীয় প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা সম্পর্কে তথ্য সরবরাহ করেছে। ভারতীয় অফিসারদের বেসামরিক লােকের ছদ্মবেশে এলাকা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখানাে হতাে এবং আমাদের অবস্থান চিনিয়ে দেয়া হতাে। এটা খুবই বিস্ময়কর যে, সকল গােয়েন্দা তথ্য অবগত হওয়ার পরও তারা একটি প্রচলিত লড়াইয়ে ভুল করেছে। ভৌগলিক অবস্থা, প্রাকৃতিক বাধা-বিপত্তি, সীমিত চলাচল এবং পশ্চাদপসরণের সম্ভাব্য এলাকা অথবা আমাদের অবস্থান এড়িয়ে যাওয়ার প্রতি চরম অবজ্ঞা প্রদর্শন করেছে। আমাদের লড়াই করার সামর্থ্য সম্পর্কে তাদের চিন্তা করা উচিত ছিল। তারা প্রথমে আঘাত হেনেও ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে জিততে পারে নি।

তখন বেশ কয়েকটি জায়গায় তারা তাদের পছন্দসই অবস্থানে থেকে লড়াই করেও সুবিধা করতে পারে নি। আমরা তাদেরকে বিআরবি ও চৌবিন্দায় থামিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলাম এবং লাহাের ও শিয়ালকোটে তাদেরকে বিজয়ী হতে দেই নি। পূর্ব পাকিস্তানে বিদ্রোহকালে তারা । আমাদের সঙ্গে লড়াই করছিল এবং আমাদের সামর্থ্য সম্পর্কে জানতাে। পূর্ব পাকিস্তানে আমরা তাদের সমর্থনপুষ্ট বিদ্রোহীদের বিজয়ী হতে দিই নি এবং সীমান্তে আমরা তাদের হামলা ব্যর্থ করে দিয়েছি। তারা ধারণা করেছিল যে, আমার সৈন্যরা। ক্লান্ত। তাই তারা দৃঢ় প্রতিরােধ গড়ে তুলতে পারবে না। এ হিসাব থেকে ভারতীয়রা। ভেবেছিল যে, সংখ্যা ও অস্ত্রশস্ত্রের শ্রেষ্ঠত্বের কারণে তারা বিনা যুদ্ধে জয়লাভ করবে। কিন্তু তাদের হিসাব ভুল প্রমাণিত হয়। আমার সৈন্যরা বীরােচিত। প্রতিরােধের মাধ্যমে ব্যর্থ করে দেয় তাদের হামলা । এ ব্যর্থতার জন্য আমি তাদের পকিল্পনায় ত্রুটি, অদক্ষ যুদ্ধ পরিচালনা এবং উদ্যোগের অভাব ও অনমনীয়তাকে দায়ী করবাে। সমন্বিত ও কেন্দ্রীভূত প্রচেষ্টার ঘাটতি এবং বেপরােয়াভাবে গােলাবর্ষণ না করায় ভ্রাম্যমাণ হামলায় তাদের দুর্বলতা প্রকট হয়ে ওঠে। আমি তাদের অদক্ষ নেতৃত্ব, দুর্বল পরিকল্পনা, অতি সতর্ক পদক্ষেপ ও দোদুল্যমানতার সুযােগ দিয়েছি। তাদের এ দুর্বলতার জন্য আমার কমান্ডারগণ তাদের অবস্থান পুনর্বিন্যাস করতে। 

পেরেছেন এবং সর্বত্র তাদের হামলা ব্যর্থ করে দিতে সক্ষম হয়েছেন।  তাদের অতি সতর্কতা এবং দ্রুতগতিতে এগিয়ে এসে আমাদেরকে বিচ্ছিন্ন অথবা এড়িয়ে যেতে ব্যর্থতা দেখে মনে হচ্ছিল যে, তারা যুদ্ধের বই-পুস্তকে বর্ণিত দিকনির্দেশনা অনুযায়ী যুদ্ধ করছিল। তাদের পরিকল্পনা ছিল আমাদের কাছে স্পষ্ট। অরােরার ঝুঁকি নেয়ার কোনাে মানসিকতা ছিল না। তিনি তার সৈন্যদেরকে দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাবার নির্দেশ দিতেও কুণ্ঠিত হন। এজন্য তার বিশৃঙ্খলা ও অসামঞ্জস্যপূর্ণ প্রচেষ্টাকে গুঁড়িয়ে দিতে আমাদের বেগ পেতে হয় নি। তিনি দক্ষতার সঙ্গে তার সৈন্য চলাচলের সুবিধা ও গােলাবর্ষণকে কাজে লাগাতে ব্যর্থ হন। এজন্য। আমাদের সকল সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আমরা তাদের অগ্রযাত্রা ব্যাহত করে দিতে সক্ষম হই। | প্রথম অভিজ্ঞতার পরই সাধারণত পরিকল্পনায় পবিরর্তন আনার অথবা পর্যালােচনা করার প্রয়ােজন দেখা দেয়। মূল পরিকল্পনা ব্যর্থ হলে প্রতিটি কমান্ডার বিকল্প পরিকল্পনা তৈরি করে। আমরা প্রতিরােধমূলক ভূমিকা পালন করেছি এবং সীমান্ত থেকে পেছনের পরবর্তী প্রতিরােধমূলক অথবা আত্মরক্ষামূলক অবস্থানে আমাদের সৈন্য প্রত্যাহারে কোনাে ঝামেলা হয় নি। আমরা এ ক্ষেত্রে কোনাে বিপর্যয়ের মুখােমুখি হই নি। আমরা প্রতিটি মধ্যবর্তী অবস্থানে ভারতীয়দের অগ্রযাত্রা ব্যাহত করে দিতে সক্ষম হই। প্রথম অভিজ্ঞতার পরই সাধারণত পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনার অথবা পর্যালােচনা করার প্রয়ােজন দেখা দেয়। মূল পরিকল্পনা ব্যর্থ হলে প্রতিটি কমান্ডার বিকল্প পরিকল্পনা তৈরি করেন। আমরা প্রতিরােধমূলক ভূমিকা পালন করেছি এবং সীমান্ত থেকে পেছনের পরবর্তী প্রতিরােধমূলক অথবা আত্মরক্ষামূলক অবস্থানে আমাদের সৈন্য প্রত্যাহারের কোনাে ঝামেলা হয় নি। আমরা এক্ষেত্রে কোনাে বিপর্যয়ের মুখােমুখি হই নি। আমরা প্রতিটি মধ্যবর্তী অবস্থানে ভারতীয়দের অগ্রযাত্রায় বাধা দিতে এবং তাদের থামিয়ে দিতে সফল হয়েছি। উদ্ভূত পরিস্থিতি মােকাবেলায় ভারতীয়দের কোনাে বিকল্প পরিকল্পনা ছিল না। তারা একটি নির্দিষ্ট পথ ধরে অগ্রসর হচ্ছিল এবং আমাদের অবস্থান এড়িয়ে যাবার পরিবর্তে বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থানের মুখােমুখি হয়ে পড়ে। যুদ্ধে তাদের যেসব সুযােগ ছিল সেগুলাে তারা কাজে না লাগিয়ে বরং তারা আমাদের তৎপরতার প্রতি। প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছিল। আমাদের বাহিনীকে ধ্বংস করার পরিবর্তে তারা ভূখণ্ড দখলের ওপর জোর দিচ্ছিল। তবে তারা ভূখণ্ড দখল চরমভাবে ব্যর্থ হয়। আমরা স্বেচ্ছায় কৌশলগত কারণে যশোের ও ময়মনসিংহ থেকে পিছু হটে এসেছি।

এজন্য এ দুটি শহরে ভারতীয়রা প্রবেশ করতে পেরেছে। এছাড়া, আর কোনাে শহর তারা দখল করতে পারে নি। প্রতিটি সেক্টরে আমরা তাদেরকে থামিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছি। বস্তুতপক্ষে, ঢাকা আক্রমণের যখন সুযোগ ছিল তখন তাদের হাতে ছিল মাত্র ৪টি দুর্বল ব্রিগেড। বাদবাকি ভারতীয় সৈন্যরা আমাদের সুরক্ষিত ও সুসজ্জিত অবস্থানের বিরুদ্ধে বিক্ষিপ্ত লড়াইয়ে জড়িত ছিল। অরােরার চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল ঢাকা দখল। কিন্তু তিনি সময়মতাে তার সৈন্যদের ঢাকা দখলে নিয়ে আসতে পারেন নি। প্রকৃতপক্ষে, এ পর্যায়ে ঢাকা ছিল অত্যন্ত সুরক্ষিত যা ছিল দুর্ভেদ্য। এ পরিস্থিতিতে ঢাকা দখল করতে হলে ভারতীয়দেরকে তাদের সকল সৈন্য একত্রিত করতে হতাে। তবে ঢাকা দখল করতে হলে ভৈরব বাজার ও নারায়ণগঞ্জে আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যুহকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। ঢাকা ছিল কেন্দ্রবিন্দু। সুতরাং ঢাকা দখল করতে হলে তাদের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা কেন্দ্রীভূত করতে হতাে। কিন্তু তাদের লক্ষ্য ছিল অন্যান্য শহর দখল করা। এজন্য এসব শহর দখলে তারা তাদের সৈন্যদের নিয়ােজিত করে। ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মানেকশ যথার্থই বলেছিলেন যে, জেনারেল অরােরা জার্মান সেনাধ্যক্ষ মার্শাল রােমেল নন। কারণ রােমেল অথবা অন্য যে কোনাে দক্ষ জেনারেল শেয়ারপাংকট’ (মূল প্রচেষ্টার কেন্দ্র বিন্দু) চিহ্নিত করতেন। | ভারতীয়রা দুই ডিভিশনের বেশি সৈন্য নিয়ে তাদের দ্বিতীয় কোর গঠন করে। এ কোর জেনারেল রায়নার নেতৃত্বে যশােরের বিপরীতে অবস্থান করছিল এবং তাদেরকে ঢাকা দখলের দায়িত্ব দেয়া হয়। জেনারেল থাপনের নেতৃত্বাধীন ৩৩ তম কোরকে রংপুর-বগুড়া ও রাজশাহী, জেনারেল সগৎ সিংয়ের নেতৃত্বাধীন চতুর্থ। কোরকে সিলেট, কুমিল্লা, ময়নামতি ও চাঁদপুর, কে (কিলাে) ফোর্সকে পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং চট্টগ্রামের প্রতি হুমকি সৃষ্টি, দুটি ব্রিগেড এবং মুক্তিবাহিনীর আরাে একটি ব্রিগেড নিয়ে গঠিত ১০১ তম কমিউনিকেশন জোনকে ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল ও ঢাকা দখলের দায়িত্ব দেয়া হয়। জেনারেল অরােরা তার বিশাল বাহিনীকে ৪টি অংশে বিভক্ত করেন এবং প্রত্যেক অংশের ওপর পূর্ব পাকিস্তানের ৪টি বেসামরিক বিভাগের দায়িত্ব অর্পণ করেন। এটুকু করেই তিনি তার দায়িত্ব শেষ করেন। তিনি ছিলেন যুদ্ধে নীরব দর্শক। তিনি কোথাও কোনাে লড়াইয়ের তীব্রতা বৃদ্ধি অথবা ঢাকায় তার সৈন্যদের অগ্রাভিযান ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে কোনাে রিজার্ভ ইউনিট অথবা ফরমেশন পাঠানাের জন্য খুঁজে পান নি। | ২০ ভারতীয় ডিভিশনের কমান্ডার মেজর জেনারেল লক্ষ্মণ সিং বলেছেন, ঈদের দিন হওয়ায় ২১ নভেম্বর ডি-ডে’র তারিখ এগিয়ে আনা হয়। ভারতীয়রা সেদিন সকল দিক থেকে আক্রমণ শুরু করে। আমরা তাদের মােকাবেলা করার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত ও তৈরি ছিলাম। ২২ নভেম্বর যশাের সেক্টরে তিনটি বিমান হারানাে ছাড়া ৩ | ডিসেম্বর পর্যন্ত আমরা কোনাে উল্লেখযােগ্য ভূখণ্ড হারাই নি। আমাদের সৈন্যরা অত্যন্ত নৈপুণ্যের সঙ্গে লড়াই করে এবং সীমান্ত বরাবর ভারতীয় হামলাগুলাে। প্রতিহত করে। সীমান্ত এলাকায় তাদের লড়াই সীমিত হয়ে পড়ে এবং তাদেরকে। পিছু হটতে হয়।

রংপুর-হিলি-বগুড়া-রাজশাহী সেক্টর

এ এলাকা দেশের শস্যবহুল অঞ্চল বরাবর প্রসারিত। ভূমি অনেকটা পাঞ্জাবের মতাে। ট্যাংক ও ভ্রাম্যমাণ যুদ্ধের জন্য উত্তম। জেনারেল অরােরা এখানে ৩৩ কোর । মােতায়েন করেন। এ কোরে ছিল দুটি ডিভিশন, একটি স্বতন্ত্র ব্রিগেড, মুক্তিবাহিনীর। আরাে ৩টি ব্রিগেড, একটি সাজোয়া রেজিমেন্ট ও বেশ কয়েকটি বিএসএফ। ব্যাটালিয়ন। জেনালের অরােরা হিলিতে বড় ধরনের হামলা করার পরিবর্তে দিনাজপুর-রংপুরে ৬ মাউন্টেন ডিভিশন মােতায়েন করেন। এখানে আমাদের একটি। ব্রিগেড এ ডিভিশনকে আটকে রাখে। অরােরা যেখানে একটি ডিভিশন মোতায়েন করেছিলেন সেখানে তিনি বিএসএফ ও মুক্তিবাহিনীর সহায়তায় কয়েক ব্যাটালিয়ন। সৈন্য মােতায়েন করলেই পারতেন। তিনি সাজোয়া বাহিনীর পূর্ণাঙ্গ সমর্থনে। আমাদের ২০৫ ব্রিগেডের বিরুদ্ধে দুটি ডিভিশন নিয়ে ব্যাপক হামলা চালালে হিলিতে আমরা ১৯ দিন টিকে থাকতে পারতাম না। আমি ৭ দিনের মাথায় সীমান্ত থেকে ৪০ মাইল দূরে বগুড়ায় সৈন্য প্রত্যাহারের কথা বিবেচনা করেছিলাম। ২০৫। ব্রিগেডের অবস্থান পুনর্বিন্যাস করে উত্তরে শক্রর ট্যাংক হামলা সাফল্যের সঙ্গে প্রতিহত করা হয়। | ষােড়শ ডিভিশনের সৈন্যরা শত্রুর অগ্রযাত্রায় বিলম্ব ঘটানাের প্রচেষ্টায় সফল হয়। এবং যুদ্ধ শুরুর ২৫ দিন পর ১৫ ডিসেম্বর শত্রুরা বগুড়ায় আমাদের প্রতিরক্ষা অবস্থান অবধি পৌছতে সক্ষম হয়। ভারতের ৩৩ কোরের অগ্রযাত্রার গড় হার ছিল । দৈনিক দু’মাইলেরও কম। ভারতীয়রা এটাকে ‘বঘ্ন অভিযান’ বলে আখ্যায়িত করছে। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না যে, সিরাজগঞ্জ ও বাহাদুরাবাদ ঘাট (ঢাকা। পৌছার প্রধান ফেরি স্টেশন ও রেল জংশন) ভারতীয়দের নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়া। সত্ত্বেও অরােরা অথবা থাপন কেন ঢাকা এগিয়ে এলেন না। তারা হিলি, বগুড়া, দিনাজপুর ও সৈয়দপুর দখল করে কি লক্ষ্য অর্জন করতে পারতেন? তাদের তৎপরতার ফলে উত্তর দিকে ২০ ডিভিশনের পার্শ্বদেশ উন্মােচিত হয়ে। পড়ে এবং ততটুকু পর্যন্ত বিস্তৃত তাদের যােগাযােগ লাইন বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আমি  এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য ও সিএএফ-এর সাহায্যে ভারতের ৬ মাউন্টেন ডিভিশনকে। বাধা দান ব্রিগেডের সাহায্যে হামলা চালানাের একটি পরিকল্পনা তৈরির জন্য আমার স্টাফকে নির্দেশ দিয়েছিলাম। স্থির করা হয় যে, ১০৭ ব্রিগেড ভারতের ২০ ডিভিশনের পশ্চাৎভাগে হামলা চালাবে এবং সর্বোচ্চ ক্ষতিসাধন করবে আমি ।  

নিশ্চিত যে, যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে ৯ ডিভিশন থেকে ব্রিগেডিয়ার মঞ্জুরের ব্রিগেড এসে পৌছুলে জেনারেল নজর ভারতের ২০ ডিভিশনের এক বিরাট অংশ ধ্বংস করে দিতে পারতেন। ভারতীয় পত্র-পত্রিকাগুলাে জেনারেল থাপনের তীব্র সমালােচনা করেছে। তার পদোন্নতি ঘটার পরিবর্তে পদাবনতি ঘটে। অনুকূল ভূখণ্ড ও সকল লজিস্টিক সহায়তা পেয়েও এ সেক্টরে ভারতীয় সেনাবাহিনী ব্যর্থ হয়। এজন্য দায়ী তাদের ত্রুটিপূর্ণ পরিকল্পনা, অদক্ষ নেতৃত্ব,

অদূরদর্শিতা, অনমনীয়তা ও সতর্ক পদক্ষেপ। এতে তাদের অযােগ্যতা, কৌশলগত ও সামরিক জ্ঞানের অভাব এবং এগিয়ে না আসার ইচ্ছাই প্রমাণিত হচ্ছে। অরােরা তার সমরাস্ত্র ও ফেরিগুলাে ব্যবহারে ব্যর্থ হন। তিনি ফেরিগুলােকে সিরাজগঞ্জ ঘাটে নিয়ে আসতে পারতেন। নদী ব্যাপক প্রশস্ত হওয়ায় সেতু নির্মাণ সম্ভব ছিল না। বিমান বাহিনীতে শ্রেষ্ঠত্ব, বিমান অথবা হেলিকপ্টারে নদী পারাপারের সামর্থ্য এবং স্থানীয় জনগণের সমর্থন থাকায় ভারতীয়রা কয়েকদিনের মধ্যেই যমুনা নদী পার হতে পারত। তারা আমাকে ময়মনসিংহ থেকে পিছু হটতে বাধ্য এবং ঢাকা সেক্টরে টাঙ্গাইল এবং রাজশাহী সেক্টরে বেড়া-পাবনা দখল করতে পারত। জেনারেল নজরের বাহিনীকে পরাজিত অথবা এড়িয়ে যাবার প্রচেষ্টায় তারা তাদের শক্তি কেন্দ্রীভূত করলে ভারতীয়রা ঢাকার প্রতি হুমকি সৃষ্টি করতে পারত এবং ঢাকা অভিমুখী তাদের অগ্রযাত্রা নিষ্কন্টক করতে নজরকে বেড়া-পাবনা লাইনে অবস্থান গ্রহণে বাধ্য করতে পারত। | জেনারেল নজরের সৈন্যরা সীমিত সম্পদ সত্ত্বেও ভারতীয়দের অভিপ্রায় নস্যাৎ করে দেয় এবং তাদেরকে বিপর্যস্ত করতে সক্ষম হয়। একজন দক্ষ জেনারেল অবশ্যই আমাদের সৈন্যদের পর্যদস্ত করে এগিয়ে আসতে পারতেন। কিন্তু অরােরা আমাদের হাতে নাস্তানাবুদ হওয়ার ভয়ে তিনি আমাদের দুর্গের মােকাবেলা করতে সাহস পান নি। তার নিশ্চিত পরাজয়কে বিজয়ের শিরােপা পরিয়ে দেয়ার জন্য ভুট্টো, ইয়াহিয়া ও ভারতীয় অপপ্রচারের কাছে অরােরার কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। নয়তাে এ সেক্টরে তার বিজয়ের কোনাে সম্ভাবনা ছিল না। সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে অরােরা ও থাপনের কার্যকলাপ খুবই নিম্নমানের।

কুষ্টিয়া-যশাের-খুলনা সেক্টর

ঢাকা দখল করতে লে. জেনারেল রায়নার নেতৃত্বে দ্বিতীয় কোর গঠন করা হয়। ভারতীয়দের বিচারে রায়না ছিলেন একজন মেধাবী জেনারেল। কিন্তু কোর পরিচালনায় ব্যর্থতা তার সুনামকে নস্যাৎ করে দেয়। আমি এখনাে ভেবে অবাক হই, কি কারণে জেনারেল মানেকশ ও অরােরা যশােরের বিপরীত দিকে কৃষ্ণনগরে দুটি পদাতিক ডিভিশনের সমন্বয়ে এ কোর গঠন করলেন। এ সেক্টরে দুর্লঙ্ বাধাবিপত্তি রয়েছে। কয়েক কিলােমিটারের মধ্যে অন্তত একটি করে নদী। মাঠ-ঘাট পানিতে পরিপূর্ণ থাকায় রাস্তা ছেড়ে চলাচল করা ছিল অসম্ভব। এখানকার ভূখণ্ড ছিল প্রতিরক্ষামূলক লড়াইয়ের জন্য এক উত্তম জায়গা। লড়াইয়ে তাই প্রমাণিত হয়েছে। ভারতের ৪টি ডিভিশন ফরিদপুর-ঢাকার পথে অগ্রসর না হয়ে যুদ্ধ শুরুর ২৬ দিন পরও কুষ্টিয়ায় আটকা পড়ে এবং সেখানেই লড়াই করতে থাকে। বিগ্রেডিয়ার হায়াতের নেতৃত্বাধীন ১০৭ ব্রিগেডকে এড়িয়ে যেতে, বিচ্ছিন্ন করতে এবং পদানত  করতে রায়নার কোরের অধিকাংশ রিজার্ভ সৈন্যের সহায়তায় ভারতীয় ৯ ডিভিশন দৌলতপুর-কুষ্টিয়ার তাদের সব প্রয়াস কেন্দ্রীভূত করে। কিন্তু তাদের এ প্রচেষ্টা শশাচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়। এ ডিভিশনের অধিকাংশ সৈন্যও ফরিদপুর এগিয়ে যেতে পারত। সামান্য কয়েকজন ভারতীয় সৈন্য মধুমতি নদীতে পৌছেছিল। তবে তারা ফরিদপুর অগ্রসর হতে পারে নি। অন্তত একজন ভারতীয় লেখক স্বীকার করেছেন যে, এখানে ঢাকা পৌছার একটি সুযােগ নষ্ট হয় । এটা অবিশ্বাস্য যে, প্রয়ােজনীয় সব গােয়েন্দা তথ্য পেয়েও রায়না তার মিশনে ব্যর্থ হন। আমি এজন্য দায়ী করব অরােরাকে। অরােরা কার্যত পূর্ব পাকিস্তানের প্রাকৃতিক পরিবেশ বিস্তারিতভাবে। বিশ্লেষণ করেন নি। তিনি অন্ধভাবে তাঁর সৈন্য পরিচালনা করছিলেন যেন তিনি পাঞ্জাবে লড়াই করছেন। উত্তর-পশ্চিম সেক্টরের ভূমি ছিল পাঞ্জাবের মতাে। কিন্তু তিনি সেখানেও সফল হতে পারেন নি। আমি তাকে একজন ক্ষমতাহীন’ জেনারেল হিসেবে আখ্যায়িত করব। তার কৌশলগত জ্ঞানের ঘাটতি ছাড়াও যথেষ্ট সামরিক জ্ঞান ছিল না। তিনি মুক্তিবাহিনী ও বিএসএফ-কে সঙ্গে রেখে আমার দুটি ব্রিগেডকে পদানত করতে পারতেন এবং ফরিদপুর দখল মনােযােগ দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেন নি। | আমি ভেবে আরাে অবাক হই যে, যেখানে তিনি ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৯ দিনের লড়াইয়ে কোনাে সীমান্ত শহরও দখল করতে পারেন নি, সেখানে তিনি ১২ দিনে কিভাবে ঢাকা দখল করতে পারতেন? নির্বিবাদে তাকে ঢাকা পৌছার সুযােগ দেয়া। হলেও তিনি দু’সপ্তাহ তাে দূরে থাকুক, ৬ সপ্তাহেও ঢাকা দখল করতে পারতেন না। কারণ ঢাকার পথে প্রচুর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নদী রয়েছে। এসব নদীতে হয়তাে ভাসমান সেতু নির্মাণ করতে হতাে নয়তাে পরিবহন বিমান অথবা হেলিকপ্টারের সাহায্যে সৈন্য পারাপার করতে হতাে। যমুনা নদী কয়েক মাইল প্রশস্ত। এ নদী তিনি ফেরি ছাড়া কিভাবে পার হতেন? যমুনা নদীতে সেতু নির্মাণের প্রশ্নই উঠে না। সুতরাং ঢাকা দখলে দ্বিতীয় কোরকে নির্দেশ দান তিনি কিভাবে যৌক্তিক বলে প্রমাণ করবেন? এ যুদ্ধে প্রমাণিত হয়েছে যে, কৌশলগত লক্ষ্য অর্জনে তার কোনাে সূত্র ছিল না।

সিলেট-কুমিল্লা সেক্টর

জেনারেল জগৎ সিংয়ের নেতৃত্বে ৪ ভারতীয় কোরকে আশুগঞ্জ পর্যন্ত দখলের দায়িত্ব দেয়া হয়। কিন্তু পরে সগৎ সিংকে ঢাকা দখলের দায়িত্বও দেয়া হয়। ৩৩ ও ২ কোর কোনাে উল্লেখযােগ্য অগ্রগতি অর্জনে ব্যর্থ হওয়ায় তাকে ঢাকা দখলের মিশনে। অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এ এলাকার ভূমি ছিল সামরিক অভিযানের জন্য মারাত্মক। এ এলাকা নদ-নদী, খাল-বিল ও হাওরে পরিপূর্ণ। তাই এখানে বড় ধরনের সামরিক অভিযান চালানাে সম্ভব ছিল না। তবে এটি প্রতিরক্ষার জন্য ছিল বেশ উপযুক্ত। 

ভারত তিনটি পদাতিক ডিভিশন, কয়েকটি স্বতন্ত্র ব্রিগেড, কিলাে ফোর্স ও মুক্তিবাহিনীর আরাে কয়েকটি ব্রিগেড নিয়ে এ এলাকায় তাদের পূর্ণ শক্তি প্রয়ােগ করে। ভারতীয় সৈন্যরা সিলেটে আমাদের দুটি ব্রিগেডকে অবরােধ করার চেষ্টা করে। কিন্তু আমরা ৬টি ব্রিগেডের সমন্বয়ে গঠিত ভারতের ৮ পদাতিক ডিভিশনকে বাধা দিতে সক্ষম হই। একইভাবে, আমরা কুমিল্লা ও ময়নামতিতে ৫৭ মাউন্টেন ও ২৩ পদাতিক ডিভিশনকে প্রতিহত করি। ভারতীয়রা এ এলাকা দখলের চেষ্টা করে। ব্যর্থ হয়। তাদের চাদপুর এগিয়ে আসার প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হয়। চাঁদপুর ধরে রাখার আমাদের কোনাে পরিকল্পনা ছিল না। কিন্তু জেনারেল হেড কোয়ার্টার্সের নির্দেশে আমরা চাদপুর দখল করি এবং ঢাকার প্রতিরক্ষার জন্য সেখানে থেকে পিছু হটি।

অরােরা গুরুত্বহীন লক্ষ্য অর্জনে তার প্রাপ্ত সকল সম্পদ নষ্ট করেন। ভৈরব। বাজার ও আশুগঞ্জে ভারতের ৫৭ ডিভিশনের বিপর্যয় ঘটে। ৪ ভারতীয় কোর ও ১০১ কমিউনিকেশন জোনের মাত্র ৪টি দুর্বল ব্রিগেডের ঢাকা দখলের জন্য এগিয়ে আসতে সক্ষম হয়। ভারতীয় হেলিকপ্টারগুলাে পদাতিক সৈন্যদের পৌছে দিতে পারত মেঘনার এপারে। প্রতিটি হেলিকপ্টারে করে অন্তত এক সেকশন সৈন্য পরিবহন সম্ভব। কিন্তু ভারতীয়রা তা করতে পারে নি। শুধু তাই নয়, তারা তাদের ট্যাংক ও ভারি কামানগুলােও মেঘনার এপারে আনতে ব্যর্থ হয়। রেলওয়ে লাইন ছিল ভৈরব বাজারে মােতায়েন আমাদের ২৭ ব্রিগেডের গােলাবর্ষণের আওতায় । ভৈরববাজার বিপদমুক্ত করতে পারলে ভারতীয়রা ভৈরব সেতু দিয়ে তাদের ট্যাংক ও কামান নিয়ে আসতে পারত এবং ঢাকায় দিকে এগিয়ে যেতে পারত। কিন্তু সগৎ সিং এ কাজ করতে ব্যর্থ হন। কারণ তার কোরের সৈন্যরা সিলেট থেকে চাঁদপুর পর্যন্ত ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল। এজন্য তিনি ভৈরব বাজারে আমাদের মােকাবেলা। করতে পারেননি।

ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল-ঢাকা সেক্টর

ভারতের তুরা থেকে আগত রাস্তাটিই হচ্ছে ঢাকা পৌঁছার সংক্ষিপ্ততম রুট। শস্যক্ষেত ও মাঠের মধ্য দিয়ে এ রাস্তাটি এসেছে। কোথাও বড় ধরনের কোনাে বাধা-বিঘ্ন ছিল না। তবে মধুপুর বন ও টাঙ্গাইলে আমাদের প্রতিরক্ষা অবস্থান ছিল। কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী ছিল যথেষ্ট শক্তিশালী। এরা ভারতীয়দের ঢাকার দিকে অগ্রাভিযানে সহায়তা দিতে পারত। আমি নিজে অরােরার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, কেন তিনি এ এলাকায় ১০১ কমিউনিকেশন জোনের নেতৃত্বে মাত্র দুটি নিয়মিত পদাতিক ব্রিগেড এ একটি মুক্তিবাহিনী ব্রিগেড পাঠিয়েছিলেন। ঢাকা দখলের মূল লক্ষ্য অর্জনে এ এলাকায় সাজোয়া ও পদাতিক বাহিনীর এটি সম্মিলিত সমাবেশ ঘটানাে প্রয়ােজন ছিল। কিন্তু ভারতের অদক্ষ নেতৃত্ব ছিল অতি মাত্রায় সতর্ক এবং কামালপুর পর্যন্ত দখল করতে পারে নি। কামালপুরে আমাদের বিরুদ্ধে ভারতের একটি কোম্পানিই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু তারা এখানে একটি নিয়মিত ব্রিগেড এবং মুক্তিবাহিনীর আরাে একটি ব্রিগেড নিয়ােগ করে। এতেও তারা কুলিয়ে উঠতে পারেনি। ২১ দিন পর আমি কামালপুর পােষ্টে আমার কমান্ডার ক্যাপ্টেন আহসান মালিককে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেই। আমি আজো বুঝতে পারছি না, অরােরা কেন এ সেক্টরের গুরুত্বকে খাটো করে দেখেছেন। এখানে বিরাট সামরিক অপারেশন শুরু করলে তিনি সম্ভাব্য সংক্ষিপ্ততম সময়ে ঢাকার প্রতি হুমকি সৃষ্টি করতে পারতেন এবং এ পরিস্থিতিতে আমাকে বিকল্প পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হতাে। টাঙ্গাইলে ভারতীয় ছত্রীসেনাদের অবতরণ ব্যর্থ হয়। কারণ সময়টা ছিল ভুল। ভারতীয় ছত্রী সৈন্যরা ময়মনসিংহ এলাকা থেকে আমাদের সৈন্য প্রত্যাহারে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে নি। জেনারেল অরােরা বলেছেন, তিনি টাঙ্গাইলে এক ব্যাটালিয়ন ছত্রীসেনা পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু তাতে কাঙিক্ষত ফলাফল অর্জিত হয়নি। ভারতীয় সৈন্যরা তাদের অবতরণ স্থলে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে এবং তারা ঢাকা অভিমুখী তাদের নিজেদের বাহিনীকে কোনাে সহায়তা দিতে পারে নি। একইভাবে, মেঘনা নদীর এপারে ভারতের হেলিকপ্টারে সৈন্য প্রেরণও লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়। হেলিকপ্টারবাহিত ভারতের চতুর্থ কোরের সৈন্যরা সাদুল্লাহর ব্রিগেডকে আশুগঞ্জ থেকে ভৈরব বাজারে পিছু হটে আসতে বাধা দিতে পারে নি। নাগরার সৈন্যরা টাঙ্গাইলের কাছে আটকা পড়ে। কারণ তাদের কোনাে পরিবহন ছিল না। সময় ও দুরদর্শিতার অভাবে এসব ঘটনা ঘটেছে। বিভিন্ন বহরের মধ্যে যােগাযােগ রক্ষা এবং শত্রু বহরের অগ্রযাত্রায় বাধা দানের জন্য ছত্রীসেনা ব্যবহার করা হয়।

অরােরা। ছত্রীসেনা ব্যবহার করে কোনাে লক্ষ্য অর্জন করতে পারেন নি। | ভারতীয় অপপ্রচার এবং আমাকে আত্মসম্পণের নির্দেশদানকারী ষড়যন্ত্রকারীদের কল্যাণে ভারতীয়রা বিজয়ী হতে পেরেছে। কিন্তু কোনাে সামরিক বিশেষজ্ঞই বলতেন না যে, ভারত বিজয়ী হয়েছে। অরােরাসহ তার কমান্ডের অধিকাংশ জেনারেলকে পদোন্নতির জন্য অযােগ্য। বিবেচনা করা হয় এবং সেনাবাহিনীতেও তাদের রাখা হয় নি। এতেই প্রমাণিত হয়। যে, পূর্ব পাকিস্তানে ভারতীয় সেনাবাহিনী বিজয়ী হতে পারে নি। বিজয়ী হলে ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের কমান্ডার লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরােরা হতেন। ভারতের পরবর্তী সি-ইন-সি অথবা শাে-পিস হিসেবে হলেও তাকে সেনাবাহিনীতে রাখা হতাে। | পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধকে ভারতীয়রা ‘ব অভিযান’ হিসেবে আখ্যায়িত করছে। কিন্তু কোথাও এ যুদ্ধের গতি বজের কাছাকাছি পৌছতে পারে নি। বরং এ যুদ্ধের গতি ছিল শম্বুক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানরা দ্রুতগতিতে ডানকার্ক দখলের জন্য যে অভিযান চালায় তার ছদ্মনাম ছিল ব্রজ অভিযান। অরােরা জার্মানদের এ অভিযান পক্ষানুপুঙক্ষভাবে বিশ্লেষণ করে সেভাবে পরিকল্পনা গ্রহণ করলে তিনি পূর্ব পাকিস্তানে তার লক্ষ্য অর্জনে সফল হতে পারতেন। কিন্তু তার পরিকল্পনা ছিল সেকেলে ও গতানুগতিক। জার্মানরা তাদের আক্রমণাত্মক অভিযানের নাম দিয়েছিল ‘ব্লিৎসক্রিগ’ (ঝটিকা হামলা)। ঝড়ের গতিতে এবং তীব্র বেগে হামলা চালিয়ে শত্রুর অবস্থানকে তছনছ করে দেয়ার জন্যই এ ধরনের নামকরণ করা হয়। জার্মানরা আৰ্দেনিজ দখলের জন্য তাদের সৈন্য সমাবেশ করে এবং এত দ্রুতগতিতে লক্ষ্যস্থলে পৌছে যায় যে শক্ররা প্রতিরােধেরও সময় পায় নি এবং তারা অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। অন্তত দু’টি সেক্টরে এবং দুটি অক্ষে দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাবার মতাে পর্যাপ্ত ট্যাংক ও সাজোয়া যান অরােরার ছিল। সেখানে ভূমি ছিল যানবাহন চলাচলের জন্য খুবই উপযােগী। তার গতি বাড়ানাের জন্য স্থানীয় সহায়তাও ছিল। সম্পদের অভাব অথবা ভূমির প্রতিকূলতার জন্য নয়, বরং দৃঢ়তা ও আত্মবিশ্বাসের অভাব এবং ভ্রাম্যমান যুদ্ধের অনভিজ্ঞতা, দক্ষ ফিল্ড কমান্ডারের ঘাটতি এবং সর্বোপরি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তীব্র ও সংগঠিত প্রতিরােধের কারণেই পূর্ব পাকিস্তানের রণাঙ্গনে অরােরার পা মাটিতে সেঁধিয়ে যায়। | জেনারেল অরােরার পরিকল্পনায় ব্লিৎসক্ৰিগের কোনাে উপকরণ ছিল না।

তিনি তার সৈন্যদের কেন্দ্রীভূত করার পরির্তে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান ছড়িয়ে দেন। তিনি রংপুর-হিলি এবং তুরা-ময়মনসিংহ সেক্টরে তার সব ট্যাংক ও সাজোয়া যান কেন্দ্রীভূত করলে সুফল পেতে পারতেন। এ দুটি সেক্টরে মুখােমুখি লড়াইয়ের পরিবর্তে তার ট্যাংক হামলা চালানাে উচিত ছিল। ৬ ডিভিশনের পুরাে শক্তিকে ব্যবহারের পরিবর্তে সর্বনিম্ন শক্তিতে তিনি আমাদের মােকাবেলা করলে এবং রংপুরদিনাজপুর এড়িয়ে গেলে তিনি হিলি এলাকার উত্তরে অগ্রগতি অর্জন করতে পারতেন। তবে অনেক পরে তিনি সে চেষ্টা করেছিলেন। অরােরা হিলি থেকে সিরাজগঞ্জ ঘাট এবং এখান থেকে ফেরি দিয়ে যমুনা নদী পাড়ি দিয়ে তিনি ঢাকার দিকে এগিয়ে আসতে পারতেন। একইভাবে তিনি তুরা-ময়মনসিংহ সেক্টরে সর্বোচ্চ সংখ্যক ট্যাংক এবং কয়েক ডিভিশন পদাতিক সৈন্যের সাহায্যে আমাদের অবস্থানের পতন ঘটিয়ে অথবা এড়িয়ে গিয়ে এক সপ্তাহের মধ্যে ঢাকার প্রতি হুমকি সৃষ্টি করার পর্যায়ে পৌঁছতে পারতেন। তিনি কাপুরে আমারে একটি মিশ্র কোম্পানির বিরুদ্ধে দুটি ব্রিগেড, আরেকটি ট্যাংক ব্রিগেড ও কোর আর্টিলারি মােতায়েন করেন। এ হিসাব থেকে এ কথা পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে যে, পূর্ব পাকিস্তান দখলে অরােরার অন্তত কয়েক মাস লেগে যেত। আমাদের সৈন্যরা ভারতীয় সৈন্যদের তিন সপ্তাহ সীমান্তে আটকে রাখে এবং পরে তাদেরকে প্ররােচিত করে আমাদের মূল প্রতিরক্ষা অবস্থানের কাছাকাছি নিয়ে আসে। এ পরিস্থিতিতে অরােরা পূর্ব পাকিস্তান দখলের চিন্তাও করতে পারেন নি।

অন্যদিকে, আমরা প্রতিরক্ষামূলক ভূমিকা পালন করেছিলাম। ৫ ডিসেম্বর আমাদেরকে ভারতীয় সৈন্যদের পূর্ব রণাঙ্গন থেকে পশ্চিম রণাঙ্গনে অপসারণের সুযােগ না দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। আমরা এ নির্দেশ পালনে সফল হয়েছি। সত্যি, ভারত পূর্ব রণাঙ্গন থেকে একটি ইউনিট ও পশ্চিম রণাঙ্গনে স্থানান্তর করতে পারে নি। পূর্ব পাকিস্তানের লড়াই পশ্চিম পাকিস্তানে করা হবে বলে যে পরিকল্পনা ছিল, পশ্চিম পাকস্তিানের সেনাবাহিনী সে লড়াই করতে পারে নি। তাদের ব্যর্থতার জন্যই আমাদের বিপর্যয় ঘটে। অথচ লড়াইয়ে জেতার মতো তাদের পর্যাপ্ত সৈন্য, বিপুল সম্পদ ও উদ্যোগ ছিল। আমরা পূর্ব রণাঙ্গনে ১২ ডিভিশন ভারতীয় সৈন্যকে আটকে রেখে পশ্চিম পাকিস্তানকে রক্ষা করেছিলাম। ঢাকা দখল করতে হলে ভারতীয়দেরকে কঠিন লড়াইয়ের মুখােমুখি হতে হতাে এবং আমার বাহিনীকে ধ্বংস করতে হলে তাদের প্রচুর প্রাণহানি ঘটত। কিন্তু তাদের ভাগ্য ভালাে যে, আমার হাই কমান্ডের ভুলের কারণে তাদের সামরিক বিপর্যয় একটি বিজয়ে পরিণত হয়েছে। আমাকে শুধু সাংকেতিক ভাষায় বলা হয়, “থামাে নীল, লাল জয়ী হয়েছে।’ 

সূত্র : দ্য বিট্রেয়াল অভ ইস্ট পাকিস্তান – লে. জে. এ. এ. কে. নিয়াজি (অনুবাদ)