You dont have javascript enabled! Please enable it!

পাকিস্তানের ভাঙন

যখন মুজিব ও ভুট্টোর সঙ্গে আলােচনা শুরু হয়, তখন কৌশল নির্ধারণের দায়িত্বে ছিলেন ইয়াহিয়া, অ্যাডমিরাল আহসান, লে. জেনারেল পীরজাদা ও লে. জেনারেল ইয়াকুব। অ্যাডমিরাল আহসান ইয়াহিয়ার কাছে অভিযােগ করেন যে, তাদের মধ্যে যেসব বিষয়ে আলােচনা হয়েছে সেগুলাে তৎক্ষণাৎ ভুট্টোকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। এটা সাধারণভাবে বিশ্বাস করা হতাে যে, পীরজাদা ভুটোকে ব্রিফ করতেন এবং ভুট্টো সেভাবে অগ্রসর হতেন। ষড়যন্ত্রে ভুট্টোকে কেউ হারাতে পারেনি। তিনি গুল হাসানকে আশ্বাস দেন যে, তাকে পরবর্তী কমান্ডার-ইন-চিফ করা হবে এবং এয়ার মার্শাল রহিমকে বিমান বাহিনী প্রধান পদে বহাল রাখা হবে। যখন তাদেরকে এ প্রতিশ্রুতি দেয়া হয় তখন তারা ইয়াহিয়ার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছিল, সেটা ১৯৭১ সালের নভেম্বরে তাদের চীন সফরকালে। ১৯৭১ সালের যুদ্ধ সম্পর্কে লে. জেনারেল গুল হাসানের কোনাে আগ্রহ ছিল না। আমি তাকে টেলিফোনে রিং করলে তিনি আমার সঙ্গে আলাপ করতেন।  এয়ার মার্শাল রহিম নিজেকে আড়াল করে রাখেন এবং যুদ্ধে তিনি বিমান। বাহিনীকে নিষ্ক্রিয় করে রেখেছিলেন। সকল প্রতিকূলতা সত্ত্বেও আমরা যখন সাফল্যের সঙ্গে লড়াই করছিলাম এবং ভারতীয়দের নির্ধারিত ২ দিনের সময়সীমার মধ্যেও যখন মাথা নত করছিলাম না তখন গুল হাসান আমাদের পরাজয়কে ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে পশ্চিম রণাঙ্গনে একটি বিলম্বিত ও অনভিপ্রেত লড়াই শুরু করার পরামর্শ দেন। ভুট্টোকে ক্ষমতায় আনার জন্য এয়ার মার্শাল রহিমের সঙ্গে তিনি যে ষড়যন্ত্র করছিলেন তা বাস্তবায়নের জন্য এ ধরনের পরামর্শ দেয়া হয়। ভুট্টোর ক্ষমতা দখলের জন্য আমাদের পরাজয় এবং পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতা অপরিহার্য ছিল। ভুট্টো টিক্কাকেও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, তাকে সেনাবাহিনী প্রধান বানানাে হবে এবং মেজর জেনারেল ফরমানকেও তার সার্ভিসের জন্য পুরস্কৃত করার আশ্বাস দেয়া হয়। ফরমান ছিলেন নেপথ্যচারী একজন চক্রান্তকারী। ভুট্টো ক্ষমতায় এসে গুল হাসানকে সেনাবাহিনী প্রধান পদে নিযুক্তি দেন। সকল সিনিয়র জেনারেলকে ডিঙ্গিয়ে তিনি তাকে এ পদে নিয়ােগ দান করেন। তখন সকল সিনিয়র জেনারেল তার অধীনে কাজ করতে অস্বীকৃতি জানান এবং পেনশনে চলে যান। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছিলেন একমাত্র টিক্কা। লে. জেনারেল টিক্কা ছিলেন গুল হাসানের সিনিয়র। তা সত্ত্বেও টিক্কা তার জুনিয়র গুল হাসানের অধীনে কাজ করতে থাকেন। তিনি কখনাে এ ব্যাপারে আপত্তি করেননি। কারণ এখানে তার ব্যক্তিগত স্বার্থের প্রশ্ন জড়িত ছিল।

এরপর ভুট্টো লে. জেনারেল টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানে তার মারাত্মক অপরাধ, ১৯৭১ সালে পশ্চিম রণাঙ্গনে রিজার্ভ বাহিনীর সাহায্যে হামলা চালানাের ক্ষেত্রে ক্ষমাহীন ব্যর্থতা এবং পাকিস্তানের প্রতিটি লড়াইয়ে তার নিম্নমানের তৎপরতা সত্ত্বেও তাকে সেনাবাহিনী প্রধান পদে নিযুক্ত করেন। ১৫/১৬ ডিসেম্বরের মধ্যবতী রাতে আমাদের হেলিকপ্টারগুলাে বার্মা পালিয়ে যায়। রাও ফরমান আলীও হেলিকপ্টারে করে পালিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমি তাকে পালিয়ে যাবার অনুমতি দেইনি। হেলিকপ্টারে করে পালিয়ে যেতে পারলে তিনিও প্রতিশ্রুত পুরস্কার। পেয়ে যেতেন। তবে যুদ্ধবন্দি হিসেবে ভারত থেকে ফিরে যাবার পর তিনি পুরস্কৃত হন। তাকে মিলিটারি ট্রেনিং-এর মহাপরিচালক নিযুক্ত করা হয়। এ পদে নিযুক্তির জন্য তার প্রশিক্ষণ অথবা অভিজ্ঞতা কোনােটাই ছিল না। এরপর তাকে ফৌজি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান করা হয়। অন্যান্য ত্যাগী ও অভিজ্ঞ অফিসারদের উপেক্ষা করে তাকে এ পদে বসানাে হয়। তখন আত্মসম্মান রক্ষায় এসব অফিসার অবসরে চলে যান। ধুরন্ধর ফরমানকে মন্ত্রীও বানানাে হয়।  আমি পরে জানতে পারলাম যে, ব্যাপক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ভুট্টোকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে রাজনৈতিক বিষয় দেখাশোনা করার দায়িত্ব দেয়া হয়। তাকে এ পদে এ জন্যই বসানাে হয় যাতে পাকিস্তানের ভাঙন রােধে জাতিসংঘ অথবা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কিছুই করতে না পারে। ফাইটিং ফরমেশন বিশেষ করে ইস্টার্ন গ্যারিসনে সামরিক সরবরাহ বন্ধ নিশ্চিত করার দায়িত্ব দেয়া হয় গুল হাসানকে। ষড়যন্ত্রকারীরা এটাও নিশ্চিত করে যে, এয়ার মার্শাল রহিম স্থল ও নৌবাহিনীকে সমর্থন দেবেন না । আমি এ কথা বিশ্বাস করি যে, জেনারেল গুল হাসান আমার চতুর্দশ ডিভিশনের কমান্ডার মেজর জেনারেল কাজী মজিদকে ষড়যন্ত্রের জালে বেষ্টন করে ফেলেছিলেন। চতুর্দশ ডিভিশনের কমান্ডার কাজী মজিদ যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে গুল হাসানের নীল নকশা অনুযায়ী কাজ করতে থাকেন। এ জন্য আমাকে নতুন করে যুদ্ধের পরিকল্পনা সাজাতে হয়। ষড়যন্ত্রকারীরা রাও ফরমান আলীকে গভর্নমেন্ট হাউসে আতঙ্ক ছড়াতে এবং যুদ্ধে নাশকতা সৃষ্টিতে নিয়ােগ করে। তিনি এ কাজ অত্যন্ত চাতুর্য ও সাফল্যের সঙ্গে সম্পন্ন করেন। 

মধ্যে। আবার বলছি, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে। সাহায্য পাওয়ার কোনাে সম্ভাবনা না থাকলে আমি আপনাকে আলােচনা করার পরামর্শ দিচ্ছি যাতে শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠুভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর সম্পন্ন হয় এবং লাখ লাখ মানুষের জীবন রক্ষা পায় এবং অবর্ণনীয় দুর্দশা এড়ানাে যায়। সাহায্য আসার সম্ভাবনা থাকলে পরিণতি যাই হােক না কেন, আমরা লড়াই চালিয়ে যাব। বিবেচনার জন্য অনুরােধ রইলাে।’  এ বার্তা আমার পক্ষ থেকে নয়, গভর্নর হাউস থেকে তা পাঠানাে হয়েছিল এবং এটার খড়সা করেছিলেন ফরমান বার্তায় পূর্বাঞ্চলীয় ও পশ্চিমাঞ্চলীয় সেক্টরের পতন ঘটেছে বলে যে কথা উল্লেখ করা হয় তা ছিল পুরােপুরি ভুল। ১৬ ডিভিশনের কমান্ডার নজর হােসেন শাহ্ ছিলেন খুবই তৎপর। সীমান্তে হিলি সেক্টরে তখনাে প্রচণ্ড লড়াই চলছিল। দিনাজপুর, রংপুর ও সৈয়দপুরে শক্রর ৬ ডিভিশনকে আটকে রাখা হয়েছিল। ৯ ডিভিশনের এলাকায় ব্রিগেডিয়ার মঞ্জুর কুষ্টিয়ায় পিছু হটছিলেন এবং ভারতের একটি ডিভিশনকে ব্যস্ত রেখেছিলেন। ব্রিগেডিয়ার হায়াত খুলনায় সৈন্য প্রত্যাহার করে নিয়ে যান এবং সেখানে তিনি আরেকটি ভারতীয় ডিভিশনের সঙ্গে লড়াই করছিলেন। মধুমতি নদীপথ বিপদমুক্ত ছিল। ফরিদপুর, সিলেট, মৌলভীবাজার, আশুগঞ্জ, ময়নামতি অথবা পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতিও কোনাে হুমকি ছিল না। এসব ঘাঁটিগুলাে তখনাে বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করছিল এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী লড়াই করার সর্বশেষ অবস্থানে সরে আসছিল। সকল সমুদ্রবন্দর, বিমানক্ষেত্র ও বিভাগীয় সদরদপ্তর এবং অধিকাংশ ফেরিঘাট ছিল আমাদের নিয়ন্ত্রণে কমান্ডারগণ সক্রিয়ভাবে যুদ্ধ নিয়ন্ত্রণ করছিলেন। শত্রুরা গ্রামাঞ্চলের দিকে পিছু হটছিল। তবে প্রধান প্রধান অনুপ্রবেশ পথগুলাে ছিল তাদের দখলে। ৭ ডিসেম্বর পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চলে আমাদের অগ্রবর্তী অবস্থানের পতন ঘটলে ৮ ডিসেম্বর সি-ইন-সি আমাকে অভিনন্দন জানাতেন না। ৮ ডিসেম্বর ১৯৭১-এর সিইন-সির সিগনাল নং জি, ০৯১০ ছিল।  ‘আমি আপনার এবং আপনার অধীনস্থ সৈন্যদের জন্য গর্বিত। প্রচণ্ড প্রতিকূলতার মধ্যে আপনার তৎপরতা অত্যন্ত প্রশংসনীয় এবং আমি নিশ্চিত, আপনার কমান্ডে এ ধরনের তৎপরতা অব্যাহত থাকবে। ভূখণ্ড হারানাের চিন্তা বাদ। দিয়ে যেখানে সম্ভব সেখানেই প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান গ্রহণ করুন। এ বিষয়ে গভর্নরের সঙ্গে আলােচনা করুন। রাজনৈতিক পর্যায়ে সম্ভাব্য সকল প্রচেষ্টা চলছে।’ 

ভারতীয় জেনারেল ডি, কে, পালিত তার ‘দ্য লাইটনিং ক্যাম্পেইন’-এ স্বীকার করেছেন, তখনাে আমাদের অগ্রবর্তী অবস্থানগুলাে ছিল অক্ষত। আরেকটি বিষয় উল্লেখযােগ্য যে, প্রেসিডেন্টের কাছে পাঠানাে বার্তায় খাদ্য মজুদ সম্পর্কে যে তথ্য দেয়া হয় পরিস্থিতি মোেটও সেরকম ছিল না। ১৬ ডিসেম্বরের পরও খাদ্য ঘাটতির কোনাে কথা শােনা যায়নি। আমার মনে হয়  পাকিস্তান ভাঙায় ফরমানের পরবর্তী কার্যক্রমকে যৌক্তিক করার জন্যই তিনি বার্তায় খাদ্য পরিস্থিতি সম্পর্কে এমন উদ্ভট তথ্য দিয়েছেন। ৭ ডিসেম্বর প্রেসিডেন্ট গভর্নরের বার্তার জবাবে বলেন  ‘আপনার ফ্ল্যাশ সিগনাল নং এ ৬৯০৫ এর জবাবে । সম্ভাব্য সব পদক্ষেপ বিবেচনা করা হচ্ছে। পশ্চিম রণাঙ্গনে পূর্ণাঙ্গ ও তীব্র লড়াই চলছে, বিশ্ব শক্তি একটি যুদ্ধবিরতির জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে। নিরাপত্তা পরিষদে উপর্যুপরি রুশ ভেটোর পর বিষয়টি সাধারণ পরিষদে উত্থাপন করা হচ্ছে। উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি প্রতিনিধি দলকে নিউইয়র্কে পাঠানাে হচ্ছে। আপনি আশ্বস্ত হতে পারেন, আপনি যে ভয়াবহ পরিস্থিতি মােকাবেলা করছেন আমি সে ব্যাপারে পুরােপুরি ওয়াকেবহাল। কী ধরনের সামরিক কৌশল অবলম্বন করতে হবে সে বিষয়ে জেনারেল নিয়াজিকে নির্দেশ দানের জন্য আমি চিফ অভ স্টাফকে নির্দেশ দিয়েছি। আপনি এবং আপনার সরকারকে খাদ্য বরাদ্দ এবং সকল অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের সরবরাহ নিয়ন্ত্রণে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে যাতে দীর্ঘদিন যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া যায় এবং পতন রােধ করা যায়। আল্লাহ্ আপনাদের সহায় হােন। আমরা আপনাদের জন্য দোয়া করছি।’  প্রেসিডেন্ট গভর্নরের কাছে প্রেরিত বার্তায় বলেছেন যে, আমাকে কৌশলগত নির্দেশ দানের জন্য তিনি চিফ অভ স্টাফকে নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু চিফ অভ স্টাফের কাছ থেকে আমি আদৌ এ ধরনের নির্দেশ পাইনি। ৭ ডিসেম্বর থেকে আমি গভর্নর হাউসে অস্বাভাবিক তৎপরতা লক্ষ্য করি। সর্বত্রই নৈরাশ্য ও হতাশার ছায়া। গভর্নর মালিক বেসামরিক লােকজনের নিরাপত্তা এবং পাকিস্তানের অখণ্ডতা সম্পর্কে উদ্বেগের মধ্যে ছিলেন। তবে জেনারেল হেড কোয়ার্টার্স অথবা প্রেসিডেন্ট হাউসে তেমন কোনাে উদ্বেগ ছিল না। আমি চিফ অভ জেনারেল স্টাফ লে. জেনারেল গুল হাসানের সঙ্গে যােগাযােগ করার চেষ্টা করি। কিন্তু তিনি আবারাে আমাকে এড়িয়ে যান। মিলিটারি অপারেশনের ডিরেক্টর। ব্রিগেডিয়ার রিয়াজ যুদ্ধ চলাকালে কখনাে আমার সঙ্গে অথবা আমার স্টাফের সঙ্গে যােগাযােগ করেননি। তার ডেপুটি কর্নেল কোরেশী চার্জে ছিলেন বলে মনে হচ্ছিল।

তবে তিনি পরিস্থিতি মােকাবেলায় মােটেও সক্ষম ছিলেন না। সেনাবাহিনী প্রধান অধিকাংশ সময় প্রেসিডেন্ট হাউসে কাটাতেন। এ জন্য আমি কোনাে দায়িত্বশীল ব্যক্তির সঙ্গে আমার সমস্যা নিয়ে কথা বলতে পারিনি। রাজনৈতিক পর্যায়ে সংকট নিরসনের তথাকথিত প্রচেষ্টা ছিল একটি প্রহসন। জাতিসংঘে আমাদের অনেক বন্ধু ছিল। কিন্তু ২১ নভেম্বর ভারত পূর্ব পাকিস্তানে হামলা চালালে নিরাপত্তা পরিষদে বিষয়টি উত্থাপনে আমাদের পক্ষ থেকে কোনাে আগ্রহ দেখানাে হয়নি। বিক্ষুব্ধ পক্ষ আগ্রহী না হলে অন্য কেউ এগিয়ে আসবে কেন? ভুট্টোর নেতৃত্বে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন প্রতিনিধি দল নিউইয়র্কে রওনা  দেয়। কিন্তু ভুট্টোর উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করতে এ প্রতিনিধি দল ঘুরপাক খেতে থাকে। পরিস্থিতির গুরুত্ব ও ব্যাপকতা সম্পর্কে ভুট্টোর কোনাে উদ্বেগ ছিল না। তিনি ‘এম, এম, আহমেদ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে অগ্রসর হন। কাবুল ও তেহরান হয়ে ফ্রাঙ্কফুর্ট এবং ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে রােমে যান। এরপর সেখান থেকে যান নিউইয়র্কে। ১০ ডিসেম্বর তিনি নিউইয়র্কে পৌছেন। কয়েক ঘণ্টায় যেখানে তিনি আমেরিকা যেতে পারতেন সেখানে তার সময় লাগে তিনদিন। নিউইয়র্কে গিয়ে তিনি আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন। নিউইয়র্কের পথে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের চিফ সেক্রেটারি মােজাফফর হােসেনের স্ত্রীর সঙ্গে লন্ডনে সাক্ষাত করেন এবং তিনি তাকে জানান, তিনি (মােজাফফর হােসেনের স্ত্রী) তার স্বামীকে দীর্ঘদিন দেখতে পাবেন না। তার মানে হচ্ছে, ভুট্টো জানতেন, চিফ সেক্রেটারিসহ অন্যান্যরা যুদ্ধবন্দি হবেন। যুদ্ধবিরতির চেষ্টা করলে অথবা সে ধরনের উদ্দেশ্য থাকলে তিনি এ কথা বলতে পারতেন না। একটি সম্মানজনক যুদ্ধবিরতি হলে পাকিস্তান আত্মসমর্পণ করার অসম্মান থেকে রক্ষা পেত। আত্মসমর্পণের দিকে ঠেলে দেয়ার উদ্দেশ্য ছিল। সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি ও বিশ্বাসযােগ্যতাকে ধ্বংস করে এমন এক মাত্রায় নিয়ে যাওয়া যেখানে জনগণ ইয়াহিয়ার পদত্যাগের আওয়াজ তুলবে এবং ইয়াহিয়া পদত্যাগ করলে ভুট্টো ক্ষমতায় আসতে পারেন। ভুট্টো তার চাতুর্যপূর্ণ চালের মাধ্যমে এক ঢিলে দুই পাখি মারেন এবং দেশের এক নম্বর ব্যক্তি হওয়ার খায়েশ পূরণে তিনি পাকিস্তানকে হত্যা করেন। পরিস্থিতির ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে গভর্নর হাউস থেকে ঘন ঘন বার্তা প্রেরণ, গভর্নরের মনােবল ভেঙে দিতে ফরমানের প্রচেষ্টা এবং আমার স্টাফদের মধ্যে হতাশা ছড়ানাের ঘটনায় কুয়াশা কেটে যেতে থাকে। আমার চিফ অব স্টাফ কিছুদিন। আগে যে ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, সেই ষড়যন্ত্র তখন চূড়ান্ত রূপ নিতে যাচ্ছিল।

আমি সতর্ক হয়ে উঠলাম। আমার একজন স্টাফ অফিসার আমাকে জানায়, মেজর জেনারেল ফরমান তাকে ৯ ডিসেম্বর জানিয়েছেন যে, পরদিন যুদ্ধবিরতি হতে যাচ্ছে। ৭ ডিসেম্বর আমি জেনারেল হেড কোয়ার্টার্সে যে সংকেত পাঠিয়েছিলাম তাতে আমি শেষ দিন পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাবার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছিলাম। ইন্টার্ন কমান্ড অথবা অন্য কোথাও কেউ যুদ্ধ বিরতির কথা বলেন নি অথবা এ ধরনের চিন্তাও করেননি। গভর্নর অন্তত এ ব্যাপারে আমাকে কিছু জানাননি অথবা তিনি এ বিষয়ে কোনাে উদ্যোগও নেননি। যেখানে কেউ যুদ্ধবিরতির কথা জানতাে না সেখানে ফরমান জানতেন কিভাবে? মেজর জেনারেল ফরমান আলীর বইয়ে এমন বহু বিষয়ের উল্লেখ করা হয়েছে যেসব বিষয়ে আমি ছিলাম অনবহিত। যেসব বিষয় আমাকে জানানাের প্রয়ােজন ছিল সেগুলাে আমাকে জানানাে হয়নি। আমাকে অন্ধকারে রাখা হয়। মনে হচ্ছিল, তিনি ভারতীয় সি-ইন-সি ও রুশদের সঙ্গে আলােচনার জন্য একটি সমান্তরাল প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। নয়তাে যেখানে ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘের কাছে লেখা গভর্নরের চিঠি প্রেসিডেন্টের কাছে পাঠানাে হয় সেখানে তিনি আমার স্টাফ অফিসারকে ৯ ডিসেম্বর কিভাবে জানালেন যে, পরদিন যুদ্ধবিরতি হতে যাচ্ছে? ভারতীয় মেজর জেনারেল নাগরার কথার সঙ্গে ফরমান আলীর বইয়ে বর্ণিত ঘটনার চমৎকার মিল রয়েছে। জেনারেল নাগরা আমাকে জানিয়েছিলেন, তারা ৯ ডিসেম্বর জানতে পারেন যে, যুদ্ধ থেমে যাচ্ছে। দৃশ্যত ফরমান রুশ কমিউনিকেশন চ্যানেলের মাধ্যমে ভারতীয়দের সঙ্গে আলােচনা চালাচ্ছিলেন। ১৫ ডিসেম্বর আমাদের বার্তার জবাবে জেনারেল মানেকশ বলেছিলেন, তিনি ইতােমধ্যেই তার দুটি বার্তায় রাও ফরমান আলীকে জানিয়ে দিয়েছেন, সৈন্যদেরকে আত্মসমর্পণ করতে হবে। শক্রর সঙ্গে আলাপ-আলােচনা করার অথবা আমার কোনাে ডিভিশনাল কমান্ডারের সঙ্গে কথা বলার এক্তিয়ার জেনারেল ফরমানের ছিল না। কিন্তু কেন তিনি শক্রর সঙ্গে তার যােগাযােগের বিষয় আমাকে, গভর্নরকে ও জেনারেল হেড কোয়ার্টার্সকে অবহিত করেননি। ৭ ডিসেম্বর পলাশবাড়িতে যােড়শ ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল নজর হােসেন ও ব্রিগেডিয়ার তাজাম্মুল হুসাইনের ওপর হামলা হয়। কিন্তু অলৌকিকভাবে তারা রক্ষা পান। একজন বেসামরিক লােক নজরকে রক্ষা করেন। তাদেরকে রক্ষায় পাল্টা হামলা চালাতে হয়। এতে লে. কর্নেল সুলতান মাহমুদ নিহত হন। এ পাল্টা হামলায় শক্রর অগ্রযাত্রা ২৪ ঘণ্টা বিলম্বিত হয়। ষােড়শ ডিভিশনের কমান্ড গ্রহণ করার জন্য মেজর জেনারেল জামশেদকে পাঠানাে হয়। তাকে বহনকারী হেলিকপ্টার অবতরণে ব্যর্থ হওয়ায় তিনি ঢাকা ফিরে আসেন। আমি ফরমানকে সেখানে পাঠাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তিনি গা ঢাকা দেন। খুঁজে পাওয়া যায়নি তাকে এ জন্য আমি আমার সেকেন্ড-ইন-কমান্ড জামশেদকে সেখানে পাঠাই। গােটা যুদ্ধের সময় একবারই আমার ফরমানের প্রয়ােজন হয়েছিল।

কিন্তু তিনি হাওয়া হয়ে যেতেন। নতুবা বরাবরই তাকে গভর্নর হাউসে দেখা যেত।  ৯ ডিসেম্বর আমি জেনারেল হেড কোয়ার্টার্সকে জানাই যে, জনগণ বৈরি হয়ে উঠছে এবং নৈশকালে চলাচল অসম্ভব। স্থানীয় লােকজন ভারতীয়দের সব ধরনের সহায়তা দিচ্ছিল এবং আমাদের পশ্চাৎভাগ ও ফাঁক-ফোকর দিয়ে তাদেরকে এগিয়ে আনছিল। ভারতীয় বিমান বাহিনী জেটি, ফেরি ও নৌযান ধ্বংস করে দেয়। শত্রুর বিমান হামলায় ভারি অস্ত্রশস্ত্র ও সাজ-সরঞ্জামের প্রচুর ক্ষতি হয়। ২০ দিনের একটানা অদ্রিা ও ক্ষুধায় সৈন্যরা ক্লান্ত হয়ে পড়ে। কয়েকটি এলাকায় গুরুতর পরিস্থিতি সত্ত্বেও আমি লড়াই চালিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। আমি বিমান হামলা এবং ঢাকায় বিমান যােগে সৈন্য পাঠানাের জন্য অনুরােধ করেছিলাম। কারণ জেনারেল হেড কোয়ার্টার্স আমাকে জানিয়েছিল যে, চীনারা আমাদের সমর্থন করতে শুরু করেছে। কিন্তু এটা মিথ্যা প্রমাণিত হয়। মার্কিন নৌ সমর্থন লাভের আশায় আমি আমার সম্পদ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে এবং চট্টগ্রাম ও চালনা সমুদ্র বন্দরকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছিলাম । কিন্তু কোনাে মার্কিন সহায়তাও আসেনি। সহায়তার প্রত্যাশা না। থাকলে আমি খুব সহজেই চালনা ছেড়ে দিয়ে সৈন্যদেরকে খুলনা নিয়ে আসতে। পারতাম। ৯ ডিসেম্বর গভর্নর আরেকটি বার্তা পাঠান। এ বার্তায় তিনি ঢাকাকে উন্মুক্ত নগরী হিসেবে ঘােষণা করার প্রস্তাব দেন। এ প্রস্তাবে বহু জটিলতা ছিল। কারণ। ঢাকার বাইরে অবস্থানরত সৈন্যদের আমি অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিতে পারছিলাম।  প্রথম বার্তায় এ ধরনের প্রস্তাব দেয়া হয়নি। তাই আমি গভর্নরকে জানালাম যে, আমি এ প্রস্তাবের সঙ্গে একমত নই । নিরপেক্ষতা ও বস্তুনিষ্ঠতার স্বার্থে ফরমানের এ বার্তাও প্রকাশ করা উচিত ছিল। কিন্তু তিনি তা করেননি। প্রেসিডেন্টের কাছে। প্রেরিত গভর্নরের বার্তায় বলা হয় ০৯১৮০০-এর এ ৪৬৬০। প্রেসিডেন্টের জন্য। সামরিক পরিস্থিতি মারমুখী। শত্রুরা পশ্চিম দিক থেকে ফরিদপুরে এগিয়ে আসছে এবং পূর্বদিকে কুমিল্লা ও। লাকসামে আমাদের সৈন্যদের অতিক্রম করে মেঘনা নদী পর্যন্ত পৌছে গেছে। শক্রর হাতে চাঁদপুরের পতন ঘটেছে। এর ফলে সব নৌ রুট বন্ধ হয়ে গেছে। বাইরের সাহায্য দ্রুত না পৌঁছলে শত্রুরা যে কোনাে দিন ঢাকার উপকণ্ঠে পৌঁছে। যেতে পারে। ঢাকাস্থ জাতিসংঘ মহাসচিবের প্রতিনিধি বেসামরিক লােকজন বিশেষ করে অবাঙালিদের রক্ষায় ঢাকাকে একটি উন্মুক্ত নগরী হিসেবে ঘােষণা করার প্রস্তাব। দিয়েছেন। আমি এ প্রস্তাবের পক্ষে এ প্রস্তাব অনুমােদন করার জন্য আমি জোর সুপারিশ করছি। জেনারেল নিয়াজি এ প্রস্তাবের সঙ্গে একমত নন। তিনি শেষ পর্যন্ত। লড়াই চালিয়ে যেতে চান এবং মনে করেন যে, এ প্রস্তাব ঢাকাকে শক্রর হাতে সমর্পণ করার শামিল। তার এ অভিপ্রায় গােটা সেনাবাহিনী, পশ্চিম পাকিস্তানি পুলিশ, সকল অবাঙালি এবং অনুগত পাকিস্তানিদের নিধনের পথ প্রশস্ত করতে পারে।

রিজার্ভে কোনাে নিয়মিত সৈন্য নেই এবং চীন অথবা যুক্তরাষ্ট্র আজকে ব্যাপক স্থল ও বিমান হামলা শুরু না করলে শক্ররা মেঘনা অথবা পদ্মা অতিক্রম করে এগিয়ে এলে আমাদের প্রতিরােধ হবে নিল। আমি আবারাে আপনাকে যুদ্ধবিরতি ও রাজনৈতিক নিষ্পত্তিতে পৌঁছার জন্য অনুরােধ করছি। নতুবা কয়েকদিনের মধ্যে পূর্ব রণাঙ্গন থেকে ভারতীয় সৈন্যরা মুক্ত হতে পারলে পশ্চিম। পাকিস্তানের নিরাপত্তাও বিপন্ন হয়ে উঠবে। স্থানীয় লােকজন অধিকৃত এলাকায় ভারতীয় সেনাবাহিনীকে অভিনন্দন জানাচ্ছে এবং তাদেরকে সর্বাত্মক সহযােগিতা দিচ্ছে। বিদ্রোহীদের তৎপরতার কারণে আমাদের সৈন্যরা পিছু হটতে এবং চলাচল। করতে পারছে না। একইসঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের আত্মত্যাগও হবে অর্থহীন। ৯ ডিসেম্বর সিগনাল জি ০০০১-এ প্রেসিডেন্ট তার জবাব দেন। এ বার্তায় আমাকে গভর্নরের সিদ্ধান্ত মেনে নেয়ার এবং তদনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশ দেয়া হয়। গভর্নরের কাছে প্রেরিত বার্তায় বলা হয় ‘আপনার ৯ ডিসেম্বর প্রেরিত সিগনাল নং এ ৪৬৬০ পেয়েছি এবং পুরােপুরি বিষয় ওয়াকিবহাল হয়েছি। আপনি আমার কাছে যেসব প্রস্তাব পাঠিয়েছেন সে ব্যাপারে যে কোনাে সিদ্ধান্ত গ্রহণের অনুমতি আপনাকে দেয়া হলাে। আমি আন্তর্জাতিকভাবে সকল ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য চেষ্টা করেছি এবং এখনাে চেষ্টা চালাচ্ছি। কিন্তু আমরা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় পূর্ব পাকিস্তান সম্পর্কে আপনার সুবিবেচনা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার আমি আপনার ওপর ন্যস্ত করছি। আপনি যে সিদ্ধান্তই নেবেন তাতে আমার সম্মতি রয়েছে। আমি একইসঙ্গে জেনারেল নিয়াজিকে আপনার সিদ্ধান্ত মেনে নিতে এবং তদনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে তাকে নির্দেশ দিচ্ছি। বেসামরিক লােকজনের জীবন বিশেষ করে আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর নিরাপত্তার প্রয়ােজনে আপনি যে কোনাে সিদ্ধান্ত নিয়ে এগিয়ে যেতে পারেন এবং আমাদের প্রতিপক্ষের সঙ্গে সকল ধরনের রাজনৈতিক উপায়ে আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন। জাতিসংঘে কোনাে রাজনৈতিক মীমাংসার প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়নি। এ ব্যাপারে গভর্নর কি রাজনৈতিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারতেন? তার এক্তিয়ার ছিল পূর্ব পাকিস্তানে সীমিত। এখানে কার্যত কোনাে সরকার ছিল না। রাজনৈতিক অর্থাৎ আওয়ামী লীগের এমএনএরা ছিলেন কলকাতায় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানে। তাদেরকে বাদ দিয়ে কিভাবে রাজনৈতিক মীমাংসায় পৌঁছানাে সম্ভব? শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে একটি চুক্তি করা যেত।

তিনি একটি কনফেডারেশন মেনে নিতে রাজি হতেন। তার সঙ্গে রাজনৈতিক সংলাপের কোনাে পরামর্শ কেন ছিল না?  পূর্ব পাকিস্তান সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার গভর্নরের ওপর ছেড়ে দেয়া হয়। বিরাজমান পরিস্থিতিতে তার পক্ষে কিছুই করা সম্ভব ছিল না। কারণ প্রতিপক্ষ ছিল কেবল ভারত। পররাষ্ট্র বিষয় ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে। প্রেসিডেন্ট একটি রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে বের করার জন্য জাতিসংঘে আমাদের মিশনকে নির্দেশ দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি সেপথে যাননি। বস্তুত তারা আমার কাঁধে বন্দুক রেখে ফায়ার করতে চেয়েছিলেন। গভর্নর কিভাবে এবং কার কাছ থেকে সশস্ত্র বাহিনীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারতেন? সশস্ত্র বাহিনী দেশের ভেতরে বিদ্রোহী মুক্তিবাহিনী ও বৈরি স্থানীয় জনগণ এবং রণাঙ্গনে ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে লড়াই করে নিজেদেরকে রক্ষা করছিল। ১০ ডিসেম্বর আমি সেনাবাহিনী প্রধানের কাছ থেকে একটি বার্তা পাই। তাতে বলা হয় : ‘ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডারের প্রতি সেনাবাহিনী প্রধানের পক্ষ থেকে। গভর্নরের কাছে প্রেরিত প্রেসিডেন্টের বার্তার কপি আপনার কাছে পাঠাচ্ছি। প্রেসিডেন্ট আপনার সঙ্গে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব গভর্নরের ওপর অর্পণ করেছেন। পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটায় সঠিকভাবে কোনাে বার্তা পাঠানাে সম্ভব নয় বলে আমি তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার আপনার ওপর ছেড়ে দিচ্ছি। এটা প্রতীয়মান হচ্ছে যে, বিদ্রোহীদের সক্রিয় সহযােগিতায় শক্রদের পূর্ব পাকিস্তানে পুরােপুরি আধিপত্য প্রতিষ্ঠা কেবলমাত্র একটি সময়ের ব্যাপার। ইতােমধ্যে বেসামরিক লােকজনের বিপুল ক্ষতি হচ্ছে এবং সেনাবাহিনীর বিপুল প্রাণহানি ঘটছে। আপনি যদি যুদ্ধ চালিয়ে যেতে চান তাহলে আপনাকে যুদ্ধের ভালাে-মন্দ দিক বিচার করতে হবে এবং পরিস্থিতি মূল্যায়নের ভিত্তিতে গভর্নরকে আপনার আন্তরিক পরামর্শ দেয়া উচিত । প্রেসিডেন্ট তাকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের এক্তিয়ার দিয়েছেন। সুতরাং তিনিই সিদ্ধান্ত নেবেন। আপনি প্রয়ােজনবােধ করলে অধিকাংশ সামরিক সরঞ্জাম ধ্বংস করে দিতে পারেন যাতে এগুলাে শক্রর হাতে না পড়ে। আমাকে সবকিছু অবহিত করবেন। আল্লাহ আপনার মঙ্গল করুন।’ এখানে উল্লেখ করা প্রয়ােজন যে, ৯ ডিসেম্বর প্রেরিত বার্তায় প্রেসিডেন্ট রাজনৈতিক উপায়ে পূর্ব পাকিস্তান সম্পর্কে একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং সশস্ত্র বাহিনীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব গভর্নরকে দিয়েছিলেন এবং ১০ ডিসেম্বর সেনাবাহিনী। প্রধানের বার্তায় আমাকে আত্মসমর্পণ করার ইঙ্গিত দিয়ে অধিকাংশ সামরিক সরঞ্জাম ধ্বংস করার পরামর্শ দেয়া হয় যাতে এগুলাে শত্রুর হস্তগত না হয়। তার মানে হচ্ছে, আমার ও গভর্নরের দিকে বল ঠেলে দেয়া হলাে যাতে আমাদেরকে দোষারােপ করা যায়।

১৯৭১-এর ১০ ডিসেম্বর ছিল পাকিস্তানের ইতিহাসে সবচেয়ে অশুভ দিন। সেদিন একজন ষড়যন্ত্রকারী তার খােলস ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে সত্যিকার রূপে আবির্ভূত হয়। এ অশুভ দিনে মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী প্রেসিডেন্টের অনুমােদন ছাড়া নিজে নিজে একটি আন্তর্জাতিক উদ্যোগ নেন এবং ঢাকাস্থ জাতিসংঘ প্রতিনিধি পল হেনরির কাছে পাকিস্তানের ভাঙন সম্পর্কে একটি অতি গােপনীয় বার্তা হস্তান্তর করেন। এটা ফরমানের বার্তা হিসেবে গণ্য হয়। কারণ এ বার্তায় প্রেসিডেন্ট অথবা গভর্নরের সম্মতি ছিল না। গভর্নর এ বার্তা সম্মতির জন্য প্রেসিডেন্টের কাছে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট সঙ্গে সঙ্গে তা বাতিল করে দেন। চিফ সেক্রেটারি ও ফরমান ১০ ডিসেম্বর দুপুরে আমার কমান্ড পােষ্টে আসেন এবং বাস্তব পরিস্থিতি নিয়ে আমার সঙ্গে আলােচনা করেন। তারা আমাকে জানান, প্রেসিডেন্ট গভর্নরকে যে কোনাে সিদ্ধান্ত গ্রহণের এক্তিয়ার প্রদান করেছেন এবং প্রেসিডেন্টের অনুমােদন সাপেক্ষে জাতিসংঘের কাছে একটি বার্তা পাঠানাের বিষয় নিয়ে আলােচনা করার জন্য গভর্নর তাদের পাঠিয়েছেন। আমি বার্তার বিষয়বস্তু সম্পর্কে চরম অসন্তুষ্ট হই। এ বার্তায় যে বিষয় উল্লেখ করা হয় তার অর্থ ছিল। ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের মৃত্যু এবং দেশ ও পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর জন্য চরম অবমাননা। দীর্ঘ আলাপ-আলােচনার পর সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, এ বার্তা সম্পর্কে প্রেসিডেন্টের মতামতের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। আমি ফরমানকে স্পষ্টভাবে বলি, রাওয়ালপিন্ডির সঙ্গে লিখিত অথবা মৌখিক আলাপ-আলােচনা সম্পর্কে আমাকে অবহিত করতে হবে। আমি প্রেসিডেন্টের অনুমােদন স্বচক্ষে দেখার কথাও উল্লেখ করি। অবশেষে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, আমার দ্বিমত পােষণের কথা উল্লেখ না করে এ বার্তায় লেখা হবে, জেনারেল নিয়াজি আপনার নির্দেশ মেনে নিতে প্রস্তুত।’ তার মানে হচ্ছে, প্রেসিডেন্টের অনুমােদন দানের পরই কেবল আমি এ প্রস্তাবে। সম্মতি দেব। গভর্নরের পক্ষ থেকে প্রেসিডেন্টের কাছে এ বার্তা পাঠানাে হয়। তাতে বলা হয় :  ‘পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের জন্য। আপনার জি ০০০১, ০৯২৩০০ ডিসেম্বর বার্তার জবাব। আমার ওপর চরম ও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব অর্পণ করায়। আমি আপনার অনুমােদনের পর ঢাকাস্থ জাতিসংঘ প্রতিনিধি পল হেরির কাছে নিম্নোক্ত বার্তা হস্তান্তর করতে চাই । বার্তা শুরু। পূর্ব পাকিস্তানের মাটিতে সর্বাত্মক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার ইচ্ছা পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর কখনাে ছিল না। কিন্তু এমন এক পরিস্থিতির উদ্ভব হয় যা সশস্ত্র বাহিনীকে আত্মরক্ষামূলক তৎপরতা চালাতে বাধ্য করে।

পাকিস্তান সরকার বরাবরই রাজনৈতিক উপায়ে পূর্ব পাকিস্তান সংকটের নিষ্পত্তি করতে চেয়েছে। সশস্ত্র বাহিনী চরম প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করেছে এবং এখনাে লড়াই অব্যাহত রাখতে পারে। কিন্তু অধিক রক্তপাত ও নিরীহ মানুষের প্রাণহানি এড়াতে আমি নিম্নোক্ত প্রস্তাব পেশ করছি যেহেতু রাজনৈতিক স্বার্থে এ লড়াই শুরু হয়েছে, তাই এ সংকট অবশ্যই রাজনৈতিক উপায়ে মীমাংসা করতে হবে। আমি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের সম্মতিতে ঢাকায় একটি সরকার গঠনের ব্যবস্থা করতে পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। এ প্রস্তাব রাখার পাশাপাশি আমি আমার কর্তব্যের খাতিরে বলছি যে, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ অবিলম্বে তাদের ভূখণ্ড থেকে ভারতীয় সৈন্যদের প্রত্যাহার কামনা করছে এবং আমি শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের আয়ােজন করতে জাতিসংঘের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি এবং অনুরােধ করছি এক, অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি। দুই, পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীকে সম্মানের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানে প্রত্যাবাসন। তিন, পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে যেতে ইচ্ছুক সব পশ্চিম পাকিস্তানি লােকজনের প্রত্যাবাসন। চার, ১৯৪৭ সাল থেকে পূর্ব পাকিস্তানে বসতি স্থাপনকারী সকল লােকজনের নিরাপত্তা। পাঁচ, পূর্ব পাকিস্তানে কোনাে ব্যক্তির ওপর প্রতিশােধ গ্রহণ না করার নিশ্চয়তা। এ প্রস্তাব পেশ করে আমি এ কথা দ্ব্যর্থহীনকণ্ঠে বলতে চাই যে, শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরে এটা হচ্ছে একটি সুস্পষ্ট প্রস্তাব। সশস্ত্র বাহিনীর আত্মসমর্পণের প্রশ্ন বিবেচনা করা হবে না এবং এ প্রশ্ন উঠতেও পারে না। এ প্রস্তাব গ্রহণ করা না হলে সশস্ত্র বাহিনী শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়াই চালিয়ে যাবে। বার্তা শেষ। জেনারেল নিয়াজির সঙ্গে আলােচনা করা হয়েছে এবং আপনার নির্দেশ মেনে নিতে সম্মতি দিয়েছেন। দ্রুত অনুমােদনের অনুরােধ রইলাে।  ফরমান তার বইয়ের ১৩০ পৃষ্ঠায় উপরােক্ত বার্তা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে দ্রুত অনুমােদনের অনুরােধ রইলাে’ বাক্যটি বাদ দিয়েছেন। এতেই তার দুষ্ট বুদ্ধির পরিচয় পাওয়া যায়। কার্যত তিনি প্রেসিডেন্টের অনুমােদনের জন্য অপেক্ষা করতে চাননি। এ বাক্য এড়িয়ে যাওয়ায় এটা নিঃসন্দেই যে, তিনি আমাকে এবং গভর্নর উভয়কে অমান্য করেছেন। এ বার্তায় দু’বার প্রেসিডেন্টের অনুমােদনের জন্য অনুরােধ করা হয়। প্রথমে বার্তার শুরুতে এবং আবার শেষে। আরাে উল্লেখযােগ্য যে, কবে, কখন ও কোথায় এ বার্তা তৈরি করা হয় ফরমান তাও এড়িয়ে গেছেন। এর কারণ খুবই স্পষ্ট। এ বার্তা টাইপ করা হয় গভর্নর হাউসে এবং সই করেন ফরমান নিজে। ফরমান পাঠক এবং এমনকি হামুদুর রহমান কমিশনকেও বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছেন। বলেছেন যে, সেনাবাহিনীর যােগাযােগের জন্য যে বার্তায় প্রতিস্বাক্ষর দেয়ার প্রয়ােজন ছিল। তার এ যুক্তি ভুল।

আমাদের বার্তা বা সংকেতগুলােতে প্রতিস্বাক্ষর নয়, সই দিতে হয়। প্রতিস্বাক্ষরের রীতি চালু রয়েছে মার্কিন সেনাবাহিনীতে। এছাড়া, ঊর্ধ্বতন বেসামরিক কর্মকর্তাদের নিরাপত্তার স্বার্থে সামরিক বাহিনীর যােগাযােগ নেটওয়ার্ক ব্যবহার করার অনুমতি দেয়া হয়। চিফ সেক্রেটারি তাতে সই করতে পারতেন। ফরমান এও বলেছেন যে, আমার সঙ্গে দেখা করে ফেরার পর পল হেনরি তাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন কেন? মনে হচ্ছে পল হেনরিকে আগেই জানানাে হয়েছিল যে, তার কাছে ফরমান বার্তা নিয়ে আসছেন। এ কথা কেউ বিশ্বাস করবেন না যে, গভর্নর প্রেসিডেন্টের সম্মতির অপেক্ষা না করে সরাসরি পল হেনরির কাছে বার্তা হস্তান্তরের জন্য ফরমানকে বলতে পারেন। কারণ গভর্নর নিজেই বার্তায় লিখেছিলেন, প্রেসিডেন্টের অনুমােদনের পর’ এটা কেমন কথা যে, সেনাবাহিনীর গােপন কোড লংঘন করে প্রেসিডেন্টের অনুমােদন ছাড়া একজন অননুমােদিত ব্যক্তির কাছে একটি অতি গােপনীয় বার্তা হস্তান্তর করা হলাে এবং ওই অননুমােদিত ব্যক্তিটি তৎক্ষণাৎ বার্তাটি জাতিসংঘে পাঠিয়ে দিলেন? এ বার্তা প্রচার করা হলে আমি গভর্নরের কাছে টেলিফোন করি। তিনি তখন বিস্ময় প্রকাশ করেন এবং বলেন, তিনি তখনাে প্রেসিডেন্টের অনুমােদন পাননি। আমি সেনাবাহিনী প্রধানের সঙ্গে যােগাযােগ করার চেষ্টা করি। তবে তাকে পাওয়া যায়নি। প্রেসিডেন্টের সঙ্গে যােগাযােগ করাও ছিল অসম্ভব। প্রেসিডেন্ট জাতিসংঘে প্রেরিত বার্তা বাতিল করে দেন। (আমি প্রেসিডেন্টের বার্তার কোনাে কপি পাইনি) পরে রেডিও সম্প্রচারে ফরমানকে দোষারােপ করা হয় এবং সরকারের তরফ থেকে। বলা হয়, জাতিসংঘে এ বার্তা পাঠানাের ব্যাপারে ফরমানের কোনাে অনুমতি ছিল। কারণ এ জন্য প্রেসিডেন্টের অনুমােদনের প্রয়ােজন ছিল। তখনাে এ অনুমােদন দেয়া হয়নি। অতএব পল হেনরির কাছে প্রেরিত বার্তা অননুমােদিত এবং এটা একটা বিপজ্জনক কাজ। প্রেসিডেন্টের অনুমােদন ছাড়া গভর্নর অথবা আমি কেউই এ বার্তা জাতিসংঘের কাছে হস্তান্তর করতে পারতাম না।

ফরমান কেন প্রেসিডেন্টের সম্মতির জন্য অপেক্ষা করেন নি? এত তাড়াহুড়াের কারণ কি? তিনি তার বইয়ের ১৪৪ পৃষ্ঠায় লিখেছেন :  ‘অন্যান্যদের দোষারােপ করা এবং ক্ষমতায় থাকা ছিল এ পরিকল্পনার লক্ষ্য। যারা নিজেদের রক্ষা করতে পারছিল না তাদের প্রতি জাতির ক্রোধকে ধাবিত করার এটা ছিল একটি নীচ ও নিষ্ঠুর অভিযান। তাদের নিজেদের অপকর্ম ও অশুভ অভিপ্রায় আড়াল করার জন্য এ গােটা নাটক মঞ্চস্থ করা হয়।’ ফরমান তার নিজের কূটচাল ও ষড়যন্ত্রের জালে ধরা পড়ে যাচ্ছিলেন। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত জেনারেল হেড কোয়ার্টার্সের সংকেতগুলাে ছিল অস্পষ্ট এবং তাতে থাকতাে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি যাতে আমাকে দোষারােপ করা যেতে পারে। জাতিসংঘে পাঠানাে বার্তার ফলে পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক অভিযানে মর্মান্তিক পরিণতি ডেকে আনে। অধিকাংশ স্থানে সৈন্যরা পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রাণপণ লড়াই করছিল। কিন্তু জাতিসংঘে এ বার্তা পাঠানাের পর আন্তর্জাতিক প্রচার মাধ্যমে তা প্রচার করা হয়। এতে লড়াইয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। কারণ যুদ্ধবিরতি আসন্ন দেখে সৈন্যরা জীবন দিয়ে লড়াই করার মনােবল হারিয়ে ফেলে। এ বার্তা বাতিল করার পর সৈন্যদের মনােবল ফিরিয়ে আনতে আমাকে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়। মনস্তাত্ত্বিক আঘাত সামলানাে হয়। আমার ডিভিশনাল কমান্ডারদের কাছ থেকে প্রাপ্ত পরিস্থিতির সর্বশেষ রিপাের্ট সম্পর্কে আমি জেনারেল হেড কোয়ার্টার্স ও সেনাবাহিনী প্রধানকে অবহিত করতাম। প্রতিটি রিপাের্টে আমি শেষ বুলেট ও শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়াই করার দৃঢ়সংকল্প প্রকাশ করি।

১০ ডিসেম্বরের পরও জেনারেল হেড কোয়ার্টার্স আমাদেরকে এমন কোনাে ইঙ্গিত দেয়নি যে, ঢাকার পতন ঘটতে যাচ্ছে অথবা আমরা ঢাকার আশপাশে লড়াই চালিয়ে যেতে অসমর্থ। ১৩ ডিসেম্বর ভারতের হেলিকপ্টারবাহিত ছত্রী সৈন্যরা ঢাকার প্রতিরক্ষা লাইনের কাছাকাছি পৌছলেও ঢাকায় হামলা করতে তাদের কমপক্ষে দু’সপ্তাহ সময় নিতে হতাে। কারণ তখনাে তাদের যােগাযােগ লাইন এবং ঢাকা অভিমুখী সরবরাহ পথগুলাে ছিল বিভিন্ন জায়গায় অবরুদ্ধ। শত্রুর এগিয়ে আসার একমাত্র রুট ছিল তুরা-ময়মনসিংহ টাঙ্গাইল তখনাে ঢাকা রক্ষায় সব মিলিয়ে আমার কাছে ৩১ হাজার সৈন্য ছিল। উর্দুভাষী পূর্ব পাকিস্তানি ও অনুগত বাঙালিরাও ছিল সশস্ত্র । সুরক্ষিত এলাকায় লড়াই। করার জন্য সকল প্রস্তুতি ছিল সম্পন্ন। এ আত্মবিশ্বাস থেকে আমি বিদেশি সাংবাদিকদের কাছে এক বিবৃতিতে বলেছিলাম, ‘ঢাকা দখল করতে হলে ভারতীয় ট্যাংককে আমার বুকের ওপর দিয়ে যেতে হবে।’ একই আত্মবিশ্বাস থেকে আমি ১৩ ডিসেম্বর বিকেল সাড়ে তিনটায় জি-১২৮২ নং বার্তায় জেনারেল হেড কোয়ার্টার্সকে আশ্বাস দিয়েছিলাম, ঢাকা প্রতিরক্ষা দুর্গ পুরােপুরি সুসংগঠিত এবং যুদ্ধ চালিয়ে যেতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।’ ১৩ ডিসেম্বর রাত ১০টায় জি-১২৮৬ নং বার্তায় আরাে বলেছিলাম, চূড়ান্ত লড়াইয়ের জন্য সুরক্ষিত এলাকায় এগিয়ে যাচ্ছি।’ তবে এ কথা সত্য যে, ঢাকায় আসন্ন লড়াইয়ের মুখে অফিসারদের মধ্যে কেউ কেউ সামান্য ভীত। হয়ে পড়েছিলেন। ১২ ডিসেম্বর চিফ অব জেনারেল স্টাফ গুল হাসান আমাকে টেলিফোন করে পশতু ভাষায় বলেন, উত্তর দিক থেকে পীত এবং দক্ষিণ দিক থেকে শ্বেতাঙ্গরা। এগিয়ে আসছে (সম্ভাব্য চীন ও মার্কিন সহায়তাকে বুঝাতে তিনি প্রতীকী ভাষা ব্যবহার করেন)। সিজিএস আমাকে কেন ধােকা দিলেন আমি তা বুঝতে পারিনি। তবে মনে হচ্ছিল বিপর্যয়ের জন্য আমাকে দোষারােপ করার পরিকল্পনা থেকেই। এরূপ ধােকা দেয়া হয়।

১১ ডিসেম্বর বেসামরিক কর্মকর্তাগণ গভর্নর হাউসে ওঠেন। তারা বেসামরিক প্রশাসনকে অক্ষুন্ন রাখার জন্য বিরাট ভূমিকা পালন করেন। প্রচণ্ড প্রতিকূলতা ও বৈরি পরিস্থিতিতে তারা দ্বিরুক্তি না করে তাদের কর্মস্থলে কাজ চালিয়ে গেছেন। তারা তাদের জীবনের ওপর বিরাট ঝুঁকি নিয়েছেন এবং দৃঢ়তার সঙ্গে সকল কষ্ট বরণ করেছেন। ১৩ ডিসেম্বর ভাের সাড়ে ৭টায় ফরমান রেডক্রস ও জাতিসংঘ ত্রাণ কমিশনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তিনি তার বইয়ে পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করেছেন যে, তিনি হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালকে একটি আন্তর্জাতিক অঞ্চল হিসেবে ঘােষণা করার জন্য। রেডক্রসকে অনুরােধ করেন এবং এ ব্যাপারে প্রাসঙ্গিক কাগজপত্রে স্বাক্ষর করেন। তিনি গভর্নর এবং আমার উভয়ের অনুমােদন ছাড়াই এ কাজ করেছিলেন। তিনি তার কাজকর্ম সম্পর্কে আমাকে অবহিত করার প্রয়ােজনবােধ করেননি। তিনি এমনভাবে কাজ করছিলেন যেন তিনি গভর্নর এবং ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার দুটিই। আমাদের বেসামরিক কর্মকর্তাগণ হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ওঠেন। ঢাকায় কার্ফ জারি করা হয়। ফরমান আরেকটি মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে বলেছেন যে, আমি নাকি গভর্নর হাউস। থেকে যুদ্ধবিরতির একটি বার্তা পাঠাতে চেয়েছি। আমি নাকি আমার সৈন্যদের তা জানাতে চাইনি। ফরমান একটি স্ববিরােধী কথা বলেছেন। তিনি ভালাে করেই। জানতেন যে, এ ধরনের একটি বার্তা গভর্নর হাউসে না গিয়ে সেনাবাহিনীর কমিউনিকেশন নেটওয়ার্কের মাধ্যমেই পাঠানাে যেত এবং কোনাে না কোনােভাবে সৈন্যরা তা জানতাে। প্রকৃতপক্ষে, আমার বার্তায় শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ করার কৃতসংকল্পই ব্যক্ত করেছি। ১৩ ডিসেম্বর ভােরে ভারতীয় বিমান বাহিনী গভর্নর হাউসে বােমাবর্ষণ করে। সাড়ে ১২টার দিকে গভর্নর আমাকে জানান যে, প্রেসিডেন্ট তার কথায় কর্ণপাত না । করায় তিনি পদত্যাগ করছেন। তখন এ কথা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, যুদ্ধের অবসান ঘটানাের জন্য গভর্নর প্রেসিডেন্টের ওপর প্রবল চাপ দিচ্ছেন। অতঃপর আমি ১৩, ১৫, ৩০ ডিসেম্বর জি-১২৮২ নং বার্তায় ঢাকা রক্ষায় যুদ্ধ চালিয়ে যাবার অঙ্গীকার ব্যক্ত করি। এতে আমি বলেছি : ‘আলফা। মাতুয়াইলে শত্রু অবস্থান সুদৃঢ় করছে এবং হেলিকপ্টার যােগে সৈন্য পরিবহন অব্যাহত রয়েছে। শত্রুরা মাতুয়াইল-ডেমরা সড়ক বরাবর অগ্রসর হচ্ছে। ব্র্যাভাে। ছত্রীসেনাদের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহের অপেক্ষায়। চার্লি। দাউদকান্দিতে শক্রর আগমনের খবর পাওয়া গেছে এবং নারায়ণগঞ্জের দক্ষিণেও। দুটি হেলিকপ্টার অবতরণ করেছ। বিস্তারিত জানার অপেক্ষায়।

ডেল্টা  শত্রু ঢাকা দখলের জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করছে। ঢাকা প্রতিরক্ষা দুর্গ সংগঠিত এবং লড়াই। চালিয়ে যেতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।’  পশ্চিম রণাঙ্গনেও পরিকল্পনা অনুযায়ী যুদ্ধ করা হয়নি। সর্বত্রই ছিল অস্বস্তি ও হতাশা। ১৯৬৫ এর চেতনা কোথাও দেখা যায়নি। পশ্চিম রণাঙ্গনে সেনাবাহিনী সাড়ে ৫ হাজার বর্গমাইল ভূখও হারায়। আমার চিফ অব স্টাফ ব্রিগেডিয়ার বাকির সিদ্দিকী সেনাবাহিনী প্রধানের একান্ত সচিব ব্রিগেডিয়ার আমির গুলিস্তান জানজুয়ার সঙ্গে সার্বক্ষণিক যােগাযােগ রক্ষা করছিলেন। চিফ অব জেনারেল স্টাফ থেকে শুরু করে মিলিটারি অপারেশনের অধিদপ্তর পর্যন্ত কারাে কোনাে সন্তোষজনক তৎপরতা অথবা নিকনির্দেশনা ছিল না। মিলিটারি অপারেশনের ডিরেক্টর একবারের জন্যও আমাদের সঙ্গে যােগাযােগ করেননি। এ জন্য আমাদের যােগাযােগ ছিল ব্রিগেডিয়ার। জানজুয়া পর্যন্ত। ব্রিগেডিয়ার জানজুয়া খুবই সহায়ক ছিলেন। শুরুতে তিনি আশাবাদী ছিলেন। কিন্তু পশ্চিম রণাঙ্গনে লড়াইয়ের কয়েকদিন পর তিনি আমার চিফ অব স্টাফকে জানান যে, পশ্চিম রণাঙ্গনে যুদ্ধ ব্যর্থ হয়েছে। সাজোয়া বাহিনীতে শ্রেষ্ঠত্ব এবং পদাতিক বাহিনীতে সমতা থাকা সত্ত্বেও পশ্চিম পাকিস্তান ব্যর্থ হয়। এ ব্যর্থতা অপ্রত্যাশিত এবং সামরিক দিক থেকে ক্ষমার অযােগ্য। আমার বার্তা পাঠানাের কয়েক ঘণ্টার পর ১৯৭১-এর ১৩/১৪ ডিসেম্বরের। মধ্যবর্তী রাতে ব্রিগেডিয়ার জানজুয়া আমার চিফ অব স্টাফের কাছে টেলিফোন করেন এবং তাকে সতর্ক করে দেন যে, একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা পাঠানাে হচ্ছে। মধ্যরাতে এ বার্তা এসে পৌঁছে। এতে বলা হয়।  ‘প্রেসিডেন্টের পক্ষ থেকে গভর্নর ও জেনারেল নিয়াজির জন্য। গভর্নরের বার্তার জবাবে । বিরাট প্রতিকূলতার মুখে আপনারা বীরত্বপূর্ণ লড়াই করেছেন। আপনাদের জন্য জাতি গর্বিত এবং গােটা বিশ্ব আপনাদের অকুণ্ঠ প্রশংসা করছে। এ সমস্যার একটি গ্রহণযােগ্য সমাধান খুঁজে বের করতে মানুষের পক্ষে যতটুকু চেষ্টা করা সম্ভব আমি ততটুকু চেষ্টা করেছি। আপনারা বর্তমানে এমন এক পর্যায়ে রয়েছেন যেখান থেকে মানুষের পক্ষে প্রতিরােধ চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব এবং প্রতিরােধ হবে নিস্ফল। এতে শুধু আরাে প্রাণহানি ও সম্পদের ধ্বংসই হবে।

এখন আপনাদেরকে লড়াই বন্ধ এবং সশস্ত্র বাহিনীর সকল সদস্য, পশ্চিম পাকিস্তানি বেসামরিক লােকজন ও সকল অনুগত নাগরিকের জীবন রক্ষায় প্রয়ােজনীয় সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এদিকে, আমি পূর্ব পাকিস্তানে অবিলম্বে লড়াই বন্ধে ভারতকে অনুরােধ জানাতে এবং সশস্ত্র বাহিনী ও অন্যান্য লােকজন যারা দুষ্কৃতকারীদের হামলার লক্ষ্যবস্তু হতে পারে, তাদের নিরাপত্তার গ্যারান্টি প্রদানে জাতিসংঘের দ্বারস্থ হয়েছি।’ ১৩ ডিসেম্বর গর্ভনরের পক্ষ থেকে পাঠানাে জরুরি বার্তা সম্পর্কে আমি ছিলাম অনবহিত। গভর্নর অথবা ফরমান কেউই আমাকে এ ব্যাপারে জানায়নি। মনে হয় এ বার্তায় প্রেসিডেন্টকে পরিস্থিতি সম্পর্কে একটি ভয়ংকর ধারণা দেয়া হয়। প্রেসিডেন্টের বার্তায় তাই প্রমাণিত হয়েছে। এ ধরনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা আনক্লাসিফাইড বার্তা হিসেবে পাঠানাের জন্য আমি বিস্মিত হই। এটা কি ষড়যন্ত্রের কোনাে অংশ ছিল? আমার ধারণা, এ বার্তা ভারতীয়দের হাতেও পড়েছে।  আমাদের প্রথম ধারণা হয় যে, এটি একটি ভারতীয় চক্রান্ত। সুতরাং আমি এর সত্যতা এবং এর প্রভাব সম্পর্কে নিশ্চিত হতে চাই। প্রথম কারণ হচ্ছে, আমি একটি আলাদা দেশে একটি স্বতন্ত্র সেনাবাহিনীর কমান্ডার হিসেবে একটি বিচ্ছিন্ন লড়াই করছিলাম না। সুতরাং আমি ভারতের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি ও যুদ্ধবিরতির শর্তাবলী সম্পর্কে জেনারেল হেড কোয়ার্টার্সের সার্বিক পরিকল্পনা জানতে চাই। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, আমাকে আমার স্বতন্ত্র যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলােচনা করতে হলে তা একটি শক্তিশালী অবস্থান থেকে সম্ভব নয়। তা হবে আত্মসমর্পণের শামিল।

এরপর আমার চিফ অব স্টাফ ব্রিগেডিয়ার বাকির ব্রিগেডিয়ার জানজুয়ার সঙ্গে যােগাযােগ করেন। ব্রিগেডিয়ার জানজুয়া জানান যে, গভর্নরের বার্তাটি আনক্লাসিফাইড অবস্থায় পাঠানাে হয়। আমরা প্রেসিডেন্টের বার্তার শেষাংশটি পরিষ্কার করে বলার জন্য জেনারেল হেড কোয়ার্টার্সকে অনুরােধ করি এবং টেলিফোনে সিজিএস ও সিওএস (সেনাবাহিনী প্রধান) এর সঙ্গে যােগাযােগ করার  চেষ্টা করি। প্রেসিডেন্টের বার্তা পাওয়ার ৯ ঘণ্টা পর ১৪ ডিসেম্বর দুপুরের দিকে। আমি সিজিএস লে. জেনারেল গুল হাসানের সঙ্গে যােগাযােগ করি এবং তাঁকে প্রেসিডেন্টের নির্দেশ সম্পর্কে অবহিত করি। তিনি আমার কাছে জানতে চান আমি কোন্ বার্তা এবং কিসের যুদ্ধ বিরতির কথা বলছি। আমি তাকে বুঝিয়ে বলার পর তিনি জবাব দেন যে, তিনি এসব কিছুই জানেন না। তিনি তখন আমাকে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলতে পরামর্শ দেন। | সেদিন সকাল সকাল গভর্নর এ এম মালিক প্রেসিডেন্টের নির্দেশ সম্পর্কে টেলিফোনে আমার সঙ্গে কথা বলেন। আমি তাকে জানালাম যে, আমি প্রেসিডেন্টের বার্তা সম্পর্কে জেনারেল হেড কোয়ার্টার্সের কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছি। তিনি আমার কাছে জানতে চান আমি যুদ্ধ বন্ধে রাজি কিনা। জবাবে আমি তাকে জানাই যে, যুদ্ধ চালিয়ে যাবার সকল অভিপ্রায় আমার রয়েছে। সেদিন বিকেলে আমি গভর্নরের পদত্যাগ করার খবর পাই। গভর্নরের পদত্যাগের পর তার সরকারি বাসভবনে বােমাবর্ষণ করা হয়। গভর্নর একই দিন গভর্নর হাউস ত্যাগ করেন। ১৫ ডিসেম্বর তিনি আমাকে নিম্নোক্ত পত্র লেখেন :

প্রিয় নিয়াজি,

আমি জানতে চাই, প্রেসিডেন্ট আপনাকে এবং গভর্নর হিসেবে আমার কাছে ১৪.১২.৭১ তারিখ পাক আর্মি সিগনাল নং ০০১৩-এ যে বার্তা পাঠিয়েছেন সে ব্যাপারে আপনার পক্ষ থেকে কোনাে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে কিনা। এ বার্তায় আপনাকে পরিষ্কারভাবে যুদ্ধ বন্ধ এবং সশস্ত্র বাহিনীর সকল সদস্য, পশ্চিম পাকিস্তানি সকল বেসামরিক লােকজন ও সকল অনুগত বাঙালিদের জীবন রক্ষায় প্রয়ােজনীয় সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ বার্তায় আরাে বলা হয়েছে যে, আপনি এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছেন যেখান থেকে মানুষের পক্ষে কোনাে প্রতিরােধ চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব এবং প্রতিরােধ হবে নিষ্ফল।’ যুদ্ধ চলছে। এবং প্রাণহানি ও বিপর্যয় অব্যাহত রয়েছে। আমি আপনাকে প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরােধ করছি।’

আপনার বিশ্বস্ত,

এ এম মালিক

১৪ ডিসেম্বর সিজিএস-এর সঙ্গে কথা বলার পর আমি ১৫ ডিসেম্বর সকাল ৯টা। ১০ মিনিটে আমার যুদ্ধ চালিয়ে যাবার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে প্রেসিডেন্টের কাছে একটি বার্তা পাঠাই। আমি প্রেসিডেন্ট ও সেনাবাহিনী প্রধানের সঙ্গে যেগাযােগ করার চেষ্টা করি। সন্ধ্যায় সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল হামিদ প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে আমার সঙ্গে যােগাযোেগ করেন। ইতােমধ্যে মালিক সম্ভবত প্রেসিডেন্টের নির্দেশ পালনে আমার অনিচ্ছার কথা তাকে জানিয়েছেন। জেনারেল হামিদের সঙ্গে আলাপ করে আমার এ বিশ্বাস জন্ম নেয়। আমি আমার চিফ অব স্টাফ ব্রিগেডিয়ার বাকিরকে জেনারেল হামিদের বক্তব্য শােনায় এবং তা নােট করতে বলি। জেনারেল হামিদ আমাকে প্রেসিডেন্টের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করতে বলেন। তিনি আমাকে যুদ্ধ বন্ধ এবং ঢাকায় আমার জানাশােনা একজনের সঙ্গে যােগাযােগ করার নির্দেশ দেন। আমি এ নির্দেশ মেনে নিতে অক্ষমতা প্রকাশ করি। আমার অনমনীয় মনােভাব দেখে তিনি তিন/চার বার একই নির্দেশ দেন এবং বলেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানের নিরাপত্তা বিপন্ন, পরিস্থিতি খারাপ এবং আমাকে আত্মসমর্পণ করতে হবে। আমি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলতে চাইলাম। জেনারেল হামিদ আমাকে জানান যে, তিনি বাথরুমে আছেন। প্রকৃতপক্ষে, প্রেসিডেন্ট বাথরুমে ছিলেন না। অতিরিক্ত মাতাল হওয়ায় তিনি বেরিয়ে গিয়েছিলেন। এয়ার মার্শাল রহিম খান আমার সঙ্গে কথা বলেন। তাকেও মাতাল মনে হলাে। রহিম খান আমাকে প্রেসিডেন্টের নির্দেশ মেনে নিতে পীড়াপীড়ি করেন। | একজন সৈনিক হিসেবে আমি নির্দেশ পালনে বিশ্বাস করতাম। সেনাবাহিনী প্রধান ও বিমান বাহিনী প্রধান আমাকে বারবার প্রেসিডেন্টের নির্দেশ মেনে নিতে এবং তদনুযায়ী কাজ করতে চাপ দেন। অগত্যা আত্মসমর্পণে প্রেসিডেন্টের নির্দেশ প্রাপ্তির ১৮ ঘণ্টা পর আমি আমেরিকান কন্সল-জেনারেলের কাছে হাজির হই। জেনারেল ফরমান আমাকে রুশ চ্যানেল ব্যবহার করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু। আমি ভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। নিম্নলিখিত শর্তাবলীর আওতায় একটি যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দিয়ে আমি ভারতীয় সি-ইন-সি’র কাছে একটি বার্তা প্রেরণ করি :

ক) প্রতিপক্ষ বাহিনীর কমান্ডারদের পারস্পরিক সম্মতিতে নির্দিষ্ট এলাকায়  পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর রিপিং -এর ব্যবস্থা।

খ) সকল সামরিক ও আধা সামরিক বাহিনীর নিরাপত্তার নিশ্চয়তা।

গ. ১৯৪৭ সাল থেকে পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসকারী সকল লােকজনের

নিরাপত্তার নিশ্চয়তা।

ঘ) ১৯৭১ সালের মার্চ থেকে প্রশাসনকে সহায়তাদানকারী ব্যক্তিদের

বিরুদ্ধে প্রতিশােধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ থেকে বিরত থাকা। এসব শর্তের অধীনে পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনী ও আধা সামরিক বাহিনী সকল ধরনের সামরিক তৎপরতা থেকে বিরত হবে। এ প্রস্তাবের একটি কপি জেনারেল হেড কোয়ার্টার্সে পাঠানাে হয়। আমি তখনাে আত্মসমর্পণ করার জন্য ফরমেশনগুলােতে নির্দেশ পাঠাইনি। কারণ ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধান আমার শর্তে সম্মত না হলে আমি লড়াই চালিয়ে যেতে প্রস্তুত ছিলাম। ১৯৭১-এর ১৫ ডিসেম্বর রাত সাড়ে ১১টায় আমরা ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মানেকশ’র জবাব পাই । নিচে তার জবাব দেয়া হলাে। তিনি যুদ্ধবিরতি সংক্রান্ত আমার বার্তা প্রাপ্তির কথা স্বীকার করেন। তবে এ কথা জোর দিয়ে বলেন যে, জেনারেল ফরমান আলীর কাছে তিনি ইতিপূর্বে যে দুটি বার্তা পাঠিয়েছেন সেসব বার্তার আলােকেই আমাকে আত্মসমর্পণ করতে হবে। জেনারেল মানেকশ’র সঙ্গে ফরমানের যােগাযােগের কথা আমি জানতাম না। আমি এটাও জানতাম না তিনি কেন, কিভাবে এবং কার নির্দেশে সরাসরি মানেকশ’র সঙ্গে যােগাযােগ করেছিলেন। ভারতের চিফ অভ স্টাফ জেনারেল স্যাম মানেকশ’র পক্ষ থেকে লে. জেনারেল নিয়াজির প্রতি। প্রথমত, আমি নয়াদিল্লীতে মার্কিন দূতাবাসের মাধ্যমে আজ গ্রিনিচ সময় ১৪৩০ ঘণ্টায় বাংলাদেশে যুদ্ধ বিরতিতে আপনার বার্তা পেয়েছি। দ্বিতীয়ত, আমি ইতিপূর্বে প্রেরিত দুটি বার্তায় জেনারেল ফরমানকে জানিয়েছি। যে, বাংলাদেশে আমার কাছে আত্মসমর্পণকারী (ক) আপনার সকল সামরিক ও আধা সামরিক বাহিনীকে নিরাপত্তার গ্যারান্টি এবং (খ) বিদেশি নাগরিক, জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং পশ্চিম পাকিস্তানি বংশােদ্ভূত সকল লােকজনকে পূর্ণ নিরাপত্তা দেয়া হবে। আপনি লড়াই বন্ধ করার ইচ্ছা প্রকাশ করায় আমি আশা করছি আপনি বাংলাদেশে আপনার কমান্ডের আওতায় সকল বাহিনীকে অবিলম্বে লড়াই বন্ধ এবং আমার অগ্রবর্তী বাহিনীর কাছে তাদেরকে আত্মসমর্পণ করার জন্য নির্দেশ জারি করবেন। | তৃতীয়ত, আমি আপনাকে পূর্ণ নিশ্চয়তা দিচ্ছি যে, যারা আত্মসমর্পণ করবে তাদের প্রতি সৈনিক হিসেবে প্রাপ্য মর্যাদা ও সম্মান প্রদর্শন করা হবে এবং আমি জেনেভা কনভেনশন মেনে চলব। এছাড়া, আপনার যেসব আহত সৈনিক রয়েছে। তাদের সুচিকিৎসা করা হবে এবং নিহতদের যথাযােগ্য মর্যাদায় সমাহিত করা হবে। কে কোথা থেকে এসেছে তাতে কিছু যায় আসে না। কারাে নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনাে কারণ নেই। আমার কমান্ডের আওতায় কোনাে বাহিনী কারাে ওপর প্রতিশােধ গ্রহণ করবে না।

চতুর্থত, আপনার কাছ থেকে ইতিবাচক জবাব পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি আপনার বাহিনীর বিরুদ্ধে সব বিমান ও স্থল হামলা থেকে বিরত হতে ইস্টার্ন কমান্তে ভারতীয় ও বাংলাদেশ বাহিনীর কমান্ডার জেনারেল অরােরাকে নির্দেশ দেব। আমার সততার নিদর্শন হিসেবে আমি আজ গ্রিনিচ সময় ১৭০০ ঘণ্টা থেকে ঢাকায় বিমান হামলা বন্ধের নির্দেশ দিয়েছি। পঞ্চমত, আমি আপনাকে আশ্বস্ত করতে চাই যে, আপনার সৈন্যদের অযথা প্রাণহানি ঘটানাের কোনাে অভিপ্রায় আমার নেই। কারণ আমি প্রাণহানিকে ঘৃণা করি। তবে আমি যেসব শর্ত দিয়েছি আপনি তাতে সম্মত না হলে ১৬ ডিসেম্বর ভারতীয় সময় ০৯০০ ঘণ্টায় সর্বশক্তিতে পুনরায় লড়াই শুরু করা ছাড়া আমার আর কোনাে বিকল্প থাকবে না।  ষষ্ঠত, আলােচনা এবং দ্রুত সকল বিষয় চূড়ান্ত করার স্বার্থে আমি আজ ১৫ ডিসেম্বর ভারতীয় সময় ১৭০০ ঘণ্টা থেকে একটি রেডিও যােগাযােগ প্রতিষ্ঠা করেছি। দিনে এ ফ্রিকোয়েন্সি হবে ৬৬০৫ (৬৬০৫) কিলােহার্টজ এবং রাতে ৩২১৬ (৩২১৬) কিলােহার্টজ ও ঢ্যাক (ঢাকা)। আমি আশা করছি আপনি আপনার সিগনালারদের অবিলম্বে মাইক্রোওয়েভ কমিউনিকেশন পুনঃপ্রতিষ্ঠার নির্দেশ দেবেন।’ | আমি জেনারেল মানেকশ’র জবাবের একটি কপি জেনারেল হেড কোয়ার্টার্সে পাঠাই এবং ১৫ ডিসেম্বর সেনাবাহিনী প্রধানের কাছ থেকে একটি সংকেত পাই। এতে আমাকে মানেকশ’র শর্তে আত্মসমর্পণের পরামর্শ দেয়া হয়। ফরমান হচ্ছেন নিঃসন্দেহে একজন বুদ্ধিমান ব্যক্তি যে জন্য তিনি স্যাম মানেকশ’র সঙ্গে তার গােপন বার্তা বিনিময়ের ঘটনা সম্পর্কে লােকজনকে প্রতারিত ও বিভ্রান্ত করতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি তার বইয়ে লিখেছেন যে, বিবিসির খবরে বলা হয় যে, আমি নাকি পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করেছি এবং তিনি (ফরমান) দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন। ভারতীয়রা জানতাে যে, আমি ঢাকায় অবস্থান করছি এবং কমান্ডেও রয়েছি। গভর্নর পদত্যাগ করা নাগাদ আমি নিয়মিত তার দপ্তরে গিয়েছি।

ক্যান্টনমেন্ট থেকে গভর্নর হাউসে আসা-যাওয়ার রুট হচ্ছে শহরের কেন্দ্রস্থল। বরাবর। আমি প্রতিদিন এ রুটে আসা-যাওয়া করেছি। প্রত্যেকে আমাকে দেখেছে। এছাড়া, আমি ঢাকার আশপাশের ইউনিটগুলাে পরিদর্শন করেছি এবং অধিকাংশ সময় ৬ এলএএ রেজিমেন্টে কাটিয়েছি। এ রেজিমেন্ট রেকর্ডসংখ্যক শত্রু বিমান ভূপাতিত করেছে। আমি বেশ কয়েকটি সাংবাদিক সম্মেলন করেছি। ১৩ ডিসেম্বর। হােটেল ইন্টারকন্টিন্টোলে বিদেশি সাংবাদিকদের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেছি যে, ভারতীয় ট্যাংককে ঢাকায় আসতে হলে আমার বুকের ওপর দিয়ে আসতে হবে।’ ১৪ ডিসেম্বর আমি হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে গিয়ে বেসামরিক অফিসারদের ক্যান্টনমেন্টে শিফট করানাের চেষ্টা করি। ফরমান তার বইয়ে বহু ঘটনার উল্লেখ করেছেন। তবে তিনি এখনাে মনে করেন যে, ভারতীয়রা বিবিসির ভুয়া খবর বিশ্বাস করার মতাে বােকা। ফরমান জানতেন যে, আমি ঢাকায় অবস্থান করছি। সুতরাং আমার কাছে মানেকশ’র বার্তা পৌঁছানাে তার উচিত ছিল। এ ব্যাপারে তার গােপনীয়তা গুরুতর সন্দেহের উদ্রেক করে। 

ভারতীয়রা একটি ব্যাপক মনস্তাত্ত্বিক লড়াই শুরু করেছিল। ৫ ডিসেম্বর থেকে তারা অল-ইন্ডিয়া রেডিও, বিবিসি, প্রচারপত্র ও স্থানীয় লােকজনের মাধ্যমে গুজব রটনা করছিল। জেনারেল মানেকশর বার্তা সকল সৈন্য, অফিসার ও কমান্ডারদের। মধ্যে ছড়ানাে হয় এবং তাদেরকে ব্যক্তিগত নিরাপত্তার আশ্বাস দেয়া হয়। সকল এলাকায় ইউনিটগুলােতে লিফলেট নিক্ষেপ করা হয়।

ফরমান তার বইয়ের ১৪৩ পৃষ্ঠায় লিখেছেন :

১১ ডিসেম্বর সকালে সােভিয়েত কন্সাল জেনারেল মি. পােপাস আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেন। তিনি বলেন, গভর্নরের বার্তায় যে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে তার সরকারের কাছে তা গ্রহণযােগ্য।’ পরবর্তী অনুচ্ছেদে তিনি লিখেছেন যে, ১১ ডিসেম্বর সকাল ৯টায় জেনারেল পীরজাদা তাকে টেলিফোন করেন এবং বলেন যে, সামান্য রদবদল করে গভর্নরের প্রস্তাব অনুমােদন করা হয়েছে এবং সংশােধিত খসড়া তার কাছে পাঠানাে হচ্ছে। এ খসড়া তার কাছে এসে পৌঁছলে তিনি দেখতে পান যে, রাজনৈতিক সমাধান সম্বলিত অনুচ্ছেদটি কেটে দেয়া হয়েছে। এতে আরাে প্রমাণিত হয় যে, তিনি প্রেসিডেন্টের সম্মতি প্রদানের অপেক্ষা না করে গভর্নরের বার্তা জাতিসংঘ প্রতিনিধি ও রুশদের। কাছে দিয়েছিলেন।  এটা সুবিদিত ছিল যে, রুশরা খােলাখুলিভাবে ভারতীয়দের তথ্য সরবরাহ করছিল এবং তাদের কাছে সর্বাধুনিক বােমাও সরবরাহ করছিল। রাশিয়ার সরবরাহকৃত বােমার সাহায্যে আমাদের বিমান ঘাঁটির অপূরণীয় ক্ষতি করা হয়। এছাড়া, রুশ পাইলটরা ভারতীয়দের সঙ্গে বিমান হামলায় অংশ নিচ্ছিল এবং রুশ বিশেষজ্ঞরা ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে কাজ করছিল। স্বয়ং রুশ উপমন্ত্রী ভারতের অপারেশন রুমে নিয়ােজিত ছিলেন। ভারতের প্রতি এত মমত্ব সত্ত্বেও ফরমানের সঙ্গে ছিল রুশদের উষ্ণ সম্পর্ক। সােভিয়েত কন্সল-জেনারেল মি. পােপাসের সঙ্গে তার আলােচনা সম্পর্কে ফরমান লিখেছেন : এরপর তিনি বললেন আমি কি আপনাকে একটি ব্যক্তিগত পরামর্শ দিতে পারি? মুক্তিবাহিনী আপনাকে হত্যা করতে যাচ্ছে। আমি আপনার জন্য একটি বিশেষ কক্ষ তৈরি করেছি। আসুন এবং সেখানে থাকুন। আমরা আপনাকে নিরাপদে ঢাকার বাইরে নিয়ে যাব।’ এ সময় আমি পাকিস্তানকে অখণ্ড রাখার লক্ষ্যে মি, মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দানের পরামর্শ দিয়ে প্রেসিডেন্টের কাছে আরেকটি বার্তা পাঠাই। আমার চিফ অভ স্টাফ ব্রিগেডয়ার বাকির সিদ্দিকী জেনারেল পীরজাদার সঙ্গে যােগাযােগ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু তাকে পাওয়া যায়নি। ব্রিগেডিয়ার ইজাজ আজিম তাকে অনানুষ্ঠানিকভাবে জানান যে, প্রেসিডেন্ট ঐ বার্তায় এনএফএ (ননা ফার্দার এ্যাকশন) লিখেছেন।

ভারত থেকে ফিরে আসার পর রিপাের্ট তৈরি এবং হামুদুর রহমান কমিশনের কাছে সাক্ষ্য দানের জন্য এ বার্তা এবং গভর্নর ও আমি অন্যান্য যেসব গুরুত্বপূর্ণ বার্তা পাঠিয়েছিলাম সেগুলাে সরবরাহ করার জন্য আবেদন করি। তখন আমাকে জানানাে। হয় যে, এগুলাে জুলফিকার আলী ভুট্টোর কাছে রয়েছে এবং তার কাছে আমাকে নিজে এগুলাে চাইতে হবে। এসব বার্তা আমাকে কখনাে দেয়া হয়নি।  ১৫/১৬ ডিসেম্বরের মধ্যবর্তী রাতে আমি আমাদের হেলিকপ্টারগুলােকে বার্মা চলে যাবার নির্দেশ দেই। জেনারেল রহিম খানকে হেলিকপ্টারে করে বার্মা নিয়ে যাবার ব্যাপারে কয়েকজন স্বার্থপর ব্যক্তি বিতর্ক তােলেন। জেনারেল রহিম চতুর্দশ ডিভিশনের জিওসি হিসেবে বিদ্রোহী তৎপরতা চলাকালে খুবই প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেছেন। তাকে হিলাল-ই-জুরাত পদকে ভূষিত করা হয়। ভারতের সঙ্গে যুদ্ধের সময় তিনি চাঁদপুরে একটি এডহক ডিভিশনের নেতৃত্ব দেন। শত্রুরা নিকটবর্তী প্রতিরক্ষা ব্যুহ ভেঙে এগিয়ে এলে এবং তার সদর দপ্তরের প্রতি হুমকি সৃষ্টি করলে তাকে ঢাকার প্রতিরক্ষার প্রয়ােজনে তার নির্দিষ্ট অবস্থানে পিছু হটার নির্দেশ দেয়া হয়। চাঁদপুর থেকে পিছু হটার সময় তার কয়েকটি ফেরি চরে আটকে যায়। ফলে তার পশ্চাদপসরণ বিলম্বিত হয়। নারায়ণগঞ্জের দিকে পিছু হটার সময় তাদের ওপর ভারতীয় বিমান হামলা হয়। জেনারেল রহিমের হেড কোয়ার্টার্স সম্বলিত নৌযান নিমজ্জিত হয়। এ ঘটনায় আমাদেরকে প্রচুর সৈন্য ও অফিসার হারাতে হয়। মেজর জেনারেল রহিম নিজেও আহত হন। তাকে ঢাকায় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে আনা হয়। জেনারেল হেড কোয়ার্টার্সে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র পৌঁছানাের জন্য আমার ব্যক্তিগত নির্দেশে তিনি হাসপাতাল থেকে ছাড়া। পান। জেনারেল রহিমকে যেসব কাগজপত্র দিয়ে পাঠানাে হয়েছিল সেগুলাে পরে ভুট্টোর হস্তগত হয়। কিন্তু এসব কাগজপত্র আর কখনাে পাওয়া যায়নি। | নার্সদের জন্য পৃথক হেলিকপ্টারের ব্যবস্থা করা হয়। অন্ধকারে নার্সরা বুল হেলিপ্যাডে পৌঁছে। তারা নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছতে পারেনি। তাদের আসন শূন্য থাকে এবং হেলিকপ্টারগুলাে তাদেরকে পেছনে রেখেই বার্মা চলে যায়।

মেজর জেনারেল ফরমান বার বার বলছিলেন যে, ১৫/১৬ ডিসেম্বরের মধ্যবর্তী রাতে তাকে বার্মায় অথবা পশ্চিম পাকিস্তানে সরিয়ে নেয়া উচিত ছিল। কারণ বাঙালি ও বুদ্ধিজীবীদের কথিত হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার জন্য মুক্তিবাহিনী তাকে হত্যা করবে। তার মুখ মলিন হয়ে গিয়েছিল এবং তার স্ট্রোক করার মতাে অবস্থা হয়েছিল। আমি তাকে কসম খেয়ে কথা দিই যে, আমার নিজের জীবনের বিনিময়ে হলেও মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয়দের হাত থেকে তাকে রক্ষা করবাে। ভারতীয় ও মুক্তিবাহিনীর উপর্যপরি দাবি সত্ত্বেও আমি কাউকে ফরমানের গায়ে আঁচড় কাটতে দেইনি। আশা করি তিনি এ কথা স্বীকার করবেন।

পরিস্থিতির দিকে তাকালে দেখা যাবে যে, যুদ্ধের শেষদিকে নিম্নোক্ত এলাকাগুলাে ছিল তখনাে আমার নিয়ন্ত্রেণে। এগুলাে হচ্ছে : |ক)

(১) দিনাজপুর-রংপুর, সৈয়দপুর, বগুড়া, নাটোর, রাজশাহী, পাবনা, বেড়া এবং অধিকাংশ ফেরিঘাট।

(২) চালনা, খুলনা ও ফরিদপুর এলাকা।

(৩) ভৈরব বাজার, সিলেট ও ময়নামতি (কুমিল্লা)।

(৪) চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, টেকনাফ, নােয়াখালী। খ) মির্জাপুর, নরসিংদী ও মানিকগঞ্জভিত্তিক ঢাকা ত্রিভুজ। গ) সাভার-মিরপুর, টঙ্গী, দেওড়া ও নারায়ণগঞ্জ। ঘ) ক্যান্টনমেন্ট ও শহরের সুরক্ষিত এলাকা।

আমি কখনাে কোনাে সময় আত্মসমর্পণ করার ইচ্ছা, ইঙ্গিত অথবা আহ্বান জানাইনি। আমার গুরুত্বপূর্ণ বার্তাগুলাে শেষ রক্তবিন্দু ও শেষ বুলেট দিয়ে লড়াই অব্যাহত রাখবাে- এ কথা উল্লেখ করে শেষ করা হতাে। গভর্নমেন্ট কোয়ার্টার্সে ইস্টার্ন কমান্ডের সদরদপ্তর প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েও এ কথা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, আমি লড়াই চালিয়ে যেতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলাম। সেনাবাহিনী প্রধানের কাছে প্রেরিত প্রতিটি বার্তায় আমি যুদ্ধ চালিয়ে যাবার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছি। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তান রক্ষায় সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আবদুল হামিদ ও জেনারেল হেড কোয়ার্টার্সের নির্দেশে আমাকে আত্মসমর্পণ করতে হয়। | হেনরি কিসিঞ্জার বলেছেন, পূর্ব পাকিস্তান রক্ষার কোনাে প্রশ্নই ছিল না। প্রেসিডেন্ট নিক্সন ও আমি উভয়ে কয়েকমাস ধরে উপলব্ধি করেছি যে, পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা অনিবার্য।’ তিনি আরাে বলেছেন, পূর্ব পাকিস্তানে ভারতীয় দখলদারিত্বকে আমরা একটি অনিবার্য ঘটনা হিসেবে মেনে নিয়েছি। আমাদের লক্ষ্য ছিল পশ্চিম পাকিস্তানকে হামলা থেকে রক্ষা করা।’ ভারতীয়রা পশ্চিম রণাঙ্গনে শকরগড় দখল করে নেয়। তারা গুজরানওয়ালা-ওয়াজিরাবাদের দিকে এগিয়ে যেতে প্রস্তুত হয়। ভারতীয়রা মারালা হেড ওয়ার্কস থেকে মাত্র কয়েক মাইল দূরে ছিল এবং পাকিস্তানের অর্থনীতি ও অবকাঠামাে ধ্বংসে উদ্যত হয়। আমি এসব ঘটনা জেনে তৎক্ষণাৎ নির্দেশ মেনে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিই এবং আত্মসমর্পণের গ্লানি বরণ করি । আমার আত্মসমর্পণে সকল পক্ষ-মুজিব, ভুট্টো, ভারতীয়, আমেরিকান ও রুশরা সন্তুষ্ট হয়। মতিউর রহমান ও ওয়াসিম হাসান ‘আয়রন বার অভ ফ্রিডম’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘বেশ কয়েকটি বন্ধুদেশ ভারতকে তার সম্প্রসারণবাদী আগ্রাসনে সহায়তা দিয়েছে। এসব দেশের মধ্যে সর্বাগ্রে রয়েছে সােভিয়েত ইউনিয়ন। এরপর হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। ছােট ছােট দেশগুলাের মধ্যে রয়েছে ইসরাইল ও আফগানিস্তান। এসব দেশ সম্মিলিতভাবে পাকিস্তান ভাঙার ষড়যন্ত্র করেছে।’ ফরাসি লেখক বি এইচ লেভি।

যথার্থই বলেছেন, ‘ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করা হয়। চক্রান্ত আঁটা হয়। পাকিস্তানকে মরতেই হবে। কারণ বৃহৎ শক্তিগুলাে পাকিস্তানকে সর্বসম্মতিক্রমে বধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’ ড, সফদর মাহমুদ লেভির উদ্ধৃতি দিয়ে তার বইয়ে লিখেছেন, ‘ভারত, রাশিয়া ও আমেরিকার মধ্যে পাকিস্তান ভাঙার পরিকল্পনা হয়।’ সংশ্লিষ্ট দেশের জনগণের সহযােগিতা ছাড়া বহিঃশক্তি একটি দেশ ভেঙে দিতে পারে না। বিভিন্ন ষড়যন্ত্রে পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। তবে চূড়ান্ত বিশ্লেষণে ইয়াহিয়ার ক্ষমতা আঁকড়ে রাখার অভিপ্রায়, ভুট্টোর বিশ্বাসঘাতকতা এবং ক্ষমতার অন্বেষণে মুজিবের সন্দেহজনক কর্মকাণ্ডই হচ্ছে এ বিচ্ছিন্নতার জন্য দায়ী।

ক্ষমতা দখলের রাজনীতিতে ইস্টার্ন গ্যারিসনকে একটি দাবার ঘুটি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আমাকে বানানাে হয় কুরবানীর ভেড়া। পূর্ব পাকিস্তানে আমার অবস্থার সঙ্গে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের প্যাসিফিক কমান্ডের তুলনা করা যেতে পারে। হিরােশিমা ও নাগাসাকিতে যুক্তরাষ্ট্র আণবিক বােমা নিক্ষেপ করলে জাপানকে রক্ষায় নৌ ও বিমান সহায়তা থাকা সত্ত্বেও ৫৮ ডিভিশন সৈন্য নিয়ে বিনা শর্তে জাপানি প্যাসিফিক কমান্ড আত্মসমর্পণ করে। ঢাকার সর্বশেষ কমিশনার সৈয়দ আলমগীর রাজা তার ঢাকা ডিবাল’ নামে বইয়ে লিখেছেন, তিনি শেষ দিন পর্যন্ত লড়াই করতে চেয়েছিলেন।’ জনাব রাজা “তিনি বলতে আমাকে, জেনারেল নিয়াজিকে বুঝাতে চেয়েছেন।

নােট

১. পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টকে মদ্যপ বলায় আমি ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে রুশ কাল-জেনারেল মি. পােপাসকে এক দ্বন্দ্ব যুদ্ধে আহ্বান করেছিলাম। অধিকাংশ কূটনীতিক তাদের আসন ছেড়ে আমার পেছনে এসে দাঁড়ান। এমন সময় কে একজন বললেন, ‘খুব হয়েছে জেনারেল, এখন ব্যাপারটি ভুলে যান। সব মীমাংসা হয়ে গেছে। আমার মনে হয় আমাকে এ কথা বলে শান্ত করেছিলেন মার্কিন কাল-জেনারেল। আমাদের প্রতি রুশদের বিদ্বেষপূর্ণ মনােভাব তুলে ধরার জন্যই আমি এ ঘটনার উল্লেখ করছি। কিন্তু আশ্চর্য, এই রুশরা ছিল ফরমানের বন্ধু। 

সূত্র : দ্য বিট্রেয়াল অভ ইস্ট পাকিস্তান – লে. জে. এ. এ. কে. নিয়াজি (অনুবাদ)

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!